| 28 মার্চ 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: গল্প: প্রিয় উদয়ভানু  অমর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

বইয়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। বই থাকবে না হয় মানুষ থাকবে। বিমল সরকারের অবস্থা হয়েছে এই।  বিমলের মেয়ের বিয়ে হয়েছে সদ্য। আর এক মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, তার বিয়ে দিতে হবে বছর তিনের মধ্যে। বিমলের সাতকেলের পুরোন ভাড়াটে ফ্ল্যাটের কোনো ছিরিছাদ নেই এমনিতে, তিনটি ঘর বড় বড়, সরু প্যাসেজ, কিচেন বা রান্না ঘর আর একটা স্টোর রুম বা ভাঁড়ার ঘর, কলতলা,  স্নানঘর ও টয়লেট আলাদা আলাদা। এই ফ্ল্যাট বিমলের বাবা ১৯৫৭ সালে ভাড়া নিয়েছিলেন, তারপর ভাড়া বেড়ে বেড়ে হয়েছে সাড়ে পাঁচশো। বাড়ি ভাড়ার চারগুন ইলেকট্রিক বিল।

কাছেই টালার জলাধার থাকায় ২৪ ঘন্টা জল। জায়গাটা খুব শান্ত। এখানে কলকাতার আর সব জায়গার মতো পুরোন বাড়ি  ভেঙে বহুতল উঠতে আরম্ভ করেছে সবে। কিন্তু একটি দুটি। সাবেক কলকাতার পুরসভায় এই জায়গা ছিল না, প্রবেশ করেছিল  ১৯২৫-এ।  সাবেক কলকাতা ছিল চিৎপুর খালের ওপার পর্যন্ত। এই সব বিমল শুনত তার বাড়িওয়ালা সত্যেন লাহার মুখে। তাঁরা কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের কাছ থেকে সস্তায় জমি কিনে ১৯৪৬ নাগাদ এই দুটি বাড়ি করেন। একটি তাঁদের থাকার, অন্যটি ভাড়া দেওয়ার জন্য আটটি ফ্ল্যাটে চারতলা। তখন ভারত ভাগ হচ্ছে। পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ।  পূর্ব বাংলা থেকে মানুষ আসতে আরম্ভ করেছে ধীরে ধীরে। কলকাতায় ভাড়াটে বাড়ির চাহিদা বাড়ছে। বিশ্বযুদ্ধ তো শেষ। যারা জাপানি বোমার ভয়ে এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে।

      চোদ্দ ফুট উচু উচু সিলিং,  চোদ্দ ইঞ্চি মোটা দেওয়াল, সেগুন কাঠের দরজা, বড় বড় জানালা, খড়খড়িওয়ালা পাল্লা, এই বাড়ি খুব পোক্ত। আর বিমল সরকারের ফ্ল্যাটের পেছনে তিরিশ ফুট অবধি খোলা, তারপর প্রাচীর তারপর দক্ষিণ খোলা জৈন মন্দির। দোতলার বিমলের মনে কী বিমল আনন্দ। কী হাওয়া এই গ্রীষ্মের দিনে। বঙ্গোপসাগর হাওয়া পাঠিয়েই যায়। বিমল তো থাকে দোতলায়। তার ঘর থেকে জৈন মন্দির দেখা যায়।  মন্দিরের ঘন্টা শোনা যায়। আর শোনা যায় মন্দির পার হয়ে ট্রাম রাস্তা, চিৎপুর রেল ইয়ারডের সেই কাছিমের পিঠের মতো উচু হয়ে থাকা ব্রিজের আরম্ভের দিক থেকে ভেসে আসা আজান ধ্বনি। ভোর চারটের আজান বিমল শুনতে পায় ঘুমের ঘোরে। শুনতে শুনতেই ঘুমোয় আবার। তার মশারি তখন ফুলে ওঠে শেষরাতের হাওয়ায়। যদি আকাশে চাঁদ থাকে  ঈষৎ পশ্চিম ঘেঁষে, তার আলো এসে পড়ে বিমলের বুকে। বিমল একা শোয়। বয়স পঞ্চান্ন। তার জন্ম  এই ফ্ল্যাটে। বিমল এখন একা শুতে ভালবাসে। এই ঘরে এই সিঙ্গল খাটে তার বাবা কমল সরকার কত দীর্ঘদিন ঘুমিয়েছেন। বাবা বছর পঞ্চাশের পর থেকে এই ঘরে। এই খটেই তাঁর প্রয়াণ। বিমলরা চার ভাই। বাকি তিনজন তিন শহরে। বিমল একা পড়ে আছে এই শহরে। খোলা জানালা দিয়ে গ্রীষ্মের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ চাঁদের আলো দখিনা বাতাস আয়ু বর্দ্ধক, বাবা বেঁচেছিলেন ৮৯ বছর। বিমল জানে যৌবন যখন অস্তাচলে ঢলতে আরম্ভ করে, তখনি আয়ুর কথা ভাবতে হয়। আয়ু যাতে বাড়ে সেই সাধনা করে যেতে হয়। তার মনে হয়, এই ঘর সারারাত ধরে যে অক্সিজেন জোগায় তাকে তা তাকে অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখবে।  একটা বয়সে একা হয়ে যেতে ভাল লাগে। সে ভাল লাগা থেকে সে এখানে। তার এই ঘরে বই আর সে আছে। বিমল সরকার লেখে। সে খারাপ নাম করেনি। কিন্তু তেমন নামও নয় তার যে একডাকে লোকে চিনবে। ১৯-২০র যুবতীরা তার লেখা পড়ে তার কাছে এসে গুনগুন করবে, বিমল এমন লেখেনা বা লিখতে পারে না। সে অমন এক লেখকের সঙ্গে একবার কোন এক সভায় গিয়েছিল কলকাতার বাইরে, বুঝেছিল তার দর কত।  সেই জনপ্রিয় লেখক যখন সভায় তাঁর বক্তৃতার কালে হিসেব দিতে আরম্ভ করলেন তাঁর বই কত বিক্রি হয়, তখন বিমল পড়েছিল বিপদে। সাহিত্যের আলোচনা সভায় তাদের বলার কথা উপন্যাস রচনার কথা। উপন্যাস কী ভাবে দীর্ঘদিন ধরে লেখেন একজন লেখক। সেই কথা বলতে গিয়ে জনপ্রিয় লেখক তাঁর পুস্তক বিক্রয়ের পরিসংখ্যান দিতে বিমল আরম্ভ করেছিল তার বই কোনোটারই এডিশন হয় না বছর চার পাঁচে, এই বচনে। সে খুবই গর্বিত তার সহযাত্রী লেখকের বই এত বিক্রি হয়ে থাকে তা জেনে। বই কারা কেনে তা সে জানে না। আশ্চর্য লাগে তবুও কেউ কেউ কেনেন, দূর থেকে চিঠি লেখেন। এইটিই তার পাওয়া। এতে সে খুশি। তার ধ্যান হলো আর একটি লেখা লিখতে পারা যা আগের লেখাকে অতিক্রম করে যাবে। সে পুরোন লেখাকে মনে রাখে না। পুরোন উপন্যাস বা গল্পকে আর ফিরে দ্যাখে না। বিমলের কথার পর অনেকে এসে তার সঙ্গে আলাপ করেছিল। তার বইয়ের খবর নিয়েছিল। এই সব কতদিন আগের কথা। বিমল পুরোন বইয়ের কথা ভাবে না। নতুন বই নিয়ে তার যত আগ্রহ। কিন্তু কদিন ধরে তার মনে হচ্ছে পুরোন বইয়ের মতো কেউ কেউ তো মনে রাখে। গত পরশু তার কাছে একটি চিঠি এসেছে তার প্রথম বই ‘মহাত্মা গান্ধীর দেশ’ নিয়ে। সেই কতকাল আগে লেখা বইটি। ১৯৭৮-এর বন্যার বছরে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয়। ১১টি গল্পের এক সংকলন। তখন তার ২৫ বছর বয়স।  সে লিখছে বছর পাঁচ। সে পাঁচ বছরে লেখা গল্প থেকে বেছে এগারটি গল্পকে নিয়ে বইটি বের করেছিল। তার এক অগ্রজ বন্ধু সম্পাদক বইটি প্রকাশের সব দায়িত্ব নিয়েছিল। 

    পৃথিবীর সব জায়গার পরিবর্তন হলেও বিমলের এই জায়গার তেমন  পরিবর্তন হয়নি। বিমল আছে বেশ। ভাড়াটে আইনে ৫৬ বছর রয়েছে, আরো ৫৬ বছর রয়ে যাবে। এই নিরাপত্তায় বিমল সরকারের কোথাও যাওয়া হয়নি এই বাড়ি ছেড়ে। এখন একটি কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাটের মালিক হতে যাচ্ছে, যার ভিত অবধি উঠেছে সবে। বিমলের বউ শুভ্রা বলেছে সে এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাবে না। নিউ টাউনে গেলে তার ভয় করবে। ওসব জায়গায় বেড়াতে যাওয়া যায়, শপিং করতে যাওয়া যায় কিন্তু ওখানে বাস করতে গেলে তার ঘুম হবে না। সবসময় মনে হবে বেড়াতে এসেছে বেড়াতে এসেছে।  তার নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে ফিরতে হবে। কথাটা বলেছে তাদের প্রতিবেশি চন্দন সাহার বউ কল্যানী। তারাও কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাট করেছে নিউ-টাউনে। সে বাড়ি অ্যাকশন এরিয়া-১ এ। তাদের গৃহ প্রবেশ হয়ে গেছে। সে মাঝে মাঝে যায়। ফিরে এসে ওই কথা বলে। বিমল সরকারের বউ শুভ্রা সেই কথাই বলে যাচ্ছে এখন থেকে। রাম না হতে রামায়ণ।  সবে ফাউন্ডেশন হচ্ছে লোহা বাঁধাই হয়ে আর সিমেন্ট ঢালাই করে। আগে উঠুক ফ্ল্যাট, তারপর বোঝা যাবে। শুভ্রা আসলে এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। এই পুরোন ফ্ল্যাটে সেই তিরিশ বছর আগে বউ হয়ে এসে, এই ফ্ল্যাটকেই তার নিজের বাড়ি বলে মনে করে। এই জীবনে বিমল সরকার কখানা বই লিখেছে আর প্রায় কিছুই করেনি। বিমলের গাড়ি নেই, বাড়ি নেই, মোটা ব্যাংক ব্যালেন্স নেই। ছিল একটি সরকারী চাকরি। অবসর নিয়ে পেনশন ভোগী আর সুদখোর হয়েছে। সে ইহজীবনে আর একটি কাজ করেছিল, যখন তার ৪৫-৪৬, এক টুকরো জমি কিনেছিল। কোথায়, না কলকাতা থেকে বেশ দূরে রেললাইনের ধারে। স্টেশন থেকে সাত মিনিট, হাসপাতাল, বাজার, শপিং –এর সুবিধা যুক্ত এক নতুন নগরী।  বিমল এখন বলে শ্মশানও ছিল কাছে মনে হয়। সেই জমিতে প্রায়ই যেত বিমল ন্সপরিবারে। ধু ধু মাঠে একটি দুটি বাড়ি হচ্ছে। স্টেশন থেকে অটোয় দশ মিনিট। রাস্তা খুব খারাপ। কয়েকবার গিয়ে ফাঁকা মাঠের হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরে শুভ্রা বলেছিল, হবে না।

    কী হবে না?

    জমি বেচে দাও, ওই জায়গা কস্মিনকালেও ডেভেলপড হবে না।

     আমাদের তো জমি নেই।

     না থাক, থাকতে হবে না, আমি এ জায়গা ছেড়ে যাব না, ওখনে গেলে ভয়েই মরে যাব, আমার দুটো মেয়ে বড় হচ্ছে।

       জমি হুট করে বেচে দিল বিমল তার অফিসের ক্ষীরোদ রায়কে। তিনি নাকি রিটায়ার করে ওখানে বাড়ি করে সেই বাড়িতে দেহ ত্যাগ করেছেন। ক্ষীরোদ রায়ের মৃত্যু সংবাদ তার কাছে এসেছিল বছর চার আগে। ক্ষীরোদ রায় অবসর নিয়েছিলেন বছর দশ। বাড়ি করতে দেড় বছর। মানে লোকটা বছর চার সেই বাড়ি ভোগ করেছিল। সব শুনে শুভ্রা বলেছিল, অলক্ষুণে জায়গা। কী দরকার ছিল ওখেনে বাড়ি করা, কী করে মারা গেল ?

        হার্ট অ্যাটাকে।

         হসপিটালাইজড করতে পেরেছিল?

         না, অত রাতে কোথায় নিয়ে যাবে, গাড়ি কোথায় পাবে, আনতে হলে তো সেই বাইপাশের ধারে বেসরকারী হাসপাতাল, ফতুর করে মরে যেত। ক্ষোভে বলেছিল বিমল।

     শুভ্রা বলেছিল, ভয়েই মরে গেছে, আমরা বুদ্ধির কাজ করেছি।

      বিমলের মনে হয়েছিল সে বুদ্ধির কাজের জন্য ক্ষীরোদ রায় বেঘোরে প্রাণ দিল, সারাজীবন কলকাতা শহরে থেকে শেষ বয়সে নিজের একটা বাড়ি করার বাসনা জেগেছিল ক্ষীরোদের মনে।  আর সেই বাসনা উসকে দিয়েছিল বিমল সরকার। সে তার জমি নিয়ে কত কথা শুনিয়েছিল। অবসর জীবন যাপনের আদর্শ জায়গা।  ক্ষীরোদ রায়ের একটি মেয়ে। সে বিয়ের পর থাকে উলুবেড়ে। উলুবেড়ে থেকে সে ঢোল গোবিন্দপুর পৌঁছনো আর দিল্লি থেকে বাই এয়ার কলকাতা পৌঁছন একই ব্যাপার, বরং পরেরটা অনেক সুবিধের। মেয়ে এসে বাবাকে জীবিত দ্যাখেনি। পরে বিমল শুনেছিল ক্ষীরোদের মেয়ে সব দোষ তার উপর চাপিয়েছিল। বিমল সরকার মশায়ই তার বাবার ভিতরে জমি আর বাড়ির লোভ চাগিয়ে দিয়েছিল। নাহলে হাওড়ার দিকে ফ্ল্যাট দেখা যেত। বাবা বাগান করবে, গাছের এম খাবে এই লোভে চারকাঠা কিনে মরেই গেল।

        বিমলের এক এক সময় মনে হয় ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় সেই গোবিন্দপুর। গিয়ে দেখে আসে তার নিজের কেনা আর বেচা জমিতে কেমন সংসার পাতিয়ে বসেছে ক্ষীরোদের মেয়ে। বাবার মৃত্যুর জন্য বিমল সরকার আঙ্কেলকে দায়ী করেও, এত সব বলেও নাকি বাবার রেখে যাওয়া বাড়ির দখল নিয়েছে  নিজের স্বামী পুত্র নিয়ে । তার হাজব্যান্ড সরকারী চাকুরে, বদলি নিয়ে কাছাকাছি চলে এসেছে।  বিক্রির কথা নাকি বলেছিলেন ক্ষীরোদের বিধবা বউ। তিনি সেই রাতে বুকের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা স্বামীর মৃত্যু দেখেছিলেন অসহায় হয়ে। আশপাশের লোক এসেছিল, কিন্তু গাড়ি কোথায় ? অটো একটা পাওয়া গিয়েছিল বটে, কিন্তু অনেকদূর বাই-পাস হাসপাতাল। আর একটা অটো রিকশায় করে কে নিয়ে যাবে ক্ষীরোদ রায়কে? ক্ষীরোদের বউ কি একা পারবেন?  কে যাবে সঙ্গে? অটো ওয়ালা বলেছিল, ফরশা হোক, সে ট্যাক্সি ডেকে দেবে। এখন ট্যাক্সিওয়ালার মোবাইল বন্ধ। সেই ভোরেই ক্ষীরোদ চলে যান।

    ক্ষীরোদের মেয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনেছে। মাঝরাতের বিপদের জন্য। জায়গাটা খুব ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। বিমল কথাটা তার বউ শুভ্রাকে বলতে, সে বলল, গিয়ে কী হবে, কী করবে গিয়ে, ওখানে কি আবার জমি কিনবে?

                                           দুই

শুভ্রার কথা সত্য। আসলে বিমলের নিজের কোনো ইচ্ছেই হয় না নিজের লেখা পুরোন বই পুরোন লেখা ঘেঁটে দেখতে। অথচ তার বন্ধু লেখকরা কেউ কেউ তা করে থাকেন। সংস্কার করেন দশ বছর আগের লেখার। বইয়ের নতুন এডিশনে তা যুক্ত বা বিযুক্ত করেন। বন্ধু সহকর্মীরা পুরোন অফিসে ঘুরে ঘুরে যান। গল্প করে আসেন। বিমলকে ডাক দেন, এসো বিমল, একবার ঘুরে যাও, দেখাসাক্ষাৎ হোক। বিমলের সব টান সরে গেছে। সে শুভ্রাকে বলে, আমার যেন মনেই পড়ে না, আমি ওখানে চাকরি করতাম, এত বছরের সম্পর্ক যেন ধুয়ে মুছে দিয়ে এসেছি। বিমল সরকার ভুলেই গেছে সে একটি চাকরি করত। তার অনেক সহকর্মী ছিল। তাদের কারোর কারোর সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল।

   সহকর্মীদের কেউ কেউ রি-এমপ্লয়মেন্ট নিয়েছে, আবার কাজে ঢুকেছে। যে পোস্টে কাজ করত সেই পোস্টে না থেকে তার চেয়ে নিচু পোস্টেও ঢুকেছে। সারাজীবন অফিসে কাটিয়েছে, সুতরাং অফিস ছাড়া থাকে কী করে? কিন্তু বিমল সরকারের মনের ভিতরে যেমন আছে গ্রহণের আকুলতা, তেমনি আছে নিঃশব্দ বর্জন। ধীরে ধীরে তার মন থেকে কী করে যে সব পুরাতন সরে যায়। নতুন এসে সেই জায়গাটি অধিকার করে। বিমল তবুও যেতে চেয়েছিল সেই গোবিন্দপুর। মন বলছিল একবার দেখে আসে কেমন বাড়ি করে গেছেন ক্ষীরোদ রায় ?

     শুভ্রা বলল, তুমি তো অনেক সময় পেয়েছ,  মন দিয়ে লেখ।

      হা হা করে বিমল হেসেছে, আগে কি মন দিতাম না।

      না অফিস গিয়ে সারাজীবন কত সময় নষ্ট করেছ বলো।

      বিমল চুপ করে থাকে। জানে না কত হাজার ঘন্টা নষ্ট হয়েছে অফিসে। চাকরি না করলে হত না।  জীবনের আরম্ভে সে লিখে তো পয়সা পায়নি, বরং লিখতে এসে পয়সা খরচ করেছে নিজের পকেট থেকে। তাই চাকরি, আর চাকরির পরে নিশ্চিন্তে লেখা, বিয়ে করা। জীবন অতিবাহিত করা। একেবারে নিরাপদ জীবনে বসে বিমল লিখেছে। যদি সেই গোবিন্দপুরে গিয়ে বাড়ি বানাত তাহলে হয় তো জীবনের নিরাপত্তা কিছুটা বিঘ্নিত হতো। সেই যে ধু ধু মাঠ, মাঠের ভিতর পাথর বসিয়ে বসিয়ে আলাদা করে দেওয়া টুকরো টুকরো জমি, সেই জমির একখন্ড তার। মহা পৃথিবীর এক বিন্দু অংশ তার নিজের। পরে মনে হয়েছে ওই সব আবেগের কোনো মানে নেই।  পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের পৃথিবীর জমির উপর কোনো অধিকার নেই। তার বাবা কাকারা যে দেশভাগের পর এপারে এসে সমস্তজীবন অন্যের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে থেকে গেলেন খোদ কলকাতা শহরে থাকার অভিপ্রায়ে। তাঁদের মনে কি খেদ ছিল কোনো ? আর বাগান করা? বিমলের মনে পড়ে তার ঘরটির জানালায় টবের ভিতরে বাবা গোলাপ রজনী গন্ধা ফোটাতেন। তখন বিমল খুব ছোট। বাবার মনে কি ইচ্ছা ছিল শূন্যে পুকুর কাটা আর মাছ ছাড়া ! তাদের ঘরে ছিল একটি অ্যাকোরিয়াম। তার ভিতরে রঙিন মাছেরা ঘোরা ফেরা করত। সে বসে থাকত অ্যাকোরিয়ামের সামনে হাঁটু মুড়ে। মা বলত। তখন তার বছর তিন। বাবা নাকি বলত, প্রকৃতির একটু চিহ্ন এইসব—টবে ফুল ফোটান, রঙিন মাছ পোষা আর খাঁচার ভিতর বিলিতি পাখি লাভ বার্ড। বিমল বলে, তার তো লেখা আছে, তার আর কিছু চাই না। তার অতো সময় নেই। সারাজীবন ঘুরেছে অনেক।

   এহেন বিমল সরকার একদিন চিঠি পেল মুরশিদাবাদের এক গ্রাম মিঠিপুর থেকে কোনো এক শাওনি চন্দের কাছ থেকে। চিঠির  যুগ তো ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের কত নতুন মাধ্যম হয়েছে। গত দশ পনের বছরে বদলে গেছে যোগাযোগের সকল উপায়। এখন ই-মেল, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারের দিন। এ ব্যতীত মোবাইল ফোন রয়েছে। লুকোনর কোনো উপায় নেই। বিজন বনে গিয়ে লুকোলেও  অপরাধীকে ধরিয়ে দেবে  মোবাইলের টাওয়ার। কিন্তু মিঠিপুরের শাওনি লিখেছে খামে পুরে এক দীর্ঘ চিঠি। আর সেই চিঠির  ভিতরে একটি সবুজ পাতা। চিঠির শেষে রঙের পোঁচ। চিঠিটি এমন,

             প্রিয় লেখক

              প্রিয় উদয়ভানু,

                               আমি শাওনি, আমি এবার এম, এ,তে ভর্তি হয়েছি গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।  আমি তোমার লেখা অনেক পড়েছি। হ্যাঁ, সত্যিই অনেক। তোমার উপন্যাসের চরিত্রের নামে তোমায় সম্বোধন করলাম উদয়ভানু। সেই যে প্রাচীন গৌড়, পাল রাজত্বের শুরু। মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটছে ধীরে ধীরে, দূর প্রাগ জ্যোতিষপুর থেকে আসছে দরিদ্র ভাগ্য অন্বেষী কৃষকপুত্র উদয়ভানু, সেই যে শাল প্রাংশু দেহ, মস্ত বুক, মস্ত উরু, মাথাভরা ঘনচুল, তামাটে বর্ণের পুরুষ, আমি তার মতোই যেন তোমাকে দেখি। আমি চাই কোনো এক পুরুষ সে হোক উদয়ভানুর মতো, আমার প্রিয় লেখক বিমল সরকার যেমন কল্পনা করেছেন, তেমনি পুরুষ সত্য হোক আমার জীবনে……………।

       

        পড়তে পড়তে বিমল সরকার অবাক। সে যা নয়, তেমন ভাবেই তো রচনা করেছে উদয়ভানুকে। সে তো পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, অতি সাধারণ চেহারার এক প্রবীন পুরুষ। এই শাওনি কি দ্যাখেনি  বইয়ে ছাপা তার ছবি ? সে কি তাকে টেলিভিশনে দ্যাখেনি? এই মেয়েটি নিতান্তই অতি কনিষ্ঠা। তার কন্যার চেয়েও ছোট। তা হোক, তার অনুরাগিনী নিশ্চিত। এ পর্যন্ত কেউ তাকে উদয়ভানু নামে ডাকেনি। ভাল লাগল বিমলের। সে যখন, সেই আঠাশ বছর আগে তার উপন্যাস উদয়ভানু লিখতে আরম্ভ করে, তখন এই মেয়ে জন্মায়নি। যখন এই উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তখন এই এই মেয়ে হয়ত মাতৃগর্ভে। এর বয়স কত হতে পারে ? ২২ কি ২৩। তার বেশি কিছুতেই নয়। এই বছরই ভর্তি হয়েছে পোস্ট গ্রাজুয়েট ক্লাসে। তার উপন্যাসের বয়সও ওই। ২৩ বছর। চিঠি পড়তে লাগল বিমল সরকার,

     তুমি ভাবছ, কে এই বেহায়া মেয়ে, এমন কথা কেউ বলতে পারে?  মনের কথা মনেই রাখুক না সে। আর তুমি তো আমার অনেক অনেক বড়। কিন্তু লেখকের কি বয়স হয় প্রিয় উদয়ভানু। তুমি আমার থেকে অনেক বড় কেন না তুমি আমার আগে জন্মেছ। আমি তোমার থেকে অনেক বড় হতাম যদি আমি তোমার অনেক আগে জন্মাতাম। কিন্তু কথা তা নয় প্রিয় উদয়ভানু, আমার এই পত্র সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমি জানি  প্রতিদিন  দূরাভাষে কতজন কত কথা বলে তোমার সঙ্গে। তোমার কাছে মেসেজ যায় কত। মেল যায় ই-মেলে। আমি চিঠি লিখতেই ভালবাসি প্রিয় উদয়ভানু। চিঠি না লিখলে আমার প্রিয় উদয়ভানুর কাছে নিজেকে প্রকাশ করব কীভাবে? শোনো উদয়ভানু, তোমার প্রতিটি বই আমার কাছে আছে। আমার মা কিনতেন, মায়ের খুব প্রিয় লেখক ছিলে তুমি। মা নাকি কোন সে বহুযুগের ওপারে তোমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে স্কটিশ চারচ কলেজে পড়ত। তখন তুমি লিখতে আরম্ভ করেছ সবে। কলেজ ম্যাগাজিনে তোমার গল্প ছাপা হয়নি। মা বলত আর হাসত। সে সব ম্যাগাজিন এডিটর কোথায়, কলার তোলা পাঞ্জাবি আর চারমিনার সিগারেট। তুমিও খুব চারমিনার খেতে, প্যাকেটের পর প্যাকেট। লেখকরা অমন নাকি হয়। তোমার মনে পড়ে প্রিয় উদয়ভানু ? ……………

      অবাক হয় বিমল সরকার। সে কি স্কটিশ চারচ কলেজে পড়ত ?  মনে পড়ে না। হা হা করে হাসতে ইচ্ছে হয় বিমলের। সে পড়ত ঝাড়গ্রাম কলেজে। তার বাবা তখন বদলি হয়ে সেই শালবনে ঢাকা শহরে। শহর নয় যেন, গ্রাম আর শহর মেশান। রেল লাইনের ওপারেই আদিবাসী গ্রাম। কী সুন্দর ছিল সব। মনে পড়ল বিমলের। ভুলেই গিয়েছিল।  ভুলে যাওয়া তার অভ্যাস। কিন্তু স্কটিশ চারচ কলেজে সে পড়তে যাবে ভেবেছিল। সেই যে হেদুয়ার পিছনে শান্ত কলেজটি। সেই কলেজে তার বাবা পড়েছিলেন দেশ ভাগের আগেই ওপার থেকে এসে অগিলবি হোস্টেলে থেকে। তার দাদা পড়েছিলেন। সেই কলেজে বিখ্যাতজনেরা সব পড়তেন বিখ্যাত হওয়ার আগে। কিন্তু তার পড়া হয়নি। ওই সময়েই বাবা বদলি হয়ে ঝাড়গ্রাম। তার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। কিন্তু এই যে শাওনি সে লিখেছে তার মা ১৯৭০-এ ভর্তি হন স্কটিশে, সন ঠিক আছে, বিমল সরকার ১৯৬৯-এ ঝাড়গ্রাম কলেজ। কেমিস্ট্রি অনার্স। শাওনির মা তার এক বছরের জুনিয়র ছিলেন ধরা যাচ্ছে। এই অবধি ঠিক আছে। সে যদি স্কটিশে পড়ত সব মিলে যেত। কিন্তু সে ভর্তি হবে এই ভাবে মনে মনে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল এইচ, এস,-এর রেজাল্টের জন্য। কিন্তু এর ভিতরে বাবার বদলি। এই ফ্ল্যাটে দাদা বউদি থাকল, মাকে নিয়ে বাবা ঝাড়গ্রাম। সে গেল। মা তাকে রেখে যাবে না। কিন্তু সেই সময় কি আর একজন বিমল সরকার প্রবেশ করেছিল স্কটিশে ? তার জায়গায় আর কেউ বিমল, সে গল্প লিখত, তার গল্প প্রত্যাখ্যান করেছিল কলেজ ম্যাগাজিন। আর ঝাড়্গ্রামের শালবনে মন খারাপ করে ঘুরতে ঘুরতে, তার সহপাঠী শান্তনুর চিঠি পেয়ে, স্কটিশ চারচ কলেজ, তার মস্ত সেমিনার হল, লম্বা সিঁড়ির বর্ণনা পড়তে রাগ হতো। সেই সময় সে প্রথম গল্প লেখে। সেই গল্পে ছিল দুঃখবোধ। কিন্তু সে কোথাও তা ছাপতে দেয়নি।          

     ……প্রিয় উদয়ভানু, মা তোমার সব বই কিনত। মা তোমার প্রথম বই মহাত্মা গান্ধীর দেশও পেয়েছিল কলেজ স্ট্রিট ফুটপথে। ঐ বইয়ের কথা মা জানত না। কোনো বিজ্ঞাপন দ্যাখেনি কোথাও। তোমার কবি আর গল্প লেখক বন্ধুরা বের করেছিল, সেই কথা অনেকদিন পরে তুমি লিখেছিলে কোন এক ছোট ম্যাগাজিনে। তোমার লেখা যে ম্যাগাজিনে বেরত আমার মা তা সংগ্রহ করত। মা তোমার গল্পের একটি বিবলিওগ্রাফি করেছিল। কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। মা যে আচমকা চলে গেল লেখক। প্রিয় উদয়ভানু, মাকে আমি কতবার বলেছি চলো যাই একবার, তোমার কলেজের সেই লাজুক, মুখচোরা যুবকটির সঙ্গে দেখা করে আসি। মা যাবে যাবে করেও শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না, মা চলে গেল, কিন্তু একটা কথা সেই দিন দুপুরে আমাকে বলেছিল গল্প করতে করতে…।

     কী কথা ? মা বলেছিল তোমার প্রথম বইয়ে তুমি চমকে দিয়েছিলে। ‘’মহাত্মা গান্ধীর দেশ’’ বইটিতে যে কয়েকটি গল্প ছিল তা ভিতরে যে তেজ ছিল, তা পড়ে মা ভাবতেও পারেনি অমন গল্প সেই লাজুক আর মুখচোরা কেমিস্ট্রি অনার্সের ছেলেটি লিখতে পারে।  তুমি কেমিস্ট্রি পড়তে স্কটিশ চার্চে। তোমাদের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন অপরেশ ভট্টাচার্য। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর। মা বলত হে গম্ভীর হে গম্ভীর। তুমিও হে গম্ভীর। এক বছর ড্রপ দিলে, পড়াশুনো করোনি, শুধু  খাতা ভর্তি করে গল্প লিখেছ। গম্ভীর হয়ে থাকো। কেমিস্ট্রির পরিবর্তে সাহিত্য পাঠ করো। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যাইয়ের মৃত্যু নিয়ে একটি লেখা লিখেছ। সমস্তদিন তাঁর বাড়ির সামনে বসে ছিলে। লিখেছিলে হিমালয়ের প্রস্থান। মা তোমার সেই খাতা পড়েছিল তোমাদের আর এক সহপাঠীর কাছ থেকে নিয়ে। …।

     বিমল সরকার অবাক হয়ে যাচ্ছিল। কী করে তা হয় ? সে খুব ছোট থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছে। এক পাড়ায় বাড়ি। টালা পার্কের ধারেই। সেই রাস্তার নাম এখন তারাশঙ্কর সরনী। তারাশঙ্করের মৃত্যুর দিনে সে ঝাড়গ্রাম। কিন্তু একটি লেখা তো লিখেছিল খাতায়, তারাশঙ্করের স্মৃতি। হিমালয়ের প্রস্থান নামে লেখাটি সে লিখেছিল তারাশঙ্করের এক জন্মদিনে। তার ভিতরে পুরোন লেখার ছায়া ছিল। রেডিওতে ধারাবিবরনী শুনেছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে। সেই সময় সেই টালা পার্কের আর একটি যুবক, আর এক বিমল সরকার ছিল তারাশঙ্করের বাড়ির বাইরে ঘাসের জমিতে বসে। সারাদিন। সে যা করত তাই করেছিল সে ?…।

     কী করে হয় ? সেই শাওনি লিখেছে, প্রিয় উদয়ভানু, তোমাকে এই নাম দিয়েছিল আমার মা। যেদিন, এই এই শ্রাবনের সতেরই মা চলে গেল আচমকা। যাবে যে ভাবতে পারিনি আমরা কেউ। বরং আমার বাবার শরীর না জটিলতায় ভরে গেছে। সুগার প্রেশার, তো আছেই, ইদানীং হারটের একটা গোলমাল দেখা দিয়েছে। বাবা বাড়িতে থাকেন। অনেকদিন অবসর নিয়েছেন।  মায়ের চাকরি সবে শেষ হলো। মা এইবার তাঁর সহপাঠীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলছিল। ঠিক হয়েছিল আমি আর মা যাব। সেদিন ছিল আষাঢ়ের অঝোর ধারা। নিম্ন চাপ এল না, উদয়ভানু, সেই সময়। সারাদুপুর ধরে মা গল্প করেছিল তোমার। স্কটিশ চারচ কলেজের সেই লাজুক গম্ভীর যুবকটির। হে গম্ভীর হে গম্ভীর ! মা মাঝে মাঝেই বলে উঠছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। সেই স্কটিশ কলেজ, হেদুয়ার জল, ট্রাম রাস্তার ধারে বসন্ত কেবিন, তুমুল আড্ডা। আবার ট্রাম লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাতিবাগান। সেখানে একটি মিষ্টির দোকান শ্রী গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার। সেই দোকানে পাওয়া যেত ক্রিম রোল। খুব সুন্দর। একবার রঙমহল থিয়েটারে তোমাদের নাটক দেখিয়েছিল মা। মায়ের এক দাদা হলেন বিখ্যাত অভিনেতা সুন্দর মুখারজি।  তোমার কি এখন এসব মনে আছে উদয়ভানু ?…

    বিমল সরকার রীতি মতো ধন্ধের ভিতর পড়ে। আশ্চর্য,  তার স্বপ্ন ছিল যেন এই সব, সেই স্বপ্নের কথা লিখেছে এই শাওনি। যা ঘটেনি অথচ ঘটতে পারত সেই কথাই যেন লিখেছে এই বছর তেইশের মেয়েটি। আষাঢ়ের ঘনঘোর দুপুরে মা আর মেয়ে গল্প করতে বসেছে খাটের উপর। মায়ের মাথার চুলে অনেকটা রূপোলি ভাব, মেয়ের চুল খোলা, শীর্ণকায় সেই মেয়ে, বড় বড় দুই চোখ, সে জিন্স আর টি শার্ট ভালবাসে। তার মাথায় ঘন মেঘের মতো চুল। মা বলে, তোর মতোই চুল ছিল আমার, উঠে উঠে এই রয়েছে।

      যা আছে, তা কি কম মা, তোমার বয়সে এমন চুল থাকে কার ?

      মা হাসল, মায়ের চোখে বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল। মায়ের নাম মন্দিরা। তাই কি? ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে এক মন্দিরা ছিল, সে তার খাতা চুরি করে পড়েছিল তার প্রথম গল্প। নাহ, তা কী করে হয়, এ যে স্কটিশ চার্চের কথা বলছে। মা আর মেয়ে গল্প করতে করতে দুপুর পার করে দেয়।  মা বলে, বিমল সরকারের সব বই আমার আছে, কিন্তু প্রথম বই, মহাত্মা গান্ধীর দেশটা গেল কোথায়?

        শাওনি বলে, আছে মা আছে।

         খুঁজবি তো।

          দেখি তো। বলে মেয়ে ওঠে। দেওয়াল জুড়ে বইয়ের তাক। তার ভিতরে লুকোল নাকি সেই বই ? বিমল সরকারের জন্য তো আলাদা তাক। তার সব বই সেখানে পরপর সাজানো। এ বাড়িতে অনেক বই। মায়ের ওই নেশা। আর বই সাজানো ও সুন্দর করে। বিমল সরকারের তাকে তার প্রথম বই নেই। অথচ ছিল। মা তা পেয়ে গিয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের ফুটপথে। সেই বইটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য বইয়ের ভিতর লুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বাবার অত বইয়ের নেশা নেই। মায়ের বইয়ের তাকে হাত দেয় শুধু মেয়ে শাওনি। শাওনিও মা মন্দিরার মতো পরিপাটি। গুছিয়ে রাখে সব কিছু। এই বাড়িটায় লক্ষ্মীশ্রী আছে। মা মেয়ের ভিতরেও তা। দুজনেরই হাসি মুখ ? মা মেয়ে  দুজনেই খুঁজছে সেই বই। খুঁজে পায়নি। তখন মায়ের কী মন খারাপ।

         শোনো উদয়ভানু,  সেই আষাঢ়ের দুপুরের পর বিকেল থেকে আমি আর আমার মা সেই বই খুঁজলাম। পাইনি। পরের দুদিনও খোঁজা হলো। পেলাম না। অন্য তাকেও খুঁজলাম, না নেই। বইটা উধাও হয়ে গেছে।  প্রত্যেক দিন মা একটু একটু করে বিমর্ষ হতে লাগল। এক দুপুরে আমাকে বলল, গল্পগুলো আবার পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে, ওর ভিতরে নানা অনুভবের গল্প ছিল, প্রথম বই, অল্প বয়সে লেখা, কী এক দীপ্তি ছিল বইটার নানা গল্পে, এখন আর একবার পড়লে ধরা যেত গল্পগুলো টিকে গেল কিনা।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে কী মা, কিসে টিকে যাবে?

     ধর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে, চল্লিশ বছর আগে লেখা সেই গল্প, বাবা আর মেয়ে যাচ্ছে নেমন্তন্ন খেতে কুটুম ঘরে। গাঁয়ের গল্প। কুটুমবাড়িতে মহাভোজ। কুটুম অনেক বড় লোক। মেয়ের ভাত জোটে না প্রায়ই। অভাবী বাপের ক্ষুধার্ত মেয়ে। আসলে বাপ তাকে বিক্রি করে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। কতগুলো ক্ষুধার্ত শৃগালের মুখে ছেড়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছে। এই রকম বা একটু অন্য রকম গল্প, তা আবার পড়ে মা দেখতে চায় বিমল সরকারের গল্প টিকে গেল কিনা।  ‘’মিথ্যে কুটুম’’ ছিল সেই গল্পের নাম। আর সেই মহাত্মা গান্ধীর দেশ!  সেই গল্প ছিল ভূমিহীন এক কৃষকের জীবন ও মৃত্যুর গল্প।  কী অসামান্য ছিল সেই গল্পের এক মৃত্যু। সারাদিন কাজ করে এসে সন্ধ্যায় আপনা আপনি একা একা লোকটি  মারা যায় বাড়ির উঠনে বসে।

     তোমার লেখা প্রথম সাড়া জাগানো গল্প, মনে পড়ে ?

                                           তিন

   অদ্ভূত এক চিঠি এসে পৌঁছেছে বিমল সরকারের কাছে। এতটা বয়স অবধি কত রকম চিঠি পেয়েছে। পাঠক আর পাঠিকার কাছ থেকে। কিন্তু তা ছিল গত দশ বছর আগে অবধি। গত দশ বছর কালেভদ্রে চিঠি পায়। ফোন পায় বেশি। ফোনে মেসেজ পায়। ই-মেলে পায় প্রতিক্রিয়া। ফেসবুকে তার একটি পেজ আছে। সেখানেও কেউ কেউ লিখে দিয়ে যায় কোনো বই নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া। যোগাযোগের মাধ্যমই বদলে গেছে। কতদিন বাদে একটি চিঠি পেয়েছে বিমল। আর সেই চিঠি তাকে টেনে টেনে পিছনে নিয়ে যাচ্ছে। বিমল সরকার নিজে পিছনে ফিরতে চায় না। একবার লিখে ফেলা লেখা আর পড়ে দ্যাখে না। সে শ্রাবনের দুপুরে চিঠি পড়তে পড়তে নিজেকে আলাদা করে নিতে পারছিল না। কিন্তু বিমল বিযুক্তিতে বিশ্বাস করে। সে জানে ডিটাচড হলে দেখা যায় সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এই এক তেইশ বছরের মেয়ের চিঠির  কাদামাটিতে সে যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল। কোনো পাঠক বা পাঠিকার চিঠি এত নিবিড়ভাবে সে পড়েনি কখনো। এই যে শাওনি লিখেছে,  

   প্রিয়  উদয়ভানু,

                         মায়ের মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল বইটি না পেয়ে। কে নেবে সেই বই ? কোথায় যাবে? মাস দুই আগেও তো যেন ছিল মনে হয়। কে নিল? তোমার সুবৃহৎ নতুন বই যদি কেউ নিয়ে যায়, বিশ্বাস হয়, কিন্তু  সেই বইটা কেন নেবে? সেই বই ছাপা ছিল স্মল পাইকা হরফে। আমি জানি না স্মল পাইকা হরফ কাকে বলে।  মা একটা ছাপা বই দেখিয়ে বলেছিল, ওইটা। এখন কম্পিউটার প্রিন্টিং-এ ১২ পয়েন্ট হবে। সেই পাইকা, স্মল পাইকা আর লাইনো ফেস টাইপের  লেটার প্রেস সেই কবে উঠে গেছে। আমার জন্ম ১৯৯0-এ। তখন আর সেই সব ছাপাখানা নেই। যা একটি দুটি টিমটিম করে বাতি জ্বালিয়ে বসে ছিল সেখানে লিফলেট আর মিষ্টির দোকানের বাক্স ছাপা হত। শেষে তারাও গেল লেটার প্রেস ছেড়ে। মায়ের মুখে শুনেছি, টাইপ কেসের কথা। খোপে খোপে এক একটি সিসের অক্ষর, ক খ গ ঘ……। সেই সিসের অক্ষর পর পর সাজিয়ে এক একটি বাক্য। বাক্যের পর বাক্য  সাজিয়ে এক একটি পাতা, এক একটি পাতা এক একটি কাঠের গ্যালিতে। ষোল পাতায় ফরমা। সিসের অক্ষর নিয়ে কাজ করতে করতে বুকে অসুখ ধরে যেত কম্পোজিটরদের। তারা হাতে হাতে অক্ষর সাজাতো। মা সব জানত। মায়ের সব বিষয়ে কৌতুহল ছিল। মানুষের পুরোনর প্রতি এক ধরনের মায়া থাকে। ছেলেবেলা, যৌবনবেলা তার মনে আসন পেতে বসে থাকে। মায়ের তা ছিল। অবসরের পর মা এই সব আমাকে বলে যেত এক এক দুপুরে। উদয়ভানু তোমার সেই বই কদিন ধরে খুঁজে না পেয়ে মা বিমর্ষ হয়ে যেতে লাগল। কলকাতার নানা পুস্তক বিক্রেতার কাছে ফোন করে করে জানতে চাইলো বইট এখন কোন প্রকাশকের ঘরে। তোমার মূল প্রকাশক মেঘদূত প্রকাশনের শ্যামাবাবু জানালেন ওই বই ছাপা নেই। তিনি ফোন নম্বর দিলেন না, ঠিকানাও না। কিন্তু ঠিকানা তো পেয়ে গেলাম ইয়ারবুকে। সেখানে ফোন নম্বর নেই। চিঠি লিখব লিখব করে লেখা হয় না। প্রিয় উদয়ভানু,  তারপর শ্রাবনের এক দুপুরে মা আর মেয়ের কথা হল, মা বলল, মা নিজে লিখবে সেই চিঠি, তোমার প্রথম বইটি আমার মা মন্দিরা আবার পড়তে চায়।

    শাওনি মুখ টিপে হাসল মায়ের কথা শুনে,  বলল, তুমি লেখ আমি স্পিড পোস্টে পাঠিয়ে দি।

     মন্দিরা বলে, আমি বলছি, তুই লেখ।

     না মা, তুমি নিজে লেখ, তুমি টেবল চেয়ারে গিয়ে বস, সুন্দর প্যাড পেয়েছ তোমার কলিগদের কাছ থেকে, ওই প্যাডে লেখ নীল রঙের কালিতে।

      না না, আমার হবে না, তুই লেখ।

      বাহরে, আমি কেন লিখতে যাব, তুমি লেখ সেই স্কটিশ, বসন্ত কেবিন, রঙমহল আর এক একদিন কফি হাউস।

      মায়ের মুখে রক্তচ্ছটা দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল যেন। মা বলল, লিখব দেখি। কী বিমর্ষ সেই কণ্ঠস্বর। মা বিন বিন করে বলল, আমি কি পারব, পারব না, তুই দেখে দিস, আমি একটা খসড়া করছি।
        যাহ, তা হয় নাকি, তোমার চিঠি আমি পড়ব কেন?

        মন্দিরা তখন বলল,  আসলে আমি দেখে নিতে চাই বিমলের সেই গল্পগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক কিনা, এত বছর বাদে সেই আগের অনুভূতি নিয়ে আসে কিনা, গল্প থেকে আমি নতুন কোনো মাত্রা খুঁজে পাই কিনা, তা যদি না হয় আমি খুব দুঃখ পাব।

         শাওনি বলল, বইটির কপি একটা চেয়ে নাও।

         মন্দিরা বলল, দ্যাখ, চাইব তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তারপর যদি আমি দুঃখ পাই, বইটি কোথায় গেল, আমি মাস দুই কেন, মাসখানেক আগেও দেখেছি, বইটি কি আর ধরা দিতে চায় না, আবার তাকে পড়া হোক তা চায় না লেখক বা বই নিজে।

          তুমি কী বলছ মা ?

          বাইরে তখন মেঘ ডাকল গুরুগুরু। সেই বহু যুগের ওপার হতে মেঘ এল। প্রায় চল্লিশ বছর আগে থেকে, তারও আগে থেকে তারও আগে থেকে যাত্রা করেছিল যে মেঘ, সে এল। মন্দিরা বলে, আমার মনে হয়, বইটি আত্মগোপন করেছে নিজে নিজে।

     কী বলছ মা ? শাওনি শিহরিত হয়।

    হ্যাঁ, আর ধরা দিতে চায় না। মন্দিরা বিনবিন করে বলে।

     তোমার তাই মনে হচ্ছে ?

     হ্যাঁরে হ্যাঁ।

      তুমি চিঠিতে লেখ তা তোমার উদয়ভানুকে।

     মায়ের ষাটোত্তীরণ চোখে কী একটা দ্যুতি জেগে উঠে মিলিয়ে গেল। প্রিয় উদয়ভানু, মায়ের কাছ থেকে এই নামটা আমি পেয়েছি তোমার। সেই রাত ছিল শেষ রাত, সকালে উঠে দেখি মা আমার পাশে নেই। আমি শুয়ে পড়ার সময় মাকে রেখে এসেছিলাম আমার স্টাডিতে।  মা কোনোদিন আমার কাছে এসে শোয়, কোনোদিন বাবার পাশে। বাবা এমনি চুপচাপ মানুষ। খেলা পাগল। সারাদিন টেলিভিশনে খেলা দেখে সময় কাটিয়ে দেন। আমার কী যে মনে হল, আমি উঠেই স্টাডিতে গেছি, মা তো কাল রাতে আমার কাছে এসে শোবে বলেছিল,  আমাদের একটা গল্প হয় ভোরে। সুখে আমরা মা আর মেয়ে গল্প করি তখন। মা তার ছেলেবেলার কলকাতার কথা বলে, লাল দোতলা বাস, হাতিবাগানের থিয়েটার,  ঠং ঠং করতে করতে ট্রামের যাওয়া আসা, বিডন স্ট্রিটে রবীন্দ্র মেলা, নাটক রাজরক্ত, চাকভাঙা মধু। পুলিশের ভয় ছিল তোমাদের খুব। তোমাকে নাকি একবার থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে জেরা করেছিল।

      চমকে যায় বিমল সরকার। হ্যাঁ। ঝাড়্গ্রামে তখন নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে। তাদের কলেজেও। পুলিশ অনেক জেরা করে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের রাজ কলেজে পোস্টার পড়েছিল বন্দুকের নল শক্তির উৎস।

       বিমল পিছিয়ে যেতে থাকে শাওনির চিঠিতে চিঠিতে। তার মা সেই প্যাডের পাতায় শুধু লিখেছিল, “ প্রিয় উদয়ভানু’’। মা ঘুমিয়ে ছিল যেন। টেবিলে মাথা। কী প্রশান্তি মায়ের মুখখানিতে। চিরঘুমে গেছে আমার মা মন্দিরা।

(আমার বিনীত প্রার্থনা তুমি যদি পারো, সেই প্রথম বইয়ের একটি কপি আমাকে পাঠিও। তোমার বইএর ভিতর সাজিয়ে রেখে দেব। মা তো সবই সাজিয়ে রেখে গেছে। তার ভিতরে সেইটি থাকবে।)
        প্রিয়  উদয়ভানু,

                         আমি উপরের যে বাক্যটি বন্ধনির ভিতরে লিখেছি, তা আমার লেখার কথা ছিল। মায়ের কাছে তেমনই শুনেছিলাম। মা তোমার কাছে সেই প্রথম বইটি চেয়ে নেবে। তোমার কি মনে পড়ে লাল দোতলা বাসের সামনের সিটে বসে পাইকপাড়া থেকে একবার বালিগঞ্জ যাওয়ার কথা। হু হু হাওয়া। তুমি আর আর একটি ছেলে বসেছিলে একটি সিটে, মা আর তোমাদের ক্লাসের মৌমিতা মুখারজী এক সঙ্গে। তখন তো এমনি হতো। যাক ওসব কথা, তুমি বিস্মিত হবে, মা চিঠি না লিখে ঢলে পড়েছিল টেবিলে। কিন্তু তোমার বইটি ছিল আবার সেই বইয়ের তাকে ঠিক জায়গায়। মায়ের ভয়ে সে নিজেকে লুকিয়েছিল অসংখ্য বইয়ের ভিতর। মা চির ঘুমে চলে যেতে সে আবার নিজের জায়গায়। আমার কী হয়েছিল, মাকে ওই অবস্থায় দেখে আমি তাকের দিকে চলে গেছি, কী মনে হয়েছিল যে মনে মনে, সেই বই ফিরে আসবে। এসেছে এসেছে।

      লেখক, আমার প্রণাম নিয়ো। আমি আর কী বলব ?

      শাওনির এইটি প্রথম চিঠি। এই হয়তো মিঠিপুরের মেয়ের শেষ চিঠি। জানি না এই চিঠি তুমি পড়বে কিনা। আমার কথা আমি বললাম। তুমি পিছনে ফিরে দেখবে কিনা জানি না। আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম, নাকি আমাকে আমার মা বলেছিল আমাদের প্রিয় উদয়ভানু কখনো পিছনে ফিরে তাকান না। তিনি লিখেছিলেন নাকি বলেছিলেন যা একবার লিখেছেন, তার দিকে ফিরে তাকালে নতুন লেখায় যাওয়া যায় না। নিজের লেখা নিয়ে নিজের মুগ্ধতার কোনো কারণ নেই।  প্রিয় উদয়ভানু তুমি তোমার প্রথম বইটির দিকে কি ফিরে তাকাও না ?

                                

    বিমল সরকার চিঠি নিয়ে বসে আছে। এই চিঠির জবাব কি দিতে পারবে সে ? যা ঘটেনি, তাই ঘটিয়েছে এই শাওনি কিংবা তার মা মন্দিরা। স্কটিশ চারচ কলেজ, বসন্ত কেবিন তার হয়নি, কিন্তু ঘটিয়েছে মন্দিরা। এ কে ? এ কি সবটাই বানিয়েছে, নাকি এইই সত্য ? এই সত্য অন্তরের সত্য। তার বইটি গোপন কুটুরি থেকে বের করে এনে আবার পড়ে প্রশান্ত ঘুমে ডুবে গিয়েছে সেই মন্দিরা। শীর্ণকায়, দীর্ঘতমা, কেশবতী সেই মেয়ে ভালবাসত প্রেমের গল্প। ভালবাসায় পৃথিবী শুদ্ধ হয়। কিন্তু তখন চাকরি পেয়ে সেই মেদিনীপুরের লোয়াদা নামের একটি জায়গায় নেমে কাঁসাই নদী পার হয়ে বহু পথ হেঁটে সে পৌঁছেছিল তার ক্যাম্প অফিসে। গরিব গ্রাম গরিব দেশ। ভালবাসায় পড়েছিল বিমল সরকার। অন্নহীনের দেশের অন্নহীন মানুষের ভালবাসায় পড়েছিল সে। লিখেছিল সেই মিথ্যে কুটুম। মহাত্মা গান্ধীর দেশ। ক্ষুধার্ত নারী পোষা প্রানীটিকে মেরে খাচ্ছে। এর ভিতরে প্রেম আর ভালবাসার হনন ছিল।  সেই সব গল্প পত্রিকায় ছাপা হল। কিন্তু বই করবে কে? কেউ না। নতুন লেখকের বই করবে কেন, চলবে না। বিমল সরকার গিয়েছিল এক গ্রামীন ব্যাংকে। দু হাজার ধার নিয়েছিল, সিকিউরিটি তার সার্ভিস। সেই টাকা শোধ করেছিল একশো করে পঁচিশ মাসে। তখন বিমল মাইনে পেত চারশো টাকা। খুব কষ্ট হয়েছিল পঁচিশ মাস। সে ছিল মহাবন্যার বছর, ১৯৭৮। বন্যায় শহর ভেসে গেছে, পথে কোমর জল। বিমল বইয়ের প্যাকেট বুকে চেপে বাড়ি ফিরেছিল। সেই যে সেই বই সেদিন বেরল।  বন্ধুরা ছিল সঙ্গে। তারা সবাই এখন দূরে সরে গেছে অভিমানে। বিমল যে পিছনে ফেরে না। বন্ধুরা কেউ নাকি বলে বিমল খুব স্বার্থপর। হয় তো। সেই কথা বলেছিল ক্ষীরোদ রায়ের মেয়েও। কিন্তু পরে তো সেই গোবিন্দপুরে ফিরে আরো গুছিয়ে নিয়েছে সে বাড়ি আর বাগান। যা বিমলের জীবনে হতে পারত, হয়নি। যা বিমলের জীবনে হতে পারত লাল দোতলা বাস, সামনের সিট মন্দিরা রায়। হয়নি। বিমল বহুদিন বাদে সেই বইয়ের কপিটি বের করতে গিয়ে দ্যাখে নেই। নেই। তার ঘর ভর্তি বই, তার ভিতরে কোথায় আছে কে বলবে। নাকি তার কোনও মায়া ছিল না বলে, আর একজনের হাতে চলে গেছে। বাড়ির কত বই একটি কাজের লোক  চৈতন্য বেচে দিয়েছিল সের দরে। তার সঙ্গে ? বিমল সরকার কেঁপে ওঠে। নাকি বইয়ের স্তুপে কোথায় সে ঘুমিয়ে আছে এত বছর ধরে ?  সুবৃহৎ উপন্যাসের লেখক বিমলের তা জানার কথা নয়। সে তো পুনর্মুদ্রণ করতে দেয়নি তার যৌবনকালের চিহ্নগুলিকে। কতজন ছাপতে চেয়ে না শুনে গেছে। বিমল বহুদিন বাদে সেই বই, সেই অলীক এক সহপাঠিনী, না পড়া কলেজ স্কটিশ চার্চ, বসন্ত কেবিন, লাল দোতলা বাস আর ক্ষীরোদ রায় ও গোবিন্দপুরের জন্য আকুল হলো।   

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত