কার্নিস, বেড়াল ও লম্বা ছায়া
এই যে সে বাস টার্মিনাসে এসে ঘােরাফেরা করছে। তাকে যেতে হবে সেই বাড়িটায় যে বাড়িতে এ জীবনের অনেক বছর কেটেছিল। বাড়িটার কথা তার বেশ মনে আছে। বড় রাস্তা থেকে সমান্তরাল আর একটা বড় রাস্তায় যাওয়ার লিঙ্ক রােড ধরে এগিয়ে ডানদিকে ঘুরে অনেকটা গিয়ে আবার ডানদিকে…। দোতলা। তার একটা চিলেকোঠা ছিলো। মনে মনে সে চিনতে পারছে বাড়িটাকে। প্রাচীরের গায়ে একটা শ্বেতপাথরের ফলক–মাতৃস্মৃতি। কার মা, পিতা না পিতামহর নাকি প্রপিতামহর? নাকি যাদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল তাদের কারওর মা। নাকি তার নিজের মা? মুখখানি খুব ভালাে লাগত তার। দেখলে মন ভরে যেত। কিন্তু শুনেছিল ঠাকুমা পছন্দ করত না। বাবাও না। রাত্তিরে কোলের কাছে নিয়ে এ কথা মা একদিন তাকে বলে ফেলেছিল।
এই যে সে। সে ট্রেনে করে এসে নেমেছে হাওড়ায়। থাকে অনেক দূরে। জায়গাটায় ছােট পাহাড় আছে, জঙ্গল আগে ছিল, এখন প্রায় মুছে গেছে। রােদের খুব তেজ। মনে হয় গরম দুধের মতাে। সে রােদের দিকে তাকিয়ে থাকত জানলা খুলে। গরম হাওয়া এসে ঢুকত ঘরে। তখন ছুটে আসত একজন। ওফ! তুমি জানলা খুলেছ! মরে যাবে যে। বাড়িটা এমনিতেই ফার্নের্স হয়ে উঠেছে। |
সে কোনও কথা বলত না। কিন্তু রােদের দিকে তাকিয়ে তার নেশা হয়ে যেত। জানালা আবার খুলে দিত বউ চলে গেলে। বউ-ই তাে হবে। নাকি অন্য কেউ? চলে গিয়েছিল না একজনের সঙ্গে? তােমার সঙ্গে থাকা যায় না। ফিরেও এসেছিল সেই একজনকে সঙ্গে নিয়ে।
সে একটা বাস খুঁজছে। বাসটায় উঠে চলে যাবে তার বাড়িটার কাছাকাছি। তার মনে আছে তেমন যেতে পারলে, মাতৃস্মৃতি। বাড়িটা তাকে টানছে অনেকদিন ধরে। জানালা খুলে ঠিক দুপুরের শহর দেখতে দেখতে, ঘন রােদে ছাওয়া রাস্তা, দূরের মাঠ, বাড়িগুলাের মুখ, রবীন্দ্রভবনের সামনে দাড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ দেখতে দেখতে তার নিজের মনে হত রােদে বেরিয়ে যায়। একদিন বেরিয়ে হাঁটতেও আরম্ভ করেছিল। তার বউ, নাকি আর কেউ তা জানতে পেরে রিকশা নিয়ে মুখে নাকে কাপড় ঢেকে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর তাকে ধরতে চষে ফেলেছিল সমস্ত গঞ্জ-শহর। সে তখন কালেক্টরের বাংলাের পাশে রােদের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা মাঠের ভিতর। রােদে নির্জন নিঝুম মাঠকে ঘুমােতে দেখে তার খুব লােভ হয়েছিল ঘুমিয়ে পড়ে। মাঠের ধারে শিরিস গাছের নীচে মস্ত একটা ছায়া ছিল। ছায়ায় বসে সে রােদ দেখছিল। জিভ বাড়িয়ে স্বাদ নিচ্ছিল যেন গরম দুধের। সেই গরম দুধ একটু একটু করে চুমুক দিতে দিতে দোতলা বাড়িটার কথা মনে পড়েছিল। সেই সময় তার বউ ছুটে এসেছিল, সঙ্গে আর একটা লােক। তাদের কারওর নাম তার মনে নেই। তপতী আর শুভেন্দু? জানি না । অরুণিমা আর মহীতোষ ? জানি না। তাহলে কি মাধুরী আর মহত্তম? জানি না, জানি না, আমার মনে নেই। তাহলে কি উত্তম-সুচিত্রা? আজ দুজনার দুটি পথ গেছে দুই দিকে বেঁকে? গানটা এই রকম। তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার। ধূপের ধোঁয়া উড়ছে। তাও জানি না, তাহলে তারা কারা? তাদের তাে নামে চিনতে হবে। মনে পড়ছে না।
মনে করো, মনে করো।
ধরতে পারছি না।
আচ্ছা তারা কি উত্তম-সুপ্রিয়া?
সে চুপ করে থাকল।
অনিমেষ আর শ্রাবণী?
ঘুরছিল সে বাস টার্মিনাসে। হাওড়ায় যারা ট্রেন থেকে নামে তারা এখান থেকে বাসে করে যে যার বাড়িতে চলে যায়। ট্রেনে চেপে সবাই বাড়ি আসে। সবার বাড়ি আছে গঙ্গার ওপারের শহরে কোথাও না কোথাও। আর হাওড়া থেকে ট্রেনে যারা চাপে তারা সবাই সেই পাহাড়ি এলাকায় চলে যায়। সেখানে মাটির নীচে কয়লা। দূরে দূরে পুকুর কেটে তার ভিতর থেকে কাঁচা কয়লা বের করে গােরুর গাড়ি করে চালান দেয় সমস্ত রাত ধরে। মাঝে মধ্যে ট্রাকও আসে।।
কী হয়েছিল সেদিন?
মনে নেই আমার, শুধু মনে পড়েছিল একটা শহরের কথা, শহরটা থেকে এদিকে আসতে হলে একটা নদী পেরােতে হয়। নদীর উপর মস্ত ব্রিজ। নদীর জলে নৌকা, লঞ্চ, জল-পুলিশের স্পিড বােট। উপরের আকাশে হালকা মেঘ। নদীর এপার থেকে ওপারের কারখানার চিমনি, ইমারতের পর ইমারত, নদীর পাড়ে পুরােনাে শিব মন্দির, লম্বা বাঁধানাে ঘাট দেখা যায়। এপারটাও ওইরকম। শ্মশান আছে পরপর। শ্মশানে ধোঁয়া উড়ত আগে খুব। মাংসপোড়ার গন্ধ ভেসে থাকত বাতাসে। আমি আমার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম মনে হয়। সে কত দিন আগে!
ট্রেনে করে হাওড়া আসার কথা তখন কেউ একজন বলে দিয়েছিল। ওই রকম শহর বলতে কলকাতা। সে কলকাতায় ঢুকবে। তারপর চলে যাবে সেই বাড়িটার কাছে যা কারও না কারও মায়ের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
সে একটা বাসে উঠে পড়ল। এই শহরে এখন বেলা পড়ে যাচ্ছে। যখন সে ট্রেনে উঠে বসেছিল তখন বেলা দুপুর। তারপর কত সময় কেটে গেছে। কতজন কত স্টেশনে উঠেছে, কত স্টেশনে নেমে গেছে। সে শুধু ভাবছিল এই বুঝি পৌঁছে গেল তার উদ্দিষ্ট জায়গায়। তার সামনে একটি বছর পঁচিশের সুন্দরী কন্যা বসেছিল, তার সিঁথিতে মেটে সিদুর উঠেছে সদ্য। তার পাশে বসেছিল এক যুবক। যুবকের কাঁধে মাথা রেখে সমস্ত পথ ট্রেনে ঘুমিয়ে এল। মুখখানি কী সুন্দর! সর্ব অঙ্গে ঝলমল করছিল সে। তার হাত ভর্তি রঙিন কাচের চুড়ি। মেহেন্দিতে রাঙানাে হাতের পাতা। থুতনিতে খুব সুক্ষ্ম একটি তিল। ট্রেন যখন প্রায় পৌঁছে গেল সে চোখ মেলল। তার চোখের সামনে যেন আলাে ফুটে উঠল। আলােয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। মনে হল সে ছায়ার ভিতর বসে আলাের দিকে চেয়ে আছে।
ছিলও তাে তাই। তারা তাকে দেখতে পেয়েছিল। রিকশা থেকে নেমে হেঁটে আসছিল ছাতা মাথায়। আগে আসছিল পুরুষ। তার পিছনে নারী। সে টের পেয়েছিল তাকেই নিতে আসছে। ছায়ার ভিতর থেকে লাফ দিয়ে সে রৌদ্রে নেমেছিল। ফুটন্ত ঘন দুধের মতো রৌদ্রের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়তে উধাও হয়ে গিয়েছিল রেল স্টেশনের দিকে।
কোথায় যাবেন?
সে মাথা নেড়েছিল, ঠিক জানে না, তবে বাড়িটার নাম মাতৃস্মৃতি।
বাস কন্ডাক্টর বলে, এটা যাবে নাগেরবাজার।
সে বলেছিল, ওখানেই হয়তাে।
কন্ডাক্টর বলেছিল, উঠে পড়ুন।
তারপর বাস চলেছে । বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ঘরে ফেরার সময় এটি। সকলেই ফিরছে। পাখপাখালি থেকে মানুষজন। সে মনে করে অন্ধকার হওয়ার আগে পৌঁছতে পারলে হতো। কিন্তু তা হয়নি। কোনওদিন হবে না। বাস ছাড়তে ছাড়তেই জগৎ অন্ধকার হয়ে এল। গঙ্গা যখন পার হয় তখনও নয়, পার হয়ে এসে এপারের শহর ছুঁতেই পরপর গাড়ির সারিতে দাঁড়িয়ে বিকেল চলে গেল। আলাে জ্বলে উঠল পথে।।
তাকে যেতে হবে দোতলা বাড়িটায়। সেই বাড়ি ছেড়ে তারা চলে গিয়েছিল ওই ঘন রোদ্দুরের দেশে, পাহাড়ি পথে। কবে গেল মনে পড়ে না। কার সঙ্গে গেল, মনে পড়ে না । কিন্তু মনে পড়ে এই শহরের সেই বড় রাস্তা। সেখান থেকে লিঙ্ক রােড ্ধরে ভিতরে ঢুকে বাডির পর বাড়ি। গায়ে গায়ে লাগানাে। লােহার গেট খুলে এক প্রশস্ত উঠোন। সবটাই বাঁধানাে, রােদের দিনে কী গরম হয়ে উঠত। বর্ষার দিনে পিছল। বারান্দায় বসে আছে এক বুড়াে। পাশের বাড়ির কার্নিসে একটা বেড়াল। উঠোনের প্রান্তে প্রাচীরের গায়ে শুয়ে দুটো পথের কুকুর। পড়েই থাকত। ঘুম ভাঙলে গেটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেত। ও পাড়ায় কত কুকুর। সমস্ত রাত তারা পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
সে কন্ডাক্টরকে ভাড়া দিতে দিতে বলল, আমাকে নামিয়ে দিয়াে। |
দেব, বলবেন স্টপেজ এলে।
সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগল সন্ধ্যার শহর। কোথাও কোথাও অন্ধকার নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই যে বাড়িটা, একবার ইলেকট্রিক বিল না মেটানােয় অনেকদিন অন্ধকার হয়ে পড়ে ছিল। হেরিকেন জ্বলত, কেরােসিনের টেমি জ্বলত। দোতলার বারান্দা, সিঁড়ি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে খুব লম্বা একজনকে সিড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল সে। খুব ভয় পেয়েছিল। তখন তার যােলাে-সতেরাে। মা বলেছিল, একজন আছেন। তিনি ঘােরাফেরা করেন। মা তাঁর নিঃশ্বাস, তাঁর পায়ের শব্দ টের পেয়েছে কতদিন। তবে তিনি নাকি কারও ক্ষতি করেন না। বাড়িরই তাে একজন ছিলেন।
বাড়ির একজন, কে?
মা বলেছিল, তার বাবার কাকা। মায়ের খুড়শ্বশুর। তিনি সুইসাইড করেছিলেন উঠোনের কোণে দাঁড়ানাে একটা আমগাছের ডাল থেকে ঝুলে। মা তাঁকে নেমে যেতে দেখেছিল মধ্যরাতে। এখনও তিনি উপর থেকে নীচে নেমেই যান। তাঁর আত্মহত্যার পরে আমগাছটিকে আর রাখা হয়নি। তিনি নেমেই যান। আমগাছটিকে খুঁজে না পেয়ে আবার উঠে আসেন। আবার পরদিন নেমে যান।
তার মনে হচ্ছিল এসে গেল হয়তাে। খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে সিগন্যালে। বাইরের এক রেস্তোরাঁ থেকে যে গন্ধটি তার নাকে এসে লাগবে, তা খুব চেনা। কত পুরোনো। বাবার হাত ধরে ওই গন্ধওয়ালা রেস্তোরাঁয় এসেছে কয়েকবার। তারা দুজনে মোগলাই পরটা, কিংবা ফিসফ্রাই খেয়ে ফিরেছে। মা হেসে বলত, তোর গায়ে কিসের গন্ধরে বুবুন ?
সেই সেই গন্ধ। বাড়িটা রেখে, ওই গন্ধ, রাস্তা, শহর রেখে কবে যে ভীষণ রোদের গঞ্জে গিয়ে কার হাতে পড়ল সে ? আবার ফিরে এসেছে। বাড়িটায় বেশ হেরিকেন জ্বলতে থাকবে। অন্ধকারে সেই লােকটা নেমে যাবে। তার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও। বাবা নাকি রেস খেলে সব খুইয়ে ছিল। চিলেকোঠার ঘরে তাস খেলত বাবারা। জুয়া। মা রাগ করত। কিন্তু মায়ের কিছু করার ছিল না। ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা পরে, গায়ে ভুরভুরে এসেন্স ছড়িয়ে, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে বাবা তাস খেলত। প্রায় সবদিন হারত। বাবা না হারলে বন্ধু আর দু’জন আসবে না, তাই বাবাকে হারতেই হতো। খেলাটা এত আনন্দের যে হারটা কোনো দুঃখেরই না, বাবা বলত। খেলাটাই আসল, হার কিছু না।
সে ভাবছিল নেমে যাবে কি না। কিন্তু নাকে আসা গন্ধটা হঠাৎ উধাও। তাহলে হয়তো গন্ধটা তার মনে এসেছিল। এখনো সে পৌছয়নি সেখানে। সে জানালা দিয়ে ভালো করে দেখল। না, চেনা লাগছে না। অথচ চেনা থাকার কথা ছিল। চেনা পথ, চেনা দোকানপাট, চেনা মানুষ। বাবা পায়চারি করছে রাস্তার মুখে। ইলেক্ট্রিক কানেকশন কেটে যাওয়ার পর জুয়ার আসর বন্ধ হল। বন্ধুরা অত অন্ধকারে অত গরমে হেরিকেনের আলোয় জুয়ো খেলতে রাজি হলো না। তখন বাবার কী অবস্থা! সন্ধের পর রাস্তায় ঘোরাঘুরি, চায়ের দোকানে বসা, শেষে চিলেকোঠার ঘরে একা। একদিন তাকে ডাকল, বুবুন খেলবি ?
মা বলেছিল, যা বুবুন।
সে বলেছিল, তোমার কষ্ট হবে না মা ?
মা বলেছিল, লোকটা আর পারছে না।
বাবা তাকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গিয়ে হেরিকেনের আলোর সামনে বসে বলেছিল, তুই জিতলে আমার আনন্দ হবে।
সে বলেছিল, আমি তাে খেলতেই জানি না।
তােকে শিখিয়ে দিই, আগে তাসগুলাে চিনে নে।
সে ছিল আশ্চর্য খেলা। তার মনে হয়েছিল বাবার জেতা উচিত। বাবা জিতলে সে আনন্দ পাবে। বাবা তাকে বুঝিয়েছিল, না ছেলের কাছে বাবা হারতেই চায়।
সে বলেছিল, না বাবা, তােমাকে জয়ী দেখতেই তাে আমি চাইব।
সারাজীবন সবার কাছে হেরে ছেলের কাছে জিততে আসব কেন আমি? ছাদের উপর বসে আকাশ দেখতে দেখতে সে বাবার কথা শুনত। বাবার পরাজয়ের বৃত্তান্ত। মানুষ হারে শুধু বুদ্ধির দোষে।।
মা একদিন বলল, সবটা সত্য নয়।
কোনটা সত্য নয়?
মা বলেছিল, তােকে বলা যাবে না, সব তােকে জানতে হবে না।।
কথাগুলাে অজানাই থেকে গেছে। তবে কিছু কিছু সে শুনেছিল। এক মহিলার কাছে তাকে বাবা পাঠিয়েছিল একবার টাকা আনতে। টাকা নিয়েও এসেছিল সে। কিন্তু পরেরবার গিয়ে আর তাঁকে পায়নি। সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন বেড়াতে। বাবা তখন জ্বরে পড়ে আছে।
মা বলেছিল, ওই জনই আমাদের সব্বোনাশ করেছে।
এসেছে যখন শহরে সে এবার সব জেনে আসবে। তার মনে হচ্ছিল উঠে পড়ে। এসে যাচ্ছে জায়গাটা। সেই যে সেই মাতৃস্মৃতির শহর। চিলে কোঠায় বসে বাবা একা তাস খেলছে মাদুরের উপর। রুহিতন, হরতন, চিড়িতন, ইস্কাবন। লাল কালাে। বাবার মস্ত ছায়া দেওয়ালে স্পন্দিত হচ্ছে। ভয়
সে একদিন জিগ্যেস করেছিল, কে মা উনি ?
ওঁর ঘরেই তো আগে তাস খেলা হত, তাের বাবা হেরে আসত, ওকে জিতিয়ে দিয়ে ওর মন পেয়ে গিয়েছিল, কােনও লােক হারতে এত ভালােবাসে!
একদিন বাবার জ্বর এল দুঃখে। জ্বর যে লেগেছিল আর ছাড়ছিল না। শেষে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল লোকটাকে। হাসপাতালটা খুব দূরে ছিল না। ফ্রি-বেডে পড়েছিল অনেক দিন। তারপর আর যুঝতে পারল না।
সে এবার নামবে। হাসপাতালের গন্ধটা পেল। ঘন করে ওষুধের গন্ধ, ফিনাইলের গন্ধ। কত মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হাসপাতালের ভিতর রেখে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করেই আছে। দিন নেই রাত নেই বসেই আছে বাইরে। হাসপাতালের মত ইমারত অসংখ্য মত্যুকে ধারণ করে কেমন ভীতিকর হয়ে উঠত মধ্যরাতে। ভিতরে ডাক্তার নার্স জেগে আছে কোনও ওয়ার্ডে। রােগীরা কেউ কেউ দু-হাত দু-পা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে মৃত্যুকে।
সে ভাবছিল নেমে পড়বে। হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথটি তার চেনা। ওই পথেই হাঁটতে হাঁটতে মায়ের কাছে শেষ খবরটি এনেছিল। সে নামতে যাবে তাে হাসপাতাল পিছনে চলে গেল ওষুধের ভারী গন্ধ নিয়ে। আবার একটি নতুন গন্ধ, নতুন চিহ্ন এলেই সে নামবে। নামবেই এবার। বাস ফাঁকা হয়ে এসেছে। সে ঘুরে বাঁ দিকে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে গিয়ে টের পায় সেই হাতে মেহেন্দি, হাত ভর্তি রঙিন চুড়ি, মেটে সিদুর, রঙিন সিঙ্কের আঁচলের নীচে ঘুমিয়ে থাকা দুটি মােহনীয় স্তন, ভারী উরু, চওড়া কোল নিয়ে যে লাবণ্যময়ী তার সঙ্গে ট্রেনে এসেছে এতদূর, সে-ও বাসে আছে। কখন উঠেছে জানে না। তার সঙ্গেই বুঝি চলেছে মাতৃস্মৃতির উদ্দেশে। সঙ্গের যুবক স্বামীটি বাসের অন্য কোথাও হয়তাে। সে তাকিয়ে থাকল। চেনা মনে হচ্ছে। এইরকম শাড়ির খসখস, ভুরভুরে এসেন্সের গন্ধ, গয়না ভর্তি গা, ফুলের মালা–। আচমকা সব আলাে নিভে গেল যেন। সে টের পায় তাকে সে রেখে এসেছে অন্য কোথাও। অথবা সে অন্য কারওর হাত ধরেছে। তাকে নিয়ে মাতৃস্মৃতিতে প্রবেশ করলে সব ঝলমল করে উঠেছিল।
বাস চলছিল। যুবতী বধূ উঠল। গেটের কাছে এগিয়ে গেল। কোথা থেকে যুবক স্বামীটি এসে তাকে ছুঁয়ে দাঁড়াল। স্বামী বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
জানি, বাসে উঠলেই তােমার ঘুম। রিনরিনে সােহাগী কণ্ঠস্বর বেজে উঠল।
তুমি যে সমস্ত ট্রেনে…।
বাহ, তুমি যে বললে, তাই।
ঘুমিয়ে নিলাম, রাত জাগা হবে তাে।
বধূটি বলল, পাশের বাড়ির কার্নিসের বেড়ালটাকে দেখলে ভয় করে, ও ঘরের ভিতরে নজর দেয়।
তাড়িয়ে দেব ?
তাই দিও, জানালায় এসে দাঁড়াবে না তো বুড়ো লােকটা?
না জানালা বন্ধ রাখব।
বধূ বলল, ‘ইস! জানালা দিয়ে কী সুন্দর যাদের আলো আসে।
আচ্ছা বুড়োকে তাড়িয়ে দেব। স্বামী বলল।
আর সেই যে একটা লম্বা লােক নেমে আসে শুনেছি, আমার কী ভয় করে ? বধূ বলল।
ভয়ের কী আছে ?
আম গাছটা কোথায় ছিল, এই জানালার ধারে নয়তো?
না, তা হবে কেন ?
এই আমার ভয় করছে, কী রকম অন্ধকার।
অন্ধকারে আমাদের অভ্যেস আছে। স্বামী মানুষটি বলল।
বধূ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কবে আলাে আসবে?
অন্ধকার আমাদের ভালাে লাগে। সে বউ-এর বুকে মুখ গুঁজল, বিনবিন করে বলল, এই তাস খেলবে, তিন পাত্তি, শিখিয়ে দেব।
আলাে না এলে আমি তাস খেলব না।
আলাে এল। ডুম জ্বলতে লাগল বারান্দায়, ঘরে। বউকে ডাকল সে, এসাে তাস খেলব, ভয় নেই তুমি জিতবে।
না, তােমার কাছে আমি হারব।
না তুমি জিতবে বউসােনা।
কেন, তুমি কি ইচ্ছে করে হারবে?
স্বামী বলল, আমার হারতে ভালাে লাগে।
নাকি জিততে পার না তাই ? তীক্ষ হয়ে উঠল রমণী কণ্ঠস্বর।
তখন কন্ডাক্টর তার পিঠে হাত রেখেছে, কোথায় নামবেন?
এসে গেছে? সে চমকে জেগে উঠল। সমস্ত বাস ফাঁকা।
হ্যাঁ শেষ স্টপেজ, এ বাস আর যাবে না।
তারা কোথায় নামল?
কারা? কন্ডাক্টর অবাক, সঙ্গে কেউ ছিল?
ছিল তাে, বাবা ছিল, মা ছিল আমার বউসােনা ছিল, কার্নিসের বেড়াল, সিঁড়িতে বসে থাকা বুড়াে, দোতলা থেকে নেমে আসা লম্বা লােক, উঠোনের কুকুর, তালা বন্ধ চিলেকোঠা, দোতলারা শরিকদের ছেলের বারান্দা থেকে ছরছর করে নেমে আসা পেচ্ছাপ-! মামলায় হেরে তাদের দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসতে হয়েছিল। বাতাসে পেচ্ছাপের ছিটে ঘরের ভিতর, বিছানায় এসে পড়ত।।
সে ফিরেছিল সেই রােদ-পড়া রােদ-সেঁকা গঞ্জে। তার বউ বলল, আবার গিয়েছিলে তাে?
হু, কী সুন্দর পড়ে আছে শহরটা, ঠিক সেই রকম, গঙ্গা নদীও রয়েছে।
লজ্জা করে না যেতে, মেরে বের করে দিয়েছিল, তােমার বাবা সব বন্ধক দিয়ে গিয়েছিল জুয়ােয়।
সে চুপ করে থাকল।
বউ বলল, সব জাল দলিল, কিন্তু কিছু করতে পারলে?
না হেরে গেলাম।
হারতে তাে ভালােবাসাে।
তাই তাে, আনন্দ আছে, সবাই খুশি হয়।
তবে গিয়েছিলে কেন, খুঁজে পেয়েছিলে?
সে মাথা নাড়তে বউ বলল, পাবে না তাে জানি, আমি আর অঞ্জন কত খুঁজলাম তোমাকে, থানায় গিয়েছিলাম, থানা বলল, নিজে নিজেই ফিরে আসবে, পুলিশ সব জানে, এলে তো! অঞ্জন চাইছিল তুমি যেন হারিয়ে যাও।
সে বলল, তাস খেলবে?
তুমি তাে হারবে জানি।
তাতে খুশি হবে না তুমি বউসােনা?
বউ বলল ওসব বলবে না তাে, অঞ্জন রাগ করে, যদি ও আমাকে নিয়ে চলে যায়, তখন তুমি কী করবে?
গিয়েছিলে তাে।
হ্যাঁ, পরে মনে হল তুমি একা পড়ে আছ, অঞ্জনই আমাকে ফেরত নিয়ে এল।
সে জিগ্যেস করল, তােমার মনে পড়ে না?
কী, সেই কার্নিশ, বেড়াল, বুড়াে, লম্বা ছায়া ?
হ্যাঁ, সব ভুলে গেছ?
হ্যাঁ, ভুলে গেছি, কিন্তু রাত হলেই মনে পড়ে, বলে তার বউ চোখ মুছতে লাগল আঁচলে। অঞ্জন তার বিয়ের আগের চেনা। অঞ্জন নিয়ে এল তাদের এই শহরে। বিনিময়ে সে অঞ্জনের সঙ্গে ঘুমােতে গেল। প্রথম প্রথম আড়ালে, লুকিয়ে, পরে এই লােকটাকে এই ঘরে শুইয়ে দিয়ে, মশারি গুঁজে দিয়ে। অঞ্জনকে শর্ত দেওয়া আছে, এই লােকটাকে রাখতে হবে সঙ্গে। এই লোকটা হারতে হারতে একেবারে হারিয়ে গেছে কোথায় যেন। একে সে ছাড়তে পারবে না।
সে ডাকল, বউসােনা?
বউ আঁচল নামাল মুখ থেকে, বলল, ও ভাবে ডাকবে না, অঞ্জন পছন্দ করে না।
সে বলল, যাও তুমি ও ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়াে, তােমাকে ছাড়া ওই অঞ্জন ঘমােতে পারে না।।
তাহলে যাই।
যাও, ঘুম ভাঙলে এসাে, তাস খেলব, গ্যাম্বলিং হবে।
কী হবে খেলে, তুমি তাে হারবে।
সে বলল, না, তােমাকে জিতে নেব, নেবই বউসােনা।
তারপর? বউ ঝুঁকে পড়ল তার দিকে।
পুরােনাে বাড়ি, কার্নিশ, কালাে বেড়াল, বুড়াে লােক, লম্বা ছায়ার ভিতরে আমরা, আমরা—আমরা। বলতে বলতে সে জড়িয়ে ধরল বউকে।
কথাসাহিত্যিক
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১ বাংলা দেশের সাতক্ষীরার কাছে ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন কাটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক দপ্তরে। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ( ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রথম ভারতীয় লেখক যিনি গাঁওবুড়ো গল্পের জন্য ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন।
স্বপ্নের মত লেখা। কি অসাধারণ
চমৎকার। ভিন্ন ছাঁদ।
এই দুটি মন্তব্য রয়েছে, অথচ comments 0 দেখায় কেন? আর মন্তব্য অনুমোদন না করলে তা কেন প্রকাশিত হয় না, এ কেমন ধারা?
যশোধরা ও অলোক গোস্বামীকে ধন্যবাদ।