অমর মিত্র সংখ্যা: আমার বন্ধু অমর । তপনজ্যোতি মিত্র
৫০ বছর আগে …
আজ থেকে ৫০ বছর আগে কোলকাতার টালা পার্কে বা বেলগাছিয়ায় কোনও চায়ের দোকানে বসে দুই তরুণ একে অন্যকে নিজেদের লেখা গল্প শোনাতো।
তাদের চোখে ছিল অনেক উজ্জ্বল স্বপ্ন, সাহিত্যের প্রত্যন্ত গভীরে পৌঁছে যাওয়ার অদম্য আন্তরিক ইচ্ছা।
তখন বেলগাছিয়া থেকে ছোটগল্পের একটি অসাধারণ পত্রিকা প্রকাশ হত, নাম ছিল ‘একাল’- সম্পাদনায় ছিলেন সাহিত্যিক শ্রীনকুল মৈত্র ও শ্রীভরত সিংহ, নিজেদের ভালোবাসায় এই পত্রিকাটিকে তাঁরা একটি উন্নত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁরা অনেক প্রতিভাবান লেখকদের এই পত্রিকায় লেখার সুযোগ দিতেন।
এই দুই তরুণের প্রথম লেখাগুলি সেই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল, যা তাদের উদ্ভাসিত করেছিল আবেগময়তায়। তারপর একসময় সেই দুটি তরুণের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় জীবিকার কারণে।
একজন সাহিত্যের তীর্থযাত্রায় থেকে যায়, আর তার কর্মজীবনের পাশাপাশি বিকশিত করে তোলে তার লেখক সত্তাকে, তার লেখক জীবনটিকে। আর একজন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় লেখালেখির জগত থেকে, সে চলে যায় সুদূর প্রবাসে।
কিন্তু পৃথিবীতে কিছু কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বছরের পর বছর সুদূর প্রবাসের সেই লোকটি নিয়মিত তার পেছনে ফেলে আসা সাহিত্যিক বন্ধুটির উপন্যাস এবং গল্পগুলি পাঠ করতে থাকে।
সে যেন জানত তার সাহিত্যিক বন্ধুটির লেখনীশক্তি অসীম এবং সেটাই তার বন্ধুকে অনেকদূর নিয়ে যাবে।
অমরের একেকটি লেখা পড়ে আমি বিস্মিত হয়ে যেতাম তার লেখার গভীরতা এবং বিস্তার দেখে। যেমন মনে করুন ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসটি- এক প্রাচীন ভারতবর্ষের বিশালতায় কাব্যপম এই মহা উপন্যাস, যার পটভূমি উজ্জয়িনী, তার সমাজকথা, তার অনাবৃষ্টি, আর ধ্রুবপুত্রের প্রত্যাবর্তন, বৃষ্টির ফিরে আসা। ধ্রুবপুত্র পড়ার পর কিছুদিন স্তব্ধ হয়েছিলাম। ভেবেছি কত উপলব্ধি আর মানস দৃষ্টি থাকলে ইতিহাসের পটভূমিকায় এই রকম এক ধ্রুপদী উপন্যাস রচনা করা সম্ভব !
এই উপন্যাসটি লেখার জন্য অমর সাত বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল, উজ্জয়িনী পর্যন্ত গিয়েছিল। এইরকম মহত্তর প্রচেষ্টা থেকেই ত সৃষ্টি হয় কালজয়ী রচনা।
উপন্যাসটির সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার তারই স্বীকৃতি। বা মনে করুন ‘অশ্বচরিত’ উপন্যাসটি- হিরোশিমার সেই ধ্বংসস্তূপের কাছে হাঁটতে হাঁটতে আমার অমরের অশ্বচরিত উপন্যাসটির কথা মনে পড়েছিল – যেখানে তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণে মরে যেতে যেতে অশ্ব কন্থক উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিল। বা মনে করুন ‘ধনপতির চর’ উপন্যাসটি- যেখানে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় একটি চর জেগেছিল, সেই চরে আসা মানুষজন, তাদের জীবনকথা আর শেষে চরটি হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য ক্লাসিক উপন্যাস ।
এরকম অনেক ধ্রুপদী ও গভীর উপন্যাস উপহার দিয়েছে অমর- ‘অরুন্ধতী তারার রাত’, ‘নিসর্গের শোকগাথা’, ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’, ‘দশমী দিবসে’, ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’, ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’, ‘পুনরুত্থান’, ‘সমুদ্র জননী’, ‘জ্যোৎস্নাবাড়ি বাতাসবাড়ি’, ‘ও আমার পছন্দপুর’ – তালিকা দীর্ঘ ।
গল্প রচনাতেও সমান দক্ষ অমর, একের পর এক অসামান্য গল্প সৃষ্টি করেছে, যেমন – ‘মেলার দিকে ঘর’, ‘গাওঁবুড়ো’, ‘স্বদেশযাত্রা’ এবং আরও অনেক গল্প। অমরের উপন্যাস বা গল্পের জন্য সুদূর প্রবাসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম। দীর্ঘ অনেক বছর পর একটা সময় এলো, যখন মনে প্রবল ইচ্ছা হল অমরের বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার। কিন্তু মনে প্রশ্ন আসতো- হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বের আহবানে অমর কি সাড়া দেবে?অনেক সাহস করে ২০১৮-য় ফেসবুক মেসেঞ্জারে একদিন যোগাযোগ করেছিলাম…
অমর আমাকে জিজ্ঞাসা করল- তুমি কি আমার সেই পুরনো বন্ধু তপনজ্যোতি? আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে!
আমারও চোখে জল এসেছিল, রুদ্ধ গলায় বলেছিলাম – হ্যাঁ আমিই সে, অমর। তারপর তো ইতিহাস। এখন অমরের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহেই কথা হয়, সাহিত্যের বিভিন্ন লেখা ও বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
আমি খুব সৌভাগ্যবান মনে করি নিজেকে, অমরের মত গভীর বিস্তারিত মনের এক সাহিত্যিকের সঙ্গে আলোচনা করতে পেরে, আমি বারবার সমৃদ্ধ হই।
কেন অমর সাহিত্যিক হিসেবে এত সফল?জীবনানন্দের কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে যায়- ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?’
অমর বারবার হৃদয় খুঁড়ে সেই সব বেদনা জাগিয়েছে, লিখেছে মানবতাবাদী, সমাজধর্মী, প্রান্তিক মানুষদের কথা- যাতে প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের দুঃখ, হাহাকার, বিষাদ চেতনার অনুভব। অমর কখনো একরকম লেখা লেখেনি, তার প্রতিটি লেখা একে অন্যের থেকে অন্যরকম।
কাজের সূত্রে জীবনের অনেক কিছু দেখেছে অমর, সেই মহাসমুদ্রের অনুভবই তার সাম্প্রতিক আত্মকথন গুরুচন্ডালীতে প্রকাশিত ‘পেন্সিলে লেখা জীবন’।
এই লেখাটি পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। সমৃদ্ধকারী এবং মননশীল এই লেখাটি পড়লে বোঝা যায় মমতা আর মানবতাবাদী অনুভব নিয়ে কিভাবে সে সমাজকে, সমাজের মানুষদের দেখেছে- যেগুলি উপাদান হয়ে উঠেছে তার বিভিন্ন লেখায়।অমরের আরেক বড় গুণ নতুন লেখকদের ভালো লেখা তুলে ধরা। খুব কম নামী লেখকই নিজেদের বৃত্তের বাইরে গিয়ে তরুণদের এইভাবে উৎসাহিত করেন। অমরের আলোচনা থেকেই আমরা অনেক তরুণ সাহিত্যিকের কথা জানতে পারি।
লেখার পাশাপাশি অমর পড়তেও খুব ভালোবাসে- যেমন দস্তয়েভ্স্কি, চেকভ, কাফকা, কাম্যু, মুরুকামি এবং বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের লেখা। এর থেকেই বোঝা যায় অমর কিভাবে বিশ্বসাহিত্য এবং বাংলাসাহিত্যের দিকে লক্ষ্য রাখছে যেটি এক বিস্তৃত মনের সাহিত্যিকের অন্যতম গুণ।
সমাজবদ্ধতার পাশাপাশি অমরের আরেকটি বড় গুণ পরিবেশ সচেতনতা। যেটি ওর উপন্যাস ‘ও আমার পছন্দপুর’ এ প্রতিফলিত। উপন্যাসটিতে আছে – ন-পাহাড়ি আর পছন্দপুরের কথা। ন-পাহাড়ি রূঢ় বাস্তব -যেখানে পরিবেশ এবং মানুষ বিপন্ন হয়েছে আর পছন্দপুর আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের পৃথিবী!
২০১৯ সালে যখন কলকাতায় এলাম তখন এক অন্য অনুভূতি ছিল মনে।
অমরের সঙ্গে এত দীর্ঘ সময় পরে দেখা হবে!যেদিন বেলগাছিয়ায় অমরের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল, ও সারাদিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল! অমরের বাড়িতে গভীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
অমর ওর সাথে আমার একটা ছবি তুলে ওর ফেসবুক পেজে পোস্ট করল। আমাকে ওর শ্রেষ্ঠ গল্পের বই উপহার দিল। এবং আমরা কত স্মৃতিচারণা করলাম, হেঁটে গেলাম রুপালি স্মৃতির পথে। কবির ভাষায় মনে হল- ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’।
দে’জ পাবলিশিং থেকে থেকে ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ বইটি যেদিন প্রকাশিত হলো সেদিন ওর সাথে ছিলাম। সেটি ছিল একটি অনন্য সুন্দর অভিজ্ঞতা।
তারপর সৃষ্টিসুখ থেকে তার ২৫টি গল্পের বই প্রকাশিত হলো। সেখানে সৃষ্টিসুখ এর সরোজ দরবার আমাকে অমর সম্বন্ধে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন।
আমি অমরের সাহিত্যকৃতি নিয়ে বলেছিলাম, আর বলেছিলাম, ৫০ বছর আগে যেন দূরদৃষ্টির মত আমার একটা সঠিক ধারণা ছিল, অমর সাহিত্যিক হিসেবে অনেকদূর যাবে, অনেক সফল হবে।
অমরের যাত্রাপথ তাইই প্রমাণ করেছে। অমর আর আমি তারপর কফি হাউসে গেলাম, সেটা আমার কাছে একটা টাইম ট্রাভেলের মত লেগেছিল। ৪৮ বছর আগে নকুলদা, ভরতদা, অমর এদের সবাইকার সাথে কফি হাউসে আসতাম। আবার ৪৮ বছর পর এলাম সেই একই কফি হাউসে যেখানে অমর বাদে আর সব লোকেরা বদলে গেছে!
অমর ওর বর্তমান কিছু সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল – যেমন নলিনী বেরা, অলোক গোস্বামী, অনির্বাণ বসু, প্রবুদ্ধ মিত্র ইত্যাদি। সেই প্রসঙ্গে আর একটি স্মৃতি মনে পড়ল। কখনো টালা পার্কে, কখনো নকুলদার বাড়িতে ‘একাল’ পত্রিকার সাহিত্য আড্ডা বসতো। সেখানে অনেক লেখক আসতেন, গল্প পড়া হতো, গল্প করা হতো।
একবার নকুলদা, তাঁর একটি বই প্রকাশ উপলক্ষে, সীমিত সাধ্যে তাঁর বাড়িতে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। সেখানে নকুলদা, ভরতদা, কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সুবিমল মিশ্র, কবি সুকোমল রায়চৌধুরী, লেখক কৃষ্ণ মণ্ডল এবং আরও অনেকে ছিলেন, আর ছিল অমর এবং আমি।ছসেই সন্ধ্যায় গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা আমরা আজীবন ভুলিনি।
সাহিত্যকে কি এইরকম ভাবে ভালোবাসা যায়? স্মৃতি হয়ে থাকে আজীবন সমুজ্জ্বল?জীবনের কোনো কোনো অমূল্য ধন উজ্জ্বল হয়ে থাকে। অমরের বন্ধুত্ব সেই রকম এক উজ্জ্বল রত্ন।
জীবন তো অনেক বর্ণময়, অনেক ভালোবাসা্র, অনেক আবেগের! সাহিত্যিক অমর মিত্র আর জীবনের অমর মিত্র যেখানে মিলেছে সেই মহা অনুভবকেই স্পর্শ করতে চাই বারবার।
ভালো থেকো অমর, মর্মের তীর্থস্থানে থেকো, আরো লিখো, তোমার আরো অনেক রূপময়, ঐশ্বর্যময় লেখা দিয়ে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করো।