অমর মিত্র সংখ্যা: গল্প: ডকুমেন্ট । অমর মিত্র
এখন বুড়ো লোকটার সঙ্গী টেলিভিশন আর অনেক পুরোন কভার ফাইল । কভার ফাইলের ভিতরেই প্রাণ ভোমরা। ক’দিন ধরে সে তার কাগজপত্র খুঁজছে। কাগজপত্র মানে প্রমাণপত্র। ডকুমেন্ট। ডকুমেন্ট চাই। না হলে বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। বুড়ো সে বেশি হয়নি, কিন্তু এই প্রমাণপত্রর চক্কোরে বয়স বেড়ে গেছে মনে হয়। কদিন আগেও লোকটা বেশ ছিল। সে আর তার বউ। আর একটি পুত্র। সারাজীবন ধরে এক পয়সা দু’পয়সা করে জমিয়েছে। বুড়োর বউয়ের সে জন্য কত ক্ষোভ। সব যদি ব্যাঙ্কেই থাকবে, তাহলে শখ-শৌখীনতা পূরণ হবে কী করে? চাকরি সে অতি সাধারণ করত। কিছু মানুষ কেরানি হতেই জন্মায়। বি,এ পড়তে পড়তে সে ক্লারকশিপ পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় থেকে চাকরি করবে, আর কী চাই এ জীবনে? কেরানিগিরি করতে করতে সে কয়েকটা প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি। অনেকটা উপরে বলা যায়। তার কপাল ভালো ছিল, এক সহকর্মী দ্বিজদাস মণ্ডল আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে তার জায়গায় শেষ প্রমোশন পেয়েছিল অবসরের দু বছর আগে। সেও এক শীতের সময় ছিল।
বুড়ো শুনেছে শীতের সময়টায় সাবধানে থাকতে হয়। এই সময় রক্তচাপ বেশি থাকে, ফলে আচমকা কিছু ঘটে যেতে পারে। দ্বিজদাস মণ্ডল সেদিন রাতে কষে পাঁঠার মাংস খেয়েছিল। লোকটা উপরি নিত। আমাদের এই বুড়ো খুব ভীতু প্রকৃতির ছিল। তার হাতে একবার এক সহকর্মী টাকা গুঁজে দিলেও ভয়ে সে ফেলে দিয়েছিল ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। হ্যাঁ, একবারই তা হয়েছিল। তারপর আর তার কাছে টাকা নিয়ে কেউ আসেনি। রটে গিয়েছিল, ও নেয় না, কাজ করে দেয়, আবার করেও না আইনের বিরুদ্ধে কিছু। তবে উপরওয়ালারা হুকুম দিলে কিংবা অনুরোধ করলে সে না করতে পারত না। পরে সে এমন দপ্তরে চলে গিয়েছিল যেখানে ওসব ছিল না। কিন্তু তার সহকর্মী দ্বিজদাস মণ্ডল নিয়মিত উপরি নিত। হাতে টাকা এলেই বউবাজারের বাঙালির পাঁঠার দোকান থেকে রাঙের মাংস কিনে বাড়ি ফিরত। রাতেই তা রান্না করত। দ্বিজদাস নিজেই ভালো রান্না করত। তার বাড়ি মেদিনীপুরের ঘাটাল। ইস্টার্ন বাই পাসের ধারে একটা ফ্ল্যাট কিনেছিল কতদিন আগে। তখন এই বুড়ো থাকত বাগবাজারের দত্তবাড়ির একতলায়। ২৫ নং কে, মল্লিক লেনের ভাড়া বাড়িতে বুড়োর বাবা চণ্ডীদাস রায় এসে উঠেছিল তার বাবা মানে এই বুড়োর ঠাকুরদা, ঠাকুমা, ভাই নিয়ে। তখন বুড়োর জন্ম হয়নি। সেই ২৫ নং বাড়ি ছেড়ে এসেছে সে তিরিশ বছর হবে। সমবায়ে জমি পেয়েছিল এই পঞ্চান্ন গ্রামে। বাড়ি তুলল। দ্বিজদাসও জমি পেয়েছিল পঞ্চান্ন গ্রামে। কম দামে নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছিল। দ্বিজদাস তাকেও উপদেশ দিয়েছিল জমি বিক্রি করে দিতে। তিন ডবল দামের খদ্দের আছে। দ্বিজদাস বুদ্ধি দিয়েছিল বাগবাজারের বাড়ি না ছাড়তে। কিন্তু বুড়োর বউ বুড়ি চেয়েছিল নিজের বাড়ি। ভাড়াটে বাড়িতে কতকাল থাকবে? নিজের বাড়ির শখ ছিল বুড়ির। বুড়োর ভিতরে তা চারিয়ে গিয়েছিল। তাই বুড়ো দ্বিজদাসের কথা মতো তিনগুন দামের খদ্দেরকে বেচে দিতে পারেনি। দ্বিজদাস কিন্তু জমি বেচে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাট থাকতে নিউটাউনে আর একটি কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাট করেছিল। ভাড়া দিয়ে সেই ফ্ল্যাটের টাকা তুলে নিয়েছিল। সে ছিল কৃতি মানুষ। দ্বিজদাসের ছেলে একটি। ছেলেটিকে সে নাম করা ইংলিশ মিডিয়মে পড়িয়েছিল। এখন বড় চাকরি করে নাকি দিল্লিতে। দ্বিজদাসের বউ মাঝে মধ্যে ফোন করে বুড়োর বউ সীমাকে। তাদের নিউটাউনের ফ্ল্যাট পড়েই আছে। ভাড়ায় রেখেছিল অনেক দিন। ভাড়াটে চলে যাওয়ার পর আর দেওয়া হয়নি। বাইপাসের ধারের ওই ফ্ল্যাট কত বড়। সে একা থাকে। ছেলের বউ তাকে পছন্দ করে না। ছেলেও বউয়ের বিপক্ষে কিছু বলে না। এই রকম সব কথা। দ্বিজদাস বছরে তিনবার বেড়াতে যেত, সারা ভারত তার ঘোরা। বিশেষত সব তীর্থস্থান। বারানসী, হরিদ্বার, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া, গুজরাতের সোমনাথ মন্দির, উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির…সব। ফিরে এসে গল্প করত। প্রসাদ নিয়ে আসত। পুরি গিয়েছিল বুড়ো-বুড়ি একবার। বিয়ের পর। একটা হলিডে হোমে উঠেছিল। দিনেই তার ঘর অন্ধকার। গুমোট। আর পুরি যায়নি। সে অবসরের আগে ফ্যামিলি নিয়ে গিয়েছিল আন্দামান। আন্দামান ঘোরার কথা তার বউ বুড়ি খুব বলে। আন্দামানে গিয়ে বুড়োর খুব ভালো লেগেছিল। সব পূর্ব বাঙলার মানুষ। ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল। তাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল খুলনা জেলার বাগেরহাট সাব ডিভিশনে। বাড়ির কাছেই ভৈরব নদী। মা বলত। খুলনা শহরে দুটি নদী আছে। রূপসা অন্যটি। ভৈরবের ওপারেই বাগেরহাট। তাদের গ্রামের নাম ‘নদীর কূল’। কী সুন্দর নাম। আন্দামানে গিয়ে তারা দুজনেই খুব অবাক হয়েছিল। বুড়িদের বাড়ি ওপারে ছিল না, কিন্তু সেই প্রথম বুড়ি তার শ্বশুরবাড়ির দেশের মানুষ দেখেছিল। সব উদ্বাস্তু। সকলের মুখে ঐ দেশের ভাষা। সে যে কী মধুর লেগেছিল। বুড়ো হ্যাভলক দ্বীপে খুঁজে পেয়েছিল বাগেরহাটের মানুষ। তার একটা হোটেল আছে সি-বিচের ধারে। খুব বড় শ্যামন মাছ ভাজা খাইয়েছিল। নামটি মনে আছে, শক্তিসাধন মৃধা। ‘নদীর কূল’ গ্রাম সে খুব চেনে। সেই শক্তিসাধনের বয়স বুড়োর চেয়ে বেশি। শক্তিসাধন বলেছিল নদীর কূল গাঁয়ে ছিল তার মামার বাড়ি। তারা আন্দামানে ভালো আছে। না দেশের কথা ভাবে না। বুড়ো আন্দামানে গিয়ে শুধু তার বাগেরহাটের লোক খুঁজেছিল, অথচ সে কোনোদিন বাগেরহাট যায়নি। শক্তিসাধন বলেছিল, ‘নদীর কূল’ গ্রাম নাকি ভৈরবের ভিতরে চলে গেছে। তার মামার বাড়ি তো। মামারা থাকে মসলন্দপুর। মামারা তেমন খবর পেয়েছে। মামাদের ঠিকানা নিয়েছিল বুড়ো। কিন্তু সেই কাগজ হারিয়ে গেছে। রিটায়ারমেন্টের পাঁচ বছর হয়ে গেছে। বাগেরহাট, ভৈরব নদ, ‘নদীর কূল’ গ্রাম সব বুড়োর কাছ থেকে আবার মুছে গেছে।
এতদিন বাদে বুড়ো বলল, আন্দামানের লোকটা সত্যি বলেনি মনে হয়।
সত্যি হলেই বা কী, মিথ্যে হলেই বা কী ?
আমি একবার যেতাম।
গিয়ে তুমি কী করতে, তোমার জন্মও তো এপারে।
তবু, আমাদের শিকড় তো।
বুড়ি বলেছিল, বয়স হয়ে তোমার মাথার ঠিক নেই, আমাদের আন্দামান ট্যুর ঐ বাগেরহাট আর ‘নদীর কূল’ করে নষ্ট হয়ে গেল, তুমি কি জানতে ওখেনে তোমাদের দেশের লোক আছে?
মাথা নেড়েছিল বুড়ো। বলেছিল, ওরা ৪৭-এর পরপর সবাই চলে এসেছিল, আমরা কবে আমি কিছুই জানি না, বাবা কোনো ডকুমেন্ট রেখেই যায়নি, ওদেশের জমির খতিয়ান, পর্চা যদি থাকত…।
কী হবে ?
বুড়ো চুপ করে থাকল। কী হবে তা জানে না, কিন্তু দরকার মনে হয়। সকলে এখন ডকুমেন্ট জোগাড় করছে। ২২ নং প্লটের অবিনাশ রাহা বলল তার কাছে নাকি তার বাবার সিটিজেন সার্টিফিকেট আছে, ৪৮ সালেই পাওয়া, যত্ন করে রেখে দিয়েছিল, তাহলে কি বুড়োর বাবা চণ্ডীদাস রায়ের সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট ছিল না কি? ছিল নিশ্চয়, কিন্তু যত্ন করে গুছিয়ে রাখেনি। আবর্জনার ভেবে ফেলে দিয়েছে হয়ত তারা।
বুড়ি বলল, ওসব কারই বা থাকে, আমরা নাকি বর্ধমানের মঙ্গলকোটের লোক, একবার খুব ভাতের অভাব হলো, ৪৩-এর মন্বন্তর, আমরা তখন চলে আসি হাওড়ায়, তারপর হাওড়া থেকে বরানগর, আমার মায়ের জন্ম আবার বিহারের ভাগলপুর, মায়ের সার্টিফিকেট নিশ্চয় ছিল মাধ্যমিকের, কিন্তু ভাই বলছে নেই, মা বেঁচে নেই, আমরা এপারের লোক।
কিন্তু ডকুমেন্ট লাগবে তো।
ভাইকে বলেছি ডকুমেন্টের কথা, বাবার একটা লাইসেন্স ছিল হোটেলের, তা রিনিউ করার কাগজ পেয়েছে, তাতেই তো হবে।
রিনিউ হয়েছিল কোন সালে?
বুড়ি বলল, মনে হয় ১৯৬০-৬২ সালে।
তোমার বাবার নামে ?
না, রাজলক্ষ্মী হোটেলের নামে।
সেই হোটেল এখন নেই তো।
না, কী করে থাকবে ?
তাহলে ঐ লাইসেন্সের মূল্য কী ? বুড়ো উদ্বিগ্ন গলায় বলল। আসলে সে ভালো ভাবে জানে না, কোনটা মান্য, কোনটা নয়। শুনে বুড়ি চুপ করে থাকে। দুজনেই চুপ। তারা এই বাড়িতে দুজন। ছেলে থাকে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে। সে একটা সিমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করে। তার বিয়ে দেবে বিয়ে দেবে ভাবছে বুড়ো। ছেলে করতে চায় না। এখন মনে হচ্ছে এদেশি ছাড়া বিয়ের সম্বন্ধ করবেই না। কারা ওপার থেকে কবে এসেছে তা কি আর জানা যাবে ? কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। আসামে ১২ লক্ষ বন্দী হয়ে গেছে। এমন হয়েছে, মাকে নিয়ে গেছে, ছেলে মেয়েরা রয়ে গেছে। বাবাকে নিয়ে গেছে, মা রয়ে গেছে। কত রকম খবর আসছে। সোলজার ছিল। যুদ্ধ করেছে দেশের হয়ে, তাকেও নিয়ে গেছে। ডকুমেন্ট চাই, ডকুমেন্ট, ডকুমেন্ট ছাড়া হবে না।
বুড়ি বলল, আমাদের কেউ কখনো পাকিস্তান বা বাংলাদেশে ছিল না।
মুখের কথায় কিছু হচ্ছে না।
আমরা তো বর্ধমানের লোক।
বর্ধমানের জমিজমার কাগজ যদি থাকে ভালো।
সে তো ৭৬ বছর আগের কথা, আমার এক জেঠা মশায় অবিশ্যি বর্ধমানের রাজার সেরেস্তায় কাজ করত, শুনেছি বাবাকে যেতে বলেছিল বর্ধমানে, যায়নি, ঠাকুরদার হোটেল চলত ভালো। বুড়ি ধীরে ধীরে বলছিল। তার মনে হলো বাবা যদি বর্ধমান রাজবাড়িতে কাজ করত, একটা ডকুমেন্ট খুঁজে বের করা যেত। কিন্তু সেই রাজবাড়িতে তো বিশ্ববিদ্যালয়। আর আছে সরকারি অফিস। সেখানে রাজবাড়ির সেরেস্তার কাগজপত্র কি থাকতে পারে ? বুড়ি তার বাবার কথা ভাবছিল। মঙ্গলকোট থানা জানে, কিন্তু গ্রামের নাম জানে না। ঠাকুরদার বাবার নামও জানে না বুড়ি। সে ভাবল, তারা এপারের লোক, যাই হোক এপারের লোক তো, কী হবে ? বুড়ির শীত করছিল। কদিন থমকে থেকে আজ আবার উত্তুরে বাতাস শুরু হয়েছে। টেলিভিশনে বলছে কাশ্মীরে বরফ পড়ছে, কাশ্মীরের শালওয়ালা রহিম এসেছে এবারও, কিন্তু লোকটা চুপ। আপেলবাগানে কাজ করতে গিয়ে চারটে লোক নিহত হয়েছে। আর যারা গিয়েছিল কাজ করতে, ফিরে এসেছে। সব থামবে কবে ?
কী থামবে ? বুড়ো জিজ্ঞেস করল।
এই সব ?
বুড়ো বলল, হবে না, আধার কার্ডের সঙ্গে মোবাইল, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কারড…সব যোগ করে দিতে হবে, খুব লাইন, ভোরবেলায় লাইন পড়ছে, লোকে ছুটছে শুধু।
না করলে ?
ডকুমেন্ট, দেশের সিটিজেনকে এসব করতে হবে।
বুড়ি বলল, আগে তো করিনি, করতে হয়নি।
এখন বলছে, না করলে সব বাতিল হয়ে যাবে ?
কী বাতিল হবে ?
সব প্রমাণপত্র, বাতিল হলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বুড়ি বলল, ধুত সব গুজব।
দিনে দশজনের কাজ করবে, লাইন পড়ছে একশো, আমাদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ঠিক আছে তো?
তুমি তো ফাইলে রাখলে, আচ্ছা আন্দামানে সবাই তো রিফিউজি।
কে রিফিউজি ?
আন্দামানের লোকের কথা জিজ্ঞেস করছি।
হ্যাঁ রিফিউজি।
ওদের কাছে সব আছে ?
বুড়ো চুপ করে থাকে। সে জানত না, কিন্তু শক্তিসাধন মৃধার কাছে দেশের বাড়ির কথা শুনে খুব লাভ হয়েছে। ‘নদীর কূল’ হাই ইস্কুলের ছাত্র ছিল তার বাবা। ওদেশেই ম্যাট্রিক, তারপর প্রাইমারি মাস্টার, তারপর এপারে এসে মুদির দোকানদার। দোকান ঐ বাগবাজারের বাড়ির সামনেই ছিল। দোকান করতে কি লাইসেন্স নিতে হয়নি কর্পোরেশনের কাছ থেকে। কিন্তু নেই। কিছুই নেই। কোনো ডকুমেন্টই নেই। বুড়োর মনে হলো এই বাড়িটার জন্য এসব হয়েছে। বাড়ি সে করত না। বাগবাজারে বেশ চলে যাচ্ছিল। ছেলে নিজে একটা ফ্ল্যাট কিনে নিত যখন দরকার পড়ত। উত্তরবঙ্গ তার মনে ধরেছে। এখন খুব শীত ওখানে। শীত কমলে তারা যাবে বেড়াতে সেই কথা আছে। দ্বিজদাসের কথা শুনলেই হত। কিন্তু তার এই বউয়ের খুব শখ ছিল নিজের বাড়ি। সে ভাড়াবাড়িতেই বড় হয়েছে। তার মা-ও বলত নিজের বাড়ির কথা। নিজের বাড়ি হলে একটা ছাদ থাকবে। শীতের দিনে ছাদে রোদ থাকবে। গ্রীষ্মের সময় ছাদে দখিনা বাতাস থাকবে সন্ধের পর। পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না থাকবে। আকাশের তারা চেনা যাবে। আর কতকাল লোকের বাড়িতে মাথা নিচু করে থাকতে হবে, নিজের বাড়ি না হলে কী আছে আমার? স্থাবরই থাকে। বাকি সব ফুরিয়ে যায়। টাকা পয়সা গয়নাগাটি–সব। বুড়ি বাড়ির উঠনে একফালি জায়গায় ফুল ফুটিয়েছে। গাঁদা, জবা, একটি কাঠ গোলাপ ও একটি শিউলি গাছও আছে। বাড়ির সেই শিউলিগাছে ফুল ফোটে যখন ভাদ্রমাসে, বুড়ির কী আনন্দ। এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে…। মা দুর্গা আসছেন। বাড়ির ফুল দিয়েই বুড়ি প্রতিদিন পুজো করে। কিন্তু এইসব ফুল, শিউলিগাছ, জ্যোৎস্না, দখিনা বাতাস কী কাজে আসে? এসব তো ডকুমেন্ট নয় কোনো। এইসব করতে গিয়ে কত ডকুমেন্ট হারিয়ে এসেছে তারা।
একটা বাড়িতে তারা ৫০-৫৫ বছর বাস করছিল । সেই বাড়িতেই সব কাগজপত্র ছিল। আসার সময় কত কিছু ফেলে দিয়েছে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তাদের মুদি দোকান উঠে গিয়েছিল কবে। লাইসেন্স রেখে কী হবে ? বুড়ো তার হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেট খুঁজে পাচ্ছে না, অথচ বি, এ, পাশের মার্কশিট রয়েছে। বি, এ, পাশের সার্টিফিকেট সে নেয়নি কলেজ থেকে। কী হবে? হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেট দরকার। বয়স আছে। পাচ্ছে না। পেলে ভালো হত। না হলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিল কোথা থেকে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ১৯৭১-এর মার্চে উচ্চমাধ্যমিক হয়ে গেলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ লাগল। ডকুমেন্ট চাই ডকুমেন্ট। আজ যে ডকুমেন্ট লাগবে না বলছে, আগামীকালও তা লাগবে না, তা গ্যারান্টি দিয়ে কেউ বলতে পারে ? সেই যে শক্তিসাধন মৃধা দিল মসলন্দপুরের ক’জনের নাম ঠিকানা, থাকলে কী কাজে লাগত বলা যায় না। তারা এসেছে, বুড়োর বাপ-ঠাকুরদাও এসেছে। তাদের একদল চলে গেল আন্দামান, একদল থাকল মসলন্দপুর আর এক পরিবার থাকল বাগবাজার। বুড়োর একটা অভ্যেস আছে, কিছুই না ফেলা। সব কিছুই কোনো না কোনো ফাইলে ঢুকিয়ে ফেলা। এই বাড়ির কোনো ফাইলেই তা আছে নিশ্চয়। আন্দামান বেড়াতে গিয়েছিল এখান থেকে। সুতরাং এখানে, এই বাড়িতেই আছে। পেলে একদিন মসলন্দপুর চলে যেত। ‘নদীর কূল’ গ্রামের মানুষ আমি। বাবার নাম চণ্ডীদাস। ঠাকুরদার নাম রামদাস। আমার নাম শিবদাস। ডকুমেন্ট চাই। কী আছে আপনাদের কাছে ? তাদের কাছে খবর আছে ভৈরবের ভিতর তলিয়ে গেছে সেই গ্রাম। নেই এখন। তাহলে কী হবে ? তলিয়ে গেছে বলেই তারা এপারে চলে এসেছিল, থানা-পুলিশ হয়নি। গ্রামটি ভৈরবের ভিতরে চলে গেল, তলিয়ে গেল দেশ তাই চলে আসতে হলো। বুড়োর কথায় বুড়ির সায় নেই। মাথা গেছে বুড়োর। এইটা মুখের কথা, ডকুমেন্ট কই ? কিন্তু ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের কথা ইতিহাসে আছে। তোমরা মন্বন্তরেই চলে আসনি কেন ? বুড়ো ফাইল খুঁজছে। ফাইল থেকে মা-বাবার ডেথ সার্টিফিকেট বেরিয়ে এল। এপারেই মারা গিয়েছিলেন সেই প্রমাণ। ডকুমেন্ট। ২০০২ এবং ২০০৪ সালে। এই বাড়ি তারপরে করা। ডেথ সারটিফিকেটে রয়েছে বাগবাজারের ২৫ নং কে, মল্লিক লেনের ঠিকানা। এ থেকে প্রমাণ হয় ২৫ নং বাড়িতে তারা থাকত। কিন্তু ঐ রাস্তায় সেই বাড়ি এখন নেই। সেখানে সাততলা ফ্ল্যাট বাড়ি। বাড়ির মালিক পরিতোষ দত্তরা চলে গেছে নিউটাউন। নিউটাউনের কোথায় তা সাততলা ফ্ল্যাট বাড়ির কেউ জানে না। পরিতোষ দত্তর নামই শোনেনি তারা। কিনেছে তো প্রমোটারের কাছ থেকে। পরিতোষ দত্তদের সঙ্গে বাবার কি কোনো চুক্তি হয়নি ? সেই কাগজ পেলে হত অনেকটা। একটা ডকুমেন্ট তো। বুড়ো যা শুনছে টিভিতে এবং খবরের কাগজে যা পড়ছে, যে কোনো ডকুমেন্ট চাইতে পারে। সব ডকুমেন্ট সব ডকুমেন্টের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটা কিছু স্থির হবে। যেমন হচ্ছে আধার, প্যান, ভোটার, রেশন কার্ড…। তেমনি হবে ‘নদীর কূল’ থেকে গঙ্গার কূলের বাগবাজার, সেখান থেকে পঞ্চান্ন গ্রাম। সকালে দেখেছে যে কাগজটা, এখন তা পাচ্ছে না সে। ইস, বাড়ি তৈরি করার সব ডকুমেন্ট রয়েছে, ইট বালি সিমেন্ট রড, জানালা, দরজা, গ্রিল…কেনার রসিদ সব। হার্ড ওয়ারের দোকানের সব বিল। কিন্তু বাড়ির দলিল নেই। গেল কোথায় ? কো-অপারেটিভ দলিল করে দিয়েছিল। আবার কো-অপারেটিভ যাদের কাছ থেকে কিনেছিল, সেই তাদের করে দেওয়া দলিল আছে। একটা আছে, আর একটা নেই। কিন্তু সব ডকুমেন্ট না থাকলে, বুড়ো ক’দিন আগে খবরের কাগজে দেখেছে, অপেক্ষা শিবির। একটা বুড়ো বসে আছে ঘাড় হেট করে। বুড়ো কেঁপে উঠল। শীতের বাতাস যেন ঝাপটা দিল। বউকে বলল, কম্বল দিতে, টুপিটা দিতে।
বুড়ি চুপ করে বসেছিল। বুড়োর তবু কিছু না কিছু আছে, তার যে কিছুই নেই। অথচ তারা পাকিস্তান কি বাংলাদেশের মুখই দ্যাখেনি। বুড়ির কাছেও শীত এল। কনকনে শুকনো বাতাস এল ঘরের ভিতর ঢুকে পড়েছে জানালার কপাটের ফাঁক দিয়ে। পাক দিচ্ছে। বুড়ি বলল, আমাকেও কম্বল দাও, আমার গায়ে কিছুই নেই, বড্ড শীত!
শীতকাল ঢুকে পড়েছে এই ধু ধু করা পঞ্চান্ন গ্রামে। এক কম্বলের ভিতর নানা ময়লা, ছেঁড়া কাগজপত্তর নিয়ে বসে আছে বুড়ো বুড়ি। বয়স হলে শীতটা বেশি হয়। তারা শুনতে পাচ্ছিল দরজায় কেউ ধাক্কা মারছে। কে এল? শীতকাল। আরো শীত!
কথাসাহিত্যিক
জন্ম :৩০ আগস্ট, ১৯৫১ বাংলা দেশের সাতক্ষীরার কাছে ধূলিহর গ্রামে। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবন কাটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের এক দপ্তরে। তিনি ২০০৬ সালে ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ( ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২২ সালে প্রথম ভারতীয় লেখক যিনি গাঁওবুড়ো গল্পের জন্য ও হেনরি পুরস্কার পেয়েছেন।