Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

আমার রবীন্দ্রনাথ

Reading Time: 3 minutes

রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই, মনে রাখাও কঠিন। তবে এটুকু বলতে পারি স্বচ্ছন্দে, প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারো লেখা পড়তাম না। আমার কৈশোর কাটে রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলে। তখনকার কবিতা-পিপাসু কিশোর ও তরুণরা পাগলের মতন রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ত। রাত্তিরবেলা উঠে রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা পড়ে নিতুম। সেসব কবিতা ছিল আমার নির্জনতার সঙ্গী। বিশেষ ভালো লাগা কোনো কোনো লাইন অপরকে জানানোর জন্য আমি বিনা কারণেই একে ওকে তাকে চিঠি লিখতুম। তখন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের গদ্য কবিতাগুলোও ছিল আমার মুখস্থ।

পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনো কিন্তু সাহিত্যের আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের কিরণ ছটাতেই অনেকখানি আচ্ছন্ন। পত্রপত্রিকায় অধিকাংশ প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে; অধ্যাপকরা রবীন্দ্রনাথে আপ্লুত। রাজনৈতিক নেতারাও তাঁদের ভাষণে যখন তখন, অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দেন। এমনই তাঁর সর্বব্যাপ্ত প্রভাব, বাংলার প্রায় সব লেখাই রবীন্দ্র-অনুসারী। ‘দেশ’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি প্রভাবশালী পত্রিকায় রবীন্দ্র-অনুসারী কাঁচা কবিতারই প্রাবল্য, নিছক ছন্দ-মিল দেওয়া সেসব অদ্ভুত জিনিস!
‘আধুনিক কবিতা’ তখন শিক্ষিত মহলেও হাসি-ঠাট্টার বিষয়। যেকোনো ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মতন এমন বিশাল মাপের প্রতিভাধর লেখকের আবির্ভাব হলে তার খানিকটা বিপদও আছে। তাঁর প্রভাব ও ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা খুবই শক্ত, সাহিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তাহলে আর সাহিত্যবহতা থাকবে কী করে?


আমি অল্প বয়সে রবীন্দ্র-বিরোধী ভূমিকা নিলেও তাঁর লেখা পড়েছি তন্ন তন্ন করে। কখনো কখনো কেঁদেছি। কোনো কোনো গদ্য রচনাও কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। এরপর অনেক কাল তাঁর গান ছাড়া অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কয়েক বছর আগে তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে একটি উপন্যাস লেখার সময় তাঁর প্রায় সব রচনা আবার পড়ে নিতে হয়। হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন, কিছুই অপাঙ্ক্তেয় নয়। যুগ অতিক্রম করে সাহিত্যের একটা চিরকালীন বিচারও তো আছে। সেই বিচারে রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ লেখক। বিশ শতকে সারা পৃথিবীতেই বা তাঁর তুল্য আর কে আছে?

গোঁড়া রবীন্দ্র-ভক্তরা একসময় রবীন্দ্রনাথের খুব ক্ষতি করতেন। তাঁরা, যেমন সুকুমার সেন ও নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলতেন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতা আর পাঠযোগ্য নয়! এতে অন্য পক্ষে রবীন্দ্র-বিমুখতা বেড়ে যেত। ষাটের দশক পর্যন্ত রবীন্দ্র-ভক্তদের বাড়াবাড়ি এবং তাঁকে গুরুঠাকুর বানিয়ে পূজা করার চেষ্টা অত্যন্ত প্রবল ছিল। আমাদের মতন তরুণ লেখকদের কাছে এটা অসহ্য মনে হতো।

রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছিলেন, আর কিছু না থাকুক, তাঁর গানগুলো থেকে যাবে। সত্যিই তাঁর গান পেরিয়েছে কালের সীমানা, আজও তাঁর গান মাতিয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের, এমনকি অবাঙালিদেরকেও। সংগীত-স্রষ্টা হিসেবে সদ্য যৌবন বয়স থেকেই তিনি বিপ্লবী। সুর আহরণ করেছেন নানান সীমানা থেকে, ইচ্ছে মতন মিশিয়েছেন কোনো প্রথা না মেনে। নানান মার্গ-সংগীতের রাগ-রাগিণীর নির্দিষ্ট রূপ ভেঙে মিলিয়ে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন সুর। প্রখ্যাত ওস্তাদদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন উচ্চাঙ্গ-সংগীতের, সেই সঙ্গে পিয়ানো বাজিয়ে দীক্ষা হয়েছে ইউরোপীয় সুরে। যখন ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলায়, তখন সংগ্রহ করেছেন বাউল, ফকির, মাঝি-মাল্লা, এমনকি ডাক-হরকরাদের নিজস্ব গান, সেসব সুরে নিজস্ব কথা বসিয়ে রচিত হলো যেসব সংগীত, তা বাংলায় অশ্রুতপূর্ব। পাঞ্জাব ও দক্ষিণ ভারতের নানান গানের সুরও মিশিয়েছেন বাংলা গানে, যা তাঁর আগে আর কেউ করেননি।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই বিভিন্ন মানসিক স্তরের রেখাভেদ অত্যন্ত স্পষ্ট। নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘কড়ি ও কোমল’ রচনার আগে কাব্যের ভাষা তাঁর কাছে ধরা দেয়নি। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ২৭। যৌবন থেকে মধ্যযৌবনই তাঁর কাব্য রচনার শ্রেষ্ঠ সময়। একাই তিনি বাংলা কাব্যকে তুলে নিয়েছেন বিশ্বস্তরে।

রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে বারবার প্রাণের মধ্যে মিশিয়ে নিতে চেয়েছেন। তাঁর মধ্যে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের মতো সেনসুয়াস আবেদন হয়তো ছিল, কিন্তু ইংরেজ কবিদের চেয়ে তাঁর আন্তরিকতা ও ব্যাকুলতা যে আরো তীব্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধ্বনি-মাধুর্যে ও চরিত্র-নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীমূলক কবিতাগুলোর গভীর আবেদন রয়েছে। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদে’র মতন সংলাপ-কাব্য বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ।

রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, শেকসপিয়ার বা ভিক্টর য়্যুগোর মতো প্রতিভাদের সৃষ্টি-ক্ষমতা অনেক ব্যাপক হয়। তাঁরা নিছক কবির মতন লাজুক, নিভৃতচারী হন না, হন দারুণ বাস্তবতা জ্ঞানসম্পন্ন, পরিশ্রমী, ভোগী, অণু থেকে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে কেতূহলী। সাহিত্য ছাড়াও আরো অন্য অনেক দিকে ছড়িয়ে থাকে তাঁদের আগ্রহ। গ্যেটে যেমন বহু রমণীচর্চা করেছেন, তেমনই গবেষণা করেছেন গাছপালা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথেরও বান্ধবী ও অনুরাগিণী-ভাগ্য ঈর্ষণীয়। তিনি ছবি এঁকেছেন, ব্যবসা করেছেন, সারা দেশের বিবেক-প্রতিভু হয়েছেন, একটি সাধারণ ছোট্ট বিদ্যালয়কে পরিণত করেছেন মহীরুহে। যেকোনো ভাষায় এ রকম একজন লেখকের আবির্ভাব প্রায় অলৌকিক ঘটনা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>