আমার রবীন্দ্রনাথ
পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনো কিন্তু সাহিত্যের আবহাওয়া রবীন্দ্রনাথের কিরণ ছটাতেই অনেকখানি আচ্ছন্ন। পত্রপত্রিকায় অধিকাংশ প্রবন্ধই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে; অধ্যাপকরা রবীন্দ্রনাথে আপ্লুত। রাজনৈতিক নেতারাও তাঁদের ভাষণে যখন তখন, অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দেন। এমনই তাঁর সর্বব্যাপ্ত প্রভাব, বাংলার প্রায় সব লেখাই রবীন্দ্র-অনুসারী। ‘দেশ’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘শনিবারের চিঠি’ প্রভৃতি প্রভাবশালী পত্রিকায় রবীন্দ্র-অনুসারী কাঁচা কবিতারই প্রাবল্য, নিছক ছন্দ-মিল দেওয়া সেসব অদ্ভুত জিনিস!
‘আধুনিক কবিতা’ তখন শিক্ষিত মহলেও হাসি-ঠাট্টার বিষয়। যেকোনো ভাষায় রবীন্দ্রনাথের মতন এমন বিশাল মাপের প্রতিভাধর লেখকের আবির্ভাব হলে তার খানিকটা বিপদও আছে। তাঁর প্রভাব ও ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা খুবই শক্ত, সাহিত্যের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তাহলে আর সাহিত্যবহতা থাকবে কী করে?
গোঁড়া রবীন্দ্র-ভক্তরা একসময় রবীন্দ্রনাথের খুব ক্ষতি করতেন। তাঁরা, যেমন সুকুমার সেন ও নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলতেন, রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতা আর পাঠযোগ্য নয়! এতে অন্য পক্ষে রবীন্দ্র-বিমুখতা বেড়ে যেত। ষাটের দশক পর্যন্ত রবীন্দ্র-ভক্তদের বাড়াবাড়ি এবং তাঁকে গুরুঠাকুর বানিয়ে পূজা করার চেষ্টা অত্যন্ত প্রবল ছিল। আমাদের মতন তরুণ লেখকদের কাছে এটা অসহ্য মনে হতো।
রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছিলেন, আর কিছু না থাকুক, তাঁর গানগুলো থেকে যাবে। সত্যিই তাঁর গান পেরিয়েছে কালের সীমানা, আজও তাঁর গান মাতিয়ে রেখেছে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের, এমনকি অবাঙালিদেরকেও। সংগীত-স্রষ্টা হিসেবে সদ্য যৌবন বয়স থেকেই তিনি বিপ্লবী। সুর আহরণ করেছেন নানান সীমানা থেকে, ইচ্ছে মতন মিশিয়েছেন কোনো প্রথা না মেনে। নানান মার্গ-সংগীতের রাগ-রাগিণীর নির্দিষ্ট রূপ ভেঙে মিলিয়ে মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন সুর। প্রখ্যাত ওস্তাদদের কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন উচ্চাঙ্গ-সংগীতের, সেই সঙ্গে পিয়ানো বাজিয়ে দীক্ষা হয়েছে ইউরোপীয় সুরে। যখন ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামবাংলায়, তখন সংগ্রহ করেছেন বাউল, ফকির, মাঝি-মাল্লা, এমনকি ডাক-হরকরাদের নিজস্ব গান, সেসব সুরে নিজস্ব কথা বসিয়ে রচিত হলো যেসব সংগীত, তা বাংলায় অশ্রুতপূর্ব। পাঞ্জাব ও দক্ষিণ ভারতের নানান গানের সুরও মিশিয়েছেন বাংলা গানে, যা তাঁর আগে আর কেউ করেননি।
রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই বিভিন্ন মানসিক স্তরের রেখাভেদ অত্যন্ত স্পষ্ট। নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘কড়ি ও কোমল’ রচনার আগে কাব্যের ভাষা তাঁর কাছে ধরা দেয়নি। ‘মানসী’ পর্বের কবিতা রচনার সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ২৭। যৌবন থেকে মধ্যযৌবনই তাঁর কাব্য রচনার শ্রেষ্ঠ সময়। একাই তিনি বাংলা কাব্যকে তুলে নিয়েছেন বিশ্বস্তরে।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে বারবার প্রাণের মধ্যে মিশিয়ে নিতে চেয়েছেন। তাঁর মধ্যে ইংরেজ রোমান্টিক কবিদের মতো সেনসুয়াস আবেদন হয়তো ছিল, কিন্তু ইংরেজ কবিদের চেয়ে তাঁর আন্তরিকতা ও ব্যাকুলতা যে আরো তীব্র, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধ্বনি-মাধুর্যে ও চরিত্র-নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীমূলক কবিতাগুলোর গভীর আবেদন রয়েছে। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদে’র মতন সংলাপ-কাব্য বিশ্বসাহিত্যেই দুর্লভ।
রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, শেকসপিয়ার বা ভিক্টর য়্যুগোর মতো প্রতিভাদের সৃষ্টি-ক্ষমতা অনেক ব্যাপক হয়। তাঁরা নিছক কবির মতন লাজুক, নিভৃতচারী হন না, হন দারুণ বাস্তবতা জ্ঞানসম্পন্ন, পরিশ্রমী, ভোগী, অণু থেকে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে কেতূহলী। সাহিত্য ছাড়াও আরো অন্য অনেক দিকে ছড়িয়ে থাকে তাঁদের আগ্রহ। গ্যেটে যেমন বহু রমণীচর্চা করেছেন, তেমনই গবেষণা করেছেন গাছপালা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথেরও বান্ধবী ও অনুরাগিণী-ভাগ্য ঈর্ষণীয়। তিনি ছবি এঁকেছেন, ব্যবসা করেছেন, সারা দেশের বিবেক-প্রতিভু হয়েছেন, একটি সাধারণ ছোট্ট বিদ্যালয়কে পরিণত করেছেন মহীরুহে। যেকোনো ভাষায় এ রকম একজন লেখকের আবির্ভাব প্রায় অলৌকিক ঘটনা।

৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, ২১ ভাদ্র, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ – ২৩ অক্টোবর ২০১২ বিংশ শতকের শেষার্ধের এক জন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিস্টোব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক ভাবে পরিচিত ছিলেন। এই সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক” ও “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টোব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টোব্দে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নীললোহিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্বা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনিটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনিতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তাঁর বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত চিরবেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশি দিন টেঁকে না। তাঁর বাড়িতে মা এবং দাদা বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত সফল মানুষ কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিষ্পৃহ একাকী জীবন যাপন করেন।
২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর দেহ দাহ করা হয়।