আজ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে লিখতে বসেছি এই চিঠি। সব যেন মনে হচ্ছে সেদিনের কথা ! মনে পড়ছে সেই দিনটা! সেই যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি লিপিদিদির বিয়েতে। আমারমামার মেয়ে, লিপিদিদি। বরের পাশে বসেছিলে তুমি। জামাইবাবুর খুব কাছের বন্ধু এটুকুই শুধু বুঝতে পেরেছিলাম আর বুঝেছিলাম আমি কেমন যেন মোহাবিষ্ট হয়ে আছি। তুমিকে, কোথায় থাকো, কি করো কিচ্ছু না জেনেই তোমাকেআমার মন প্রাণ সব সবটুকু সঁপে দিয়েছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, একেই কি বলে প্রথম দর্শনে প্রেম?
আমার মামার বাড়িতে আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে এই প্রথম বিয়ে। আমরা সব মামাতো পিসতুতো ভাইবোনরা একসঙ্গে হয়েছিলাম, আড্ডা আর হৈ চৈ চলছিল সাতদিন আগে থেকে।সাজগোজ, ঠাট্টা ইয়ার্কি সবেতেই আমার বড় উৎসাহ ছিল। কিন্তু তোমায় দেখার পর আমার সব কেমন যেন উবে গেলো, কি এক অজানা ভালোলাগায় মন ভরে ছিলো। তুমি কে, তোমার আমায় ভালো লাগবে কিনা এসব মাথাতেও ছিল না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলছিলাম আমি।
মফস্বলের সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে আমি. ছোটবেলায় একটু সেলাই ফোঁড়াই আর হারমোনিয়ামে প্যাঁ প্যাঁ শেখানো, তারপর টেনেটুনে বি এ পাস করতেই তাড়াতাড়ি ছেলে দেখে শুভক্ষণে শ্বশুর বাড়ি প্রেরণ করে কর্তব্যের দাঁড়ি টানাই ছিল আমার পিতৃমাতৃকুলের মেয়েদের প্রতি মনোভাব।আমার ক্ষেত্রেও তাই চলছিল। লিপিদিদির পরেই আমার টার্ন সব্বারজানা ছিল। তাই নিয়ে মজা ঠাট্টাও চলছিল সমানে।
বাসর নিয়ে আমাদের জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছিল প্রায়একমাস আগে থেকে। কে কি গান গাইবে, কে কি ভাবে জামাই কে জব্দ করবে এসব নিয়ে মহাভারত রচনা করে ফেলেছিলাম আমরা। উদ্যোগ আমারই বেশি ছিল কিন্তু বাসরের সময় যত এগিয়ে আসছিলো আমার গোটা শরীর যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠছিলো। বাসরে নিশ্চয়ই তুমি থাকবে এই ভাবনায় পা আমার আর সরছিল না।
যেতে অবশ্য হয়েছিল। ভাইবোনেরা কি ছাড়ে? মাথা ব্যথা ইত্যাদি নানান অজুহাতের একটাও ধোপে টিকলো না। চুপচাপই বসে ছিলাম বাসরে গিয়ে। প্রথম দিকে আমার মামা মাসি মামীরাও ছিল কিছুক্ষণ গান টান হবার পর জামাইবাবু আলাপ করালেন তোমার সাথে সবার। তখনই জানলাম তুমি জামাইবাবুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এয়ারফোর্সে আছ। অনেক গুরুদায়িত্ব তোমার ওপর তবুও তুমি ছাড়া জামাইবাবু আসবেই না বিয়ে করতে। তাই অনেকদিন আগে থেকে তোমার সাথে কথা বলে তবে তাদের বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে। যদিও তুমি বলেছিলে এমার্জেন্সি হলে তোমার আসা হবে না কিন্তু পেরেছিলে তাই জামাই বাবুর আনন্দের শেষ নেই।
আমার কল্পনা তখন ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে কোথায় কোনআকাশে। তুমি তখন সত্যি আমার কাছে কল্পলোকের রাজপুত্তুর! পক্ষীরাজ চড়ে ঘুরে বেড়াও দেশ থেকে দেশান্তরে!
কতক্ষন অন্যমনস্ক হয়েছিলাম মনে নেই। সম্বিৎ ফিরে পেলাম লীলা, আমার ছোট বোনের কনুইয়ের ধাক্কায়। তাকিয়ে দেখি তুমি তাকিয়ে আছো। কিছু ভাববার আগেই তোমার প্রশ্ন
আপনি তখন থেকে চুপচাপ কেন? বাকিদের তো কথার শেষ নেই! আপনি বুঝি খুব শান্ত?
জানিনা কেন তুমি তখন আমায় নিয়ে পড়েছিলে।পরে তোমাকে অনেক প্রশ্ন করেছি এই নিয়ে, তুমি জবাব দাওনি শুধু মুচকি মুচকি হেসেছো।
বাকিরা হাঁ হাঁ করে উঠলো, কি জানি বাপু এখন হঠাৎ ও এতো চুপ হয়ে গেলো কেন? এমনিতে তো মুখে খৈ ফোটে!
আমি তখন আমার উপহারটা বের করলাম লিপিদিদি আর জামাইবাবুর জন্যে। ওদের দুজনের আলাদা আলাদা ছবি আমি গ্রাফ পেপারে ফেলে কাপড়ে ক্রস স্টিচ করে ছিলাম, ওই একটা কাজে আমি বড় পটু ছিলাম। সবাই দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। অনেকেই অবশ্য জানতো সুঁচের কাজ আমার বড় আদরের। কিন্তু তোমার চোখের সেই বিস্ময় আজ আমার চোখে ভাসে।
আপনি? আপনি করেছেন এই কাজ? সত্যি সত্যি? এতো গুণ আপনার?
আমার মনের সব ক’টি কমলদল পাপড়ি মেলেছিল তখন!
কদিন বাদেই অষ্টমঙ্গলায় এসেই লিপিদিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বাব্বা! তোর পেটে পেটে এতো! কি করে বশ করলি আমার বরের বেস্ট ফ্রেন্ড টা কে?
আমি তো লজ্জায় দিশাহারা! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! ভগবান এতো সুখ আমার জন্যে রেখেছিলেন? বিয়ে হয়ে গেলো!
মায়ের একটু আপত্তি যে ছিল না তা নয়। ঠিক আপত্তি নয়, অজানা শঙ্কা! জামাই বিমান সেনা বাহিনীতে! কি আছে মেয়েটার কপালে? মায়ের মন তো!
কিন্তু তোমার পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়ে আর তোমার মধুর ব্যবহারে মায়ের মন ও স্নেহে সিক্ত হয়ে গিয়েছিলো!
চলে এলাম দিল্লিতে! বার কয়েক মাত্র কলকাতায় আসা যার জীবনের দৌড় ছিল সে এসে পড়লো রাজধানীতে। অচেনা শহর, নতুন বাসা আর কাছের মানুষটি। সময় বয়ে চললো তরতর করে।
এখন দেশে যুদ্ধ টুদ্ধ নেই। তাই মনে অহেতুক ভয় ও নেই। কাজে যাওয়া আসা তোমার আর আমার রান্না ঘরের কাজ আর একটু আধটু কাজ চালাবার মতো হিন্দি ইংরিজি জগা-খিচুড়ি মিশিয়ে দু’এক জন অবাঙালি বন্ধুদের সাথে বাক্যালাপ।
দুজনে দুজনকে নিয়ে এতটাই মজে ছিলাম যে খুব একটা বন্ধু-বান্ধবদেরও দরকার হয় নি I এর মধ্যে একবার লিপিদিদি আর জামাইবাবু ঘুরে গেলো দিল্লি। তুমি কি খুশি ! বারে বারে শুধু বলছিলে, লিপি, তুমি জানো না তুমি আমার জীবনে কি অমূল্য উপহার দিয়েছো! লিপিদিদি যাবার সময় বলে গেলো, তোর বরের কাছে শিখতে হয় কি করে ভালোবাসতে হয় !
দিল্লি থেকে চলে এলাম ব্যাঙ্গালোরে। সারাদিন ঘরে বসে থাকি। তুমি ব্যস্ত। আমার সময় কাটে না।একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম তোমায় যে আমার বড় সাধছিল বিএসসি পড়ার। কিন্তু বাড়িতে বলেছিলো ধুর , মেয়েদের মাথায় অঙ্ক ঢোকে না, তুই ডাহা ফেল মারবি।
দুদিন বাদেই দেখি তুমি বইটই নিয়ে এসে হাজির। আমি ও মন দিয়ে শুরু করে দিলাম কলেজ এডমিশন এর প্রস্তুতি।
তারপর একদিন হয়ে গেলাম সাইন্স গ্রাজুয়েট।কি খুশি তুমি! বিরাট পার্টি দিলে। যেন আমি মহাকাশ জয় করেছি! লজ্জায় মরি আমি তোমার আদিখ্যেতা দেখে!
মাস কয়েক পরে, তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই লিপিদিদির ফোন এলো, জানালো নতুন অতিথি আসতে চলেছে তাদের জীবনে।
ফোনটা কাটতেই তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদের গলায় বললে এবার আমাদের বাড়িতেও আসবে কচিমুখ, তাই না সোনা! আমি লজ্জায় আশ্লেষে মুখ লুকোলাম তোমার বুকে।
এর কদিন বাদে সকালে তুমি বেরোবে আমি ব্রেকফাস্ট করছি তোমার আর আর সুরজ ভাইয়ার আজ টেস্ট ফ্লাইং এর দিন। যুদ্ধে যে বিমান যাবে তার প্রাথমিক ওড়াটা তোমরা দেখে নেবে। আমি গুনগুন করছি, “না এখনই নয় , যাবে যদি যেও কিছু পরে।” তুমি গাইতে গাইতে বেরিয়ে গেলে, “যেতে মনচায় নাতো, তবু যাই যাই করে। “
ঘন্টাখানেক পর আমি স্নান করে চা নিয়ে সোফায় বসেছি, টিভিটা চালালাম, একি! এ কি দেখাচ্ছে এসব! তোমাদের প্লেন মিরাজ ২০০০ আকাশে উড়তে গিয়েই ভেঙে পড়েছে !
না! না! একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আমার মুখথেকে ! আর তারপর সব অন্ধকার !
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি ! চারপাশ তাকালাম , তুমি নেই ! চোখ বুজলাম, না না আছো তো তুমি, বলছো আমায় , ওঠো সোনা ! আদর করছো আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে !
টিভি ক্যামেরা, সাংবাদিক, আত্মীয় স্বজন, ক্যামেরার ঝলকানি! এ কোন আমি! কেন কেন এতো প্রশ্ন? কি জবাব দেব? আমার মনের ভাব? কি অবস্থায় আছি আমি!
কেন কেন বলবো? কে তোমরা? কেন বলবো আমার রাজপুত্তুরের কথা তোমাদের !
সন্তানহারা তোমার মায়ের শূন্য চোখের দিকে তাকয়ে চোয়ালশক্ত হলো, মন করলাম দৃঢ়! আমাকে প্রশ্ন করার লোকেদের প্রশ্নবাণ দিলাম ছুঁড়ে!
আর কত? কত? কত মায়ের কোল খালি হবে? আর কতস্ত্রীর স্বপ্ন ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে তোমরা?
সাতমাস কেটে গেছে তারপর! নাকি সাতশ বছর? না কি সাতযুগ? জানি না!
ঠোঁট ফুলছে তো তোমার! সাত মাস পর চিঠি লিখতে বসেছি বলে তাই তো?
কি করবো বলো গত পাঁচ মাস যে নিঃশ্বাস নেবার ও সময় ছিলনা!
আজই তো Service Selection Board (SSB) এর রেজাল্ট বের হলো।
পেরেছি গো আমি পেরেছি! আমি আজ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে।
তুমিই যে আমাকে প্রাথমিক ভাবে তৈরি করেছিলে সোনা। তখন কি জানতাম এটা আমার এতোবড়ো চাবিকাঠি হবে! পরীক্ষায় বসার প্রাথমিক শর্ত ছিল যে সেটা !
আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে জানো? আর কটা মাস সোনা তারপরই আমি উড়বো আকাশে!
তোমার চোখ দিয়ে আমাকে যে দেখতেই হবে আমাদের এই নীলচে মায়াবী পৃথিবীটা কে! ওকে যে আমি কিছুতেই ধূসরহতে দেব না গো !
শুধু তোমাকে ই ভালোবেসে
তোমার পাগলী
কিছুকথাঃ এই চিঠির অনুপ্রেরণা শ্রীমতি গরিমা আব্রল এর জীবন থেকে। গরিমা, স্কোয়াড্রন লিডার সমীর আব্রলের স্ত্রী। সমীর প্রাণ হারান মিরাজ ২০০০ এর টেস্ট ড্রাইভ করতে গিয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পাঁচমাসের মধ্যে গরিমা তাঁর ইন্টারভিউ শেষ করেছেন বারাণসী থেকে। খুব শিগগিরই আকাশে উড়বেন গরিমা।