| 29 মার্চ 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

অমিতরূপ চক্রবর্তী’র একগুচ্ছ গদ্য কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

দাঁত

কতদিন পর আবার একই সরলরেখায় আমাদের মুখ চোখের সুদূর আর ঠোঁটের গন্ধ। কতদিন পর আবার আঙুলে আঠা আঠা শীত। কতদিন পর আবার ঘামের বিন্দুরা উড়ে এসে আমাদের কপালে গলার সামর্থ্যে আর নিভে যাওয়া চুলের কুণ্ডে বসছে। কতদিন, কতদিন পর। না, আজ কেউ কারো কঙ্কাল ছুঁয়ে দেখব না। শেকল থেকে খসে পড়া হাতের মুঠিকে কপট বলে সন্দেহ করব না। অলীক এই ডিনার টেবিলের ওপরে স্মৃতিকে উপজীব্য করে যে বলশালী গাছটি দাঁড়িয়ে উঠেছে, যার ডালপালায় আলোর লালা দৈববৃষ্টির মতো ঝুলে আছে- তাকে এক পা দুমড়ে ধর্মীয় শৈলীতে অভিবাদন জানাব। ধরে নিই আজ তোমাকে ঘিরে ফুলের প্রকাণ্ড পাপড়ির মতো কুটকুটে সুন্দর পোশাক। আমার কাধে কনিষ্ঠার ওপরে একটি দেশের ভার। ধরো আমি পা বাড়িয়ে তোমার পায়ের আঙুলকে সেভাবে আর খুঁজে পাব না। শুধু বুঝতে পারব কতগুলি কাষ্ঠল নায়ক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। কতগুলি কল্পবৃক্ষ সেখানে মজবুত জ্যোৎস্নার পিলারের মতো তাদের অত্যন্ত নিকটে নেমেছে। কতদিন পর তুমি তোমার মোজা পরা পায়ের পাতা আবছায়ায় দিকে সরিয়ে নেবে। পোশাকের নীচে আঁটোসাঁটো স্তন থেকে ফাট ধরা স্তন সরিয়ে নেবে। কতদিন, কতদিন পর আবার ঈষৎ অপবিত্র একটি জলধারা এসে চুপ করে শুয়ে থাকবে মূল জলধারাটির পাশে। মাঝে মাঝে তার কাতর নিঃশ্বাস পড়বে আর দপদপ করে উঠবে সব বিস্ফারিত বাতি, আজীবন থমথমে হয়ে থাকা বিদ্যুতের তার

মুখের খাদ থেকে কুয়াশার মতো তাল ধরা হাসি উঠে আসবে। এমন সব সমূহ সমূহ হাসি যাদের কোনও অভিষ্টই নেই। তবু তারা দলে দলে উঠে আসবে। ধোঁয়া ধোঁয়া একটি আবরণও গুঁজে দেবে চারপাশে। এই আবরণের বাইরে যারা, যেসব থামের মতো সব বাড়িঘর বা স্ট্যাপ ঢিলে হয়ে যাওয়া ব্রা-এর মতো সব বহুখোদিত বারান্দা বা গোল রুটির মতো চা-দোকান বা শস্যপোকার মতো অজস্র, হাজারে-বিজারে গাড়ি দেহ বা দেহাতীতের সব কনভয় বা ভারাটে রিকশা- সেসবের কুহর থেকে এই ধোঁয়ার আবরণকে এক মৈথুনে আত্মহারা বেলুনের মতো মনে হবে। মনে হবে যেন সুতো ছেঁড়া কোনও শুভ্র স্বপ্ন অথবা আকাশপ্রদীপ- যা নাগালের খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মন্থরভাবে। ভেতরে একই সরলরেখায় তোমার আমার নিষ্পলক চোখমুখ। শ্বাসযন্ত্রের টিকটিক করা প্রপিতামহসম ঘড়ি আর ওৎ পেতে থাকা দু দিকের একপ্রস্থ করে শিকারি আঙুল। না, আজ আর আঙুলকে শিকারি বলব না। তাদেরকে মনে করি সমুদ্রের কাছাকাছি এসে পড়া দুঃখিত সাদা পাথর অথবা বালিতে আক্রান্ত কোনও নৌকার দেহাবশেষ। আহ! আকাশের ছিদ্র দিয়ে কীসব বিষ্ময়কর নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে, দ্যাখো। তাদের কপালে খুব চেনা তিলক। তিলকের শুঁড় ছড়িয়ে পড়েছে নাকের পিঠেও। অলীক ডিনার টেবিলে স্মৃতি ফুঁড়ে বা স্মৃতিকে উপজীব্য করে যে বলশালী গাছটা চতুর্দিকে বাহু মেলে দাঁড়িয়ে আছে- তার কালো চকচকে পাতার ফাঁকেও, শেকড়ে উপজীব্য স্মৃতির ভেতরে যে দীর্ঘ সিল্কের শাড়ি আর অন্তসারশূন্য পাজামা- সেসব, সেসবের মতো 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

সাঁকো

একটি ছোট্ট কবিতাকে আদর করেই আমরা ঘুমোতে যাব। বললাম ঠিকই ঘুমোতে যাওয়া, কিন্তু আসলে তুষার পেরিয়ে বহু, বহুদূর দেশে চলে যাওয়া অথবা নৃত্যমান কোনও পাহাড় পেরিয়ে। ছোট্ট কবিতাটি শিশিরের মধ্যে শুয়ে থাকবে। গমের মতো উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়বে ওর। ও জানতেও পারবে না আমরা ছিঁড়ে গিয়ে কত ভূমণ্ডল পেরিয়ে চলে গেছি। ওর কাছে শুধু আমাদের ম্লান জামাকাপড়গুলি পড়ে আছে। কারও লম্বা বিধুর রেললাইনের মতো হাতা, কারও খাসীর মাংসের মতো ঢলঢলে পিঠ। ছোট্ট কবিতাটি এসব কিছুই জানবে না। শুধু অকাতরে ঘুমোবে। নশ্বর ঘুম ওকে দিয়ে তাই- ই করিয়ে নেবে। কেননা ওর পুষ্ট হওয়া চাই। বলশালী ডালপালা ছড়িয়ে দেওয়া চাই। সেখানে পরগাছা রক্ষার মতো পরিসর থাকা চাই। হন্তারক প্যাঁচা কখনও বিশ্রাম নিতে আসবে- তারও পরিবেশ বা সবুজ কুহক থাকা চাই

আমরা তখন অনেক হিমযুগ, অনেক প্রস্তরযুগ দূরে। প্রচলিত ভাষা বা প্রবাদ থেকেও দূরে। লজ্জা শব্দটি যদি আদিমতম হয়- তবে তা থেকেও দূরে। নক্ষত্র ধরা আকাশের আগে। নীলাভ ধূসর জংগলের আগে। হয়তো বিবর্তনের একটি অংশে- যখন আমাদের ঠোট চোখ আর নাকের তুলনায় বড় আর মোটা। স্তনের চারপাশে পুড়ে যাওয়া ফসলের মতো চুল। এভাবেই আমরা নিতম্ব পাহারায় রেখে ঘুমোব। অ্যাতো সহস্র হাজার পরেও এই, বিশেষত এই নিয়মটি কি পাল্টেছে? চেনা দেয়াল, চেনা ঘর অথবা লিঙ্গেরিক আসবাবের মধ্যে কেউই ঘুমোয় না। অবশ্য মাকড়সার জালে ঢাকা কবরও একটি বিকল্প বা সেমেটিক কোনও নদীপাড়, যার ঝোপে জংগলে অদ্ভুত আলোর সব পতঙ্গ, কেউ তীব্র মাংসাশী। আমাদের উরু দিয়ে চেপে রাখা লিঙ্গ আর যোনিছিদ্রের খোঁজে খুব, খুব নীচু দিয়ে ওড়ে

অন্ধকার ও শূন্যতাকে ঈশ্বরও ভয় পান। এ কথা মানুষ দেবদারু গাছের সমান হলে জানে। তখনই সে প্রকৃত জ্ঞানফল ছিঁড়ে খায়। তার আগে যা- সেসব মিথ। তখনই সে বোঝে ছিঁড়ে যেতে হবে। বোঝে সে আসলে একটি লঞ্চের চালক। যে লঞ্চটি নিয়ে সে একবার ওপারে যাবে এপারের বর্জ্য রাখার জন্য আবার এপারে আসবে ওপারের বর্জ্য নিয়ে। লেখনিতে একেই আলোকপ্রাপ্তি বলে। যা নিয়ে তর্ক হয়, যুদ্ধ হয় অথবা বনমানুষের মতো কাম। বিছানায় যে ঘাস, তার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠতে শতক শতকও পেরিয়ে যায়। ঈশ্বরের তর্জনী থেকে একরকমের ঘোড়া ছুটে আসে- এর নাম ভোর। অভিভাবকদের সান্ত্বনা দিতে গোলাকার রোদ ওঠে। ছোট্ট কবিতাটি একটি সাঁকো পেরিয়ে এসে দ্যাখে আমরা ভুল জামা গায়ে গলিয়ে আগের মতোই আছি। শুধু বিধুর রেলপথের মতো হাতায় তোমাকে  প্রতিবন্ধীর মতো লাগছে আর খাসীর মাংসের মতো পিঠে আমাকে শহিদের মতো

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

খর্ব

একবার টোকা দিলে তার ধ্বনি প্রতিধ্বনিগুলি আমার ভেতরে দূরদূরান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ততক্ষণ আমার শুধু বরফের মতো নিঃশ্বাস পড়ে। পড়ে, নাকি খাদে ঝাঁপিয়ে পড়া জলপ্রপাতের ধোঁয়ার মতো উড়ে যেতে থাকে। কিছু না- এমন বললে পৃথিবীর সব নশ্বরতা, সব মেটেরিয়ালিটি অর্থ হারায়। শুধু তাদের আলোয় সাজানো কঙ্কালেরা বেঁচে থাকে। অগ্রজ কবিতার মতো হয়তো ফুটপাত বদল হয়। একটি লেন ছেড়ে আরেকটি লেনে পৌঁছতে গায়ের রঙ পাল্টে যায়। চোখের সুড়ঙ্গে দৃষ্টি পোশাক বদলে অন্য চেহারায় ফিরে আসে। সেই দৃষ্টির সামনে মাটি ফুঁড়ে জন্মায় অন্য উদ্ভিদ, অন্য মানুষেরা। তারা ট্যুর বোঝে। সুষ্ঠ ব্যয় বোঝে। সূর্যের আলোয় ক্ষতিকর প্ল্যাঙ্কটন থাকে- তাও বোঝে। দুধ সাদা বিছানায় কখন পরমহংসের ছায়া পড়ে- বোঝে তাও

আমি যে তোমাকে বুঝি না, তার সহস্র প্রমাণ প্রতিদিন গাছের পাতায় লেগে দোলে। সামনের চেয়ারে তুমি আত্মসমর্পণ করে বসে থাকলেও আমি শুধু ফাইবারের চেয়ারটিকেই দেখি। তার পিঠে পাঁজরের মতো জালক। রক্তবিন্দুরা হয়তো অন্য কোনও শুস্কতায় উড়ে গ্যাছে। নিতম্বের বদলে যেন কতগুলি কাঠের পাটাতন, যেমন কোনও চতুষ্পদ ফরেস্ট বাংলোয় থাকে। সেট্রোনিলার ঝাঁঝ যেগুলোর ওপরে রাজত্ব করে। চশমা খুলে আবারও যদি চশমা পড়ি- দৃশ্য সেই একই। অত্যন্ত বিনীত একটি প্রৌঢ় কমলা রঙের চেয়ার, যে কারও সাহায্য পেলেই স্থানবদল করতে পারে। এই শূন্যতার কথা ভাবলেই যেন স্ত্রী-মৃগের মতো শরীরে শীতবোধ উঠে আসে আমার। হয়তো অদৃশ্য কোনও আঙুল থেকে

একটি মৃত্যুর কবিতায় এমন কয়েকটি লাইন ছিল- চাঁদ উঠে থাকবে আকাশে/ না- কামড়ানো পাউরুটি পড়ে থাকবে/ খোলা পৃষ্ঠার একটি বই পড়ে থাকবে জানালার কাছে। মৃত্যুবোধ আমাদের ধমনীর গায়ে বাসা বাঁধা অর্বুদের মতো। নাম মৃ্ত্যু, অথচ আমাদের সঙ্গে আমাদেরই মতো সাধারন জৈবধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকে। ওদেরও প্রেমিকা থাকে- যে কিছুদিন পর ভেঙে যায়। স্ত্রী থাকে, কূট অন্ধকারের যোনি নিয়ে। বুদবুদের মতো সন্তান হয়। চাঁদের আলো একদিন ভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে গলে আসতে গিয়ে বেড়াল হয়ে নিঃশব্দে লাফিয়ে নামে। গোড়ালির শেষে সূর্য ডোবে। যেমন আমাদের হয়। জ্ঞানফলের ভেতরে এমনই ম্যাজিক রিয়ালিজমের শাঁস। সেদিক থেকে ভাবা গেলে আমরা সবাই যেন ঘোরের বলয়ে আছি। ধরো যেন পাশাপাশি রাখা সিনট্যাক্সের জলাধার। এদের সরিয়ে দেখলে তুমি আমি আর আমাদের সব পরিচিত পরিজনদের হলোউইনের মতো পাওয়া যাবে

আমাদের তিনটি ঘরের একটিও এখনও ঘুমিয়ে পড়ে নি। মা যে ওষুধগুলো খেয়েছে, তার ফেলে দেওয়া খোসাগুলো সবেমাত্র জ্যান্ত হল। আরেকটি ঘরের চৌকাঠে খুলে রাখা স্যান্ডেল এখনই চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে আসবে। আরেকটি ঘরে ব্রহ্মাণ্ডের অন্যমনস্ক লিঙ্গ এবার চৈতন্য ফিরে পাচ্ছে। এই যে অসংলগ্নতা- সেও তো কোথাও, কোনও রাস্তার শেষে সংলগ্ন হয়ে আছে। যেমন আমার বাবার বৃন্তচ্যুতির পর মা ভাবল, এমন কী কঠিন বাকিটা। কত ত্বকই তো খসে ঝরে পড়ে যায়। হাতের নাগালে একটা ঠাণ্ডা হ্যান্ড্রেইল তো আছে। তারপর একদিন রাতে চাদর ভেদ করে পা বেরিয়ে ছটফট করে উঠতেই মা বুঝল সেই বৃন্ত যে গাছের- তাতেই পা ঠেকে আছে

টোকা দিলে, একবার টোকা দিলে তার ধ্বনি প্রতিধ্বনিগুলি আমার ভেতরে দূরদূরান্ত অবধি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 

 

ভাঁজ

সাদা দেওয়ালগুলি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অক্লান্ত ফুলগুলি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুসফুস কেটে বাদ দেওয়া সব সিংহ রঙের জামাগুলি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি অভিযুক্তের মতো এই সমবেত দৃষ্টির মধ্যমণিতে বসে থাকি। পরস্ত্রীর মতো আমার আঁটি বাঁধা মজুদ শস্য। ঘাট, এবং জলের নীচে ভাঙা, পূর্ণ চাঁদ। অনেকে এভাবে বসে ব্লাউজের ফেটে যাওয়া কাঁধ সেলাই করেন। ছুঁচে ভর করে একটা দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করার পরও দেখা যায় আরও অনেকটা রাস্তা বাকি থেকে গ্যাছে। তখন চোখের কোলে হঠাৎ পিছল শ্যাওলা শুরু হয়। আমি আমার একটি পা দিয়ে অন্য পা-টিকে খুঁজি। ছলের মতো এই ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে দুর্জ্ঞেয় অন্ধকার। অনেক পুরনো ব্রহ্মাণ্ড ব্রহ্মাণ্ড পেরিয়ে আসা অন্ধকার। উইঢিবি গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশ ফেরার নামে নিজেকে ভাঁজ করে ছোট করে ফেলি। এতে আর তেমন কষ্ট হয় না। ছিঁড়েও যায় না কিছু। আমি ছোট করে ফেলি, নিজেকে ছোট করে ফেলি। এইখানে এসে কেন যে আমার সীমান্তরেখার কথা মনে হয়। কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া কাঁটাতার। মরচে ধরা তীক্ষ্ন শীত। কোথাও আগুন জ্বলছে বিষণ্ণ রহস্যের মতো। কেন মনে হয়? আমার অবচেতন কি কাঁটাতারে ভয় পায়? সীমান্ত পেরোনোর কোনও ট্রমা তার এ জন্মেও আছে? বা আমিই কি কখনও অজ্ঞাতে কোনও সীমান্তরেখা পেরোতে গিয়ে মরে গেছি? তুমি কি কখনও নিজের মধ্যে রাতচরা পাখির কর্কশ ডাক শুনতে পেয়েছো? একটি ঘুমের গ্লেসিয়ার তখন আরেকটি ঘুমেরর দিকে যাচ্ছে 

সীমান্ত পেরিয়েছিল আমার ছায়ার মতো পূর্বপুরুষ। এদেশে এসে তাঁরা কিছুদিন ভূত হয়েছিলো। তারপর আবার মানুষ। তারপর ক্যান্সারের মতো তাঁদের সংসার শেকড় ছড়িয়েছে। তারই কোনও একটা প্রান্তে আমি ফুটেছি। তুমি অন্য একটা সংসারের শেকড়ে ফুটেছ। একটা ইচ্ছাহীন যৌনতার পর এমনই মনে হয়। একটানা মনে হয়। মনে হয় তোমার আমার শেকড়ের উৎস আলাদা। এই উৎসে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কাঁটাতার পেরিয়েছিলেন আলাদা আলাদা উপায়ে। ইচ্ছাহীন যৌনতার পর গায়ে খুব মাটি লেগে যায়। সেসব তখন ভেঙে ভেঙে ঝেড়ে ফেলতে হয়। ইচ্ছাহীন যৌনতা পৃথিবীর অতিকায় সমুদ্রগুলোর মতো স্থানদখলকারী। পরস্ত্রীর মতো আমার আঁটি করা শস্য সব আলগা হয়ে যায়। পরপুরুষের মতো তখন তুমি স্থির বাতিঘর হয়ে জেগে থাক। আমার যোনি উপছে অশ্রু বেরিয়ে আসে। এও তো নামান্তরে রক্তই। সাদা দেওয়ালগুলি, অক্লান্ত ফুলগুলি বা ফুসফুস কেটে বাদ দেওয়া সিংহ রঙের জামাগুলির গায়ে তখন সহসা ধুলোঝড় আসে। কাঁটাতারের এ প্রান্ত থেকে কেউ অমানুষিক চিৎকার করে, অন্য প্রান্ত তার প্রতিধ্বনি ফেরায়। দেখতে দেখতে কত প্রাচীন আমবাগান, শ্বেতাম্বর জ্যোৎস্না পেরিয়ে এলাম আমরা। আঁকড়ে ধরা আঙুল ঢিলে হয়ে গেল। ব্ল্যাঙ্কেটের নীচে যে দুর্জ্ঞেয় অন্ধকার, চকচকে ফলার মতো এক স্বর্গবিতাড়িত নদী চলে এল সেখানেও। দু-পাড়ে দুটো উর্বর দেশ তৈরি হল। রাষ্ট্রপ্রধানদের আলাদা আলাদা পতাকা তৈরি হল। কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া কাঁটাতার আবার কুয়াশা থেকে বেরিয়ে বয়ে চলল উঁচু-নীচু মাইলের পর মাইল   

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

যীশু

আবার একটি কালো চাঁদের ছায়া কেমন অলক্ষ্যে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কারও কারও রঙিন প্রাণবন্ত ঠোঁট দেখলে মনে হয় এই উদ্দিষ্ট দিনটি ওরকম সুন্দর প্রান্ত ঘেরা ঠোঁটদুটির মতোই। যেন সেটাই আজকের দিনটির অরো। কালো চাঁদ আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আমাদের আলোকিত করে। আমাদের পুরুষ ও স্ত্রী চোয়াল, পত্রশিরার মতো সব স্বাধীন বলিরেখা, নখের ধার- সব কালো হয়ে ওঠে। এমন আলোকিত দিন অথচ দুজন ক্রীতদাসের মতো এই দিনটির নাভির ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। অথবা যেন রঙের শ্রমিক, হাতে অস্ত্রের মতো ব্রাশ যা দিয়ে যেখানে যা কিছু দৃশ্যমান- সব কালো করে দিতে হবে। এইসব দিনে তাঁবু নিয়ে দলবদ্ধ স্মৃতিরা আসে উৎকীর্ণ পাহাড়, রেভাইন পেরিয়ে। তাদের মুঠোয় আরও সব বীতকাম স্মৃতি। তাদের কোমরে তাবিজ। ক্ষুদ্র ফলের মতো শিশ্ন। আমার জীবনে তেকোনা কোনও শরীরের আবির্ভাব হয় নি। হয়তো তোমার জীবনে কোনও দীর্ঘাঙ্গ দৃঢ় কণ্ঠের আওয়াজ ফুটে ওঠে নি। তাই শুধু আত্মরক্ষার জন্য এ অন্যকে হয়তো আঁকড়ে ধরেছি। যা আপাত অলংকৃত, ভেতরে প্রতিহিংসার মতো। তাই নয়? এই যূথবদ্ধ প্রশ্ন প্রতিটি শীতের শুরুতে হানা দেয়। কত শস্য নষ্ট হয়ে যায়। ধানখেতে বুনো গরম হলুদ লুকিয়ে থাকে। তাই কি ব্রাশ টেনে সব দৃশ্যমানতা কালো করে দেওয়া? কালো চাঁদটির সঙ্গে কত নক্ষত্রযুগের সম্পর্ক আমাদের?

না, কোনও মনোরোগের হাতে অ্যারেস্টেড হয়ে যাই নি। এই তো বাথরুম থেকে মুখে জল দিয়ে ফিরতে ফিরতে সুদূর একটি চায়না ল্যাম্পের মতো বলে গেলে ‘তুমি একটি পশু।‘ আমি তখনই লক্ষ করে দেখলাম আমার দুই হাতের পেটের দিকটায় এখনও তুলনামূলক ফর্সা রঙ বেঁচে আছে। কনুইয়ের ভেতরের ভাঁজ থেকে অনেকরকম শিরা গাছের ঝুরির মতো নেমে নিঃশব্দ করতলে পৌঁছেছে। জঙ্ঘায় মানুষের যেমন থাকে, তেমন নাইলনের মতো বৃত্তাকার লোম। কোমরে দুরারোগ্য সংসারী মেদ। মাথার ওপরে তখনও তোমার নাড়িয়ে যাওয়া লাল চায়নাল্যাম্পটি দুলছে। ঠিক এ জায়গা থেকেই কি কালো চাঁদটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের শুরু? কালো চাঁদের তাহলে কি সব মনে আছে? পর্দার পর পর্দা টানা সব নক্ষত্রযুগের কথা? স্মৃতিরা ঘনিষ্ঠ গাছের কাছে তাদের ছোট ছোট তাঁবুগুলি টানিয়েছে। ভেতরে স্টোভের আগুন। পেঁয়াজের তীব্র চিৎকার ও গন্ধ। কারা আছে তাঁবুর ভেতরে? পরিচিত মুখেরা যদি অন্য মুখের মুখোশ পরে আসে, চিনতে পারব না। তবে হয়তো তাদের নড়াচড়া অথবা কথার ধরন দেখে মনে হবে এ আমাদের প্রথম চুম্বনটি অথবা গলার ঘাম অথবা সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরা পরস্পরের আঙুল জাহাজডুবির আগে। অথবা গ্রীলক্রাফ্টের বারান্দায় মাঝে মাঝেই যাকে চোখে পড়ত, কলসগলার ওপরে ফুটে থাকা মুখ- যার মাথায় কাঁটার মুকুটের মতো অসংখ্য সব চোখ ছিল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত