লোকটা মারা গেছে। হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ শেষে পক্ষপাতমূলকভাবে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর দিকে, মাটির দিকে।
এখন সে শুয়ে আছে নিজের বাসার ড্রয়িংরুমের মেঝেতে কার্পেটে বিছানো একটা চাদরের ওপর। লোকটার শরীরটাও একটা চাদর দিয়ে ঢাকা। শুধু মুখটা খোলা। বাড়ির সব লোক তার চারপাশে জড়ো হয়ে আছে। সবার মুখ থমথমে, চোখ অশ্রুসজল। শুধু তার ঘনিষ্ঠতম দুই নারী—তার বউ এবং মেয়ে বসে আছে তার শরীর স্পর্শ করে। তারা ডুকরে উঠছে একটু পরপর আর সেই বেদনার শব্দে আরো একটু ভারী হয়ে পড়ছে ঘরের বাতাস।
লোকটার পায়ের দিকে বসেছিল তার বউ। কাঁদতে কাঁদতে ঝুঁকে পড়ছিল লোকটার উরুর ওপর। ক্লান্তিতেই হয়তো বা। কয়েকদিন ধরে হাসপাতাল আর বাসায় দৌড়াদৌড়ি করলে ক্লান্তি তো আসেই। এখন লোকটার মৃত্যুতে সেই ক্লান্তি আরো ঘন হয়ে বৃষ্টি নামিয়েছে যেন। আর সেই বৃষ্টির ধারাতে পৃথিবীর গাছপালার মতো, কাকের মতো, গাভীর মতো মাথা নীচু করে নুয়ে পড়েছে তার বউ। অথবা হয়তো স্বামীর পায়ে মাথা রেখে ক্ষমা চাইছে মৃত্যুতেও লোকটার সঙ্গী হতে পারল না বলে। নিজের এই স্বার্থপরতার প্রকাশে লজ্জায় হয়তো অধোবদন সে। বিবেকের ধর্মাবতারের সামনে এখন পাপ স্বীকার করা অপরাধীর মতো সে নুব্জ্য এবং মলিন। কিংবা হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছে।
এই জিরিয়ে নেওয়ার সময়ই বউ হঠাৎ খেয়াল করলে লোকটার উরুর একটা মাংসপেশী মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছে। যেন মৃত্যুর হিম শীতলতার মধ্যে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়েছে ওই পেশীটা, এখন মুক্তি চাইছে, দাপাতে চাইছে, আবার ছুটতে চাইছে জীবনের গরম রাস্তায়। ব্যাপারটাতে চমকে উঠল বউ। তারপর ঘটনাটা একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করার জন্য কান্না থামিয়ে নীরবে পরের কম্পনটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল সে। এবার ঘটনাটা ঘটলেই এমনভাবে চেপে ধরতে হবে যেন ভিতরের সব কথা, সব গুপ্ততাকে প্রকাশ করতে বাধ্য হয় পেশীটা। হড়বড় করে জানিয়ে দেয় তার এই কেঁপে ওঠার অর্থ।
কিছুক্ষণ পরে যথারীতি আবার কেঁপে উঠল পেশীটা। সাথেসাথেই বউ তার স্পর্শক্ষমতার সবটুকু দিয়ে বুঝতে চাইল ব্যাপারটাকে। তার মনে হলো লোকটা মরেনি। সাথেসাথেই প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠল সে। মেয়েকে জানাল তার বাবার জীবিত থাকার সম্ভাবনার কথা। মেয়ে চমকে উঠল মায়ের কথা শুনে। ঘরের বাকিরাও বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে ঝুঁকে এলো খবরটাকে ঘিরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। আর সেটা শুনেই লোকজনের মধ্যে জেগে উঠল ধর্মীয় আবেশ। সৃষ্টিকর্তার অপার অলীক লীলার ব্যাখ্যা ও তার মহিমায় গুরুজনেরা হয়ে পড়ল বিহ্বল। মধ্যবয়সীরা তাদের কাছাকাছি থেকে বোঝাতে চাইল তারাও বিধর্মী না। কেবল কিছু তরুণ তাদের যৌবনের তেজে ঘটনাটার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে পেল হাসপাতালের দোষ। তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল সেই ডাক্তারের ব্যাপারে, যে লোকটার ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছে। আস্তে আস্তে তাদের দলটাও ভারি হতে শুরু করল। মধ্যবয়স্করা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো ধর্ম আর যুক্তির ধাক্কায় টলমল করতে লাগল। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হলো হাসপাতালে গিয়ে ওই ডাক্তারের কাছে চাইতে হবে জবাবদিহি।
এমন সময় পাড়ারই একটি ছেলে জানাল তাদের এক ডাক্তার বন্ধুর কথা। অবশ্য সেটা জবাবাদিহি চাইবার জন্য না বরং মৃতদেহটাকে আরেকবার পরীক্ষা করার জন্য। উত্তেজিত জনতারও মনে ধরল কথাটা। তারা সাথে সাথেই অনুমোদন করল প্রস্তাবটাকে এবং ছেলেটাকে পাঠাল তার বন্ধুকে ধরে আনতে। ছেলেটাও উৎসাহে সজ্জিত হয়ে ছুটল এইরকম একটা বার্নিং ইস্যুর সাথে নিজেকে যুক্ত করার সুযোগ পেয়ে। এখন আর ঘাড় উঁচু করে দূর থেকে ঘটনাটাকে দেখার চরিত্রে তাকে অভিনয় করতে হবে না—এটা কি কম বড় কথা!
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল সেই ডাক্তার ছেলেটা। এরমধ্যেই সে বন্ধুর কাছ থেকে জেনে নিয়েছে বিষয়টার হিস্ট্রি ফলে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েই সে পরীক্ষা করতে শুরু করল মৃতদেহটাকে। স্টেথোস্কোপ, নাড়ি টেপা সব পদ্ধতিতেই ধরা পড়ল লোকটার মৃত্যু। ঠিক সেই সময়ই বউটা আবার চেঁচিয়ে উঠল পেশীর কাঁপুনিতে। আঙুল দিয়ে সনাক্তও করে দিল পেশীটাকে। অনভিজ্ঞ নবীন ডাক্তার বউটার চিৎকারে প্রথমে থতমত খেল। তারপর পেশাগত দক্ষতার কথা মনে পড়াতে পেশীর নড়াচড়াটা নিজের চোখে দেখবার জন্য বউটাকে সরিয়ে সেই জায়গায় বসল এবং লোকটার উরুর ওপর থেকে সরিয়ে দিল চাদরটাকে। এবার অপেক্ষা।
তারপর সত্যিই ঘটল ঘটনাটা। দেখা গেল তিরতির করে কাঁপছে লোকটার উরুর সামনের পেশী। নবীন ডাক্তার ভাবল, এটা হয়তো রিগর মর্টিস। তাই কতক্ষণ আগে লোকটা মারা গেছে এটা জানতে চাইল সে। উত্তর যেটা পেল, তাতে রিগর মর্টিসকে তত্ত্ব হিসাবে দাঁড় করানোটাকে বেশ কঠিন হয়ে গেল তার জন্য। এবার একটু ঘাবড়ে গেল সে। মনে করবার চেষ্টা করল মেডিকেল কেইস স্টাডিগুলিতে এমন কোনো অস্বাভাবিকতার কথা যেখানে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস সব স্তব্ধ হয়ে যাবার পরও পায়ের একটা পেশী কাঁপতে থাকে জীবনের উপস্থিতি প্রমাণ করতে। তার ঘাবড়ানোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে তার স্মৃতি বলল, এমন ঘটনার কথা সে জানে না। এবার কী হবে?
ঠিক তখনি প্যান্টের যে পকেটটাতে নিজের মোবাইল ফোন রাখে ডাক্তার, সেই পকেটের নিচে তারও পায়ের মাংসপেশীটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। আর সাথেসাথেই সে পেয়ে গেল সামনে থাকা সমস্যাটার সমাধান। সে বুঝে ফেলল পেশীর এই কাঁপাকাঁপির ঘটনা ঘটেছে মোবাইল ফোনের কারণে। প্যান্টের একই পকেটে নিয়মিত মোবাইল ফোন রাখলে ফোনটার বিভিন্ন ভাইব্রেশনের কারণে সংলগ্ন পেশীতেও তৈরি হয় বিক্ষোভ যা মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরেও অভ্যাসবশত দেখাচ্ছে তার স্বরূপ।
খবর নিয়ে সে জানল, মৃত লোকটারও অভ্যাস ছিল প্যান্টের পকেটে মোবাইল ফোন রাখার।