| 28 মার্চ 2024
Categories
পাঠ প্রতিক্রিয়া

সময়ের কানাগলিতে বন্দী শিবিরের দিকে নির্মোহ যাত্রা

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

 

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না। জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা; তার রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ, মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;

হুমায়ুন আজাদ ‘সেই অন্ধের মতোন যাত্রা’ সম্পর্কে আলোচনা করে পীড়ন করতে নিষেধ করেছিলেন বলেই কিনা জানি না আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতার অব্যবহিতকাল পরের অস্থির সময় চিত্রিত হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম। ’৭১ এ স্বাধীন ভূখন্ড অর্জনের পরপরই প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নতুনভাবে জাতি হিসেবে স্বাতন্ত্র্যতা অর্জনের। একপাশে যেমন ছিল খন্ডিত বাংলার অন্তর্দহন অন্যদিকে ছিল এ ভূখন্ডের স্বাতন্ত্র্যতার প্রশ্ন। এরপর শুরু হল যুদ্ধ পরবর্তী নানান প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসাবশেষের বিপরীতে লুটপাট, হত্যা, ধরপাকড়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র নিয়ে যে দেশের সংবিধান যাত্রা শুরু করেছিল সে দেশের মাটিতেই ঘটেছে মুজিব হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থানের মত হতাশাজনক ঘটনা। জাতির রক্তাক্ত পতাকা খামচে ধরেছে পুরোনো মৌলবাদ। জনগণ ভয়ানক সব অপারেশন দেখেছে স্বাধীন স্বদেশেই, যেখানে ট্রাকের নিচে পিষে ফেলা হয়েছে মানুষকে অবলীলায়। আবার, তাদেরই বাঁচানোর জন্য মহান সংসদে সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে লজ্জাহীনভাবে, খুনীরা দাপুটে গলায় বর্ণনা করেছে নির্মমতার। মানুষ দেখেছে সাংবাদিক, লেখকদের অবস্থা, দেখেছে তালেবান গণতন্ত্রের সক্রিয় কর্মকান্ড। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী এই সময়টুকু বিশেষ করে ’৭২ থেকে ’৯১ পর্যন্ত সময় আমাদের উপন্যাসে যেভাবে আসার কথা ছিল, তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত। এ সময় নিয়ে যে উপন্যাসগুলো সামনে এসেছে তাতে নির্দিষ্ট কন্টেন্টের যেমন মুজিব হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থান, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন নানা লেখায় উঠে এসেছে। তিতা হলেও সত্য এই যে, এই সময়ের তথাকথিত রাজনৈতিক উপন্যাসগুলো অধিকাংশই দলীয় গন্ধে বিভোর। তার চেয়েও বড় বিষয় হল সেগুলোকে উপন্যাসের ফর্মে ফেলে কতটুকু যাচাই করা যায়, সে ভিত্তিমূলও প্রশ্নবিদ্ধ।

 

ঐতিহাসিক কোন ঘটনা নিয়ে রচিত উপন্যাসে বা রাজনৈতিক উপন্যাসে ঔপন্যাসিক কতটুকু ইতিহাসকে মানবেন বা অনুসরণ করবেন তা সম্পূর্ণতই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবু ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশের দায়বদ্ধতা লেখকের তাড়নায় থাকে বৈকি। শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে একজন সম্রাট আকবর তাই পাইক, বরকন্দাজ বনে যান না। যে কোন শিল্পসাহিত্যের ফর্ম বিস্তৃতি লাভ করে প্রতিবেশের সাথে। উপন্যাস নামক শিল্পটিও পরিবর্তিত হয়েছে সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর সময়ে আমাদের সাহিত্যে কবিতা ভূমির উর্বরতা যতটা প্রত্যক্ষ হয়েছে, হতাশাজনক হলেও সত্য কথাসাহিত্যের ভূমি ততটা শস্যধারণ করতে পারেনি। ছোটগল্প যেমন অগ্রসর হতে পারেনি, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও সে রিক্ততা চোখে লাগার মতো। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা কবিতাকে যেমন তেজস্বী-বহমান করেছে, উপন্যাস শাখায় তেমন জোয়ার আসেনি। কিছু অসাধারণ কাজ হলেও সৃষ্টির সামঞ্জস্যবিধানে উৎকৃষ্টমান উপন্যাসের অভাব লক্ষণীয়। বিশেষ করে উপন্যাসের ক্ষেত্র যেখানে বহুধাবিশেষ। সামাজিক উপন্যাসের ধারাটি জনপ্রিয় হলেও সেখানে রাজনৈতিক উপস্থিতি অনেকটাই সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো। লেখকেরা যেন ‘সাধু সাবধানের’ ভূমিকা পালন করেছেন। তোষামোদ, চাটুকারিতা বা দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছায়ায় অনেকাংশই তা নতুন অন্ধকারে চটকদারিত্বের মোড়কে সয়লাব। তবু আশার কথা ভয়াবহ অভিশাপের বন্যাতেও নুহের নৌকা থাকে। সময়ের বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে উজানের খোঁজ তারা ঠিক খুঁজে পান। ইমতিয়ার শামীম এই ঘরানার লেখক। স্বাধীনতাত্তর এত এত রাজনৈতিক উপন্যাসের(!) মধ্যে ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসটিকে সুপাঠকের কাছে নুহের নৌকা বলেই প্রতীয়মান হবে। গল্পটা পুরোটাই তথাগতের গল্প, যেখানে রবিনসনক্রুশোর মতো অ্যাডভেঞ্জারার্স আর অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা বাবাও মুহূর্তে হয়ে উঠে ‘হারামজাদা’, ‘শুয়োরের বাচ্চা’।

উপন্যাসের শুরু হয়েছে তথাগতের শৈশবের বয়ানে। কিন্তু কাল বিবেচনায় লেখক যেন পেÐুলামের অনুবর্তী হয়েছেন, স্থির নন কোন কালেই। অতীত-বর্তমান সেখানে মিলেমিশে একাকার। মারিয়ার সাথে কথোপকথনের মধ্যেই সে বারে বারে ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যাচ্ছে শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে। তবে তাতে পাঠকের খুব একটা সমস্যা হয় না। আশ্চর্যজনকভাবে লেখক কালের ভারসাম্য রক্ষা না রেখেও যেন এক সাম্যবস্থা তৈরি করেছেন সিকোয়েন্সে। পাঠক ঠিকই ধরতে পারেন তথাগত অতীতে না বর্তমানে। সময়বিন্দু আগে থেকে জানতে না পারলেও কাহিনীর ধারাবাহিকতা তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হয়নি কিছু সময়ের জন্য হলেও। তবে একথা সত্য উপন্যাসের শুরুতে প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠককে সচেতনভাবে অগ্রসর হতে হয়, তবে তা সাময়িক। কারণ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই লেখকের স্টোরি টেলিংটা ধরতে আর অসুবিধা হয় না পাঠকের। বরং বর্ণনার সাবলীলতা ও বলার ধরণটা বেশ তন্ময় ভাব তৈরি করে; পাঠককে আকর্ষণ করে দৃঢ়ভাবেই। এরপর তথাগতর কী হল তা জানার যে তাড়না পাঠকের মনে তৈরি হয়, তা অক্ষুন্ন থাকে উপন্যাসের একেবারে শেষবিন্দু পর্যন্ত। উপন্যাসের উত্থান-পতন নিয়ে লেখক দারুণভাবে খেলেছেন। এতদ্বসত্তে¡ও তথাগতকে তিনি ধ্রুবতারার মতো স্থির রেখেছেন। সময়ের পরিবর্তনে এমনকি উপন্যাসের চরমতম স্থানেও আমরা তথাগতের সাথেই এমনভাবে দর্শকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছি যেন আমাদের দেখা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই। তথাগতর ভাবলেশ-প্রতিক্রিয়াহীন অক্রিয়তা যেন আমাদেরও গ্রাস করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

 

উপন্যাসের মূল চরিত্র তথাগতের বয়ানে লেখক যে যাত্রা শুরু করেছেন, তাতে তথাগতকে কাজে লাগিয়ে তিনি আশ্চর্য এক নির্মোহ হাঁটা দিয়েছেন সময়ের অন্ধকারের দিকে। প্রধান চরিত্র হয়েও তথাগত তাই শেষ পর্যন্ত প্রধান চরিত্রত্ব অর্পণ করেছে সময়ের কাঁধে। সময়ই যেন হয়ে উঠেছে প্রধান বিষয়, যাকে কেন্দ্র করে তথাগতের গল্পটা বলেছেন লেখক। সরাসরি বলতে চাইলে বলা যায়, তথাগতের গল্প বলতে চাননি লেখক। তাঁর মূল উদ্দেশ্য আসলে সময়ের গল্প বলা। উপন্যাসের নামের মধ্যে দিয়েও লেখক আমাদের এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। একটু সচেতনতার সাথে উপন্যাসের নাম চিন্তা করলেই যেন সূত্রটি ধরা যায়। উপন্যাসের নাম ‘আমরা হেঁটেছি যারা’। নামের সর্বনামগুলো ‘আমরা’, ‘যারা’ বহুবচনবাচক। তথাগত তাই সেখানে আর তথাগত থাকে না, হয়ে যায় একজন সামষ্টিক তথাগত; যাঁরা ঐ সময়ে হেঁটেছেন। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে তাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এর কথা মনে হয়। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এর মূল চরিত্র ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামক সময়। গ্রাম ও শহরের যুগপৎ প্রেক্ষাপটের সাথে বাহ্যিক ও মনোস্তাত্তি¡ক বিস্তারের সমান্তরালে এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা তৈরি করেছেন ইলিয়াস। উপন্যাসটি যত না বাহিরের ডামাডোলে সজ্জিত, তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্তি¡ক উন্মোচনে আচ্ছন্ন। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’তে কেন্দ্রীয় চরিত্র সময় হলেও ইমতিয়ার শামীম এখানে আনোয়ারের মনস্তাত্ত্বিক জগতের মত তথাগতর মনোজগতের ব্যবচ্ছেদ করেননি। বরং তথাগতকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন পরিপূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক অন্ধকারের শিকার হিসেবে। তথাগত এখানে যেন একাত্তর পরবর্তী যীশু। তথাগতকে তিনি ব্যক্তিক সমস্যাজর্জরিত, দ্বন্দ্ব-সংকুল মানুষ করেননি; গড়ে তুলেছেন সামষ্টিক নিপীড়িত মানুষের প্রতীকরূপে। বাম রাজনীতির পারিবারিক তকমা গায়ে নিয়ে তথাগতের পরিণতি পূর্ব নির্ধারিত ছিল বলে, তাঁর কাঁধে ভর করেই ইমতিয়ার শামীম উৎরে গেলেন এমন একটি অসাধারণ রাজনৈতিক উপন্যাসে, এ কৌশল অবলম্বনের জন্য নিঃসন্দেহে তিনি বাহŸার দাবিদার। আখতারুজ্জামান যেমন ঊনসত্তরের সময়টাকে ফ্রেম করেছিলেন, লেখক যেন সেভাবেই হিসাব কষেছেন স্বাধীনতা উত্তর সময়ের। উপন্যাসের ফ্রেম হিসেবে নিয়েছেন স্বাধীনতা অব্যবহিতকাল থেকে সামরিক শাসন শেষে নতুন রাজনীতিক অধ্যায়ের সূচনার পূর্ব পর্যন্ত। স্বাধীনতাপূর্ব একজন আনোয়ার যেমন শেষপর্যন্ত সিজোফ্রেনিক হয়ে যায়, আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়; তেমন স্বাধীনতাত্তর একজন তথাগতও বুঁদ হয়ে যায় নেশায়, নিজেকে বিচ্ছিন্ন খুঁজে পায় লোকারণ্যে। শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায় হারিয়ে গিয়েই। তথাগতের বাবার গভীর জীবনদর্শন তাই অব্যর্থ, দেখবে হৃদয় যেরকম সর্ম্পক দাবি করে সমাজ সেরকম সর্ম্পক নাও চাইতে পারে। রাজনীতি যেমন আচরণ প্রত্যাশা করে নৈতিকতার ধারণা সেরকম আচরণ অনুমোদন করতে নাও পারে। এ বড় জটিল কাজ দুয়ের মধ্যে মিলিয়ে চলা, হয় তোমাকে সমাজের সঙ্গে নিজের হৃদয় মিলিয়ে দিতে হবে, নয় আমৃত্যু তোমার হৃদয়বৃত্তির পক্ষে যেরকম সমাজ প্রত্যাশা কর তার জন্য সংগ্রাম করে যেতে হবে। এর মাঝামাঝি কোন পথ নেই। এর মাঝামাঝি পথে থাকে পলাতকেরা। তারা বিদ্রোহ করে না, বিদ্রোহীদের পূজা করে। আবার, অন্যায়কারীদের সামনেও নত হয়ে থাকে।

 

এই পলাতক, বিদ্রোহীদের পূজা করা আর অন্যায়কারীদের সাথে প্রতিনিয়ত আপোস করার মানসিকতা মধ্যবিত্তেরই। শ্রেণিগতভাবে তথাগত তাই আরেক ‘চিলেকোঠার সেপাই’। স্বাধীনতাপূর্ব আনোয়াররাই যেন স্বাধীনতা উত্তর সময় হয়ে উঠে তথাগত। যার চোখে ধরা পড়ে সকল অসঙ্গতি কিন্তু সে গা বাঁচিয়ে চলে নিরন্তর। মামুনের মত গান গেয়ে বিদ্রোহ করে না কিংবা ট্যাংকের নিচে পিষ্টও হয় না; মিছিলে অংশগ্রহণ করে পথ-প্রদর্শক হতে পারে না, আবার নির্দ্বিধায় মিশে যেতে পারে না জলপাইবাহিনীর সাথে। কিন্তু এই পলায়নপরতা তাঁকে তাঁর অতীতের অমোঘ পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না।

 

ইমতিয়ার শামীমের ‘স্টোরি টেলিং’ এর মধ্যে এক ধরনের মায়া আছে স্বীকার করতেই হবে। কখনো তিনি পরাবাস্তবতায় ডুব দেন কিন্তু নিমেষেই বাস্তবের কঠিন রুক্ষ ডাঙায় অবতরণ করেন। তবে জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ এর মতই এখানে বাস্তব আর পরাবাস্তব একি সমান্তরালে সহোদর ভাইয়ের মত পাশাপাশি অবস্থান করে, কেউ কাউকে ছাপিয়ে যায় না। তাই আমরা ফ্ল্যাশব্যাকে তথাগতের শৈশবে ফেরত গেলে মণীষা আর তার ছেলেভুলানো শৈশবেই শুধু থাকি না, একি সাথে রাতবাহিনী, রক্ষীবাহিনী আর মুন্ডুবিহীন লাশের সাথেও সময় যাপন করি সমভাবে। তথাগত-মণীষার চোখে অসীম আকাশ, বিস্তৃত মাঠ, অবারিত প্রান্তর আর পায়ের নিচের নরম মাটি, আলতো আল, আলুলায়িত ঘাস, ছেঁড়া গামছা দিয়ে বেলেমাছ ধরা আমাদের মধ্যে মুর্হূতেই অপু-দূর্গার নৈসর্গিক আনন্দের অনুভূতিকে জাগ্রত করে। অনেকটা কাব্যিক ভাষাতেই অপু-দূর্গার মতই তথাগত-মণীষাও পার করে যায় মাঠের পর মাঠ, গোরস্থান, প্রাইমারি স্কুল, বটগাছ আর পাতকুয়াটাও। কিন্তু হুট করে স্বপ্নডাঙার মত আমাদেরও নৈসর্গিক ছেলেখেলার আনন্দ থেকে ধাক্কা দেয় বোটকা গন্ধ। আমরাও যেন আকস্মিক গ্রামীণ আবহ থেকে বের হয়ে ঢুকে পড়ি শহরে ঘটা রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রবাহে। আমরাও মুন্ডুহীন ধড়গুলোর মত তড়পাতে থাকি বা একেবারে নিস্পৃহ হয়ে যাই পেছন মোড়া হাত-পা বাঁধা লাশগুলোর মতই। কিংবা আশেপাশের অগুনতি পঁচা লাশ দেখে হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলি; বমিতে বেরিয়ে আসে যুদ্ধপরবর্তী দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষগুলোর কয়েকদিন পর খাওয়া চুলার ভেতরের পোড়ামাটি, পানিফল ও শালুক। উপন্যাসের এই অর্ধেকে এসে আমাদের মত স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের বার বার মনে হতে বাধ্য ‘এ কোন বাংলাদেশ?’ এ অবারিত প্রান্তর আমি চিনলেও এ দেশ আমি চিনি না। এ কোন সময়ের কথা বলেছেন ইমতিয়ার শামীম? এমন রুদ্ধ, নিঃশ্বাস বন্ধ করা, মুন্ডুহীন মানুষতাড়–য়ার সময় কি আমাদের অগ্রজদের যাপিত জীবন! কিন্তু এ কোন সময় যা আমাদের সাহিত্যে একেবারেই অবহেলিত? বাস্তব হলেও সত্য স্বাধীনতা উত্তরকালের এই সময় নিয়ে লেখালেখি নেই বললেও চলে। কিছু যা আছে দলীয় লেজুড়বৃত্তি আর ফাপড়বাজিতে পরিপূর্ণ নতুবা অন্য বাহিনীর নিন্দায় ঠাঁসা। তবে এসব থেকে আশ্চর্যজনকভাবে মুক্ত ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’। উপন্যাসের শুরুটা হয় রহস্যমতি ছায়া দিয়ে, ‘অনেক রাতে আমাদের জানালা দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে মনীষার মুখের ওপরে অধরা মায়ার জাল বুনতে থাকে। ঠিক তখনই আমি কড়া নাড়ার শব্দ শুনি।’ উপন্যাসের শুরুতেই এই যে কড়া নাড়ার শব্দ, উৎকণ্ঠা, ভীতিকর অবস্থা তা পাঠককে চেপে ধরে থাকবে একেবারে শেষ পর্যন্ত। লেখক কী প্রারম্ভ দিয়েই বোঝাতে চেয়েছেন স্বাধীনতা নামক জ্যোৎস্নার আলোয় স্বপ্নের জাল বুনার আগেই আমরা আবারও ভীতিকর অন্ধকার, উৎকণ্ঠায় প্রবেশ করছি?

কলকাতা থেকে পালিয়ে এদেশে আসা প্রাক্তন নকশালকর্মী সৎমায়ের কাছে হারাধনের দশটি ছেলের গল্প কিংবা জাসদকর্মী পিতার কাছে আর্কাদি গাইদারের ‘চুক’ আর ‘গেক’ গল্প শুনতে শুনতে, হারাধনের শেষ ছেলেটি উদ্ধারের ব্রত নিয়ে কিংবা কল্পনায় তিমুরের দল গঠন করার সংকল্প নিয়ে যাদের শৈশব শুরু হয়, তাদের মনন কিছুটা ভিন্ন হবে এই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পরপরই যে অস্থির সময় সকলে পার করেছে, তা ভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিবেশে বড় হওয়া শিশুদের জন্য ভিন্ন। তাই মুক্তিযোদ্ধা বাবা যখন রক্ষীবাহিনী আর রাতবাহিনীর হাত থেকে প্রাণে বাঁচার জন্যে পালিয়ে যায়, তখন শুনিয়ে যায় অডিসিউসের ট্রয়ের যুদ্ধের জন্য বাড়ি ত্যাগ করবার গল্প। তথাগতদের তাই পেনিলোপের মতো প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। অতীত কখনো পিছু ছাড়ে না। আর আমাদের ইতিহাস রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, বিভীষণের ইতিহাস। ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধার করার মত উদার মানসিকতা আমাদের মধ্যে কখনো তৈরিই হয়নি। তাই যে দেশ সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র নিয়ে এগোতে চেয়েছিল, শুরুতেই তাতে ফাঁটল ধরেছিল খুব সহজেই। লেখক সে কথাই যেন প্রচ্ছন্নভাবে বলে গেছেন তথাগতের পিতার বয়ারে, ‘যদি তোমার পেছন দিক দুর্বল হয়, দেখবে সামনের দিকে হাঁটতে তোমার কষ্ট হবে। দেখবে তুমি ঠিক পা ফেলতে পারছ না। কোনও দিকে ঝুঁকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে।’ স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে একদিকে মুজিববাহিনী শ্রেণিশত্রু শেষ করার নামে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যে লুণ্ঠন, হত্যা চালিয়েছে তার প্রতিরোধ হিসেবে গঠিত রক্ষীবাহিনীও বর্বরতার দিক দিয়ে কোন অংশে কম যায়নি। ফলশ্রুতিতে পুরো উপন্যাস জুড়ে লাশের বিস্তৃতি আমাদের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, জিজ্ঞাসিত করে তোলে সেই সময়ের যাপিত জীবনের সম্বন্ধে, পাতাল ফুঁড়ে যেন এক নতুন যাত্রায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। আর ঠিক এইখানেই লেখকের সার্থকতা।

 

উপন্যাসের শুরু থেকেই যে উৎকণ্ঠা, গুমোট সময়ের ইঙ্গিত লেখক আমাদের দিচ্ছিলেন তা হয়ত ঐ সময়ের অনাচারে অভ্যস্ত হওয়ার জন্যই। লেখক যেন পাঠকের মন তৈরি করছিলেন এতক্ষণ। ভূমিকা ছেড়ে লেখক তাই প্রথম একটা রাজনৈতিক উপন্যাসের ভেতরেই প্রবেশ করলেন তথাগত আর মণীষার অকস্মাৎ দেখা ঐ মুন্ডুহীন লাশগুলোর সাথেই। ভূমিকার মত রহস্য, ছায়া সেখানে নেই। ৪০ পৃষ্ঠার পর যে কোন পাঠক নির্দ্বিধায় বলবেন ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ একটা পরিপূর্ণ রাজনৈতিক উপন্যাস। ছেলের হাতের ‘আমের আটির ভেঁপু’ বা ঘুড়ির সুতা নয়, লেখক তথাগতের গায়ে ততক্ষণে লাগিয়ে দিয়েছেন পুরোই রাজনৈতিক পরিবারের তকমা। তথাগত যতই আটদশটা কিশোরের মত স্বাভাবিক জীবন প্রত্যাশা করুক, আর তা হবার নয়। এজন্যই পিতার পলাতক হওয়ার রাতে রাতবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ তাকে একরাতেই অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়। রাতবাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল বইগুলোতে দেওয়া আগুনের লেলিহান শিখার সাথেই যেন তথাগতের কল্পনার স্বাভাবিক জীবনেরও ভস্ম হয়। উপন্যাসের এই মানুষতাড়–য়া সময়টুকু পাঠককে স্তম্ভিত বিস্মিত করবে কিন্তু ঐ সময়ে বাস করা একজন ঘাসুড়ে হালিম নানা বিস্মিত হন না বা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা তিনি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাই যখন হালিম নানা লাশগুলোর পা ধরে টেনে টেনে সামনের আরেকটা খেতে একত্র করে হাত ঝাঁড়া দিয়ে যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় বলে উঠে, ‘ন্যাও, কাজ ফিনিশ। ইবার চল তোমাগের আগিয়ে দিয়ে আমি।’ যেন এমন মাথাহীন লাশ এভাবে পড়ে থাকাই স্বাভাবিক ছিল। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের নতুন করে বাঁচার আকুতি অন্যদিকে নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা নিয়ে কামড়াকামড়ি। একজন মুক্তিযোদ্ধার নিমেষেই ‘হারামজাদা’, ‘শুয়োরের বাচ্চা’ তে অবনমন বা রাতবাহিনী-রক্ষীবাহিনীকে চাঁদা না দিতে চাওয়ায় সাজানো সংসার থেকে পলায়ন, অবস্থাপন্ন স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে হাড় ঝিরঝিরে অবস্থা, খেতে মুন্ডুহীন লাশ হয়ে পড়ে থাকার মধ্য দিয়ে আমরা যখন তথাগতের সাথে নরম আল দিয়ে হাঁটি তখন নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা ধ্বনিত করিয়ে ছাড়েন লেখক,

‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তাক্ত কসাইখানা আমার দেশ না
আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশার ভেজা কাশবিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল, নারী নদী।’

কিন্তু ইমতিয়ার শামীম কোন রূপকথার গল্প বলেন না, হেঁটে চলেন, কেবল হেঁটে চলেন সময়ের ইতিহাসের কানাগলিতে। ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র যাত্রা শুরু করে। কিন্তু যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধ সর্বদাই অপেক্ষা করে। ’৭১ ছিল জাতি হিসেবে আমাদের রুখে দাঁড়ানোর গৌরবের বছর, স্বাধীনতা অর্জনের বছর। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রকৃত যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল-তারই ইতিহাস যেন বলে গেলেন লেখক। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নানা অব্যবস্থাপনা রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অগ্রগতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। যুদ্ধের সময়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল, কোনও অবদান রাখেননি বা পাকিস্তানের হয়েও কাজ করেছিলেন গোপনে, অনেকেই অক্রিয় থেকেছেন, অপেক্ষা করেছেন সুযোগ বুঝে পক্ষাবলম্বনের, তারাও দেশে ফিরে ভোল পাল্টিয়ে নানা পদ জাঁকিয়ে বসেছিলেন অবরুদ্ধতার আর দেশপ্রেমিকের ফিরিস্তি গেয়ে। অযোগ্য, তোষামুদে মানুষের ভিড়ে একদিকে যেমন বহুযোগ্যব্যক্তি বঞ্চিত হয়েছিলেন তেমন একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কর্মীরা যতটা ফায়দা লুটেছিল, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বিরা তেমন কোন সুযোগ পাননি; বিপরীতে শিকার হয়েছে নানা হেনেস্তা ও ধরপাকড়ের। তাছাড়া, দলীয়গতভাবেও নিজেদের মধ্যে দল-উপদল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল সুবিধাভোগীরা। লুঠতরাজ, হত্যা, বর্ষণ, দখল, চাঁদাবাজি চলেছে কোন রাখঢাক ছাড়াই। তাতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেমন অংশগ্রহণ করেছিল তেমন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্য বাহিনীগুলোও কোন ছাড় দেয়নি। ফলশ্রুতিতে জনমনে ক্ষোভ, অনিরাপত্তা জন্মেছিল যেমন, তেমনই এতদ্বসকল অব্যবস্থাপনায় নজির স্থাপন করেছিল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষও।

লেখক বেশ সংযত শৈল্পিক নমুনায় তার প্রকাশ করেছেন বালক তথাগতের ঘাস আর ছাতুর মিশ্রণে তৈরি রুটির গোগ্রাস গলাধঃকরণে। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘প্রেম আর ধর্ম জাগিতে পারে না বারোটার বেশি রাত।’ একাত্তরে যাঁরা অনেক মহৎ ছিলেন, তাঁরাও তাঁদের সেই মহৎ প্রেরণা বেশিদিন ধারণ করে রাখতে পারেননি। তারাই দেশে ফিরে বা অভ্যন্তরে থেকেও চালিয়েছেন লুটতরাজ, দখলদারিত্ব। মুজিব সপরিবারে নিহত হবার পর আমাদের দেশ যে নতুন শোষণের শিকার হয়েছিল, সেই অন্ধকার সময়ের সূচনা লেখক বর্ণনা দিয়েছেন সাবলীলভাবে। তথাগতের মত কিশোরও যেন তার নেতিপদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল মৌলভী স্যারের সেদিন সবার আগেই এ্যাসেম্বেলিতে হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ভাষণ যেন এদেশে মৌলবাদের ঝান্ডা গাঁড়ার দলিল, ‘আগে যা হয়েছে, হয়ে গেছে, এখন আর বেশরিয়তী কাজকাম চলবে না। আল্লাহ কখনো সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।…মুসলমানরা হল ভাই ভাই। দেশ আলাদা হতে পারে, রাষ্ট্রপ্রধান আলাদা হতে পারে, শরীরে তো একই রক্ত। যেখানেই থাক না কেন, মুসলমানের প্রতিটি কণাই আল্লার নাম জিগির করে। ভাইয়ে ভাইয়ে গন্ডগোল হতে পারে। তারপরেও ভাই সবসময়েই ভাই। মুসলমানরাও তাই। পাকিস্তানের মুসলমানেরাও ভাই আমাদের।…এখন সময় হয়েছে, হিজরত শেষে আবার আমাদের প্রবাসী মুজাহিদ ভাইয়েরা ইমলামের ঝান্ডা নিয়ে দেশে ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ।’

 

স্বাধীন দেশের মাটিতে আবার সামরিক শাসন আর নতুন করে ‘জামাতে ইসলামী’ র রাজনীতি দেশকে আবারও যেন ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার পূর্ব সময়ে। লেখক বেশ চাতুরতার সাথেই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ এর মতো গন্ধের বয়ান করে গেছেন। এরপর নতুন দল, নতুন বাহিনী আবারও রুদ্ধ শাসন, আমাদের কালিমালিপ্ত সময়, পশ্চাৎ যাত্রা। আবারও শুরু হয় ধরপাকড়, এবার আর ফেরারী পলাতক নয়, লাশ হয়ে ফিরেন জাসদকর্মী তথাগতের পিতা। যিনি বলতেন, ‘সবকিছু বইয়ের পাতা থেকে পাওয়া যায় না। অনেক কিছু শিখে নিতে হয় নিজেদের আশেপাশে থেকে, প্রতিদিনের চলাফেরা থেকে।’ শিখে নিতে হয় গরু সবচেয়ে পছন্দ করে শামা ঘাস আর সেগুলো কোথায় পাওয়া যায় দুবলা ঘাস, ভ্যাদলা ঘাস, চেঁচো ঘাস, ব্যাঙ থুবড়ি ঘাস এত এত ঘাসের মধ্যে। আর তাই তথাগতও জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই শিখে গিয়েছিল জলপাই বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে পিতার যে লাশ ফিরিয়ে দিল, সেজন্য টু শব্দ করা যাবে না। কোন প্রশ্ন করা সেখানে অবান্তর। জীবন্ত মানুষটাকে মুর্হূতেই যারা মানুষতাড়–য়া বানিয়ে দিল; আবার তারাই পাহারা বসালো কবরে যেন সে মানুষ-তাড়ুয়া আর ফিরে না আসে, ডেকে না নিয়ে আসে আরও মানুষ; যেন কেউ পালন করতে না পারে সামান্যতম শোক। তাঁর কবরের পাহারা সাধারণ মানুষগুলোকে যেন শেখালো মানুষতাড়ুয়ারা শোক পাবে না, এমনকি মাতম করতে পারবে না তার ঔরসজাত সন্তানও। তথাগত শিখেও গিয়েছিল। কোন শোক করেনি, করেনি কোন প্রতিবাদ; যেন সে জন্ম থেকেই বোবা। শুধু রাতারাতি বড় হয়ে গিয়েছিল সে, বুঝে গিয়েছিল রাতবাহিনী হোক আর রক্ষীবাহিনী কিংবা জলপাইবাহিনী; এরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ, ভিন্ন ভিন্ন নামের হলেও মূলে এক। এদের সকলের মূল চালিকাশক্তি এক ও অভিন্ন। বুঝে যাওয়ার কিছু পরেই তথাগত কলেজে চলে আসে। গল্পের পরিবৃত্তে সৎমা, মণীষা, গ্রামের রাজনীতি পেরিয়ে তথাগত প্রবেশ করে শহুরে জীবনের বাষ্পে। মারিয়া, মামুন কিংবা শুভ্রাদের বৃত্তে সে প্রবেশ করে তার নিজ মহিমাতেই। কিন্তু এক হয়েও কোথায় যেন তারা ভিন্ন।

গ্রামের জীবনানন্দীয় আনন্দময় জীবনের গল্প বইয়ের মলাটের মধ্যে সীমাবদ্ধ জ্ঞানের মত নয় বলে গৃহদাহের অচলার যেমন গ্রামযাত্রা মধুর হয়নি, তেমন গ্রাম্য রাজনীতি আর কঠোর বাস্তবতা ভিন্ন বলেই তথাগত চাইলেই সেখানে মারিয়াকে নিতে পারার আশ্বাস দিতে পারে না। গ্রাম সেখানে কবিতার সোঁদা মাটির গন্ধের মত পবিত্র ও নিরাপত্তার আধার নয় বরং বাস্তবে অন্য আঁধারের প্রাধান্যই সেখানে প্রতিষ্ঠিত। যে আঁধারের নগ্ন রাজনীতিতে এক রাতের ব্যবধানে তথাগত হয়ে যায় তাঁর পিতার অবৈধ সন্তান, খুন হয়ে যায় তার সৎমা, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় মণীষা; আর তার জের ধরে সমস্ত পৈত্রিক সম্পত্তি চলে যায় চাচা আর চেয়ারম্যানের ঝুলিতে। তথাগত তখন সময়ের ফেরে জেনে গিয়েছিল মারিয়াকে তার যশোরের পায়রা নদীর তীরে পাথরপাড়া বা আলোকদিয়ার সেই রবিনসনক্রুশোর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে না। নেশার ঘোরেও তথাগতর তাই মনে হয়েছে,

 

রাতে আমাদের ঘিরে ধরবে একদল নৈশ পুলিশ। তারা হো হো করে হাসবে, তারা আমাকে বেঁধে ফেলবে, বাধতে গেলে বাধা দিলে মেরে ফেলবে, নদীতে ফেলে দেবে; আর বাঁধা না দিলে আমি দেখব মারিয়াকে ওরা একের পর এক ধর্ষণ করছে, মারিয়া আর কথা বলবে না। পৃথিবীর সকল নিরবতা তার শরীরে যেন ভর করেছে, সে নিরবতায় শোনা যাচ্ছে শ্বাপদের উল্লাস, উল্লাসধ্বনির মধ্যে দিয়ে মারিয়ার শরীর থেকে গড়ানো রক্ত নদীপারের বালি শুষে নিচ্ছে মারিয়ার লজ্জা আর ঘৃণা তার নিজের কাছে রেখে দিতে, তারপর একসময় মারিয়া মারা গেলে তাকেও ওরা নির্বিঘ্নে নদীতে ফেলে দেবে।

 

নকল ভোটে ক্ষমতায় টিকে যাওয়া, পাতি নেতারা ক্ষমতায় জেঁকে বসা, নতুন করে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ফণা তোলা সব নির্বিবাদে দেখে চলি আমরা। তথাগতকে দিয়ে লেখক সময়ের উম্মোচন করতেই থাকেন, আমরা হাঁটতেই থাকি শিউলি ফুলের মতোই ঝরতে ঝরতে ভোরের আলো কখন আমাদের অবগাহন করবে সেই প্রত্যাশায়। কখনোবা থমকে দাঁড়াই, বুক চেঁপে ধরে আসে দীর্ঘশ্বাসে, তবু লেখক থামেন না, তথাগতর পথ ধরে আমরা হাঁটতেই থাকি। লেখক বলে চলেন, কিন্তু এখন একাত্তর নয়, এখন আমরা পেরিয়ে এসেছি পঁচাত্তরও। এখন আর রাজপথে মৃত মানুষ পড়ে না, নালার ভেতর গলাকাটা লাশ দেখে আমরা আর দৌড়াই না উর্ধ্বশ্বাসে, খেতের মধ্যে লাশের সারি দেখে এখন আর মণীষা বমি করে না হড়হড়িয়ে। কিন্তু এখনও মৃত্যু ঘটে, ঘাতকের থাবা কেড়ে নেয় আগের মতোই ধড়, মুÐু। তফাত, এই লাশগুলো আর নালায়, খেতে কিংবা রাস্তায় পড়ে থাকে না। সযত্মে তাদের কবর দেওয়ার পর পাহারা বসানো হয় কবরস্থানে, কিংবা গুম করে দিয়ে তাদেরই আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিরীহ গলায় খোঁজ নেয়া হয়, কোথায় গেছে অমুক।

এরপর আবারও আরেক সামরিক অভুত্থান, শহরের বুকে জলপাই রঙা ট্যাঙ, আবারও সৈন্যদের বাম-ডান, ধরপাকড়, অজ¯্র মানুষতাড়–য়া। আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনুরুদ্ধার, আবারও নতুন বাহিনীর প্রত্যাবর্তন। তথাগত তাই বলে যায়,
এতটুকু জীবন আমার, একজীবনেই কত স্মৃতি, কত বাহিনী। মুজিব বাহিনী, রাত বাহিনী, রক্ষী বাহিনী, লাল বাহিনী, গণবাহিনী, জলপাইবাহিনী। বাহিনী দাঁড়ায় আরাম করে। বাহিনী ডাইনে ঘোরে, বামে ঘোরে, উল্টো ঘোরে, তারপর মার্চপার্চ করে, ডান-বাম, ডান-বাম। তারা এত নিপুণভঙ্গীতে ডান-বাম করে যে আমি একটুও বুঝতে পারি না কখন ডান পা’টা পড়ল, কখন বাম পা’টা। আমাকে মিছিলে দেখে অনেকেই বলে, কোন পার্টি করি আমি। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারি না স্পষ্ট করে। কখনও বলতে চাই, আমি আসলে প্রতিদিনই শোক মিছিল করি। মামুনের শোকে, বাবার শোকে, মামুনের বাবার শোকে। ছাত্ররা কেউ বোঝে না তা, অথবা শোনার চেষ্টা করে না। আমি ভাই, সাধারণ ছাত্র বলে এড়িয়ে যাওয়া। আমি সেটাই করি।

তথাগতের মৃত্যুর সাথে সাথে উপন্যাসটি যখন শেষ হয়, যেন কী এক কষ্ট আমাদের বুক থেকে জাগ্রত হয়ে গলা পর্যন্ত এসে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আনে। তথাগতের নির্মম ইন্টারোগেশন লেখক এমনভাবে বর্ণনা করেন, যেন তথাগত বোধহীন, অনুভূতিহীন। ইন্টারোগেশনের যন্ত্রণা তাকে আর স্পর্শ করছে না, যেন সে এত র্দীঘপথ এই ইন্টারোগেশনের জন্যই হেঁটে চলছিল, এরই প্রতীক্ষা ছিল তাঁর। তথাগতের মৃত্যু বর্নণায় লেখকের অসাধারণত্ব স্বীকার না করে কোন পথ খোলা নেই তাই। কী সংযত কিন্তু কাব্যিক মেদহীন স্পষ্ট ঘোষণা যেন, ‘এক আশ্চর্য সুন্দর নির্মল স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমার মৃত্যু ঘটে।’ তথাগত তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েও স্বপ্ন দেখে যায়, রেখে যায় তার স্বাপ্নিক জগত যেখানে একে একে বাহিনী আসতেই থাকে, কিন্তু সাথে সাথে মঙ্গলপান্ডেরাও বার বার ফিরে আসে; মায়েদের কপালে উনুনের আঁচে আবারও শিশির ফুটে ওঠে আর দিনে দিনে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তথাগতের মৃত্যু তার অনুভুতির উর্ধ্বে হলেও পাঠকের একটা চাপা কষ্ট হতে বাধ্য, এতে কোন সংশয়ের অবকাশ নেই। নিজের অজান্তেই পাঠকের চোখের কোণ আর্দ্র হয়ে উঠলেও উঠতে পারে। তথাগতের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাঠকের যাত্রারও যে মৃত্যু হয়, শেষপর্যন্ত তথাগতের মৃত্যু স্বপ্নই যেন আমাদের তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নতুন করে স্বপ্নাবিষ্ট করে তোলে। কী এক ঘোরে পাঠকেরও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, এই মানুষতাড়–য়ারা আবারও মানুষ হয়ে উঠছে, ক্রমাগত তারা বাড়তে থাকছে, আরও আরও মানুষকে জাগ্রত করছে। খুব করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, তথাগতরা হেঁটে একদিন ঠিক তাদের স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছুবে। বন্ধুর পথে হেঁটেও যে তথাগতরা আবারও ফিরে এসে পাঠককে স্বপ্নের দিকে মোহাবিষ্ট করতে পারছে এতেই লেখক ইমতিয়ার শামীমের সার্থকতা, এটাই তাঁর পরম পাওনা।

 

উপন্যাস বাস্তবতার পুননির্মাণ। ভাষা মাধ্যমের ঢালাইয়ের চমৎকারিত্বে তা মানুষের মনে অন্য এক জগত তৈরি করে। পাঠকের সামনে আসে শব্দ দিয়ে গড়া এক অলীক বাস্তব। শামীম সে গাঁথুনিতে পাঠককে বাঁধতে পেরেছেন, অন্তত এ উপন্যাসে তো বটেই। ভাষা এখানে গদ্যকাব্যের মিশ্রণে প্রবাহমান নির্ঝরিণীর মতো, বেশ ঘোর লাগাতে সক্ষম। মণীষা-তথাগতকে অপু-দূর্গার মত শেষপর্যন্ত দেখতে পেলে হয়ত পাঠক স্বস্তি পেত, কিন্তু জীবনের গভীরতায় হৃদতায় পাঠক সে স্বাভাবিক সম্পর্কের স্বস্তি পাঠককে দেননি। তবে যতটা সংযত ভাষা ও কৌশলের প্রয়োগ তিনি এ ব্যাপারে করেছেন এবং কিছু না বলেই সমাজের বেঁধে দেওয়া সম্পর্কের স্বাভাবিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন তা দুঃসাহসের নামান্তর। বিশেষ করে আমাদের সংস্কৃতিতে ভাই-বোনের সম্পর্ককে যেখানে অন্য এক পর্যায়ে ভাবা হয়, সেজন্য কৌশলগতভাবেই লেখক তথাগত-মণীষাকে সৎ ভাইবোনের ছকে সাজিয়েছেন এবং সফলতাও পেয়েছেন। শামীমের শব্দচয়নের পরিমিত বোধও লক্ষণীয়, ‘যতিচিহ্নবিহীন মুর্হূতও মায়ের উদগ্রীব হওয়াকে রোধ করতে পারে না।’ বিশেষ করে কিছু অপ্রচলিত লোকজ শব্দ তিনি ভাবানুযায়ী সেঁটে দিয়েছেন, যেমন: ‘নান্দা’, ‘চক রাখালি’, বিচিত্র সব ঘাসের প্রকারভেদ, বা প্রবাদ ‘হাতি পাঁকে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে’ এমন গ্রামীণ জীবনের নানান অনুসঙ্গ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর সাবলীল গদ্যছন্দের গাঁথুনিতে। কাব্যিক ভাষার প্রবাহমানতায় জীবনের গভীরতা ছন্দ পেয়েছে যুক্তির পর যুক্তিতে যেমন, হয় সমর্পণ না হয় পরম একাকিত্ব এ যদি অর্জন করতে না পার, তবে তুমি কালজয়ী দিক-নির্দেশক হতে পারবে না। আমাদের নবী আল্লাহ্র কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন, তার জন্যেও যথাযোগ্য সম্মানও পেয়েছেন। আবার, চিন্তা কর বুদ্ধের কথা, তিনিও ধর্মপ্রচারক ছিলেন কিন্তু আদ্যপান্ত নাস্তিক আরকি। তবুও তিনি তাঁর নিঃসঙ্গতা নিংড়ে নিংড়ে মানুষকে নির্বাণের পথ দেখিয়ে গেছেন। তুমি ধার্মিক না নাস্তিক, তুমি আশাবাদী না নিরাশীবাদী সেটা আসল কথা হল তুমি একাগ্র হতে পারছ কিনা। উপমার ব্যাপারে শামীম প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দেন বলে মনে হয়েছে, ‘কাঁদামাটি মাখা ক’টা ঘাস ধীরে ধীরে মাথা তোলে মণীষার পাঁজর আর কণ্ঠার হাড় জেগে ওঠার মতো’ বা ‘আমরা হাঁটতেই থাকি শিউলি ফুলের মতোই ঝরতে ঝরতে ভোরের আলো কখন আমাদের অবগাহন করবে সেই প্রত্যাশায়।’

 

মূলত আশি থেকে নব্বই দশকের অস্থির জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে এই ভূখন্ডের কিছু দায়িত্বশীল নিমোর্হ লেখক অবাণিজ্যিক গভীর চিন্তনকে সঙ্গী করে নতুন সাহিত্যক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার যে বিকল্প ধারার কথা ভাবলেন, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি সর্বোপরি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে যে নিরপেক্ষতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিল, ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হাঁটছি যারা’ এমন একটা দায়বদ্ধতার উপন্যাস। ‘আমরা হেঁটেছি যারা’কে রাজনৈতিক উপন্যাস বলা কতটা যুক্তিযুক্ত বা উপন্যাস হিসেবে লেখক কতটা উৎরে গেছেন, সে আলোচনা পাঠকের হাতে উন্মুক্ত থাকাই ভাল। তবে এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, নিতান্ত অলস পাঠককেও লেখক বাধ্য করবেন ঐ সময়ের কর্দমাক্ত কানাঘুঁপচিতে দিকে যাত্রা করতে, আর এখানেই ‘আমরা হেঁটেছি যারা’র সাফল্য।

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত