Categories
আমি কোথা থেকে এসেছি । ভালজিনা মর্ট । তনিমা হাজরা
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
কবি পরিচিতি
১৯৮১ সালে বেলারুশের মিনস্কে শহরে (প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন, ভালজিনা মর্ট। আইরিশ টাইমসে “আন্তর্জাতিক কবিতা জগতের উদিত নক্ষত্র” হিসাবে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন । তিনি যখন ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন, তার আগেই তিনি তার প্রথম বই প্রকাশ করেছিলেন, ” আই অ্যাম অ্যাজ থিন অ্যাজ ইয়োর আইল্যাশস “এবং সারা বিশ্বের পাঠকমহলে তার কবিতারা যথেষ্ট পরিচিত হয়ে পড়ে । আমেরিকায় তার প্রথম সংগ্রহ, ফ্যাক্টরি অফ টিয়ার্স (২০০৮), প্রশংসা পেয়েছে: নিউ ইয়র্কার লিখেছে, “মর্ট তার জন্মভূমির জন্য একজন দূত হওয়ার চেষ্টা করেছেন, বেলারুশ এবং এর ভাষার জন্য একটি স্পষ্ট পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে সে সম্পর্কে প্রায় উদ্বেগজনক সোচ্চারতার সাথে লিখেছেন।” তিনি যে বেলারুশিয়ান ভাষায় তার কবিতা রচনা করেন তার কারণ হচ্ছে ঐতিহ্যগত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা, যা তার কাজকে প্রচলিত এবং যুগান্তকারী উভয়তই প্রকাশ করে।
মর্ট ২০০৫ সালে স্লোভেনিয়ায় ক্রিস্টাল অফ ভিলেনিকা পুরস্কার এবং ২০০৮ সালে জার্মানিতে বুর্দা কবিতা পুরস্কার পান। তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এবং নিউইয়র্কের ইথাকাতে থাকেন।
(১)
আমি কোথা থেকে আসছি?
কালো রাজপ্রাসাদের মধ্য থেকে
অবিরাম টেনে আনা
একটি ক্রুশবিদ্ধ মানুষের অবয়ব
মনে হচ্ছে যেন
হ্যাঙ্গার থেকে একটি পোশাককে টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেলা হচ্ছে,
তার পেশীর ঘন মেঘ -
মেঘলা শরীর-
বিমূর্ত জলবায়ু
পৃথিবীর মানুষের কাছে খুব সামান্য পরিচিত কোনো একটি দেশের।
(আমি যে দেশ থেকে এসেছি?)
তারা মানুষটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে,
তার বগলের নিচে তাদের হাত লাঠি।
লাঠিটিকে তারা কী সহজে স্থাপন করেছে লোকটির এত আরামদায়ক
এই উষ্ণ জায়গায়!
তার বুক থেকে খুবলে কেটে নিয়েছে
একখণ্ড মাংস, যেন
ইভ একখানি রক্তচক্ষু মেলে অপলক তাকিয়ে আছে।
বুকের মধ্যে একটি তীব্র ক্ষত – যেন একটি জ্বলজ্বল লাল চোখের খোলা পাতা।
কিন্তু
আমি কোথা থেকে এসেছি?
কেউ বলছে না আমাকে।
(২)
হ্যাঁ, একজন মানুষ
যেন একটি হ্যাঙ্গার থেকে ছিনতাই
করা একটি পোশাক।
ভেতরে কালো কালো যত
বর্ণমালা
অবিরাম টেনে হিঁচড়ে
নিচে জোর করে নামিয়ে আনা
প্রতিটি অক্ষর
যেন এক একজন মানুষ।
(৩)
দীর্ঘ সরু করিডোরের শেষপ্রান্তে রাখা একটি টেলিফোন
যেন আমার কাছে
জলের খাবার জন্য একটি কূপ।
(আচ্ছা, আমি কোথা থেকে এসেছি?)
(মায়েরও নয়
না বাবারও সাথে কোনো মিল নেই,
আমার গোল মুখ
যেন একটি ঘূর্ণমান ফোনের
ডায়াল বক্স ।)
এই ঘূর্ণমান ফোন যেন
আমার জিন পুল,
ছুটতে ছুটতে আমার শরীর বেজে ওঠে
আমার মাথা একটি
রিসিভারের শক্ত কাঁধে কিছুটা জিরিয়ে নিতে চায়।
রক্ত কথা বলছে!
ওগো শুনতে পাচ্ছ তোমরা
রক্ত সংযোগ যে ভারি দুর্বল।
রিসিভারের ভিতরে আমি একটি ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পাই
যেন আগুন ডাকছে।
ইনি কে?
এটা আমি,
আমি একটি ফায়ার রিসিভার.
কিন্তু আমি কোথা থেকে এসেছি?
(৪)
রান্নাঘরের জানালার পিছনে বরফাচ্ছন্ন নির্দয় দিনগুলি -
তুষার যখন আমাদের ত্বকের নিচে চর্বির মত জমা হয়েছে।
সেইসব দীর্ঘদিনে আমরা কতটা বড় হয়েছি!
রান্নাঘরের টেবিলে এতটাই সময় কেটে যায় যে
জীবনের বাক্যে,কোথায় যে যতি লাগাতে হবে তাই সিদ্ধান্ত নিতেই
দিশাহারা হয়ে পড়েছি।
হাসপাতালের লবির মতো কী প্রচণ্ড ভিড় সারা মস্তিষ্ক জুড়ে,
তবুও কেউ আমাদের বলতে বিরক্ত হয়নি যে, এই কথাগুলো একবারের জন্য হলেও উচ্চারিত হয়েছিল।
সেই ক্ষত জুড়িয়ে
সেরে ওঠারই তো কথা
কারণ সময়কে হাতে একটি স্ক্যাল্পেল নিয়ে তোমার শুশ্রূষায় নিবিষ্ট হতে দেখা গেছে.
তুমি হয়ত কোনো শিশুর লিখিত পংক্তির দিকে তাকিয়ে রহস্যময় গলায় বলবে, ওহে, তুমি ভুল করছো,
ভেবে দেখো আর একবার।
একই শব্দমূল থেকে উৎসারিত আরেকটি সমার্থক শব্দ,
যেন শব্দদের পায়ে শিকড় থাকতে পারে।
যেন এইসব শব্দেরা কেউই
অন্ধকার ভেদ করে আসেনি,
থলেতে থাকা বিড়ালের
ছটফটানির মতো শব্দ,
যেন আমাদের মানব জন্মের শিকড়জ্ঞান ইতিমধ্যেই আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত।
এখানে ব্যাকরণ,
এখানে অর্থোগ্রাফি ,
এখানে একটি কাগজে মোড়ানো “রুটি, দুধ, মাখন।”
শিকড় কি?
কাকে বলে অঙ্গসংস্থানবিদ্যা?
কে নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করে এই অধীনতাতন্ত্র?
বারবার একইভাবে
একই ভুল করা কিভাবে সম্ভব?
এখানে পদার্থবিদ্যা , রসায়ন ,
জ্যামিতি এবং ভৌগোলিক ব্যাখ্যার ভূগোলকসহ,
ভ্যাকলাভের চিঠিগুলো সব কোথায়,
১৯৪৬?
আমাদের উৎসের শব্দতত্ত্ব ও ব্যুৎপত্তি নিয়ে সকলে কী করবেন?
আমাদের অঙ্কুরোদগমের বুৎপত্তি?
১৯৪৬ সাল
আমার মস্তিষ্কের ভিতর হাসপাতালের লবির মতো
থিকথিকে ভিড় করে আসে।
আর ফিরে ফিরে আসে
একটি ঘূর্ণমান ফোনের মুখ,
একটি ঘড়ির মুখ,
দেয়ালে টাঙানো একটি
রেডিওর মুখ-
এই সবগুলো একসঙ্গে মিলে মিশে হয়ে ওঠে আমার অগণিত
পূর্বজদের মুখাবয়ব
কিন্তু এখানে ভ্যাকলাভের মুখ
কোথায়?
(আবার একজন মানুষ
ঠিক যেন একটি
হ্যাঙ্গার থেকে হিঁচড়ে নামিয়ে আনা একটি পোশাক।)
আর চিঠিগুলো কোথায়?
সেইসব সাপ্তাহিক চিঠির গোছা,
তার মক্সো করে লিখিত
রবিবারের সেরা হাতের লেখা?
রিসিভারের ভিতরে জ্বলছে আগুন।
(এমন উষ্ণ জায়গায় আমার কান কেন যে এতটা আরামদায়ক!)
কিন্তু আমি কোথা থেকে এসেছি?
(৫)
একটি যুদ্ধোত্তর শহরের সৈন্য ব্যারাক -
একটি স্থায়ী অ্যাপার্টমেন্ট জুটে যাবার আনন্দ -
একটি কোট, একটি জ্যাকেট, একটি চামড়ার পার্স
পার্সে রাখা মোটা মাইনে,
কিন্তু কোথায় সেই হারানো চিঠি
সেই হারানো মুখ?
শূন্য উদভ্রান্ত মুখ,
উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া মুখ,
আটকে থাকা ক্রনিক অসুখ সব মুখেদের দেওয়ালে, দেওয়ালে
শূন্যতা লেপ্টে থাকা মুখ,
ঠিক যেন পরীক্ষাগারের ইঁদুরদের মুখের মতো।
ভ্যাকলাভকে মুখপাত্র করে
এই দেশটির উপরে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল।
সব ঝড় পেরিয়ে,
এখন আমরা শান্তিতে থাকতে পারি।
তাই,
আমি কোথা থেকে এসেছি?
একটি যুদ্ধোত্তর শহর,
অজস্র সৈন্যব্যারাক -
যুদ্ধের নিস্ক্রিয়তায় আনন্দিত অথচ শূন্য কিছু মুখ,
হ্যাঙ্গার থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনা কিছু বিপন্ন মুখ।
যাদের শরীরে অভ্যন্তরীণ
অঙ্গগুলি লক্ষ্যনীয়ভাবে অনুপস্থিত।
(৬)
খুব বড় জলাশয়ের জন্য সুবিদিত কোনো একটি গ্রামে যেখানে সমস্ত শিশুগুলি দুটিভাগে ভাগ করে গুণে ফেলা যায়,
এক, যারা জীবিত জিনিসকে আঘাত করে এবং
দুই, যারা নির্জীব জিনিসকে আঘাত করে,
এমনই একটি সবুজ
সুজলা সুফলা গ্রামে
যেখানে আমি নেহাতই অপরিচিত একজন আগন্তুক,
(আমি কোথা থেকে এসেছি?),
সেই গাঁয়ে প্রবেশ করে দেখি
একটি পুরানো গির্জার চারপাশে একটি কবরস্থান,
সেখানে লিখিত ভয়ঙ্কর সব বর্ণমালা
গ্রামের চারপাশে,
সমাধির পাথরের উপর লিখিত সেই বর্ণমালারা
মার্বেল অক্ষর হয়ে তুষারের উপর অজস্র মৃত মথের মতন পড়ে আছে।
মথ-খাওয়া সেইসব বরফের নীচে শায়িত আছে
আমার মাতৃভূমির উত্তম কঙ্কালগুলি।
(৭)
আমার মাতৃভূমি সেইসব হাড়ের চাবিগুলিকে ধরে তীব্র ঝাঁকুনি দেয়।
এক একটি হাড় যেন আমার মাতৃভূমির জন্মের চাবিকাঠি।
(৮)
আমার মাতৃভূমি তাদের হাড়ের চাবিগুলিকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
ওই দেখো আদিজননী ইভ তার লাল চোখের পাতা খুলে তোমাদের দেখছে।
মথ-খাওয়া বরফের নীচে
আমার মাতৃভূমির উত্তম কঙ্কালগুলি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে.
আমার মাতৃভূমিতে মানুষ কুয়োর জলের কাছে নতজানু হয়,
আমার মাতৃভূমিতে লোকেরা উড়ন্ত পাখিদের ক্রুশচিহ্ন যূথে উড়বার গতির কাছে প্রার্থনা করে।
এক একটি হাড় আমাদের মানুষদের জেগে উঠবার একটি একটি চাবিকাঠি.
আমাদের নাগরিকদের মধ্যে
কেবল মৃত মানুষদেরই একটা করে মুখ আছে।
তবুও একটাই প্রশ্ন,
আমি কোথা থেকে এসেছি?
(৯)
সোনার সুতোর বেরেটে এমব্রয়ডারি করা পোশাক পরণে
ওই যে মহিলা সন্তদের দল
তারা কেন তোমার পায়ের কাছে, অমন পোষা প্রাণীর মত বসে আছে?
ময়ূরের পেখমওয়ালা কোনো দেবদূত,যাদের মুখাবয়ব মানুষের মতন,
কিন্তু
তোমার পায়ের কাছে ওরা কারা,
পোষ্য প্রাণীর মতন অমন করে বসে আছে?
এখন, তুমি যদি এই ধরনের সোনার বেরেট পরে ফেলতে পারো
তুমি যদি ঠিক একই ভাবে
শিশুদের এবং ফেরেশতাদের বশ করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো,
তাহলে তোমার সাদা হাড়বিহীন আঙ্গুল একটি বইয়ের পাতার উপরে উপুড় হয়ে যেমন করে শ্লোকগুলি খোঁজে, ঠিক তেমন করে কাঠের কফিনের উপর লিখিত যন্ত্রণাময় লিপিকাগুলিকে খুঁজে ফিরবে,
তখন কি সোনার বেরেট পরিহিতা
হে পবিত্র সাধ্বীগণ, আপনারা আপনাদের
নিজস্ব কবরী খুলে আমার জিভের উপর তা বিছিয়ে দেবেন?
(১০)
এক একটি শব্দপ্রেমী ইঁদুরের জন্য
একটি করে কাটা ইঁদুরের লেজ!
আমার বর্ণমালার ভিতর থেকে
অবিরাম হ্যাঁচকা টান মেরে নামিয়ে আনা প্রতিটি ভীতিকর চিঠি
এক একজন মানুষের মৃত্যুর খবর।
সেসব ভয়ঙ্কর বর্ণমালা তার রবিবারের মক্সো করে লিখিত
সেরা হাতের লেখা।
হারিয়ে যাওয়া চিঠিগুলোকে উদ্দেশ্য করে লেখা আরও এক একটি চিঠি,
ফোনের মতন মুখ,
ঘড়ির মতন মুখ,
রেডিওর মতন মুখ —
এক একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গের মতন এক একটি মুখ।
এক একটি নিখোঁজ অভ্যন্তরীণ অঙ্গের মতন ভ্যাকলাভের সেই চিঠিগুলো সব কোথায়?
আমার মাতৃভূমির সীমান্তে
— ধোপাখানার কাপড় কাচার আওয়াজ বন্দুকের শব্দের মতন যেন বাতাসে হাততালি দেয়।
আমার মাতৃভূমির কথা শুনেছ?
আমার মাতৃভূমি একটি আস্ত সোনার ডিমের আবরণের ভিতর সাজানো একটি কাঁচা কুসুম।
এই কুসুমই সোনাকে তার রঙের জেল্লা দেয়।
এই মুখ আগুন বর্ষণকারী
এই মুখ একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গের প্রতিকৃতি।
এক একটি হাড় যেন এক একটি মানুষের চাবি,
আমি কোথা থেকে এসেছি?
(১১)
ওহে! দেখো,দেখো!
আমার মাতৃভূমির সোনার হাড়গুলো কেমন ঝংকার তুলে বেজে উঠেছে!!
কবি, অনুবাদক, কথাসাহিত্যিক।
বিশ্বাস করেন লেখাই তাঁর অস্ত্র, লেখাতেই তাঁর নির্বাণ ও মুক্তি।