| 7 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: ভিখারি » অ্যানচ্যালি । অনুবাদ মাজহার জীবন

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

 

anchalee-vivatanachai
পুুরা নাম অ্যানচ্যালি ভিভাতানাচাই (anchalee vivatanachai)। ব্যাংককের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে স্নাতক পাশ করে ঐ বছরই জেমোলজিক্যাল ইনিস্টিটিউট অব আমেরিকা (জেআইএ) এ পড়তে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এক সন্তানের জননী স্বামীর কম্পানিতে সহায়তার পাশাপাশি নিউইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষার উপর স্নাতকোত্তর করছেন।

অ্যাননচ্যালির প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প ম্যায় ক্রাপ (প্রিয় মা) ১৯৮৫ সালে পেন ইন্টারন্যাশনাল থাই সেন্টার এবং ছোটগল্পের সংকলন অ্যানিয়ামানি হায়েং চেউইট (জুয়েলস অব লাইফ) ১৯৯০ সালে সাইথইস্ট এশিয়া রাইট এওয়ার্ড লাভ করে যার একটি গল্প ভিখারি। গল্পটির চ্যানচ্যাম বুনাং-এর ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হলো।


কাক ভোর। ভিক্ষু রাস্তায় এসে ভক্তদের দেয়া খাবার ও দান গ্রহণ করছেন। ভোর গড়িয়ে সকাল হয়ে আসলে মন্দিরে ফেরার পথে দু’জন ভিখারির সঙ্গে তার দেখা। ওরা স্বামী- স্ত্রী। তাদের নিত্যদিনের ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করার জন্য এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভিক্ষুর হাতে ধাতব দানপাত্রটি দান-দক্ষিণায় ভরে গেছে। আর ভিখারিদের ভিক্ষাপাত্র প্রায় খালি। এভাবে দু’পক্ষের প্রতিদিনই দেখা হয়। ভিক্ষু প্রতিদিনই তার দানপাত্র থেকে ভিখারিদের কিছু দেয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু কখনই তা হয়ে উঠে না। মনে মনে ভাবেন এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। লোকে দেখবে, অস্বস্তি লাগবে। তার চেয়ে না দেয়াই ভাল।

অন্যদিনের মতো আজও তাদের দেখা। তবে আজ অন্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভিখারি দম্পতি গ্রিলের সাটারিং দেয়া এক দোকানের সামনে। মাথার উপর দোকানের ছাউনি। দোকান এখনো খোলেনি। খোলার সময় হয়নি। তাদের আচরণে অদ্ভূত গোপনীয়তা। অন্তত ভিক্ষুর কাছে তাই মনে হচ্ছে। কয়েক পা সামনে এগিয়েই তিনি খেয়াল করলেন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দু’জনে ফিস ফিস করে কথা বলছে। ভিক্ষু চোরা চাহনিতে তাদের দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা শুরু করলেন যাতে তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু মুহুর্তেই ভিখারিনী ক্ষিপ্র বেগে তার পথ আগলে দাঁড়াল।

সকাল হওয়ায় রাস্তায় লোকজন কম। কেউ কেউ প্রাত্যহিক কাজে যোগ দিতে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। কতগুলো কুকুর রাস্তার ডাস্টবিনের ময়লা থেকে খাবার খুঁজে খাচ্ছে। ভিক্ষু এখনো হতবিহ্বল। ভিখারিনীর হাতের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কাঁধের কাপড়ে তৈরি ময়লা ঝোলার মধ্যে ভিখারিনীর হাত। ভিক্ষু ভাবছেন, কীভাবে এ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। এমন সময় ভিখারিনী তার স্বামীর দিকে তাকাল। মুহুর্তে স্বামীর কাছে ছুটে গেল। ভিক্ষু আরো ধন্ধে পড়ে গেলেন। বুঝতে পারছেন না, এই সুযোগে দ্রুত সটকে পড়বেন, না অপেক্ষা করবেন। তবে সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় লাগলো না। ভিক্ষু নিয়ম শৃঙ্খলাবদ্ধ, সন্ন্যাসব্রত, সুললিত মন্ত্রপাঠ আর আত্মনিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ। তিনি অপেক্ষা করে খেয়াল করলেন, ভিখারিনী তার স্বামীকে ক্রাচে ভর দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে সাহায্য করছে। স্বামীর এক পা খোড়া। ব্যাগের ভেতর রাখা ভিখারিনীর হাত এমনভাবে কাঁপছে যেন তা এখনই বেরিয়ে আসবে। আসলে ব্যাগের ভেতর কী? ছুরিও তো হতে পারে। কে জানে? ভিক্ষু ভাবেন – যদি তাই হয় তবে আমার গায়ে যা শক্তি তা দিয়ে এ দু’জনকে মোকাবেলা করতে পারব।
এবার সেই ম্যাজিক মুহুর্ত! হঠাৎই। যেন বিদ্যুৎচমক। না কোন ছুরি নয়। ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বেরিয়ে পড়ল। ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে নিখুঁতভাবে বাধা যাতে কোনভাবেই খুলে না যায়। ব্যাগের ভেতর ভাত। ভিখারিনী সতর্কতার সাথে ধরে আছে। এরপর সে এটিকে অত্যন্ত ভক্তি ভরে দু’হাত তুলে মাথায় ঠেকালো। এরপর স্বামীর হাত নিয়ে দু’জনে মিলে ভিক্ষুকে তা তুলে দিল। ‘দয়া করে এগুলো গ্রহণ করুন পুজনীয় ভিক্ষু’ কোনরকমে ভিখারিনী কথাগুলো আওড়াতে পারলো। দু’জনই খুব ভীত ও অস্বস্তিতে থাকলেও ব্যাগটা ভিক্ষুকে দেবার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। ভিক্ষু তাদের ময়লা হাতের দিকে তাকালেন। হাতের দানপাত্রটি খুলে ধরলেন। প্রভু বুদ্ধের অনুসারী হিসেবে ধনী বা গরিব, ছোট বা বড়, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বা নোংরা! সব ধরনের ভক্তদের জন্যই যেমনটি তিনি প্রতিদিন করে থাকেন। ভিখারি-দম্পতি দেখল আক্ষরিক অর্থেই খাবার ও দানসামগ্রীতে দানপাত্রটি ভর্তি। তারপরও কোনরকমে অপরিচ্ছন্ন হাত দিয়ে ভাতগুলো দানপাত্রে গুঁজে দিতে পারল।

ভিক্ষু যথারীতি স্বভাবসুলভ আশীর্বাদ করলেন। দু’হাত কপাল পর্যন্ত তুলে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানালেন। অস্বস্তিকর হলেও মুখে মেকি হাসিও ফুটে উঠলো। ভিক্ষু তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে নিজ গন্তব্যে এগুতে থাকলেন। মন এখনো কিছুক্ষণ আগের ঘটনায় আচ্ছন্ন। ভিখারি-দম্পতিকে আশীর্বাদ ও তাদের জন্য মেত্তা বা পরম করুণা, ভালবাসা ও দয়া কামনা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আনমনে পালি শব্দমালা সব্বে সত্তা আভেরি হন্তু বিড়বিড় করে আওড়াতে শুরু করলেন। সকল প্রাণি পরস্পর হিংসা থেকে মুক্ত থাকুক!

ভিক্ষু এবার তার নিজের জন্য শুভচিন্তা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে লাগলেন। দরিদ্র, অভাগী মানুষকে আমি আমার ভালোবাসাসিক্ত করুণা সব সময় দিয়েছি প্রভূ। আমি যেন আলোকিত মানুষ হতে পারি। আমার এই মহান কর্ম আমাকে পরমধর্মে পৌঁছুতে ভূমিকা রাখুক। আমি যেন ভবিষ্যতে পরমধর্মে পৌঁছুতে পারি। প্রার্থনার আগে তার এ আকাঙ্খার জন্য মনে মনে লজ্জিত হলেন। এ চিন্তা থেকে তিনি কিছু সময়ের জন্য বিরত থাকলেন।

ভিক্ষুর মনে আবার সেই চিন্তা ঘুরপাক খায়, এই ভিখারিদের মত অসহায় মানুষের প্রতি আমার ভাল কাজের ফল আমাকে আমার চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। আমি এই অনন্ত দুঃখময় জীবন থেকে মুক্ত হয়ে একজন অর্হৎ হব। আমার নির্বাণ হবে। এই তো আমার পরম প্রাপ্তি! সাধু!

ভিক্ষু দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভিখারি-দম্পতি রাস্তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তখন ভিক্ষুর মনে কী চিন্তা দোল খাচ্ছে তারা তার কিছুই জানলো না। শুধু এটুকু বুঝে শান্তনা পেল যে, তাদের দেয়া অর্ঘ ভিক্ষুর ভর্তি দানপাত্রের সাথে চলে গেছে।

‘তুমি অত দেরি করছিলে কেন?’ স্বামী স্ত্রীকে ভর্ৎসনা শুরু করল ‘আর একটু হলেই তিনি আমাদের ছেড়ে যেতেন। তুমি একটা হদ্দো বোকা!’ ‘তা ঠিক। কিন্তু আমার লজ্জা লাগছিল গো।’ স্ত্রী নিচু গলায় উত্তর দিল ‘আমাদের তো কেবল ভাত। আর তো কিছু দেয়ার মুরোদ নাই। দেখতে কেমন লাগে বলো?’

দিন বাড়ে। সূর্য মাথার ওপর উঠতে থাকে। গরমও বাড়তে থাকে। অন্য মন্দিরের ভিক্ষুদের মত ভিক্ষু নিজ মন্দিরে ফেরত আসেন। আর ভিখারি দম্পতি হাত ধরাধরি করে তাদের ভিক্ষা করার জায়গায় চলে যায়। লেনের উল্টোদিকে। প্রতিদিনের মত তারা লেনের পাশে বসে। স্ত্রী জুড়ি দিয়ে স্বামীর গাওয়া গানের সাথে তাল মেলায়। এই যৌথ সংগীতই পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষে চাওয়ার কৌশল। গানের বিনিময়ে ভিক্ষা। গান সবটাই যে শ্রুতিমধুর তা কিন্তু না। ভিক্ষা দেয়া না দেয়া পথচারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। তাই ভিক্ষা পাওয়া ও দেয়ার মধ্যে কোন ঠকানোর কোন সম্পর্ক নাই।

ভিখারির গাওয়া একটা গানে নানা রকমের গাছের নাম পাওয়া যায়। এসব গাছের শাখা, প্রশাখা, ফুল ও ফলের বেড়ে ওঠা, ছড়িয়ে পড়া, ঝিলিক দেয়া, আন্দোলিত হওয়া, নেচে উঠা, ঘুরপাক খেয়ে গতি পরিবর্তন করা, দোল খাওয়া ইত্যাদি গানের বিষয় আশয়।শিল্পী একই সুর ও অনুপ্রাসের গান গায়। প্রতিদিন গাওয়া হয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। এ লেন দিয়ে নিয়মিত চলাফেরা করা মানুষের কাছে বারবার শুনে তা পরিচিত হয়ে গেছে। পথচারীদের আকর্ষণের জন্য তাই শিল্পী তার গানে কখনো কখনো অনাবশ্যক শব্দ জুড়ে দেয়। কখনো কণ্ঠ বিকৃত করে। স্ত্রীর জুড়ির ঝুনঝুনানির সাথে নিয়মিত তার এ গান। এটাই তাদের ভিক্ষে চাওয়ার উপায়। ছুটির কোন বালাই নাই। কেবল দু’জনের কেউ অসুস্থ হলে তারা আর ভিক্ষে করতে পারে না। অসুস্থ দেখার তো আর কেউ নেই। রোগীকে ফেলে এসে একা ভিক্ষা করা যায় না।

লেনের পাশেই বৃদ্ধ এক তেঁতুল গাছ। গাছের ছায়ায় তারা বসতে পারে। সেখানে বসে না। রোদে বসে। এতে পথচারীদের সহানুভূতি বেশি আদায় করা যায়। এলাকায় তাদের কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীও আছে। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এ এলাকায় তারা ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদি নামে পরিচিত। আসল নামে কেউ ডাকে না। শরীরের খুঁত থেকে পরিচিত হওয়া নামেই তাদের ডাকতে ভালোবাসে মানুষ। দু’জনের কথা মাথায় আসলেই নাম দু’টো মানুষের ঠোঁটে আগে চলে আসে।

ভিখারি দম্পতি খবরের পুরাতন কাগজ অথবা সিমেন্টের খালি বস্তা পেতে তার উপর বসে ভিক্ষা করে। দু’জনেই পা দুটো সুন্দরভাবে মুড়ে বসে। কিছুদূর সামনেই একটা নামকরা কফির দোকান। এছাড়া কয়েকটি মুদি ও মনোহারির দোকান। দোকানে চাল, তরকারি, নুডল, মদ, কোমল পানীয়- এসব হরেক রকম জিনিস বেচাকেনা হয়। ভিখারিদের সামনে রাখা প্লাস্টিকের ভিক্ষাপাত্রটা সহজেই নজরে আসে। অনেক আগে তারা ভিক্ষাপাত্র হিসেবে নারকেলের মালা ব্যবহার করতো। প্লাস্টিক পাত্রের ব্যবহার সাম্প্রতিক। অনেকদিন ব্যবহারে ভিক্ষাপাত্রটি এক অদ্ভূত রং ধারণ করেছে। রাস্তার ধুলা, হাতের ময়লা আর কয়েনের সংস্পর্শে তার এ দশা। অনেকে কয়েন দেয় পকেটের ওজন কমানোর জন্য। কেউ দয়া ও করুণা পাওয়ার জন্য বা অন্য কোন কারণে। কারণ ভিখারি দম্পতির জানার দরকার পড়ে না।

অনেকে দুর্বল ও বৈকল্যের উদাহরণ দেখাতে ছেলেমেয়েদের এখানে নিয়ে আসে। পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চাদের নীতিকথা বোঝানোর জন্য ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদি। বাচ্চাদের বোঝানো হয় আগের কোন পাপের কারণে তাদের এ দশা। বাচ্চাদের বোঝানো হয় তারাও যদি তাদের মা বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তবে তাদের দশাও ভবিষ্যতে এমনটি হবে। নীতিকথার এটাই মোদ্দা কথা। আজ সকালে এক মা তার ছোট্র কন্যাকে এনেছেন। একই নীতিকথা বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ছোট্র শিশুটি এ সময় মনে মনে ভাবছে, আমার মা সবসময় বকবক করে। অতিরিক্ত কথা বলে। আমি চাই সে বোবা হয়ে যাক। আমার কান তখন মার চিল্লানিতে ঝালাপালা করবে না। ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদিকে দেখিয়ে মা মেয়েটিকে বলল, ‘চেয়ে দেখ ওদের।’ মেয়েটির কাছে ভিখারি দম্পতিকে খুব সুন্দর লাগল। তাদেরকে পুতুলের মত মনে হলো। যেন একটা পুতুল গান গাইছে আর আরেকটা পুতুল বাজনা বাজাচ্ছে। কী মজার!

ভিখারি দম্পতির কত রকমের খরিদ্দার। লেন দিয়ে কত জন আসে, কত জন যায়। পথচারীদের অনেকের কাছে তাদের গান প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম। যেমন রোদ, বৃষ্টি, বজ্রপাত। অনেকে তাদের প্রিয় মানুষের সাথে আলাপে মত্ত হয়ে চলে যায়, খেয়ালও করে না। অনেকে ঝুঁটঝামেলাহীন শান্ত পরিবেশ চায়। আবার কেউ গাড়ি আর মটরসাইকেলের বিকট আওয়াজের চেয়ে তাদের গান পছন্দ করে। তারপরও ভিখারি দম্পত্তিকে সব ধরনের খরিদ্দারের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সব বয়সের, সব লিঙ্গ, সব ধরনের কাজ ও আচরণের মানুষই তাদের খরিদ্দার। মজার ব্যাপার হলো, তাদের আবার কিছু ভক্তও আছে। এরা কয়েকজন সৌখিন শিল্পী। সামনের কফি শপে তাদের আড্ডা। আড্ডার বিষয় আশয় জীবন আর শিল্প থেকে শুরু করে ধরাধামের কোন কিছুই বাদ পড়ে না। গভীর দিব্যদৃষ্টিতে এমন সব বিষয়ের মাঝে তারা সৌন্দর্য খুঁজে পান যা হয়ত সাধারণ মানুষের চোখে মামুলি ব্যাপার। তাদের কাছে মুখের বচনে বা পোশাক আশাকে দারিদ্র্যের প্রকাশ এক দূর্দান্ত ব্যাপার। তারা এমনও চিন্তা করে, একদিনের জন্য হলেও যদি ভিক্ষা করতে পারত। ভিক্ষার পাত্রটি ভরে যেত, তবে মন্দ হতো না। অবশ্য সেক্ষেত্রে ভিক্ষার স্থানটি হতে হবে ভাল পরিবেশে- যেন অতি গরম কিংবা অতি ঠান্ডা না হয়। সকাল থেকে বিকেল, বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি। ঘড়ি দেখার বালাই নাই। সব ঘড়ির কাটাই এখানে সমান। ফলে ঘড়ি মেরামতও নিস্প্রয়োজন। আর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা? পানি ব্যবহারে কোন টাকা দিতে হয় না। কত মৌলিক আর সাদামাটা জীবন! তারা ভাবে, হাজার সমস্যায় জর্জরিত বড়লোকেরা ভিখারিদের এই সাদামাটা জীবন দেখতে পায় না। ভিখারিদের জীবন আসলেই স্বাধীন…!

শিল্পীরা এই সব ভাবনা ও অনুভূতি নিয়ে ফেরত যায়। তাদের ক্যানভাসে তা ফুটিয়ে তোলে। শিল্পকর্ম সাধারণ, স্বাভাবিক করার অনুপ্রেরণা পায়। এই অনুপ্রেরণা থেকে অনেকগুলো সুন্দর ছবি আঁকে। ছবিগুলো বাজারে বিকোয়ও সহজে। একটা ছবি ট্যারা দাদিকে নিয়ে। শেষ বিকেলের আলো ক্যানভাসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। দাদি হাস্যজ্জ্বল, প্রশান্ত। ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃদ্ধ তেঁতুলগাছটা ঝকমক করছে। দাদিকে রাজপরিবারের একজনের মত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার চোখ দু’টি জুড়িতে একদৃষ্টে নিবদ্ধ। সংগীত পরিচালকের একাগ্রতায় নিমগ্ন যেন এ দৃষ্টি…। বাস্তবে ট্যারা দাদি তার ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য দু’হাতে জুড়ি দুটোকে একে অপরের সাথে মেলাতে মাঝেমাঝে ভূল করে। একটার সাথে আরেকটা ঠিকমত লাগে না। তাল কেটে যায়। দাদি তার এই দুর্বলতা ভালই বোঝে। তাই এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য সবসময় সতর্ক থাকে। এটাই তাকে এই ভঙ্গিমা দিয়েছে। দাদিকে নিয়ে আঁকা ছবিটাতেও এ মর্মভেদী, সুতীক্ষ ছবি ফুটে উঠেছে যা হয়ত অন্যথায় ফুটে উঠতো না।মাঝে মাঝে এই শিল্পীদের সাথে লেখকেরাও আসে। অধিকাংশই প্রগতিশীল। দুনিয়া থেকে দারিদ্র্য দূর করতে তারা বদ্ধ পরিকর। শিল্পীরা চায় না লেখকেরা তাদের ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদির বিষয়ে আগ্রহ দেখাক। এমনকি তারা লেখকদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করতেও চায় না। ভিক্ষুক দম্পতি যেন কেবল শিল্পীদের সম্পদ। লেখকদের সাথে এর ভাগ দিতে তারা হিংসা বোধ করে। কিন্তু একদিন এই লেখকদের একজনের হাতে ভিক্ষুক নামে একটা বই দেখা গেল। লেখকের দাড়ি সুন্দরভাবে কামানো। দেখতে বেশ চেকনাই গোছের। বইটির প্রচ্ছদ ভরা শিরোনাম। তার নিচে অনেকগুলো হাত। হাতগুলো ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। নারকেলের মালাতে এই হাতগুলো পয়সা দিচ্ছে। মালাটা একজন দুঃখী মানুষ ধরে আছে। বইয়ের লেখক দেতো হাসি দিয়ে জানালেন, বইটা সদ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছে। এ পুরস্কার তাকে খ্যাতিমান করে তুলবে। বইটি বিষয়বস্তু জানতে চাইলে লেখক লজ্জাবনত হয়ে বললেন, সমাজে মানুষের মধ্যে যে বৈষম্য ও অবিচারের সমস্যা রয়েছে তা বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদের মতামত তোয়াক্কা না করে একজন পানাহারের আহ্বন জানাল। তাই সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া উপলক্ষে পার্টি শুরু হয়ে গেল। পার্টিতে মজা ও হই হুল্লোড়ের ছড়াছড়ি। লেখকের কাছ থেকে জানা গেল, তিনি বইটির রসদ পেয়েছেন এ এলাকা থেকে। বাস্তবে লেখক দাদু-দাদিকে ইঙ্গিত করলেন। দাদু-দাদি তখন নিত্যদিনের মত অদূরে বসে ভিক্ষার জন্য গান গাইছিল।

‘ঐ দু’জনই হলো আমার গল্পের উপজীব্য- প্রধান চরিত্র’ লেখক শান্তভাবে জানালেন। ‘তুমি ভাই তোমার বইয়ে ওদের একজন কন্যাসন্তান রাখতে পারতে। আর কন্যার হাতে গিটার ধরিয়ে দিতে। একজন গায়িকা অভাবের তাড়নায় দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছে এ রকম রগড়ানো ঘটনা থাকলে পাঠকের কাছ থেকে আরো সহানুভূতি পেতে।’ আড্ডার ভেতর থেকে একজন ফোঁড়ন কাটল। কিন্তু তার কথায় কেউ কান দিল না। পার্টি চলতে থাকল। সকলেই ধীরে ধীরে মাতাল হয়ে পড়ল। তাই বাড়ি ফিরতে তাদের দেরি হয়ে গেল।

ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদির ভিক্ষে করার জায়গায় অনেক রকমের খরিদ্দার ও অখরিদ্দার আসা যাওয়া। কখনো কখনো ঝগড়ুটে দম্পতি আসে। এলাকায় এদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। অতি উচ্চ স্বরে তারা চিৎকার করতে থাকে। লেনের বহুদূর থেকে শোনা যায়। লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দিতে থাকে। অনেকে দাদু-দাদিকে খেয়াল না করেই ঝগড়া করতে করতে তাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। তারা লক্ষ করে না তখন হয়ত ল্যাংড়া দাদু তার জীর্ণ-শীর্ণ হ্যাট দিয়ে সুর্যের প্রচন্ড তাপ থেকে ট্যারা দাদিকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছে। এই ছেঁড়া হ্যাটই রোদ থেকে তার স্ত্রীকে বাঁচানোর ঢাল। দাদু তখন প্রচন্ড গরমে পুড়ে ছারখার।

একই রকমের ঘটনা দেখা যায় বৃষ্টির সময়ও। তখনও দাদু তার হ্যাট দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে দাদিকে রক্ষা করছে। আবার যখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয় তখন দু’জনই বৃষ্টিতে ভেজে। এতে শরীরও ঠান্ডা হয় গায়ের ময়লা কাপড়চোপড়ও পরিস্কার হয়।
বৃষ্টি প্রচন্ড হলে তারা কোন দোকানের শেডের তলায় আশ্রয় নেয়। অনেকেই বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে সেখানে জড়ো হয়। সুযোগে দাদু-দাদি গান জুড়ে দেয়। আয়ের আশায়। তাদের একটা গানে এক গাদা জন্তু জানোয়ারের নাম পাওয়া যায়। ময়ূর, হরিণ, শজারু, ভালুক, শুকুর ইত্যাদি। এ জন্তু-জানোয়ারের নাম পর পর ছন্দোবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। প্রচলিত অনুপ্রাসে লেখা। শুধুই শব্দের খেলা। অনেক ঘটনার সমাবেশ। একটার সাথে আরেকটার সম্পর্ক নেহাত কম। অর্থ বোঝা দায়। যদিও রস ও নাটকীয় আবহ তৈরি হয়। গানের এক পর্যায়ে এক হরিণী গর্ভবতী হলে হরিণ তাকে ছেড়ে যায়। হরিণী একা হয়ে যায়। অসহায়। তখন শ্রোতা দর্শক হরিণীর জন্য ব্যথিত হয়।

সেদিন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। সম্ভবত গান পছন্দ হয়নি। কারণ যাই হোক, প্লাস্টিকের ভিক্ষাপাত্রটি সহসা এক বড় লাথি খেল। মুহুর্তে তা ডিগবাজি দিল। ভেতরের কয়েনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। ল্যাংড়া দাদু খুব সুন্দর চেহারার অল্প বয়সী এক মেয়েকে দেখল। মেয়েটি গর্ভবতী। তার পেট অতিরিক্ত উঁচু। শেষ সময় হয়ত। তার পেছনে বয়স্ক এক চাইনিজ। বাজারের কসাই। পেছন থেকে ছাতা ধরে আছে যাতে মেয়েটির গায়ে রোদ না লাগে। পরিস্থিতি সামলাতে দাদু ফিক করে হেসে দিল। তার আর কিইবা করার ছিল! ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েনগুলো গুছিয়ে পাত্রে রাখা শুরু করলো। দাদু চিন্তা করতে লাগলো: যদি মেয়েটি তার হতাশা ভিক্ষাপাত্রে লাথি মেরে দূর করতে পারে তবে সে তাই করুক। এভাবেই দাদুর চাইনিজ বুড়ো আর সুন্দর মেয়েটিকে নিয়ে মজার চিন্তা এগুতে থাকে। যদি মেয়েটি একটা কাল বাচ্চা জন্ম দেয়…।

তখন বাছা চাইনিজ খুড়ো, তুমি কী করবে? তুমি তো বুড়ো ব্যাটা। ভুড়ি ঝুলে গেছে বহুদুর। রক্ষিতা হিসেবে কোথায় খুঁজে পেলে এই মেয়েটাকে? মেয়েটা তো আকর্ষণীয়! লাস্যময়ী। সুন্দরী। এই ভূড়িওয়ালার তো এর জন্য একেবারেই যোগ্য না…।

প্রধান সড়ক থেকে এই লেনের দিকে কুড়িতলা কনডোমিনিয়াম। দেখে মনে হচ্ছে, আনন্দে উদ্বেলিত শিশুদের উড়ানো ঘুড়ির চেয়ে উঁচু এ ভবন। লেনটা প্রস্থ ও চওড়া। বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। কিছুদূর যাবার পর এটাকে আর লেন বলা যায় না। তারপর এক খন্ড জমি যা আসলে ভাগাড়-ময়লার স্তুপ। যেন হাইরাইজ স্ট্রাকচার। এখানে নানা কিসিমের বস্তি গজিয়ে উঠেছে। এখানকার এক বস্তিতে ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদির বাস। এছাড়া এখানে একটা খালি জায়গা পড়ে আছে। জায়গাটি ঘেরা। তারপর রেললাইন। এরপর বিস্তৃত মাঠ যা এখনো শহরের সীমানায় আসেনি। বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গাটা সিটি প্রশাসনের। যারা আশপাশের বস্তিতে যারা গাদাগাদি করে বাস করছে তাদের কাছে বড় বিস্ময় জায়গাটা কেন খালি পড়ে আছে। তবে এ খালি জায়গায় বিশেষ করে বর্ষায় নানান জাতের বুনো শাকসব্জি গজায়। সবজিগুলো সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। আশপাশের মানুষ তা পছন্দ করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতির দেয়া এ সবজি তুলতে বেড়ার অনেক জায়গা ভেঙ্গে গেছে।ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদি ভাগাড়ের পাশেই বাস করে। ছোট ঘর। দু’জনে কোনরকমে বাস করা যায়। টিনের ছাদ। টিনে মাঝে মাঝে ফুটো। নড়বড়ে কাঠের খুঁটি। দেয়াল তক্তার পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে তৈরি। ময়লার স্তুপ ও অন্যান্য জায়গা থেকে টুকিয়ে আনা হয়েছে। মাঝে মাঝেই ফুটো। ছেঁড়া মাদুর, ম্যাগাজিন, পোস্টার দেয়ালে সেটিয়ে ফাঁক বন্ধ করা হয়েছে। দিনের বেলায় বাইরে থেকে তা দেখে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের এক ছাত্র আপন মনে বলে উঠে: কী চমৎকার রঙের ধারনা, কী চমৎকার কোলাজ! এ রকম রঙিন বস্তিঘর থেকে রোজ দুর্বল বৃদ্ধ দম্পতি কাকভোরে বের হয়। ফেরত আসে সুর্যাস্তের পর যেমনটি পাখিরা নীড়ে ফেরে। সাথে আনে ভাত ও সয়া সস্। রাতের খাবার। তবে চাইনিজ নববর্ষের সময় দোকানীরা প্রায়ই ভাতের সাথে হাঁস বা মুরগীর হাড় দেয়।

সারাদিন এই বৃদ্ধ দম্পতি রাস্তাঘাটের কত ঘটনারই সাক্ষী হয়। কেবল যানবাহনের কথায় ধরা যাক। এ যেন এক অন্তহীন প্রদর্শনী। ট্রাক, বাস, মোটর সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, বাইসাইকেল, খালি দুধের টিন দিয়ে বানান খেলনা গাড়ি। আর বিলাসবহুল প্রাইভেট কার? কখনো যদি এসব দামি প্রাইভেট কারের জানালার কাঁচ নামানো থাকে, তবেই পথচারীদের সাথে এসব কারের যাত্রীদের চোখাচোখি হওয়ার সুযোগ হয়। এ লেন দিয়ে দামি গাড়ির চলাচল ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদি দু’জনই খেয়াল করে। আজ বিকেলে তারা যে বিলাসবহুল গাড়িটি দেখছে, তা অন্য যেকোন দামি গাড়ি থেকে আলাদা। আধুনিক, নতুন, রোমাঞ্চকর। দেখতে অনেক বেশি লাগসই স্মার্ট। মসৃণ, চকচকে। আলোর রোশনাই ছড়াচ্ছে। যেন আধুনিক রূপকথার কোন গল্পের গাড়ি। টেম্পেল উৎসবে বড় বড় স্ক্রিনে বাইরে থেকে দেখা যায়। গাড়ির হর্ন দাদু-দাদির গান ও জুড়ির আওয়াজকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা চলা শুরু করলে সব কিছু দ্রুত সরিয়ে নেয়া হচ্ছে যাতে গাড়িটি জায়গা পায়। যে যুবক গাড়িটা চালাচ্ছে সে গাড়ির রঙচঙা জানালার কাঁচ নামিয়ে চিৎকার করছে ‘সামনে থেকে দ্রুত সরে দাঁড়াও, নইলে কিন্তু গায়ের ওপর চালিয়ে দেব।’ কিন্তু গাড়িটার সামনে পার্কিং করা আরেকটা গাড়ি পড়ে যাওয়ায় থেমে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না। ফলে যুবককে অপেক্ষা করতেই হলো। গাড়িটার জানালার কাঁচ তখনো নামানো। ফলে ট্যারা দাদি যুবকটির পাশে বসা মেয়েটিকে দেখার সুযোগ পেয়ে গেল। মেয়েটিকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। কী অপরূপ সুন্দরী! দাদি মনে মনে ভাবল, আমি এর আগে এতো সুন্দরী মেয়ে দেখিনি। কী নিখুঁত! এমন সময় মেয়েটি দাদির দিকে ফিরে তাকালো। একে অপরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটির ভঙ্গি ভাবলেশহীন। কিন্তু তারপরও মেয়েটিকে দেখতে মোহনীয় লাগলো। মেয়েটি যুবকটিকে কী যেন বলল। যুবকটি ভ্রুকুটি করলো। মেয়েটি দাদির দিকে আবার তাকাল। কাছে আসার জন্য ইশারা করলো। দাদি মেয়েটির ইশারায় সাড়া দিয়ে গাড়িটার জানালার কাছে গেল। দাদি অস্বস্তিকর হাসি দিল। মেয়েটি দাদিকে পাঁচশ’ বাথের একটা নোট গুঁজে দিল। কিন্তু মুখে কোন কথা বললো না। গাড়িটার কাঁচ তুলে দেয়ার আগে ভেতরের এয়ারকন্ডিশন ও সুরভিত সেন্টের গন্ধে দাদির ইন্দ্রিয় আবেশে ভরে গেল। গাড়িটা যাবার পর তার ধোঁয়ায় সেই সুন্দর গন্ধ বিলীন হয়ে গেল। নাক ও চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিল। কিন্তু দাদির কাছে এর কোনটিতেই কিছু আসে যায় না। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় এখন সে মগ্নœ হয়ে আছে।

গাড়িটা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কেউ বলছে ‘এই তুমি কি ঘটনাটা দেখেছ? দাদিকে মেয়েটি পাঁচশ’ বাথ দিয়েছে।’ কেউ বলছে ‘মেয়েটিতো বড় গায়িকা। সেলিব্রেটি। বিশাল তারকা।’ কেউ বলছে ‘বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী। এই ক’দিন আগে নতুন রেকর্ড বেরিয়েছে। সর্বাধিক বিক্রিত।’… ইত্যাদি।

ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দু’জনই তাতে মজা পাচ্ছে। ‘তাই নাকি, তাই নাকি’ বলে দাদি হাসছে ‘তাই তো ম্যাগাজিনে মেয়েটির ছবি দেখেছি। এখন মনে করতে পারছি মেয়েটি কে। আমি ওর ছবি দেয়ালে ঝুলিয়েছি।’
দাদি তার পাঁচশ’ বাথ উঁচিয়ে ধরে সবাইকে দেখাচ্ছে। ‘গাড়িটার নাম্বার তো টুকে রাখতে পারতে’ ন্যাংড়া দাদু দাদির সাথে আনন্দে রসিকতা করছে ‘ঐ নাম্বারের একটা লটারি কিনতাম।’
‘তোমার যা ইচ্ছে বলে যাও’ দাদিও কম যায় না, ফোঁড়ন কাটে ‘খালি আমার কাছ থেকে টাকাটা চেওনা।’ দাদির হাসি যেন আর থামে না। ‘পাঁচশ’…’ দাদি বেগুনী রঙের নোটটা ধরে বিড়বিড় করতে থাকে। এমনভাবে উঁচিয়ে ধরে যেন নোটটা প্রাণ পায়। জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে মেয়েটির আরো সম্পদ, আরো সুখ, আরো সাফল্য কামনা করতে থাকে। চিন্তা করে, তুমি এত বড়, এত বিখ্যাত তারপরও এই গরিব রাস্তার পাশের ভিখারির কথা চিন্তা কর। মেয়েটির কথা ভেবে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। এতগুলো টাকা দিয়ে কী কী কিনবে তার একটা বড় তালিকা চিন্তা করতে থাকে। মাছের সস দিয়ে তালিকার শুরু হয়। সুস্বাদু মাছের সস। কয়েক বোতলই কিনে ফেলবে! এর সাথে থাকবে ভাত। মন্দিরের ভিক্ষুকে এবার মাছ-ভাত দেয়া যাবে। দাদি তার জুড়িটার দিকে তাকায়। জুড়িটাকে আজ উজ্জ্বল ও নতুন লাগে। তাই কী!

ল্যাংড়া দাদু আর ট্যারা দাদির বসার লেন পার হয়ে দামি গাড়িটা বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। উদ্দেশ্য সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্ট। ‘আমি তোমায় নিয়ে চিন্তিত মি’ যুবকটি বলে ‘তুমি সবসময় অদ্ভুত কান্ড করে বসো।’ যুবকটি আদও কওে মেয়েটিকে সংক্ষেপে মি নামে ডাকে।
‘এর মাঝে আবার অদ্ভ‚ত কান্ড আবার কী দেখলে! আমার জন্মদিনে এর চে’ আর বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে। যখন বৃদ্ধা পাঁচশ’ বাথের নোট দেখলো, তখন তার চাহনি তুমি দেখনি। ও প্যাট, তোমার ওটা দেখা দরকার ছিল। আমি ওরকম অভিব্যক্তি দেখার জন্য লক্ষ বাথ দিতেও রাজি। এ অভিব্যক্তি ধরে রাখার জন্য তোমার সাথে ক্যামেরা রাখা উচিত। যাতে পরে দেখতে পারি। আমাকে তখন ক্যামেরার সামনে কেমন দেখাবে?’ মেয়েটি এভাবে বকবক করতে থাকলো। কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ, আরো আক্রমণাত্মক হতে থাকলো। যুবকটি অগত্যা অবিশ্রান্ত হয়ে শুনতে লাগলো। মাঝে মাঝে মেয়েটার কথায় মুচকি হেসে সায় দিতে থাকলো। এমন ভাব দেখাতে থাকলো যাতে বোঝা যায় মেয়েটির আবেগে সায় দিচ্ছে। ‘কী অদ্ভুত!’ মেয়েটা বলতে থাকে ‘সামান্য পাঁচশ’ বাথ। অথচ এই সামান্য কটা টাকা কীভাবে আরেকজনের কাছে বিশাল অঙ্কের টাকা বলে মনে হতে পারে। তা নির্ভর টাকাটার মালিকের আর্থিক অবস্থার ওপর। কী মজার ব্যাপার, তাই না!’

মেয়েটির মুখ এখন গাড়ির জানালার অন্ধকার কাঁচের দিকে। বাইরে কিছু দেখছে না। বরং বাড়িতে তার কাপড়চোপড়ের কথা চিন্তা করে। পোশাক, জুতা, ব্যাগ, গহনা, প্রসাধন। কত ধরনের। কত রকমের। কত দামের। কতগুলো আজো ব্যবহারই করা হয়নি। এমনকি কতগুলোর প্যাকেট আজো খোলাও হয়নি। খেয়ালের বসে কেনা। মেয়েটির কাছে প্রাচুর্য সীমাহীন। মানুষ যেমন বেঁচে থাকার জন্য পানি পান করে, কোন স্বাদ টের পায় না। জীবনধারণের জন্য এটি অপরিহার্য। ‘তবে টাকা থাকাই ভাল’ যুবকটি মৃদু হেসে মেয়েটির অনুভূতি খেয়াল করে বলে ‘যখন কেউ নিজেকে সাধু ভাবে তখনো সে টাকা ঢালে। টাকা থাকলে সুখ কেনা যায়। যেমন টাকা দিয়ে সুপারমার্কেট থেকে দামি জিনিষ কেনা যায়। লক্ষী মি আমার। তুমি আমার কাছে অন্যায়ভাবে সুযোগ নিয়েছ। এসো আমরা ওদের বড় হতে দিই কারাবাও ব্যান্ডের এ গানটা গাই। হাল্কা হই। আনন্দে গা ভাসাই।’

‘বোকার মত কথা বলো না।’ মেয়েটি রুক্ষ দৃষ্টিতে যুবকটির দিকে তাকায়। যুবকটিকে ঘুষি মারতে উদ্যত হয়। যুবকটি মেয়েটার আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচায়। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সুন্দর একটা গানের রেকর্ড চালিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটা স্বপ্নের রাজ্যে চলে যায়। ঘুমের ঘোরে মাথা নাড়াতে থাকে। সে চায় সংগীত তার সত্তার মধ্যে ঢুকে যাক। যুবকটি যেন তাকে বুঝতে পারে। কিন্তু যুবকটি উল্টো মেয়েটার হালকা মেজাজে বিরক্ত হয়। সব সময় মেয়েটার কিছু ভূল খুঁজে পায়। কিন্তু তার শিশুসুলভ ভাল লাগাকে অগ্রাহ্যও করতে পারে না। গাড়ি এখন হাইওয়েতে চলছে। গ্রামের মাঠ, খাল পার হচ্ছে। অনেক ভিখারি ও মানুষ পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার মত শহরটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে দূরে যাচ্ছে।

মেয়েটি চোখ বন্ধ করে অত্যন্ত নরম গলায় বলে ‘… এতো গরিব মানুষও আছে।’
‘ওদেরকে দয়া করে গরিবই থাকতে দাও’ যুবকটি সুযোগে চট জলদি জবাব দেয়। গলায় তার ঝাঁজ। ‘চুপ করো’ বলে মেয়েটা ফুঁপিয়ে ওঠে। ঠোঁটে তার অস্বস্তিকর হাসি।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত