অন্ধদের হাডুডু খেলা

Reading Time: 3 minutes

এক স্নিগ্ধ বিকেলে রুম হতে বের হয়ে নরম পায়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা খোলা জায়গায় লোকজনের জটলা দেখে থেমে পড়ি। ভিড়ের কাছে গিয়ে আশেপাশের লোকজনের কাছে ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করে কোন সাড়া না পেয়ে অবশেষে ভিড় ঠেলে একেবারে সামনের কাতারে চলে এসে দেখতে পাই অন্ধদের হাডুডু খেলার বিরতি চলছে। কোর্টের মধ্যে দর্শকরা যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কোর্টের চারদিকে বাঁশের বেড়া।

আয়তাকৃতির বাঁশের বেড়ার তিনপাশ ঘিরে আছে ছেলে-পুরুষের দল আর একপাশ সংরক্ষিত নারী- শিশুদের জন্য। পুরুষদলের চিৎকার-চেচামেচি এবং হল্লা-কোলাহল নারী-শিশুদের কমনীয় গুঞ্জনকে যেন গলা চেপে ধরেছে। ছেলে-পুরুষের দল নিজ নিজ সমর্থিত দলের খেলোয়ারদেরকে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। তবে অন্ধ খেলোয়াররা দর্শকদের দিক-নির্দেশনার প্রতি বধিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ- নিজেদের মধ্যে খোশ আলাপে মগ্ন।  দুই দলের সমর্থকরা তাদের বিপক্ষ দলকে দোষারোপ করছে এই বলে যে দলটির কয়েকজন খেলোয়ার অল্প অল্প চোখে দেখে- এটা নাকি ঐ সুনির্দিষ্ট খেলোয়ারদের গতিবিধিই বলে দিচ্ছে। তাদের দাবী ঐ তথাকথিত অন্ধদের চোখ যাতে গামছা দিয়ে কষে বেঁধে দেয়া হয়। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে এই নিয়ে বিবাদ শব্দ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোন ফল বয়ে আনছে না।

দুই পক্ষের অন্ধ খেলোয়াড়রা নির্বিকারভাবে বিশ্রাম নিচ্ছে- খেলায় জেতার কৌশল নিয়ে তাদের মধ্যে নেই কোন ধরনের সলাপরামর্শের ছিটেফোঁটা। সত্যি বলতে, খেলায় হারজিত নিয়ে তারা মোটেই উদ্বিগ্ন নয়- লোকজন আমোদ পাচ্ছে এতেই তারা সন্তুষ্ট। আমি নিজেকে ভিড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই পুনরায় খেলা শুরু হয়ে গেল। অন্ধ খেলোয়াড়রা নিজ নিজ কোর্টে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই তাদের মুখে লেপ্টে থাকা নির্বিকারভাব বাতাসে মেঘ সরে যাওয়ার মত করে কেটে গিয়ে ফুটে উঠে এক ধরনের খেলোয়ার সুলভ আক্রমনাত্বক ভাব তারপর তাদের অঙ্গভঙ্গির মধ্যে তা মাটিতে মার্বেলের গড়িয়ে যাওয়ার মত করে ছড়িয়ে পড়ে।

রেফারীর বাঁশি তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় খেলা: এক দলের বেশ শক্তসমর্থ একজন অন্ধ খেলোয়ার অপর দলের কোর্টের কিছুটা ভেতরে ঢুকে দম(টক, টক, টক,….) দিতে থাকে- দম দিতে দিতে সামান্য আগায় আবার খানিকটা পিছায়, এরপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দম দেয়, বাম হাত প্রসারিত করে আর ডান হাত ঝুলিয়ে রেখে বাম পাশে সরে আসে আবার ঠিক একই ভাবে ডান হাত প্রসারিত করে বাম হাত ঝুলিয়ে রেখে ডান পাশে ফিরে আসে- এই গতিবিধির সাথে তাল মিলিয়ে তার অন্ধ ঘোলাটে চোখ দুটোও উঁকি ঝুঁকি মারে । ওদিকে অপর দলের খেলোয়াড়রা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে একবার উবু হয়ে দুই হাত দিয়ে মাটি চাপড়ায়, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতের তালু ঘষে। এই কাজটি তারা বারংবার করতে থাকে। ধুলা লেগে থাকা হাত দিয়ে ঘেমে পিচ্ছিল হয়ে উঠা প্রতিপক্ষকে জাপটে ধরলে সে সহজে সটকে যেতে পারবে না। উপরন্তু, দুই হাত দিয়ে মাটি চাপড়ানো যুদ্ধের ময়দানে দামামা বাজানোর মত- এতে তাদের শরীর ও মনে জোশ খরায় আটকা পড়া পুটি মাছের মত লাফিয়ে উঠে।  যাহোক, একপর্যায়ে খেলোয়াড়রা মাটি চাপড়ানো এবং হাতের তালু ঘষার কথা ভুলে গিয়ে শুধু উঠবস করতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে তারা এই উঠবসের মধ্যে এমনই আত্মস্থ হয়ে পড়ে যে বাদ-বাকী সব কিছু ভুলে যায়। ফলে খেলার শুরুতে তাদের মুখ ও শরীরে যে আক্রমনাত্বক ভাবের সঞ্চার হয়েছিল তা নিঃশোষিত হয় এবং পুনরায় আসীন হয় নিরীহ ভিক্ষুক ভাবটি। প্রথম প্রথম তারা মাটিতে হাত চাপড়ানোর পর সটান উঠে দাঁড়াত আর এখন মাটিও চাপড়ায় না আবার উঠেও দাঁড়ায় কুঁজো হয়ে।

হঠাৎ করে, কোর্টের এক কোনায় দাঁড়িয়ে উঠ-বস করতে থাকা এক বলশালী খেলোয়ার এক ঝটকায় তার সকল নিরীহপনা ঝেড়ে ফেলে দম দিতে থাকা খেলোয়ারটিকে ছাড়িয়ে অর্ধবৃত্তাকার এক দৌড়ে অপর পাশের কোনায় নিশ্চিন্ত মনে উঠ-বস করতে থাকা নিজ দলের একজনকে গড়মড়িয়ে ধরে এক লাফে কোর্টের বাইরে গিয়ে আছড়ে পড়ে ভূতল কাঁপিয়ে দেয়। আর সাথে সাথে একই দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রা ঐ দুজনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং একে অপরকে বিপক্ষ দলের খেলোয়ার মনে করে তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে জাপটে ধরে। ওদিকে দম দিতে থাকা অন্ধটি সামনের দিকে মুখ রেখেই পিছন হেঁটে নিজেদের কোর্টে ফিরে এসে ধপাস করে বসে পড়ে। ধৃত হওয়া জন যতই জাপটে ধরা জনকে বলছে আমি তোমার দলের, জাপটে ধরা জন এটাকে চাতুরী ভেবে তাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরছে। ফলে সকলে কথা বলা বন্ধ রেখে স্প্রিং এর মত করে প্যাঁচিয়ে উঠে নিজেকে অপরের হাত থেকে ছাড়ানোর এবং ছাড়া পেলে আরেকজনকে ধরার চেষ্টায় আক্রান্ত উঠেছে। কেউ কোনক্রমে ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথে অন্য আরেকজন তাকে পুনরায় জড়িয়ে ধরছে বা সে নিজেই ছাড়া পাওয়া আরেক জনকে, আরেক জনকে ধরে থাকা কাউকে বা কারো হাতে ধৃত হওয়া কোন একজনকে পাছরাইয়া ধরছে। ঘেমে তেলতেলে হয়ে উঠা কাছা মারা কালো কুচকুচে অন্ধ ভিক্ষুকদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকা এবং একে অপরের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার দুরন্ত প্রচেষ্টা অথবা মুক্ত হওয়া মাত্রই আরেকজনক আঁকড়ে ধরা বা আরেকজন কর্তৃক ধৃত হওয়া ওরা যেন নিজেদের শরীরের আঠায় পরস্পরের সাথে আটকে গিয়ে কিলবিল করতে থাকা এক দলা কেঁচো।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>