অন্নদাশঙ্কর রায়

ছোটবেলা থেকেই অসংখ্য বই ও অজস্র পত্রিকা পড়ে আমারও সাধ যেত লিখতে। কিন্তু কী লিখব, কেমন করে লিখব, যা লিখব তার অর্থ কী, এসব আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। বারো বছর বয়সে আমার হাতে পড়ে স্কুলের কমন রুমের পত্রিকার আলমারির চাবি। ক্লাস পালিয়ে কমন রুমে যাই, আলমারি খুলি, যত ইচ্ছা পড়ি। যতদূর মনে পড়ে ‘ভারতী’তে তখন চলছে অবনীন্দ্রনাথের ‘নালক’ আর চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্রোতের ফুল’। ‘সবুজ পত্রে’ রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ আর প্রমথ চৌধুরীর ‘চার-ইয়ারি কথা’। আরো একরাশ পত্রিকায় তখনকার দিনের বড়ো বড়ো লেখকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ি? আমার নেশা ধরে যায়।

সেই বয়সেই আমার চোখে পড়ে ‘আর্ট’ বলে একটি কথা। ‘সবুজ পত্রের’র পাতায়। কথাটা মনে গেঁথে যায়। তার মানে কী তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু সাহিত্যে তার নমুনা কী সেটা তো আমার চোখের সামনেই ছিল। রূপকে বাদ দিয়ে সার নয়, সারকে বাদ দিয়ে রূপ নয়। তখন থেকেই আমার নজরন রয়েছে রূপের উপরে, মন রয়েছে সারের উপরে। বলতে গেলে বারো বছর বয়সেই আমার উপনয়ন হয়। আর্টের গুরুগৃহে উপনয়ন। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী এঁদের কাছেই আমার শিক্ষানবিশি শুরু হয়। একটি জিজ্ঞাসার উত্তর পাই। কেমন করে লিখব? কেমন করে লিখলে আর্ট হবে?

কিন্তু তখনও আমার বাকি ছিল জানতে, কী লিখব? অত কম বয়সে জানাও যেত না। প্রশ্নটা সে বয়সে জাগবার কথাও নয়। ষোল বছর বয়সে আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয় টলস্টয়ের ‘টোয়েন্টি থ্রি টেলস’। তার একটি গল্প আমি সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে ‘প্রবাসী’তে পাঠিয়ে দিই। চারু বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন যে গল্পটি মনোনীত হয়েছে। পরের সংখ্যা খুলে দেখতে পাই ‘তিনটি প্রশ্ন’। টলস্টয়ের সঙ্গে আমার নাম এক অদৃশ্য সূত্রে জড়িত হয়। তখনও জানতুম না যে এটা আকস্মিক নয়। টলস্টয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পরে আরো ঘনিষ্ঠ হবে। বছর-তিনেক পরে যখন আমি কলেজের ছাত্র তখন লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়ি তাঁর ‘হোয়াট ইজ আর্ট’। বইখানা আমাকে খুবই নাড়া দেয়। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় সাহিত্য আমি তন্ময় হয়ে পড়েছিলুম। টলস্টয়ের বিচারে ওর বেশিরভাগই আর্ট নয়, কিংবা আর্ট হিসেবে খাটো। আর্ট তাহলে কী? আমি যদি আমার শিক্ষানবিশি সমাপ্ত করে সাহিত্যিক রূপে আত্মপ্রকাশ করি তা হলে আমি কী কী লিখব? কী নিয়ে লিখব? এর উত্তর এককথায় , সত্য লিখব। সত্য নিয়ে লিখব। টলস্টয় উদ্ভাবন পছন্দ করতেন না। মস্তিষ্ক থেকে যা উৎপন্ন তার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অলঙ্করণেরও বিরোধী। যে যা অনুভব করেছে তা সরলভাবে প্রকাশ করবে, সহজ ভাষায়। তিনি নিজেও শেষ বয়সে সেই সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।

তবে টলস্টয়ের শেষ বয়সে ছিল এক নীতিবাতিক। তাঁর সুনীতি কুনীতির মাপকাঠি মেনে নিরে সাহিত্য বা আর্টের রাজ্য থেকে জীবনের পনেরো আনা বাদ দিতে হয়। কারণ সেটা ভালো নয়, মন্দ। শাদা নয়, কালো। জীবনকে যেমন ভালো আর মন্দ, শাদা আর কালো, এই দুইভাগে বিভক্ত করা যায় না, করলে করলে দুটোকেই স্বীকার করতে হয়, তেমনি সাহিত্যকেও। আর্টকেও। এটা ছিল টলস্টয়ের সমসাময়িক পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়ে আমার প্রত্যয়, তাই টলস্টয়ের সত্যের উপর জোর আমি মেনে নিলেও নীতির উপর জোর মেনে নিতে পারিনি। যে টলস্টয় আর্টিস্ট তাঁরই অনুসরণ করেছি। যিনি মরালিস্ট তাঁর নয়। নীতিবোধে যে আমার ছিল না তা নয়। সংসারের বিনিময়ে আত্মাকে বিক্রয় করা আমার চোখে চুড়ান্ত কুনীতি। কিন্তু সাহিত্যমাত্রেই হবে সুনীতিসম্মত এতে আমার রসবোধ সায় দেয়নি। আর্ট যদি শুধু পাপের শাস্তি আর পুণ্যের পুরস্কার বন্টন করতে নিযুক্ত থাকে তবে তাকে ফিরে যেতে হয় পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের পূর্ববর্তীকালে। রেনেসাঁস থেকে আধুনিক যুগেরি সূচনা। তাই রেনেসাাঁসকে আমি মনেপ্রাণে বরণ করেছিলুম। পাশ্চাত্য বলে বর্জন করিনি, আধুনিক বলে গ্রহণ করেছিলুম। ‘সবুজ পত্র’ আমাকে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল। যদিও কোনোদিন তাতে লিখিনি।

কিন্তু ‘সবুজপত্র’ ছিল বিদগ্ধজনের জন্য। জনগণের জন্যে নয়। অসহযোগ আন্দোলন আমাকে বিদগ্ধ মহল থেকে জনগণের অভিমুখে নিয়ে যায়। চরকা কাটতে না পারি, এমন কিছু কি পারিনে যা জনগণের জন্যে? কিন্তু একটি জায়গায় বাধা ছিল। যেটা লিখব সেটা বিদগ্ধজনের বিচারেও রসোত্তীর্ণ হওয়া চাই। সেটা যদি আর্টই না হয় বা খাঁটি আর্ট না হয় তাহলে শুধু জনগণের স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়। লেখা যদি রূপভ্রষ্ট হয়, বক্তব্য যদি জলমেশানো হয় তাহলে জনগণ তো সঞ্চয় করে রাখবেই না, মহাকাল তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে। তবে আমি স্থির করি যে, অর্ধেক পথ আমি যাব জনগণের দিকে আর অর্ধেক পথ ওরা আসবে আমার দিকে। মাঝপথে দেখা হবে।

কাদের জন্য লিখব, এরপরের প্রশ্ন কিসের জন্য লিখব? কেউ বলতেন মানবকল্যাণের জন্যে, কেউ সমাজসংস্কার বা সমাজবিপ্লবের জন্যে, কেউ নৈতিক উন্নয়নের জন্যে, কেউ দেশ উদ্ধারের জন্যে, কেউ মনোরঞ্জনের জন্যে, কেউ লোকশিক্ষার জন্যে। কেউ বা ধর্মপ্রচার বা মতবাদ প্রচারের জন্যে। একালের লেখকদের মতো সেকালের লেখকদের কাঞ্চনভাগ্য তেমন প্রসন্ন ছিল না। তাই কেউ বুক ফুলিযে বলতেন না, টাকার জন্যে। টাকা যাঁরা নিতেন তারা লজ্জার সঙ্গে নিতেন। রম্যাঁ রলাঁ আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, কখনো টাকার জন্যে লিখবে না। আমি তাঁর সেই উপদেশ শিরোধার্য করেছিলুম। কিন্তু আর্টের জন্যে আর্ট এই তত্ত্বে তিনিও বিশ্বাস করতেন না। আমি কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষপাদের ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের মতো বিশ্বাস করতুম যে, আর্টের জন্যেই আর্ট। অর্থাৎ আর্ট আর কারো মীনস নয়, নিমিত্ত নয়। সে নিজেই একটা এন্ড বা উদ্দিষ্ট। ধর্মের প্রতি তার ভক্তি থাকতে পারে, নীতির প্রতি শ্রদ্ধা, সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব থাকতে পারে, দেশের প্রতি কর্তব্য, মনোরঞ্জনেও তার আনন্দ থাকতে পারে, লোকশিক্ষায় পরিতৃপ্তি, কিন্তু তাই বলে সে কারো প্রজা নয়। সেও একজন রাজা। পাঠকরা তাকে যা দেন তা একপ্রকার নজরানা। প্রকাশকরা দেন রয়ালিটি।

এর পরের প্রশ্ন, আর্টের সার্থকতা কী? আদৌ লিখব কেন? সৃষ্টি করব কেন? কে এমন মাথার দিব্যি দিয়েছে যে আমাকে আর্টের জন্য আর্ট করতে হবে? আমি তো ইচ্ছা করলে ইতিহাসও করতে পারি। যেমন গান্ধীজি করছেন, গান্ধীপন্থীরা করছেন, বিপ্লববাদীরা করছেন। আমি তো প্রশাসনও চালাতে পারি। যেমন আমার পুরোগামীরা করছেন। জীবনে করবার মতো কত রকম কত কাজ আছে, সেসব ছেড়ে সাহিত্যসৃষ্টি? এত গুরুত্ব যার সে তো আজ বাদে কাল বাসি হয়ে যেতে পারে, কেউ মেনও রাখবে না লেখকের নাম। তেমন নাটক বা তেমন উপন্যাস ক’খানাই বা লেখা হয়েছে যা সব সময় তাজা? সেই ক’খানার রহস্য কী? তার একখানাও যদি লিখতে না পারি তো কেন এই দুর্গম পথে যাত্রা, জনপ্রিয়তা বা অর্থপ্রাপ্তি যখন লক্ষ্য নয়? লক্ষ্য কি তবে নোবেল পুরস্কার ও নাইট উপাধি? বিশ্বব্যাপী যশ? বিশ্বময় সম্মান? কিন্তু অধিকাংশের কপালেই জুটেছে অনাদর, অবহেলা, লাঞ্ছনা, ব্যর্থতা ও অবলুপ্তি। আমিও হয়তো অধিকাংশেরই সামিল। কিন্তু কলম যতক্ষণ আমার হাতে আছে ততক্ষণ আমিও এ পৃথিবীর একজন প্রভু। কী থাকবে, কতটুকু থাকবে, সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, ওর সার্থকতা কী? কেন লিখব? েকেন সৃষ্টি করব? না করলে কী আসে যায়?

একজন হয়তো আপন মনে গান গেয়ে চলেছে। কিংবা দূরবর্তী আরেকজনের কানে পৌঁছে দিচ্ছে তার সুরের দূতীকে। প্রথম ক্ষেত্রে আর্ট হচ্ছে আত্ম আবিষ্কার। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আত্ম প্রকাশ বা পরিচিতি। তেমনি একটি তৃতীয় ক্ষেত্রও আছে। সেখানে আর্ট হচ্ছে জগৎ প্রকাশ বা পরিচিতি। যে জগৎ একজনের ভিতরে ও বাইরে। আট দশ হাজার বছর আগেকার গুহাচিদ্র পাওয়া গেছে। তাতে সেকালের গুহামানব তার আপনাকে প্রকাশ করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার চেনা জানা জগৎকে। সে যুগে রিলিজিয়ন ছিল কিনা বলা যায় না। কিন্তু আর্ট ছিল। আমরা ধরে নিতে পারি যে, যারা ছবি আ৭কত তারা গানও গাইত, নাচও নাচত। নাটক ও কাহিনী এসে থাকবে আরো পরে। ব্যালাড থেকে এপিক ও এপিক থেকে ক্লাসিক পর্যায়ে উপনীত হতে হাজার হাজার বছর লেগে থাকবে। একজন থেকে দু জন, দু জন থেকে হাজার জন যোগ দিয়েছে। এক একটি মন্দির গড়তে হাজার হাজার জন নিযুক্ত হয়েছে।

কিন্তু এহো বাহ্য। আমার কাছে আর্ট একটা অন্বেষণ। রিয়েলিটিকে আমি ধরতে ছুঁতে প্রাণপণ করেছি। প্রথমে আমার ইন্দ্রিয় ও মন দিয়ে, তারপর আমার লেখনী দিয়ে। এক একটা সুরকে, এক একটা ভাবকে, এক একটা ইঙ্গিতকে বা আভাসকে হরিণের মতো তাড়া করেছি। হরিণকে হয়তো পাইনি, তার বদলে হয়তো পেয়েছি শকুন্তলাকে। যে কথা লিখতে চেয়েছিলুম সে কথা লেখা হয়নি। হঠাৎ আপনা থেকে লেখা হয়ে গেছে অন্য কথা। কবিতার বদলে ভ্রমণকাহিনী। ভ্রমণকাহিনীর বদলে উপন্যাস। কখনো হরিণের বদলে শকুন্তলা, কখনো শকুন্তলার বদলে রাজ সিংহাসন। শকুন্তলা এসে উপেক্ষিতা হয়ে ফিরে গেছে। আর্টের অন্বেষণ রাজকার্যের খাতিরে কতবার যে স্থগিত রাখতে হয়েছে তার ঠিক নেই। কিন্তু সেসব পরবর্তী জীবনের কথা। যে সময়ের কথা বলছিলুম সেটা আমার শিক্ষানবিশির বয়সের।

সেই বয়সেই উপলব্ধি করি যে আমি চাই আর না চাই আর্টও আমাকে তাড়া করে নিয়ে যায় ঝড়ের মতো। আমাকে ধ্বংসভ্রংশ করে, শ্রান্ত ক্লান্ত বিপর্যস্ত করে, নিষ্পেষিত ও নিঃশেষিত করে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর নাম কি ইন্স্পিরেশন, না ইমপালস, না ক্ষ্যাপামি? আমি লিখছি না আমাকে দিয়ে লেখানো হচ্ছে? একটু আগে বলেছি আমি একজন প্রভু। কিন্তু প্রভুরও প্রভু আছে। আমাকে সে তার খেয়ালখুশি মতো বা তার প্রয়োজন মতো গাধা খাটুনি খাটায়। সৃষ্টির চক্র অহরহ আবর্তিত হচ্ছে। আমিও রথের দড়ি ধরে টানছি। আমাকেও বেগার খাটিয়ে নিচ্ছেন জগন্নাথ। আমি ভাবছি আমিই দেব। তা জানতে পেরে হাসছেন আমার অন্তর্যামী।

আর্টের সার্থকতা কী? হওয়া। না হয়ে তার গতি নেই, হয়েই তার সার্থকতা। হলেই যে অমর হতে হবে এমন কী কথা আছে? সব লেখা বাঁচে না। যেটা বাঁচে সেটাকে আর পাঁচজনে বাঁচিয়ে রাখে বলেই বাঁচে। গ্রিক নাট্যকারদের নাটকের অল্প কয়েকখানাই বেঁচে আছে। হয়তো ওর চাইতেও সেরা নাটক ছিল। হারিয়ে গেছে, পুড়ে গেছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আলেকজান্দ্রিয়ায়। একবার লেখা হয়ে গেলে লেখকের উচিত নির্লিপ্ত হওয়া। যেটাকে নিয়ে এত পরিশ্রম, এত প্রত্যাশা সেইটেই হয়তো অল্পায়ু। সেটার কোথাও কোনো খুঁত আছে বলে নয়। যেটা নিখুঁত নয় সেইটেই হয়তো ক্লাসিক হয়ে যায়। কেন যে এমন হয় কেউ ঠিক জানে না।

জীবনের সঙ্গে আর্টের অতি নিবিড় সম্বন্ধ। কখনো জীবন আর্টকে প্রভাবিত করে, কখনো আর্ট জীবনকে। সেইজন্যে আমার সাহিত্যজিজ্ঞাসা আমার জীবনজিজ্ঞাসার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে এসেছে। একটা অপরটার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তা বলে একটা অপরটার অধীনও নয়। আর্ট আর আর্টিস্ট চিরদিন স্বাধীন। তবে রিয়েলিটি আমার মনের মতো না হলে তাকে আমি পরবির্তন করতে চেয়েছি। জীবনে না হোক, সাহিত্যে। সেইজন্যে আমি একজন বাস্তববাদী সাহিত্যিক হতে পারিনি, হয়েছি একজন আদর্শবাদী সাহিত্যিক। তা বলে সাহিত্যের আদর্শকে খাটো হতে দিইনি। সেখানে আমি অতন্দ্র প্রহরী।

আমার শিক্ষানবিশির প্রথম ফলশ্রুতি ‘পথে প্রবাসে’। তেইশ বছর বয়সে ওর আরম্ভ। পঁচিশ বছর বয়সে শেষ। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী ‘বিচিত্রা’য় লক্ষ করে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন তো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভূমিকা লিখে দেন। তাঁর নামের সঙ্গে আমার নামও জড়িয়ে যায়। যেমন আরো আগে টলস্টয়ের নামের সঙ্গে। এসব আকস্মিকের মতো লাগলেও আসলে কিন্তু আকস্মিক নয়। কোনো লেখকই নিঃসম্পর্কীয় হতে পারে না। প্রত্যেকেরই কেউ না কেউ পূর্বসুরি। আমার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার সাদৃশ্য এইখানে যে সবাই আমরা রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি। তাঁদের সঙ্গে আমার পার্থক্য এইখানে যে আমি টলস্টয়ের তথা প্রমথ চৌধুরীর মতো দৃ জন ভিন্নধর্মা লেখকেরও উত্তরসুরি।

আবাল্য আমি দুই মহান সাহিত্যপ্রবাহে লালিত। একটি তো ভারতের রামায়ণ মহাভারতের গঙ্গোত্রী থেকে নির্গত নির্গত তিন হাজার বছরের ধারা। অপরটি ইউরোপের রেনেসাঁসের সাগরপার থেকে সমাগত পাঁচ শ বছরের জোয়ার। কলকাতার বন্দরে উভয়ের যোগাযোগ ঘটে। এপারেও রেনেসাঁস শুরু হয়। ওপোরের রেনেসাঁসের সঙ্গে এপারের রেনেসাঁসের একটি পরম্পরাগত সম্পর্ক ছিল। যেমন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির একটি পরম্পরাগত সম্পর্ক। দুটি পরম্পরাই ছিল আমার কাছে সত্য। প্রেরণার জন্যে আমি কখনো ফিরে তাকাতুম অতীতের দিকে। যে অতীত স্বদেশের অতীত। আবার কখনো দৃষ্টিপাত করতুম পশ্চিমের দিকে। যে পশ্চিম স্বযুগের ভাবকেন্দ্র। সেই বারো বছর বয়স থেকেই আমি সাগরপারের স্বপ্ন দেখি। আমার উপনয়ন গায়ত্রীমন্ত্রে হয়নি। হয়েছে ‘আর্ট’ মন্ত্রে। সাগরপারেই তো তার আধুনিকতম বিকাশ।

তেইশ বছর বয়সে ইউরোপের মাটিতে উপনীত হওয়াও একপ্রকার উপনয়ন। আমার সেই দ্বিতীয় উপনয়ন না ঘটলে আমার ভবিষ্যৎ কেমন আকার নিত কে জানে! সেটাও তো একটা আকস্মিক ঘটনা, অথচ ঠিক আকস্মিক নয়। আকস্মিক আমার জীবনে বার বার এসেছে। আমাকে যা করবার তা করে দিয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে তা নিয়তিনির্দিষ্ট। আমার ইচ্ছা অনুসারেই যদি আমার জীবন চলত তা হলে তো আমার সতেরো বছর বয়সে আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে সাংবাদিক হওয়ার কথা। তাও ইংরেজি ভাষায়। তার মধ্যে কোথায় সাহিত্য, কোথায় সাহিত্যজিজ্ঞাসা! তেমনি পরবর্তী বয়সে লেখার সাধনা ফেলে অ্যাকশনের পেছনে ছুটেছি। হতে চেয়েছি ম্যান অব অ্যাকশন। ব্যর্থ হয়েছি। পরিশেষে হৃদয়ঙ্গম করেছি যে সাংবাদিকতার মতো সেটাও আমার পক্ষে বন্যহংসীর পশ্চাদ্ধাবন। সে পথে গেলে আর যাই হোক সাহিত্যে পুরোগমন হতো না।

লোকে একতলা বাড়ির জন্যে যখন ভিৎ পাতে তখন মনে ধরে নেয় যে পরে দরকার হলে দোতলা তেতলা তৈরির সময় সেই ভিতেই চলবে। আমারও সাহিত্যের ভিৎ গাাঁথা হয়েছিল সারাজীবনের জন্যে নয়, প্রথম যেবৈনের জন্যে। আমার ধারণা ছিল আমিও আমার মার মতো বাঁচব পঁয়ত্রিশ বছর মাত্র। জরাগ্রস্ত জীবন আমি কামনা করিনি। চেয়েছি যৌবনের সঙ্গে জীবনেরও ইতি। ‘পথে প্রবাসে’ শেষ হলে শুরু হয় ‘সত্যাসত্য’। কথা ছিল সেটি পাঁচ খন্ডের উপন্যাস হবে। পাঁচ বছর বয়সে সারা হবে। যাকে বলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। তার পরেও আরো পাঁচ বছর হাতে থাকবে। কল্পনায় ছিল প্রেমের উপাখ্যান। কিন্তু দেখা গেল পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও ‘সত্যাসত্য’ অসমাপ্ত। তার সমাপ্তির জন্যে আরো তিনবছর বাঁচতে হলো। তারপরে দীর্ঘকাল ধরে মনের জমিন অপেক্ষাকৃত পতিত রাখতে হয়। যে মাটিতে ফসল ফলে সে মাটি বিরাম চায়। একটানা বারো বছর নিবিড় আবাদের পর আমাদের মনের জমিন যে বারো বছর অপেক্ষাকৃত অনাবাদী থাকতে চায় সেটা আমার তখন জানা ছিল না। এক অলিখিত নিয়ম অদৃশ্যে কাজ করছিল। আমি তো ধরে নিয়েছিলুম যে দেশব্যাপী অনর্থের দরুন ক্রমাগত চিত্তবেক্ষেপই আমাকে ‘রত্ন ও শ্রীমতি’ পর্যায়ের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একাগ্র হতে দেবে না। তা ছাড়া আমার রাজকর্মের দাবিও উত্তরোত্তর বাড়ছিল। সাহিত্য আর রাজকর্ম উভয়েই যদি অসপত্ন হতে চায় তবে তো একটির জন্যে অপরটিকে ছাড়তে হয়। সাহিত্য ছাড়লে আমার জীবনে আর কী থাকে! কেনই বা বাঁচব! রাজকর্ম ছাড়লে জীবিকার কী উপায়! রম্যাঁ রলাঁ তো উপদেশ দিয়েছিলেন টাকার জন্যে রা লিখতে। লিখলেও তো সেটা অতিলিখন হতো। মনের জমিনের অতিকর্ষণ।

পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে যাবার কথা ছিল আমার। কিন্তু চলে গেল আমার একটি ছেলে। যেন বলে গেল যে আমার জীবনযাপনের ধারায় মারাত্মক কোনো ভুল ছিল। যার প্রতিফল ওই ট্র্যাজেডি। ম্যান অব অ্যাকশন হতে গিয়ে আমি ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলুম। কথায় বলে অর্থই অনর্থ। কিন্তু ক্ষমতার মতো অনর্থ আর নেই। কামও বড়ো অনর্থ নয়। আমি বুঝতে পারলুম যে জীবনের আমূল পরিবর্তনই শ্রেয়। প্রেয় ওই পুরনো জীবনকে আঁকড়ে ধরা। শ্রেয় আর প্রেয়র দ্বন্দ্ব যে শুরু হলো তার পরিণতি আমার রাজকর্ম থেকে সাতচল্লিশ বছর বয়সে স্বেচ্ছা অপসরণ। কিন্তু জীবনকে সরল করে আনা এক কথা, আর্টকে সরল করে আনা আরেক। জীবনকে নিরাভরণ করে আনা এক কথা, আর্টকে নিরাভরণ করে আনা আরেক। জীবনকে অকপট করে তোলা এক কথা, আর্টকে অকপট করে তোলা আরেক। ‘এই হচ্ছে আদর্শ জীবন’ বলা এক কথা, ‘এই হচ্ছে আদর্শ আর্ট’ বলা আরেক।

মনে প্রাণে আমি টলস্টয় ও গান্ধীর অনুসরণ করি। শুধু রাজনীতি বাদে। আমার জীবনযাত্রা ভুলে ভরে যায় না। আমার তো মনে হয় আমি ঠিক পথেই চলেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জীবনের আমূল পরিবর্তন হলে আর্টেরও কি আমূল পরিবর্তন হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নতুন করে ভাবতে হয় কেমন করে লিখব, কী লিখব, কার জন্যে লিখব, কিসের জন্যে লিখব, লিখে সার্থকতা কী। জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়েও আর্টকে আমি সরল, নিরাভরণ ও অকপট করি, ছলচাতুরী ছাড়ি, উজ্জ্বলতা পরিহার করি। জীবনে ক্ষমতা জিনিসটা মন্দ বলে আর্টেও ক্ষমতা বিসর্জন দিই। এক একটি বাক্য হয় এক একটি সূত্রের মতো সংক্ষিপ্ত। সারটাই আসল। ধারটা কিছু নয়। ভারটা তো বাহুল্য। আর্ট হয়ে দাঁড়ায় আর্টলেস। তাতেও আমার খেদ ছিল না। কিন্তু দেখা গেল সৃষ্টির আগুন নিবে আসছে। যে আগুন শিল্পীসত্তার আদি বহ্নি।

ইতিমধ্যে নাৎসিদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে আমিও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কামনা করি। কিন্তু যুদ্ধ যখন সত্যি সত্যি বেঁধে যায় তখন তার বীভৎসতা দেখে আমিও আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে মোহমুক্ত হই। টলস্টয় যেমন হয়েছিলেন। গান্ধী যেমন হয়েছিলেন। কিন্তু বিকল্প সভ্যতা কি আদি খ্রিস্টান। যেমন টলস্টয়ের বেলা। না ভারতের সাত লক্ষ পল্লীর স্বশাসিত স্বনির্ভর ধর্মপ্রাণ জনগণের নৈতিক বলে বলীয়ান সভ্যতা? যেমন গান্ধীর বেলা। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে আমার মোহ ছিল না। মহাভারতের যুগের কুরুক্ষেত্রও সেকালের অনুপাতে সমান বীভৎস ও সমান লোকক্ষয়কর। কারো কারো মানসে আরো এক বিকল্প ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যবাদী সভ্যতা। সিডনি ও বিয়াত্রিস ওয়েবেরে বই পড়ে আমিও তার দিকে ঝুঁকেছিলুম। কিন্তু ওদেশের শিল্পী ও ভাবুকরা যেভাবে বিতাড়িত বা নিহত হন তার খবর পেয়ে আমার মোহভঙ্গ হয়। কেবল পোষা বুদ্ধিজীবিরাই সে স্বর্গে বাস করতে পারে। যারা পোষ মানবে না তারা যদি মানে মানে বাঁচতে চায় তো কাজ বন্ধ করবে বা অন্য কাজ করবে।

আমি গান্ধীজির স্বপ্নের শরিক হই। আমি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করি যে ভারতের জনগণই একদিন আনবে ভারতের মৌলিক রেনেসাঁস। সেটা ইউরোপের সঙ্গে মেলানো গত শতকের মধ্যবিত্তশ্রেণীর ক্ষীণপ্রাণ রেনেসাঁস নয়। রেনেসাঁসের যাঁরা নায়ক হবেন তাঁদের হৃদয় পড়ে থাকবে না কয়েকটি মহানগরে। সেসব শহরে তাঁরা ঘরেরও নন, ঘাটেরও নন। তারা মূলহীন ও পরাসক্ত। শহুরে বুদ্ধিজীবিদের নেতৃত্বে নতুন একটা সভ্যতার উদ্ভব বা বিকাশ হতে পারে না। পুরাতনের পুনরাবৃত্তিও কি হবে? রাজসভা ভিন্ন তার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। অথবা মঠবাড়ি। জনগণের অংশ তাতে সামান্য।

আমি লোকসংস্কৃতির ভিতরেই ভাবী সংস্কৃতির সম্ভাব্যতা নিহিত দেখি। হাজার হাজার বছর ধরে সে সংস্কৃতি অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বহমান থেকেছে ভারতের নিভৃত পল্লীর জনমানসে। রাজসভার বা মঠবাড়ির, গঙ্গার বা যমুনার ধার ধারেনি। আমি তার স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু কালের সঙ্গে তাল রেখে চলা কি তার পক্ষে সম্ভব! আমরা যারা যুগসচেতন বিজ্ঞানসচেতন বিশ্বসচেতন তারা কি লোকসংস্কৃতির প্রাকৃত রূপে গ্রাম্য রূপে তৃপ্ত হতে পারব? আমরা যদি তাকে সংস্কৃত করতে চাই সভ্য করতে চাই সেও কি আমাদের হস্তাবলেপ সইতে পারবে? তা হলে কি আমরা শিক্ষিত বিদ্যা ভুলে যাব? প্রকৃতির কাছে পাঠ নেব? মাটির সন্তান হয়ে হাল ধরব, দাঁড় বাইব, তাঁত বুনব? গান্ধিীজির মনের কথাটা ছিল তাই। কিন্তু আমার মনের কথাটা তা নয়।

ইউরোপের মহাযুদ্ধ শেষ হলো। এদেশের গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হলো। সেটা গত শতকের আমেরিকার গৃহযুদ্ধের অনুরূপ না হোক, দ্বাপরের কুরুক্ষেত্রের পুনরাবৃত্তি হতে পারত। দেশভাগ প্রদেশভাগ দিয়ে কোনো মতে সেটা থামানো গেল, কিন্তু যে পরিমাণ বিদ্বেষ জমেছিল এখনো তা সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়নি। কেমন করে বলব যে ইউরোপের চেয়ে এদেশের লোক অহিংস বা সাত্ত্বিক বা উদার বা মহৎ বা অগ্রসর বা সভ্যতর সংস্কৃতিমান? জনগণের উপর ছেড়ে দিলে তারা এক মৌলিক রেনেসাঁস ঘটাবে, কেমন করে এ বিশ্বাস পোষণ করব? স্বাধীনতার স্বরূপ দেখে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীই একদিন দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করেন যে তার মোহভঙ্গ হয়েছে। আমারও মোহ যেটুকু আছে সেটুকু এই কারণে আছে যে মানুষ ভুল করতে করতেই শেখে, এদেশের জনগণও ভুল করতে করতেই শিখবে। বাংলাদেশের মানুষ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ দান করে শিখেছে।

কিন্তু হাতের মুঠোর মধ্যে যে পাখিটা রয়েছে সেটার দাম ঝোপের দুটো পাখির সমান। সেটাকে আমি হাতছাড়া করতে নারাজ। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের সংস্পর্শে এসে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী গত শতাব্দীতে যে রেনেসাঁস ঘটায় সেটা মৌলিক নয় বলে বা জনগণের নয় বলে কম মূল্যবান নয়। তার রেশ এখনো মিলিয়ে যায়নি। তার সঙ্গে অন্বয় রক্ষা করছি আমরা একালের শিল্পী ও ভাবুকরাও। যে কোনো চিত্র প্রদর্শনীতে গেলে দেখতে পাওয়া যায় এদেশের চিত্রকরদের আঁকা আধুনিক রীতির ছবি। যার সঙ্গে মিল খুঁজতে হলে ইউরোপে যেতে হয়। অজন্তায় নয়। ভাস্কর্য সম্বন্ধেও সেই কথা খাটে। সাহিত্য সম্পর্কেই বা খাটবে না কেন? তা হলে কি মানতে হবে যে দেশের চেয়ে যুগ আরো প্রবল? না, অতদূর আমি যাব না। আমি বলব সমান প্রবল। যুগকে বাদ দিয়ে দেশ নয়, দেশকে বাদ দিয়ে যুগ নয়। এখানে শ্রেণী পরিচয় অবান্তর। জনগণের উপর যেদিন দেশের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বর্তাবে সেদিন তারাও স্বীকার করবে যে তারা কেবল এদেশের নয়, এ যুগেরও সন্তান। তাই তাদেরকেও তাকাতে হবে বাইরে। তাদের লেখা, তাদের আঁকাও যুগের সঙ্গে তাল রাখবে।

দারুণ এক দুর্যোগের ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে দেশের লোক এখন আলোর জন্যে আমাদের দিকে তাকায়। শুধু রসের জন্য নয়। আর আমরা তাকাই প্রাচীন ও আধুনিক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দিকে। দীপ থেকে দীপ জ্বালিয়ে তুলে ধরি। খুব বেশিদূর না গেলেও কিছুদূর যায় তার আভা।

জীবনের আমূল পরিবর্তন এখনো ঘটেনি, যদিও এখন আমি সত্তরে পড়েছি। কিন্তু এতদিনে আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি যে জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটলেও আর্টের আমূল পরিবর্তন ঘটেনা। ঘটা উচিতও নয়। জীবনের সঙ্গে আর্টকে মেলাতে গেলে সে তার আপনার লক্ষ্য বেদ করতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য আর আর্টের লক্ষ্য এক নয়। মানুষ হিসেবে ভালো হতে চাওয়া নিশ্চয়ই ঠিক, কিন্তু মানুষ হিসাবে ভালো হতে গিয়ে শিল্পী হিসাবে মন্দ হওয়া একেবারেই ভুল। জীবনযাপনের ধারায় মারাত্মক ভুল ছিল বলে তার সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু অশুদ্ধ জীবনেও আমার ভিতরে যে সৃষ্টির আগুন দিনরাত জ্বলেছিল সে আগুন যদি শুদ্ধ সাত্ত্বিক ত্যাগময় জীবনে একটু একটু করে নিবে যায় তবে সেটাও তো হবে মারাত্মক ভুল। সেখানে জ্বালা নেই সেখানে সৃষ্টি নেই। সূর্যনক্ষত্রের মতো জ্বলতে হবে আমাকেও, আমিও যদি বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে চাই। স্রষ্টার স্বধর্ম সৃষ্টিশীল হওয়া। স্রষ্টার কর্তব্য সৃষ্টির আগুনকে জ্বালিয়ে রাখা। সেক্ষত্রে তো মারাত্মক ভুল হয়নি। আমূল পরিবর্তন করতে হয় জীবনে করব। আর্টে কেন?

বহুবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার পর উপলব্ধি করি যে আমার শিক্ষানবিশির দিনের সেই সব মূল প্রত্যয় মোটের উপর ঠিকই ছিল। আরো ভালো লেখার খাতিরে যখন যেটুকু পরিবর্তন আবশ্যক হবে তখন সেটুকু করলেই চলবে। কিন্তু লেখা যদি আরো ভালো না হয় তবে পরিবর্তন নিরর্থক। ভালো এক্ষেত্রে নীতির বিচারে নয়, রসের বিচারে, রূপের বিচারে। আমার উপরে পড়েছে রসের দায়, রূপের দায়। অন্য কথায় সত্যের দায়, সৌন্দর্যের দায়। এর উপরে শিবের দায় যদি চাপে সে ভার বইতেও আমি রাজি। কতবার বইতে হয়েছে। কিন্তু তার চাপে যেন আর্ট চাপা না পড়ে। জগতের ভালো করতে গিয়ে আর্টের মন্দ করতে আমি অনিচ্ছুক। আমার আর্টিস্ট সত্তাকে আমি রক্ষা করব। এটা প্রাথমিক।

বছর পঞ্চাশ বয়সে আরো একবার উপনয়ন হয় আমার। বার বার তিনবার। হঠাৎ একদিন দৃষ্টি খুলে যায়। আমি নিরীক্ষণ করি এ বিশ্বের অন্তরে আছে এক সৌন্দর্যলোক। সেই অন্দরমহলে যে প্রবেশ করে সে অন্ধকারেও পায় আলোর দিশা, অসুন্দরেও সুন্দরের দেখা, অমঙ্গলেও মঙ্গলের আভাস। আমার উপর বরাত আমাকে আরো ভিতরে যেতে হবে। আরো গভীরে। যেখানে রয়েছে সার সৌন্দর্য বা এসেনশিয়াল বিউটি। শুধুমাত্র বাইরের রূপ নিয়ে আমি করব কী, যদি অন্তঃসৌন্দর্য আমাকে ধরা না দেয়? সেই আমার সাধ্য শিরোমণি। তারই সন্ধানে গত উনিশ বছর কেটেছে, বাকি জীবনটাও কাটবে।

(১৯৭৩)

গ্রন্থসূত্র: শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ অন্নদাশঙ্কর রায়; প্রকাশ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫ বাণীশিল্প (কলকাতা, ভারত)