| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

অপ্রেম

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

যে দরজায় তুমি দাঁড়িয়ে আছ সেই দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আলগা বাতাস আমার ঘাড়ে এসে কান ছুয়ে এলোমেলো চুলে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি ঘুম ঘুম চোখে তোমার বুনো ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখছি। কাল রাতে একটা উন্মত্ত সমুদ্রের মত লাগছিল। কি ভীষণ ঝড় ছিল নিঃশ্বাসে, বাহুতে, বুকে অথবা ভারি দু’ঠোঁটের অদ্ভুত পেষণে। আমি একটা ঝরা পাতার মত সমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে। তুমিও টেনে নিয়েছিলে আদিম টর্নেডোর মত। একটা খরস্রোতা নদী এবড়ো থেবড়ো পাথুরে পথ পাড়ি দিয়ে সব শেষে সাগরে মিলেছিল। নিশ্চুপ সেই সাগরে সুখের ক্লান্তিতে তোমার বুকেই তো চোখ বুজেছিলাম।

এখন সকাল। একটা অচেনা পাখীর ডাক কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে। আমার তোমাকে এই অলস ভাবে দেখতে ভাল লাগছে। অথচ, আজ খুব জরুরি একটা কাজ আছে আমার। তোমারও তো কোথাও যাওয়ার কথা। কিন্তু, মনে হচ্ছে এভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে থেকেই পার করা উচিৎ একটা আস্ত দিন। তুমি এবার ফিরে তাকালে। কি মিষ্টি তোমার হাসি! আমিও ছোট একটা হাসি ফিরিয়ে দিলাম।

-ওঠ! আটটা বেজে গেছে কিন্তু…

-উহু…

-আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে।

-উহু

-নাস্তা খাবে না?

-উহু

-আবার উহু! কি পাগলামি করছ! ওঠ তো…

অগত্যা, আমাকে উঠতে হয়। আমি তোমাকে বিদায় জানাই এক গাঢ় আলিঙ্গনে। গতরাতের উন্মত্ততা, তীব্র ক্ষুধা আজ তোমার চোখে দেখি না। তাই ভালবাসার প্রকাশ চুম্বন পর্যন্ত গড়ায় না।

তুমি চলে যেতেই স্নানঘরে যেয়ে যখন জলের ধারায় সাবানে নিজেকে মেশাই, তখন ঘাড়ে, গলায়, বুকে এখানে ওখানে জ্বালা করে ওঠে। দংশনে প্রেম থাকলে ঠোঁটের পাশে টোল পড়ে, যন্ত্রণা বাড়ে না।

বাইরে রোদ বাড়ছে। আমার বেরিয়ে পড়া উচিৎ। আমার আজ অনেক কাজ। কিন্তু কি এক ঘোর আজ আমার!  এই ঘোরের নাম তুমি। এ তো এমন নয় যে আমাদের দেহজ প্রেমের সূচনা কাল রাত্রি থেকেই। এমনও নয় যে কালকের মত আনন্দময় মুহূর্ত আমাদের আর আসেনি। বরঞ্চ, যেবার তুমি আমাকে নিয়ে কাছের এক নদীতে ডিঙ্গি নৌকায় ভেসেছিলে, তুলে দিয়েছিলে এক মুঠো শাপলা, ভিজিয়ে দিয়েছিলে ঘোলা পানির ঝাপটায়, সেই দিনটা তো কালকের চেয়েও ভয়ঙ্কর সুন্দর ছিল। তোমার ঠোটে লাজুক একটা হাসি ছিল, আমাকে লুকিয়ে বার বার দেখার তৃষ্ণা ছিল, আমিও কি শক্ত করে তোমার হাত ধরে ছিলাম, তুমি বার বার বলছিলে, ‘এই পাগলি… এই পাগলি’ আমি বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে তোমার ঘামমেশা পারফিউমের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম অদ্ভুত আসক্তিতে, আর বলছিলাম, ‘ইশ…যদি ডুবে যাই!” এক ঘাটে ভাতের হোটেলে যখন এক প্লেটে দুজন আগুনঝাল ইলিশ মাছের পেটি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম তখন তোমার কি দারুণ ঝাল লেগেছিল! আমি তোমাকে পানি খাওয়াতে গিয়ে তোমার গায়ে যখন পানি ফেলে দিলাম কি করুন চোখে তাকিয়ে ছিলে!

এখন, কোন ভুল করলে তোমার কথায় রাগ থাকে। ধর সেদিন, ঐযে মিনারা দের বাসায়। তোমার গাড়ির চাবি আমায় দিয়েছিলে আর আমি ব্যাগে রেখেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সবার সামনে কেমন করলে তুমি! মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নাড়িয়ে চাপা ধমকে কষ্টের চেয়ে অবাক হয়েছিলাম বেশী। কিন্তু, তুমি জান, এসব আমি ধরি না, মনে কিছু করি না, তাই হয়তো বল, তাই না?

আচ্ছা, তোমার মনে আছে, আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিনটা? আমি হলপ করে বলতে পারি, তোমার এখন তেমন কিছুই মনে নেই। তুমি একটা পেস্ট কালারের শার্ট পরেছিলে যেটার স্লিভে একটা খয়েরি দাগ ছিল। আমি রঞ্জু ভাইর সামনে তোমাকে সেটা নিয়ে টিজ করেছিলাম আর তুমি কি অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিলে!

ঘর গোছানো দরকার। কিন্তু, গোছাবো না। থাক।  বিছানার কোঁচকানো চাদর, ওয়াশরুমের বেসিনে তোমার চুল, অথবা ডাইনিংএর অ্যাশট্রেতে জমা তোমার সিগারেটের ফিলটার জানান দিচ্ছে তুমি ছিলে। আরও কিছুক্ষণ নাহয় থাক। আর, আমার সময়ও নেই। আবেগ, প্রেম, ভালবাসার চিহ্ন ঘরে জমিয়ে একটা সবুজ ট্রাউজার আর চেক শার্ট পরে বেরিয়ে পড়ি।

পথে এত ধুলো! কাজের জায়গায়ও ধুলো আর রোদ। কবে যে বৃষ্টি হবে! কবে আবার ভিজব! কি আশ্চর্য! আমি তোমার সাথে ভিজতে চাই না। আমার যার সাথে ভিজতে ইচ্ছে করছে তাকে আমি ভালবাসি না। কিন্তু, মাঝে মাঝে খুব অস্থির মুহূর্তে তাকে কামনা করি! কি অদ্ভুত না? আমি কি নষ্টা? আমি কি ভয়ঙ্করকম চরিত্রহীন? সেই লোকটা আমার সাথে একটা দিন কাটাতে চায়। কিংবা বলা ভাল, একটা পুরো রাত। আমি এড়িয়ে চলি। কেন চলি? তোমার কাছে সতী থাকার আশায়। কেন তোমার কাছে আমার সতী থাকতে হবে? তুমি তো কোন শর্ত দাওনি। তুমি তো কখনও কিছু জানতেও চাওনি। বরং বলা ভাল, আমার প্রতি তোমার আগ্রহ দিন দিন কমে আসছে। শুধু কি এক অলীক প্রেমের গল্প শুঁকে আমি দিন কাটাই, রাত পার করি। মাঝে মাঝে কিছু অপার্থিব মুহূর্ত আসে, ঐটুকু সম্বল করে অনেক আকাশকুসুম ভাবনায় যে আল্পনাটা আঁকি সেটাও ক’দিন যেতে না যেতেই চুরমার করে দাও অবলীলায়। অবশ্য তুমি জানতেও পার না। তুমি তোমার ‘ডানা মেলা পাখিতে’ চেপে এদেশ সেদেশ তো ঘুরবেই। পাইলটের প্রেমিকা অপেক্ষা করবে বেশী কাছে পাবে কম, এ তো তুমিই বলেছ। তবু তোমার উদগ্র ক্ষুধার ধরণ দেখে, দিন দিন আমার প্রতি তোমার কমে আসা আগ্রহ দেখে আর সেলফোনে এত এত মেয়েদের ফোন নম্বর দেখে আমি কি ভাবতে পারি না যে তুমিও আর কাউকে কামনা কর? এই যে, এত ভালবেসেও আমি মাঝে মাঝে অন্য পুরুষকে ভাবি। কারো চোখ, কারো ভ্রু, কারো ঠোঁট অথবা উগ্র রোমশ বুক আমার মাথায় ঝিম ধরায়। তখন তোমাকে ভাবতে একটুও ভাল লাগে না। তবে শুধু ঐ সময়টায়। বাকি সময় আমার চোখ, মন শুধু তোমাকেই খোঁজে, তোমাকেই ভাবে। এই দ্বিচারী মনোভাব কি অমার্জনীয় অপরাধ?

আচ্ছা, এবার এলে যদি এসব বলি তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? আমার ধারনা, করবে। কারণ তোমার আমাকে ত্যাগের একটা ছুতো প্রয়োজন। আমি বুঝতে পারছি, আস্তে আস্তে তুমি দ্বীপের মত সরে যাচ্ছ। আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক বিশাল অন্তরীপ। তুমি গুটিয়ে যাচ্ছ ধীরে ধীরে। এতগুলো বছর তো আসলে এক ধাক্কায় ভুলে যাওয়া যায় না। সুতো ছড়াতে হয়। তার পর হয় ঘুড়ি ভোঁকাট্টা হয় নয়তো নাটাইএর সুতোই ফুরিয়ে যায়।

এ বছর তোমার বয়স হবে বিয়াল্লিশ আর আমার গত জুনে তেইশ হলো। তোমায় যতই ভালবাসি বিয়ে কনসেপ্টটায় মাথা নোয়াবার ইচ্ছে নেই এক রত্তি। অন্তত এই মুহূর্তে। আর তুমি সেটা জেনেই কাছে এসেছ। সামাজিক ভাবে সংসার করার জন্য তোমার কাছাকাছি বয়সের কোন ডিভোর্সিকে খুঁজছ তাও আমি জানি। কারণ, বিয়ে তোমাকেও দ্বিতীয়বারই করতে হবে। কিন্তু, আমাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম হিপোক্রেসি তৈরি হচ্ছে। আমাকে ভাল লাগছে না তোমার, আমিও তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবছি। আমরা কেউই বলতে পারছি না, আবার আমরা একে অন্যকে ছাড়া থাকতেও পারছি না। এই চেইনটা ভাঙ্গা দরকার, তাই না?

রাত পৌনে তিনটা। নির্ঘুম রাত নতুন নয় আমার কাছে। আমি আমার ফোনে লুকিয়ে রাখা ভিডিওটা তোমাকে পাঠালাম। সাথে লিখলাম, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে খুব বেশী ঘৃণা করবে? আমাকে ভয় পাবে? এখন নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছ? কাল এটা দেখে নিশ্চয়ই ফোন করবে? ইশ! তোমার আওয়াজ শুনব! আমাকে প্লিজ বাজে গালি দিও না। আমি তোমার গালি শুনেও আবার প্রেমে পরে যেতে পারি। আমি অধীর হয়ে ভোরের অপেক্ষায় বসে থাকি।

     

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত