‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…’ রিং টোন বেজে উঠল
-নীলার্ণ,অদিতি নার্সিংহোমে অ্যাডমিটেড…
গভীর রাতে অনিমেষদার গলা শুনে নীলার্ণ হতচকিত হয়ে গেল।
– নার্সিংহোম ! কেন?
– অ্যাটেম্পড টু স্যুইসাইড,স্লিপিং পিল ইন্টেক করে…অনিমেষ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল..অদিতি…অদিতি…এ আমি কী করে ফেললাম রে নীল। আমার খুব ভয় লাগছে,অসহায় লাগছে রে …তুই… তুই একবার আসবি আমার কাছে?
রাত্রি আড়াইটের সময় নীলার্ণের মস্ত অডি গাড়িটা সোসাইটির গেটে ঢুকল।
লিভিংরুমে কাশ্মীরি কার্পেটের ওপর ছড়িয়ে বসেছে অনিমেষ,সামনে কাঁচের টেবলে কাট গ্লাসে হুইস্কি টিচার্স ফিফটি ,প্লেটে সেঁকা কাজু আর আদা কুচি ছড়িয়ে আছে।বোতল দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকটা গলধঃকরণ করা হয়ে গেছে। নীলকে দেখে জড়ানো স্খলিত কণ্ঠে বলল- ভাই,তুই আমার ছোট ভাই। তুই কাল সকালে একবার নার্সিংহোম যা,অদিতিকে গিয়ে একবার বল যে তুই ওকে ভালবাসিস। ও তোর প্রেমে পাগল হয়ে গেছে রে ভাই।
– না,আমি পারব না,অনিমেষদা, সামনের নভেম্বরে আমার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।সায়নীকে আমি আর হারাতে পারব না। আমি… আমি শেষ হয়ে যাবো দাদা।
– তুই আমার এই সামান্য কথাটা রাখবি না,বউটা আমার মরে যাবে রে,সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ভুগছে।মুঠো মুঠো ওষুধ খাচ্ছে যে চার বছর ধরে!
– সে তুমি বুঝে নাও। তুমি বিশাখাদির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে আমাকে ঠেলে দিলে অদিতির দিকে। অদিতিদি তোমার থেকে আঘাত পেয়ে কী নিদারুণ যন্ত্রণা পেয়েছিল আমি প্রতিদিন তা টের পেতাম, রাতের পর রাত জেগে আমরা কথা বলতাম। তোমাদের কলেজ প্রেম,অভিনয়কে ভালবাসা,অদিতিদির কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়া সব বলত…সব। অদিতিদি অমন অভিনয় কেরিয়ার ছেড়ে দিল শুধু তোমার জন্য, তোমার নাটকের দল একা হাতে সামলানোর জন্য, কেন?
– জানি রে
– তুমি বলতে দল তোমার সন্তান, নাট্যদল তৈরির সাধনায় তুমি তোমার জীবন দেবে। তোমার মধ্যে সম্ভাবনার স্ফুলিঙ্গ দেখে অদিতিদি তাকে দাবানলের রূপ দিতে চেয়েছিল, যা সমস্ত সংস্কার, বস্তাপচা ধ্যানধারনাগুলোকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে আর সেই ভস্ম থেকে নতুন আশা ও ভাবনার অঙ্কুরোদগম হবে। নবীন সৃষ্টি পল্লবিত হবে।
– আর সে সময় আমার দলে এলো বিশাখা, এসেই উলোটপালোট করে দিল।
– হ্যাঁ,আর তুমি তোমার আদর্শ থেকে সরে গেলে। অদিতিদি একদিন টের পেয়ে গেল তোমার মধ্যেকার আগুন ছাই চাপা পড়ে যাচ্ছে, দেখে সরে যেতে চাইল। তুমি তখন ওকে আটকাতে চেয়েছিলে, দলের জন্য, তোমার নিজের জন্য।
– হ্যাঁ, ওকে আটকাতে তুই ছাড়া আর আমার কোন উপায় ছিল না রে।
– তোমায় আমি গুরু মানতাম, আমার নাট্যগুরুও তুমি। তুমি তাই আমাকে পাঠালে প্রেমের ছলনা করতে। আমিও বোকার মত তোমার নির্দেশে সুচতুর অভিনয়ে অদিতির মন বেঁধে ফেললাম, তোমার দিক থেকে ঘুরিয়ে নিলাম আমার দিকে। একলব্যের মত আমি তোমায় গুরুদক্ষিণা দিলাম। তুমি নিষ্কৃতি পেলে! কিন্তু অদিতিদি টিকে গেল। তোমার দল আর সামাজিক স্ট্যাটাসের গায়ে আঁচ পড়ল না।
– আমি অপরাধ করেছি রে….. ভুল করেছি। নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তোকে, অদিতিকে, সায়নীকে এক সাথে গাড্ডায় ফেলেছি। স্বার্থপর আমি।
– ভীষণ স্বার্থপর তুমি, তুমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসোনি। একদিন সায়নীও আমায় ছেড়ে চলে গেছিল। তোমার মুখ চেয়ে আমি অন্যায় করেছি দু-দুজনের সঙ্গে…. কিন্তু আর নয়!
– ভাই,ও যে তোকে ভালবেসে ফেলেছে, জ্ঞান ফেরার পর আমাকে চিনতে পারেনি শুধু তোর কথাই বলছে রে! তুই একবার যা কাল।
– না,আমায় এই অনুরোধ করো না!
– জানি,জানি…. এখন তুই আমায় চিনবি না। নৈহাটি থেকে কে তোকে কলকাতার রঙ্গমঞ্চ চিনিয়েছিল। তখন তো নেড়ি কুত্তার মত দিনরাত রিহার্সাল রুমের বাইরে বসে থাকতিস একটা ছোট পার্টের জন্য। আমার দল ছেড়ে’ সফর’,তারপর ‘ রঙ্গনাট্য’ তে চলে গেলি আর এখন বাংলা ফিল্মে মুখ দেখিয়ে মাল্লু কামাতে শিখে আর আমায় চেনো না, বানচোদ কোথাকার!
– অনিমেষ সিংহ মুখ খারাপ করবেন না। টিভি বা ফিল্ম দুনিয়ায় আপনিও সুযোগ খুঁজেছিলেন, পাননি বলে আমাকে খিস্তি করতে পারেন না।
-যাঃ শালা! কাউকে যেতে হবে না। আমিই যাব,আমিই গিয়ে সব খুলে বলব। যা হবার হবে,অদিতি মরলে মরবে,বাঁচলে বাঁচবে।
ফোনটা বেজে উঠতে অনিমেষ তুলে নিয়ে বলল- হ্যালো,ইয়েস ডক্টর….মিঃ সিনহা রয় স্পীকিং…. শেষ রাতে, পাঁচটা বিয়াল্লিশে! … ওহ্ মাই গড!
ফোনটা রেখে দিয়ে অনিমেষ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।অনেকক্ষণ পরে মাথা তুলে বলল- ভোরে অদিতি এক্সপায়ার করে গেছে,নার্সিংহোম থেকে ইনফর্ম করল। ওর স্যুইসাইডাল নোটটা হয়ত এ যাত্রায় আমায় পুলিশি হাঙ্গামা থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
নীলার্ণ উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে বলল- চলো,আমরা দুজনেই যাই।মুখাগ্নি দুজনে মিলেই করব।
গল্পকার ও অনুবাদক