নারীর অধিকার রক্ষায় অগ্রণী তিনি
মুনমুন দাশগুপ্ত
সময়টা ছিল মেয়েদের জন্য একেবারে অন্য রকম। নারীশিক্ষার প্রসার তেমন ঘটেনি। মেয়েদের স্থান তখনও অন্তঃপুরে। তারা জানতেই পারত না, সমাজে নারী পুরুষ সবার সমান অধিকার। এই রকম সময়েই লেখালিখি কবি, ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবীর। দাপটের সঙ্গে সংসার সামলে লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, কবিতা। যুক্ত হয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন নারী কল্যাণমূলক বিভিন্ন প্রকল্পে। নারীর সমানাধিকারের লড়াইয়ে প্রথম দিকের রূপকার তিনি, বললে ভুল হবে না।
১৮৮২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্ম অনুরূপা দেবীর। পিতা মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায়, মা দয়াসুন্দরী। বিশিষ্ট লেখক ভূদেব মুখোপাধ্যায় তাঁর পিতামহ। বাংলা সাহিত্য, দর্শনশাস্ত্র ও সংস্কৃত শিক্ষা লাভের প্রেরণা ছিলেন দাদামশাই। তবে লেখালিখি শুরু করেন দিদি ইন্দিরা দেবীর প্রেরণায়। যে যুগে মেয়েদের পড়াশোনাকে তাচ্ছিল্য করা হত, সেই যুগে এই পরিবার থেকে উঠে আসেন দুজন লেখিকা— ইন্দিরা দেবী ও অনুরূপা দেবী।
মাত্র দশ বছর বয়সে উত্তরপাড়ার শিখরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় অনুরূপা দেবীর। বিহারের মুজফ্ফরপুরে শুরু হয় সংসার জীবন। দুটি সন্তান হয়, একটি পুত্র এবং একটি কন্যা। শিখরনাথ অবসরে পড়তেন দেশ-বিদেশের সাহিত্য; সাহিত্য নিয়ে আলোচনা খুব পছন্দ করতেন। স্ত্রীকেও লেখালেখির ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন।
‘রাণী দেবী’ ছদ্মনামে গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার জিতে নেন অনুরূপা দেবী। ১৩১১ বঙ্গাব্দে (১৯০৪) তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘টিলকুঠি’ প্রকাশিত হয় নবনুর পত্রিকায়। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে (১৯১১) ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পোষ্যপুত্র’ উপন্যাসের মাধ্যমেই তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এর পর একের পর এক উপন্যাস লিখেছেন— ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘মা’, ‘মহানিশা’, ‘জ্যোতিহারা’, ‘বাগদত্তা’, ‘পথের সাথী’, ‘উত্তরায়ণ’। মোট তেত্রিশটি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। নারী নিয়ে তাঁর রচিত ‘সাহিত্যে নারী’ (১৯৪৯) বইটি নারী রচিত সাহিত্য-আলোচনার পথপ্রদর্শক। কবিতা লেখার হাতও ছিল চমৎকার। ‘ভারতী’ পত্রিকার পৌষ ১৩১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা ‘দেবদূতের প্রতি রাজা অরিষ্টনেমি’। ঝোঁক ছিল পরীক্ষামূলক রচনা, বা একই লেখার রূপান্তরের দিকেও। নিজের কয়েকটি উপন্যাস নাটকে পরিবর্তিত করেছিলেন। স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘মন্ত্রশক্তি’, বিখ্যাত নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রূপদানে।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পণপ্রথা, বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও জনমত গড়ে তুলেছিলেন। এ দিক থেকে দেখলে তিনি এক জন সমাজ সংস্কারকও। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতার সঙ্গে একযোগে মুজফ্ফরপুরে ‘চ্যাপম্যান গার্লস স্কুল’ নামের ইংরেজি স্কুল শুধু স্থাপনাই নয়, পরিচালনাও করতেন। যুক্ত ছিলেন কলকাতা ও কাশীর কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয়ের সঙ্গেও। ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন যে নারীদেরও আছে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। নারী কল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ শুরু করেন, প্রতিষ্ঠা করেন একাধিক আশ্রম। ১৯৩০-এ মহিলা সমবায়ও তৈরি হয় তাঁর দক্ষতায়। পরের বছর উত্তর বিহার সাহিত্য সম্মেলনে কথাসাহিত্য শাখার সভানেত্রী হয়েছিলেন। সরব হয়েছিলেন ১৯৪৬-এর হিন্দু কোড বিল আন্দোলনেও।
১৯১৯-এ শ্রীভারতধর্ম মহামণ্ডল তাঁকে দেয় ‘ধর্মচন্দ্রিকা’ উপাধি। ১৯২৩-এ পান ‘ভারতী’ উপাধি, শ্রীশ্রীবিশ্বমানব মহামণ্ডল থেকে। তাঁর পুরস্কারের সংখ্যাও কম নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৫-এ জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, ১৯৪১-এ ভুবনমোহিনী দাসী স্বর্ণপদক পান। ১৯৪৪-এ ‘লীলা লেকচারার’ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
জীবন তাঁকে দু’হাত ভরে দিয়েছে, নিয়েওছে বড় কঠিন ভাবে। ১৯৩৪-এ মুজফ্ফরপুরের ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় তাঁর কন্যার। ভূমিকম্পে তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত। সব-হারানো মানুষের কান্না মোছাতে তৈরি করেছিলেন ‘কল্যাণব্রত সঙ্ঘ’।
অনুরূপা দেবীর শেষ জীবন কেটেছিল রানিগঞ্জ শহরে। নাতি অংশুমান বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেখানে এক সংস্থার উচ্চপদাধিকারী। প্রায়ই দেখা যেত বাংলোর বারান্দায় বসে রোদে চুল শুকোতে শুকোতে বই পড়ছেন বা লিখছেন এক বৃদ্ধা। মাঝে মধ্যে পানের বাটা থেকে পান খাচ্ছেন। ১৯৫৮ সালের ১৯ এপ্রিল রানিগঞ্জেই মৃত্যু হয় তাঁর। অসমাপ্ত থেকে যায় ‘জীবনের স্মৃতিলেখা’ রচনাটি।
কৃতজ্ঞতা: এবিপি
