| 29 মার্চ 2024
Categories
দেশ ভ্রমণ

আলোর ঠিকানা তিনচুলে

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

ছবিঃ লেখক

 

বছর দুয়েক আগের কথা। সময়টা ছিল শীতের শেষ। ছোট্ট একটা ছুটি পাওয়া গেল সেবার। কোথায় যাওয়া যায় ? তার আগের বছরেই দার্জিলিং আর কালিম্পং গিয়েছি। ডুয়ার্স তো প্রায়ই যাওয়া হয়। অতএব বৈঠক বসে গেল। দলে মোটামুটি দুটো ভাগ রয়েছে। এক, যারা পাহাড়ে যেতে চায়। আর দুই, যারা জঙ্গলে যেতে চায়। জঙ্গল আমার ভালোই লাগে, কিন্তু পাহাড়ের প্রতি একটু হলেও টানটা বেশী। তাই আমার ভোট পাহাড়ের দিকেই। আমি তো পারলে আবার দার্জিলিং চলে যাই। কিন্তু বাকিরা তা মানবে কেন ? অগত্যা একটা নতুন জায়গা ভাবতে হয়। তখনই উঠে এলো তিনচুলের নাম। তিনচুলে কোথায় ? এরকম নাম কেন ? কি আছে সেখানে ? কেমন সে জায়গা ? উত্তরে পেলাম ধমক,  ‘পাহাড় পাহাড় করে মাথা খারাপ করিস, কত পাহাড় দেখবি চল। ‘’

অগত্যা আশায় আশায় নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনে উঠে পড়লাম।  এনজেপিতে নেমে গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল তিনচুলের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি থেকে তিস্তাবাজার হয়ে জোড়বাংলার রাস্তায় পেশক ছাড়িয়ে বাঁদিকে ওপরে উঠতে হবে, এমনটা জেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো কেজো কথা। শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে পাহাড়ে যাওয়া মানেই ডানদিক দিয়ে মোহময়ী তিস্তার রূপ দর্শন করতে করতে চলা। পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলতে চলতে অনেকটা খোলা আকাশের নীচে তিস্তার মনভোলানো সবুজ রূপকে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ছুঁয়ে যাওয়া, আর তার এঁকেবেঁকে চলাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া, এ যেন কোনদিন পুরনো হবার নয়। এতবার ওই রাস্তায় যাতায়াত করেছি, তবু প্রতিবারে একইরকম জাদু করে তিস্তা। মাঝে মাঝেই লুকিয়ে পড়ে রাস্তার বাঁকে, আবার নিমেষে ধরা দেয় সবুজ ওড়না। তিস্তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই আদ্ধেক রাস্তা পার হয়ে গেলাম।  তারপর শুরু হলো ওপরে ওঠা। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম তিনচুলের পাহাড়ে।

জায়গাটা দেখে প্রথম দর্শনে খুব একটা ভক্তি হলো না।  ছোট একটা পাহাড়ি গ্রাম, রাস্তাগুলোও সরু সরু। বেশ রাগ রাগ হচ্ছে, দার্জিলিং এত কাছে তবু এখানে আসার কি দরকার ছিল ? আকাশও মেঘলা, আমারও মুখ ভার। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পেলে পুরো ট্রিপটাই জলে যাবে। যাই হোক, আমাদের যাবার কথা গুরুং গেস্ট হাউজে। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল গেস্ট হাউজ। ভেতরে ফুলের মেলা দেখে তাও মনটা একটু ভালো হলো। কাঠের বড় বাড়ি। দুটো তলাতেই তিনদিক ঘিরে পরপর ঘর রয়েছে। তার ওপরে রয়েছে খাবার ঘর।  খোলামেলা গেস্ট হাউজটা দেখে নিজেকে স্বান্তনা দিলাম, দুটো দিন মন্দ কাটবে না। থাকার ঘর হিসেবে যেটা পাওয়া গেল সেটা দোতলায়। একটু বদ্ধ হলেও কাঠের ঘরের একটা আলাদা মেজাজ রয়েছে। আর ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে গেলে একটা টানা বারান্দা পাওয়া যায়। সব ঘর দিয়েই সেই বারান্দাটায় যাওয়া যায়। সেই বারান্দায় রয়েছে বড় বড় জানলা। জানলা দিয়ে দুরের আবছা পাহাড় আর ঘন সবুজ দেখা যায়। সেই দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে তিনচুলেকে ভালো লেগে গেল। এটা উল্টোদিক, পাহাড়ের দিক নয়। তবু এদিকটা অদ্ভুত সুন্দর। পাহাড়ের দিকে যেতে হলে রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হবে। এই দূরত্বটা বেশ মুশকিলের। কিন্তু উপায় নেই, তাই মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। তখনো তো জানিনা কি অপেক্ষা করে রয়েছে। যাই হোক, খেতে ডাক পড়লো ওপরে। ছাতের পাশে খাবার ঘরে কি আপ্যায়ন করে ভাবীরা খাওয়ালেন সে বলার নয়। ধোঁয়া ওঠা বাসমতী চালের ভাত, ঘন ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, দুরকম তরকারী, মাছের ঝাল আর লাল লাল করে মুরগির ঝোল। খিদের মুখে কি যে তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম সেদিন, সে চিরকাল মনে থাকবে। খেয়েদেয়ে ছেলেরা বেরিয়ে পড়লো জায়গাটা চক্কর কেটে আসতে।  আমরা মেয়েরা বসলাম আড্ডা দিতে।

খানিক বাদেই বাইরে থেকে কত্তার ফোন, ‘স্যুটকেস কি খুলে ফেলেছো ?’ বললুম, ‘না তো, কেন ? সবে তো জামাকাপড় চেঞ্জ করলাম। ’ তা তিনি বললেন, ‘আবার চেঞ্জ করে ফেলো, গেস্ট হাউজ যেতে হবে। ’

‘মানে ? গেস্ট হাউজেই তো আছি। ’

এবার তিনি যা বললেন তা শুনে আমি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, ‘আরে না না, আমরা ভুল গেস্ট হাউজে উঠেছি। ওটা আমাদের না, আমাদেরটা এদিকে তো। গুরুং সাবকে রাস্তায় পেয়ে গেলাম ভাগ্যিশ !’

বোঝো কাণ্ড ! তারপর যেন ঝড় বয়ে গেল। সবাই মিলে দৌড়লাম ব্যাগ গোছাতে। খানিক বাদেই স্বয়ং সেই গুরুং সাহেব সমেত সবাই এসে হাজির। জানা গেল এই গেস্ট হাউজের গুরুং বাবুও ওনারই আত্মীয় হন। কিন্তু এনারা আমাদের এত খাতির করলেন কেন ? বুকিং-এর কাগজও তো দেখেননি এরা। অবশেষে জানা গেল আর একদল ট্যুরিস্ট আসার কথা ছিল। তারা এখনো এসে পৌঁছয়নি। আর এনারা ভেবেছিলেন আমরাই তারা। যাই হোক বাকি বিদায় পর্ব মধুরভাবে মিটলো আর আমরা আমাদের বুকিং করা গেস্ট হাউজে এসে উঠলাম।

এবার সত্যি অবাক হবার পালা। এই গেস্ট হাউজটা একটা ঢালের একদম শেষ মাথায়। সামনে একটা বিরাট লন। আকাশ পরিস্কার থাকলে লন থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিন্তু আকাশ তখনও মেঘলা। অতএব অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। রাত যত বাড়তে থাকে একটু একটু করে মেঘ কাটতে থাকে। আমাদের আড্ডাও চলে পাল্লা দিয়ে। এই গুরুং সাহেবও আতিথেয়তায় মন ভরিয়ে দিলেন। পাহাড়ি জাতটাই বোধহয় এমন হয়, ভারি অতিথিবৎসল ! খাওয়ানোয় এদেরও জুড়ি মেলা ভার।

বেড়াতে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়া মানা। তাই খাওয়াদাওয়ার পরেও চললো আড্ডা আর গান। সে তো একবার শুরু হলে রফি-কিশোর-আশা থেকে আমাদের মান্না-মানবেন্দ্র-শ্যামল-হেমন্ত, কিছুই বাদ পড়ে না। ঠাণ্ডা বাড়ছে, ওদিকে আকাশও পরিস্কার হচ্ছে। অনেক রাতে গেস্ট হাউজের লন আলো করে আধখানা চাঁদ উঠলো আকাশে। তার জ্যোৎস্নায় যেন চারপাশ ধুয়ে গেল। কেউ একজন গান ধরলো ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’। সকলে তখন মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, ঘুম কেটে গেছে আজ, এমন সুন্দর রাত ঘুমিয়ে নষ্ট করতে নেই। আরও অনেক পরে চাঁদ নেমে গেল আস্তে আস্তে। আমরাও ধীরে ধীরে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। আবার যে সূর্যোদয়ের আগে উঠে পড়তে হবে।

ছবিঃ লেখক

তারপর ? তারপর সেই ভোরবেলার অপেক্ষা, মুহূর্তের পর মুহূর্ত গুণে যাওয়া, কখন গিরিরাজ মেঘের পর্দা সরিয়ে চোখ মেলে তাকাবেন সামান্য মনুষ্যজাতির দিকে। প্রকৃতির আশীর্বাদে সেদিন এই অভাগা কলকাতাবাসীর ওপর পর্বতশ্রেষ্ঠ কাঞ্চনজঙ্ঘা যারপরনাই দয়াপরবশ হয়েছিলেন। ঝকঝকে রোদ উঠেছিল সেদিন। আর আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, সম্মোহিত দৃষ্টিতে, ঈশ্বর দর্শনের মতো চাক্ষুষ করেছিলাম সেই সোনায় মোড়া পাহাড়চূড়াকে। তারপর প্রায় সারাদিন ধরে তাকে দেখছি। এমনকি লনে বসে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেও দেখেছি। যাকে দেখার জন্য এতবার আকুল হয়ে উত্তরবঙ্গে ছুটে আসা সে সারাদিন আমাদের গেস্ট হাউজের লনের একেবারে মাথার ওপর জেগে রইল, এতটা কল্পনাতেও ছিল না। তবু সেই ভোরের আলোয় ধীরে ধীরে আলোকিত হওয়া সোনালী আভায় তাকে যেন আরও আকর্ষণীয়, আরও মায়াময় লাগে। দার্জিলিং আমাকে তার সব রূপ খুলে দেখায়নি আজও। এখনো তার পূর্ণ যৌবন আমার চোখে অধরা রয়ে গেছে, কিন্তু তিনচুলে আমাকে হতাশ করেনি। প্রথম দেখাতেই সে আমাকে ভালবেসে তার সবটুকু রূপ রস গন্ধ উজাড় করে দিয়েছে। তাই আজও বার বার ফিরে যেতে চাই সেই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে, এক মাঠ আলো আর আশ্রয় নিয়ে যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা অপেক্ষা করে রয়েছে শুধু আমারই জন্যে।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত