| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : অপরূপ বিষণ্ণ এক আলো

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

নিখিলেশের সঙ্গে জীবন বদল করার এক অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘জুয়া’, ‘নির্বাসন’ আর ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কবিতায়। হ্যাঁ, গল্পই। শুধু এই কবিতাগুলোতেই নয়, তাঁর অধিকাংশ কবিতার মধ্যেই একটা ‘গল্প’ লুকিয়ে আছে, নিদেনপক্ষে গল্পের উপাদান। কিন্তু এ কেমন গল্প? জীবন বদল করা যায় নাকি কারো সঙ্গে? আর নিখিলেশই বা কে? কাল্পনিক চরিত্র নিশ্চয়ই? যেমনটি নীরা? নাকি তাঁর নিজেরই ভিন্ন আরেকটি সত্তা? হারিয়ে ফেলা, কাঙ্ক্ষিত সত্তা? এ বিষয় নিয়ে তো কত চমৎকার গল্পই হতে পারে, কবিতা কেন? এসব প্রশ্ন করার কোনো মানে হয় না অবশ্য। তিনি কি আর জানতেন না যে, এই কনসেপ্ট নিয়ে অসাধারণ গল্প হয়? জানতেন, নিশ্চয়ই জানতেন। তিনি তো কেবল কবি হিসেবেই নন, গল্পকার হিসেবে, ঔপন্যাসিক হিসেবে, গদ্যকার হিসেবেও নমস্য। সবই তাঁর হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে অনায়াসসাধ্য দক্ষতায়। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলিয়েছেন তিনি। তবু পাঠকের মনে প্রশ্নের উদয় হবেই, যেমনটি আমার হয়েছে এবং স্বয়ং কবির কাছে জানতে চাওয়ার বা উত্তর পাওয়ার উপায় যেহেতু নেই, নিজেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখি—তাঁর অনেক কবিতাই আসলে গল্পে ভরা। ‘ঊনিশে বিধবা মেয়ে ক্লায়কেশে ঊনতিরিশে এসে গর্ভবতী হলো’—‘বিবৃতি’ কবিতার শুরুতেই এই বিধ্বংসী পঙক্তি কি একটি গল্পেরই ইঙ্গিত দেয় না? দেয় তো! কল্পনাপ্রবণ পাঠকের মনে হয়তো কোনো একটি গল্প জেগেও ওঠে, পরের পঙক্তিগুলো পড়ার আগেই। এ রকম বিধ্বংসী পঙক্তি তিনি কম লেখেননি। ‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি—তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে’—এই পঙক্তি তিনি লিখেছিলেন ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ কবিতায়। লিখেছিলেন, ‘আমি কপাল থেকে ঘামের মতন মুছে নিয়েছি পিতামহের নাম/আমি শ্মশানে গিয়ে মরে যাবার বদলে, মাইরি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ একদম অস্তিত্ব ধরে টান দেওয়ার মতো পঙক্তি। যেন নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি আমাদের সবাইকেই মনে করিয়ে দিলেন পিতামহের নাম মুছে নেওয়ার স্মৃতি। আবার তাঁর অতি বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ও তো গল্পই একটা। বেদনাঘন-বিষণ্ণ এক গল্প। দুই বাংলার তরুণদের মুখে মুখে ফিরছে এই কবিতা—রচিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত। এ যুগে এসে আর কোনো কবিতা এত জনপ্রিয় হয়েছে বলে মনে হয় না। অসুখের ছড়া, আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, উত্তরাধিকার, ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি, এক একদিন উদাসীন, যদি নির্বাসন দাও, মন ভালো নেই—এ রকম আরো কত কত কবিতার সঙ্গে কেটেছে আমার একান্ত-একাকী সময়গুলো, কী গভীর-কোমল-মায়াময় অনুভূতিতে তিনি ভরিয়ে তুলেছেন আমার বিষণ্ণ মুহূর্তগুলো, সেসব ভাবলেও কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে মন। আর তাই, তিনি যখন চলে গেলেন তখন যেন স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করলাম। সত্যি কথা বলতে কি, যেকোনো প্রিয় লেখকের প্রস্থানই আমার ভেতরে এই অনুভূতির জন্ম দেয়। ব্যক্তিগত পরিচয় থাকুক বা না থাকুক, তাঁদের প্রয়াণে অধিকতর নিঃসঙ্গ হতে থাকি। আর হবোই বা না কেন? তাঁদেরকে নিয়েই যে বেড়ে উঠেছিলাম আমি, তাঁদেরকে নিয়েই যে কাটিয়ে দিয়েছি জীবনের অধিকাংশ সময়।

সুনীলের কত লেখা যে পড়েছি, তার হিসাব নেই। কত দিন-রাত্রি, কত একাকী মুহূর্ত তিনি ভরিয়ে দিয়েছেন অপূর্ব আনন্দ-বেদনায়, সুখ-দুঃখে, উচ্ছলতায়-অশ্রুতে তার হিসাবও তো রাখিনি। বুঝতে চেয়েছি, কেন তাঁকে এত আপন লাগে, এত কাছের মানুষ মনে হয়! তার কারণ কি এই যে, তিনি সাহিত্যকে আমাদের মতো অতি সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবলম্বন করেছিলেন আটপৌরে ভাষাভঙ্গি? যেন পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলে চলেছেন, এ রকম অনুভূতিই তো হয় তাঁর লেখাগুলো পড়বার সময়! এত সহজে, এত আপনজনের মতো করে তাঁর আগে কেউ কি বলেছেন গভীরতর উপলব্ধির কথা? তাঁর বিষণ্ণ-সুন্দর কবিতাগুলো যেন বাংলা কবিতার আবহমান ধরন থেকে বেরিয়ে এসে অতি সহজে হৃদয়ের কাছে পৌঁছে যাওয়ার জন্যই রচিত হয়েছে। অন্যদিকে তাঁর গদ্যের দিকে যদি তাকাই দেখব, তাঁর সমকালের বন্ধু-লেখকরা—অমিয়ভূষণ, দেবেশ কিংবা কমলকুমার—যখন সচেতনভাবেই নিজেদের ভাষাটিকে করে তুলেছেন নন-কমিউনিকেটিভ; তিনি তখন আটপৌরে-মেদহীন-সহজবোধ্য ভাষায় বলে গিয়েছেন আমাদের আনন্দ-বেদনার কথা, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা। কবি হয়েও তিনি কবিতার প্রভাব পড়তে দেননি তাঁর গল্প বা উপন্যাসে; বরং কবিতার ভেতরেই বুনে দিয়েছেন গল্পের বীজ, যেমনটি বলেছি এই লেখার শুরুতেই। গল্প বলার একটা সহজাত ক্ষমতা তাঁর ছিল। যাই লিখতেন, একটা গল্পের ঢং তাতে উপস্থিত থাকত। তারুণ্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-হাহাকার কিংবা গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের হাহাকার, এমনকি ছোট্ট একটি পাখির ডাককেও তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠতে দেখেছি।

আর উপন্যাস? সেখানেও তিনি এক অনিবার্য প্রসঙ্গ। তাঁর ‘একা এবং কয়েকজন’ বাংলা সাহিত্যের এক মাইলফলক উপন্যাস। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বেদনাবহ, সবচেয়ে ট্র্যাজিক রাজনৈতিক ঘটনা দেশভাগ। অসাধারণ সব উপন্যাস লেখা হয়েছে এই বিষয় নিয়ে। কিন্তু সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বারো ঘর এক উঠান’ আর মাহমুদুল হকের ‘কালো বরফ’—এই তিনটে উপন্যাস যেন অন্য সবগুলোকে ছাপিয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির কূটচাল যে ব্যক্তিমানুষ বা সামষ্টিক মানুষের জীবনকে কীভাবে তছনছ করে দেয়, এই উপন্যাসগুলো যেন তার দলিল হয়ে আছে। ডকুমেন্টেশনের কচকচানি নেই একটি উপন্যাসেও, এমনকি রাজনৈতিক বিষয়গুলোও খুব বেশি উচ্চকিত নয়, কিন্তু মানুষের জীবন যে করুণ-বেদনায় ভরে উঠেছে, এ ঘটনার ফলে তার একটা জীবন্ত ছবি আমরা দেখতে পাই এসব উপন্যাসে, এই এতকাল পরেও। ‘একা এবং কয়েকজন’-এর কথা বলি। সুনীলের গল্প বলার যে অনবদ্য ভঙ্গি, প্রবল আকর্ষণীয়-জাদুবিস্তারি-ঘোরলাগা বর্ণনাভঙ্গি, এই উপন্যাসেই তার দেখা মেলে সবচেয়ে বেশি। বিষয়টি এত জটিল, এত টানাপড়েনের, অথচ গল্প বলার গুণে তা হয়ে ওঠে অনির্বচনীয় সুন্দর। আর ওই চরিত্রগুলো—বড়বাবু, সূর্য, বাদল স্থায়ীভাবে মনে দাগ কেটে যায়। বড়বাবু—বর্ণাঢ্য এক চরিত্র—জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য খুঁজতে গিয়ে যিনি কোনোদিন কোথাও থিতু হতে পারেননি, মৃত্যুর সময় বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘দেখে গেলাম।’ ওটাই ছিল তাঁর সারা জীবনের অর্জিত দর্শন। দেখে গেলাম! অর্থাৎ, তিনি ছিলেন কেবলই দর্শক। একটি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কোনো অংশগ্রহণ ছিল না তাঁর। যদিও আমার জীবনটা মোটেই বর্ণাঢ্য নয়, বরং ভীষণ রকম সাদামাটা, তবু নিজেকে আমার বড়বাবুর মতো মনে হয়। বহুদিন ধরে আমি মনে মনে নিজেকে বড়বাবুর জায়গায় কল্পনা করেছি। কিংবা বাদলের কথাই বলি। বড়বাবু যে মৃত্যুর সময় বিড়বিড় করে এই কথা বলেছিলেন—এটা বাদলেরই দাবীকৃত আবিষ্কার। সত্যিই কি বলেছিলেন? নাকি বাদল নিজেই আরোপ করেছে তাঁর ওপর? কেন মনে হয় এই কথা? কারণ, এত যে ঘটনাবহুল সময়, বাদলই তো তার সবচেয়ে নিবিড়-মনোযোগী দর্শক, সে-ই তো কেবল দেখে যায়! উপন্যাসের শেষে—ততদিনে বাদল তরুণ হয়ে উঠেছে—সে বেড়াতে গিয়ে একা উঠে যায় পাহাড়ের ওপর, আর তার ঠিক আগে ফিরিয়ে আনে বড়বাবুর স্মৃতি, মনে হয় ওই পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তরুণটি আমিই, যে আপন মনে একা একা বলে চলেছে—দেখে গেলাম, দেখে গেলাম। সুনীল তো এভাবেই ঢুকে পড়তেন পাঠকের মনের গভীরে, এবং আর বেরোতেন না। বেরোতেন না বলে সময়ে-অসময়ে কারণে-অকারণে তাঁর নানা চরিত্রের কথা মনে পড়ে, কবিতার পঙক্তি মনে পড়ে, এমনকি মনে পড়ে প্রবন্ধের অংশও। আর এ তো জানা কথাই যে, পৃথিবীর সব সফল লেখকই আসলে স্মরণযোগ্য লেখক, উদ্ধৃতযোগ্য লেখক। কোনো কোনো লেখককে যে জীবনের নানা পর্যায়ে, নানা প্রয়োজনে আমরা উদ্ধৃত করি, তার কারণ তো এই যে, তাঁদের লেখাগুলো আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে, আমাদের জীবনকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে। সুনীলও সেই ধরনের লেখক।

আরেকটি ঘটনা থেকে সুনীলের প্রভাব বোঝা যায়। তাঁর অতি বিখ্যাত ট্রিলজি ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ তো এখন হয়ে উঠেছে বাঙালির ইতিহাসের অংশ। কিন্তু এর মধ্যে ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর ব্যাপারটা একটু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমার মনে হয়, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস আসলে দুই পর্বে রচিত, একটি ‘পূর্ব পশ্চিম’-এর আগের, আরেকটি পরের। উপন্যাস হিসেবে এটি তো তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, বড়জোর ডকুমেন্টেশনের জন্য এটা খানিকটা মনোযোগ পেতে পারে। সত্যি বলতে কি, এটিকে উপন্যাস না বলে ইতিহাসের সাংবাদিক ডকুমেন্টেশন বলাই ভালো। তা ছাড়া এটি তাঁর স্বভাবের বাইরের একটি উপন্যাসও বটে। যে স্বতঃস্ফূর্ত টানটান অনবদ্য জাদুকরি গদ্যে তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে যান তাঁর লেখার ভেতরে, এই উপন্যাসে তার চিহ্নমাত্র নেই। তিনি কি খুব সংশয়ে ছিলেন এই উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে? হয়তো। কারণ, এর আগে তো তিনি এ রকম আঙ্গিকের উপন্যাস আর লেখেননি! ডায়েরির পাতা, সংবাদপত্রের ক্লিপ, ডকুমেন্টেশন এবং ডকুমেন্টেশন, পাঠককে প্রায় ক্লান্ত করে তোলে। অথচ এই উপন্যাসের আঙ্গিক কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের লেখকদের পছন্দ হয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, আনিসুল হকের ‘মা’, শাহাদুজ্জামানের ‘ক্র্যাচের কর্নেল’ এই ধারার উপন্যাস। এমনকি সৈয়দ হকের ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ প্রথম সংস্করণে যেমন ছিল, দ্বিতীয় সংস্করণে তেমনটি নেই, পূর্ব পশ্চিমের আঙ্গিক গ্রহণ করা হয়েছে এই উপন্যাসেও! এই উপন্যাসগুলোও ঠিক ‘উপন্যাস’ হয়ে উঠতে পারেনি, হয়তো ডকুফিকশন বলা যায় তাদের। অর্থাৎ সুনীল নিজেই শুধু একটি দুর্বল উপন্যাসের জন্ম দেননি, আরো কিছু অসফল উপন্যাসের জন্ম-প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করেছেন। আর এখানেই সুনীলের প্রভাব-প্রতিপত্তি টের পাওয়া যায়। একজন লেখকের অসফল একটি উপন্যাসের যদি এতখানি অনুকরণ হয়, তাহলে তার প্রভাব যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মজার ব্যাপার হলো, সুনীল নিজে আর এই আঙ্গিকের উপন্যাস লেখেননি—‘একা এবং কয়েকজন’, ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’ ইতিহাস সাশ্রয়ী উপন্যাস হলেও ডকুমেন্টেশনের ঝুঁকি নেননি, অর্থাৎ নিজের তৈরি করা ফাঁদ থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন অচিরেই, অন্যদিকে বাংলাদেশের লেখকরা ক্রমাগত সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন এবং একের পর এক রচনা করে চলেছেন উপন্যাস নামধারী ডকুফিকশন।

শুধু কবিতা-গল্প-উপন্যাসের কথাই বা বলি কেন, তাঁর ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ হয়ে উঠেছে বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের অপরূপ-ব্যতিক্রমী-বিশেষ সংযোজন। তাঁর ট্র্যাভেলগ আর গদ্য রচনাগুলোও বারবার এক অপূর্ব উপলব্ধির জগতে নিয়ে গেছে আমাদের, দেখিয়ে দিয়েছে—সামান্যের ভেতরেও থাকে অসামান্যের সম্ভাবনা।

এত স্বল্প পরিসরে তো সুনীলবিষয়ক কথাবার্তা শেষ হবে না, আপাতত তাঁর একটি গদ্যগ্রন্থের কথা বলে শেষ করি। তাঁর ‘আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য’ গ্রন্থে তিনি তাঁর সমকালের লেখকদের সম্পর্কে দুর্দান্ত সব মূল্যায়ন হাজির করেছেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, আবু সায়ীদ আইয়ুব, বিভূতিভূষণ, সুধীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, সমরেশ বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী—এ রকম আরো অনেকের সম্পর্কে চমকপ্রদ সব মূল্যায়ন খানিকটা গল্পের ছলেই বলে গেছেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে আবু সায়ীদ আইয়ুবের প্রসঙ্গে তাঁর লেখাটি নিয়ে বলব। তার আগে কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে তাঁর লেখা থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করি—

‘কমল কুমার মজুমদার বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম ধাঁধা। এরকম কোন লেখক হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়, অথচ সত্যিই কমল কুমার মজুমদার নামে একজন লেখক বেশ কয়েক বছর বাংলা সাহিত্যে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করে গেছেন। সাহিত্য নিয়ে তিনি কি ছেলেখেলা করতে চেয়েছিলেন, না সাহিত্য তার অস্থিমজ্জায় মিশে হৃদপিণ্ডের ধমনির সঙ্গে সমন্বিত হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ নয়। আমি তাকে প্রায় কৈশোর বয়েস থেকে দেখেছি, বহু বছর তার সঙ্গ লাভ করেছি, তবু মানুষটিকে ঠিক বুঝতে পারিনি। তার রচনাগুলির মতো রচয়িতাটিও দুর্বোধ্য ও রহস্যময়।… দু-একটি উপন্যাস ও বেশ কয়েকটি ছোটগল্পে যখন কমলকুমার আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছেন, আমাদের মনে হয়েছে এমন বর্ণাঢ্য, এমন উচ্চস্তরের রস, সম্পূর্ণ বাক-বিভূতিসম্পন্ন রচনা আমাদের অভিজ্ঞতায় আর নেই, তখনই কমলকুমার যেন ইচ্ছে করে তাঁর পাঠকদের দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেন। পুরস্কার কিংবা অর্থাগম সম্পর্কে নির্লোভ এবং মোহমুক্ত থাকতে পারেন কোনো-কোনো লেখক, কিন্তু এমন লেখক কি সম্ভব, যিনি পাঠক চান না? … মোট পঁয়ষট্টি বছর বেঁচেছিলেন কমলকুমার। এর মধ্যে সাহিত্যে মনোনিবেশ করেছিলেন শেষ কুড়ি বছর। গল্প লিখেছেন মাত্র তিরিশটি, তাও দু-তিনটি অসমাপ্ত। এর মধ্যে অর্ধেক গল্প ভাবনার ঐশ্বর্যে, পুঙ্খানুপুঙ্খু নির্মিতিতে, কাব্য ও চিত্রশিল্পের মেলবন্ধনে বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ। আর দ্বিতীয়ার্ধের গল্পগুলি ভাষার কঠিন বুহ্যের কারণে ঠিক মতন বিচার করা যায় না। সেগুলি কি এক লেখকের খামখেয়াল না আরও বড় সম্পদ তা কে জানে! আমি সেই গল্পগুলির রসের সন্ধান এখনো পাইনি। মাঝে-মাঝেই সেগুলি পড়ি, হয়তো সারাজীবনই পড়ে যেতে হবে।’

কমল কুমারকে নিয়ে হিমশিম আমরাও কম খাইনি। তিনি প্রায়ই থাকেন বোঝা ও না-বোঝার মাঝখানে, কখনো তাঁকে ধরা যায় বলে মনে হয়, কখনো মনে হয় সারা জীবন তিনি অধরাই রয়ে যাবেন। এ রকম এক বিমূঢ় অনুভূতির মধ্যে যেতে যেতে যখন সুনীলের এই লেখাটি পড়েছিলাম। মনে পড়ে, বড় শান্তি পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, কেবল আমিই নই, আমরাই নই, কমল কুমারের অতি ঘনিষ্ঠ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এ রকম ধাঁধার মধ্যে দিনাতিপাত করে যাচ্ছেন এবং সরলভাবে তার স্বীকারোক্তিও দিচ্ছেন। সুনীলের এই সরলতা একমুহূর্তে তাঁকে কতটা আপন করে তুলেছিল, সে কথা এখনো মনে পড়ে।

এবার আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রসঙ্গ। তিনি যে বাঙালি ছিলেন না, বাংলা ভাষাটিও জানতেন না, সেটি আমরা অনেক আগেই জেনে ফেলেছি। কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলাম এই কথা জেনে যে, তিনি কেবল রবীন্দ্রনাথকে পড়ার জন্যই মধ্যবয়সে এসে বাংলা শিখতে শুরু করেছিলেন। যেহেতু তাঁর পাণ্ডিত্য প্রায় প্রবাদতুল্য, বোঝাই যায় যে, রবীন্দ্রনাথ পড়ার আগেই জগতের তাবৎ বড় বড় লেখকের বই তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ও পড়েছিলেন ইংরেজিতে, আর সেই থেকে তাঁর রবীন্দ্রপ্রীতির শুরু। তাঁকে মূল ভাষায় পড়ার জন্য বাংলা শেখা শুরু করলেন আইয়ুব, পড়লেন এবং শেষ বয়সে এসে কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই লিখে গেলেন একের পর এক বই। ব্যাপারটা বিস্ময়করই বটে। কেন এই রবীন্দ্রপ্রেম? কী পেয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে? সুনীল এসব প্রশ্নেরই এক চমৎকার ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। চমকপ্রদ একগুচ্ছ বাক্য দিয়ে তাঁর এই আইয়ুব-বিশ্লেষণ শুরু—

‘আবু সায়ীদ আইয়ুব মুসলমান নন। যেমন আমি হিন্দু নই। কোনও একটি রচনায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসী নন। ঈশ্বরকে বাদ দিলে আর ধর্মের প্রয়োজন কোথায়? কেননা ধর্মগুলি তো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছবার পথ বা সোপান। যিনি ঈশ্বর মানেন না তাঁকে বিশেষ কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি হিসেবের চিহ্নিত না করাই উচিত। উনিশ কুড়ি বছর থেকে আমিও নিরীশ্বর হয়ে উঠি। আমি ঈশ্বর বিরোধী নই, কিন্তু একথা নিশ্চতভাবে বুঝে গেছি, আমার কোনো প্রয়োজন নেই ঈশ্বর অনুসন্ধানের।’

তা কী প্রয়োজন আইয়ুব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গ তোলার? হ্যাঁ, প্রয়োজন তো আছেই, কারণ এরপরই তিনি রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরপ্রেমের ধরন নিয়ে বলবেন, আইয়ুবের প্রসঙ্গ আনবেন, তারপর প্রশ্ন করবেন—শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতাই নয়, রবীন্দ্র জীবনদর্শনেও আইয়ুব এতখানি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন কীভাবে? পরবর্তী আলোচনায় এ প্রশ্নের উত্তরও খুঁজবেন তিনি। সুনীল বলছেন—

‘যারা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেছে, তারা ঈশ্বরের বদলে কাকে অবলম্বন করে? কেউ কেউ মেতে ওঠে ঈশ্বরদ্রোহিতায়। সেটাই হয়ে ওঠে একটা নেশার বস্তু।…কেউ কেউ পুরোপুরি সরে আসতে পারেন না, অস্বীকার করেন বটে ঈশ্বর নামের বিগ্রহকে, এমনকী সৃষ্টিকর্তাকেও, কিন্তু কোনও একটি শক্তি, চেতনার অতীত কোনও সত্তা, সৌন্দর্য-অনুভূতি দিয়ে দেখা মঙ্গল-অমঙ্গলের কোনো নিয়ামক যেন তাঁদের জীবনে থেকেই যায়। এই মোহময় সত্তা সম্পর্কে যুক্তহীন সুস্বাদুতম ভাষায় অনেক কিছু লেখা হয়েছে উপনিষদে। সেই ঔপনিষদিক ধারণাই রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও দিয়ে চুঁইয়ে এসে, অনেকটা সরলীকুত হয়ে নানা বর্ণবাহারে ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়।

আইয়ুবও কি সেই মোহেরই বিলাসী? তিনিও কি পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি? এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তিনি এখনও এত আনন্দ পান, অথচ আমাদের একঘেয়ে লাগে?’

এর পর আবার এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা। আইয়ুবের আধুনিকতার বিচার নিয়ে, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতার প্রসঙ্গ নিয়ে, আর তার পর ফেরেন নিজের উত্থাপিত প্রশ্নটির উত্তর সন্ধানে—

‘‍আধুনিককালে, ঈশ্বরকে হারিয়ে আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যেকে একা, সমস্ত সুখ-দুঃখ আমাদেরকে একা একা ভোগ করে যেতে হবে। প্রকৃতি আমাদের কাছে শুধুই প্রকৃতি, বিশ্বপ্রকৃতি নয়, এবং সমস্ত রূপ শুধু, এক জীবনের ক্ষয়ে যাবার। আধুনিক মানুষ অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জেনে গেছে যে চিরপথ বা চিরশান্তি বলে কিছু নেই।…

আইয়ুব একা হতে চাননি। তিনি রবীন্দ্র-রচনার মধ্যে শান্তি পেয়েছেন। নিশ্চয়ই তাঁর সঞ্চিত বেদনা সব কেটে গেছে। তিনি শান্তি ও আনন্দ পেয়েছেন জেনে আমরাও সুখী।’

না, এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি আবু সায়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে। সুনীল সেটিই ভাবালেন। আর এভাবেই পাঠকের জন্য চিন্তা ও ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন তিনি তাঁর গদ্যে, গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়। আর তাই তিনি যখন প্রস্থান করেন এই নশ্বর পৃথিবী থেকে তখন মনে হয়—এ কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, কেবল একজন লেখকের মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের অবসান হয়ে গেল।

একটি কবিতায় সুনীল লিখেছিলেন—

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো

আমি বিষপান করে মরে যাবো!

বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ

নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ

প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ—

এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি

যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো

আমি বিষপান করে মরে যাবো।

এই দেশ, বিষণ্ণ আলোর এই বাংলাদেশ থেকে নির্বাসন তাঁর কাছে বিষপান করে মরে যাওয়ার মতো ব্যাপার ছিল। তিনি তো নির্বাসিতই ছিলেন সারা জীবন। নির্বাসিত, উদ্বাস্তু, ঠিকানাবিহীন। দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা, দেশভাগের সেই বিমূঢ় সময়ে। সেই বেদনা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি, নানান লেখায় বারবার ফিরিয়ে এনেছেন প্রসঙ্গটি, আর মনে করিয়ে দিয়েছেন—এই দেশত্যাগে তাঁর সায় ছিল না, তিনি মেনেও নেননি কোনোদিন। দেশের জন্য আমৃত্যু পুড়তে থাকা তাঁর এই মনটির কথা যখন ভাবি, মনে হয়, এক অপরূপ বিষণ্ণ আলো হয়ে তিনি জেগে আছেন বাংলাদেশের আকাশে।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত