| 19 জানুয়ারি 2025
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল ,তুমি কোথায় থাক!

তুমি বলেছিলে এখন তুমি একটা তিব্বতী পরিবারে পেয়িংগেস্ট হিসেবে আছ—মাসিক বন্দোবস্তে।

অফিসে থাক না নাকি সে জিজ্ঞেস করেছিল।

তুমি অফিসে থাক না বলেছিলে।বলেছিলে প্রথমে কয়েকদিন ছিলে। খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা,তাছাড়া অফিসে থাকলে অফিসের পরিবেশটাও নষ্ট হয়।দুজনকর্মচারী,টুরিস্টদের ও অসুবিধা হয়।তাই তুমি অফিস ছেড়ে প্রথমে হোটেল একটাতে থাকতে শুরু করেছিলে।তারপরে তুমি এই পরিবারটার খবর পেলে।বড়ো ঘরোয়া পরিবেশ।থেকে ভালো লাগে।

সে জিজ্ঞেস করেছিল মানুষের সঙ্গে থাকতে তোমার অসুবিধা হয় না।

        তুমি বলেছিলে হয় না। কারণ বাড়িটার নিচের মহলে পরিবারটা থাকে। উপর মহলে চারটি রুম আছে এটাচডবাথরুম।সেগুলোতেপেয়িংগেস্টরা থাকে। তারই একটি ঘরে তুমি থাক,একটাতে থাকে একজন সুইস  সাহেব। বাকি দুটিতে মানুষের  আসা যাওয়া চলতে থাকে। দীর্ঘদিনের অতিথি তোমরা দুজন। ওপরে দুটো ঘর এখনও বানানো হয়নি। সেই জায়গাটা খালি হয়ে রয়েছে। সেখানে ছাদের নিচে সুন্দরভাবে বসে থাকা যায়। বসার ব্যবস্থা আছে। সেখান থেকে  একদিকে ধৌলাধার এবং অন্যদিকে ভালোভাবে উপত্যকা দেখা যায়।

 খাওয়া–দাওয়া? 

খাওয়া-দাওয়া ভালো।? সকালবেলা এবং রাতের খাবার পাওয়াযায়।

        খাবার জন্য কী দেয়, সে জিজ্ঞেস করেছিল। 

সকালবেলাপ্যানকেক  বা পরোঠা। রাতের বেলা ভাত। সাধারণত মাংস বা ডিম কিছু একটা থাকে। রান্নাবান্না ভালো। বিকেলে যার সঙ্গে কেক বিস্কুট বা স্যান্ডউইচ থাকে।

সে জিজ্ঞেস করেছিল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কি? 

তুমি বলেছিলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খুব পরিষ্কার।  সেই জন্যই সেখানে থাকতে ভালো লাগে। গৃহকর্ত্রী এইসব বিষয়ে ভীষণ কড়া।নিজেই অনবরত পরিষ্কার করে থাকেন। সকালবেলামেয়েটি বা ছেলেটি এসে রুমগুলিকে পরিষ্কার করে দেয়। তুমি বলেছিলে তোমার মতো মানুষের জন্য এই ধরনের ব্যবস্থাইসবচেয়ে সুবিধা জনক।

 মেয়েটি কিছু সময়  চুপ করেছিল। খুব গভীরভাবে সে যেন কিছু একটা চিন্তা করছিল। সে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ছিল। বোধ করি কিছু একটা বিষয়ে  সে নিজের মনেই যুদ্ধ করছিল। তুমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করব বলে ভেবেও  চুপ করে গিয়েছিলে।  এই ধরনের সময়ে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে ভালোভাবে উত্তর পাওয়াযায় না। তুমিও চুপ করে তার কথা বলার অপেক্ষা করছিলে। 


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩৪) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


মেয়েটিজিজ্ঞেস করেছিল সেও সেখানে পেইংগেস্ট হয়ে থাকতে পারবে নাকি।  লোকেরা মেয়েদের অতিথি হিসেবে রাখতে চায় না।

 তুমি বলেছিলে রাখে।  মাঝখানে আমেরিকান একটি মেয়ে এসে অনেকদিন ছিল।চারপাশের খুব ফোটো নিয়েছিল।বইয়ের কাজ করত সে।

 জিজ্ঞেস করেছিল তুমি মেয়েটিকেনিয়েবেরিয়েছিলে নাকি।

 তুমি বেরোওনি বলে  বলেছিলে। সে ট্রেকিং এর জন্য বা হাইকিং এর জন্য আসে নি। পরিচয়হয়েছিল একই ঘরে থাকার জন্য। সে কতদিন থাকার পরিকল্পনা করেছিলে তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে। বলেছিল কম দিন থাকলে ভাড়াবেশি, বেশিদিন থাকলে ভাড়া কম।

সে বলেছিল সে কিছুদিন থাকার কথা ভাবছে। ঠিক কতদিন সে বলতে পারে না। ভালো লাগার ওপরে নির্ভর করবে। সে বলেছিল সে থাকা হোটেলে এভাবে একটা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারলে ভালো লাগবে। হোটেলে খুব নিঃসঙ্গ অনুভব হয়। কারও সঙ্গে কথা বলার উপায় থাকে না।এভাবে এক ঘর মানুষের মধ্যে,একটা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারলে অন্তত নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচা যায়। হোটেলের একাকীত্ব কখনও বড় বিষন্ন এবং বিরক্তিদায়ক হতে পারে।

        তুমি তাকে বলেছিলে যে তুমি থাকা পরিবারটিতে থাকলে তার কোনো অসুবিধা তো হবেই না বরঞ্চ ভালো লাগবে। গৃহকর্ত্রী খুব স্নেহময়ী এবং কথাবার্তা বলতে ভালোবাসে।দুটিমেয়ে এবং একটি ছেলে আছে। ওরা ও খুব  ভালো। পরিবারটা সবাইকে আপন করে নেয়। সকালের আহার চাইলেরুমের মধ্যে দিয়েযায়; কিন্তু সন্ধ্যার আহার সব সময় নিচে খাবার ঘরে গিয়ে খেতে হয়। এবং প্রায়ইবিদেশি অতিথি থাকে বলে তারা অতিথির প্রাইভেসিকে সম্মান করতে জানে। কখনও অতিথির ব্যক্তিগত কথায় তারা নাক গলায় না। 

সে তোমাকে পরিবারটিতে জায়গা পাওয়া যাবে কিনা খবর করে দেখতে অনুরোধ করেছিল।

 তুমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ঠিকঠাক করে দিয়েছিলে।

 সে তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল।

 তোমার নিজের মনটাও খুব ভালো লেগেছিল। তোমার মনটা এক অজানা উপলক্ষে পুলকিত হয়ে উঠেছিল। তুমি ভেবেছিলে সে তোমার কাছে থাকবে— তোমার কাছে থাকবে। সকাল— দেখা হবে। কথা বলতে পারবে। এবং লাল রঙের  স্কার্ফটা , সেই রক্ত রাঙ্গা স্কার্ফটা তুমি তাকে দিতে পারবে। কেবল দিতে পারাই নয় –তোমার খুব ইচ্ছা সেই স্কার্ফটা তুমি নিজের হাতে তার গলায়পরিয়ে দেবে— তাকে কিরকম লাগে তুমি দেখবে। তার কোমল ফর্সা মুখের চারপাশে সেই রক্তরাঙ্গা স্কার্ফটা একটা কোমল আবর্তের সৃষ্টি করবে— ইস— তুমি সেই ছবিটারকল্পনায়কিছুদূর বিভোর হয়ে পড়েছিলে।

 সে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি যে চুপ করে আছ।

 তোমার মনে তখনও লাল গলা বন্ধটা আর তার মুখটার ছবি ভেসেছিল। তুমি কেবল হেসেছিলে। কোনো উত্তর দাওনি।

        সে বলেছিল তুমি তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছ। অনেক আনন্দ দিয়েছ। সে ট্রেকিংয়ে না যাওয়ার থেকেই তুমি নিঃস্বার্থভাবে তাকে সঙ্গ দিয়েছ। তার অকারণ দুঃখে ভারি হয়ে পড়া মনটা তুমি অনেক হালকা করে দিয়েছ। আর সেই ভিক্ষুণীদের সংঘে নিয়ে যাওয়াটা —সেটা যে তার কাছে কত বড়ো কাজ  করেছ সেটা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবেনা। আর শেষে এই থাকার জায়গাটা ঠিক করে দেওয়াটা। সন্ধান দেওয়াই নয়, ঠিকও করে দিয়েছ। সে এখানে কিছুদিন থাকতে চায়। কেন সে বলতে পারেনা, কিন্তু এই জায়গায় এবং এখানকার মানুষগুলোর প্রতি সে বুঝাতে না পারা আকর্ষণ অনুভব করছে। কিন্তু সে তোমাকে আর অসুবিধা দেবে না। ইতিমধ্যেই সে অনেক অসুবিধা দিয়েছে। সে হয়তো কিছুদিন এখানে থাকবে। কতদিন এখনই তা বলতে পারেনা। কিন্তু সে তোমাকে আর কোনো ধরনের অসুবিধা দেবে না।

তার কথা শুনে তোমার মনটা হাহাকার করে উঠেছিল।

 তুমি বলেছিলে তুমি তাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছ, ক্লায়েন্ট হিসেবে নয়। তার জন্য তুমি যা করেছ সেটা বন্ধু হিসেবেই করেছ— ক্লায়েন্টের জন্য করনি। তোমার কণ্ঠস্বর গভীর হয়ে উঠেছিল। মনে মনে তুমি আঘাত পেয়েছিলে বলে অনুভব করেছিলে আর সেটা তোমার কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠেছিল। তুমি বলেছিলে যে তুমি মানুষের প্রাইভেসিকে সম্মান জানাতে জান,বন্ধুরপ্রাইভেসির বিষয়েও তুমি সচেতন এবং সতর্ক।সে যদি তোমার কাছ থেকে কোনো অসুবিধা পেয়ে থাকে….

সে তোমাকে কথাটা শেষ করতে দেয় নি।টেবিলের ওপরে থাকা তোমার হাতটা তার দুই হাতে আলগোছে তুলে নিয়ে ধরে ফেলেছিল।সে তোমার কাছে মাফ চেয়েছিল।সে বলেছিল সে তোমার মনে আঘাত দিতে চায় না—সত্যিই চায় নি।আর সত্যিই অন্তর থেকে সে তোমাকে আপনজন বলেই গ্রহণ করেছে—আর সে এটা সত্যিই ভেবেছিল যে সে যেন তোমার কাছ থেকে বেশি করে সুবিধা নিয়েছে—অন্যায়ভাবে সুবিধা নিয়েছে।কিন্তু সে আর এভাবে ভাবে না ।এভাবে ভাবার জন্য সে নিজেই এখন লজ্জা পাচ্ছে।

তোমার চোখদুটিজ্বলে উঠেছিল—চোখের জন বের হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।

আর তার কুয়োর মতো গভীর চোখজোড়া থেকে দুটো জলের ধারা স্ফটিকের ফোঁটার মতো মসৃণ গাল দুটির ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত