| 28 মার্চ 2024
Categories
চলচ্চিত্র

আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্ম প্রসঙ্গে । সন্দীপন চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্ম মিডিয়া জগৎতে বেশ জায়গা দখল করেছে। বিজ্ঞানের এক মজার আবিষ্কার হিসেবেই চলচ্চিত্রের জন্ম। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে তার ব্যবহার শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তা জনপ্রিয় ও বাজারসফল হয়ে ওঠে। এরপর ক্রমে তা এক স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পূর্বোক্ত ধারার ছবিগুলোর থেকে শিল্পিত ছবিগুলোকে আলাদা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ‘আর্ট সিনেমা’কথাটার প্রয়োগ এসেছে আমেরিকান ‘আর্ট হাউস’-এর অনুসরণে; এসব আর্ট হাউসগুলোয় বিশেষভাবেই বারংবার ধ্রুপদী চলচ্চিত্রগুলো এবং সিরিয়াস ও সচেতনভাবে বুদ্ধিপ্রধান যেসব চলচ্চিত্র, সেগুলো দেখানো হত। এমনকি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজ ধারাটির প্রসারের সঙ্গেও ‘আর্ট সিনেমা’পরিভাষাটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, আর্ট সিনেমা বলতে সেখানে মূলত বোঝানো হয় ‘ফিল্মস’-কে; ‘ফিল্মস’ও ‘মুভিজ’ শব্দ দুটোর মধ্যে সেখানে একধরনের গুণগত তফাৎ করা হয়-দ্বিতীয়টা এক ব্যাপক আবেদনময় বাজারি ও বাণিজ্যিক পণ্য; আর প্রথমটা স্বল্প খরচে নির্মিত, তার প্রয়োজনাব্যয় কম ও বুদ্ধিগত দিক দিয়ে তা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তবে, এই আর্থিক বিভাজন জনপ্রিয়তার কোনো চরম মাপকাঠি নয়। তাই The Fall of the Roman Empire (১৯৬৪) বা Hello Dolly (১৯৬৯)-র মতো বাণিজ্যিক ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও, অবাণিজ্যিক বিষয় নিয়ে তৈরি ফেলিনির Eight and Half (১৯৬৩) আবার বাণিজ্যিকভাবে বেশ সফল।

আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্ম-এর মধ্যে পার্থক্যের নানা মাপকাটি আছে। যেমন, ইংলণ্ডে কোনো বাণিজ্যিক ছবির ডিস্ট্রিউশনের জন্য ৫০টা বা তার বেশি সংখ্যক প্রিন্ট তৈরি করা হলেও কোনো শিল্পিত ছবির বিশেষ কিছু থিয়েটারে প্রদর্শনের জন্য তৈরি হয় বড়জোর ২০টা প্রিন্ট। তাছাড়া একটি শিল্পিত প্রয়োজনা ব্যয় কৃচিৎ একটি মূলধারার ছবির মতো এত বেশি; মূলধারার ছবির মতো অত লাভও তা থেকে হয় না, আবার অত ক্ষতিও হয় না। দীর্ঘদিন ধরে কোনো ছোট সিনেমা হলে কোনো আর্ট ফিল্ম চললে তা থেকেও মোটামুটি আর্থিক সাফল্য আসে। তবে এর দর্শক পাওয়াটাই এক সমস্যা। বড় বাণিজ্যিক সিনেমা হলগুলাতে যদি অনাড়ম্বরভাবে কোনো আর্ট ফিল্ম মুক্তি পায়, সেক্ষেত্রে মোটামুটি দর্শক হয়ত পাওয়া যেতে পারে, আবার কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে সেসব সিনেমাহল আধ-ফাকাও যেতে পারে। আন্তোনিওনির Zabriskie point (১৯৬৯) এভাবে MCM সিনেমায় মুক্তি পেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

বাংলা ছবির ক্ষেত্রে একই অবস্থা হয়েছিল সত্যজিতের ‘পথের পাচালী’ (১৯৫৫)-র প্রথম প্রদর্শনের সময়ে বা ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১)-এর। অথচ ছোটো হলগুলাতে মুক্তি পেলে এই ছবিগুলোর প্রশংসা ও আর্থিক সাফল্য দুটোই লাভ করার সম্ভাবনা থাকে। যেমন হয়েছিল মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯)-এর ক্ষেত্রে। আবার যেমন কুরোসাওয়ার Seven Samurai (১৯৫৪) জাপানে প্রভূত সাফল্য পেলেও, তা তখন সাবটাইটেলসহ বিদেশে মুক্তি পায়, তখন খুব একটা চলেনি। অথচ পরে ঐ একই গল্প নিয়ে জন স্টার্জের পরিচালনায় আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ছবি The Magnificent Seven (১৯৬০) মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি হিসেবে প্রভূত সফলতা পায়।

আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্ম-এর মধ্যে এই পার্থক্যের ইতিহাস সংস্কৃতিগতভাবে নির্ধারিত হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই তফাতের দিকটাকে প্রথম জোরদারভাবে উস্কে দিয়েছিল ১৯১৭-র রাশিয়ান বিপ্লব, তখন র-ফিল্ম স্টকের ঘাটতির ফলেই চলচ্চিত্রবিদ্যার সিরিয়াস চর্চা শুরু হলো বলা যেতে পারে। আমেরিকান ফিলোর প্রিন্ট, যেমন গ্রিফিথের The Birth of a Nation (১৯১৫)-এর দৃশ্যগুলোকে কেটে সেগুলোকে আবার ভিন্ন ক্রমে জুড়ে এবং খাতায় কলমে শুরু হয়ে গেল চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ। এর পরপরই ফ্রান্সে শুরু হয়ে যাবে আর্ট হাউস আন্দোলন। ১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে প্যারিসে স্বল্পস্থায়ী কিছু ফিল্ম ক্লাব গড়ে ওঠে—যেমন Friends of the Seventh Art বা ১৯২৪-এ চিত্রপরিচালক লুই দেকের প্রতিষ্ঠিত Cine Club। ঐ একই বছরে প্রথম নিয়মিত ফিল্ম সোসাইটি The Free Tribune of Cinema এবং ছোট্ট Vieux Colombier থিয়েটার গড়ে ওঠে, যা পরে বিশেষ ধরনের ছবি দেখানোর জন্য বিশ্বখ্যাত এক সিনেমা হল হয়ে উঠবে।

তাছাড়া শুধু বাণিজ্যিক কারণে নয়, বরং ‘Art of the Film’-এর সংরক্ষণের জন্যই গড়ে ওঠে কিছু ফিল্ম আর্কাইভ। এর মধ্যে প্রথমটা ছিল ইংলণ্ডের National Film Library (পরবর্তীকালে National Film Archieve) আর এ ধরনের সংস্থা। এখন সারা পৃথিবী জুড়েই, যেমন— আমেরিকার George Eastunan Hose, The Library of Congress, Museum of Modern Art, রাশিয়ার Gosfilmofond, মিশরের National Film Archieve প্রভৃতি। ভারতেও এ ধরনের আর্কাইভ গড়ে উঠেছে। এমনকি অনেক সময়ে নিজেদের দেশেও যেসব ফিল্মের প্রিন্ট আর পাওয়া যায় না, সেসব ফিল্মের সন্ধান মেলে অন্য কোনো আর্কাইভে। তাছাড়া এ ধরনের আর্কাইভগুলো টেলিভিশন কোম্পানীগুলোকেও ফিল্মের প্রিন্ট যোগান দিয়ে থাকে । সর্বোপরি, তারা ফিল্মের প্রিন্টগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে এবং বিশেষ ধরনের সিনেমাহলগুলোয় (যেমন—লণ্ডনের National Film Theatre. প্যারিসের CinemathequeFrancaise. বার্লিনের Arsenal Kin০ প্রভৃতি)। সেগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে।

১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকেই বাংলা ভাষাতেও বিশ্লেষণমূলক চলচ্চিত্র সমালোচনা ধারাটির শুরু হয়। প্রবাসী, ভারতী, নাচঘর, বায়োস্কোপ, চিত্রলেখা চিত্রপঞ্জী প্রভৃতি পত্রিকায় এ ধরনের লেখাগুলি প্রকাশিত হতো। মূলত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের হাতেই এর সূত্রপাত। ১৯২৪-এ তিনি নাচঘর পত্রিকায় ‘কিলমের আট প্রবন্ধে লেখেন— ‘ফিল্মকে আটিস্টিক করিতে হইলে সর্বাগ্রে চাই গল্পের সুসমঞ্জস বিকাশ ও তার অভিনয় মনস্তত্ত্বের নিখুঁত লীলা।’ এখানে আদর্শ হিসেবে ধরা হচ্ছে, গ্রিফিথের চলচ্চিত্রকে, জোর দেওয়া হচ্ছে ‘মানবতা’ ও ‘স্বাভাবিকতা’র উপর, যেখানে গল্প বলার কাজটি ‘Natural chain ধরিয়া চলিবে; train of events স্বাভাবিক হইবে।’

১৯৩০-এ চিত্রলেখায় প্রকাশিত শ্রীচিত্র সেনের ‘বাংলা চলচ্চিত্র ও বাংলা উপন্যাস’ প্রবন্ধেও চলচ্চিত্রকে উপন্যাসেরই এক চিত্ররূপ হিসেবে দেখা হয়েছে, তবে সেই উপন্যাসে গতিময়তা ও দৃশ্য-প্রতিমার প্রাধান্য থাকা প্রয়োজন। ১৯৩২-এ চিত্রপীর বিভিন্ন প্রবন্ধেও বলা হচ্ছে এক বাস্তববাদী, ধারাবাহিক, নির্মেদ সম্পদনার কথা। ১৯৩৪-এ প্রকাশিত হয় নরেন্দ্র দেবের সিনেমা: ছায়া মায়ার বিচিত্র রহস্য গ্রন্থ, যেখানে রাজশেখর বসুর সহযোগিতায় তৈরি হয় চলচ্চিত্র সংক্রান্ত নানা শব্দের এক পরিভাষার তালিকা। ১৯৩৯-এ ফরিদপুরে হয় প্রথম বঙ্গীয় চলচ্চিত্র সম্মিলনী। কিন্ত ব্যবসায়িক পত্রপত্রিকাগুলো ক্রমে তাদের চলচ্চিত্র সমালোচনার একটা নির্দিষ্ট চেহারা তৈরি করে নিতে লাগল, যা চলচ্চিত্রকে আলাদা কোনো শিল্পমাধ্যম হিসেবে নয়, বরং সাহিত্যের সেলুলয়েড রূপ হিসেবেই দেখতে দর্শককে অভ্যস্ত করে তোলে। কিন্তু শিল্পিত চলচ্চিত্রে তো অনেক সময়েই ঘটনার থেকে বরং ঘটনার অনুরূপ কতি বা ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য এমনকি ঘটনাকে তুচ্ছ করে দিয়ে এক প্রবন্ধের গড়নই বড় হয়ে ওঠে। তাই তাকে বুঝতে হলে চাই— এক অন্য ধরনের চলচ্চিত্র-চর্চার পরিবেশ। ১৯৪৭ থেকে পরপর কিছু ঘটনার সূত্রে বাংলার চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতেও আসে এক নতুন জোয়ার।

১৯৪৭ (৫ই অক্টোবর)—ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি স্থাপন। ১৯৫০- জঁ রেনোয়ার কলকাতায় আগমন। ফিল্ম সোসাইটির সভ্যদের তার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ । সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, নরেশ গুহ ও সুভাষ সেনের সম্পাদনায় চলচ্চিত্র (প্রথম পর্যায়) সঙ্কলন প্রকাশ।

১৯৫১ পুদোভকিন ও চেরকাসভের কলকাতায় আগমন। ফিল্ম সোসাইটিতে তার বক্তৃতা প্রদান। ১৯৫২- ভারতে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেরঅনুষ্ঠান। ১৯৫৫- সত্যজিতের‘পথের পাঁচালী’র মুক্তিলাভ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে শিরোপা লাভ। ১৯৫৬— ফিল্ম সোসাইটির দ্বিতীয় পর্যায়। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সংস্থার সঙ্গে এই ফিল্ম সোসাইটির যোগাযোক স্থাপন।

এইসব ঘটনার মধ্যে দিয়েই বাংলায় আর্ট ফিল্ম ও কমার্শিয়াল ফিল্ম-এর পার্থক্য একটা নির্দিষ্ট চেহারা তৈরি করে নিতে শুরু করে। চলচ্চিত্র-সংসদের কর্মকর্তারা যখন কার্য-কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ও অতিরিক্ততা-মুক্ত বাস্তবতার সর্বাঙ্গীণ উপাদানগুলিকে যথার্থ শিল্পিত চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞান হিসেবে নির্দেশ করলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের অ-শিল্পিত চলচ্চিত্রের মানচিত্র ও তৈরি করে দিতে হচ্ছিল। মূলত ফিল্ম সোসাইটির মুখপত্রগুলোর মাধ্যমেই নির্দিষ্ট ও গণ্ডীবদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল শিল্পিত ছবি। ধর্ম প্রধানত হলিউডের বাস্তববাদী উপস্থাপন ভঙ্গি ও ইতালিয় নিও-রিয়ালিজমের বোধ থেকেই বাংলায় জেগে উঠেছিল শিল্পিত চলচ্চিত্র-বিষয়ক সেই ধারণা। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে শিল্পিত ছবির শিকড় খুঁজতে গিয়ে, সত্যজিতেরও আগে আমরা চলে যেতে পারি প্রমথেশ বড়ুয়ার চলচ্চিত্রগুলোয়। ঋত্বিক খেয়াল করেছিলেন যে, কিভাবে প্রমথেশের ‘গৃহদাহ’ (১৯৩৬)-এ অচলার শহর থেকে গ্রামে আসার দৃশ্যে, হাইহিল পরা। দু’টো পা থেকে সরাসরি কাট করে দেখানো হয় আলতা রাঙানো দু’টো পা, অথবা মুক্তি’ (১৯৩৭)-তে অসাধারণ সাবজেক্টিভ ক্যামেরার ব্যবহার-এসবের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল শিল্পিত ছবির হরেক উপাদান। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মূলধারার জনপ্রিয় ছবিতে উদ্ভাবনার দিকটি মূলত প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত। সেক্ষেত্রে, শিল্পিত ছবির স্বকীয়তা বরং অনেক বেশি এবং তার কাছে দর্শকের চাহিদাও অনেক বেশি।

পশ্চিমী ছবির মধ্যে, মূলধারার জনপ্রিয় ছবি বলতে আমরা মূলত হলিউডের বাণিজ্যিক ছবিগুলোকেই বুঝে থাকি, যার আখ্যান অনেকাংশেই দলগত কাজের ফসল, যেখানে অনেক লেখক মিলে সে-আখ্যানের পরিকল্পনা—তার চূড়ান্ত মুহূর্তগুলো, উত্থান পতন, নাটকীয় পরিবর্তন ও সমাপ্তি নিখুঁতভাবে সাজায়। কিন্তু ভারতের মূলধারার জনপ্রিয় ছবিতে আবার তা হয় না, সাধারণত এক বা দুজন মিলেই রচনা করেন আখ্যান ও সংলাপ। তবে, মোটামুটিভাবে সব জায়গাতেই, এই ধরনের ছবিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিচালকের থেকে বেশি নির্ভর করে প্রযোজকের উপরে। এই ছবিগুলোয়, সুসামঞ্জস্য বিকাশযুক্ত এক নিটোল ও আপাতসরল রৈখিক আখ্যানের বিন্যাসে, গুপ্ত থাকে শিল্প নির্মাণের আয়াস এবং সেই আখ্যানও হয় নেহাৎ ছক বাঁধা চরিত্রের। তবে কখনো কখনো এসব ছবির কোনো কোনো লেখক বা পরিচালক এরমধ্যেও তাঁদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি যোজনা করতে পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রেও মূলত বাণিজ্যিক দিকটা মাথায় রেখেই তাকেও একভাবে ছক বন্দি করতেই হয় ঐ চলচ্চিত্রকে।

বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতায় সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও, কিভাবে এইসব পরিচালক তার মধ্যেও ব্যক্তিগত এক স্বকীয় প্রকাশভঙ্গি গড়ে তোলেন, তার যথাযথ মূল্যায়ন তকালীন দর্শকেরা খুব একটা করতে পারেন নি। কিন্তু বর্তমান চলচ্চিত্রবিদ্যার চৌহদ্দিতে মূলধারার এসব জনপ্রিয় ছবিগুলোও শিল্পিত ছবির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন চলচ্চিত্র-গোত্রের পরিচালকদের (যেমন—হাওয়ার্ড হক্স, জোসেফ ভন স্টার্নবার্গ, আনস্ট লুবিৎস প্রমুখ) কাজ বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই এখন আলোচিত হচ্ছে। আট হাউসের দর্শকেরা নিজেদের দেশ ছাড়া অন্য দেশের ছবিও দেখতে ভালোবাসেন। তবে স্থানভেদে এই দর্শকদের রুচি আর চাহিদাও আলাদা আলাদা। এমনকি সেই রুচি যে সবসময় ‘filmic’ তাও নয়, বরং তাকে এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে রেখেই বিচার করা উচিত; রুচির এই অনুকূলতা যে সব সময়ে নিজের দেশের ছবির দিকেই ঝুঁকবে, এমনও কোনো কথা নেই, বরং কখনো কখনো তা বিদেশী ছবির বাজার তৈরিতেও সাহায্য করে। যেমন— ইতালিয় নিও-রিয়ালিজমের একটি বিখ্যাত ছবি রোবের্তো রোসেলিনির ‘Rome, Open City’ (১৯৪৫) ইতালিতে এবং ১৯৪৬-এর কান ফিল্ম ফেস্টিভালেও সমানোচকদের কাছে খুব একটা প্রশংসিত হয়নি, কিন্তু তার পরপরই তা প্যারিসে মুক্তি পায় ও উচ্চ প্রশংসিত হয়। আর, প্রযুক্তির নিম্নমান বা অপেশাদারদের দিয়ে অভিনয় করানো ইত্যাদি যে কারণগুলো ইতালিতে তার সমালোচনার হেতু ছিল, সেগুলোই প্যারিসে তার প্রশংসার হেতু হয়ে ওঠে। এই ছবির প্লট ক্লিশে হলেও, তার চেয়ে বরং অনেক বড় হয়ে ওঠে— এক ধরনের মেকি আড়ম্বরকে এর পাশ কাটিয়ে যাওয়া, এর দানাদার ধাচের প্রিন্ট থেকে ফুটে ওঠে এক তাৎক্ষণিক তার তাড়না, প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে এর যোগাযোগও একধরনের প্রামাণিকতার বোধ ফুটিয়ে তোলে। আমেরিকাতেও সাফল্য পায় এই ছবি।

ইতালিয় নিও-রিয়ালিজমের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী; তা আমাদের দেশেও বিমল রায়ের মতো বাণিজ্যিক ছবির এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো শিল্পিত ছবির পরিচালক উভয়কেই প্রভাবিত করে। বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩)-এ দেখি, জমিদারের অত্যাচার আর অজন্মার মধ্যে দাঁড়িয়েও এক কৃষক আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য কিভাবে মরণপণ লড়াই করে। এ বিষয়বস্তু বিশ্বজনীন, এ নিয়ে জন ফোর্ড “The Grapes of Wrath’ (১৯৪০) বা জঁ রেনোয়া ‘The Southerner’ (১৯৪৫) এমনকি একটু আলাদাভাবে মিজোগুচি ‘UgetsuMonogatari’ (১৯৫৩) করেছেন। আর সত্যজিৎ রায় মূলত প্রভাবিত হয়েছিলেন জঁ রেনোয়ার ‘The River’ (১৯৫৮) এবং ভিত্তেরিও দি সিকার ‘Bicycle Thieves’ (১৯৪৮)-র দ্বারা। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি পশ্চিমি অনুমোদনের মুখাপেক্ষী। সাফাই হিসেবে তিনি বলতেন, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি, তার ঐতিহ্য ও পুরাণ— এসবের গহনে ঢুকলে অভারতীয় দর্শকদের কাছে তা দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে। আসলে এই ধরনের শিল্পিত ছবি বিদেশে দর্শক পেলে, তার পরিচালকের বিরুদ্ধে প্রায়ই সাংস্কৃতিক বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদেশী সংস্কৃতির তোষণের অভিযোগ উঠে আসে; কিন্তু বিদেশি রুচিমান দর্শকের কাছে আবেদনহীন হলেই তা কেন অধিক প্রামাণ্য হবে, সেটা ঠিক বোঝা যায় না। সত্যজিতের পর বাংলার থেকে একে একে উঠে আসেন ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনের মতো বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব। এ ধনের শিল্পিত ছবির গণ্ডীর মধ্যে চলচ্চিত্রের মাস্টার পিসগুলো যেমন পড়ে, তেমনই এমন কিছু ছবিও পড়ে যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস থেকে মুছে গেছে। কিন্তু নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে রয়ে গেছে শ্রেষ্ঠ ছবিগুলো, ক্রমাগতই তার পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে এবং এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক ছবিগুলোও কখনো কখনো তার বিষয়বস্তুকে নিজের উপজীব্য করে তুলছে। এরকমই এক ছবি কার্ল থিয়োডোর ড্রেয়ারের The Passion of Joan of Arc’ (১৯২৮), যা মুক্তি পাওয়ার পর তার সম্পর্কে লেখা হচ্ছিল‘অসম্ভব ক্লান্তিকর ছবি… এক ডলার দিয়ে দেখা কোনো আমেরিকান বাণিজ্যিক ছবিও এর চেয়ে ঢের ভালো, সেটিই পরে হয়ে উঠবে এক আর্কেটাইপাল শিল্পিত ছবি, যা বারবার ছায়া ফেলবে রোবের ব্রেসঁ-র ছবিগুলোয়, যার প্রতি জঁ লুক গোদার নির্দেশ করবেন তার ‘A Married woman’ (১৯৬৪)-এ। যেসব চলচ্চিত্রের নির্মাণ, তার অন্তর্গত বোধ ও জটিলতাসহ দর্শকের কাছে উপস্থাপিত হয়, সেসব চলচ্চিত্রকে দর্শকেরাও নতুনভাবে পড়েন এবং তা নিয়ে চর্চা করেন। এই দর্শকেরা চলচ্চিত্রকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং সমাজের অন্তর্গত এক বিস্তৃত নৈতিক, দার্শনিক ও সামাজিক বিতর্কের অংশ হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। তবে সম্প্রতি ইউরোপীয় শিল্পিত ছবির উৎপাদনে বেশ মন্দা চলায় ১৯৯০-এর দশক থেকে এই দর্শকেরা ঝুঁকে পড়েছেন ভারত, ইরান, এশিয়ার অন্যান্য অংশের ও লাতিন আমেরিকার ছবির দিকে, যেখানে দৃশ্য-উপস্থাপনার আঙ্গিক সৃষ্টি হয় মতাদর্শ থেকে এবং সেই চলচ্চিত্র-আঙ্গিকও কোনো অচল অনড় বস্তু নয়, বরং তা ক্রমাগতই নতুন নতুন ভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে।

তথ্যসূত্র:

১. সুধীর চক্রবর্তী; বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ৫৭-৬২।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত