| 28 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

মানুষ ও পৃথিবী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মানুষ সবসময় মনে করে মানুষকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী। ভাবে, পৃথিবীর যাবতীয় ভাল মন্দ মানুষের সুখ দু:খের সাথে জড়িত। এই ধারণাটাই মানুষের সবচেয় বড় ভুল। ৬০০ কোটি বছর বয়সী পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান খুব বেশি হলে ১ লক্ষ বছর। মানুষ মরে গেলেও পৃথিবী থাকবে সুন্দর। বরং বলা চলে পৃথিবীতে মানুষই তার দু:খ যন্ত্রণা যুদ্ধ ধ্বংস কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে গ্রহটিকে জর্জরিত করে তুলেছে ক্রমাগত।

এমনটা অনেকেই মনে করেন, মানুষই পৃথিবীতে সভ্যতার সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নটা হলো, সভ্যতাটি কি পৃথিবীর? না কি মানুষের? সুরময প্রাসাদ কিংবা বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার বানিয়ে মানুষ যে তেলেসমাতি নাকি দেখিয়েছে তাতেইবা পৃথিবী নামক মাটির ঢেলা ও বৃহৎ জলাশয় সমূহের কী এমন ঘটে গেল? ক’জন মানুষেরইবা এতে উপকার হয়েছে? মানুষের চন্দ্রাভিযান বা মঙ্গলাভিযানেও এ গ্রহের কী এসে যায়? মারণাস্ত্র তৈরি কিংবা রকেট ক্ষেপনে ক’জন মানুষের খুব আয়েশ হয়েছে? আর পৃথিবীর? কতো প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হয়েছে মহাযুদ্ধের তাণ্ডবে?

মানুষের সভ্যতায় অন্য জীবজগতের কীইবা আসে যায়! কিংবা একতাল মাটি ও জলের গ্রহের! সভ্যতার নামে যে গাড়ি চলে, যে কলের উনুন জ্বলে, তাতে সমস্ত গ্রহের মাটি জল সহ সকল জীবই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বময় করোনা সংক্রমণের গ্রহের দুর্দিন ভেবে, এখন যারা এই গ্রহটির জন্যে আক্ষেপ করেন তারা কেবল মানুষের জন্যেই সে আক্ষেপ করতে পারেন। লক্ষ্য করেন, মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণেই এ মড়ক সারাবিশ্বকে নাকাল করেছে। আগেকার যুগে মহামারী একটা নির্দিষ্ট অন্চলের মানুষকে আক্রান্ত করতো। এবং সেই এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। ইদানীং অর্থনীতির স্বার্থে কতো কথাই না বলা হয়। এই করোনাকালেও বিশ্ব অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে কতো আহাজারি। হায় অর্থনীতি! যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে বরাদ্দ কেবল মোট বাজেটের ৪–৫%, যেখানে সমর তথা প্রতিরক্ষা বাজেট আমাদের ধারণার বাইরে থেকে যায়। সে অর্থনীতির সুফলইবা ক’জন মানুষই পায়! তারপরও বলতেই হয়, এই অর্থনীতি জিনিষটাওতো মানুষের একান্ত নিজের। এই অর্থনীতির উত্থান পতনেও অন্য জীবজগতের এমন কী জড় জগতেরও কোনো বিন্দু বিসর্গ বিলাপ নেই। জমিদারী শেষ হয়ে গেলে প্রাসাদের পাঁজর বেরিয়ে এলে, কই অন্য কোনো দালান এসে তার শুশ্রুষা তো করে না?

মানুষের বর্তমান জ্ঞান বা ধারণা মতে, অন্যগ্রহে কিন্তু প্রাণ নেই, গাছ নেই, পশুপ্রাণী বা পাখি নেই। মানুষ ছাড়াও পৃথিবী অন্য যে কোনো গ্রহ থেকে সুন্দর বলেই আমি মনে করি। আর এই সৌন্দর্য তার প্রকৃতির জন্যে। সবুজ শ্যামল বৃক্ষরাজির জন্যে। বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির জন্যে। সুউচ্চ পাহাড় পর্বত আর তাকে আচ্ছাদনকারী বরফের জন্যে। আবার কোথাও ধু ধু বালিয়াড়ি, মরুপ্রান্তর এবং মরুদ্যানের সুষমাও অনস্বীকার্য। তবে, যদি অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ বা জীবন থেকে থাকে বলে প্রমাণিত হয়, তখন নতুন করে প্রাকৃতিক তুলনাবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে সৌন্দর্যের তুলনা করে দেখা যেতে পারে। প্রাণী জগতের অনেক ধরনের প্রাণীর মধ্যে মানুষ নিতান্ত একটিমাত্র প্রজাতি ভিন্ন অন্য কিছু নয়, তবে অত্যন্ত বিষাক্ত ও বিধ্বংসী বটে।

প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে যা কিছু প্রকৃতির জন্যে ক্ষতিকর বা প্রকৃতিতে বিসদৃশ তা কোনো এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ পর্যন্ত ৪ কি ৫টি বরফ যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীতে। তাই প্রতিবার জীবজগতের নবায়ন হয়েছে। মানুষ তো মাত্র সেদিন এসেছে। শারীরিক দৌর্বল্যের কারণে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে জীবনের প্রয়োজনে। তারপর সেই বুদ্ধি দিয়ে মানুষ অন্য প্রাণী মারার জন্যে পাথর দিয়ে অস্ত্র বানায়। তারপর থেকে অস্ত্রের উন্নতির ইতিহাসই মানুষের উন্নতির ইতিহাস। মানুষই বলে প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ, আনবিক যুগ, পারমানবিক যুগ। এইভাবে মানবিক থেকে মানুষ অমানবিক প্রাণীতে অধ:পতিত হয়েছে। আমরা যে প্রকৃতি দেখে আসছি দীর্ঘদিন, প্রকৃতি তারচেয়ে আরও অনেক বেশি সুন্দর। করোনা হয়তো সেই সুন্দর প্রকৃতিকে খাঁচাবন্দী মানুষকে দেখার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। তাই আজ বৈশাখে তেমন উত্তাপ নেই, বাতাসকে অনেক নিষ্কলুষ মনে হয়। কলকারখানা প্রায় বন্ধ, অনেক গাডির ইন্জিন অচল পডে আছে। কতো সহজে জানযট উধাও হয়ে যায় শহরের ব্যস্ততম এলাকায়।

ইলিস সিলভার নামে একজন বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র এলিয়েন। নিজে টিকে থাকার জন্য পৃথিবীকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। আবার এরিক ফন দানিকেন সহ অনেকেই ভিনগ্রহ তত্ত্ব দিয়েছেন। দানিকেনের মতে মানুষ এলিয়েন নয়, এলিয়েনরা পৃথিবির বাইরে থেকে এসে মানুষকে ট্রেনিং দিয়ে সভ্য করেছে। তবে ভাই আমি ইতিহাসকে কল্পনার রঙিন চশমাতে দেখতে চাই না। এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখতে আগ্রহী। হাতে নাতে প্রমাণ হাজির হলে এই তত্ত্বও মেনে নেবো বৈকি! এদিকে Ellis Silver-এর Humans are not from Earth: a scientific evaluation of the evidence গ্রন্থে বরং যুক্তি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ নিজেই এলিয়েন। তার যুক্তিগুলিও ফেলনা নয়। মানুষের বেঁচে থাকার পদ্ধতি, জীবনযাপন পৃথিবীর অন্যান্য জীব-জানোয়ারের চাইতে অনেক পৃথক। তাছাড়া বিজ্ঞানের কোন থিয়োরিইতো নিঁখুত নয়। সমাজ বিজ্ঞানের তো নয়ই! কিছুই নিখুঁত নয় বটে, তবে, মানুষের জন্যে পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তা’ও ৬০০০ বছর আগে সৃষ্ট— এই তত্ত্ব যে সম্পূর্ণ খুঁত তাতে কোনো খুঁত নেই।


আরো পড়ুন: এই কবিতা এমনি থাকুক সহজ ও সুশিক্ষিতা


কেউ কেউ মনে করেন, মানুষ এরই মধ্যে জেনে গিয়েছে পৃথিবীর প্রকৃত ইতিহাস। সত্যিই যদি জেনে থাকে পৃথিবীর ইতিহাস, তবে মনে রাখতে হবে কিতাবে উল্লিখিত ৬০০০ বছর আগে কিন্তু এই মাটির গোলাটি তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানে মনস্বী হলে সব জানতে পারতেন এবং অহেতুক গোমুত্র পান এবং গোমাংস ভক্ষণে দলাদলি করে সময় ক্ষেপন করতেন না। এক দালান ভেঙে আরেক দালান গড়ার খেলায় বাবর এবং রামচন্দ্র নামের দু’জন শোষক নৃপতির নামে হাজার মানুষের রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হতো না। তবু কেউ কেউ জিদ করে দাবী জানান, মানুষই পৃথিবীর সভ্যতার রূপকার। আবারও বলছি, সভ্যতা পৃথিবীর নয়। সভ্যতা শুধু মানুষের একান্ত নিজের অর্জন, মানুষের মধ্যেই তার যতো মহিমা। মানুষ কি আর কোনো জীব-প্রজাতিকে তথাকথিত সভ্য করতে পেরেছে বা করেছে? প্রকৃতি একটা নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। তাই সূর্য পূর্ব দিকেই ওঠে, আর পশ্চিমে অস্ত যায়। ইচ্ছা করলেই গ্রহে গ্রহে ধাক্কা লাগার কোনো কারণ নেই। এটা গুলিস্তানের মোড় নয়। মহাবিশ্ব চলে মহাকর্ষের প্রেম ও বিরহের এক মধুর খেলায়।

একমাত্র মানুষই বিনা প্রয়োজনে যে কোনো দ্রব্য থেকে শুরু করে যে কোনো উদ্ভিদ প্রাণী এমনকি মানুষকে হত্যা বা ধ্বংস করে থাকে। মানুষ আছে বলেই মানুষই পৃথিবীর জয়গান করে। কিন্তু সে জয়গানে বনের হাতি বা শৃগালের কী এসে গেল? নি:সন্দেহে আপনারা একমত হবেন যে, মানুষকে তার নখদন্ত সামাল দিতে হবে। অন্যথা মানুষই ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। পৃথিবীর তাতে কিছুই আসবে যাবে না।

মানুষ প্রজাতি হিসাবে অন্য প্রজাতির উপর তার অবস্থানের কারণে কী না করছে…… প্রকৃতি ও প্রাণের সর্বনাশ করছে। আর নিজ প্রজাতির মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্যের চর্চা এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, আমরা তাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। মানুষের জীবন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি তুলাদণ্ডে রাখছি। আমি — এই আমি, এই আমি মানুষই! আশ্চর্য!!!

পৃথিবীকে মানুষ নিজের লাভ আর লোকসানের কাজে সবসময়ে ব্যবহার করেছে। তার ফলতো মানুষকেই ভোগ করতে হবে। এটা আমরা বুঝেও স্বার্থপরের মত না বোঝার ভান করে থাকি। আমার তো মনে হয় মানুষ সভ্যতার অহঙ্কার নাকি লজ্জা, এই প্রশ্নটা আজ খুব জরুরী।

পৃথিবী নামের গ্রহটি তো কেবল মানুষ কেন্দ্রিক নয়। করোনার সংক্রমণে মৃত্যু হচ্ছে শুধু মানুষের। গ্রহটি দিনে দিনে রূপে রঙে ভরে উঠছে। সেদিন এক বন্ধু ছবি পাঠালেন দিল্লীর ব্যস্ততম সড়কে গাড়ি চলছে না, বরং ময়ূর পেখম মেলে নেচে বেড়াচ্ছে। তাই গ্রহটি সর্বস্ব হারিয়ে নি:স্ব হচ্ছে—এমনটি ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। মানুষ না থাকলেও পৃথিবীসহ সকল গ্রহ নক্ষত্র ভাল থাকবে। এযাত্রায় তো ভ্যাকসিন এসে যাবে, মানুষ বেঁচেও যাবে। কিন্তু মানুষকে বহুকাল টিকে থাকতে হলে, পরিবেশধ্বংসী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে প্রকৃতির সাথে তাল মেলানোর পথ ধরতে হবে বৈকি! কিঞ্চিৎ মনুষ্য আদল বিশিষ্ট বলে নিজেকে নিয়ে নিজেই শরমিন্দা আছি। তবে এই এক প্রজাতির স্বৈরতন্ত্রের জায়গায় প্রকৃত পরিবেশতন্ত্র একান্ত দরকার। এতে তিলার্ধও সন্দেহ নেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত