| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য মনের অন্দরে সাহিত্য

দ্বিধাহীন জানলা খুলে যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার…

মরে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাঁচে সকলে। আর কেউ কেউ বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন পায়ে পায়ে ঘুমের ঘোরে ঢুকে যায় আর স্বপ্নগ্রস্তমানুষরা কাঁদে-হাসে। এখানেই এবং এখনই,আগে-পরে কিছু নেই।বাস্তবে পা মুছে তারা  দরজা ভেজিয়ে মুহূর্তের সমুদ্রে নেমে যায়। ভেতরে গেলে নিভু নিভু শরীর ও মন অন্যরকম ভেজে। খুঁজলে মহাসাগরের তলায় পড়ে আছে কত মায়া,ইনকার ধ্বংসাবশেষ।ডুবুডুবু কাঁটা-কম্পাস-মানচিত্র নিভিয়ে তারা হয়তো মানুষ নয়, মানুষের খুব কাছাকাছি,হতে পারে ভুলভাল  মানুষ।

ঠিকঠাক মানুষরা গাছে জল ঢালে, বাজারের ফর্দ মেলায়। স্নান শেষে পাত পেতে খেতে বসে, রীতিমত সঙ্গম করে। ঠিকঠাক মানুষের সমুদ্র কই? কোথায় আর শীতল ঢেউ তাদের তপ্ত প্রবাল শরীরে? বড়জোর বহু ব্যবহারে চটচটে হয়ে যাওয়া কিছু ক্লিশে সভ্যতা এবং অ-সভ্যতা ডুবিয়ে রাখে বালতির জলে। সে জলও ক্রমশ ঘোলাটে। নেই তাতে স্পর্শাতীত প্রাচীনতা কিংবা রোমহর্ষক নবীনতা।ঠিকঠাক মানুষের নেই কিছুমিছুই।মানুষের কাছাকাছি যারা, সেই ভুলভাল মানুষ শুধু মুক্ত অভিযাত্রী নয়।একাগ্র ধারাবাহিক পর্বতারোহণ যাকে বলে তার চেয়েও বেশি করে।আঁধার চেঁছে পাহাড় কাটে অধ্যবসায়ে।পাথরের চাঙ্গড় ভেঙে রাস্তা গড়ে বাকিদের জন্য।গাইতি, শাবলে রক্তাক্ত দুটো হাতে অনুভবের একটি একটি নক্ষত্র কুড়োয় একদিন ছায়াপথ বানাবে। কতদিন প্রতীক্ষারত,অত্যাশ্চর্যজনক ধূসর পথে অপরিচিতের মতো অপেক্ষারত। এরপর মাহেন্দ্র ক্ষণ। স্তব্ধ হও, ফিরে তাকাও দিব্যজ্ঞানের দিকে।এমন সময় স্বপ্ন থেকে উত্থিত নিশিগ্রস্থ কেউ আসে। হাত ধরে বাঁচা-মরার ভূলোক ছাড়িয়ে ভুলভাল মানুষকে নিয়ে যায় বিস্ময়কর বোধের এবসোলিউট কেন্দ্রে ।সাধনা যেখানে সিদ্ধ, সেই অসীম শূন্যতায় পাপ-পূন্য স্থির চেয়ে তোমার দিকে। রাত ফুরিয়ে আলো বাড়ছে, তুমি কি বোঝো?

 

আমি আর মুখোমুখি আমি…                        

কেউ জানলা হীন।কারো গুহায় জানলা থাকে।হাতকড়ায় সবটুকু নৈঃশব্দ্য রেখে ছায়াশব্দ হাতড়াতে হাতড়াতে জেরবার দুটি হাত। স্পর্শটুকুতে বুঝে নেয় সারি সারি লোহার শিক দাঁড়িয়ে।চৌদ্দটি গথিক থাম ঘিরে আছে ভেতরের অন্ধকার। ওপারে অসংখ্য আলোর স্বচ্ছ স্তর খুলে পড়ছে আকাশ থেকে প্রতি মুহূর্তে। জানলা পেরিয়ে বারান্দা, তারপর বিরাট উঁচু প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে যে ক্ষীণ আলো পৌঁছে সে একটু অন্যরকমই।আলোর ধারা জানলার ওপারে লেজ গুটিয়ে মিউমিউ ফিরে যায়।আমি এক ঠিকঠাক মানুষ। একঘেয়ে সুখ আর অনায়াস প্রাপ্তির অভ্যস্ত জীবনে গা গুলোয়। আলোর বাইরে আমি কিংবা আলো আমার।একদিনও না দেখিলাম যারে। কী আমি চোখে হারাই? চোখ কেঁদে কেঁদে অন্ধপ্রায়।মনে নেই,কিছু কি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম? অথবা কেউ কিছু ফিরিয়ে দিয়েছিল?হতে পারে কবিতার ক্যালাইডোস্কোপ, গল্পের এক টুকরো চুম্বক কিংবা রোদচশমা থেকে খুলে পড়া ঘোলাটে সবুজ একটি কাঁচের অসম্পূর্ণ উপন্যাস। রাজবন্দী কবি ভিসার যিটির অভিশাপ শোঁশোঁ নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এসে আমার ভেতর ঢুকে যায়- For you yourself are the greatest worry on earth…

অপ্রকাশিত, অনুচ্চারিত এক একটি স্তবক সোডিয়াম আলোর মতো একাকী ঝরে কনডেম সেলে।রঙিন মার্বেলের মতো ছিটকে এখানে ওখানে স্রেফ হারিয়ে যায় অজস্র মাইক্রো এবং ম্যাক্রো ফিকশান। ঘর আর ঘাটের মাঝে ভুলভাল আমি একা দাঁড়িয়ে।অনন্য বিষাদ জীবনের স্বভাব।ডিএনএ ঘেঁটে দেখি কী এক গভীর অসুখ আমার সাথে শুয়ে পড়ে।ভয়ে, অজান্তে বিপন্ন বিবমিষায়,এমন অদ্ভুতুড়ে সময়গুলোতে রোজ পাতাওড়ে, জল গড়িয়ে পড়ে।আনন্দভ্রমন শেষে বেদনার শিমুল বীজ ওড়ে শরীরের একান্ত গভীরে।

ওই তো সে।গোধূলি সন্ন্যাসী নিভৃত ইচ্ছের ডানায় গেরুয়া রঙ লাগিয়ে দেয়। রঙের মাহাত্ম্য টের পেলে ক্ষীণদৃষ্টি চোখ সরু করে সইয়ে নেয় তুখোড় আলো। বৈরাগ্য শরীরে ঢুকে পড়লে আমি হয়ে যাই একলা অলীক ভাস্কর্য। ঠিকঠাক আমার দিকে তাকিয়ে হাসে ভুলভাল আমি। বাইরে দইওয়ালা ডাকে আর মামাবাড়ির মাঝিও। মার্লোর প্যাশোনেট শেফার্ড ছলছল তাকিয়ে পো’র অ্যানাবেল লী’র শ্রাবস্তীর কারুকার্যে। প্রচন্ড সামাজিক জীবনে কবিতা কানাইয়ার সৎ বাঁশি বাজে। মনে মনে ঘরের কোণে গল্প মাখা শ্যামের পিরীত গোপনে রেখে দিই। এভাবে কি পারা যায়, গদ্য পদ্য? কী দুর্যোগ ঘনায় কপালে ভাঁজ ফেলে, ভ্রুকুটি জমে। দাঁতে নখ কাটা। কী তীব্রভাবে দাঁড়িয়ে আছে ভুলভাল  আমি। আমি তারে পারি না এড়াতে। এসো কবিতাশস্য, এসো গল্পসম্ভাবনা… উত্তাল ঢেউ থিতিয়ে ক্ষতে দাও নিরাময়ের শীতল সুগন্ধী ঘুমচুম প্রলেপ।

অন্ধকার পুরাতনী হাওয়া, আজ বসবো কি নিজেকে নিয়ে?কাঠের ভারী পাল্লা মেলে জানলার গ্রিলে গাল ঠেকালে ঠাণ্ডা শিরশির।ফিনকি দিয়ে ছোটে নিরুপায় গল্প-কবিতার ধোঁয়া ধোঁয়া অ্যাবস্ট্রাকশান।রক্তধুলোয় চাপা পড়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে যায় শব্দের ভেতরের অক্ষর ডানা। উঁচু পাঁচিলে ঠোক্কর খেয়ে ককিয়ে ওঠে ব্যথায়। ফিরে এসে স্বস্থানে চুপচাপ কাঁদে। অষ্টপ্রহর যাঁতা পিষে জেনেছি এ কান্নার কোথাও ঠাঁই নেই, কারো কাছে না। তবু বেখেয়ালে বিরামহীন অক্ষরে-শব্দকল্পে পৌনঃপুনিক কান্না যাপন।পরাবাস্তব সুতোয়বাঁধা মানব-মানবীর কাহিনীগুলো ইঁদুর দাঁতে কেটে নেয়।ম্যাসেজবাক্স বোঝাই কথারা উড়ে গেলে নিজেকে টাঙ্গিয়ে রাখি নোনাধরা দেয়ালে। প্রেমিকের আদর শূন্য নির্জন দুপুরে পাতা পুড়িয়ে আসে ধোঁয়ার দহন।প্রিয় কেউ আসে না। ভালোবাসাহীন এক-একটি শ্রাবণরাত স্নায়ু জুড়ে নিয়ে আসে দুরূহ খোঁয়ারির অবরোধ।নেই, নেই শ্বাসরোধী তীব্র বিস্ময় মায়া, শুধু দমবন্ধ ছটফট।না-হয়ে-ওঠা লেখার মর্মর।অপেক্ষার ভারী গ্রেভস্টোন।জিভে কষাটে স্বাদ। বিজবিজে ঘাম। নিষ্পাপ আপেল পচে যাওয়া ভ্যাপসা আর্দ্রতা। আর পেয়েছি টা কী,বলো?একটি লেখার পাতা পেলে অরণ্য হতাম।

আমি তারে পারিনা এড়াতে…

অন্ধকার কুঠুরী থেকে ছুঁড়ে দিলাম কসমিক সিগন্যাল তোমাদের গ্যালাক্সিতে। পৌঁছতে আর মাত্র পাঁচশ আলোকবর্ষ।ততক্ষণে কেউ বলুক- বেচারা ঈশ্বর, আজ কোনো কাজ নেই, তোমার ছুটি! আমি তোমায় মুক্তি দিলাম, এক কাপ চা, এক টুকরো নরম রুটি। তারপর বেঁচে থাকার দুরন্ত আকর্ষনে তালা ভেঙ্গে ঠিকঠাক আমার জীবন নেমে যাক ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে। নিজ হাতে খুলে দিই হৃদয় জানালা, হারিয়ে যাই দূর গাঁয়ের কাব্যমেলায়।দু’পাঁচ টাকার সনেটের লজেন্স মুখে পুরে আমি আউট ‘ল হয়ে যাই। দুর্বহ ব্যাগগুলো ফেলে দিই।বোধ বৃত্তের পরিধি ধরে হেঁটে ভুলভাল মানুষদের একজন হয়ে যাই।ভিজে ভিজে লক্ষ্মণরেখার ওপারে পাঁচিল পেরুলে কত সরণী, এ্যভেনিউ!কোনো উসখুস নেই, তাড়াহুড়ো নেই। ল্যাম্পপোস্ট আমায় গল্প শোনায়, বলে, সে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের টিনেরসেপাই। আর আমি? রাজপথ, বনপথ, আলপথ উজিয়ে ব্যক্তিগত খুচরো নক্ষত্র গাঁথা নির্লিপ্ত ছায়াপথ ধরে হাঁটি ভুলভাল অথচ ভাবনাহীন।

ক্ষ্যাপাটে হাওয়ার দিনে হঠাৎ মেলাঙ্কলিক হয়ে যায় যাবতীয় হার্টওয়ার্মিং ইলাস্ট্রেশানস্‌।ঘুমঘুম হেমলক। বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে,আহ ঘুম, তুমি এসো,প্লিজ! দরজা ভেজিয়ে মুহূর্তে সাগরের অতলান্তিক ভেতরে। আবেগ কি রঙের অপেক্ষায় বসে থাকে? নোনাজলে হাত ভিজিয়ে ক্যানভাস নয় ছেঁড়া মানচিত্রে আঁকি ড্রিপ পেইন্টিং। কবিতা মিশিয়ে।সময় গড়িয়ে সাঁঝ বালিকা যুবতী হলো। রমণী রাত এসে দাঁড়াল আকাশে।আজ তবে বের করি ভুলে যাওয়া রিমোট কন্ট্রোল। কোথায় লুকিয়ে রেখেছি অন্ধ কুঠুরির গোপন তোরঙ্গে,মনে পড়ে না। একবার খুঁজে পেলে,রাতের বুক থেকে সরিয়ে দিই ঘুমন্ত আঁচল, যা প্রায় স্খলিত। সেখানে উঁকি দিয়ে চাঁদ। রিমোট কন্ট্রোল কিংবা টিউব থেকে হাতের চাপে বেরিয়ে এলো হঠাৎ এত রঙ।হাজার লক্ষ বছরের কলঙ্কবিদ্ধ আমার শাশ্বত চাঁদে লাগে বাড়তি রঙের ছোঁয়া।বিশ্বাস রাখি, হাত বাড়াবেই বন্ধু, এমন মাধবী রাতের আবহাওয়ায়।সে ভোলেনা, মনে করে নিয়ে যায় অসীম অ্যাবসোলিউট ভরকেন্দ্রে। ভুলভাল আমিই প্রকৃত আমি।

এখন আমি রাত লিখি, আকাশ লিখি, জীবনও। বলে দিই-  চাঁদ হে, তুমি মুক্ত। তোমায় আর জামা পরাব না।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত