আসাদ মান্নানের এলিজি ‘‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’’
২০২১ সালের বইমেলাতে প্রকাশিত জনপ্রিয় কবি আসাদ মান্নানের ‘‘এলিজি মুজিব নামে’’ গ্রন্থের ২১টি কবিতা ও একটি অনুভববেদ্য গল্প পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ‘এলিজি’ বলতে প্রচলিত অর্থে যাকে বাংলা কবিতায় ‘শোকগাথা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার কাব্যিক বোধনে এই কবি অনন্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এজন্য সম্প্রতি যখন অগ্রজের প্রয়াণে ‘‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’’ শিরোনামে অন্য একটি এলিজি পাঠের সুযোগ হলো তাতেও দেখতে পেলাম শোকে মুহ্যমান কবি নিজের মনোজগতে ঘটে যাওয়া রক্তক্ষরণের বিবরণ দিয়েছেন বাস্তবতার পরিসর ও স্মৃতির গহনতলের জাগরচৈতন্যে। কবিতায় বিন্যস্ত ৯টি স্তবকে বিয়োগ ব্যথার মনোকষ্টে তিনি এতোটাই নিমজ্জিত যে কবিতার পঙক্তিতে লিখতে বাধ্য হয়েছেন-‘চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে’ গেছে। যে অদৃশ্য খুনি বিশ্বব্যাপী ক্রিয়াশীল তাকে তাঁর মনে হয়েছে ‘ক্লাসিক জল্লাদ’।এই জল্লাদের ছোবলে বড় ভাইকে হারানোর বেদনা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে তাই প্রথম স্তবকে উচ্চকিত হয়েছে সংকটময় পরিস্থিতি চিত্রণে।
করোনা মহামারির মারণব্যাধি আমাদের অনেকেরই আপনজনকে কেড়ে নিয়েছে।ব্যাধি আর দুর্ঘটনা নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা।২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ ‘কর্তৃত্ববাদী মানুষের’ জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।সর্বক্ষণ ঘুরতে থাকা এই অদৃশ্য আপদ স্বাভাবিক জীবনকে করেছে ব্যাহত।মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে ব্যাধি যখন দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকে তখন কবির মনে হওয়া স্বাভাবিক-‘জলে স্থলে অন্তরীক্ষ্যে এ কেমন আতঙ্ক সন্ত্রাস’। ‘মরণ জীবাণু’র সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে মানুষকে।কবির উচ্চারণ যথার্থ- ‘ঘরে থাকো দূরে থাকো একা থেকে একা হয়ে যাও;/জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে…/ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।’
দ্বিতীয় স্তবকেও ‘মানুষ বিনাশী’ ‘ভয়ংকর’ ও ‘হিংস্র ভাইরাস’-এর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মূল শক্তি নিয়ে কথা বলেছেন কবি। ‘বিশ্বমারী ঘাতক করোনা’ যে আমাদের সময়হীনতার রাজ্যে নিক্ষেপ করেছে এজন্য-‘ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়’ বলা হচ্ছে, করেছে শূন্য সামাজিক জীবে সেই বিনষ্টের মধ্যে বসে সমূলে বিনাশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখেও বাঁচার আকুতি আমাদের কাতর করেছে। ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তি অক্সিজেনের অভাবে যেমন মৃত্যুমুখে পতিত হয়, শ্বাসকষ্টে যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়ে তেমনি আবার করোনা পীড়িত মানুষকে নিয়ে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় স্বজনদের।কবি দেখেছেন-‘হাসপাতালে রোগী নিয়ে ঝগড়া করে স্বজন-সেবিকা’।
মৃত্যু ও ব্যাধির উপত্যকায় বসে কবি নির্ঘুম রাত্রি অতিক্রম করেন। দুর্বিনীত করোনাকে বাগে আনার চেষ্টা দেখা গেলেও সময় কারো জন্য বসে থাকে না কিংবা বলা যায় আমরা চলেছি সময়হীন বীভৎস অনন্তলোকে। টানা লকডাউনে গৃহবন্দী কবি উদ্বেগে উৎকণ্ঠায় আলো অন্বেষী হয়ে ওঠেন।আর ঠিক তখনই সংবাদ পান সহোদর হাফেজ নুর-উস ছফা আর নেই।প্রয়াত পিতা-মাতার কাছে চলে গেছেন তাঁর ভ্রাতাও।
যে পরিস্থিতির মধ্যে কবির ভ্রাতৃ বিয়োগ সেই কঠোর লকডাউনে তিনি নিজেকে অসহায় ভেবেছেন।ঠিক যেমন ঘটেছিল পারিবারিক দুর্ঘটনাগুলো।চতুর্থ স্তবক থেকে কবির স্মৃতির রাজ্য আন্দোলিত হতে থাকে।সেখানে তাঁর মায়ের কাছে শোনা আরেক ভাইয়ের কলেরা মহামারিতে প্রয়াণের খবর ব্যক্ত করা হয়।কবিতা পাঠকরা আরো জানতে পারেন তাঁর মামা সবংশে ওলাবিবি’র আক্রমণে তিরোহিত হন। দাদা কালামিয়া মালাদার কবির জন্মের বহু পূর্বে মারা যান সাপের কামড়ে।আমরা আরো জানতে পারি কলেরায় মৃত্যু হওয়ায় অন্য কেউ এগিয়ে না এলেও তাঁর ভাইয়ের মরদেহ সমাধিস্থ করেন প্রিয় জেঠামণি আতর আলী।
অতীতের মহামারি ও দুর্ঘটনাগুলো বিবৃত করে পুনরায় আসাদ মান্নান বড় ভাইয়ের প্রসঙ্গে চলে আসেন। দুর্যোগে কবর দেওয়া হয়েছে মায়ের পাশে, ভাইয়ের এই অন্তিমযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি, নিজের বোন ও তিনি দূর থেকে বিলাপ করেছেন অবিরত।
‘দূর থেকে বিলাপ করেছি-
যে বুকে কোরান জ্বলে ওই বুক আগুনে কি পোড়ে?
আমার চোখের জলে নরকের অগ্নি নিভে যায়।’
কেবল বড় ভাইয়ের করোনায় মৃত্যু নয় ‘মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না’- এই গভীর উপলব্ধির কথা এসেছে আসাদ মান্নানের জীবনের প্রথম বেলায়- যা তাঁর প্রাজ্ঞচেতনার অভিব্যক্তি ষষ্ঠ স্তবকে এসে উপস্থাপিত।তিনি আরো লিখেছেন- দ্বীপবাসী জীবনে কৈশোর থেকে তিনি অসহায় মানুষের পাশে থেকেছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন মানুষকে করেছেন সাহায্য।এমনকি ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে বঙ্গোপসাগর পাড়ে অগুনিত লাশের মিছিল দেখেছেন। ‘শবাকীর্ণ সন্দ্বীপের উপদ্রুত দীর্ণ উপকূলে’ দাঁড়িয়ে তাঁর বোধবোধি গেছে পাল্টে। মনে জেগেছে দার্শনিক প্রত্যয়-
‘নদীর ওপারে আছে জীবনের শেষ চাওয়া- পাওয়া;
মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।’
সামাজিক কৃত্য হিসেবে কৈশোর থেকে মানবিক কবি চেনা-অচেনা মানুষের পাশে থেকেছেন। দুঃসময়ে অনেক লাশ দাফন করেছেন। কিন্তু করোনা-দুঃসময়ে আপন ভাইয়ের জীবনের শেষ দৃশ্যে তিনি থাকতে পারেননি বলে নিজের ভেতর অনুশোচনার দহন চলেছে।এজন্য তিনি শরণ নিয়েছেন বিধাতার কাছে। ভাই এবং মা-বাবার জন্য আর্জি পাঠিয়েছেন যা গ্রহণ করা হলে তাঁর বিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে বলে জানিয়েছেন সৃষ্টিকর্তাকে।সামান্য বান্দা হিসেবে সারাক্ষণ নিরাকার স্রষ্টার সেবা করে, হৃদয়ে ধারণ করেছেন তিনি। এজন্য তাঁর এরকম দাবি উঠেছে অন্তরময় হয়ে-
‘আমি একা কিন্তু একা নই ; আমার রক্তের মধ্যে
ধারণ করেছি আমি সমুদ্রের উত্তরাধিকার
নিখিলের ধ্যানচক্র, কুয়াশার সমূহ বিনাশ,
আমার মায়ের মতো ভালোবাসি গোলাপের হাসি
বাঘের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া হরিণীর প্রেম।
আমার ভেতর দিয়ে বহমান অনন্ত কালের
নদীর ধারাকে তুমি যদি অন্যদিকে, অন্যখানে
নিয়ে যেতে চাও, তবে নাও- আমার আপত্তি নেই
যা কিছু তোমার ইচ্ছে যখন তখন করতে পারো;
তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি আছে কার?
সুন্দরের আমি অন্ধ সেবাদাস- তোমার পূজারী।’
নবম স্তবকে এসে কবি নিজের শোককে অনন্তে সমর্পণ করেছেন।যদিও স্রষ্টার অনন্যতায় তিনি বিমোহিত। তাঁর প্রতি কবির অগাধ আস্থা।কিন্তু কবি জানেন, ‘ডিক্টেটর ক্ষমতার একক মালিক’ও তিনি। একারণে অভিমানভরা কণ্ঠে তাঁর উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে এভাবে-
‘আমাকে তোমার নামে যদি বলো শত কোটি বার
সেজদা দিতে তাও দেবো, শুধু বিশ্বব্যাপী চলমান
দুর্বিনীত জীবাণু যুদ্ধের সমাপ্তির পর্দা টানো;
না- টানলে বিনষ্ট হবে বিশ্বাসের বেহেস্তি আঙুর।
করোনার দুঃসময়ে যারা আজ প্রয়াত হয়েছে
তাদের হিসাবে যদি পাপ বলে কিছু লেখা থাকে
পাপটাকে মুছে দিয়ে নিজ গুণে পুণ্য লিখে দাও।’
কবি আসাদ মান্নান এভাবেই নয়টি স্তবকে শতাধিক পঙক্তি তথা হাজার শব্দে ‘‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’’ শিরোনামের এলিজিটি শেষ করেছেন।ব্যক্তিগত দুঃখকে কবি সকলের বেদনায় পরিণত করেছেন।করোনা মহামারি বিশ্ববাসীর সংকট।সেই ব্যাধিজনিত সৃষ্ট দুর্যোগ কেবল একজনের ভাই হারানোর বেদনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং কবিতাটির বিষয় বিশ্বজনীন আবেদনে উন্নীত হয়েছে।
মূলত আসাদ মান্নান নিজের বড় ভাইয়ের প্রয়াণকে স্মরণীয় করে রেখেছেন সকল মানুষের মঙ্গল অভিযাত্রাকে সামনে রেখে। ঠিকই লিখেছেন-‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না।’ ভেতরের কষ্ট প্রকাশের কাতরতায় কোনো কোনো কবি অনেকসময় ভাবাবেগে তাড়িত হন। কিংবা অসংখ্য পঙক্তি উচ্চারণ করেন যার কোনো বোধগম্যতা থাকে না। এদিক থেকে আসাদ মান্নান ভিন্ন প্রকৃতির।অগ্রজের মৃত্যুতে তাঁর চোখের জলে যন্ত্রণার অগ্নি নিভে গেলেও তা কেলাসিত হয়েছে সৃজন নৈবেদ্যে। এজন্য তিনি চমৎকার সব চিত্রকল্পে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।যেমন-‘জানালার পর্দা তুলে মাঝেমধ্যে তাকাও আকাশে-/ওখানে নক্ষত্রবীথি তার পাশে স্বপ্নের কফিন।’‘স্বপ্নের কফিন’ বলা যায় করোনা নিয়ে লিখিত বাংলা কবিতার অনন্য চিত্রকল্প। শব্দের দ্যোতনায় রচিত কবির পঙক্তিগুলো নিঃসন্দেহে অভিনব। মনে রাখার মতো কয়েকটি পঙক্তি-
ক) ঘড়ির ডায়ালে বসে স্থবিরতা বরফে ঘুমায়।
খ) মরে গেলে মানুষের আর কোনো স্বজন থাকে না।
গ) বুকে যে আগুন জ্বলে আমি তার উত্তাপ কুড়াই।
স্বজন হারানো কবির বেদনা পাঠককে ছুঁয়ে গেছে।স্রষ্টার কাছে কবির অভিযোগ কান্না হয়ে গলে পড়েছে।যাতনায় অসহায় কবি সংকটময় পৃথিবীর মানুষের কল্যাণ কামনা করে শেষ অবধি নিজের ভেতরেই আশ্রয় নিয়েছেন, কোনো অলৌকিক বিশ্বাসে স্থিত নন তিনি। এজন্যই স্রষ্টাকে লিখেছেন- ‘দুর্বিনীত জীবাণু যুদ্ধের সমাপ্তির পর্দা টানো; /না- টানলে বিনষ্ট হবে বিশ্বাসের বেহেস্তি আঙুর।’
এ ধারার বেশ কিছু কবিতা জমা হলে ‘‘মরে গেলে মানুষের স্বজন থাকে না’’ নামেই হয়ত নতুন কাব্যগ্রন্থ পাবো আমরা।
প্রিয় কবি আসাদ মান্নানকে অভিনন্দন।

লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।