অমর মিত্র সংখ্যা: দিক্ বিদিক ছুটছে ঘোড়া । বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
অমর মিত্র (জন্ম-১৯৫১)-এর ‘অশ্বচরিত’ (১৯৯৬)উপন্যাসের নামে মনে পড়ে অশ্ব ঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’-এর কথা। বুদ্ধচরিতের অনুষঙ্গ এসেছে আখ্যানে। রাজকুমার গৌতমের মহানিষ্ক্রমণের সঙ্গী ছিল যে অশ্ব, সেই অশ্বের চরিত রচনা করেছেন অমর মিত্র। কবি অশ্ব ঘোষ রচনা করেছিলেন গৌতম বুদ্ধের চরিতাখ্যান, আর অমর মিত্র রচনা করলেন বুদ্ধের অশ্বের আখ্যান। একটি কিংবদন্তীকে অবলম্বন করে, নতুন একটি কিংবদন্তী রচনা করলেন। একটা প্রাচীন মিথের সূত্রে রচিত হল আধুনিক একটি মিথ। সাম্প্রতিকের আবহে, দৈনন্দিনতার প্রেক্ষিতে বিন্যস্ত হল এক চিরকালীন বাস্তব। সভ্যতার নামে ক্রমশ বৃহত্তর পরিবেশকে নষ্ট করার বাস্তবতা। বিষাক্ত করার বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতাকে ছুঁয়ে আছে পৌরাণিক ঐতিহ্য। পরম্পরা। দেশজতা। উপস্থাপনভঙ্গির মধ্যেও এসেছে দেশজতা। কথকতার আবহ।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ ‘অশ্ব’ অর্থে বলা হয়েছে—“দ্রুতগামিত্ব হেতু সর্বদেশ ব্যাপিতে পারে।” অমর মিত্রের ‘অশ্বচরিত’-এ সেই অশ্ব অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটে বেড়াচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এক যুগ থেকে আর এক যুগে। বহু যুগ আগের কপিলাবস্তুর রাজপুত্রের ঘোড়া এই আধুনিক কালেও বিরাজমান। তার পথ চলা শেষ হয়নি। অশ্বমেধের ঘোড়ারা আজও পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলেছে। অশ্ব-সারথিও যুগে যুগে সঙ্গী হয়েছে। হাজার বছর ধরে তারা পথ হেঁটে চলেছে পৃথিবীর পথে। “সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে”। এই পথ-চলারই আখ্যান ‘অশ্বচরিত’। শুধু পথ-চলা নয়, অনন্ত অন্বেষণের আখ্যান। অশ্ব-সারথি ভানুচরণ তার সাধের ঘোড়াকে খুঁজে বেড়িয়েছে। আখ্যানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে চলেছে। এই খুঁজে চলাই তার জীবন। এই অন্বেষণই তার বেঁচে থাকা। অন্বেষণ করতে করতে সে অনুভব করেছে ক্রমশ দূষিত হয়ে গেছে আমাদের দেশ। বিষাক্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবী। অন্বেষণকালের অজস্র অভিজ্ঞতা ধরা আছে আখ্যানে। সেই অভিজ্ঞতায় মিশে আছে অলৌকিকতার ছোঁয়া। শুধু ভানুর অন্বেষণ নয়, আমাদের প্রত্যেকের বেঁচে থাকার আরেক নাম তো অন্বেষণ। প্রত্যেকেই তো আমরা পথ হাঁটছি শুধু। আর হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়েছি ক্লেদাক্ত এক পারমাণবিক আবহে। সভ্যতার কিমাকার ডায়নামোর কালো বাষ্পের গহনে।
মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের ‘ঘোড়া’ কবিতার কথা—“আমরা যাইনি ম’রে আজো—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় :/ মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;/প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে/ পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে।/ আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায় ;/ বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে ;/ চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো— ঘুমে— ঘেয়ো/ কুকুরের অস্পষ্ট কবলে/ হিম হ’য়ে ন’ড়ে গেল ও-পাশের পাইস্ রেস্তরাঁতে ;/ প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।/ সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে ;/ এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।”
দিঘার ‘সমুদ্র পাখি’ হোটেলের মালিক শ্রীপতি মাইতির একটি ঘোড়া ছিল। সেই ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল ভানু দাস। ভানু মনে করে এই সেই প্রাচীনকালের ঘোড়া। ঘোড়াটি কপিলাবস্তুর রাজপুত্রের মহানিষ্ক্রমণের সঙ্গী হয়েছিল। রাজপুত্রকে তপোবনে পৌঁছে দিয়েছিল। রাজপুত্র সাধু হয়ে গেলেন। ভগবান বুদ্ধ হয়ে গেলেন। তারপর শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব আর তার সারথি মাথা হেঁট করে ফিরল। সেই অশ্বই ছিল কন্থক। আর ভানু দাস সারথি ছন্দক।
আখ্যানের শুরুতেই শ্রীপতির অশ্বটি হারিয়ে গেছে। আর শুরু হয়েছে ভানুর ঘোড়া খোঁজার পালা। বাবুর কাছ থেকে রাহা খরচ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। শ্রীপতিও এখানে ওখানে তল্লাশি করে। নুন-মারা অনন্ত সারকে দেখতে পেয়ে জানতে চায় ঘোড়ার কথা। তার বছর পনেরোর মেয়ে কুন্তী বলে, সে দেখেছিল একটা ঘোড়া। শ্রীপতি ঘোড়ার রঙ জানতে চাইলে তার উত্তর, সে অশ্ব দেখেছে, রঙ দেখেনি। কিন্তু রঙ ছাড়া কি বস্তু হয়! মেয়েটা জবাব দেয়—“কেনে ই বাতাস। ইর বন্ন কী, অথচ বুঝছোনি বাতাস আছে।” লেখক প্রথমেই একটা বিভ্রম তৈরি করেছেন। অলৌকিক বিভ্রম। বর্ণহীন ঘোড়া। “বর্ণহীন ঘোড়া কেমন দেখতে ? কী তার রং! গায়ের রং, মাথার রং, কপালের রং, পুচ্ছের রং!” আসলে এই ঘোড়া তো অলৌকিক। প্রাচীনকালের ঘোড়া। তার গায়ে প্রাচীনত্বের ঐশ্বর্য।
মাইতিবাবুর পলাতক ‘পংখিরাজ’ কন্থকের খোঁজে গিয়ে ভানুর সঙ্গে দ্যাখা হয় মদরঞ্জিওয়ালা গৌরমোহনের। তার বাড়ি মীরগোদায়ও যায় ভানু। গৌরমোহনের স্ত্রী কোকিলা ছবি আঁকে। সেই আঁক দুজনে ফুটিয়ে তোলে মাদুরে। চিত্রিত মাদুরকেই মেদিনীপুরে ‘মদরঞ্জি’ বলা হয়। ভানু দ্যাখে মদরঞ্জিতে তার কন্থক ধরা আছে। কোকিলা বধূ স্বপ্নের ঘোরে এঁকেছিল ঘোড়া। বৈশাখী পূর্ণিমার সকালে উঠোনে ধুলোর উপরে আঙুল দিয়ে টেনে টেনে ঘোড়াটিকে এঁকে ছিল। মনে মনে ঘোড়াটাকে দেখেছিল বলেই এঁকেছিল। পুরো শুক্লপক্ষ ধরে চলে ঘোড়া বোনা। শেষ করেছিল পূর্ণিমার জোছনায়। পূর্ণিমার দিনেই তো হারিয়ে গিয়েছিল অশ্ব। কোকিলা বধূ যেন কুহকিনী, যাদুকরী, ভানুর পংখিরাজকে বেঁধে ফেলেছে। “অশ্বটারে সে ডাক দিয়ে তার মদরঞ্জিতে এঁকে ফেলেছে।”
ভানুর সঙ্গে শ্রীপতি যায় কুহকিনীর কাছে। সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের মধ্যে রাস্তাতে দ্যাখা হয়ে যায় তার সঙ্গে। “কোকিলা দাঁড়িয়েছে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে। বুকের আঁচল উড়ে যেতে চাইছে। কোমরে আঁচল গুঁজে সে কদমগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো, হেসে বলল, তুমার পংখিরাজ আমার নিকট বাঁধা পড়ে গেছে গো মাইতিবাবু।… শ্রীপতি দেখল দপদপ করছে স্তনযুগল। গাঢ় লাল ব্লাউজ যেন পটপট করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সেলাই-এর জোড় ফেটে যাচ্ছে, সামনের হুক, বোতাম যা থাকুক খুলে যাচ্ছে আপনা আপনি। দুহাতে একটি নবীন তরুকে ধরে আছে কোকিলা বধূ। অদৃশ্য, বর্ণহীন কোনো পুরুষের হাত তাকে উন্মুক্ত করছে ধীরে ধীরে। গাঢ়, গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে, গাঢ়, গভীর শ্বাস নিচ্ছে গৌরমোহনের যাদুকরী বউ, ভানুর লাল যাদুকরী। আশ্চর্য! এমন তো দ্যাখেনি কোনোদিন শ্রীপতি। গৌরমোহনের বউ দুহাতে বেড় দিয়ে গাছটিকে বুকে টানল। দুই ঊরুতে বাঁধল বৃক্ষটিকে। তলপেটে, তার নিচে, ঊরু সন্ধিতে বৃক্ষের কাণ্ড যেন পুরুষ হয়ে উঠল।…বাতাস উঠেছে খুব। বাতাসে বালি উড়ছে। বাতাসে গাছ তার মাথা দোলাচ্ছে। গাছ দুলছে, পুরুষ যেমন দোলে নারী সংলগ্ন হলে। কোকিলা যেন গাছের মাথা ধরে দোলাচ্ছে তার সর্ব শরীর। মেঘ ছেয়ে ফেলছে সমস্ত আকাশ। মেঘের গা থেকে সোনালি মেঘের আলো পড়েছে কোকিলার মুখে। ঝাউ, হরিতকী, আম, কাঠালের বন, যুবতীর নবীন শরীর পেয়ে উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে যেন। কোকিলা বধূও হয়ে উঠেছে ঝড়ের মতো প্রবল। গাছ আঁকড়ে ঝড়ের সঙ্গে দুলছে।”
যে আস্ত একটা ঘোড়াকে মাদুরে বেঁধে ফেলতে পারে, সে তো আর-পাঁচটা মানুষের মতো হবে না। প্রকৃতির সঙ্গে নিগুঢ় সম্পর্ক তার। তার আশ্লেষের ছোঁয়ায় প্রকৃতি-গাছ-পালাও সম্মোহিত হয়ে যায়। বলশালী পুরুষ হয়ে ওঠে। শ্রীপতি তো কোন্ ছার। অমর মিত্র আশ্চর্য মুনশিয়ানার সঙ্গে কোকিলা চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সে যেন দৈবীগুণ সম্পন্ন অলৌকিক নারী। জাদু ক্ষমতার অধিকারী। তার অঙ্গে আদিম শুচিতা। প্রাচীনকালের কোনও এক মেয়ে। তাই তো তার অনুভবে ধরা দেয় পৌরাণিক অশ্ব।কোকিলাই আখ্যানের শ্রেষ্ঠ শিল্প-প্রতিমা।
অশ্ব, কোকিলা এবং ভানু সকলেই প্রাচীন সভ্যতার সময় প্রবাহের অনিবার্য অংশ। “যেন ঘোড়া আর নিজেতে কোনো তফাৎই ছিল না। ভানু বলছে, ঘোড়া হারায়নি, যেন সে নিজেই হারিয়ে গেছে। কত জন্মের, কতকালের সাথী তার!”মাইতিবাবুকে বলেছে, অনেকবার জন্মেছে ভানু। “যতদিন পৃথিবী রয়েছে বাবু, ততদিন মরেছি আর জন্মেছি, যতবার মরেছি ততবার জন্ম নিয়েছি, এক জন্মে ছিলাম তো ছন্দক, মনে নেই ? সোনালি মেঘের নিচে কন্থক, আমি আর রাজপুত্র হাঁটতাম।” তাই ভীমাপুর বাঁচাতে চায় সে। ভীমাপুর বাঁচলে সোনালি মেঘ যদি ফোটে, কন্থক সেই মেঘ দেখে ফিরে আসবে বাবু।” কোকিলাকে বলেছে, “যেদিন আমাদের ত্যাগ করে রাজপুত্র জন্ম-মৃত্যু খুঁজতে বেরিয়ে গেল, সেদিন থেকে” সে তাকে চেনে।
শিবরামকেও ভানু বলেছে কোকিলাকে সে চেনে বহুকাল, বহু বছর। “হাজার বছর”। মনে হয় “পূর্বজন্মের চেনা।” হাজার বছর ধরে পথ হাঁটলে হয়তো ক্ষণিকের জন্য কোকিলার মতো নারীর দ্যাখা পাওয়া যায়।
কোকিলা যেন পথক্লান্ত ভানুচরণের বনলতা।
“অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে/ সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;/ আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/ আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।”
ঐতিহাসিক ঘোড়ার কথা বলতে গিয়ে লেখক বিশাল একটা ভৌগোলিক প্রেক্ষিত এনেছেন। ভানুর মাথার ভিতরে সমুদ্র ঢুকে যায়। সে কন্থকের খোঁজে দূর সমুদ্রে তাকিয়ে থাকে। সে ভাবে, “কন্থক কি উড়ে যেতে পারে না ? সেই জাভা, সুমাত্রা, বালিদ্বীপ!”ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক বিস্তার এই আখ্যানটিকে নিয়ে গেছে মহাকাব্যিক উচ্চতায়।
কোকিলার আঁকা ঘোড়া আর পাওয়া যায়নি। মদরঞ্জিওয়ালা এক বুড়িকে বিক্রি করে দিয়েছে। পরদিন ভানু গৌরমোহনের সঙ্গে গেল সেই বুড়ির কাছে। কিন্তু বুড়ি সকালের বাসে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে মদরঞ্জি। বুড়ি বলেছিল, “ও জিনিস কেউ ঘরে রাখে ?… দেখলেই মনে হচ্ছিল খাঁটি অশ্ব, আহা কেমন বুনেচে মদরঞ্জিওয়ালা, কাল রাতভর ঘোড়া দাপাইছে শানের মেঝেতে। … একেবারে আরবি ঘোড়া, ও ঘোড়ায় চেপে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট ঘুরত পথে পথে।”
কতদিন মধ্যরাতে জেগে উঠে শ্রীপতি দেখেছে ঘোড়াটা পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। আবার এক-একদিন দেখেছে ঘোড়াটা তাকিয়ে আছে আকাশে। আশ্চর্য! ঘোড়ারা রাত জাগে। এক-একদিন দেখেছে ঘোড়ার মুখ তার খোলা জানালায়। জানালা দিয়ে ঘরের অন্ধকারে তাকিয়ে আছে পক্ষিরাজ। তন্দ্রার ঘোরে তার মনে হয়, “ঘোড়া না থাক তার ছায়া আছে। বর্ণহীন ছায়া। নাকি বর্ণহীন অশ্ব ? বর্ণহীন অশ্ব কি দেখা যায় ? জলের মতো ঘোড়া ? পক্ষিরাজ জলের মতো হয়ে গেছে! বাতাসের মতো ?”
পুরাণের অশ্বরা আজও আমাদের চারপাশে অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দোসর দৃশ্যত ভানুও ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মীরগোদার পর ভানু তার প্রিয় কন্থকের খোঁজে যায় উড়িষ্যায়, ভীমাপুরে। সেখানে শ্রীপতির কাছারি আছে। ভানু গিয়ে শোনে দে-পাল, মহাপাত্রপুর, কুসমাড় ইত্যাদি মৌজার জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। এখন ধূ ধূ সব। “সব গাছপালা, নারকেল সারি, সুপুরির বন, তালবন কেটে ফেলেছে সরকার। একটা গাছও নাই। এমনকি কতকালের বুড়ো একটা বটগাছ ছিল তাও কেটে ফেলেছে সরকার। তরমুজ খেত নাই, পান বরজ নাই, বুনো ঘাসের জঙ্গল নাই, পুকুর নাই, ডোবা নাই, গ্রামদেবতির থান নাই, শিবমন্দির নাই, কিছুই নাই। পায়ের তলায় মাটিও নেই।” মিলিটারি ক্যাম্প হয়েছে সেখানে। শুধু জমি নয়, ‘মেয়েমানুষ’দের নিয়েছে পুলিশ-ঠিকাদার-মিলিটারি-লেবার সবাই।
“পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে/ সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।”
জমিন চলে গেলে এরকম হয়। মেয়েদের মানসম্ভ্রমও থাকে না। টর্চ নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি এসে মেয়েদের অত্যাচার করেছে। অত্যাচারিত সুভদ্রা কাছারিতে এসে নায়েব রামচন্দ্রের আশ্রয়ে আছে। লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন প্রশাসনিক বাস্তবতা—“পুলিশ জানত, পুরুষগুলো ভয় পেতে পারে তাদের ঘরের মেয়েদের বে-আব্রু করে দিলে। কিন্তু বে-আব্রু সত্যিই পুলিশ করেছিল কি না, মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল কি না পুলিশ এবং কাঁটাতার বসানোর ঠিকেদারের মাস্তান বাহিনী, সে কথা বলার মতো তো কেউ ছিল না। কোন্ মেয়ে তার লাঞ্ছনার কথা বলে ? বলে না, বলতে পারে না বলেই তো ধর্ষণ, লাঞ্ছনাই পুলিশের হাতের সব চেয়ে বড় অস্ত্র।” লেখকের জীবন-অভিজ্ঞতা, জীবন-দর্শন থেকে উঠে এসেছে এরকম উচ্চারণ।
যদিও সুভদ্রা একদিন তার লাঞ্ছনার কথা বলে ফেলে। ধর্ষিতা সুভদ্রার কান্না শুনে অন্যান্য চাষি বউরাও জানায় তাদের লাঞ্ছনার কথা। পুলিশের সঙ্গে কিছু মানুষও ছিল। তারা নেশাচ্ছন্ন হয়ে পুলিশের মোটা টর্চের আলোয় মেয়েমানুষ পছন্দ করছিল। “হায়! সমস্ত পল্লীটাকে সেদিন যেন বারবনিতা পল্লীর মতো ভেবে বসেছিল পুলিশ আর ঠিকাদারের লোক।”
লেখক সুভদ্রার জবানীতে একটা গভীর প্রশ্ন তুলেছে। সরকার কি মানুষের উপকার করে ? “গরমেন কি মানুষের জন্যিই সবু করে ?…ইত জমিন, চাষবাস, তরমুজ, পান, ধান, নারকেল সবু তো চলি গেলা, মানুষের কুছুই থাকলনি, গরমেন তো জানে সবু।…ভারতের লক, তবু মদের ধান, পান, সব লিয়ে মোদের উচ্ছেদ করিদিলা।…কহ ভানুবাবু, ভারতের লক মোরা, তবু কেনে সব্বুনাশ হয়, তার কুনো বিচার হিলানি!…শুধু মনে হয় মোর সব্বোনাশ করার লেগ্যে গরমেন এত জমিন নি।” ভারত সরকার ভারতের লোকেরই সর্বনাশ করল ; সর্বনাশ করে। ভানু সুভদ্রাকে বলে মিলিটারিরা ভারতের শত্রু, অন্যদেশের উপর আক্রমণ করবে বলে তৈরি হচ্ছে মিলিটারি ক্যাম্প। আকাশে গুলিচলা চলবে। সুভদ্রা চীৎকার করে, “আকাশ-পুড়ানোয় মোদের কী লাভ ?”
আমরাও এই প্রশ্নের শরিক হয়ে উঠি না কি ?
এরপর অশ্বের খোঁজে ভানু যাত্রা করে বজবজ, কাঁঠালবেড়ে। সেখানেও গিয়েও দেখে কত উঁচু চিমনি। কাঁঠালবেড়ে পুড়ছে। প্রকৃতি পুড়ছে। কোম্পানি কেটে ফেলেছে প্রাচীন বটবৃক্ষ। বড় সুন্দর ছিল এই দিকটা। কত গাছ, কতরকম পাখি। সব উড়ে গেছে যেন। সেখানে চায়ের দোকানির সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে ভানু জানতে পারে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে পোখরানের মরুভূতিতে পরমাণু বোমা ফাটার কথা। ভানু আশ্চর্য হয়ে একটা যোগসূত্র পেয়ে যায়। ওইদিনই তো পালিয়েছিল তার ঘোড়াটা। ভানু অবাক। “রাজপুত্রের জন্মদিন, পূর্ণিমা, পোখরানের মরুভূমিতে বিস্ফোরণ, ঘোড়ার পালানো—এসবে কি যোগাযোগ আছে ? একটার জন্য আর একটা হয়েছে ? বোমা না ফাটলে কি থাকত ? কিন্তু ঘোড়াকে খবরটা দিল কে ? ভানু মাথা ঝাঁকায়, বাতাসে খবর এসেছে। তেজস্ক্রিয় বাতাস! সেই বাতাস কি এতদূর আসবে ? মরুভূমির বাতাস! বাতাসে খবর পেয়ে পক্ষিরাজ কি পোখরানের দিকে ছুটে গেল ? কী থেকে যে কী হয় তা কে বলতে পারে ? তবে মিলে তো গেছে। অন্যদিন তো পালায়নি, পালালো সেই পূর্ণিমার রাতে।…যেদিন বোমা ফাটল সেদিন তার কন্থক উধাও, কী করে হয় ?”
ভানুর মনে পড়ে সুভদ্রা তাকে বলেছিল, “ওইদিন দুপুরে চাঁদবালির আকাশ পুড়িয়ে সমুদ্রে কী যেন ছুটে গিয়েছিল, আকাশ কালো হয়ে গেল, জ্বলে গেল যেন।” সেই বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন রকেট-ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল মিলিটারিরা।
কোকিলার কাছে গিয়ে ভানু জানায় পোখরানের কথা। কোকিলা খুঁজে বেড়ায় পুরনো খবরের কাগজ। সেই বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে কোকিলা বন্দী করেছিল অশ্বটিকে। কোকিলা ভানুকে বলে, “তারে আবার ছেড়ে দিতে হবে, সেই মন্তরটাই ধরতি পারছিনে, আমি তারে বাইরে আনতি পারছিনে।” ভানু ভাবে কোকিলা কুহক করেনি, ঘোড়াটাই কুহক করেছিল কোকিলাকে। “কোকিলা বধূকে আচ্ছন্ন করে ঘোড়াটি তাকে দিয়ে নিজেকে আঁকিয়ে নিয়েছে মদরঞ্জির উপর, নিজের বেগবান রূপটি প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে মদরঞ্জির উপর, যাতে তা দেখে কেউ না কেউ ধরতে পারে ঘোড়াটা পালাচ্ছে। সে পালাচ্ছে কেননা বিষ তাকে ছুঁয়ে ফেলতে চাইছে! হায় চাঁদের আলো, নরম ঘুম ঘুম বাতাস, হায় জল, মাটি—সব কিনা ছেয়ে যাবে তেজস্ক্রিয় ভস্মে! ওই যে অনন্ত আকাশ, আকাশের মেঘ, সব কিনা ভরে যাবে তেজস্ক্রিয় বিষকণিকায়। পৃথিবীর আকাশ, মাটি, নদী, সাগর, অন্ধকার, জ্যোৎস্না যা কিছু ভগবান দিয়েছিল ঘোড়াটির জন্য, বেগবান ঘোড়াটির জন্য, সব গেল বিষময় হয়ে! ঘোড়াটি তাই পালাচ্ছে। পালাচ্ছে কিন্তু তার সূত্রটি রেখে যাচ্ছে কোকিলা বধূর কাছে।” গৌরমোহনের গুণবতী বধূ পূর্ণিমার রাতে এঁকেছিল এক বেগবান অশ্ব। আদিকাল থেকে সে ছুটছে। কেশর ফুলে উঠছে, পুচ্ছ ফুলে উঠছে, চারটি পায়ের পেশী দপদপ করছে। শাদা ঘোড়া সেই পৃথিবীর জন্ম থেকে বেগবান। “তার পিঠে চেপে মানুষ দেশের পর দেশে গেছে। নদী পার হয়েছে, অরণ্য পার হয়েছে, পাহাড় পার হয়েছে, মরুভূমির বালি উড়িয়ে চলে গেছে সেইখানে যেখানে চাঁদের আলো, বাতাস, জল, সবই ভালবাসে মানুষকে।…সেখানে ঢুকে পড়েছে তেজস্ক্রিয় বাতাস।”
এতো দিন চাঁদের গায়ে নীল ছিল। জ্যোৎস্না নীল ছিল। সেই নীলের ভিতরে এত লক্ষ কোটি বছর মানুষ ঘুমিয়েছে নিশ্চিন্তে, জেগেছে নিশ্চিন্তে, ভালোবেসেছে, শোকে আনন্দে বিপন্ন হয়নি কোনওদিন। ভানুর ভাবনায় ঢুকে পড়ে অশ্ব। সে বলে—“আমি দেখলাম নীলের রং বদলে যাচ্ছে। চাঁদ উঠল বটে, কিন্তু চাঁদের আলোটিতে যেন বিষের নীল, গাঢ়, গাঢ় থেকে গাঢ়তর। নীল ঘন হতে হতে কালো হয়ে গিয়েছিল প্রায়। নাক টানলাম, কীসের যেন গন্ধ! জ্যোৎস্নায় যেন মৃত্যুর গন্ধ ছিল। হায় ! আমি তো কত মৃত্যুই না দেখেছি, কিন্তু তার তো এমন গন্ধ ছিল না। আমার তখন কী যেন মনে পড়ে যাচ্ছিল। চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে আমি টের পাচ্ছিলাম যেদিন সেই দূর হিরোসিমার প্রতিটি বিন্দু দগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারপর আকাশ থেকে কালো বৃষ্টি ঝরে পড়ছিল। মনে পড়ে গেল সব। কবে যেন শুনেছিলাম, দেখেছিলাম। বুঝতে পারছিলাম মারণ জ্যোৎস্নায় ঢেকে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবী। নীল জ্যোৎস্নায় বিষ ভেসে আসছে উত্তর-পশ্চিম থেকে। সেদিকে পাহাড় আছে, মরুভূমি আছে। মরুভূমির জ্যোৎস্না ছড়িয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। টের পেলাম সামনের ওই সাগর শুকিয়ে যাবে, গাছপালাও মরে যাবে, মাটি বালি হয়ে যাবে, আমি আর দৌড়তে পারব না। আমি পঙ্গু হয়ে যাব। তখন আর দাঁড়ালাম না। দড়ি ছিঁড়ে দৌড়েছি। দৌড়, দৌড়, দৌড়! নদী পার হয়ে, অরণ্য ভেদ করে, পাহাড় পার হয়ে আমি ছুটেছি, আমার পিছনে ধেয়ে আসছে মরণ। মানুষ যেন মরণের সখা হয়ে আসছে। মাটি চৌচির করে দিচ্ছে। ওই যে পিছনে পুড়ছে নদী, মাটিই, সাগর। আমি পিছনে ফিরছি না। ফিরছি না, ফিরছি না।”
ভানু অন্যদের বোঝায় ওই পূর্ণিমায় মরুভূমিতে বাতাসে মরণ ঢুকে গেল। “বাতাসে বিষ। শ্বাস-প্রশ্বাসে বিষবাতাস। সে-বাতাস এমন যে মানুষের গায়ে ঘা হয়ে যায়, হাড়ে ঘুণ ধরে যায়, চোখ অন্ধ হয়ে যায়, রক্তবমি হয়, বহু দূরে, ওই পুবদিকে জাপান দেশে কী হয়েছিল জান ?”
ভানু উড়িষ্যায় নগেন গিরির কাছে যায়। নগেন গিরির ঘুড়িটার টানে ভানুর অশ্ব ছুটে যেত চৌদ্দবেড়িয়ার চরে। ভানু অবাক হয়ে শোনে নগেনের কথা—“প্রাণী কি তার পূর্বপুরুষের স্মৃতি নিয়েও জন্মায়, এটাও কি তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হয়ে যায় জন্মানোর সময় ? সেই স্মৃতি ঘুমিয়ে থাকে মাথার ভিতরে, স্তরের পর স্তর লুকিয়ে থাকে মনের অন্ধকারে! একটি দুটি করে স্তর যখন ভাঙে, তখন জেগে উঠে পূর্বপুরুষের স্মৃতি। এর নাম জন্মান্তর নয়। এ হল তিন পুরুষ আগের ব্যাধি জেগে ওঠার মতো, পাঁচপুরুষ আগের স্বভাব জেগে ওঠার মতো ব্যাপার।” অ্যাটমবোমার খবর টের পেয়ে পলাতক হয়েছিল ঘোড়াটা। হিরোশিমার গন্ধ পেয়েছিল। নাগাসাকির স্মৃতি জেগেছিল অশ্বের মধ্যে। জ্যোৎস্নায় পোখরানের খবর এল, বাতাসে উড়ে এল পোখরানের তাপ, তা থেকে সে যেমন টের পেল, তেমন হয়তো হিরোশিমার সময়েও পেয়েছিল।
কোকিলা বধূ বহুদিনের চেষ্টায় আরেকটি ঘোড়া আঁকে। কিন্তু তা পছন্দ হয়নি শ্রীপতির। সে কেনে না মদরঞ্জি। কোকিলা সেই মাদুর গোটাতে গোটাতে বলে—এটা নিয়ে গৌরমোহন হাটে হাটে ঘুরবে। না বিক্রি হোক, লোকে জানবে কেন পালিয়েছিল পংখিরাজ। কথকতার মতো ছড়িয়ে পড়ুক এই আখ্যান। ভানুও বয়ে বেড়াবে তার কন্থকের স্মৃতি।
বৈশাখ মাসে শুরু হয়েছিল কাহিনি। শেষ হয়েছে আশ্বিনে। এই কয়েক মাস ধরে ভানু ঘুরেছে শুধু। খুঁজেছে শুধু। চিরপথিক ভানু এবার যাবে হাওড়া থেকে ভোজপুর। যাবে রামনগর, কাঁথি, মোহনপুর, বালিমুণ্ডা, ভীমাপুর, মীরগোদা, দৌলতপুর, দরিয়াপুর, রসুলপুর…। নদীতীরে অন্ধকারে। এতদিন ধরে হাঁটছে সে।
হাঁটছে তার ঘোড়াও। কখনো রাজপুত্রের স্মৃতি, সারথি ছন্দকের স্মৃতি, নদীতীরের স্মৃতি, বনভূমির স্মৃতি ফিরে আসে আচমকা। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়টি বিন্যস্ত হয়েছে সম্পূর্ণ ঘোড়ার ভাবনায়। কবে কোন্ পুরাণের কালে সে বেরিয়েছিল যজ্ঞের ঘোড়া হয়ে। সেই অশ্বমেধের ঘোড়া দেখেছে গৌতমের জন্মের আগে থেকে হিংসায় ভরে গিয়েছিল পৃথিবী। এখন ছুটতে ছুটতে মনে পড়ে সব। “কন্থক ছুটল। কালোমেঘের দিকে ছুটল। সে মেঘের দিকে এগোতেই বর্ষণ শুরু হলো। কালো বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল মেঘ থেকে। এই সেই বৃষ্টি যা হিরোসিমা ভাসিয়ে দিয়েছিল বহু বর্ষ আগে। এই সেই মেঘ যে মেঘ হিরোসিমার আকাশ ছেয়ে ফেলেছিল অভিশপ্ত দিনটিতে, যে-মেঘ এখনো মাথার ভিতরে বহন করে চলেছে মানুষ, হিরোসিমার মানুষ। কৃষ্ণবর্ষণ চারদিক অন্ধকার করে দিল। কৃষ্ণজলধারা নেমে আসছিল বালুকাসমুদ্রের উপর। ঘোড়াটি অন্ধ হয়ে গেল। তার গায়ের রোম খসে খসে যেতে লাগল। তার কেশর ঝরে যেতে লাগল, পুচ্ছ ঝরে যেতে লাগল। সে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। নাক মুখ দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এল। রক্তের লাল রং বাইরে বেরিয়ে কালো হয়ে গেল। ঘোড়াটি উঠতে চাইছিল। তার জিভ বেরিয়ে আসে। জিভ তেজস্ক্রিয় বাতাসে খসে যেতে থাকে। সে ধরতে পারে কালো আগুনের সমুদ্রে সে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঋতু বদল হয়নি, শুধু সে ভুল করেছিল। ভুল তো হয়েই থাকে। প্রকৃতির এমন যাদু আছে বলেই প্রাণ আছে। প্রাণ থাকে। কিন্তু সেই ভুল কোথায় নিয়ে এল যে তাকে!”
শেষবারের মতো দৌড়তে গিয়ে উলটে পড়ে যায়। আবার ওঠে, আবার পড়ে। বালির সমুদ্রে ডুবে যায়। অন্ধ চোখ দিয়ে জল বেরোতে থাকে। ওই জল ছাড়া আর কোনো জলের চিহ্ন নেই হিরোশিমায়। চোদ্দবেড়িয়া মুছে গেছে, কপিলাবস্তু মুছে গেছে, সমুদ্র মুছে গেছে, মুছে গেছে জ্যোৎস্নারাত্রি।আধুনিক সভ্যতা ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে চায়। মুছে ফেলতে চায় অতীত ঐশ্বর্য।
অশ্ব চলে গেছে অর্ধ শতক আগের সময়ে, ১৯৪৫-এ, হিরোশিমারকালে। প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিকে। আবার সাম্প্রতিক থেকে অতীতে। অমর মিত্র এই আখ্যানে জাদু-বাস্তবতার ব্যবহার করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। স্থান-কাল একাকার হয়ে গেছে। হিরোশিমার কালো মেঘ পোখরাণের বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় মিশেছে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশের নাগরিকরা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে অনন্ত বিষবাষ্পে। “এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো/ চোখের সমুখে নেই যাত্রিকের”। আমাদের চারপাশের পরিবেশে অদ্ভুত আঁধার এক ঘনিয়ে এসেছে। পরিবেশও অস্বচ্ছ-আঁধার। সেই ব্যাপ্ত অন্ধকারে শুধু মানুষ নয়, সমস্ত জীবজগতের আত্মাও রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। তারই অশনি সংকেত এই দার্শনিক আখ্যানে উদ্ভাসিত।
কোকিলা, সুভদ্রার মতো এই আখ্যানে এসেছে কুন্তীর কাহিনিও। মদনানি সাহেব কিনে নিয়েছিল তাকে। মদনানি সাহেবকে দেখে ভানু গুমোট গন্ধ পেয়েছিল। মাটির তলায় যেন ছিল সে। বেঙ্গার বউয়ের সঙ্গে সাহেবের লীলা। বেঙ্গা সমুদ্রে ফিসিং-এ গিয়ে হারিয়ে যায়। শ্রীপতির বান্ধবী নার্স ভারতী চৌধুরীর আখ্যান। কিছুদিন পরে বান্ধবীর থেকে মন উঠে যায় তার। ভারতীকে ফেলে দেয় নির্দ্বিধায়। তাকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেতে বলে দূরে। ঠাকুর বলে—“বাবুর নার্স মেয়েমানুষটার কপাল পুড়ল, সি নাকি বদলি হঁই যাবে, বাবুর মনও বদলি হঁই গিছে।” কত সহজে বদলে যায় পুরুষের মন। কী সহজে ঠাকুরানিকে বিদায় করে দিল ঠাকুর। তারপর কোনো কষ্ট নেই তার মনে। সব মেয়েদের আখ্যানই যন্ত্রণাদীর্ণ।এও তো এক চিরন্তন সত্য। এই আখ্যানের মধ্যেও রয়েছে সেই চিরন্তনতা।
অমর মিত্রের ‘অশ্বচরিত’অমোঘ এবং অনিবার্যভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে সভ্যতার সঙ্গে। সময় ধারার সঙ্গে। আমাদের মনুষ্য সভ্যতার সারাৎসার ধরা আছে আখ্যানে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে এর প্রাসঙ্গিকতা কমবে না। আধুনিক লেখক আমাদের শুনিয়েছেন আধুনিক এক ভারত কথা; আধুনিক এক মহাকাব্য। স্থান-কালের ব্যবধান ঘুচিয়ে এক দার্শনিক প্রত্যয় নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের কাছে। মহাকালের ঘোড়া ছুটে চলেছে অনন্তের পথে। তার হ্রেস্বারব শোনা যাচ্ছে আখ্যানের পাতায় পাতায়।তার যাত্রাপথে বার বার হানা দিয়ে যায় দূষণ-যন্ত্রণার স্মৃতি। শুদ্ধতর জীবনে বার বার ফিরতে চেয়েছে সে।কিন্তু পারমাণবিক সময়ে পবিত্র কোনও বিশুদ্ধতা নেই। তাই আদিম শুচিতার সন্ধানে পিছু ফিরতে হয় তাকে। আমরাও পিছু নিই তার। এভাবেই গতিময় থাকে অশ্ব। চলমান থাকে সময়। চলমান থাকে সভ্যতা। সেই নিয়ত চলমান যাপনে অসহ্য দুঃখ মহূর্তের গোপন প্রস্থানভূমি হয়ে ওঠে বার বার অমর মিত্রের ‘অশ্বচরিত’।
অশ্বচিরত ।। অমর মিত্র ।। করুণা প্রকাশনী ।। কলকাতা বইমেলা—১৯৯৬ ।। চতুর্থ মুদ্রণ—এপ্রিল ২০১৭ ।। ২০০ টাকা ।। ৩০৪ পৃষ্ঠা