মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১) । ডঃদীপক কুমার বরকাকতী
মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃদীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা,অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন,প্রব্রজন ,ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi,New Delhi ,2010) এবং The Highlanders(Blue Rose Publishers, New Delhi,2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন,কলকাতা,২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১।
(১)
১৯৮৯ সনের জুন মাস ।
মস্কোর রেড স্কোয়ার দিয়ে নাটালিয়া দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে একজন যুবতি গবেষক।তার গুরু অধ্যাপক মিখাইল ক্রিয়োস্কভে তাকে দ্রুত ডেকে পাঠিয়েছে কীযেন জরুরীকথাআছে। সঙ্গে ফিয়ডোর ইভানভিছ নামের যুবক গবেষক একজনের সঙ্গেও নাকি পরিচয় করিয়ে দেবার কথা।
তার সম্পূর্ণ নাম নাটালিয়া নিকলায়েভনা। মা লিডিয়া পাভলভনা তাকে আদর করে নাটস্কা বলে ডাকে। কখনও আবার আদর করে তাকে নাটস্কা অথবা নাটচেঙা বলেও ডাকে। এই মাকে নিয়ে সে কালিনিন গলির একটা সুউচ্চ অট্টালিকার একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। সে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ অধ্যাপক ক্রিয়োসকভের কাছ থেকে খবর পেয়েছে এবং সকালের খাবার খেয়েই সে দ্রুত বেরিয়ে এসেছে। বাইরে বেরিয়ে আসার আগে সে নিজের সুবিধার জন্য দরজার কাছে ঝুলিয়ে রাখা তাপমান যন্ত্রটিতে তাপ দেখে এসেছে। উনিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরে সোনালি রোদ ঝলমল করতে থাকা জুন মাসের এই আবহাওয়া বড় উষ্ণ। দুপুরে আরও উষ্ণ হয়ে পড়বে।এই উষ্ণতা অক্টোবর মাসে ধীরেধীরে কমতে শুরু করবে। নভেম্বর মাসের শেষ থেকে বরফ পড়বে এবং ফারে আবৃত লোম টুপি পরার মতো মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত শীত অব্যাহত থাকবে।
নাটালিয়া তাপমান যন্ত্রটা দেখে একটা পাতলা রঙ্গিণ সোয়েটার পরে নিল।সন্ধেবেলা ফিরতে দেরি হলে আবশ্যক হতে পারে ভেবে মাথায় এবং গলায় পরার জন্য একটা স্টোল গবেষণার কাগজপত্র থাকা ব্যাগটিতে ভরে নিল। তারপর সে বাইরে বেরিয়ে এল।
মস্কো মহানগরীতে মেট্রো অর্থাৎ পাতাল রেলে যোগাযোগ করা বড় সুবিধাজনক। উপপথের সুদৃশ্য সুড়ঙ্গ,স্টেশন গুলির দেওয়াল এবং সিলিং সিন্টেলিয়ারের আলোতে জাঁকজমক। সুউচ্চ আর্চ,শিলামূর্তি ,মার্বেল এবং বিস্তৃত মোজাইকের বিলাসী সাজসজ্জায় অত্যন্ত মনোমোহকর। তাছাড়া শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বেশ উষ্ণতা রয়েছে। তবু সে মাঝে মধ্যে ট্রলিবাস,ট্রাম অথবা বড় বাসে যাত্রা করতে ভালোবাসে। কয়েক কোপেক খরচ করলেই যাত্রা করতে পারা,এই বাসগুলি ছাত্র ছাত্রী এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষদের বড় প্রিয়। নাটাস্কা কিন্তু কেবল পয়সা বাঁচানোর জন্য বাসে যাওয়া আসা করে না,বাসের বড় বড় জানালার কাঁচের মধ্যদিয়ে ইতিহাস প্রসিদ্ধ জায়গাগুলো দেখতে দেখতে যাবার জন্য করে।বাস কখনও মস্কোর রাজপথের পুতুল থিয়েটারের পাশদিয়ে ,আবার কখনও মস্কো সার্কাসের পাশ দিয়ে,কখনও বা বলশেভিক রঙ্গমঞ্চের পাশ দিয়ে যায়। আবার কখনও বা বিভিন্ন গির্জার পাশ দিয়ে,পুশকিন যাদুঘরের পাশ দিয়ে অথবা দূরে দেখতে পাওয়া প্যাকলনা টিলার ওপরে থাকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিতে তৈরি সৌধের পাশ দিয়ে যায়। এই সমস্ত দেখতে দেখতে যাওয়া ছাড়াও শীতল বাতাবরণের জন্য ঘনীভূত হয়ে জানালার কাঁচের ওপর দিয়ে চোখের জলের মতো বয়ে আসা জলের ধারা দেখতেও তার ভালো লাগে। বরফে লাইম এবং বার্চ গাছ গুলি দেখতে সহজ,নিরীহ এবং ভালো লাগে। উঁচু সাইপ্রাস এবং তালজাতীয় গাছগুলি থেকে এগুলি যেন অনেক বেশি আপন। সে রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ে। নাটালিয়া বাসে উঠল এবং শীঘ্রই রেড স্কোয়ারের পাশের বাসস্টপে নেমে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার সময় তার হয়তো দেরি হবে। তাই এক সপ্তাহ পরে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে গাম নামে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে একটা বিশেষ উপহার এখনই কিনতে হবে।তাই নাটাস্কা স্টোরের উদ্দেশ্যে রেডস্কোয়ারের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
ভোরের সোনালি রোদ উপচে পড়া বাতাবরণে নাটালিয়ার গতি দ্রুত হল। তার চলার তালে তালে কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা বাদামি রঙের চুলের ঝুটি দুলতে লাগল। কালো বর্ণের তীব্র চোখদুটিতে সে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
নাটালিয়া মূলত ইতিহাসের ছাত্রী। তাই কোনো জায়গা দিয়ে যাওয়া আসার সময় তার মনে জায়গাটার ইতিহাস মূর্ত হয়ে উঠে। এখনও তার এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এবং একশ ত্রিশ মিটার প্রস্থের এই রেড স্কোয়ার দিয়ে যাবার সময় এর ইতিহাসের কথা মনে পড়ল। তার মনে পড়ল যে এর নামকরণের সঙ্গে অক্টোবরের মহাবিপ্লবের কোনো সম্পর্ক নেই,দেশের লাল পতাকার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। এর উঁৎপত্তি ক্রাসনিয়া নামের রুশ শব্দ থেকে। ক্রাসনিয়ার অর্থ হল লাল এবং মনোরম। তাই হয়তো লোকেরা রেড স্কোয়ারকে মধ্য যুগ থেকে ক্রাসনিয়া প্লচ্চাড বলত। নামকরণের যদি আর অন্য কোনো কারণ থেকে থাকে নাটালিয়া তা জানে না। কিন্তু সে জানে শীতকালে বরফ পড়তে শুরু করলেই এক সময়ে মস্কোর রাজপথ গুলির মতো এই রেডস্কোয়ারেও অনেক ঘোড়ায় টানা শ্লেজ গাড়িগুলি সোঁ সোঁ করে দৌড়াত। কয়েক শতক আগে চেঙ্গিজ খানের নাতি বাটু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল আক্রমণকারীরা এখানে ছাঊনি পেতেছিল। জারের রাজত্ব কালে এটা জনগ্ণের সভাক্ষেত্র এবং বিচারালয় হিসেবে ব্যবহার করা হত। তার একাংশে ছিল ফাঁশিশালা আর অন্যদিকে বাজার। এখন এর একদিকের বিশাল অংশটা রাজনৈতিক সমারোহ এবং মিলিটারি প্যারেডের গ্রাউণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সঙ্গীতানুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়।
নাটালিয়ার চোখের সামনে ত্রিভুজাকৃতির ক্রেমলিন দুর্গের পাথরে বাঁধানো বিশাল প্রাচীরটা চোখে পড়ল। প্রহরীরা চারপাশে কড়া নজর রাখার জন্য দেওয়ালের মাঝে মধ্যে তৈরি কয়েকটি মিনার ও চোখে পড়ল। রাশিয়ার প্রতিটি প্রধান শহর এই ধরনের দুর্গকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠার মতো মস্কো শহরও ক্রেমলিনকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল। এই দুর্গের মধ্যে পনেরো শতকে তৃতীয় ইভানের সময় রাজমহল,গির্জা এবং ক্যাথেড্রেলগুলি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মহান ইভানের নামে সাদা রঙের তিনশ ফুটের ও অধিক উচ্চতার ঘন্টার মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জার কলকল তৈরি করেছিলেন কুড়িফুট উচ্চতা এবং কয়েকশ টন ওজনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বলে পরিচিত ঘন্টাটি। এই বিশাল ঘন্টা আঠারোশো শতকের প্রথম ভাগে মাটিতে ছিটকে পড়ে একটা অংশ খুলে গিয়েছিল।তবু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই ঘন্টার পাদদেশ একটা ক্ষুদ্র প্রার্থনা গৃহরূপে পালিত হয়েছিল।এই সমস্ত ছাড়া ক্রেমলিন দুর্গের ভেতরে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মহলের সংযোজন হয়েছিল। ১৭১২ সনে সেই সময়ের সেন্টপিটাসবার্গ এবং এখনকার লেনিনগার্ডে রাজধানী স্থানান্তর না করা পর্যন্ত এই রাজমহল থেকেই অনেক জার ইউরোপীয় রাশিয়া শাসন করতেন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে এই দুর্গের মধ্যে গ্রেণ্ড ক্রেমলিন রাজমহল তৈরি করা হয়েছিল। ১৯১৭ সনের অক্টোবর বিপ্লবের একবছর পরে রাজধানী মস্কোতে পুনরায় স্থানান্তরিত করে এনেছিল। তখন থেকেই এই ক্রেমলিনের উঁচু দেওয়ালের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি,মন্ত্রীদের সংগে প্রধান সরকারি অফিস গুলি স্থাপন করা হয়েছিল।
এই ক্রেমলিনের ভেতরে আর্চাঞ্জেল ক্যাথেড্রালে অনেক জারের কবর রয়েছে। জারদের রাজ অভিষেকে রাজমুকুট পরিধান করা এসামসন ক্যাথেড্রালটাও এখানে রয়েছে। কয়েকদশক আগে এর ভেতরে থাকা একটা মহল জারদের অতি মূল্যবান এবং অত্যাধুনিক ঐতিহাসিক রাজমুকুট,সাজ-পোষাক,মণি-মুক্তা,অন্য আসবাব,তৈল চিত্র এবং অস্ত্র-শস্ত্র প্রদর্শন করা যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই যাদুঘরের জাঁকজমকে মানুষের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় এবং উগ্র শীতে চারপাশের বরফের স্তূপের মধ্যে নির্দয়তায় ছোট কাঠের এক একটি ঝুপড়িতে ছেঁড়া কাপড়ে কাল কাটানো একালের নিঃস্ব ভূমিদাসদের সঙ্গে জারদের জীবন ধারণের মানের আকাশ পাতাল প্রভেদ বড় নগ্নভাবে প্রকট করে তোলে। ভূমিদাসদের দুর্দশা ইভানদের কথা বাদই মহান পিটারের দিনেও পরিবর্তিত হয় নি। আঠারো শতকের শেষভাগে বরফে আবৃত পথের সুবিধা নিয়ে অনেক ঘোড়ায় টানা কাঁচের জানালা দিয়ে চারপাশ আবৃত শ্লেজ গাড়িতে বসে যখন জারিনা ক্যাথেরিন রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাত্রা করতেন তথন বিচারালয়ের ধনী অফিসাররা সুন্দর সাজপোষাক পরিয়ে স্বাস্থ্যবান মানুষদের শহরের অলিতে গলিতে অভিনেতার মতো সারি পেতে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। তাই কোনো কৃষক কোনো অজুহাত দেখিয়ে বেঁচে গেলেও ক্যাথেরিন বিশ্বাস না করে বড় নিষ্ঠুরভাবে শাস্তিবিধান করতেন এবং জোর জুলুম করে কর আদায় করতেন। এমনকি ভূমিদাসেরা ওদের কুড়ে ঘরে চিমনি লাগালেও কর দাবি করতেন। প্রথম আলেজাণ্ডারের সময়েও ভূমিদাসদের অবস্থা একই রকম ছিল। ১৮১২ সনের নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের পর থেকে ওদের ওপর অত্যাচার বাড়তে শুরু করে। কৃষকের ছেলেদের সাত বছর বয়স থেকেই চাষবাস ছাড়া সামরিক শিক্ষা দিয়ে আঠারো বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে বাধ্য করা হয়। ১৮২৫ সনে প্রথম আলেকজাণ্ডারের হঠাৎ মৃত্যু হয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই বছর যুবক অফিসাররা এবং দেশহিতৈষীরা সেন্টপিটাসবার্গে ডিসেম্বরের বিদ্রোহের সূচনা করে। নতুন জার প্রথম নিকোলাস বড় কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে। পাঁচজন নেতাকে ফাঁসি দেয়। একশোরও বেশি বিদ্রোহীকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে।
ডিসেম্বর বিদ্রোহের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাটালিয়ার মনটা আনন্দিত হয়। এই বিদ্রোহে নির্বাসিত হওয়া দেশহিতৈষী ডিসেমব্রিস্ট লোকদের জন্যই নয় তাঁদের অনেক পরিবারের আত্মত্যাগের কথা তার মনকে গর্বে ভরে তোলে। ১৮২৫ সনের বিদ্যুৎ বিহীন সাইবেরিয়ায় দিনের বেশিরভাগটাই ছিল অন্ধকার। তাছাড়া সাইবেরিয়া ছিল বছরের দশমাস বরফে আবৃত এক নরক। তবু নির্বাসিত হওয়া লোকদের পরিবারের অনেকেই সাইবেরিয়ায় গিয়ে নিজের লোকের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা জানাল। প্রথম নিকোলাস মহিলাদের ওপর অনেক শর্ত আরোপ করে সাইবেরিয়ায় যাওয়াটা বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। তারা যেতে চাইলে নিজের উপাধি এবং সম্পত্তি ত্যাগ করতে হবে। তাঁদের পুনরায় সাইবেরিয়ায় বিয়ে করতে হবে। তাছাড়া কোনো সন্তান সঙ্গে নিতে পারবে না। এই শর্তগুলি আরোপ করা সত্ত্বেও পরিবার ছাড়াও কিছুলোকের মা এবং কিছুলোকের ভাই বোনও নিজেদের স্নেহ ভালোবাসা এবং ইচ্ছাশক্তি প্রদর্শন করে সাইবেরিয়ায় যাত্রা করে।
নাটালিয়ার মনে পড়ল রাজকুমারী মারিয়া ভলকনস্কায়ার কথা। এক বছরের পুত্র সন্তানকে ফেলে রেখে ১৮২৬ সনে সাইবেরিয়ায় গিয়ে রাজকুমার সার্গেইর সঙ্গে দেখা করা এই রাজকুমারীটি মহিলাদের প্রথম দলে ছিলেন। ত্রিশ বছর পরে যখন ডিছেমব্রিষ্ট এবং পরিবারদের ক্ষমা করে মূল স্রোতে ফিরে আসার সুযোগ দেওয়া হল তখন তিনি ইতিমধ্যে মৃত্যুর মুখে পড়া অনেক দেশহিতৈষী, মহিলা যুবক যুবতি এবং শিশুদের ছেড়ে ফিরে আসার নিজের অভিজ্ঞতা কথা লিখতে শুরু করেন। তিনি লিখেছিলেন কীভাবে অন্যান্য মহিলাদের মতো টাইগা বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে সাইবেরিয়ায় যাবার সময় অশেষ কষ্টের সম্মুখিন হয়েছিলেন,কীভাবে জারের নির্দয় অফিসারদের অযথা নিয়ম কানুনের কঠোর প্রয়োগ তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল,বরফে আবৃত কোনো কোনো গ্রামে বরফ মাড়িয়ে যাবার সময় কীভাবে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অসার হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কও বিকল হয়ে পড়েছিল। অবশেষে তিনি রাজকুমার সার্গেইকে সাক্ষৎ করা এবং বসবাস করা ঘরটির বর্ণনা দিয়েছিলেন। বিকেলে গভীর অন্ধকার হয়ে পড়া পরিবেশে রাজকুমারী নাকি কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। রাজকুমার সার্গেই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বরফের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে এগিয়েছিলেন। কিন্তু শিকলের ঝনঝনানি শুনে তিনি অত্যন্ত অবাক হয়েছিলেন। তিনি ধারণাই করতে পারেন নি যে সাইবেরিয়ার সেই পরিবেশের মধ্যেও কাউকে শিকলের দ্বারা বেঁধে রাখা যেতে পারে। তিনি দুঃখের সঙ্গে অনেক কথা লিখে তাঁদের থাকতে দেওয়া কুড়ে ঘরটির ও বর্ণনা দিয়েছিলেন। কুড়ে ঘরটি এত ছোট ছিল যে শুতে গেলে পা এবং মাথা বেড়া এবং দেওয়ালে ঠেকে যেত। ঘরের ভেতরে রাখা ভিজে খড়ি দিয়ে জ্বালানো উনুন থেকে সবসময় ধোঁয়া বেরোত। বাইরে জোরে বাতাস বইলেই বেড়ার ফুঁটো দিয়ে ঘরের ভেতর বাতাস ঢুকে যাওয়ায় মাঝে মধ্যেই উনুনটা জ্বালানো সম্ভব হয়ে উঠত না।
নাটালিয়া রাজকুমারী ভলকনস্কায়ার নোট পড়ে ভীষণভাবে অখুশি হয়েছিলেন।তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেন এই মারিয়াকে আদি করে মহিলাদের ডিসেমব্রিষ্টরা তাঁদের উদ্ধারকারী স্বর্গের পরী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁরা দেশ হিতৈষীদের মানসিক বল বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে রান্না-বান্না করে দিতেন,রোগীদের শুশ্রূষা করতেন,কাপড়-চোপড় সেলাই করে দিতেন।এর বাইরে তাঁরা মস্কোর সঙ্গে ,পরিবারদের সঙ্গে নির্বাসিত লোকেদের হয়ে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। কারণ নির্বাসিতদের চিঠি লেখার কোনো অধিকার ছিল না। সাংস্কৃতিক দিকটিকেও সজীব করে রাখা এই মহিলাদের স্মৃতিকথা নাটালিয়াকে আনন্দিত করার সঙ্গে সঙ্গে গর্বিত করে তুলেছিল। তার কয়েকজন বান্ধবী যে আত্মত্যাগ করা সেই মহিলাদের নিজের আদর্শ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে সে কথা তার মনে পড়ল এবং একই সঙ্গে সে ও যে বান্ধবীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে,সে কথা ভেবে তার ভালো লাগল।আনন্দে রেড স্কোয়ারে নাটালিয়ার হাঁটার গতি বেড়ে গেল।
তেরো বছরের কঠোর পরিশ্রম এবং তার পরের সতেরো বছরের নির্বাসন ভোগে ১৮৫৬ সনে ডিসেমব্রিষ্টরা যখন সামাজিক মূল স্রোতে ফিরে এসেছিল তখনও ভূমিদাসদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।ইতিমধ্যে তার আগের বছর প্রথম নিকোলাসের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় এলেক্সজেণ্ডার জার হয়েছিল। তাঁর সহানুভূতি সত্ত্বেও কয়েকবছর পর্যন্ত ভূমিদাসদের জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।ভূমিদাসরা আগের মতোই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়ে চূক্তিবদ্ধ শ্রমিকে পরিণত হয়েছিল।মাটির মালিকেরা কয়েকশ বছর ধরে চলে থাকার মতো নিজের ইচ্ছানুসারে দাসদের কেনাবেচা করতে পারত।মালিকের অনুমতি ছাড়া দাসরা বিবাহপাশে আবদ্ধ হতে পারত না,হস্তশিল্প বা অন্যান্য ব্যবসা করতে পারত না।
সেইসময় কাউন্ট হলেও লিও টলস্টয় ওদের মুক্ত করার জন্য এককভাবে চেষ্টা শুরু করেছিলেন।এর আগে তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল স্টাডির কেন্দ্রে আরবি এবং তুর্কি ভাষা পড়তে গিয়ে আধাতেই ছেড়ে দিয়ে ককেসাসে থাকা দাদা নিকোলাইর প্রেরণায় সামরিক বিভাগে যোগ দিয়ে লেফটেন্যান্ট পদে পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন।পরবর্তীকালে অবসর নিয়ে যখন ১৮৫৫ সনে ২৮ বছর বয়সে (ডিসেমব্রিষ্টদের সেই বছর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল)জন্মস্থান ইয়াস্নায়া পলিয়ানার নিজেদের হাউলিতে একেবারে ফিরে এসেছিলেন,তখন থেকেই ভূমিদাসদের জীবনের উন্নতির জন্য টলস্টয় নানা প্রকারে চেষ্টা করেছিলেন।তিনি কয়েকজনকে নামমাত্র চুক্তিতে চাষ করার জন্য মাটি দিয়েছিলেন। কিছুলোককে বাড়ি তৈরি করার জন্য কাঠের জোগান দিয়েছিলেন। তার তিনবছর পরে চাষার ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠশালা খুলে দিয়েছিলেন এবং নিজে শিক্ষাদান করতে শুরু করেছিলেন।দ্বিতীয় এলেক্সজেণ্ডার ১৮৬১ সনে ভূমিদাস প্রথা উঠিয়ে দেবার কয়েকবছর আগে লিও টলস্টয় এই কাজ আরম্ভ করেছিলেন।তাঁর বন্ধু কবি আফানাসি ফেটকে লিখেছিলেন-‘আমাদের আর শেখার প্রয়োজন নেই।আমরা যতটুকু জানি তাই সাধারণ লোকের মধ্যে শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিলিয়ে দেওয়া উচিত।–এই কাজ কাউন্ট লিও টলস্টয় হাতে কলমে করেছিলেন এবং ১৮৬১ সন থেকে জন্মস্থান ‘ইয়াস্নায়া পলিয়ানার’নামে একটি শিক্ষামূলক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।এতে তিনি শিশুদের সহজাত অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক জোগাতে পারার মতো প্রবন্ধ সন্নিবিষ্ট করা ছাড়াও জনগণের মুক্ত কণ্ঠ জাগ্রত করতে পারার মতো শিক্ষকরা যাতে ইচ্ছামূলক শিক্ষাদান করতে পারে তার জন্য আহ্বান করেছিল।
টলস্টয়ের কথা নাটালিয়ার মনকে আপ্লুত করে তুলল। সে এরকম একজন মানুষের কথা রাশিয়ার ইতিহাসের পাতায় পায় নি যে ভূমিদাস এবং নিঃস্ব চাষিদের কথা এত আন্তরিকভাবে চিন্তা করেছিলেন এবং একক ভাবেই তাদের উন্নতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
১৮৭০ সনে টলস্টয়ের বয়স ৪২ বছর। সেই বয়সে টলস্টয়কে আধ্যাত্মিক ক্লান্তি অবসাদগ্রস্ত করে তুলল।গ্রিক ভাষা শিখে হোমারের মূল গ্রন্থ অধ্যয়নও করলেন সেই সময়। নয়বছর পরে এই মহান লেখকের পৃথিবীর এবং জীবনের প্রতি ধারণা তুঙ্গে উঠল এবং নিজের আভিজাত্যিক বাতাবরণ থেকে নিজেকে ভিন্ন করে আনল।এই সময় থেকেই নিজের আত্মানুসন্ধানের জন্যই ব্যক্তিগত স্বত্ব,শোষণকর্তা,সামাজিক-সরকারি ধর্ম এবং শাসক শ্রেণির সমালোচনাকে তাঁর লেখার মূল বিষয় হিসাবে বেছে নিলেন এবং মাঝে মধ্যে নৈতিকতার কথা উল্লেখ করাটা প্রয়োজনীয় বলে অনুধাবন করে সেই বিষয়গুলি লেখায় সংযোজন করতে লাগলেন।৫৬ বছর বয়সে তিনি ইয়াস্নায়া পলিয়ানার হাউলি ছেড়ে কৃষক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
সেই সময়ে জার দ্বিতীয় এলেক্সজেণ্ডারকে কয়েকটি বিদ্রোহী প্রজা হত্যা করেছিল এবং সেই অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচানোর অনুরোধ করে টলস্টয় তৃতীয় এলেক্সজেণ্ডারকে পত্র লিখছিলেন। এই পত্রের কোনো ফল হয়নি।তবু তিনি নিজের মতে কাজ করে গিয়েছিলেন।১৮৯১ সনে তিন বছরের জন্য রিয়াজান প্রদেশে আকালে পড়ে অনাহারে ভোগা কৃষকদের জন্য তিনি ছাউনি পেতে খাবার জিনিস বিলিয়ে আর্তসেবার আয়োজন করেছিলেন।তার মধ্যে ১৮৯৫ সনে সাধারণ কৃষকদের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে ‘লজ্জা’নামের একটি প্রবন্ধ লিখে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন।এই সমস্ত কাজই টলস্টয় নিঃস্ব চাষিদের কথা ভেবে করেছিলেন।
টলস্টয় গির্জার ধার্মিক অনুষ্ঠানকেও আক্রমণের লক্ষ্য করে নিয়েছিলেন।তিনি লিখেছিলেন যে এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রশংসনীয় দিকটি হল কারও অপকার না করে সবার মঙ্গলের জন্য করা নিরীহ প্রার্থনাগুলি এবং গির্জার সভ্যদের লোভ সম্বরণের অনুশীলন করা। কিন্তু তিনি প্রশ্ন করেছিলেন-অন্য আনুষঙ্গিক কাজগুলি না করে অনুষ্ঠানটি নিরীহ মানুষগুলির কয়েকবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে না কি? এটা বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় যে গির্জার ধার্মিক অনুষ্ঠাণে জড়িত এই লোকেরা গির্জার দাসত্বের শৃঙ্খলের মধ্যে বড় হয়ে উঠা এক একজন সাধুপুরুষ। এই ধরনের সমালোচনার জন্যই রাশিয়ার গির্জার গোড়া প্রতিষ্ঠান তাকে সামাজিভাবে বহিষ্কার করতে আহ্বান জানিয়েছিল।টলস্টয় একটা প্রবন্ধ লিখে তার উত্তর দিয়েছিলেন। তাকে গির্জায় স্থান দেওয়া হয়নি,কিন্তু মস্কোর পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময় পথিকরা তাকে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছিল।
সেই সময় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি ক্রিমিয়ার গাছপ্রালে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবু সেখান থেকেই ১৯০১ সনের মার্চমাস থেকে শাসন ভার নেওয়া দ্বিতীয় নিকোলাসকে তিনি একটি সুদীর্ঘ পত্র লেখেন এবং নিরীহ মানুষদের ইচ্ছা এবং প্রয়োজন দমন করে রাখা শক্তিগুলিকে ধূলিসাৎ করার জন্য আহ্বান জানালেন।তাছাড়া মৃত্যুর দুই বছর আগে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন।প্রবন্ধটির নাম দিলেন-‘আমি মনে মনে থাকতে পারব না।’
নাটালিয়ার মনে পড়ল এই মহান লেখকের মৃত্যুর কথা। ১৯১০ সনের নভেম্বর মাসে সারা রাত বৃষ্টির পরে একটি সিক্ত সকালবেলা জনগণের মধ্যে থাকার মানসে ইয়াস্নায়া পলিয়ানার হাউলি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। চারদিন ভ্রমণের পরে তিনি নিউমোনিয়া রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অষ্টাপভ নামের অপরিচিত ছোট একটি রেলস্টেশনে নেমে পড়েন। সেখানেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়।
লেখকের মৃত্যুতে লেনিন লিখলেন-‘টলস্টয় আমাদের সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে ধরেন এবং এরকম করতে গিয়ে তিনি এরকম পটুতায় শিল্পসুলভ কলা-কৌশল প্রয়োগ করলেন যে তাঁর সমস্ত রচনাই পৃ্থিবীর মহান সাহিত্যের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হল।’
এইজন্যই নাটালিয়া টলস্টয়ের বিষয়ে গবেষণা করবে বলে স্থির করেছে।তাই ইতিহাস,সাহিত্য এবং সমাজতত্ত্বের আধারে রাশিয়ার সমাজে টলস্টয়ের প্রভাবের বিষয়টা বেছে নিয়েছিল।মার্ক্স এবং অ্যাঞ্জেল ছাড়া লেনিনের ওপরেও টলস্টয়ের প্রভাব পড়েছিল নাকি,এই সমাজতাত্ত্বিক বিপ্লবে এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনায় অবদান জুগিয়েছিল নাকি?
নাটালিয়ার অধ্যাপক ক্রিয়োসকভের কথা মনে পড়ল।এই অধ্যাপকের সঙ্গে সে এই বিষয়ে গবেষণা করতে মনস্থ করেছে।অধ্যাপক এখনও তার বিষয়ে অনুমোদন জানায়নি।তিনি বলেছেন-‘বেছে নেওয়া বিষয়টা মাথায় রেখে তোমাকে লিও টলস্টয় বিষয়ে পড়াশোনা করে যেতে হবে।অধ্যয়ন করার সময় বিষয়ের পরিবর্তন হতেও পারে।তাই বিষয়টা এখনই স্থির না করে কেবলমাত্র অহরহ পড়াশোনা করে যাও।’-আর এই অধ্যাপক ক্রিয়োসকভই তাকে গবেষণা সম্পর্কীয় জরুরি একটা কথা বলার জন্য তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
নাটালিয়ার হাঁটার গতি বেড়ে গেল।
দূরে রোদের আলোতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল রেড স্কোয়ারের একটা প্রান্ত জ্বলজ্বল করতে থাকা সেন্ট বেসিলার ক্যাথেড্রেলটা এবং তার পেঁয়াজের মতো নানা বর্ণের গগনচুম্বী চূড়াগুলি। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে দুর্ধর্ষ ইভান নামে পরিচিত রাশিয়ার প্রথম জার চতুর্থ ইভান কাজান এবং আষ্ট্রাখান নিজের দখলে আনার বিজয় উল্লাসের চিহ্নস্বরূপ বাইজেনটাইন ধর্মী এই ক্যাথেড্রেলটা নির্মাণ করেছিলেন। আর তখন থেকে বলশেভিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এটা গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাসের মুখ্যকেন্দ্র রূপে চিহ্নিত হয়ে আসছিল। কিন্তু এখন একে একটি যাদুঘর এবং গ্রন্থাগার রূপে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
কেথেড্রেলটার বিপরীত দিকে রয়েছে এলেক্সজেণ্ডার গার্ডেন এবং লেনিনের স্মৃতিসৌধ। বলশেভিকদের নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করা লেনিনের মৃত্যুর ৬৫ বছর পার হয়েছে যদিও তাঁর মোমের মতো মৃতদেহটি শীতল বাতাবরণে কাচের বাক্সে এখনও সংরক্ষিত করে রাখা আছে। থুতনির বিশেষ দাড়ি এবং একটি হাত মুঠো করে থাকা বিশেষ ভঙ্গিমায় এখনও সুন্দর করে রাখা এই ব্যক্তিটিকে দেখার জন্য স্মৃতিসৌধ ভবনের সামনে পর্যটকদের একটা হালকা ভিড় এখনও দেখা যায়।
নাটালিয়া দূর থেকেই দেখতে পেল রেডস্কোয়ারের প্রান্তে তার গন্তব্যস্থল ভেতরের তিনটি মহলে থাকা অজস্র ছোট ছোট দোকানের আলোয় আলোকিত উনবিংশ শতকে আরম্ভ করা গাম নামের বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা। স্টোরটা এইমাত্র খুলেছে এবং দুই একজন গ্রাহককে ভেতরে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে।
নাটালিয়া ভেতরে প্রবেশ করে উপরমহলে উঠে গেল এবং মাকে দেবার জন্য একটা জন্মদিনের উপহার খুঁজতে লাগল। খুববেশি সময় নষ্ট করবে না ভেবেছিল যদিও তার আধ ঘণ্টার মতো সময় লাগল এবং যখন সে গাম থেকে বেরিয়ে এল , তখন রৌদ্রস্নাতা রেড স্কোয়ারের মেঝেতে সমগ্র পৃথিবীর উজ্জ্বল মুখের নানা বর্ণের পর্যটকে ভরে পড়েছিল।
সমগ্র মহানগর ইতিমধ্যে জেগে উঠেছিল। গাড়ি মোটর, অফিসার-কর্মচারী এবং কর্মব্যস্ত মানুষের মৃদু কলরবে সরব হয়ে উঠেছিল। সে বুঝতে পারল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাড়াতাড়ি যেতে হলে পাতাল রেল ছাড়া গত্যন্তর নেই।
নাটালিয়া ক্রেমলিনের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া মস্কভা নদী এবং তার উপরে থাকা ব্রিজ অফ কিসেস দূরে ফেলে এসে কাছের প্ল’চ্ছাড রিভ’ল্যুটছিল নামে মেট্রো স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। উপপথের সুরঙ্গ দিয়ে সে নেমে গেল, টিকেট কিনে নিল এবং সিন্ডেলিয়ারের আলোতে ঝলমল করতে থাকা মার্বেল এবং মোজাইক খচিত মেঝে দিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে দ্রুত গিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পরে আসা মেট্রোটাতে সে উঠে পড়ল।
অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ হয়তো তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় ঘরে এখনও অপেক্ষা করছেন। ফিয়ডর ইভানভিচ নামের গবেষকটিও কি অপেক্ষা করছেন?
অনুবাদক