Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 18

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৪) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

Reading Time: 10 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১৪।


পরের দিন সকালের আহার খেয়ে ফিয়োডর এবং নাটালিয়া যখন ম্যানেজার বরিস জোগাড় করে দেওয়া গাড়িতে য়াকুরিম গ্রামে   যাত্রা করল তখন সূর্যের কোমল আলোতে জায়গাটা ঝকঝক করছিল। পথের পাশের বনানিগুলিতে স্তরে স্তরে গাঢ় তুষার জমা হয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। পাশের গভীর খালে এবং দূরের ঢালু পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা বরফ জমা হয়েছিল।

ওদের পথ ধীরেধীরে ঘন চিরহরিৎ সরলবর্গীয় গাছগুলির মধ্য দিয়ে যেতে লাগল। অরণ্যের পথ ফার পাইন এবং সিডার গাছে পরিপূর্ণ। সেইসব পার হয়ে ওরা ধীরে ধীরে কিছুটা খোলামেলা জায়গা পেল। কাঠের ঘরের একটি ছোট্ট গ্রাম পার হল। গ্রামটির আশেপাশে কয়েকটা অ’ক, ম্যাপল এবং বার্চ গাছ দেখা গেল।ম‍্যাপল গাছের উজ্জল লাল পাতাগুলি সোনালি বরণ ধারণ করেছে। সেইসঙ্গে বার্চ  গাছের পাতাগুলিতেও কয়েকদিনের মধ্যে খসে পড়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। চারপাশে পরিস্ফুট হয়েছে হেমন্তের হাতের -ইশারা।

নাটালিয়া বাইরের দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। সে ম্যাপল এবং বার্চগুলির দিকে তাকাতে তাকাতে বলল–’ আমাদের ওখানে পরিপূর্ণ শরৎকাল। এখানে দিন পনেরোর ভেতরে ঋতুটা শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।’

ফিয়োডর সায় দিয়ে বলল–’ আমাদের ওখানে নভেম্বরের পর পরই ঘটা ঘটনাগুলি এখানে অক্টোবরে হবে বলে মনে হচ্ছে।’

ইভান নামের ওদের গাড়ির চালকটি খুবই শান্ত স্বভাবের।ফিয়োডরদের  কথা শুনে সে বলল –’হ‍্যাঁ মিস্টার ফিয়োডর ,শীত পড়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে ভালোভাবে পড়বে । গাছের পাতাগুলিতো খসে পড়বেই, বার্চ গাছের ছালগুলিও চটপট খসে পড়তে শুরু করবে।

গাড়ির চালক বলার আগে থেকেই ফিয়োডর সাদা রঙের  মসৃণ ছালের গাছের গুড়ি দাঁড়িয়ে থাকা পথের পাশে সারি সারি বার্চ গাছগুলি  দেখতে দেখতে যাচ্ছিল। কারন প্রিয় এই  উপকারী গাছগুলি শিল্পী এবং কবিদের মতো তাকেও শৈশব থেকেই প্রেরণা জুগিয়ে আসছিল।সে জানতে পেরেছিল ভালো খার   হিসেবে ব্যবহার হওয়া এই গাছের ছাল থেকে লাপ্টি  নামের জুতোত্ত নাকি মানুষ সেলাই করে নিয়েছিল । সঙ্গে বেরি এবং ব্যাঙের ছাতা কুড়োনোর জন্য এক ধরনের বাঁশের পাত্র নির্মাণ করে নিয়েছিল । কেবল তাই নয় কাগজ আবিষ্কার করার আগে এই গাছের ছাল গুলিতেই মানুষ লেখালেখি করত । সেই জন্যই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে অতীতের মানুষেরা উপকারী এই গাছগুলির গুড়িতে ফুল ইত্যাদি দিয়ে পুজো করত।

ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল–’ ইভান আমরা য়াকুরিম গ্রামে যাব। তুমি কি সেখানে গিয়েছ?’

ইভান বলল–‘ আমি কয়েকবার গিয়েছি। গ্রামটির কিছু অংশ ‘বাম’  রেলপথ তৈরি করার জন্য ছেড়ে দিতে হল। সেখানে থাকা মানুষেরা পশ্চিম দিকে কয়েক মহল পর্যন্ত তৈরি করা অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেল। আগের ঘরগুলি থাকার জায়গা থেকে লেনা নদীর সেতুর জন্য রেলপথের উচ্চতা আরম্ভ হয়েছে।’

চালক বলল-‘ আমার পিতৃগৃহও সেখানে ছিল। কিন্তু গ্রামের ঘর গুলি ভেঙ্গে দেওয়ায় পিতা সেখান থেকে উষ্টকুটে   চলে এল। তিনি নিজের নামে পাওয়া অ্যাপার্টমেন্টটা অন্যকে দিয়ে দিলেন। আমার জন্ম কিন্তু এখানে–উষ্টকুটে। গতবছর বাবার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তার আগে আমাকে কয়েকবার আমাদের অতীতের ঘর কোথায় ছিল তা দেখানোর জন্য য়াকুরিম গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল ।’

ইভানের গাড়িটা ছিল পুরোনো। সে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে ফিয়োডরকে জিজ্ঞেস করল–’ আপনাদের তাড়াহুড়ো  নেই তো? অবশ্য আধঘণ্টার মধ্যে গ্রামে পৌঁছে যাব।’

দু’দিকের ঘন গাছগুলির মধ্য দিয়ে থাকা  গাড়ি মোটর বিহীন পথটা দিয়ে তাঁরা যেতে লাগল।

‘ মিস্টার ফিয়োডর,য়াকুরিম গ্ৰামে কার সঙ্গে দেখা করার জন্য আপনারা এসেছেন?’

যুবক চালকটির প্রশ্নের উত্তরে ফিয়োডর বলল–’ নাডিয়া প’পভনাকে তুমি জান কি?’

কিছুক্ষণ চিন্তা করে ইভান বলল–’না, জানিনা।’

নাটালিয়া – ‘নাডিয়া  প’পভনা,  তিনি এখন বোধহয় আশি বছরের বুড়ি হবেন ।’

নাটালিয়ার কথার সুরে আশঙ্কা প্রকাশ পেল–’ ঠাকুমার বেঁচে আছে তো?’

ইভান বলল–’ও মহাশয়া নাডিয়া প’পভনা তাকে জানি। আমি আরও আপনাদের বয়সের কেউ বলে ভেবেছিলাম।’

সে খুশি মনে বলল–’ মহাশয়া নাডিয়া প’পভনা  আমার বাবাকে পড়িয়ে ছিলেন। আমার বাবার ষাট   বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে। এখন মহাশয়া নাডিয়া বেঁচে আছেন কিনা ?’

চালক ইভানের কাছে বসে যাওয়া ফিয়োডর তার দিকে উৎসুক ভাবে তাকাতে দেখে সে বলল–’ মিস্টার ফিয়োডর, গত ছয় মাস আগে আমি একবার তার কাছে যখন গিয়েছিলাম তখন তিনি ভীষণ ভাবে অসুস্থ ছিলেন। আমরা আবার গত বছর তিন বারের মতো তার কাছে গিয়েছিলাম। একটা বিশেষ কারণে গিয়েছিলাম। তার কাছে থাকে একজোড়া যুবক-যুবতি– দাদা বোন।ওরা মেরু অঞ্চলে  থাকা য়াকুট, নেনেটস না ছুকছিজ – নাকি অন্য কোনো সম্প্রদায়ের জানিনা। ওরা নাকি এস্কিমো – ইগলুতে  বাস করে। ওদের কথাগুলি শুনতে ভালো লাগে। আমাদের এখান থেকে আলাদা। মাছধরা, শিকার করা, রেইনডিয়ার এবং কুকুরে টানা স্লেজ গাড়িতে উঠা– সমস্ত আলাদা। ওদের মুখে অশুদ্ধ উচ্চারণে উচ্চারিত আমাদের ভাষায় বলা কথাগুলি বড় সুন্দর। তা শোনার জন্য সঙ্গীদের নিয়ে তার  বাড়িতে আমরা যাই।’

ইভান বলল–’ আমাদের ঋতুগুলির কথা তো আপনারা জানেনই । ঋতুগুলি নির্ধারিত এবং চারটি ।’

হ্যাঁ ,ফিয়োডর জানে ওদের নভেম্বরের মাঝখান থেকে তিন মাসের জন্য হওয়া শীতকালের কথা। ফেব্রুয়ারি দুই  তারিখের ক্যান্ডেলমাস ডে থেকে দিনগুলি একটু দীর্ঘ হতে আরম্ভ হওয়ার বিশ্বাসের কথাও সে জানে।এই বিশ্বাসের জন্য ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ থেকে ঘোড়ার লাগাম, গাড়ি এবং অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম মেরামতির কাজ গ্রামে আরম্ভ হয়। এপ্রিলের ৮ তারিখ থেকে নাকি নদীর ওপরের গাঢ় বরফের স্তর ছিন্নভিন্ন হয়ে ফাটতে শুরু করে। সেই সময়ে বন জঙ্গল এবং মাঠে বরফের ফাঁকে ফাঁকে স্নো-ড্রপস নামের প্রথম ফুলগুলি ফুটতে শুরু করে‌।১৭ এপ্রিলের’ ভগবানের মানুষ–এলেক্সেইর দিনটিতে মাঠের বরফ গলে নাকি শেষ হয়। তারপরে য়েগরি ভেসনির দিনের দিন মানুষগুলি গৃহপালিত জীব জন্তুগুলিকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য মাঠে নিয়ে যায় এবং হাল বাইতে শুরু করে । তার পরের দুই মাসেই হল বসন্তকাল। জুলাই-আগস্টে গ্রীষ্মকাল এবং নভেম্বরের মাঝখান থেকে আরম্ভ হওয়ার শীতকালের আগের মাস কয়টি শরৎকাল।

‘ কিন্তু’– ইভান পুনরায় বলল– ওদের ঋতু দুটি– আট নয় মাসের জন্য একটা তীব্র শীত কাল এবং অন্যটি শীতল গ্রীষ্মকাল।’

ফিয়োডর ঋতুর ধারণা গুলির কথা ভেবে থাকার  সময় নাটালিয়া ঠাকুমা নাডিয়া প’পভনের কথা ভাবছিল । সে ইভানকে জিজ্ঞেস করল – মহাশয়া নাডিয়া প’পভনার অসুস্থতার কথা বললেন যে, কী অসুখে তিনি ভুগছেন এবং কতদিন থেকে?’

ইভান বলল– কী অসুখ জানিনা। বৃদ্ধ বয়সের অসুস্থতা হবে বলে মনে হয়। তবে ভাই বোনরা আছে কিনা কে জানে।’

নাটালিয়া আর ফিওডোর ভাবছে নাডিয়া প’পভনার কথা আর ইভান ভাবছে ছেলেমেয়েদের কথা। তবু ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল – ওদের কী হয়েছে?’

ইভান বলল – ঠান্ডা পড়তে শুরু করলেই নিজের জায়গায় যাবার জন্য ওরা ছটফট করতে থাকে। ওদের ওখানে চারপাশে বরফ। বরফ আর বরফ। কিছু কিছু জায়গায় সপ্তাহ খানেক ধরে বাইরে বেরোতে না পারার মতো ঠান্ডা । তবু শীতকালে সেখানে থাকতে ওরা ভালোবাসে। সেখানে থাকার আমেজই আলাদা । উষ্টকুটের একজন ডাক্তার বলেছেন এটা নাকি সুদূর উত্তরে বাস করা মানুষের মানসিকতা। কী যেন বলে উত্তরের বেমার।’

ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল কোথায় দেখা হল ছেলেমেয়েদের সঙ্গে?’ 

ইভান বলল–’ মহাশয়া নাডিয়া প’পভনার বাড়িতে একসময় বসবাস করা একজন কাঠুরিয়ার কাছ থেকে। তার সঙ্গে নাকি আনুক এবং নেলিয়া নামে ছেলে মেয়ে দুটি এসেছিল। তিনিই নাকি ছিলেন বাড়ির গৃহস্বামী। তার বয়স হয়েছিল যদিও টাইগার ভাটা অঞ্চলে কাঠ কাটায় তিনি বড় অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি অন্যান্য কাঠুরিয়াদের সঙ্গে খাবার দ্রব্য এবং অন্যান্য সাজসরঞ্জাম নিয়ে গরমের দিনে টাইগারের ভাটা অঞ্চলে বড় বড় গাছ কাটতে গিয়েছিলেন। ওরা কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি ছোট একটি করে জড়াজড়ি করে কোনরকমে রাত কাটিয়েছিল। সকালে ওঠে খাবার খেয়ে কাঠুরিয়ারা বড় বড় করাত, কুঠার, দা নিয়ে গাছ কাটতে জঙ্গলে যেত। এর আগের দিন খাজ কেটে  চিহ্ন দিয়ে রাখা গাছ গুলির একটিতে কুঠার দিয়ে না হলে দুজন মানুষ দুদিক থেকে বড় করাত একটা ধরে গাছের গুড়ির দুই ফুটের মতো ওপরে কাটতে শুরু করত। গাছটা ধীরে ধীরে হেলে পড়তে শুরু করলেই ওরা যেদিকে গাছটা পড়ছে সেদিকে চিৎকার করতে শুরু করত– এখন গাছ পড়বে, এখন গাছ পড়বে– এরকম একটি দৃশ্য নাকি আনু নামের ছেলেটি ভাটা অঞ্চলে গরমে অনুষ্ঠিত, বাবার সঙ্গে বস্তু বিনিময় করতে আসার সময় দেখেছিল। দেখে সে ও চিৎকার করতে শুরু করেছিল। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে থাকা শক্ত সরল জাতীয় সোজা গাছটির মট মট শব্দ করে ধুরুম  করে গড়িয়ে পড়তেই কাঠুরিয়াদের সঙ্গে তারও আনন্দের সীমা থাকত না। ওরা লম্বা গাছটার কোমল ডালগুলি কুঠার  এবং করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করত। তারপর অনেক কষ্ট করে গাছের গুড়িটা গড়িয়ে গড়িয়ে  নিয়ে নদীর জলে ফেলে দিত। সেই সময়ে মহাশয় নাডিয়া প’পভনার বাড়ির গৃহস্বামী কোনোভাবে পায়ে ব্যথা পেল। বেলা দুপুর পর্যন্ত কাঠুরিয়াদের হিসেব-নিকেশ দেখতে থাকা আনুক হাট থেকে ফিরে আসা বাবাকে চিৎকার করে ডেকে বয়স্ক মানুষটিকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শুশ্রূষা করার জন্য মিনতি করতে লাগল। সেবার ওরা মানুষটাকে শ্লেজে তুলে ওদের বাড়িতে নিয়ে এক সপ্তাহ রাখল। সুস্থ হওয়ার পরে আনুক এবং নেলিয়াকে ভাটা অঞ্চলের বরফহীন গ্রাম শহর দেখানোর জন্য য়াকুরিম গ্রামে নিয়ে এল। ইতিমধ্যে নদীতে জমা হওয়া কুড়ি পঁচিশটার মতো গাছের গুড়ি মানুষটার সঙ্গীরা বৈকাল হ্রদের   দিকে বয়ে যাওয়া নদী দিয়ে ভেলা তৈরি করে ভাসিয়ে এনেছিল। হাতে লম্বা লম্বা দাঁড় নিয়ে গাছের গুড়িগুলির ওপরে ওপরে যুবক কাঠুরিয়া লাফিয়ে লাফিয়ে ভেলাটির দিক সঠিক পথে রেখে ভাটা অঞ্চলের নদীর পাশে একটা কাঠের মিলে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সব ঠিকঠাক করে রেখে বাড়ির মালিকরা আনুক এবং নেলিয়াকে নিয়ে য়াকুরিম গ্রামে পৌঁছেছিল। ওরা আধা রাস্তায় থাকতেই ওদের গায়ে থাকা নোংরা ফারের কোটটা খুলে ফেলেছিল । ওরা একটা কুকুরের বাচ্চা সঙ্গে এনেছিল। কুকুরের বাচ্চাটার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পেয়ে মহাশয়া নাডিয়া প’পভনা মাঝ বয়সে পড়াতে শুরু করার ছাত্র-ছাত্রীদের মতোই আদর আপ্যায়ন করতে লাগল।’

কথাগুলি বলে চালক ইভান বলল–’ সেভাবেই ছেলেমেয়েগুলিকে পেয়েছিলাম।এক মাসের জন্য থাকতে আসা ওদের এখানে থাকার এখন প্রায় এক বছর হয়ে গেল।তবু গতবার শীতকালে ফিরে যাবার জন্য উশখুশ করছিল।কিন্ত ঠিক তখনই বাড়ির গৃহস্বামীর মৃত্যু হল এবং তারা মহাশয়া নাডিয়া প’পলভনাকে ছেড়ে যেতে চাইল না।‘

নাটালিয়া বলল-‘ছেলেমেয়েগুলি খুব কোমল মনের হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।তবে শীতের সময় যে নিজের জায়গায় যেতে চায় সেই তীব্র শীতে ওরা কী করে?’

ইভান বলল-‘আনুক নামে যুবকটি বলেছে নদ-নদী-পাহাড় হ্রদের  জল বরফ হয়ে যখন দূর দিগন্তে তুষারাবৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে,তখন ওরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত গরম লোমশ পোশাকে আবৃত্ত হয়ে স্কি এবং স্কেট করে মুক্তাঙ্গনে ঘুরে বেড়ায়।লম্বা লম্বা শিঙের রেইনডিয়ারের দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।তাছাড়া নদীর বুকের ওপরের গাঢ় বরফের স্তরগুলিতে একহাত দুইহাত কুয়োর মতো গর্ত খুঁড়ে মাছ ধরে।ওরা গর্তে বড়শি ফেলে অপেক্ষা করে এবং বড়শিতে মাছ উঠলেই মা-বাবাকে দেখানোর জন্য বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।এইসমস্ত করে ক্লান্ত হয়ে যখন তারা বাড়ি ফিরে আসে তখন ওরা গায়ে লেগে থাকা বরফের টুকরোগুলি ঝেড়ে ফেলে ফারের নোংরা কোট খুলে ঘরের ভেতরে অহরহ জ্বলতে থাকা আগুনের চারপাশে ঠেলা্ঠেলি করে উষ্ণতার জন্য বসে এবং বরফে জমে থাকা এক টুকরো কাঁচা মাছ ধোঁয়া উঠতে থাকা উষ্ণ মিষ্টি এক কাপ লাল চায়ের সঙ্গে খায়।সেটা খেয়ে নাকি ওরা খুব তৃপ্তি লাভ করে।‘

‘কাঁচা মাছ?’-নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ।এস্কিমো মানেই কাঁচা মাংস খায় যারা।ওরা শীল এবং তিমি মাছের মাংস খেতে ভালোবাসে।‘-ইভান বলল।

‘ওরা কি ইগলুতে বসবাস করে?’

নাটালিয়ার প্রশ্ন শুনে ইভান বলল-‘ইগলুতে বসবাস করা ছাড়াও এদিকে ওদিকে নিয়ে যাবার মতো করে তৈ্রি করা একটা ঘরেও বাস করে।ঘরটাকে ছোম বলে।উপর দিকে সূঁচলো করে তৈ্রি এই ছোমগুলির খুঁটির কিছু ওপরে রেইনডিয়ারের ছাল মেলে শীতকালে ঢেকে দেয়।শীত-গ্রীষ্মকালে বার্চগাছের ছাল দিয়ে ঢেকেও অনেকে ছোম তৈ্রি করে।ভেতরে আহরহ আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়।সেই আগুনের প্রতি ওরা বেশ সম্মান প্রদর্শন করে।তারমধ্যে নোংরা জিনিস ফেলে না এবং থু থু ফেলে না।কোনো মানুষের মৃত্যু হলে আগুনটা নিভিয়ে ফেলে এবং পরে আগুন জ্বালায়।‘

‘মেয়েরা কী করে ইভান?’-নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল।

ইভান বলল-‘আনুক নামে ছেলেটির বোন নেলিয়া বলেছে বিবাহিতা মহিলারা দীর্ঘ শীতকালে পুরুষরা রেইনডিয়ার প্রতিপালন করার সময় এবং শিকার করার সময় পরার জন্য পারকাস নামের এক ধরনের বিশেষ পোশাক সেলাই করে।নিজেই তৈরি করে নেওয়া ছোমটির মহিলা একজনেই মালিক।বিয়ের আগে ছেলে এক বছরের জন্য এসে মহিলাটির ছোমে কাজ করে।মহিলাটির ছোম তৈ্রি করা এবং রান্না বান্না করার দক্ষতা পরীক্ষা করে।একবছর বা তার চেয়েও বেশি কিছুদিন থাকার পরে পুরুষটি বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে।অন্যদিকে মহিলাটির ওপরে হাত তুললেই স্বামীকে ছোম থেকে তাড়িয়ে দেবার অধিকার মেয়েটির থাকে।

‘ছেলেমেয়েরা সেখানে কী করে?’-ফিয়োডর জিজ্ঞেস করল।

ইভান বলল-‘তাদের ছেলেমেয়েরা খেলা-ধুলো নিয়ে কাটায়।ভেতরে থাকতে হলেই ছোট ছোট জিনিস,বিশেষ করে বার্চ গাছের ছাল দিয়ে পুতুল তৈ্রি করে।সেই পুতুলগুলি শীতল গ্রীশ্মকালে কদাচিৎ বেড়াতে আসা ভ্রমণকারীদের কাছে বিক্রি করতে পারে।কেউকেউ আবার ওদের অতি প্রিয় সৌভাগ্যের প্রতীক বলে ভাবা ভালুকের মুখোশ ও তৈ্রি করে।এই বিশেষ মুখোশকে ওরা ‘গ্র্যাণ্ড-পা’বা তাইগা বনের মাস্টার বলে।‘

ইভান বলল-‘নেলিয়া এবং আনুক বলেছে ওদের ওখানে গরমের দিনে নাকি তিনমাস সূর্য অস্ত যায় না।তখন খাদ্যের ভাণ্ডার শক্তিশালী করে তোলার জন্য ওদের পরিবারের সবাই শিকারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।জলে খণ্ড খণ্ড ভাবে ভেসে থাকা বরফের মাঝে মধ্যে ওরা কায়াকে উঠে হারপুন নিয়ে তিমিমাছ শিকার করতে যায়।তিমিমাছ দেখলেই হারপুন ছুঁড়ে রশি একবার ঢিলা দিয়ে একবার টান করে মাছটাকে ক্লান্ত করে নিয়ে শেষে পারে টেনে আনে।তিমি মাছ শিকারের এই আনন্দ নাকি অসীম।মাছটা থেকে খাদ্য হিসেবে প্রচুর মাংস পাওয়া যায়।ছোম এবং টুপেকগুলিতে অহরহ আগুন জ্বালিয়ে রেখে ঘরটাকে উষ্ণ রাখার জন্য অনেক তেল পাওয়া যায়।তাছাড়া শীতকালে জামা সেলাই করার জন্য তার ছাল পাওয়া যায়।তারা আধা জল আধা মাটিতে থাকা শীলও মাঝে মধ্যে শিকার করে।তার ছাল থেকে তারা গামবুট জুতো তৈ্রি করে।সূর্যাস্ত না হওয়া সেই গরমকালে ওরা জন্তুর ছাল,ফার,পোশাক এবং পুতুল শ্লেজে বোঝাই করে একবেলা বা সারাদিনের জন্য গিয়ে হাটে বাজারে একটুকু জায়গা খুঁজে নেয়।সেখানে এই জিনিসগুলির বিনিময়ে ওদের বাবা বন্দুক,গুলি এবং হারপুন বদলে   আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরে আসে।দূরে যাবার জন্য শ্লেজ গাড়ি বের করলেই আনুক   সঙ্গে  যায়। সে যদিও শ্লেজে  বসে যায় শ্লেজ টানা কুকুর গুলির জন্য সে মাঝে মধ্যে সামনের দিকে শীলের মাংস ছুঁড়ে দেয়।’

ইভান বলল আনুকের মুখে শোনা শীতকালের শুরুর কথা । গাছের পাতাগুলি ধূসর হয়ে খসে পড়ার সময় আরম্ভ হয় এই কালটি। এই শীতের শুরুতে ফার শিকারিরা ফার থাকা ছালের জন্তু গুলি ধরার জন্য ফাঁদ  পাতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে । ওরা উত্তরের কোমল তুষার পড়া জায়গায় কয়েকদিনের খাবার জিনিস বোঝাই করে নিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় দোকান দিয়ে বসে। শীত আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু জন্তুর গলা এবং শরীরের ফারগুলি বড় সুন্দর ভাবে বেড়ে গিয়ে ফুলতে শুরু করে । এই জন্তু গুলিকে ছররা  এবং ফাঁদ পেতে মারার জন্য এই ফারের শিকারিরা উত্তরের দিকে যাত্রা করে। বরফে জন্তুদের পায়ের চিহ্ন দেখে ওরা আসা-যাওয়া করা পথে খাবার জিনিস দিয়ে ফাঁদ পাতে এবং পরের দিন সকালের আহার খেয়ে কোমল বরফে যাতে ঢুকে না  যায় তার জন্য চওড়া পাতের জুতো পরে একপা দুপা করে দুলে দুলে শিকারিরা ফাঁদ দেখে আসে। কখনও কখনও ফাঁদ গুলি তুষারপাতে ডুবে যায়। কখনও আবার কোনো দুষ্ট বুড়ো শিয়াল ফাঁদে না পড়ে খাবারটা খেয়ে পালিয়ে যায় । কখনও ফাঁদে   শিকার পড়ে – লোমশ শিয়াল অথবা মার্টেন। আবার কখনও পড়ে দীর্ঘ নেউলের মতো ছেবল নামের প্রাণী। এই প্রাণী এই ফাঁদে পড়লেই শিক্কারিরা  আনন্দে অধীর হয়। কেননা কোমল সোনার মতো ছেবলের ফারগুলি অত্যন্ত মূল্যবান। একবার নাকি আনুকের বাবার ফাঁদে একটা ছেবল পড়েছিল। সেকথা আনুক ইভানদের সামনে বেশ উত্তেজনার সঙ্গে ব্যাখ‍্যা করেছিল।

ইভান বলে গেল–’ দীর্ঘকালীন শীতের মধ্যে দু মাসের চেয়েও অধিক কাল সূর্য সম্পূর্ণভাবে দিগন্তে লুকিয়ে পড়ে। সেই অন্ধকারময় পরিবেশে ওরা নিজের নিজের ঘর ইগলু ,ছোম বা টুপেকে ঢুকে থাকে। যখন আড়াই তিন মাস পরে আলো হয় এবং দিনগুলি ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে শুরু করে তখন তারা নতুন সাজ পোশাক পরে এবং বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে আসা যাওয়া করে নানা ধরনের গল্প গুজব এবং হাসি ঠাট্টা করে। কুকুরগুলির শ্লেজ   টানা লাগাম, পেটের এবং গলার জরি গুলিও মেরামত করে।রেইন ডিয়ারে চালানো শ্লেজের যন্ত্রপাতিগুলিও  ঠিক করে।’

ইভান বলল– ওদের বরফের রাজ্যে রেইনডিয়ারগুলি  দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। তারই কয়েকটিকে ধরে ওরা গৃহপালিত করে নিয়ে পোষে। বরফে মোটা  দড়ি গলায় পরিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেননা এই প্রাণীগুলি ওদের জন্য বড় উপকারী। ওরা বিশাল এবং বলবান বলে একসঙ্গে মাইলের পর মাইল জুড়ে শ্লেজ টেনে নিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া ওরা দুধ দেয়, মাংস দেয় এবং পোশাক তৈরির জন্য শরীরের ছাল ও দেয়। ওরা তুষারে  আবৃত্ত জায়গায় থাকতে কোনো অসুবিধা ভোগ  করে না। কেননা বড় বড় শিং এবং  সূঁচলো খুর দিয়ে বরফ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার নিচে থাকা শেওলাগুলি  খেয়েই ওরা বেঁচে থাকতে পারে।’

ফিয়োডরদের ছোট গাড়িটা ধীরে ধীরে কিছুটা ভাটার দিকে যাবার সময় দূরে একটি গ্রামের গোটা পঁচিশেক বাড়ি দেখা গেল। তার চারপাশটা ফাঁকা। দূরে টাইগার চিরহরিৎ অরণ্য দেখা যাচ্ছে।

ইভান বলল–’য়াকুরীম গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। তবে–।’

ফিয়োডর বুঝতে পারল চালকটি মহাশয়া নাডিয়া প’পভনা এবং ছেলে মেয়েদের বিষয়ে কিছু একটা বলতে চাইছে।

ওরা গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। কাচের জানালা থাকা কাঠের ঘরগুলি দেখা গেল। দেখা গেল চারপাশের বেড়া। তার বাইরে বাইরে গ্রামের পথটির আশেপাশে  রয়েছে বরফ পড়া এবং গলার সময় ফাটার জন্য কাঠের চাঙের তৈরি পায়ে চলা পথ। তার ওপর দিয়ে দুই একজন মানুষকে পায়ে হেঁটে আসা যাওয়া করতে দেখা গেল।

ইভান গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে নিয়ে রাখল। কাঠের গেট দিয়ে ভেতরের ঘরটা দেখা গেল। ঘরটা পুরোনো, কিন্তু নীল রং দিয়ে রং করা। ওরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। ছোট ছোট সবুজ গাছে চারপাশটা পরিপূর্ণ। খোলা উঠোনের এক কোণে একটা রশিতে ঝুলে রয়েছে কিছু কাপড়। তার মধ্যে নোংরা ফারের কোটদুটি রোদে শুকোতে দেখা গেল । তার মধ্য থেকে ঝুলে  রয়েছে বিভিন্ন জরি।

সেদিকে তাকিয়ে ইভান বলল–’ ছেলেমেয়েরা বাড়িতেই রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত শীতের আগে আগে পুনরায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।’

উঠোনে কেউ ছিলনা। ঘরে মহাশয়া নাডিয়া প’পভনা ছিলেন কিনা জানার কোনো উপায় ছিল না।

ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কাঠের ভারী মূল দরজার সামনে দাঁড়াল।

ভেতরে কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা গেল।

কিন্তু ঠাকুমা নাডিয়া প’পভনা আছে কি না বোঝা গেল না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>