| 16 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৬) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১৬।


দ্বিতীয় খন্ড

(ষোল)

হ্যাঁ, সময় ছিল ১৯৩২ সনের বসন্তকাল।

স্থান ছিল লেনিনগ্রাড।

লেনিনগ্রাডের সুভোরভ প্রসপেক্টের পাশ দিয়ে নাডিয়া প’পভনা দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার হাতে ছিল একটা বাজারের সাধারণ ব‍্যাগ। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত নেভস্কি প্রসপেক্টে  সে যায়নি। এই পথটির পাশ থেকেই সেই বিকেল পর্যন্ত আসতে চলা অতিথির আধিক্যের জন্য কয়েকটি জিনিস কিনেছিল।

পাথর দিয়ে বাঁধানো পায়ে চলা পথটিতে নাডিয়ার হাঁটার গতিতে তার ২২ বছরের যৌবনের চাঞ্চল্য প্রকাশ পাচ্ছিল। চাঞ্চল্য প্রকাশ পাচ্ছিল প্রতিটি পদক্ষেপে দুলতে থাকা তার ঘি বর্ণের চুলে, তার লাল সাদা চেহারার মুখের অভিব্যক্তিতে এবং তার পাতলা নীল রঙের চোখ জোড়ায়। এই চাঞ্চল্যে অবদান যুগিয়েছিল লেনিনগ্ৰাডের ক্ষনিকের বসন্ত প্রাচুর্য ।

লেনিনগ্রাডের শীতকাল গুলি বেশ দীর্ঘকালীন। সেপ্টেম্বর মাস থেকেই শহরটিতে বেশ ভালো করে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে। অক্টোবর মাস পর্যন্ত ঘরের টুই, উঠোন, পথঘাট এবং গাছের ডাল পাতাগুলি বরফের পাতলা আস্তরণ ঢেকে ফেলতে শুরু করে। ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে কোমল তুলোর মতো তুষারের টুকরোগুলি বৃষ্টির মত নিচে খসে পড়ে তুষারপাত হতে শুরু করে। বাইরে বের হওয়া মানুষগুলির দীর্ঘ ওভার কোটে এবং মাথার টুপিতে  সাদা সাদা তুষারের টুকরো লেগে থাকে। দাড়িওলা মানুষগুলির দাড়ি মোচেও বরফের টুকরো লেগে থাকতে দেখা যায়। সেইসবে ভ্রুক্ষেপ না করে মানুষেরা দীর্ঘ বুট জুতো পরে নতুন করে পড়া বরফের আস্তরণের ওপরে খচখচ শব্দ করে হেঁটে নিজের নিজের কাজ করে যায় ।

সাদা রঙে রূপান্তরিত হওয়া লাইম এবং বার্চ গাছগুলি এপ্রিল মাস পর্যন্ত সহজ এবং সুন্দরভাবে পথের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষ থেকে বরফ গলতে শুরু করে। বরফের ফাঁকে ফাঁকে গজে উঠে স্নোড্রপ গুলি। মে মাসের মধ্যে নতুন নতুন পাতা বেরিয়ে জুন মাসে সবুজ পাতায় গাছগুলি ঝকমক করতে থাকে। এখানে সেখানে থাকা বাগানগুলিতে ঋতুকালীন ফুলের প্রাচুর্যে রঙ্গিন হয়ে উঠে। লেনিনগ্রাডে বসন্ত নামে।

নাডিয়া উৎসাহের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। শহরটা উষ্ণ সোনালি রোদে উপচে পড়ল। সোয়েটারের ওপরে ফারের কোট আর টুপি পরার প্রয়োজন হয়নি। তাই বুক খোলা একটি রঙিণ সোয়েটার এবং হাঁটুর একটু নিচ পর্যন্ত একটা স্কার্ট পরেছে। পায়ে  পরেছে  ছোট মোজা এবং জুতো।

নাডিয়ার মনে হল শহরের পায়ে চলা পথ এবং এখানে সেখানে থাকা মার্গগুলিতে মানুষের আসা-যাওয়া বেশি হয়েছে। বাগানগুলিতে ফুলে শোভিত সোয়েটার পরা ছোট শিশুদের নিয়ে আজকের এই বন্ধের দিনে পিতা মাতা বা পরিচারিকারা বেরিয়ে এসেছে। কোনো কোনো মহিলার কোলে রয়েছে এক একটি পমেরানিয়ান কুকুর। সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়েছে বসন্তের হাসি।


 আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৫) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


নাডিয়ার  গায়ের পোশাক বাগানে বেড়াতে আসা যুবতিদের তুলনায় কিছুটা নিম্নমানের। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। ওদের রঙচঙে পোশাক এবং রঙিণ মুখ দেখেই তার মনটা রঙে উপচে পড়ল।

 নাডিয়ার বাজার করা হল। তবু সে পায়ে চলা পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। সুদীর্ঘ শীতকালে বরফের আস্তরণ ঘিরে থাকা এই শহরের পায়ে চলা পথ দিয়ে সে বহুদিন হাঁটেনি। তার এমন মনে হল যে পুরো গ্রীষ্মকালটা উদ্দেশ্যহীনভাবে সে শহরটা ঘুরে বেড়াবে।

নাডিয়া শহরটাকে বড় ভালোবাসে। মহান পিটার নেভা নদীর এই ব-দ্বীপের জলাশয়ে অনেক সেতুর সঙ্গে জুড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে একটি নগর স্থাপন করার কথা সে জানে। তারপরে দুশো বছর পর্যন্ত এটা জারদের রাজধানী হয়ে থাকার কথাও সে জানে। মহাযুদ্ধের শুরুতে শহরটার নাম পরিবর্তন করে পেট্রোগ্রাড করা হয়, সঙ্গে গত আট বছর আগে–১৯২৪ সনে– লেনিনের মৃত্যুর পরে শহরটির নাম লেনিনগ্রাডে পরিবর্তিত করার কথা তার অজানা নয়। কিন্তু তার বহু আগে থেকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এখানে বিভিন্ন ঘর- দুয়ার, প্রাসাদ-অট্টালিকা, রাজমহল গড়ে উঠা, শহরের মূল দ্বীপটিতে পিটার এবং পল নামের দুর্গদুটি তৈরি করা তার বেছিলিকাতে অনেক রমানভ জারকে কবর দেবার দুশো বছরের ইতিহাসের কথা সে ইতিহাসের পাতায় পড়েছে।ডিসেমব্রিট মার্গে  তৈরি মহান পিটারের ঘোড়ায়  উঠে থাকা একটি সুউচ্চ প্রস্তর মূর্তি ,এখন যাদুঘর হিসাবে ব্যবহার করা একশো মিটার উঁচু তৈরি বিশাল সোনার কলশ নিয়ে সেন্ট ইজাকের ক‍্যাথেড্রিলটির কথাও সে পড়েছে এবং দেখেছে। শহরের এই সবগুলিই তার  বড় আপন।আপন শহরের অঞ্চলে মনোরম ফোয়ারা তৈরি করে মহান পিটার  তৈরি করা তাঁদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদটা এবং জারিনা  ক্যাথারিনের দিনে তৈরি শেষ হওয়া শীত প্রাসাদটা। কতদিন হয়েছে? পনেরো বছর? নাডিয়া ভাবল – হ‍্যাঁ, পনেরো বছর। পনেরো  বছর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯১৭ সনের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই শীত প্রাসাদটিতেই  জার দ্বিতীয় নিকোলাস বাস করতেন।

নাডিয়া পায়ে চলা পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। তার দ্রুত চলার বেগেই  শহরের অন্য ভালোলাগা জিনিসের ছবি গুলি তার চোখের সামনে দিয়ে পার হয়ে গেল। পার হয়ে গেল নেভা এসপ্ল্যানেড এবং মার্চোভো, পার হয়ে গেল পাথরে বাঁধানো নদী এবং প্রণালীর তীরগুলি, সেখানে থাকা লোহার রেলিং এবং পাশের পাথরের পায়ে চলা পথগুলি।

  নাডিয়া এবার ওখটিনস্কি সেতু পার হল। তার মুখে লাগল মধুর বাতাস এবং শীতলতা। সে সতেজ হয়ে পড়ল এবং দ্রুত গতিতে সে কিছুটা রাস্তা এগিয়ে গেল।

নাডিয়ার মনে পড়ল শৈশব থেকে দেখে আসা কামেনি, আপটেকারস্কি দ্বীপ থেকে গ্রীষ্মকালে আকর্ষণীয় কাপড় পরে  আসা ধনী মানুষগুলির  কথা। পারগ’ল’ভ ডিপির সম্ভ্রান্ত মানুষগুলি এবং ক্রেস্টভস্কি দ্বীপের বিমর্ষ  বদনের মানুষগুলির কথা। সপ্তাহের শেষে পুশকিন নাটঘরে কখনও এই মফস্বলের মানুষ গুলি এসে ভিড় করে।। শীতের দিনে এই মানুষগুলি পরে আসে ফারের নোঙরা কোট। ওরা সেগুন কাঠের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রেখে নাট ঘরের ওপর মহলে প্রবেশ করে । কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলা অপেরা দেখা ভাঁজ না করা দূরবীন সঙ্গে নিয়ে আসে এবং তার মাধ্যমে উঁকি দিয়ে দিয়ে অপেরা দেখে। সঙ্গের পুরুষরা কখনও বাইরে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু সময়ের জন্য সিগারেট খায় এবং অন্য ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে। তারপরে এসে কোনো পরিচিত মহিলা দেখলে কিছুটা হেলে অভিবাদন করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে। নাটক বা অপেরার শেষে কিছু মানুষ অপেক্ষা করে থাকা ঘোড়ার গাড়িতে বা শ্লেজ গাড়িতে উঠে ফিরে যায়।

আজকাল ঘোড়ার গাড়ি কম দেখতে পাওয়া যায়। শহরের মধ্য দিয়ে শীতের দিনে ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়ি চলার দিন যেন ধীরে ধীরে কমে আসছিল। এখন আসা যাওয়া করার জন্য ট্রামের প্রচলন হয়েছে। দূরের যাত্রার জন্য রেল সেবা আরম্ভ হয়েছে। সরকারি কার্যালয়ে হালকা ভাবে হলেও মোটরগাড়ির ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং কিছু লোক বাই সাইকেলও কিনে নিয়েছে।

নাডিয়া আরও কিছুদূর পায়ে হেঁটে গেল এবং তারপরে হাতে কয়েক কোপেক মুদ্রা নিয়ে একটা ট্রামে উঠল। সিঁড়ির আশপাশে গজিয়ে ওঠা বসন্তের বনানীর ওপর দিয়ে ট্রামটা  চলতে লাগল।

ট্রামে  উঠলেই তার মনে পড়ে লেনিনের কথা।১৯১৭ সনের ২৪ অক্টোবর তিনি যখন গোপন স্থান থেকে এই শহরের স্মলনি ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন,তখন বটকিনস্কায়া গলি পর্যন্ত তিনি ট্রামে এসেছিলেন। তারপরে টিনেইনি সেতু পার হয়ে পায়ে হেঁটে এসে রাত এগারোটার সময় শিক্ষা কেন্দ্রটিতে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে ২৫  অক্টোবরের বিকেলবেলা তিনি সমবেত গ্যারিসন এবং নৌবহরের সেনা প্রতিনিধিদের সামনে ভাষণ দিয়েছিলেন। তখন নাডিয়া ছিল সাত বছরের কিশোরী। সে এই কথাগুলি শুনে ছিল এবং শুধুমাত্র মায়ের  মুখেই নয় সবার মুখেই আনন্দের উচ্ছ্বাস দেখতে পেয়েছিল।

নাডিয়া এক জায়গায় নেমে পড়ল। সে বাড়ি পৌঁছাতে এখনও প্রায় দুই মাইল পথ বাকি আছে। সে বাজারের ব্যাগটা ডান হাতে নিয়ে মূল পথটি থেকে ধুলায় ধুসরিত ছোট একটা পথ দিয়ে নেমে হাঁটতে শুরু করল । 

রাস্তাটাতে বসতি কম। যে দুই এক ঘর হালকাভাবে রয়েছে সেই সবও কাঠের। পাথর বা ইটের দেওয়াল দিয়ে বাড়ি তৈরি করার মতো মানুষগুলির সামর্থ্য নেই। দাদু আর মায়ের মতে বাড়িগুলি নাকি একশো  বছর আগের ভূমি দাসদের ঘরের মতো । পার্থক্য কেবল কাচ লাগানো জানালাগুলির মধ্যে। একশো বছর আগে ভূমি দাসদের ঘরে কাচ লাগানোর সামর্থ‍্য  ছিলনা।

নাডিয়াদের ঘরটা এই সমস্ত ঘর থেকে উন্নত নয়। ওদের ঘরে কেবল ওপর মহলে একটা এটিক আছে। তাছাড়া ওদের ঘরের চৌহদে একটা কাঠের বেড়া আছে। সঙ্গে আছে মেটে বর্ণের  একটি দরজা। বেড়াটা মাঝেমধ্যে হেলে পড়েছে। বেড়াটা ঘিরে রেখেছে করবী এবং মিনিয়নেট ফুলের একটি ছোট ফুলের বাগান। সেখানে কখনও অরিয়ল পাখি উড়ে বেড়ায়।

নাডিয়া যেতে থাকা পথের সমান্তরালভাবে গিয়েছে টেলিগ্রাফের তার। সেইসব ঝুলিয়ে টেনে রাখা ফাঁপা ধাতুর খুঁটিগুলি থেকে গুণগুণ শব্দ ভেসে আসছে।

পথটির দুপাশে রয়েছে বিভিন্ন মাঠ। সেখানে আলু টমেটো ছাড়া ঘাস যোগদান করায় ইত্যাদি বিভিন্ন শস‍্য হয়েছে। আশেপাশে সুন্দর সুন্দর বন‍্য ফুল ফুটেছে। কোথাও বা দুই একটি লাইলাক ফুলও   দেখা যাচ্ছে । ধীরে ধীরে জ্বলজ্বল করছে সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ হতে চলা উঁচু উঁচু একেকটি সাইপ্রাস এবং তাল জাতীয় গাছ। দূরে- অনেক দূরে হয়তো একটি কারখানা আছে। তার ঘরগুলি ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার চিমনি থেকে বের হওয়া কালো রঙের ধোঁয়ার রেখা আকাশে উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।

পথের ওপাশ থেকে টুপি পরা একটি যুবক আসছিল। সে তার পিঠে একটা বস্তা বহন করে দুই হাতে কাঁধের উপরে ধরে রেখেছিল। সে বস্তার ভারে বোধ হয় কিছুটা কুঁজো হয়ে পড়েছিল এবং তার ভারী বুট জুতা পায়ে হেঁটে আসার সময় ধুলো উড়ছিল। তথাপি তার মুখে শিস ধ্বনিতে মাতাল সংগীত শোনা যাচ্ছিল।

নাডিয়া যুবক ছেলেটিকে দূর থেকেই চিনতে পারল। সে আর কেউ নয় সমনভ মুচির ছেলে গ্ৰেবিল’ভ। সে নিশ্চয় শহরে জুতোর জোগান  দেওয়ার জন্য এক বস্তা বহন করে এনেছে এবং এতদিন শীতকালের বরফের আস্তরণে ভিজে থাকা পথটার মাটিটুকু বসন্তের রোদে ধুলোয় ধূসরিত হয়ে  পড়তে দেখে সে তার বিশাল বুট জুতোগুলিতে ধুলো উড়িয়ে আসছে।

নাডিয়াকে দেখে সে শিস বাজানো ছেড়ে দিল। তারপর ইতস্তত করে বলল–’ বড় সুন্দর আবহাওয়া , নয় কি নাডিয়া? কোথা থেকে এলে?’

গ্ৰেবিলভ বয়সে তার চেয়ে বড়। তার নাডিয়ার প্রতি কিছুটা অনুকম্পা থাকলেও সমীহ করে।মনের ভাব একেবারেই প্রকাশ করতে পারে না।

নাডিয়া তার কথা শুনে হেসে বলল – বড় সুন্দর আবহাওয়া । একটু বাজার করে আনলাম ।’

সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল – জুতো এনেছিস নাকি শহরে ?’

গ্ৰেবিল’ভ সায় দিল।  তার পরে আসা পুরোনো কোটটার পিঠের কোঁচগুলি ঠিক করার জন্য বস্তাটা একটু নামিয়ে পুনরায় নিল এবং মাথার টুপিটা ঠিক করে পুনরায় একই পদক্ষেপে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার মুখে শিস ধ্বনি শোনা গেল না। 

নাডিয়ারা গ্ৰেভিল’ভদের পরিবারের কাছে ঋণী। নাডিয়ার পিতা প’পভ ভেসিলিয়েভের মহাযুদ্ধে মৃত্যু হওয়ার পরে বাড়ির আর্থিক অবস্থা বড় শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুর আগেই যেন এই মাটিতে বাপ কাঠের ঘরটা তৈরি করে গিয়েছিল– এই আর কি। নাডিয়ার মা মাছা রমান’ভনাই ওদের ঘরের এটিকেট দুই বছর পর্যন্ত কয়েকটি রুবলের বিনিময়ে একজন যুবককে ভাড়া দিয়েছিল। ইতিমধ্যে ছমন’ভ মুচি মাছা রমান’ভনাককে  একটি চামড়ার উদ্যোগে কাজ জোগাড় করে দেওয়া থেকে ওদের আর্থিক অবস্থাটা জোড়াতালি দিয়ে চলার মতো হয়ে পড়েছিল। সেই জন্যই মাছা রমান’ভনা গ্ৰেভিলভের পিতার বদান্যতার কথা মাঝেমধ্যে নাডিয়াদের কাছে বলত।

নাডিয়া এবং তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় দাদা মিখাইল বড় হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মা মাছা রমান’ভনার চামড়ার উদ্যোগের কাজটার বিষয়ে আপত্তি করতে লাগল। গায়ে লেগে থাকা চামডার গন্ধের কথা বলে বলে ওরা বলল–’মা, গন্ধটা ভালো লাগেনা। কাজটা ছেড়ে দাও।’– এরকম কথা শুনলেই প্রথম অবস্থায় মাছা রমান’ভনা হাসতে শুরু করেছিল । চামড়ার  উদ্যোগ থেকে আসার সময় পরে আসা কাপড় বদলে ভালোভাবে হাত ধুয়ে রাতের আহার   রান্না করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভাবে খাবার সাজিয়ে দিয়েছিল। কেননা এদের দুজনের বাইরে তাঁর আপন মানুষ বলতে আশেপাশে আর কেউ ছিল না । 

ছয়দিনের রেলযাত্রার পরেও একদিনের নৌকায় যাত্রা করার দূরত্বে থাকা আপন মানুষের বাড়িতে সম্ম্পূর্ণ  পরিবারকে নিয়ে যাবার মতো তার আর্থিক সামর্থ‍্য  ছিলনা । তাছাড়া বহুদিন দূরে থাকা অঞ্চলটিতে এখন কে কোথায় আছে সেই বিষয়েও সন্দেহ ছিল। তাই নাডিয়াদের  আপত্তি শোনার পরে সে গম্ভীর হয়ে পড়েছিল এবং কথাটা ভালোভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছিল।

মাছা রমান’ভনার স্বামী প’পভ ভেসিলিয়েভের পূর্বপুরুষ ছিল ইনিছি নদীর তীরের। প্রথম পিটার করা সংস্কারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তার প্রপিতামহ ভেসিলিবুগের এবং তাঁর সঙ্গীরা পাণ্ডববর্জিত লেনা নদীর কাছে মুক্ত করে রেখে যাওয়া পথ অনুসরণ করে এসে উষ্টকূট অঞ্চলে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেছিল । ১৮৬১ সনে সামন্তবাদের ভূমিদাস প্রথা উঠে গেলেও চাষাদের অবস্থার উন্নতি হয়নি এবং শীতকালে চারপাশে পড়া বরফের প্রকোপে মানুষগুলির দুরবস্থার অন্ত ছিল না। কিন্তু সেই হিসেবে নাডিয়ার দাদু নিজের অবস্থার কিছুটা উন্নতি করেছিল। সেই সময় লেনা নদীতে বসন্ত এবং গ্রীষ্মের বরফহীন সংক্ষিপ্ত সময়ে অষ্টকূট অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে নদীর পাড়ের দুটো জায়গা ব্যাপারীদের আগমন এবং কলরবে তোলপাড় লেগে গিয়েছিল । নদীর বুকে ভেড়ার ছাল বা শিয়ালের বড় নোংরা কোট পরে আসা উত্তর অঞ্চলের মানুষগুলি এসে সারি সারি নৌকা বেঁধেছিল। ব্যাপারীদের ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠেছিল। নৌকাগুলিতে ব্যবহারিক  সামগ্রীর ভারী সম্ভারে বোঝাই করে নদীর বুক বরফে আবৃত হওয়ার আগেই মানুষগুলি দ্রুত উত্তরমুখী হয়ে সাইবেরিয়ার তৃণমূলের উদ্দেশ্যে নৌকা মেলে দিয়েছিল। কিছু লোক আবার উত্তর মহা সাগরের মোহনা অঞ্চল পর্যন্ত সাত-আট মাসের খোরাক নিয়ে গিয়েছিল।

পপ’ভ ভেসিলিয়েভ যখন যুবক ছিলেন ব্যাপারীরা ব্যবসা নিয়ে বসলেই প্রথম দেখা মানুষগুলো ঘোড়ায় উঠে চিৎকার করে করে বেপারী আসার খবর পাশের গ্রামগুলিতে জানিয়ে দেবার জন্য ঘুরে বেড়াত। সেই সময় তিনি লেনা নদীর তীরে কয়েকবার গিয়েছিলেন।তিনি একবার লেনা নদীর ঠান্ডা জলে পড়ে ভেসে যাওয়া মূল্যবান একটা বস্তু সাঁতার দিয়ে গিয়ে উদ্ধার করার জন্য জিনিসটার মালিক ধনী বেপারী একজন তাকে সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে এসেছিল এবং বাল্টিক নৌবহরের নাবিকের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলং। সেই চাকরিতে ঢোকার সময় মাছাকে বের করে সেন্ট পিটার্সবার্গের পাশের এই অঞ্চলটিতে  মাটি কিনে কাঠের  বাড়িটা তৈরি করেছিল।

মহাসমরে প,পভ ভেশিলিয়েভের মৃত্যু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নাডিয়ার মা মাছা রমান’ভনা ছেলে মেয়ে দুটিকে নিয়ে অসুবিধায় পড়লেন। গ্রেবিল’ভের পিতা ছমনভ মুচি যদিও চামড়ার উদ্যোগের কাজে তাকে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটি বড় হয়েই মায়ের  চামড়ার কাজে আপত্তি করতে লাগল। মাছা রমান’ভনা কথাটা চিন্তা করে আশেপাশের দু’একজনকে কথাটা বলেছিলেন, বুড়ো দর্জি খুড্রিকভ তাকে একটি বেকারির কাজের খবর দিলেন। এখন তিনি সেই বেকারিটিতেই  কাজ করেন ।‌ বাড়িতে এলে দুটো করে গরম পাউরুটি নিয়ে আসাই নয় নিয়ে আসে বেকারির সুগন্ধি সুরভি।‌ সেই জন্যই মা কাজ থেকে বিকেলবেলা ফিরে এলে মিখাইল এবং নাডিয়ার নাক মুখ কুঁচকানো অঙ্গভঙ্গি নাই হয়ে গেল । ওদের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল।

নাডিয়া ওদের ঘরের প্রায় কাছাকাছি এসে পৌছাল। দু পাশে থাকা আলু,রাই, বার্লি আর গমের বিস্তৃত মুক্তমাঠ সে পার হয়ে এল। দূর থেকেই ওদের ঘরের চৌহদে   থাকা হেলেপড়া কাঠের বেড়াটি এবং ঘরের এটিকটা দেখল। অন্য একদিকে চোখে পড়ল ধোঁয়া বের হতে থাকা চিমনির দীর্ঘ চুঙাটা। মা নিশ্চয় ফিরে এসেছে, সে ভাবল।

তখনই হঠাৎ সে দর্জি খুড্রিকভের নাতি ডিমভের কথা শুনতে পেল – দিদি নাডিয়া, বাজার করলে নাকি?’ 

দশ বছরের ডিমভ কোথাও থেকে ঘোরাঘুরি করে দৌড়াদৌড়ি করে চাকা চালিয়ে আসছিল। সে নাডিয়ার  কাছে পৌঁছে নাডিয়াকে  ডেকেছিল। নাডিয়া তার দিকে তাকাতে দেখে সেই চাকাটায় এক হাত ঢুকিয়ে তার কাঁধের প্যান্টের গার্লিছটার  কাছে উঠিয়ে নিল এবং নাডিয়ার কথার উত্তর পাওয়ার আগেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল–’ দাও দিদি, ব্যাগটা আমাকে দাও। তোমার হয়তো ক্লান্ত লাগছে।’

নাডিয়া তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–’ দুষ্টু কোথাকার কার ক্লান্ত লাগছে– তোর না আমার?’

ডিমভ  হাসল। তারপরে বলল–’ ইস দিদি, আমার আবার কিসের ক্লান্তি। এখনও পাঁচ মাইল  পথ দৌড়াতে পারব। দাও ব্যাগটা  দাও।’– সে হাত এগিয়ে দিল।

‘ যা দুষ্ট। তুই চাকা চালা। আমি এটা নিতে পারব।’

‘ সত্যিই কি? তাহলে আমি যাই।’

‘ যা।’– কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে পুনরায় বলল–’ বিকেলে একবার আসিস। ঘরে যদি অতিথি থাকে দেওয়ালের পাশে পাখির সুরে শিস বাজাবি – বুঝেছিস?’

ডিমভ   আনন্দিত মনে চাকাটা নামালো এবং চালাতে চালাতে দৌড়ে চলে গেল ।

কিছুক্ষণ পরে নাডিয়া দূর থেকে দেখতে পেল সে এক জায়গায় চাকাটা রেখে পথের পাশ দিয়ে নেমে গিয়ে টেলিগ্রাফের ধাতুর একটা খুঁটিতে কান দিয়ে কিছুক্ষন গুণগুণ আওয়াজ শুনছে আর পুনরায় চাকা চালিয়ে চলে গেছে ।

নাডিয়া ঘরের কাছে পৌঁছে গেল । কাঠের মেটে রঙের দরজা খুলে ঢুকে যাবার আগে সে দেখল ওপাশ থেকে একজন মানুষ বাইসাইকেল চালিয়ে আসছে । মানুষটার কোট-পাতলুন, জুতো এবং মাথার টুপিটা কোনো একজন কমরেডের মতো। তাঁর কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে বুকের ওপর দিয়ে পার করে ডান দিকে ঝুলিয়ে আনা চামড়ার চকচকে ব্যাগটা  সে যে সরকারি মানুষ সে কথাটা নাডিয়াকে বুঝিয়ে দিল। সেই চামড়ার ব্যাগটাতে রয়েছে সরকারি কাগজপত্র।

মানুষটা সাইকেল থেকে নাডিয়ার দিকে তাকাল। তারপর বাড়িটার দিকে তাকাল। তিনি থামলেন না । সাইকেলটা চালিয়ে চালিয়ে শহরের দিকে যেতে লাগলেন ।

বাড়িতে ঢুকেই নাডিয়া দেখল মা মাছা রমানভ’না ইতিমধ্যে বেকারির কাজ থেকে ফিরে এসেছে এবং দ্রুত রান্নাঘরে ঢুকে খড়ির উনুন জ্বালিয়ে দুপুরের আহার তৈরি করায় লেগে পড়েছে।

নাডিয়া বাজারের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে হাত দুটি মুছে নিল তারপর মায়ের স্বাস্থ্যবান দেহের পেছনে দাঁড়াল এবং দুটো কাঁধে  দুটো হাত রেখে কাঁধের একপাশে মাথাটা সরিয়ে উনুনে উতলাতে থাকা তরকারির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল – মা আজ কি রেঁধেছ ?’

যুবতি মেয়ের শিশুসুলভ আচরণে মাছা রমানভ’নার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে বলল – ‘শুয়োরের মাংস , সঙ্গে আছে পাউরুটি আর আচার ।’

নাডিয়া তার গালটা মায়ের গালের  সঙ্গে লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল–’ ও, বেশ মজা হবে। আজ আমিও কেভিয়ার এনেছি’

মা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করল। কেভিয়ার নামে এই সাগরের মাছের ডিম বেশ দামী । সে মেয়ের দিকে তাকাল এবং সেই বিষয়ে কিছুই না বলে সে জিজ্ঞেস করল আর কী কী এনেছ?’ 

নাডিয়া উৎসাহের সঙ্গে বলল–’ আমিও দুই ধরনের আচার এনেছি। টম‍্যাটো এবং শশা এনেছি। কিন্তু আবহাওয়া এবং মানুষ গুলির রং দেখে কেভিয়ার ও  এনে ফেললাম। লোক আসবে তো।’

নাডিয়াদের আহার ওদের স্থানীয় কৃষকদের খাদ্যের চেয়ে আলাদা নয়, রুটি ,রাশিয়ান পানীয় কভাছ এবং পনরু। কখনও ময়দার সঙ্গে লুথুরি এবং মাংস । সার্ডিন মাছ ,কেভিয়ার ইত্যাদি ওদের কাছে বহু মূল্যবান। তাই কেভিয়ার কেনার জন্য মায়ের কোন উচ্ছ্বাস না দেখে সে জিজ্ঞেস করল – খরচ একটু বেশি হল। তুমি খারাপ পেলে নাকি?’ 

সকালের আহার রেঁধে সেই ভোরবেলাতেই বেকারির কাজে বেরিয়ে যাওয়া মাছা রমানভ’না অতিথি আসবে বলে জানত না। সে যাবার সময় মিখাইল বিছানায় ছিল । নাডিয়া উঠেছিল । মিখাইল উঠে সকালের আহার খাওয়ার সময় সে নাডিয়াকে বলেছিল – বিকেল পর্যন্ত কয়েকজন মানুষ আসার কথা আছে।লিঅ’নিড আসবে। পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় আসবেন । তার সঙ্গে আসবে অন্য দু’জন মানুষ । দু একটা খাবারের জিনিস কিনে আনবে নাকি?’

লিঅ’নিড এডলার নাডিয়ার পরিচিত। সে তার দাদা মিখাইল প’পভিছ ভেসিলিয়েভের সমবয়সী এবং সরকারি গণআদালতের কর্মচারী। যুবকটি মাঝেমধ্যে দাদার সঙ্গে দাবা খেলতে আসে। অন্যদিকে পিটার যেলেনক’ভ বয়স্ক। আধ পাকা মুখভর্তি দীর্ঘ দাড়ির এই মানুষটি কথাবার্তায় ধীর। ওদের পরিচিত মানুষের মধ্যে তিনিই মানী এবং শহরের এক ধরনের মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়।

নাডিয়া হাই স্কুলের গন্ডি পার করার পরে একজন বান্ধবীর সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষা শিখেছে। আজ বন্ধের দিন বলে অতিথির জন্য দুই এক পদ জিনিস কেনার জন্য বেরিয়ে যাবার সুবিধা পেয়েছে ।

মা মাছা রমানভ’না ইতিমধ্যে অতিথির কথা জানতে পেরেছিল । তিনি বাড়ি ফিরে আসার সময় মিখাইল কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় পথে দেখা হওয়া মাকে অতিথির কথা বলে গিয়েছিল।

মেয়ে নাডিয়া দামি জিনিস কিনে আনার জন্য মনে মনে খারাপ পেল যদিও তিনি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন–’ খারাপ পাই নি রে মা। কেভিয়ার তো আমরা বহুদিন খাই নি ।’

মায়ের কথা শুনে আশ্বস্ত হওয়া নাডিয়া জিজ্ঞেস করল–’ বল,আমি কি করব– বল।’

দুপুরের খাওয়ার পরে মিখাইল বের হল। সে মুখ হাত ধুয়ে খেতে বসার আগে হাত মুছতে মুছতে বলল–’লিঅ’নিড তাড়াতাড়ি আসবে। সে বলেছে পিটার যেলেনক’ভ মহাশয়ের দেরি হয় নাকি? সঙ্গের মানুষগুলির জন্য।’

নাডিয়া কিছু বলল না। মাকে বলল–’ এখন খেয়ে নাও তো। যেলেনকভ মহাশয় আর কি বলবেন? টলস্টয়ের কথাই বলবেন।’, নাডিয়া জানে পিটার যেলেনকভ মহাশয় টলস্টয়বাদী একটা সংগঠনে যোগ দিয়েছে। সংগঠনটি মস্কোতে প্রথম গঠিত হয়েছে। লেনিনগ্রাডে  থাকা তার শাখার তিনি সংগঠক। তিনি এলেই ভালো খারাপ খবরের পরে মহান লেখক টলস্টয়ের কথা উত্থাপন করেন। তার জীবনের কথা বলেন। তার গল্প উপন্যাসের কথা উত্থাপন করেন। আর উত্থাপন করেন তিনি নানা সময়ে লেখা প্রবন্ধ এবং রচনাগুলির তাৎপর্যের কথা, সমাজ বিশ্লেষণের কথা। তিনি বড় অমায়িক ভাবে কথা বলেন এবং আধাপাকা দীর্ঘ দাড়িতে মাঝে মাঝে তিনি হাত বোলান।

নাডিয়া বই পড়তে ভালোবাসে। রুশ ভাষার বেশ কিছু বই সে পড়েছে। আর ইতিমধ্যে ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষা শিখে থাকার জন্য তার সাহিত্যের শিক্ষক কয়েকজন সেই ভাষাগুলির কয়েকটি গল্পের আভাস দেবার জন্য সে বেশ আমোদ পেয়েছে। টলস্টয়ের  গল্প পড়েও তার ভালো লেগেছে । তাই পিটার যেলেনক’ভ মহাশয়ের  কথা শুনে সে রস  পায়। তাই ঘরের একপাশে একটা টুলে বসে মানুষগুলির কথা শুনে থাকে।

দুপুরের আহার খাওয়ার অল্প পরে সাইকেলে উঠে লিঅ’নিড এডলার  বের হলেন। সে মেটে রঙের দরজাটা খুলে বাইসাইকেলটা দেওয়ালের ভেতর দিকে হেলান দিয়ে রাখলেন।

লিঅ’নিড মিখাইলের মনে আর আনন্দ ধরে না।

সে দাবা খেলার একজন সঙ্গী পায়। ওরা দুজনেই চুপ করে দাবার ঘরটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে । অনেক চিন্তা ভাবনা করে অনেকক্ষণ পরে চাল দেয়। এভাবেই ওদের একবেলা পার হয়ে যায়। পরে যাবার মুহূর্তে দুজনের মুখে প্রায়ই সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠে। কচ্চিৎ কখনও কারও বিমর্ষ হয়ে পড়া মুখে চিন্তার বলিরেখা ছড়িয়ে পড়তে নাডিয়া দেখতে পায় ।

লিঅ’নিড এলে মা মাছা রমানভ’নার মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়ে । মা হয়তো সেই গণ-আদালতের সুদর্শন আমলা লিঅ’নিড এডলারকে নিয়ে মনে মনে অনেক আশা পোষণ করে রাখে । নাদিয়াকে মাঝে মধ্যে বলে– যা তো– ছেলেটিকে এক কাপ কফি দিয়ে আয়। 

নাডিয়ারও লিঅ’নিডকে ভালোই লাগে । কিন্তু সে এত লাজুক  তার সঙ্গে সে কথাই বলে না । তাছাড়া দাদা মিথাইলের সঙ্গে দাবা খেলায় বসলে আর রক্ষা নেই । শীতের দিনে সে ওদের দাবা খেলার টেবিলের সামনে থাকা চিমনি দিয়ে রান্না ঘরের উনুনে আগুন ভালো করে জ্বালিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতায় লিঅ’নিড খেলার মধ্যেই কখনও তার দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে শুধু মুচকি হাসে।

আজও তাই হল। মিখাইলরা দাবা খেলায় বসল। কফি ঢেলে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। লোকজন আসবে বলে ঘরটাকে আগেই সাজানো হয়েছিল। তাই মায়ের সঙ্গে সে দু’একটি কথা বলে নিল। কিন্তু মা ও উল বোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।’ বসন্তকালেই স্লেজগাড়ি তৈরি করে রাখতে হয়’ এই প্রবাদ বাক্যটা মাঝেমধ্যে বলে–’ গরমকালে শীতের উষ্ণ কাপড় ঠিক করে রাখতে হয়।’

নাডিয়া কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এটিকে গেল। এটিকেই তার শোবার এবং পড়ার ঘর। তার কাছের একটা জানলার দিকে ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া ধুলোয় ধূসরিত পথটির দিকে সে তাকাল। গুনগুন করতে থাকা ধাতুর ফাঁপা খুঁটিগুলির ওপর দিয়ে তারগুলি অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছে। পথের দুপাশে চাষের জমি দেখা যাচ্ছে। পাশে থাকা দুই একটি বন‍্য ফুলও দেখা যাচ্ছে। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় ততদূর পর্যন্ত সে একবার উঁকি দিয়ে দেখল। মূল্যহীন কথাবার্তা বলে সময় কাটানোর জন্য ডিমভটা এখনও পর্যন্ত এল না।

সে বারদুয়েক ফরাসি ভাষার একটা বই পড়ার চেষ্টা করল। পারল না।

পাখির মতো ডিমভের শিশধ্বনি শোনার জন্য  নাডিয়ার সময় লাগল। কথা শুনে জানলা দিয়ে উঁকি দিকে তাকাল। দেখল দুষ্টু ডিমভ কাঠের নির্জন দেওয়ালের মধ্য দিয়ে মুখের দুই পাশ হাত দিয়ে ঢেকে উঁকি দিয়ে দিয়ে শিস বাজাচ্ছে। তার মাথাটা ঢুকিয়ে মিনিয়নেট ফুল স্পর্শ করার মতো হয়েছে ।

‘ দাঁড়া ,মজাটা দেব।’- বলে নাডিয়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল এবং কয়েক টুকরো রুটির মধ্যে কেভিয়ার এবং আচার ভরিয়ে কাগজে মুড়ে তার দীর্ঘ স্কার্টের পকেটে ভরিয়ে নিল এবং বাইরে বেরিয়ে গেল।

মা উল বোনা থেকে চোখটা ওপরের দিকে তুলে একবার মাত্র মুচকি হাসল।

কাঠের দরজা পার হয়ে নাডিয়া ডিমককে ধমক দিল–’ এই তোর মাথাটা দেখছি ভেতরে চলে গেছে। তোকে কেউ পাখি বলে ভাববে কি? আয়– এদিকে আয়।’

নাডিয়া তার সঙ্গে কিছুদূর গিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরল এবং কয়েকটা গাছের নিচে গেল। গাছগুলির নিচে কিছুটা মুক্ত ঘাস। তাতে ওরা দুইজন বসল। তারপরে সে এটা-ওটা কথার মধ্যে তাকে শহরে দেখে আসা কথাগুলি বলতে লাগল। ডিমভ অবাক হয়ে কথাগুলি শুনল এবং মাঝেমধ্যে দু’একটি প্রশ্ন করল। সে একবারই ট্রামে উঠে শহরের মাঝখানে গিয়েছিল বলে আফসোস করল। তারপরে নাডিয়া যখন তার স্কার্টের পকেট থেকে কেভিয়ার এবং জেলি দিয়ে মাখানো রুটি বের করে দিল ডিমভের চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘ কেভিয়ার?’– সে বলল।

সে কেভিয়ারের নাম শুনেছে কিন্তু কখনও খায়নি। সে খাবার আগে ঢোক গিলল।

ডিমভের খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই গ্রেবিলভের শিসের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। সে দোকানে জুতো  জমা দিয়ে শহর থেকে ফিরে এসেছে এবং বাড়ির উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তার চোখে পড়ায় ডিমভ চিৎকার করে উঠল–’ দাদা গ্ৰেবিলভ। এসো রুটি কেভিয়ার খেয়ে যাও। নাডিয়া দিদি  এনেছে।’

গ্রেভিল’ভ স্বাভাবিক সংকোচবশত দাঁড়িয়ে রইল।

‘ এসো, এসো।’– নাডিয়া তাকে সহজ করার জন্য বলল। এখনও দু টুকরো আছে। খেয়ে যাও।’

গ্ৰেবিল’ভ অবাধ্য হতে পারল না। সে এসে তার খালি বস্তাটা পাশে রেখে বসে  পড়ল এবং হাতদুটো মুছে নাডিয়া দেওয়া রুটি হাতে নিয়ে বলল–’ তোমাদের বাড়িতে দেখছি দুটো সাইকেল। অতিথি এসেছে বোধহয় তাই না?’

‘ হ্যাঁ’- নাডিয়া লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল–’ অতিথি এসে গেছে। তোরা খা–।’

দ্রুত ঘরে ফিরে এসে নাডিয়া অবাক হল। ওদের বাড়িতে কচ্চিৎ  আসা  সমনভ মুচি অন্য দু’জন মানুষের সঙ্গে ঘরের এককোণে  কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মানুষ দুটির দুজনেরই জুতোয় ধুলোর আস্তরণ। ভেতরের চেয়ারটাতে অপরিচিত অতিথি দুজনের সঙ্গে পিটার যেলেনকভ , মস্কোর ভাডিমি ভেলিস্ক, মিখাইল এবং লিঅ’নিড বসে আছে।পিটার যেলেনকভের হাতে রয়েছে একটা সরকারি কাগজ। তাতে লেখা সংক্ষিপ্ত কথাটা তিনি বারবার পড়ছেন। অন্য সবাই চুপ করে বসে আছে। মিখাইল কুঁজো মুচিটার সঙ্গের মানুষ দুটির দিকে দুবার মাথা ঘুরিয়ে দেখছে । তার দৃষ্টি সরল নয় । চিন্তান্বিত ।

সেই নীরব এবং গহীন পরিবেশে ঘরের চিমনিটার ভেতরে বাইরে থেকে বয়ে চলা বাতাসের শো শো ধ্বনি জোরে শোনা যাচ্ছে ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত