| 10 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৮) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-১৮।


হ্যাঁ, নাডিয়া প’পভনার ভুল হয়নি।

পিটার যেলেনক’ভ চিঠিটা পড়ে থাকার সময় কোনো সংকটের আশঙ্কা করে প্রত্যেকেই তার দিকে  আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়েছিল। তাকে কিছুটা চিন্তান্বিত এবং অস্থির দেখা গেল । চিঠিটা পড়ার পরেও তিনি কিছু সময় মৌন হয়ে থাকায় সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। চিঠিটা  ধরে থেকে কিছুক্ষণ পরে তিনি অন্য হাতে আধপাকা দীর্ঘ দাড়িতে দুবার হাত বুলালেন এবং তারপরে বলতে লাগলেন–’ চিঠিটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কার্যালয় থেকে এসেছে। ‘

তিনি ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা চমনভ মুচির  পাশে মানুষ দুটির দিকে তাকিয়েজিজ্ঞেস করলেন–’ তোদের মধ্যে ভেসিলি কে?’

কুঁজো চমনভ মুচির পাশে ধুলোর আস্তরণ পরা জুতো পড়েদাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ বললেন–’ আমি।’

‘ তোরা কোন দিকের?’

‘আমাদের অঞ্চলটা ভেতরে। প্রায় নয়  মাইল দূরে।’ মানুষটা বললেন।

পিটার যেলেনকভমহাশয় তার কাছে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন–’ ভেসিলিদের অনেক মাটি আছে। এই চিঠিটার  মর্মে তাকে জানানো হচ্ছে যে তার মাটিতে সমবায় কৃষি পামবসানো হবে। সেই জন্য তাদের জমি থেকে উঠতে হবে এবং মাটিটা সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। তার জন্য ওদেরকে তিন মাস সময়দেওয়াহয়েছে।

পিটার যেলেনক’ভ চিঠিটা  ভ্লাদিমির ভেলিস্কের  হাতে তুলে দিল। তারমধ্যেকমরেড বলে সম্বোধন করে লেখা কথাটার বক্তব্য হল এই ধরনের– ১৯২৮ সনের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুসারে আমরা পশু, কৃষি এবং উদ্যোগের সমবায় গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছি। তারমধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বত্ব থাকবে না। যৌথ পামগুলি রাজ্যের সম্পত্তি হবে এবং রাজ্য পরিচালনা করবে। এখন আপনাদের দখলে থাকা জমিটুকুসমবায় ভিত্তিতে স্থাপন করার জন্য কৃষিপামের জন্য রাজ্য গ্রহণ করবে। তাই তিন মাসের মধ্যে জমিটাফিরিয়ে দিতে হবে।

কথাটা সবাইকে বোঝানোর জন্য তিনি মিখাইলকে চিঠিটা পড়ে শোনাতে বললেন। মিখাইল পড়ে উঠার পরে ভেসিলি বলে উঠল–’ মহাশয়গন. ভূমিদাস প্রথা উঠে যাবার পরে গত তিন পুরুষ ধরে আমরা নিজে জমিতে চাষ করে আসছি। আমাদের এখন কী হবে?’

‘ তা ছাড়া’– সে বলল–’ শুনতে পাচ্ছি আমাদের  গরুঘোড়া এইসবও নাকি আমাদের থাকবে না।’ মানুষটারকণ্ঠস্বর বড় করুণ শোনাল। তার প্রশ্নের উত্তর কেউ চট করে দিতে পারল না। সবাই নীরব হয়ে রইল। মানুষটা পুনরায় বললেন– আমরা দুজনেই আপনার কাছে এসেছি। কিন্তু আমাদের অঞ্চলের কয়েকজন এ ধরনের চিঠি পেয়েছে।’

বসে থাকা মানুষগুলি এবারও কিছু বলল না। ওরা চুপ করে রইল।

পিটার যেলেনক’ভ নীরবতা ভেঙ্গে বললেন– আমাদের কথাটা চিন্তা করতে দিন। আলোচনা করতে দিন।’

তিনি পুনরায় বললেন-‘এখনও তিনমাস সময় আছে।‘ 

কথাগুলি মুক্তভাবে আলোচনা করার জন্য পিটার যেলেনক’ভ ভেসিলিদের চলে যাওয়াটা চেয়েছিল ।‌ তিনি বললেন – তোরা দুজন দূর থেকে এসেছিস। তোরা এখন যা । আমরা কিছু করতে পারি কিনা আলোচনা করে দেখতে দে ।’

মানুষ দুটি  খুব একটা সন্তুষ্ট হল না। তবু কুঁজো মুচিটার  সঙ্গে  দ্বিধান্বিত মন নিয়ে চলে গেল। বাইরে ওদের গুঞ্জন শোনা গেল।

চেয়ারে বসে থাকা অপরিচিত মানুষ দুটির একজন ছিল শ্বিগান’ ঝুছুপ’ভ। কাজাখ  অঞ্চল থেকে আগত তিনি একজন লোকনৃত্যের শিক্ষক। তিনি যেন মানুষগুলির যাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গারুশভাষায় বলতে লাগলেন– ‘আমাদের এখানেও জনগণের কৃষি পাম পাতা নিয়ে মানুষের মধ্যে অশান্তি আরম্ভ হয়েছে।আমাদেরআরাল হ্রদের আশেপাশে কখনও না হওয়া দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। আমাদের মানুষেরাদলবেঁধে আলোচনা করে উটে উঠে কিছু লোক চারিয়ারকির বিস্তীর্ণ তৃণভূমি স্টেপ ভূমিতে খাদ্য আনতে গিয়েছে। বাকিরা  গিয়েছে ঘাসে ভরা সাভানাঅঞ্চলে।এই অঞ্চল গুলি খাদ্যের ভান্ডার বলে পরিচিত। কিন্তু সেখানকারউপজাতিদের অবস্থা নাকি একই। আমার শোনা মতে সেখানকারদুরবস্থা দেখে সেখানে যাওয়া অনেক মানুষ নিজেদের উটগুলি সেখানকার মানুষকে দিয়েকয়েকটি অনাথ ছেলে মেয়েকে উটের পিঠে বসিয়ে নিয়ে হেঁটে ফিরে এসেছে। এসেই পেয়েছে পাম পদ্ধতিতে চাষ করার খবর। মানুষগুলি ক্ষোভ, অশান্তি আর ক্রোধে পাগল হয়ে উঠেছে।’

ঝুছুপ’ভের কথা শেষ হওয়ার পরেও মানুষগুলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

পিটার যেলেনক’ভ কাজাখ অঞ্চলে আগে একবার গিয়েছেন।সেখানেচিরদরিয়া নদীর উর্বর তীরে হর হর শব্দে হাতে কাঁচি, কোদাল, ওখন আদি নিয়ে কাজ করতে থাকা চাষিদের সঙ্গে উটের দুধ থেকে তৈরি করা কিমরান নামের মদিরা পান করেছে । তাই নয় আড়াল সাগর এবং তুর্কিস্তানের পাশের পাহাড়েরসমভূমিকিপচাক এবং নেইমান অঞ্চলের ঘোড়ার আস্তাবল, ধান এবং আঙ্গুরের চাষি, শিকারি, জেলে এবং শিল্পী অনেকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে এবং ভেড়ার দুধ থেকে তৈরি করা কুমিছ নামের মদ্যপানও করেছেন। তিনি অঞ্চলটির হাসিমুখ মানুষগুলির কথা জানেন।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১৭) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


পিটার যেলেনক’ভ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অক্টোবর বিপ্লব এবং তার পরের তিন বছর গৃহ যুদ্ধের শেষে যখন সুস্থির  সরকার গঠিত হল, জনসাধারণের অধিকাংশই আনন্দে অধীর হয়ে পড়েছিল এবং অনেক আশা করেছিল। তাদের কিছু আশা এবং রাজনৈতিক বাস্তব তাদের ছেলেমেয়েদের নামকরণে প্রকাশ করেছিল। তাদের কেউ  বিপ্লবী নেতা মার্ক্সএঞ্জেল লেনিনের   নামের  সঙ্গে মিলিয়েনিয়ে ছেলের নামকরণ করেছিল। কেউ এমনকি কমিউনিস্টেরস্লোগান’ দীর্ঘজীবী হোক মে ডে’র প্রথম অংশ’ডাজড্রাপার্মা’ দিয়ে নতুন সন্তানের নামকরণ করেছিল। লেনিনের মৃত্যুর পরে তার নাম অনুকরণ করে কারও নাম ভাডলেন, লেনিনা, ভিলেন অথবা নীল ইত্যাদি রেখেছিল।

এত  আশার শেষে এখন দেশের কী অবস্থা হল? পিটার যেলেনক’ভ পুনরায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

চেয়ারে বসে থাকা য়ুরিফমিসেভ নামের অন্য একজন অপরিচিত মানুষ কাজান  অঞ্চল থেকে এসেছিল। তিনি একসময় ঘোর রাজনীতি করতেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লেনিনগ্রাডের মোহে  পড়ে তিনি টলস্টয়বাদেরমানবীয়তায়মূগ্ধ হলেন এবং তার প্রচারের কাজে পিটার যেলেনক’ভের দলে যোগ দিলেন। আলোচনার ধারা দেখে তিনি কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

তিনি বললেন- আমাদের ভল্গার পারের বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতেও মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করেছে। তার মাটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ এবং গাড়ি মোটর নির্মাণ করার জন্য চেষ্টা চরিত্র করছে। সেখানে নাকি কর্মীদের বসবাসের জন্য বাড়িঘর তৈরি করবে।

তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন–’ এখন আমাদের জনতার সরকার হল। জারের শাসনের অন্ত পড়ল। বহুদিন বসতি করে খেটে খাওয়া এই মানুষগুলির স্বত্ব থাকা মাটি অধিগ্রহণ করে আঘাত দেওয়াই আমাদের সমাজতান্ত্রিক সরকারের লক্ষ্য নাকি?’

মানুষটা প্রশ্ন করেই চুপ করে রইল।

মস্কো থেকে আসা ভ্লাডিমির ভেলিস্কই কাজান  অঞ্চলের কথা ভালোভাবেই জানেন। কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে টলস্টয় কূটনীতিবিদ হওয়ার জন্য আরবি এবং তুর্কি ভাষা অধ‍্যয়ন  করেছিলেন। তিনি টলস্টয়ের  পদস্পর্শ থাকা কাজান শহরে যুবক বয়সেই গিয়েছিলেন। যেদিন তিনি সেখানে প্রথম গিয়েছিলেন সেই সময় ছিল বসন্ত এবং গ্রীষ্মের মাঝা মাঝি। বরফের বাকি থাকা দুই একটি টুকরোও ঝর্ণার জলে গলতে  শুরু করেছিল। পথের এখানে সেখানে মাটি মিশ্রিত ঠান্ডা জল জমাট বেঁধে থাকতে দেখা গিয়েছিল। তথাপি সেই আবহাওয়ায় সেদিন গ্রীষ্মের প্রথম বৃষ্টি ঝিরিঝিরি করে পড়তে শুরু করেছিল। তার শহুরে  জুতোজোড়া জলে ভিজে গিয়েছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে ঢুকেই একটি টেবিলে একা বসে থাকা একটি তাতারযুবতির ওপরে তার চোখ পড়েছিল। তার চোখ দুটি ছিল কালো এবং গভীর। লাল রঙের একটা পাতলা স্কার্ফ গলায় জড়িয়ে থাকা তাতার  যুবতিটির চোখ থেকে চোখ সরাতে না পেরে সে থমকে  দাঁড়িয়েছিল।মেয়েটি তার অবস্থা দেখে মুচকি হাসায় তিনি যেন সম্বিত ফিরে পেয়েছিলেন। পরে ভ্লাডিমিরভেলিস্কের সেই তাতারযুবতির সঙ্গে প্রেম হল, বিয়ে হল এবং দুটি সন্তানের পিতা হল। তাই তিনি কাজান অঞ্চলকে জানেন।

ভ্লাডিমিরভেলিস্কইয়ুরিফমিসভের কথায় সায় দিলেন – এরকম কোনো কথা যে আমি শুনিনি তা নয় ।’

নাডিয়ার মা মাছারমানভ’না মানুষগুলির জন্য কফি করেছিল। নাডিয়া পাশে দাঁড়িয়ে কাপ প্লেট গুলিগুছিয়ে  দিচ্ছিল। তথাপি তারা দুজনেই কান খাড়া করে মানুষগুলির কথা শুনছিল।

মাছা রমান’ভনারশৈশবকাল মস্কো শহরের পাশে মর’ঝভের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে পার হয়েছিল ।তাঁর মা-বাবা দুজনেই কারখানায় প্রস্তুত করা পণ্য দ্রব্যের শ্রমিক ছিলেন । শ্রমিকদের আলাদা কোনোশয়ন কক্ষ ছিলনা। মাছা রমান’ভনারা অন্য দুটি পরিবারের সঙ্গে মোট দশ জন মানুষ একটি কক্ষে শয়ন করত। বুড়ো এবং বড়রাবিছানায়ঘুমোতো এবং যুবক-যুবতিওছেলেমেয়েরামেঝেতে পাতা ঢালা বিছানায়ঘুমোতো। তাঁদের প্রত্যেকেরই আলাদা স্নানঘর বা রান্নাঘর ছিলনা ।

তাঁরা কখনও কারখানার মালিক মঝ’ঝভকেদেখেনি।তাঁর পরিবার মর’ঝভনা মহাশয়াকে  তাঁরা তারা তাদের নিজের জন্মদিনের দিন রঙ্গিন  সাজপোশাকে দেখতে পেত। সেদিন তিনি কারখানায় আসতেন। তারা কিশোর-কিশোরীরা এই সুন্দর মানুষটিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত। শুনতে পেয়েছিল এই মানুষটি নাকি কখনও রাতে বুক খোলা সাজপোশাকে সম্ভ্রান্ত মানুষের সঙ্গে বল নাচ নাচত। সেই মহিলা কারখানায় এসে সবচেয়েবেশি বয়স্ক এবং পঙ্গু হয়ে পড়া শ্রমিক কয়েকজনকে তাদের জন্মদিনের জন্য তিন রুবল করে উপহার দিয়েছিলেন।

সেই কারখানায় থাকার সময়মাছারমান’ভনা কৈশোর অবস্থায় শিক্ষানবীশ হিসেবে কারখানায় কাজ শিখত। তাদের সঙ্গী সাথীরা ছিল একই শয়নকক্ষে থাকা পরিবারের ডিনা নামের মেয়েটি। তারা দুজনেই হাতে-কলমে কাজ শিখে কারিগর হয়েছিল। সেই সময় তারা দুজনেই কুড়ির গণ্ডি অতিক্রম করেছিল। মাছার বান্ধবী ডিনাটুস্কিন অঞ্চলের একটি ঘরে এলেক্সেই নামে এক যুবকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে গোপনে দেখা করত। শেষ পর্যন্ত ওরাবিয়ে করে সেই অঞ্চলেই থাকতে শুরু করেছিল। সেই সময়মাছার পিতা আলাদা একটি কারখানার বাণিজ্যকুঠিরঅধিকারীর সাহায্য নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে এসেছিল এবং সেখানেই মাছা নাবিক প’পভভেসিলিয়েভের   সঙ্গে   পরিচয় হয়ে বিবাহ পাশে আবদ্ধ হয়েছিল।

এখন বহুদিন পরে দুই বছর আগে মাছা রমান’ভনা ডিনার থেকে একটা চিঠি পেয়েছে। তাতে সে দুঃখের সঙ্গে লিখেছে এতদিন মস্কোতেটুশকিনে বসবাস করলাম। এখন আমাদের প্রস্পেক্ট তৈরি করার জন্য উচ্ছেদ করছে। সঙ্গে মাটির জমিদার কুলাকদের থেকে স্ভ‍্যাটেক্রেস্টে ক্রোক করা মাটিতে পাতার জন্য সমাবায় কৃষি পামে  কাজ করার জন্য আমাদের আদেশ দিয়েছে। ‘আমার মনের অবস্থা তুই বুঝতে পারবি’বলে ডিনাইমাছারমানভ’নার কাছে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে চিঠিটা শেষ করেছে। তিনি জানেন মস্কোর পাশে টুশকিনজলাহের সেই বাড়িতেইডিনাইঅ্যালেক্সের সঙ্গে গোপনে প্রথম মিলিত হয়েছিল।

মাছা রমান’ভনা কফি ঢেলে বাকি পেয়ালাগুলিনাডিয়াকেবিলিয়ে দেবার সময়ও কথাগুলি ভাবছিল। তিনি কিন্তু কিছুই বলেননি। কিন্তু কথাগুলির গভীরতা তিনি ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।

ভ্লাডিমিরভেলিস্কের কথা শেষ হয়নি। তার  পরবর্তী কথায় মাছারমানভ’না ভাবা কথাটাই প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি বলেছিলেন–’ আমিও মস্কোতে শুনে এসেছি প্রস্পেক্ট এবং তাঁতের  মিল তৈরি করার জন্য মাটি ক্রোক করতে শুরু করেছে। সেখানকার বাসিন্দাদের উদ্যোগ, পশু বা কৃষিকাজে যোগ দেবার জন্যও যেতে বলেছে। ‘

মানুষগুলির সামনে কফির পেয়ালারধোঁয়াউড়তে  থাকল। দুজন ছাড়া তাতে কেউ চুমুক দিল না। ওরা চুপ করে বসে রইল।

কম কথা বলা লিঅ’নিড এডলার অনেকক্ষণ পরে নীরবতা ভঙ্গ করল– আমি গণ-আদালতে কাজ করি। আমি আদালতের কথা বলাটা শোভা পায় না। কিন্তু যে সমস্ত কথা শুনলাম আমি বুঝতে পারলাম, তার গভীরতা আমি বুঝতে পারছি। তাই দুই  সপ্তাহ আগে ভেতরের অঞ্চলের বিশাল পরিমাণের মাটি থাকা সম্ভ্রান্ত একজন কুলাককে আদালতে কী করল আমি তাই দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হয়েছি। কুলাকটি সরকারি ক্রোক প্রথার বিরোধিতা করেছিল ।তাঁর বিশ্বাসী রায়তরা সরকারি দলকে ক্রোক করতে বাধা দিয়েছিল । সম্ভ্রান্ত কুলাকটিকেকয়েকজন চাষার সঙ্গে একত্রে ধরে বেঁধে আনল এবং সেদিন আদালতে বিচার করে ওদেরপ্রত্যেককেশ্রমিকশিবিরে পাঠানোর রায় দিল।

নাডিয়া যেন অনেকদিন পরে লিঅ’নিড এডলারের মুখের কথা শুনছিল। তাই তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েরইল। 

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লি’অনিড বলল – আপনারা জানেন সাইবেরিয়াতে  থাকা শ্রমিক শিবিরের কথা । সেখানে বিশেষ করে কয়েদিদের  কাজে লাগায় । আট নয় মাসের দীর্ঘ উগ্ৰ শীতে বরফের মধ্যে ওরামরনাপন্ন হয়ে কাজ করে-রাস্তা, রেলপথ, সেতু নির্মাণ করে।এই মানুষগুলিকেও কয়েদিদের সঙ্গে একই কাজে লাগায় ।

লিঅ’নিড পুনরায় বলল – এই ধরনের শ্রমিকের শিবির এখন আরও বাড়বে। ভলগা ডন প্রণালীর কাজ শুরু হবে। ওদিকে উজানে শ্বেত সাগরের প্রণালীর কাজও হাতে নেওয়াহয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। সেখানেও শ্রমিক পাঠানো হবে। 

লিঅ’নিড এডলারকে  কিছুটা উত্তেজিত হতে দেখা গেল। সে কথাটা তাড়াতাড়ি করে কথাটা বলে যেন কিছুটা শান্ত হল। পেয়ালাটা হাতে নিয়ে সে কফিতে চুমুক দিল।

মানুষগুলি পুনরায় নীরব হয়ে পড়ল।

পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় কথাগুলি শুনে গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন। তাঁর চিন্তার আর ও অনেক কারণ ছিল। গত এক দশক জুড়ে কমিউনিস্টের সংস্কারের নামে দেশে চলতে থাকা কিছু কথা ছিল চিন্তার কারণ। দেশে অনেক পুরোনো পরম্পরা ভেঙ্গেদেওয়াহয়েছে। ইস্টার, বড়দিন এবং নববর্ষের উৎসবগুলি বন্ধ করে দেওয়াহয়েছে। তার পরিবর্তে বিপ্লবী নেতাদের জন্মদিন পালন করার নিয়ম করা হয়েছে। ধর্ম যাজকরা বিবাহসমূহ পরিচালনা করার নিয়ম বন্ধ হয়েছে। তার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলর আংটি বদলিয়ে শপথ খাইয়ে বিবাহে পৌরোহিত্য করতে শুরু করেছে। যাজকদের কর্মী মানুষের উপরে পরগাছা বলে অভিহিত করে আপত্তিকরা কিছু যাজককে এমনকি গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

পিটার যেলেনক’ভ জানে যে পঞ্চবার্ষিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনামতে গজাল থেকে ডিম পর্যন্ত উৎপাদনেরনিয়ন্ত্রণ রাজ্যে রয়েছে। সোসালিস্টস্টেটে সমস্ত মানুষ দেশের এবং সমাজের জন্য কাজ করে সুখী হওয়াটা  বাঞ্ছা করা হয়েছে । আশা করা যাচ্ছে যেহেতু প্রত্যেকেপ্রত্যেকের ভালোর জন্য কাজ করবে, কোনো নাগরিকই অলস বা দুর্নীতি পরায়ণ হবে না। কিন্তু ভূমি এবং ব্যবসায়ের ব্যক্তিগত স্বত্ব নাই হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় মানুষই সমৃদ্ধশালী এবং উন্নতি করার স্পৃহায় আঘাত হানতে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলির সৃষ্টিশীলমনোবৃত্তি লোপ পাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

পিটার যেলেনক’ভ মহাশয় তাঁর আধ পাকা দীর্ঘ দাড়িতে দুবার হাত বোলালেন এবং অনেকক্ষণ পরে বললেন – পরিস্থিতির গভীরতা আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু এখন কথা হল আমরা কী করতে পারি । আমরা হলাম টলস্টয় বাদী সংগঠন। আমাদের কাজ হল দুষ্কর্মের প্রতি নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ। নীতি হল কাউকে হত্যা না করা। এমনকি হত্যা বন্ধ করার জন্য ও হত্যা না করা।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি গম্ভীরভাবে পুনরায় বললেন–’ আমি এই কথাটা যতই ভাবছি ততই টলস্টয়ের সঙ্গে অন্য একজন মানুষের কথা মনে পড়ছে। তিনি একজন হিন্দু। ভারতের হিন্দু। তিনি একসময় দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন এবং টলস্টয়ের জীবনের শেষের দুই বছর মহান লেখকের সঙ্গে  তিনি চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলেন।’

নিঃশ্বাস ফেলে পিটার যেলেনক’ভ বললেন –তাঁর নাম এমকে  গান্ধী। টলস্টয়ের  দ্বারা তিনি যথেষ্ট প্রভাবিতহয়েছিলেন। বিশেষ করে ‘দ‍্য কিংডম অফ গডইজউইদিনইউ নামের গ্রন্থটি থেকে। পরে জোহান্সবার্গের পাশের এক হাজার একর মাটির ফার্মটিকে গান্ধী’ টলস্টয় ফার্ম’ নামে নামকরণ করেছিলেন। টলস্টয় এবং গান্ধী- দুজনেই মাঝ বয়স থেকে ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করেছিলেন । দুজনেই সাধারন পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করতেন । টলস্টয়কাউন্ট হলেও মাঠে চাষ করা,খড়ি ফালা এবং জুতো  সেলাইয়ের কাজ করার মতো গান্ধী ব্যারিস্টার হয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, পায়খানা পরিষ্কার করেছিলেন । পরবর্তীকালে গান্ধী সুতো কাটা শুরু করেছিলেন এবং তার জন্য মানুষকে উৎসাহ দিতেন। দুজনেই ধার্মিক দর্শন এবং অহিংসা নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই নীতি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রয়োগ করে গান্ধী সফল হয়েছিলেন এবং এখনও তাদের দেশে চলা ইংরেজির শাসনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে চলেছেন ।’

মানুষটার কথা শুনে চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলি তার দিকে আগ্রহ সহকারে তাকালেন। তারমধ্যেভাডিমিরভেলিস্কই বললেন – হ্যাঁ মহাশয়, আপনি কথাটা ঠিকই বলেছেন। আমি একবার টলস্টয়েরইয়াস্নায়াপলিয়ানার প্রাসাদে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে  সপ্তাহ খানেক তাঁর পড়ার ঘরে অধ‍্যয়ন  করেছিলাম। টলস্টয়র ডায়েরিতে গান্ধীর উল্লেখ থাকার কথা মনে পড়ছে। আমি তার কিছু কথা আমার ডায়েরিতে টুকে এনেছিলাম। ডায়েরিটা আমি আজ আনিনি।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি বললেন–’ একটা কথা ঠিক যে টলস্টয় যে নীতির কথা বলেছিলেন সেই নীতি গান্ধী হাতে কলমে প্রয়োগ করেছিলেন। এখন আমরা হয়তোগান্ধীর কথা অধ‍্যয়ন  করলে আমাদের কার্যপন্থারউৎস খুঁজে পাব।

কাজান থেকে আসা য়ুরিফমিসভও কথোপকথনে যোগ দিলেন। তিনি বললেন– আমি একটা কথা বলতে চাই। আমরা টলস্টয়ের  জন্ম শতবার্ষিকী আয়োজন করা চার বছর হয়েছে কি? হ্যাঁ, চার বছর – কারণ ১৯২৮ সনে শতবার্ষিকীর আয়োজন করেছিলাম। সেই সময় গান্ধীজি ইউরোপে আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারেননি। তিনি আমাদের অনুষ্ঠানে একটা শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়েছিলেন। বাণীটা আমাদের মনে নেই, কিন্তু তাকে সংক্ষিপ্ত করে আমি কোথাও লিখে রেখেছি। সেই বাণীটাতেইটলস্টয়েরজীবন এবং নীতি তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে কথা উল্লেখ করেছিলেন বলে এখন মনে পড়ছে।

শ্বিগান’ক  ঝুছুপ’ভেও ভাঙ্গা ভাঙ্গারুশভাষায়আলোচনায় যোগ দিলেন – দুই বছর আগে মে মাসে আমাদের এখানকার খবরের কাগজে গান্ধীর একটা খবর বেরিয়েছিল । ইংরেজ সরকারের সাগরীয়নূনের  উপরে থাকা করের যে আইন সেই আইন তিনি নাকি হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে প্রায় আড়াইশো মাইল পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে সাগর থেকে নিজ হাতে নূনকুড়িয়ে অমান্য করেছিলেন । তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তার অবিহনেও শত শত লোক নূনেরভান্ডারগুলি দখল করার জন্য একদলের পরে অন্য দল গিয়েপুলিশের নির্যাতন নীরবে সহ্য করে ছিল। রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল কিন্তু তবুও ওদের কেউ একটা হাত তুলে ও প্রতিরোধ করে নি । এটাই নাকি টলস্টয় বলা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ ?’

ভ্লাডিমিরভেলিক্সই মাথা নেড়েসায় দিল –’হ‍্যাঁ, ওটাইনিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ। তাই আমি বলছি গান্ধীর কার্য পন্থা হয়তো আমাদের নিশ্চয় সহায়তা করবে।’

চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলির মুখগুলি ইতিমধ্যে ভারী হয়ে পড়েছিল । ভ্লাডিমিরভেলিস্কের কথা শুনে তাদের মুখে কিছুটা আনন্দের ভাব ছড়িয়েপড়েছিল।

লিঅ’নিড কথা বলার পর থেকে নাডিয়া সুযোগ পেলেই তার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। তার মুখেও চিন্তার রেখা ছড়িয়েপড়েছিল। কিন্তু ভাডিমিরভেলিস্কের  কথায় তার মুখের রেখা বিলীন হতে দেখে সেও সহজ হল এবং মা মাছারমানভ’না ইঙ্গিত দেওয়ায় সে কফির পেয়ালা গুলি সামলাতে লাগল।

পিটার যেলেনক’ভ বললেন– তাহলে আমি এক সপ্তাহ পরে এখানে দেখা করব। ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যেকেই এমকে গান্ধীর বিষয়ে জানার চেষ্টা করব যাতে পরবর্তী সময় আলোচনা করতে পারি।’

মানুষগুলি একটা দিন ঠিক করে যার যারবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরেও মিখাইলের সঙ্গে লিঅ’নিড এডলার কিছু সময় বসে রইল। নাডিয়ার মনে হল লিঅ’নিডঅন্যদিনেরমতো আজও চুপ করে আছে, কিন্তু সে কিছু একটা চিন্তা করছে সেটা সে বুঝতে পারল। তার মুখটা দেখে তার খারাপ লাগল। সেই চিন্তান্বিত মুখটা নিয়েই বাড়িতে ফিরে যাবার সময়লিঅ’নিড আশ্চর্য ভাবে তার দিকে এক পলক তাকিয়ে গেল ।

নাদিয়ার হৃদয়ে খোদিত হয়ে  রইল কালো চোখ জোড়ার করুণ চাহনি।

দুদিন পরে মধ্য বয়সের ভিক্টর একছুৰ্স্কিবাইসাইকেলে ছবি আঁকার সরঞ্জাম বেঁধে নাডিয়াদেরবাড়িতে এসে পৌছালো। সময়টা ছিল দুপুর বেলা। নাডিয়া কিছুক্ষণ আগে ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষা পাঠ সমাপ্ত করে ফিরে এসেছিল। তাদের দুপুরবেলার আহার খাওয়া শেষ হয়েছিল।

ভিক্টর একছুৰ্স্কিমাছারমানভ’নাকে  বললেন–’ কাকিমা, আমি নাডিয়ার একটি ছবি আঁকব। লাইলাক ফুলের মধ্যে।’

দাড়িওলাচিত্রকরের মুখের দিকে তাকিয়ে মা আপত্তি করল না।

‘আপনাদের  পাশেই ঘাস বনের কাছে আমি লাইলাক ফুলের বাগান দেখে এসেছি। সেখানে নাডিয়াকেনিয়ে আমি যাব।’

নাডিয়াবাড়িতেস্কার্টের উপরে একটা রঙ্গিন জামা পড়েছিল। তার আনন্দ এবং লজ্জা মিশ্রিত মুখের দিকে তাকিয়েএকছুর্স্কি বললেন–’তুমি উপরে লেস দেওয়া ফোলা  ধরনের একটি জামা পরবে নাকি?’

পোশাক পাল্টেনাডিয়ামানুষটার সঙ্গে উৎসাহেবেরিয়ে গেল।

ভিক্টর একছুর্স্কিবাইসাইকেলেঝুলিয়ে আনা রং এবং তুলির ব্যাগটা নাডিয়ার হাতে তুলে দিলেন। নিজে স্ট্যান্ডক্যানভাসনিয়েমেটে রঙের কাঠের গেট খুলে বেরিয়েধুলায়ধুসরিত পথ দিয়ে ঘাসের দিকে এগিয়ে গেলেন। বসন্তের নীল আকাশের নীচে ছিল রৌদ্রস্নাত কোমল ঘাস। আর সেখানে ছিল লাইলাক ফুলের ঝোপ। তার অণ্য পারে নাডিয়াকে একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বসতে দিয়ে ভিক্টর একছুৰ্স্কিকেনভাসের উপরে মনোযোগের সঙ্গে স্কেচআঁকতে লাগলেন।

আঁকতেআঁকতে ভিক্টর একছুর্স্কির মনে হল নাডিয়ার চোখে যেন বিরাজ করছে একটি অবুঝ  কারুণ‍্য। রেখাচিত্র আঁকা তার হাতের অঙ্গারের টুকরো থমকে গেল। তিনি নাডিয়ার দিকে তাকাতে লাগলেন।

সবুজ কোমল ঘাসে নাডিয়া বসে রয়েছে। তার সামনে রয়েছে লাইলাক  ফুলের ঝোপ। বাতাসে ফুলগুলিই নয়, নাডিয়ার দুই  একটি সোনালি চুলও নাচছে। মুখে চলে আসা চুলগুলি তাকে বারবার বিরক্ত করছে। তাকে বিরক্ত করছে লেস দেওয়া পাতলা সাদা রঙের জামাটা। ষোড়শীর  কমনীয়তায় পরিপুষ্ট তার উন্নত বুকে জামাটা বারবার আঁটোসাটো হয়ে উঠেছে । সে লাইলাক  ফুলের ঝোপটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে হাতটা এগিয়ে দিচ্ছে- একটি ফুল স্পর্শ করার জন্য। কিন্তু এই বসন্তের মধ্যেও তার কাজল চোখ জোড়ায়ছড়িয়েপড়ছে শীতের কারুণ‍্য।

ভিক্টর একছুর্স্কি কিছুক্ষণ নাডিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েরইল। তার চোখ জোড়ার দিকে  তাকিয়েরইল। নাডিয়ার দুই চোখের কারুণ‍্যের গভীরতা বোঝার জন্য তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়েরইলেন। বসন্তের বাতাসে ভাসতে থাকা ফুল ছেড়ার আশঙ্কাতেই তার চোখে এই কারণ‍্য নাকি ? ভিক্টর একছুর্স্কি যত ভাবে ততই তিনি উপলব্ধি করতে লাগলেন নাডিয়া ও বসন্তের একটি সুন্দর ফুল । তার দিকে তিনি হাত বাড়াতে পারেন না।

একটা অবুঝ কারুণ্য তার মনটাকেঘিরে ধরল। তিনি আঁকা ছেঁড়ে নীরব হয়ে রইলেন।

মাঝবয়সীমানুষটি তার ছবি আঁকার আগ্রহ প্রকাশ করায়নাডিয়াপুলকিত হয়ে পড়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়ও সে  রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় ভিক্টর একছুর্স্কির  সামনে বসে থেকে তার মনটা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসতে লাগল। তার সমস্ত পুলক এবং রোমাঞ্চমিলিয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা বিরাগ ভাব যেন জেগে  উঠল। ধীরে ধীরেকারুণ‍্য তাকে গ্রাস করে ফেলল।

ভিক্টর একছুর্স্কি লেখচিত্র আঁকতে শুরু করায় কোথা থেকে গার্লিস লাগানো প্যান্ট পরা ডিমভবেরিয়ে এল। সে সচরাচর চালানো চাকাটা কাঁধে নিয়ে এসেছিল। সে সবার অজান্তে ঘর সে চুপ করে বসে ছিল এবং এক সময়ে দুই হাতের তালুতে থুতনিটা রেখে দূরে বসে থাকা নাডিয়ার দিকে তাকাচ্ছিল এবং অন্যবার চিত্র করের দিকে এবং আঁকতে থাকা স্কেচটার দিকে তাকাচ্ছিল। শূন্য কেনভাসটিতে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠা নাডিয়ার রেখাচিত্রটা দেখে তার ভালো লাগছিল। কিন্তু চিত্রকর ছবি আঁকা ছেঁড়েনাদিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা তার ভালো লাগল না। সে মনে মনে অস্থির হয়ে পড়তে লাগল। পরে তার মন ক্ষুব্ধ  হল। কিছুক্ষণ পরে তার মুখ দিয়ে একটা অবুঝ শব্দ বেরিয়েপড়ল।

ভিক্টর একছুর্স্কি তার দিকে মাথা তুলে তাকাল। গার্লিস লাগানো প্যান্ট পরা উজ্জল চোখের ডিমভহঠাৎ বসা  থেকে উঠে দাঁড়াল এবং চাকাটাতে ধরে দাড়ি থাকা চিত্রকরের দিকে ভয়েভয়েতাকিয়েরইল। চিত্রকর যেন ছবি আঁকার অন্য একটি বিষয় পেল – চাকার সঙ্গে একটি বালক ।

সে ডিমককে তার নাম জিজ্ঞেস করল। তারপর বলল–‘ এই ছবিটি আঁকা হয়ে গেলে তোরও একটি ছবি আঁকব।’

 সে ইতস্তত করে দাঁড়িয়েরইল।

নাডিয়া ইতিমধ্যে ডিমককে দেখতে পেয়েছিল। ভিক্টর একছুর্স্কির কথাও তার কানে পড়েছিল। সে সেখান থেকেই হেসে বলল–’ মহাশয়ওরও ছবি আঁকবেন, ওর দুষ্টুমির ছবি।’

চিত্রকরনাডিয়ার দিকে তাকিয়ে অবাক হল। তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে সেই প্রথম দেখা আনন্দের চপলতা।

ভিক্টর একছুর্স্কি চিত্রের সরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে লাগলেন। ফিরে আসার পথে তারা বুঝতে পারলেন ডিমভই নয়,তার সমবয়সীদুইজন এবং চমনভ মুচির ছেলে গ্ৰবিলভেও দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

ধুলায়ধুসরিত পথ দিয়ে আসার সময় ভিক্টর একছুর্স্কিনাডিয়াকেজিজ্ঞেস করল–’ তোমার মুখে আমি মন খারাপের চিহ্ন দেখতে পেলাম। কোনো কারন আছে নাকি নাডিয়া?’

নাদিয়া কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু কেন জানি সেদিন কুঁজো চমনভ মুচি ওদেরবাড়িতে আসার দিন টলস্টয়বাদীদের আলোচনার পর থেকে তার মনটা মাঝেমধ্যে কোনো আশঙ্কায় মুহূর্তের জন্য বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে রইল। সেই কথা ভিক্টর একছুর্স্কিকে বলতে পারল না। সে চুপ করে রইল।

চিত্রকর গেট খুলে প্রবেশ করার আগে তাকে বলল–’ তোমাকে কথা গুলি জিজ্ঞেস করার জন্য খারাপ পেয়ো না।’

ছবি আঁকার সরঞ্জামগুলি নাডিয়াদের ঘরে রেখে ভিক্টর একছুর্স্কিবাইসাইকেল চালিয়ে শহরের দিকে চলে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত