| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২) । ডঃদীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃদীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা,অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন,প্রব্রজন ,ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi,New Delhi ,2010) এবং The Highlanders(Blue Rose Publishers, New Delhi,2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন,কলকাতা,২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২।


 

মস্কোর স্টেট ইউনিভার্সিটির নির্ধারিত স্টেশনটিতে নেমেই নাটালিয়া দূর থেকে দেখতে পেল জুন মাসের সোনালি রোদে ঝলমল করতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়ত্রিশ তলা বিশাল ভবন এবং তার উপরের চূড়াটি। সে বড়সড় চৌহদের প্রশস্ত মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করে লিফটে উঠে নির্ধারিত মহলে থাকা ইতিহাস বিভাগের দিকে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগল।

অধ্যাপক মিখাইল ক্রিয়োসকভ নিজের রুমে ছিলেন না।তিনি ক্লাস নিতে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক আসতে আসতে নাটালিয়া গবেষকদের জন্য থাকা ঘরটিতে প্রবেশ করল।বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ভবনটির উষ্ণ বাতাবরণ ঘরটির ভেতরেও ছিল। সে কাঁধের ব্যাগটির কাগজ পত্রগুলি বের করে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে নিল এবং ইতিমধ্যে তৈরি করা টীকাগুলিতেও চোখ বুলিয়ে নিল।

অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ ফিরে এসেছে জানতে পেরে সে অধ্যাপকের দরজার সামনে উপস্থিত হল। সে সুপ্রভাত জানাতেই আগ্রহের সঙ্গে ভেতরে ডেকে বসতে বলে বল্লেন-‘নাটালিয়া তোমাকে ডেকে পাঠানোর কারণ আছে। কিন্তু তার আগে বল তোমার অধ্যয়ন কতটুকু এগিয়েছে।’

    নাটালিয়া বলল –‘করছি স্যার টলস্টয়ের রচনা এবং তাঁর বিষয়ে পড়াশোনার তো শেষ নেই।’

সে বলল-‘তাঁর বিষয়ে পড়তে গিয়ে একটা কথা বুঝতে পারলাম,সেটা হল-আমরা সব সময় দেখা বা শোনা  পরিবেশ থেকেই তিনি কয়েকটি মনোরম কাহিনি লিখেছিলেন।তিনি ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন ইয়াস্নায়া পলিয়ানার পাশের টুলা মহকুমার আদালতের আইনজীবী ইভান ইলিচ মেসনিকভের মৃত্যু তাঁর মনে রেখাপাত করার সময়।বাস্তব কাহিনি আলাদা যদিও তিনি সমাজের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটনের কাহিনিরূপে ঘটনাটির রূপদান করেছিলেন।’

সে পুনরায় বলল-‘ক্রোয়েটজার সোনাটা’লিখিছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ভি এন অ্যাণ্ড্রায়েভ –বুলার্কের পরামর্শ মতো।তিনি নাকি একটি রেলযাত্রায় একজন ভদ্রলোকের পরকীয়া প্রেমের জন্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠার কথা শুনেছিলেন।

অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ বললেন-‘হ্যাঁ,নাটালিয়া,তোমার কথা ঠিক।জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এই ধরনের বহু কাহিনি আহরণ করেছিলেন।তার মাঝখানে আরও একটি কথা ছিল ‘বলনাচের পরে’।তুমি সেই বিষয়ে জান কি?’ নাটালিয়া কৃ্তজ্ঞতার সুরে বল্ল-‘হ্যাঁ,স্যার।টলস্টয় তাঁর দাদা সার্গেনিক লায়েভিসের জীবনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্পটা লিখছিলেন।’

নাটালিয়ার মনে পড়ল কাজান নগরের সামরিক অধিনায়কের কন্যা ভার্ভারা অ্যাণ্ড্রেয়েভনার প্রেমে সার্গে পড়ার কথা।কিন্তু ভার্ভারার পিতার নির্দেশে একটা নির্মম শাস্তি দেবার দৃশ্য দেখার পরে সেই যুবতির সঙ্গে সম্পর্ক তিনি ছিন্ন করেছিলেন।টলস্টয় একটি প্রবন্ধে সেই অভিজ্ঞতার কথা এভাবে লিখছিলেন-অধিনায়ক আগের দিন রাতে কোনো একটি বলনাচের অনুষ্ঠানে নিজের সুন্দরী যুবতি মেয়ের সঙ্গে আনন্দিত মনে মাজুর্কা নাচ নেচেছিলেন। কিন্তু তিনি পরের দিন ধরে বেঁধে আনা অন্য একজন পলাতক তাতার সৈনিককে পিটিয়ে মারার আদেশ দিয়েছিলেন।সৈনিকটির ওপরে চারপাশ থেকে অবিরাম চাবুকের আঘাত পড়ল এবং একসময়ে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল।তারপর অধিনায়ক গর্বের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে এসে পরিবারের সঙ্গে আনন্দিত মনে দুপুরের আহার করল।

    নাটালিয়া বলল –‘স্যার,গল্পটা নাকি তার জীবিতকালে প্রকাশিত হয়নি।’

    অধ্যাপক প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল।বললেন-‘সমাজকে এবং সরকারকে সমালোচনা করার জন্য তাঁর কিছু রচনার অবস্থা সেরকমই হয়েছিল।আর কিছু ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন করতে হয়েছিল-জারের অনুচর বাহিনীর নির্দেশে।’

    নাটালিয়া কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল-‘স্যার,টলস্টয় বিষয়ে পড়াশোনার কোনো শেষ নেই্ল’যুদ্ধ এবং শান্তি’র কাহিনিরও যেন শেষ নেই।চরিত্রের ও শেষ নেই।আমার কাছে আশ্চর্যের বিষয় হল একজন মানুষ এতগুলি চরিত্র –হয়তো প্রায় পাঁচশো আশিটা একসঙ্গে কীভাবে একই উপন্যাসে কল্পনা করতে পেরেছিলেন।’

    অধ্যাপক ক্রিয়োসকভের গম্ভীর মুখ কোমল হয়ে এল।তিনি শুধু বললেন –‘বিশালতা এবং বিচিত্রতার মধ্যে থাকা ঐক্য –এটাই টলস্টয়ের বৈশিষ্ট্য।’

    নাটালিয়া বলল-‘হ্যাঁ স্যার।সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের মণিকোঠায় তিনি যেন প্রবেশ করেছিলেন।’নাটালিয়া পুনরায় বলল-‘স্যার,তাঁর বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি একটি কথা বুঝতে পারলাম।তিনি নাকি বলেছিলেন-কোনো গ্রন্থ রচনা করে থাকার সময় গ্রন্থের মূল ভাবটির প্রতি লেখকের স্নেহ ভালোবাসা অটুট থাকা প্রয়োজন।কোনো হেরফের হওয়া উচিত নয়।তখনই একজন লেখকের গ্রন্থ মহৎ গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে।’

    অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-‘হ্যাঁ,কথাটা টলস্টয়ের ঠিকই,কিন্তু কে লিখে রেখেছিল জান কি?’

     নাটালিয়া টলস্টয়ের সেক্রেটারি পেট্রোভস্কির কথা জানে। টলস্টয় নির্দেশ দিলেই তিনি আবশ্যকীয় কথাগুলি লিখে রাখতেন। অবশ্য টলস্টয় বলা সমস্ত কথাগুলি লিখে রাখাটা টলস্টয় মোটেই পছন্দ করতেন না।পেট্রোভস্কি তার কথা না মেনে টলস্টয়ের চোখের আড়ালে পকেটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে নোটবুকে এই মহান ব্যক্তির ছোট ছোট কথাগুলি টুকে রাখতেন। এই কথাগুলিও নিশ্চয় তাঁরই লেখা। তাই নাটালিয়া বলল-‘নিশ্চয় পেট্ৰভস্কি।’

    গম্ভীর অধ্যাপকের মুখে বিজলির মত মুচকি হাসি একটা নিমেষের জন্য ছড়িয়ে পড়ল। তারপর বললেন-‘পেট্ৰভস্কি নয়। তাঁর পত্নী সোফিয়া টলস্টয়।’

    নাটালিয়াকে তার মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে অধ্যাপক ক্ৰিয়োসকভ বললেন-‘আঠারো  বছরের সোফিয়া আণ্ড্ৰেয়েভনা বেহরছ বিয়ে হয়ে আসার এক বছরের পর থেকে সাত বছরের জন্য টলস্টয় অবিরত ভাবে ‘যুদ্ধ এবং শান্তি’ লিখেছিলেন ।সোফিয়া অমানুষিক ধৈর্যের সঙ্গে পান্ডুলিপি সাতবার শুদ্ধ করেছিলেন এবং এই হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রতিটি প্রতিলিপি আগ্রহের সঙ্গে করেছিলেন সোফিয়া নিজে।’

    কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ক্রিয়োসকভ বললেন -‘ এই পৌনঃপুনিক শুদ্ধ করা একটি অক্লান্ত সাধনা। স্বাক্ষর রাখার জন্য এই পৌনঃপুনিকতার অত্যন্ত প্রয়োজন। চুয়ান্ন বছর একসঙ্গে কাটিয়ে তেরোটি  ছেলে মেয়ের মাতৃ   হওয়া সোফিয়া ছিল টলস্টয়ের এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের নিকট সম্বল।তথাপি শেষের কয়েক বছর বিষয় আশ্রয়ের প্রতি উদাসীন হওয়া টলস্টয়ের জন্য তিনি বড় মনোকষ্টে ভুগেছিলেন।

    অধ্যাপক পুনরায় বললেন-‘একজন গবেষকের কাজ কী তুমি জান।অন্যে কী বলছে বা লিখছে পড়তেই হবে,কিন্তু তুমি নিজে কী উপলদ্ধি কর এবং কেন তা উপলদ্ধি কর-তার বিবরণ বই,অধ্যায় পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করাটাই হল তোমার মতো গবেষকের দায়িত্ব।’

    ‘হ্যাঁ স্যার। সেইজন্যই আমি ‘যুদ্ধ এবং শান্তি’ এবং ‘আনা কেরেনিনা’পুনরায় পড়েছি এবং নোটস নিয়েছি।‘আনা কারেনিনা’নাকি পরিবারের প্রতি থাকা স্নেহ নিয়ে এবং ‘যুদ্ধ এবং শান্তি’নাকি দেশের প্রতি থাকা ভালোবাসা নিয়ে  তিনি রচনা করেছিলেন।

    নাটালিয়ার কথা শুনে অভিজ্ঞ অধ্যাপক ক্রিয়োসকভ গম্ভীর ভাবে বললেন-‘তুমি পুনরায় উপপাদ্যের উক্তির মতো মন্তব্যটা সামনে তুলে ধরতে চাইছ। তুমি নোটস নেবার সময় মন্তব্যটা নিজের করে দেবে এবং অন্যের মন্তব্যের সঙ্গে মিল বা অমিলটা তুলে ধরবে।’

    অধ্যাপক পুনরায় বললেন-‘তুমি বলা কথাগুলি টলস্টয়ের নিজের।তিনি ছিলেন লেখক।তুমি কিন্তু লেখক নো-লেখকের মতো আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে তুমি কাজ করতে পারবে না। তোমার কাজ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যুক্তির আধারে।’ 

    নাটালিয়া বুঝতে পারল অধ্যাপক ক্রিয়াসকোভ তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে।টলস্টয় বললেই তার মন উৎসাহে আকাশ ছুঁতে চায়,তার সমস্ত যৌক্তিকতা লোপ পেয়ে যায়।সে অধ্যাপকের সামনে বিনয়ী হয়ে পড়ল।

    ‘আমি বলা কথাগুলি মনে রাখবে।’অধ্যাপক বললেন-‘আমার দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ –এখন তোমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছি বলছি, শোন।’

    কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অধ্যাপক পুনরায় বললেন-‘আমার দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বিশিষ্ট গবেষক পণ্ডিত আছে-এল পুঝিন এবং ওয়াই লাছেলেঙ্ক।’দুজনেই কয়েকবছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন।তাঁরা দুজনেই টলস্টয়ের ইয়াস্নায়া পলিয়ানার হাউলিতে থাকা যাদুঘরে বসে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে গবেষণা করেছিল।’

    মিখাইল ক্রিয়োসকভ পুনরায় বললেন-‘তাঁদের কাজগুলি গ্রন্থাগারে পেয়ে যাবে।তুমি সেসব দেখবে।কিন্তু তোমার প্রধান কাজটা হবে তাঁদের ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করে আলোচনা করা।একজন হয়তো জীবিত নেই।’

    নাটালিয়া অধ্যাপকের কথা মন দিয়ে শুনল এবং পণ্ডিত দুজনের নাম টুকে রাখল।ফিরে আসার সময় পর্যন্ত পরিচয় করে দেবার মতো ফিয়ডর ইভানভিচের কথা কিন্তু অধ্যাপক উত্থাপন করলেন না।

    গবেষক পণ্ডিত দুজনের ঠিকানা জোগাড় করতে নাটালিয়ার এক সপ্তাহের মতো সময় লাগল।সে খবর নিয়ে জানতে পারল অবসর নেবার পরে অধ্যাপক লেছালেঙ্ক লেনিনগ্রাডে  থাকতে শুরু করেছেন যদিও তাঁর ইতিমধ্যে মৃত্যু হয়েছে।অধ্যাপক পুঝিন ইউক্রেইনের কিয়েভে থাকতে শুরু করেছেন।তার ঠিকানা নাটালিয়া পেল এবং সেখানে গিয়ে পন্ডিত মানুষটির সঙ্গে দেখা করবে বলে স্থির করল।

    বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে একবেলা অধ্যয়ন করে যখন নাটালিয়া বাড়ি ফিরে এল,মা লিডিয়া পাভলভনা কাপড়ের কারখানার কাজ থেকে ফিরে এসেছিল।গতরাতে মেয়ে নাটালিয়া তাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে বড় বড় করে ফুল আঁকা একটা দীর্ঘ জামা উপহার দিয়েছিল। জামাটার রঙ এবং ফুলগুলি তাকে মেয়ের স্নেহ ভালোবাসা এবং রঙিণ মনের আভাস দিয়েছিল।সারাটা দিন তার মনটা আনন্দে ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল।কাজ থেকে এসেই তিনি একবার জামাটা দেখলেন এবং বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত পরা একটা দীর্ঘ এপ্রন বেঁধে দ্রুত সন্ধ্যার আহার প্রস্তুত করতে লেগে গেলেন।

    নাটালিয়া উষ্ণ ঘরটিতে প্রবেশ করেই দরজার মুখে তাঁর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে একটু চিৎকার করে বলল-‘মা,আমি এসেছি।’

    সে তার গায়ের পাতলা কোটটা খুলে রেখে খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখল।তারপরে পায়ের জুতোজোড়া খুলে রেখে পাশেই থাকা আঙ্গুল ঢাকা শ্লিপার একজোড়া পরে হাত দুটি কিছুক্ষণ মুছে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল এবং মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।কাঁধের একদিকে মাথাটা হেলিয়ে গ্যাস স্টোভের ওপরে উতলাতে থাকে তরকারিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-‘মা,আজ কি রেঁধেছ?’

    যুবতি মেয়ের শিশুসুলভ আচরণে লিডিয়া পাভলভনার মুখে হাসি ফুটে উঠল।তিনি বললেন-‘মাংস,শূয়োরের রাণ।তার সঙ্গে এনেছি ব্যাঙের ছাতার আচার। ব্রেড তো আছেই।

    ‘ব্যাঙের ছাতা এখনই পাওয়া যাচ্ছে?সাধারণত জুলাই মাসে পাওয়া যায়।’

    কথাগুলি বলে নাটালিয়া তার ঠান্ডা গালটা মায়ের গালে লাগিয়ে দিয়ে বলল-‘ও,বেশ মজা হবে।আমাকে কী করতে হবে বল।’

    লিডিয়া পাভলভনা দুই বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিল।মায়ের আশ্রয়ে বড় কষ্টের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বড় হয়েছিল।‘বিয়ের পরেও নয় বছর তিনি সুখেই ছিলেন।আঙ্গারা নদীতে তৈরি বিশাল বাঁধের জন্য ইরকুটস্ক শহরের পাশের ব্রাটস্কতে বড় বড় ঘরের নতুন নগর গড়ে উঠেছিল।তাঁরা সেখানে ছিলেন এবং ১৯৬৪ সনে নাটালিয়ার সেখানেই জন্ম হয়েছিল। তার সাত বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা সবাই মাঝে মধ্যে ইরকুটস্ক শহরের পুরোনো ভাস্কর্য দেখার জন্য বেড়াতে গিয়েছিল। সতেরো শতকের মধ্যভাগে রাশিয়ার উপনিবেশ হিসেবে শহরটি ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক কেন্দ্রে পরিবর্তিত হয়েছিল। সেই শহরের পুরোনো বাসগৃহগুলির দরজা-জানালা-দেওয়াল-চাল সবকিছুতে থাকা কাঠের ভাস্কর্য নাটালিয়াকে নিয়ে বেড়াতে যাবার সময়েও লিডিয়া পাভলভনা অটুটভাবে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তখন একবার সার্ভের কাজে বৈকাল হৃদের দিকে যাবার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে স্বামী নিকোলা ডেভিডভিসের মৃত্যু হয়। তারপরে মনের দুঃখে লিডিয়া মস্কোয় ফিরে আসে এবং মহানগরটির পাশের অঞ্চলে থাকা একটা কাপড়ের কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন এবং নাটালিয়াকে অনেক কষ্টে লালন পালন করতে থাকেন।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-১)


 

    লিডিয়া পাভলভনার  ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু নাটালিয়ার মুখের হাসি এবং আবদারে তাঁর অন্তরে স্তূপীকৃ্ত হয়ে থাকা বিষাদ এবং দেহের ক্লান্তি কর্পূরের মতো উবে গেল। তিনি স্নেহের সুরে বললেন-‘তোকে কিছুই করতে হবে না মা ।যদি একান্তই চাইছিস খাবার টেবিলটা ঠিক কর।’

    নাটালিয়া সমস্ত ঠিক করে সাজিয়ে দিল এবং দুজনেই খেতে বসল।

    নাটালিয়া  কিছুক্ষণ প্রার্থনা করল।শ্রীমতী পাভলভ কিন্তু করলেন না।তাঁর জন্ম হয়েছিল একটা কঠিন সময়ে-১৯৩০ সনে। ১৯১৭ সনের বিপ্লবের পর থেকে জারের পৃষ্ঠকোষকতায় চলা গির্জাগুলির সম্পদ সমাজতান্ত্রিক সরকার ক্রোক করে নাস্তিক হিসেবে ধর্মকে চূর্ণবিচূর্ণ করার জন্য গির্জার ওপরে অশেষ নির্যাতন চালিয়েছিল। তাই তাঁর জন্মের সময় পর্যন্ত মুক্ত ধর্মের চর্চা লোপ পেয়েছিল। অবশ্য ১৯৭৭ সন থেকে এর বাধ্য বাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।তারপর থেকে কিছুসংখ্যক মানুষ পুনরায় ধর্ম চর্চা করতে শুরু করেছে। তথাপি শ্রীমতী পাভলভ এখনও এই বিষয়ে অভ্যস্থ হতে পারেন নি।

     প্রার্থনার শেষে নাটালিয়া বড় আগ্রহের সঙ্গে খেতে লাগল। মা লিডিয়া নিজে খাওয়ার চেয়ে মেয়ের খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।অর্ধেক খাবার পরে মা জিজ্ঞেস করল-‘ তোর আজকের কথা বলতো। ঠিকানা জোগাড়  হয়েছে কি ?স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’ 

    নাটালিয়া বলল-‘ অধ্যাপক পুঝিনই কেবল বেঁচে আছেন। ঠিকানা পেয়েছি -কিয়েভে থাকেন। স্যার ক্রিয়োসকভ আমাকে যত দ্রুত সম্ভব গিয়ে আলোচনা করতে বলেছেন।

     লিডিয়া পাভলভনা চুপ করে রইলেন। নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল-‘মা কিছুই বললে না দেখছি। আমাকে কিন্তু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তার আগে স্যার ক্রিয়োসকভ আমাকে একবার ইয়াস্নায়া  পলিয়ানা গিয়ে আসতে বলেছে ।শৈশবে তুমি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে, এবার কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যাব। আমার জলপানির পয়সায়’ ।

    মেয়ের কথা শুনে মায়ের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তবুও কিছু সময় তিনি মনে মনে রইলেন। তারপরে খাবারে মনোযোগ দেওয়ার মতো করে জিজ্ঞেস করলেন -‘ইয়াস্নায়া পলিয়ানায় না হয় গেলাম। কিন্তু কিয়েভে তোকে যেতেই হবে নাকি?’ নাটালিয়া সামনে বসে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল -‘তুমি কেন এভাবে জিজ্ঞেস করছ?’

    মেয়েকে খাবার ছেড়ে বসে থাকতে দেখে লিডিয়া পাভলভনা কিছুক্ষণ মনে মনে রইলেন। তারপর বললেন-‘মা, আমি বলব। পরে বলব । এখন তুই খেয়ে নে তো ।’

    কিছুক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নাটালিয়া খেতে লাগল।খেয়ে উঠা পর্যন্ত সে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। 

    মায়ের সঙ্গে রান্না ঘরের সমস্ত কাজ সামলে নিয়ে নাটালিয়া আগ্রহের সঙ্গে মায়ের কথা শোনার জন্য ওদের ছোট বৈঠকখানা ঘরে এসে বসে রইল। শ্রীমতী পাভলভ এটা ওটা করে কিছুটা সময় কাটালেন ।তারপর এসে মেয়ের কাছে একটা সোফাতে বসলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইলেন।’ মা ‘-নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল -‘তুমি কী বলবে বলে বলেছিলে?’

    লিডিয়া পাভলভনা কিছুক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘বলব মা। কথা অনেক রয়েছে আর তা দীর্ঘকালীন।’

    বৈঠকখানা ঘরের ছোট শোকেসটার ওপরে কয়েকটি ফোটো সাজিয়ে রাখা ছিল।তারই একটি ছিল লিডিয়া পাভলভনার -দুই বছর বয়সে বাবা পাভলভ টেলপুগভের কোলে ওঠে উঠা একটি ধূসর সাদা কালো ছবি এবং অন্য একটি তার মেয়ে নাটালিয়া এবং স্বামী নিকোলাই ডেভিডভিসের সঙ্গে তোলা একটি পরিষ্কার ফোটো।

    সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে লিডিও পাভলভনা বলল -‘মা,তুই জানিস আমি বাবাকে ছোট থাকতে হারিয়েছি ।সবাই বলেছিল বাবা নাকি মাকে বড় ভালোবাসতো ।দুই বছর বয়সে যে চলে গেল সে আর ফিরে এলনা ।আমি মনে রাখতে পারার মতো তাকে দেখতেই পেলাম না।’

    লিডিও পাভলভনা বলে গেল তার বাবা টেলপুগভের কথা ।তিনি রেডগার্ড ছিলেন ।বলশেভিকরা এখনকার লেনিনগ্রাড এবং তখনকার পেট্রোগ্রাড উইন্টার প‍্যালেস  দখল করার এক সপ্তাহ পর্যন্ত মস্কোর রাজপথে স্থানীয় সরকারের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে তুমুল গোলাগুলি নিয়ে যুদ্ধ করে গিয়েছিল। তারপরে সরকার ফেলে দিয়ে বলশেভিকরা ক্রেমলিন দখল করতে পেরেছিল ।সেই দলে বাবা পাভলভ টেলপুগভও  ছিলেন‌। আহত না হওয়া পর্যন্ত বাবা তখন থেকে মস্কোর আশেপাশে চাকরি করতেন। লেনিনের মৃত্যুর পরে স্টালিনের অধীনেও কাজ করেছিলেন ।কিন্তু স্টালিনের একনায়কত্বে মানুষের মনে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে লাগল। ক্ষমতায় আসার চার বছর পর থেকে তিনি নিষ্কণ্টক হওয়ার জন্য তার প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকা মানুষগুলোকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। কিছুক্ষণ থেমে লিডিয়া পাভলভনা বললেন-‘ বাবা ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক ।তবুও লাঝারের প্রতি থাকা তার অনুকম্পার খবর স্টালিনের অনুচর বাহিনী পেয়েছিল। সেই জন্য তাকে প্রথমে লেনিনগ্রাদের এবং পরে কিরভের অনুগামী বলে জানতে পেরে শ্বেতসাগরের প্রণালী তৈরি করা কয়েদিদের তদারক করার জন্য শ্বেতসাগরের উপকূলে বদলি করে পাঠিয়েছিল। সরকারকে সমর্থন না করা সবাইকে পূর্ণোদ্যমে বিচার করার জন্য আদেশ দেওয়ার রাতেই কিরভের মৃত্যু হল। প্রকৃতপক্ষে তাকে হত্যা করা হল। সেটা ছিল ১৯৩৪ সালের পহেলা ডিসেম্বর। তার কয়েক মাস আগে থেকে পাভলভ টেলপুগভের খবর আর পাওয়া যাচ্ছিল না। মানুষ ফিসফিস করে বলাবলি করছিল –কয়েদিদের  সঙ্গে তাকেও নাকি হত্যা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শ্বেতসাগরের প্রণালী তৈরি করা কয়েদির ছাউনিটা সাইবেরিয়াতে থাকা অনেক ছাউনির মতো একটা গুলাগই (সেল)ছিল।’

    কথাগুলি বলতে বলতে লিডিয়া পাভলভনা কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইল। তারপর রুদ্ধ কন্ঠে নাটালিয়াকে বলল-‘বুঝেছ মা আমার বাবা,লেলিনগ্রাডে বদলি হয়ে যাবার এক সপ্তাহ আগে সেই ছবিটা তুলেছিল। বাবা যে গেল তিনি আর ফিরে এলেন না।’ লিডিয়া পাভলভনা কদাচিৎ কখনও খাওয়ার মতো একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিয়েছিলেন।ঘরটিতে তার একটা ফুরফুরে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। সিগারেটটা জ্বলতে জ্বলতে সামনের অংশে ছাই জমা হতে লাগল। ধীরে ধীরে তাঁর আঙ্গুলে তার উত্তাপ লাগল। তিনি সচেতন হলেন এবং সামনের টেবিলে থাকা ছাইদানিতে সিগারেটটা গুঁজে দিলেন।

     নাটালিয়া মায়ের কাছে এসে বসল। সে কিছুই বলল না। লিডিয়া পাভলভনা পুনরায় বলতে লাগল-‘ তোকে নিয়ে বাবার সঙ্গে আমরা ইরকুটস্কে খুব ভালোভাবেই ছিলাম। কিন্তু সেই সময়ে তিনি একদিন সার্ভের কাজের জন্য বৈকাল হৃদের কাছে গেলেন। সেখানে দুর্ঘটনা ঘটল।তোর বাবার মৃত্যু হল।

    বৈকাল হৃদ বিশাল ভূতাত্ত্বিক বিচ্যুতিতে তৈ্রি হওয়া নির্মল জলের হ্রদ বলে নাটালিয়া জানে। আর জানে চারপাশের পাহাড়গুলি নয় হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু বলে। হৃদের কাছের পাহাড়িয়া পথে দুর্ঘটনা ঘটাটা অস্বাভাবিক নয় ।নীরব হয়ে পড়া মায়ের হাত একটা নাটালিয়া অনেকক্ষণ ধরে রইল।

     ‘এইজন্যই মা,’ লিডিয়া পাভলভনা বললেন-‘কেউ দূরে যাবে বললে আমার ভয় হয়। তুই কিয়েভে না গেলে হয় না?

*আগের অধ্যায়ে একটা ভুল থেকে গেছে। ‘বলশ্বই’ রঙ্গমঞ্চের জায়গায় ভুলে বলশেভিক রঙ্গমঞ্চ হয়ে গেছে।এই অনিচ্ছাকৃ্ত ভুলের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

      

      

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত