| 25 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-৩) । ডঃদীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃদীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা,অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন,প্রব্রজন ,ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi,New Delhi ,2010) এবং The Highlanders(Blue Rose Publishers, New Delhi,2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন,কলকাতা,২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-৩।


   

 

কিয়েভে যাবার জন্য মা লিডিয়া পাভল’ভনাকে রাজি করাতে নাটালিয়ার দুদিন সময় লাগল। সে মাকে বলতে লাগল-‘মা, তুমি নাকি যুবতি কালে শরৎ মহোৎসব কোয়াড্ৰিল নাচ নাচার জন্য কিসিনেভে গিয়েছিলে। রিগালৈ পর্যন্ত গিয়েছিলে । তাই নয় কি?’

    শ্রীমতী পাভলভ কথাটা অস্বীকার করতে পারলেন না। হ্যাঁ ,তিনি একসময় এই ধরনের লোকউৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।লেটাভিয়ার দ্বীনা  নদীর পারে যখন বাৎসরিক সঙ্গীত মহোৎসব হয়েছিল তখন সেখানে নিমন্ত্রণ পাওয়া নৃত্যশিল্পী দলে তিনিও ছিলেন‌। তাছাড়া মলডাভিয়ার নিস্তব্ধ নদীর কাছে বিস্তৃত সবুজ ঘাসে তিনি নিজের সহশিল্পীদের সঙ্গে কোয়াড্রিল নৃত্য নেচেছিলেন । কিসিনেভ থেকে মলডাভিয়া ঝক শিল্পীরা এসেছিলেন ।ঝক মানে ছিল নৃত্য। যখন খাদ্যের ভাঁড়ার উপচে পড়ে এবং পিপাগুলিতে নতুন শস্য থেকে মদিরায় নেশাগ্রস্ত হয় , তখন নাকি মলডাভিয়ারা বলে-খেয়ে নাও ঝক-ঝক মারতে যাই চল। তারপরে চৌরাস্তায় মুক্ত মাঠে নদীর পাশে বা মিলের সামনে মুক্ত উঠোনে যুবক বৃদ্ধ যুবতি বধু প্রত্যেকেই হাত ধরে ধরে বৃত্ত করে ঘুরে ঘুরে মজার মজার গান গেয়ে দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে শুরু করে। শরৎ মহোৎসবে এই নৃত্য ছাড়া মেষ পালকরা  চোখ জুড়ানো কেলুছারী নৃত্য ও প্রদর্শন করে। নৃত্যটিতে  হাসি-ঠাট্টা প্রিয় মলডাভিয় মানুষগুলির মানসিকতা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। সঙ্গে প্রকাশ পায় তাদের রীতিনীতি। সবার আগে গ্রামের একজন বয়স্ক মানুষ কমেডিয়ানের অভিনয় করে। পরে তার কাছে গ্রামের কামার হাঁটু ভেঙ্গে কুঁজো হয়ে নাচতে নাচতে নৃত্য শুরু করে। তারপর আসে জাতীয় পরিচিতির বিচিত্র বর্ণের  কাপড়ে ফুল তোলা সাদা ব্লাউজ পরা হাসিমুখের সুগঠিত যুবতিরা। ওরা চারপাশ ঘিরে নাচতে শুরু করে। তারপরই মেষের ছালের অমসৃণ টুপি পরা যুবকেরা এক এক করে এসে ওদের ঘিরে ধরে নাচতে নাচতে নৃত্যের উজ্জ্বলতা বাড়ায় ।

    লিডিয়া পাভল’ভনার মনে পড়ল সেখানে বিস্তর পরিমাণে হওয়া আঙ্গুরের ভালোবাসা জ্ঞাপন করে নাচা নৃত্যের  কথা । সেগুলো ছিল মনোমুগ্ধকর উৎফুল্লদায়ক এবং চোখ জুড়ানো এই নৃত্য গুলি বন্ধের দিনে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলত। ১৮২০ সনে কবি আলেকজান্ডার পুশকিন যখন মলডাভিয়ায় নির্বাসন কাটাচ্ছিলেন তখন তিনি নাকি ঝক নৃত্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার প্রিয় নৃত্য ছিল মিটিটিকা।

    যুবতি কালের এই স্মৃতি লিডিয়া পাভল’ভনার মন কোমল করে তুলল। তাঁর মনে পড়ল ইতিহাসের কথা। বাইক নদীর তীরে পাঁচ শতকের আগে ছোট একটি গ্রাম নিয়ে আরম্ভ হওয়া কিসিনেভ পরবর্তীকালে সাতটি ছোট ছোট পাহাড়ে বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল এবং কয়েকটি টিলায় পাথরের কয়েকটি পুরোনো গির্জা গড়ে উঠেছিল। এই টিলায় তিন বছরের মতো কাল কাটানো কবি পুশকিনের ঘরটি জাদুঘর হিসেবে লিডিয়া নাচতে যাবার সময় যুবতি কালেই দেখতে পেয়েছিল। জাদুঘরের সামনে স্থাপন করা কবির একটি মূর্তিও সে দেখে এসেছিল।

    মেয়ে নাটালিয়ার কথা শুনে লিডিয়া পাভল’ভনা বললেন-‘ গিয়েছিলাম, কিসিনেভের সেইউৎসব গুলিতে গিয়েছিলাম। বড় সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি।’

    নাটালিয়ার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে বলল-‘সেখানেই তোমার সঙ্গে বাবার দেখা হয়েছিল, তাই না?’

     হ্যাঁ, নিকোলাই ডেভিডভিসকের সঙ্গে সেখানেই তার দেখা হয়েছিল। লিডিও পাভল’ভনার মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

    ‘ জানি জানি।’- নাটালিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল-‘ তুমি যে কথাগুলো বলেছিলে, ভুলে গেলে?’

     লিডিয়া পাভল’ভনা বললেন-‘ দুষ্টু মেয়ে,ভুলে যাইনি।’ 

    নাটালিয়া বলল-‘আমারও কারও সঙ্গে দেখা হবে বলে তোমার ভয় হচ্ছে ?’

    শ্রীমতী পাভলভ এবার গম্ভীর হলেন। তিনি বললেন-‘ সত্যিই ভয় হয় নাটচেংকা।’

    তিনি বললেন-‘ তুই কিয়েভে  যাবি। কিন্তু বন্ধুত্ব করার সময় সাবধান হবি। সমস্ত মানুষ তোর বাবার মতো দায়িত্বশীল নয়।’

    নাটালিয়া মুচকি হাসল। একহাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল- ‘ভয় কর না।’

    কিছুক্ষণ পরে বলল-‘ পরশুদিন বন্ধ।ইয়াস্নায়া পলিয়ানার উদ্দেশে বের হবে।’

    আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। কিয়েভে যাবার আগে  অধ্যাপক ক্রিয়োসকভের সঙ্গে নাটালিয়াকে দেখা করতেই হবে। আগামীকাল তার কাছে গেলে ফিয়ডর ইভানভিছের সঙ্গে দেখা হবে কি?

    পরের দিন কিন্তু নাটালিয়া অধ্যাপকের দেখা পেল না। তিনি ছুটিতে ছিলেন।

    বন্ধের দিন সকাল নটার সময় যাত্রা আরম্ভ করে ইয়াস্নায়া পলিয়ানা পেতে নাটালিয়াদের তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগল। টুলা পার হয়েও ওদের আরও কিছু সময় চলতে হল। পৌঁছাতে পৌঁছাতে দিনের প্রায় একটা বেজে গেল। ইয়াস্নায়া পলিয়ানা উজ্জল রোদে উষ্ণ হয়েছিল। যতই কাছে গেল ততই গাছগুলির শরীর থেকে খসে পড়া চটচটে সাদা ছালগুলি নাটালিয়ার চোখে পড়তে লাগল। তার আরও চোখে পড়ল এক পাশে ঢালু হয়ে ডানদিকে ওপরে উঠে যাওয়া  লাল মাটির পথ।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২)


     দেশি-বিদেশি অনেক মানুষ আজ এসেছে। প্রত্যেকেই নীরবে পথটা  দিয়ে হেঁটে চলেছে। সেইসবের মধ্য দিয়ে  নাটালিয়া মায়ের পাশে পাশে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে ঢালু পথের ডান পাশে তারা দেখতে পেল কয়েকটি বুড়ো শক্ত বার্চ গাছ। তার নিচে আছে গাছের ছাল দিয়ে তৈরি অমসৃণ একটি পুরোনো চাং।তার কিছুটা আগে ডান পাশে আছে একটি ছোট গভীর খাল।তার ওপরে আছে একটি ছোট সাঁকো,সেই একই ধরনের গাছের ছাল দিয়ে তৈরি।টলস্টয় নাকি মাঝে মধ্যে চাংটাতে বসতেন। সাঁকোর ওপর দিয়ে খালটা এপার ওপার করতেন।এই সমস্ত কিছুর সাক্ষী হয়ে বুড়ো বার্ছ গাছ কয়েকটি যেন নিরলে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    দুপাশের সবুজ গাছ পালার মধ্য দিয়ে লাল মাটির পথটা একপাশে ঢালু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে।বাঁদিকের পথের পাশে ছিল চাঙে বাইতে থাকা আঙুরের লতা।তার ওপাশে উঁচু বড় সবুজ গাছের পাশে পাশে ছিল আপেল এবং আখরুটের গাছের সারি। সেইসবের মাঝে মধ্যে তাঁরা নীরবে যেতে থাকল।

    কিছুক্ষণ পরে তারা গিয়ে একটা সমান জায়গা পেল। সেটাই ছিল টলস্টয়ের ঘরের উঠোন।উঠোনের দুপাশে ছিল দুটো সাধারণ কাঠের ঘর-যেন গ্রামে বসবাস করা একজন চাষার ঘর। এখানেই বাস করতেন কাউন্ট লিও টলস্টয়।

    উঠোনে সমবেত বিদেশি ভ্রমণকারী দুজন স্টেণ্ডের ওপরে ক্যামেরা রেখে ছবি তুললেন।অন্যেরা উঁকি দিয়ে দিয়ে নিজেদের ক্যামেরায় ছবি তুললেন। দুয়েকজনকে কাঁধের ব্যাগ থেকে নোটবুক বের করে নোটস নিতে ও দেখা গেল। অন্যদের হাতে ক্যামেরা ছিল না,নোটবইও ছিল না।ছিল কিছু ফুল অথবা গাছের সুন্দর পাতা। নাটালিয়া এনেছিল একটা রঙিণ ফুল।

    নাটালিয়া প্রথমে ডানপাশের ছোটোখাটো দোতালার ঘরটার কাছে গেল।ঘরটাতে ঢুকেই পাওয়া গেল একটা ছোট বৈঠকখানা ঘর।তারপরেই পাওয়া গেল টলস্টয়ের নিজের পাঠাগারটা-পৃথিবীর ছয়ত্রিশটা ভাষার কুড়িহাজার বইয়ের গ্রন্থাগার।

    টলস্টয়ের মা কাউন্টেস মারিয়া নিক’লায়েভনা টলস্টয় উনিশ শতকের পরিবেশে অতি শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। মায়ের স্মৃতি লিখে টলস্টয় লিখেছিলেন –রুশ ভাষা ছাড়া মা ফরাসি,জার্মানি,ইংরেজি এবং ইতালি ভাষা জান্তেন।তিনি পিয়ানো বাজাতে পারতেন এবং এত সুন্দর রূপকথার গল্প বলতে পারতেন যে শুয়ে শুয়ে শুনতে থাকা শিশুরাও ওঠে বসতেন এবং তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে গল্প শুনতেন।

    নাটালিয়ারা বাঁদিকের ঘরটাতে প্রবেশ করলেন।ঘরটা সংকীর্ণ এবং একটা দীর্ঘ টেবিল।পাশে একটা নিচু টেবিল এবং টেবিলের নিচে একটা অপ্রয়োজনীয় কাগজ ফেলার বাঁশের তৈরি খাং। টেবিলে সাজানো ছিল দোয়াত কলম।আর তার পাশে ছিল কিছু সাদা কাগজ।এখানেই-এখানেই টলস্টয় লিখে গেছেন তাঁর মহান গ্রন্থগুলি।হাজার হাজার পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিগুলি এখানেই অসীম ধৈর্যে শুদ্ধ করেছিলেন,পুনরায় লিখেছিলেন।আর হয়তো এখানেই পাশে বসে পত্নী সোফিয়া টলস্টয় ছাপার জন্য সেগুলির প্রতিলিপি লিখে বের করেছিলেন।

    নাটালিয়া স্থিরভাবে টলস্টয়ের লেখার ঘরের সমস্ত আসবাব দেখে গেল।চেয়ারের বাঁদিকে রয়েছে একটা বিশাল জানালা।জানালাটি থেকে ইয়াস্নায়া পলিয়ানার টোলটার সবুজ গাছপালাগুলি দেখা যাচ্ছে।হয়তো লিখতে লিখতে ক্লান্ত বোধ করলে সেদিকে তাকিয়ে মন জুড়োতো।

    পর্যটকরা যতটা সম্ভব চুপ করেই ছিল।কখনও কারও অস্ফুট কন্ঠের দুই একটি কথা ভেসে আসছিল।তার মধ্যে কোনো যুবতি গাইড অনুচ্চ অথচ স্পষ্ট কন্ঠে কথাগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিল। টলস্টয় কখনও কখনও টেবিলে সাজিয়ে রাখা দাবা খেলার দিকেও তারা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল।

    মহান লেখকের বসবাস করা ঘরের দেওয়ালে একটা তৈলচিত্র ছিল।একজন দাড়িওয়ালা বুড়ো মানুষ মুক্ত আকাশের নিচে একজোড়া ঘোড়ায় হাল বাওয়ার ছবি গাইড মেয়েটি ছবিটার বিষয়ে কিছু বলছিল।নাটালিয়া সেদিকে লক্ষ্য করছিল না।চারপাশে মনোযোগ দিয়ে বস্তুগুলি দেখে যেতে লাগল। সে উঠোনটার বাঁদিকে থাকা কাঠের ঘরটার শোবার ঘরে ঢুকে গেল।

    শোবার ঘরটা ছিল সাধারণ এবং মাঝারি আকারের।এই ঘরটিতে টলস্টয় পত্নী সোফিয়ার সঙ্গে জীবনের চুয়ান্নটা বছর কাটিয়েছিলেন। তাঁরা ব্যবহার করা বিছানার সঙ্গে অন্য আসবাবগুলি একভাবেই সাজানো ছিল।একটা দেওয়ালে ছিল পরিবারের কয়েকজনের গ্রুপ ফোটো।অন্য একটি দেওয়ালে ছিল ম্যাডোনার একটি তৈলচিত্র।

    মূল শোবার ঘরটি থেকে নাটালিয়ারা অন্য মানুষদের সঙ্গে পাশের একটি ছোট ঘরে ঢুকে গেল।সেখানে ছিল বাইরের দিকে যাওয়া দুটি দরজা এবং একটি বিশাল জানালা।দেওয়ালের পাশে চিকিৎসালয়ের বিছানার মতো একটা লোহার ছোট খাট ছিল।সাদা চাদরে ঢাকা ছিল।এটাই ছিল টলস্টয়ের শেষ শয্যা।অষ্টাপ’ভ স্টেশন থেকে তাঁর নশ্বর দেহ এনে হাজার হাজার দর্শকের জন্য এখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছিল।শয্যার মাথার দিকে রাখা ছোট বেতের চেয়ারটাতে বসে দুই একজন তাঁর নিশ্চল হাতে নাকি চুমো খেয়েছিল।

    মায়ের সঙ্গে নাটালিয়া অনেক সময় সেখানে দাঁড়িয়ে নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপরে সে মায়ের হাত ধরে ছোট একটি দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল।

    বাইরের রোদের তীব্রতা কমে এসেছিল। পশ্চিম দিক থেকে হালকা মেঘ ধীরে ধীরে সূর্যকে ঢেকে ফেলছিল। একঝাঁক বাতাস ও বইছিল। ধীরে ধীরে তার বেগ বেশি হয়ে এল।

    নাটালিয়ার মা লিডিয়ে পাভল’ভনা কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা পাতলা স্কার্ফ বের করল এবং কান ঢেকে মাথায় বেঁধে নিল।নাটালিয়া পরনের কোটটার দুটো বুতাম আটকে লাল মাটির অন্য একটি পথ দিয়ে মা এবং অন্য মানুষদের সঙ্গে যেতে লাগল।

    দুপাশে ছিল বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত বার্ছ এবং মেপল গাছের একটি পাতলা অরণ্য। লালমাটির পথটা গাছের গুড়িগুলির মতো মেপল গাছের শুকনো হলদে পাতায় ঢাকা পড়ে ছিল। সেই পাতাগুলি মাড়িয়ে মাড়িয়ে তারা জঙ্গলের পথটার এক প্রান্তে এসে দাঁড়াল।  

    জায়গাটার কয়েকটি উঁচু বুড়ো গাছের নিচে ছিল অনেকটা প্রশস্ত চিকুন ঘাসের আচ্ছাদন।তারমধ্যে ছিল সবুজ বনে ঢেকে থাকা একটা ছোটোখাটো নাতিদীর্ঘ মাটির ঢিপি।অনুচ্চ ঘাসের বেড়া দিয়ে ঘেরা।সেটাই ছিল টলস্টয়ের কবর।

    বাতাসে চারপাশের উঁচু বুড়ো গাছগুলি থেকে উড়ে উড়ে একটা দুটো গাছের শুকনো পাতা এসে কবরটার ওপরে এসে পড়ছিল।

    কবরটার এক প্রান্তে যাত্রীরা কিছু ফুল রেখে গিয়েছিল।বিচিত্র ফুলগুলি সেখানে জমা হচ্ছিল।

    নাটালিয়া সেখানে ঢুকে গেল এবং হাতে করে আনা উজ্জ্বল বর্ণের লাল ফুলগুলি অন্য ফুলগুলির সঙ্গে আলগোছে সাজিয়ে রাখল।লাল মাটির পথটা দিয়ে এসে থাকার সময় মা লিডিয়া পাভল’ভনা এনেছিল পাশেই নতুন করে এসে পড়া মেপল গাছের হলদে রঙের একটা পাতা।নাটালিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তিনিও পাতাটা মহান লেখকের কবরের ওপরে সাজিয়ে রাখল।নিরল পরিবেশে মেয়ের সঙ্গে তিনিও কিছুক্ষণ মৌন হয়ে প্রার্থনা করলেন।

    ওরা যখন অন্য মানুষগুলির সঙ্গে লালমাটির পথটা দিয়ে নীরবে ফিরে এল তখন দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।নাটালিয়া তার গালে এসে পড়া বৃষ্টির দুই একটি ফোঁটা রুমালে আলগোছে মুছে নিল-যেন সে চোখের জল ফেলছে।

    সে বহু সময় নীরব হয়ে রইল।

    বৃষ্টির ফোঁটাগুলি বড় হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে কাঁধের ব্যাগটা থেকে একটা টুপি বের করে পরে নিল-‘মা,আমরা এখন তপোবন থেকে ফিরে এলাম। একজন ঋষির তপোবন।’

    মা কিছুই বললেন না।

    নাটালিয়া পুনরায় বলল –‘এই ধরনের জায়গায় এলে মানুষ অন্তর্মুখী হয়।’

    লিডিয়া পাভল’ভনা গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছিলেন।তিনিও অন্তুর্মুখী হয়েছেন। তাঁর টলস্টয় ভক্ত ভলক’ভ রিয়াজন’ভের কথা মনে পড়ছিল।

    তিনি মেয়ের কথার কোনো উত্তর দিলেন না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত