| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-৮) । ডঃদীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃদীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা,অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন,প্রব্রজন ,ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi,New Delhi ,2010) এবং The Highlanders(Blue Rose Publishers, New Delhi,2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন,কলকাতা,২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-৮।


 

 

    ফিয়োডরের সঙ্গে নাটালিয়া এক সপ্তাহ পরে ভলগ’গ্ৰাডে উপস্থিত হল। জায়গাটা গোর্কি, কাজান,ক‍্যুবিসেফ, সারাটভ এবং আস্ট্রাখনের মতো ভলগার পারের একটি উন্নত মহানগর। এটা ভল্গা-ডন প্রণালীর পুবদিকের শেষ প্রান্ত। তাই মস্কো থেকে শহর পর্যন্ত জলপথ দিয়ে যোগাযোগ সুবিধাজনক। তথাপি নাটালিয়া রেলে এসে মহানগরের বড় জংশনটাতে নেমে পড়ল।

    শহরটা ১৫৮৯ সনে জারিটশ্যন নাম দিয়ে সীমান্তের পাহারাদার হিসেবে পাতা হয়েছিল। তথাপি ১৮০০ সন পর্যন্ত তার বিশেষ উন্নতি হয়নি। তারপরে ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কুড়ি শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষের গৃহযুদ্ধ এবং বিপ্লবে রেড আর্মি শহরটির হোয়াইট আর্মিকে পরাজিত করে কমিউনিস্ট শাসনে এনেছিল। লেনিনের মৃত্যুর এক বছর পরে ১৯২৫ সন থেকে শহরটির নাম লেনিনগ্ৰাড করা হয়েছিল । কিন্তু স্টালিনের মৃত্যুর পরে তার কঠিন শাসনকালের স্মৃতি ভুলে যাবার জন্য শহরটিকে পুনরায় ১৯৬১ সনে ভল্গগ্ৰাড করা হয়েছিল।

    ফিয়োডর এবং নাটালিয়া শহরটির একটি হোটেলে উঠে নিনা ভল’কভনার বাড়ির খোঁজে শহরটি থেকে সাত মাইল দূরের অঞ্চলটিতে  গেল । গিয়ে বুঝতে পারল দু-একটি মার্গে এখনও স্টালিনের মুষ্টিমেয় সমর্থক রয়েছে। তাদের মতে বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বিধ্বস্ত হওয়া  শহরটি স্টালিনের আমলেই পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে।১৯৫৩ সনে স্টালিনের মৃত্যুর পরে বাধা-নিষেধ গুলি শিথিল হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার নির্দোষী লোককে কারাগার থেকে মুক্ত করার পরেও কিছু মানুষের আগের নেতার প্রতি প্রীতি নষ্ট হয়ে যায় নি। পেরেষ্ট্রইকা এবং গ্লাসনষ্টের জন্য পাওয়া কঠিন সময়ের খবর গুলিও তাদের প্রশমিত করতে পারেনি। তারা এখনও কমিউনিস্টের কাগজপত্র মাঝে মধ্যে বিতরণ করে চলেছে।

    ফিয়োডর এবং নাটালিয়া বুঝতে পারল মস্কো এবং লেনিনগ্রাডে  যে আধুনিকতা আসতে শুরু করেছে ভলগ’গ্ৰাডে তার প্রভাব  এখনও ভালোভাবে পড়ে নি। ওরা যেন কিছুটা  অতীতের দিকে  গতি করেছে। ওরা চলাফেরা এবং কথাবার্তায় নিজেকে কিছুটা সামলে নিল ।

    বাড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল।

    নিনা ভলকভনা লেপিনা তখনও কাজ থেকে বাড়ি ফিরে আসেনি। মহিলার স্বামী ইগর ডেভিডভিচ লেপিনের সঙ্গে কিছুটা সময় তাদের কাটাতে হল। মিস্টার লেপিন নাটালিয়ার মায়ের কথা জানে। কেননা তাঁর পরিবার মস্কো যাওয়ার সময় লিডিয়া পাভল’ভনার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তাকে বলেছিল । 

    শ্রীমতী লেপিনা কাজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত ইগর ডেভিডভিচ নাটালিয়াদের  সঙ্গে খোলা মনে  কথাবার্তা বলল না । তিনি বড় সংকট পূর্ণ সময়ের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। তথাপি তিনি গত ছয় মাস আগে পর্যন্ত চিকিৎসা সম্পর্কে রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা পেশাটা মন দিয়ে করছিলেন। তাছাড়া তিনি একজন লোক নৃত্যশিল্পী ছিলেন। পেশার জন্য নয় শিল্পী মনোভাব থাকার জন্যই তিনি নিনা ভলকভনা লেপিনার মনের কাছাকাছি আসতে  পেরেছিলেন।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-৭)


    মিঃলেপিন নাটালিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন-‘ আমি শুনতে পেয়েছি তোমার মা নাকি একজন ঝক -শিল্পী ছিলেন?’

    ‘হ্যাঁ।’- মায়ের কথা বলতে পেরে নাটালিয়ার ভালো লাগল ।-‘ কিসিনেভের শরৎ  মহোৎসবে যাওয়া নৃত্যের দলে মা কয়েকবার সেখানে গিয়েছিল।’

    মিঃলেপিন এবার ফিয়োডরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-‘ তোমার বাড়ি কোথায় বলেছিলে?’ লেনিনগ্রাডে?’

    ‘ হ্যাঁ’, সেখানই মূল বাড়ি ছিল।’- ফিয়োডর  বলল-‘ কিন্তু আমার জন্ম কালিনিনগ্রাডে এবং সেখানেই আমি বড় হয়েছি। পরবর্তীকালে কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির শিক্ষা লাভ করেছি লেনিনগ্রাডে।

    ‘ কালিনিনগ্রাড? কালিনিনগ্রাডে তোমার জন্ম?’

    ‘ হ্যাঁ, আমার বাবা সেখানকার বন্দরে চাকরি করত। প্রেগেল নদীর কাছে আমরা ছিলাম।’

    ফিয়োডরের  উত্তর শুনে ইগর ডেভিড’ভিচ লেপিন  বললেন-‘ও, বাল্টিক সাগরের  বন্দরে? সেই বন্দরে তো সারা বছর একফোঁটা বরফও জমা হয় না, নয় কি?’

    ফিয়োডর সম্মতি জানাল।

    বাল্টিক সাগরে প্রেগেল  নদী থেকে জাহাজ চালানোর জন্য প্রণালী আছে। প্রকৃতপক্ষে প্রেগেল  নদীর তীরেই  বন্দরটা। এখানে বরফ জমে না। সেই জন্যই সারা বছর বন্দরটা বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা প্রধান কেন্দ্র।

    মানুষটা তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটার দৃষ্টি তার বড় গভীর অনুভূত হল।

    তিনি বললেন-‘ আমি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা মানুষ। আমি টলস্টয়ের বিষয়ে এত পড়াশোনা করি নি। নিনা পড়েছে, নিনা জানে।’

    ‘ কিন্তু’,-তিনি বলে যেতে লাগলেন-‘ আমি টলস্টয়ের একটা কথা জানি। সেটা হয়েছিল মস্কোর কনজারভেটরিতে।পিয়টর সাইকোভস্কি সেখানে একদিন সন্ধ্যাবেলা তাঁর আনডান্টের প্রথম কোয়ার্টেট  বাজাচ্ছিলেন। সঙ্গীতজ্ঞের সেই মধুর সুর শুনে টলস্টয়ের দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।’ 

    কথাটা বলে মানুষটা চুপ করে রইলেন।

    ফিয়োডর  এবং নাটালিয়ার কাছে কথাটা নতুন নয় যদিও ওরা  উঁচু লম্বা এই ইগর ডেভিডভিচ লেপিন নামের মানুষটার দিকে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে রইল।

    ফিয়োডর কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই শ্রীমতী লেপিনা প্রবেশ করলেন। তার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এলেন একটা অন্য অন্য ধরনের বাতাবরণ । তিনি তার স্বামীর চেয়েও উচ্চ পর্যায়ের পদে চাকরি করেন । চিকিৎসালয়ের নার্সের একটা বিষয় মন প্রাণ দিয়ে পরিচালনা করেন ।

    নিনা ভলক’ভনা লেপিনা নাটালিয়া এবং ফিয়োডরের খবর টেলিফোনের মাধ্যমে কার্যালয়ে থাকতেই পেয়েছিলেন ।

    ‘তুমিই নাটালিয়া নয় কি?’- তিনি হেসে নাটালিয়ার গালে গাল রেখে আদর করলেন। তার সঙ্গে আনা বাজারের ব্যাগ সযত্নে এক জায়গায় রেখে জলের কলে হাত ধুয়ে মুছে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল বসিয়ে ফিয়োডরদের সঙ্গে এসে বসলেন ।

    ‘ লিডিয়া কেমন আছে নাটালিয়া?’

    নাটালিয়া নিনা ভলক’ভনার দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষটা এমন একটি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এবং দৃঢ় মনে কাজগুলি করে চলেছেন যে প্রতিটি কাজে তাঁর আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠেছে। নাটালিয়ার ভালো লাগল।

    সে বলল-‘ মার ভালো সখী। তোমার জন্য মা একটি ফ্রুট কেক দিয়ে পাঠিয়েছে।’

    ‘ সত্যি’- শ্রীমতী লেপিনা নাটালিয়া এগিয়ে দেওয়া কেকটা নিয়ে বলল-‘ এটা আমাকে অতীতের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। কাকিমা অর্থাৎ তোমার দিদিমা আমাকে শৈশবে প্রায়ই কেক দিতেন। সেই সময় তিনি যেডার নামে বিখ্যাত বেকারিটিতে কাজ করতেন।’

    ‘ হ্যাঁ’- নাটালিয়া সম্মতি জানিয়ে বলল-‘ মা সমস্ত কিছু বলেছে।’

    নিনা ভলক’ভনা উঠে গিয়ে চার কাপ কফি করে আনলেন। কফি খাবার সময় হাতের ফুটবল নিয়ে একজন কিশোর প্রবেশ করল। এলেক্স- লেপিন পরিবারের ষোলো বছরের ছেলেটি।

    সে ভেতরে যাবার পরে নিনা ভলক’ভনা কয়েক মিনিটের জন্য উঠে গেলেন এবং তাকে কিছু কথা বুঝিয়ে পুনরায় বাইরে এসে নাটালিয়াদের সঙ্গে বসলেন ।

    শ্রীমতী লেপিনা তাঁর এবং নাটালিয়ার মায়ের কথা বলে কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিলেন। তারপর কিছু সময় চুপ করে রইলেন। কিছু একটা বলতে গিয়ে তিনি স্বামী ইগর লেপিনের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ তুমি এলেক্সের পড়াটা একটু দেখবে নাকি? টিভিতে খেলা রাত আটটার সময় শুরু হবে।’

    গত রাতেও এলেক্সের পড়াশোনা কিছু সময়ের জন্য ইগর ডেভিডভিচ দেখেছিল। কিছুক্ষণ পরেই টিভিতে খেলার অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছিল। সেইজন্য পরের এক ঘন্টার জন্য নিনাকে নিজে ছেলের পড়াশোনা দেখতে হয়েছিল। খেলা দেখে আমি বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত সময়টুকু ছিল নিনা ভলক’ভনার একান্ত নিজস্ব। তিনি এক কাপ লাল চা করে নিয়ে সেদিনের খবর কাগজটা মেলে ধরে ছিলেন । সামনের পৃষ্ঠার মুখ্য খবর গুলিতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে তিনি সাহিত্য এবং কলা বিভাগের লেখাগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন । তারপর পরের দিন সকাল সাতটার সময় উঠার জন্য ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে হালকা মনে বিছানায় গিয়েছিলেন ।

স্বামী ভেতরে যাওয়ার পরে নিনা ভলক’ভনা বললেন – নাটালিয়া বলতো তোমাদের কথা । কীসের জন্য এসেছ ?’

    নাটালিয়া তিনি মাকে দেওয়া বইটির কথা বলল। সঙ্গে তাঁরা করতে থাকা অধ্যায়নের কথাও বলল।

    ‘তাই ‘- নাটালিয়া বলল,-‘ আপনার কাছ থেকে একটা কথা জানতে এলাম। আপনার পিতা ভলক’ভ রিয়াজনভ টলস্টয়বাদী ছিলেন কি?’

    নিনা ভলক’ভনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তিনি যেন অনেক কথা মনে করার চেষ্টা করছেন।

তিনি বললেন-‘ আমার দুই বছর বয়সেই  তিনি লেনিনগ্রাডে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তাঁর বিষয়ে আমার কোনো কিছুই মনে নেই।’

    কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি বললেন-‘ হ্যাঁ, মা আমাকে বাবার কথা বলেছিলেন। বাবার টলস্টয়ের প্রতি থাকা আগ্রহ এবং ভক্তির কথা বলেছিলেন। মা আমাকে আমাদের বাড়িতে থাকা টলস্টয়ের বইপত্র গুলি পড়ে দেখতে বলেছিলেন। বলেছিলেন-‘ তুই বাবাকে দেখতে পেলি না, বইগুলি পড়লেই বাবাকে বুঝতে পারবি।’ বইয়ের ঝোলাটা মা আমাকে বারবার যত্ন করে রাখতে বলেছিলেন।’

    শ্রীমতী লেপিনা বলে চলেছিলেন -‘ আমার জানা মতে আমার বাবা নিরুদ্দেশ  হয়েছিলেন ১৯৩২ সনে। তোমাদের বাবা তখনও লেনিনগ্রাড  বা শ্বেত  সাগরের উপকূলে চাকরি করছিলেন। আমাদের দুঃখের আর সীমা ছিল না। বাবার কোন দোষে আমাদের পরিবারের উপর সরকার বাহিনীর চোখ পড়েছিল মা ও তা জানতেন না। মা-বাবাকে চিন্তাশীল এবং শান্ত ব্যক্তি হিসেবেই জানতেন। তাঁর বন্ধু কয়েকজনও এই ধরণেরই ছিল এবং দেখা হলেই তাঁরা টলস্টয়য়ের দর্শনের কথা আলোচনা করতেন। ১৯২৮ সন থেকেই দেশে আরম্ভ হওয়া ঘটনাপ্রবাহ বাবা এবং বন্ধু কয়েকজনকে চিন্তিত করে তুলেছিল ।

    শ্রীমতী লেপিনা বলল-‘বাবা লেনিনগ্রাড থেকে নাই হয়ে যাওয়ার তিন বছর পর পর্যন্ত মা বহুকষ্টে তোমাদের মায়ের বাড়ির সামনেই ছিল। পরে তোমাদের বাড়িতেও নাকি অসুবিধা হতে লাগল। অবশেষে আমরা এখানে দিদিমার বাড়িতে চলে এলাম। এখানেও-।’

    নিনা ভলক’ভনা চুপ করলেন। তাঁর শৈশবের কথা মনে পড়ল। তার বোঝার বয়স হওয়ার  পরে মা বলতে শুরু করে যে মস্কো থেকে আসার পরে তারা যেন আরও বেশি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ল। স্তালিনগ্রাডে সরকারি বাহিনী বড় সক্রিয় হয়ে উঠেছিল‌। দাদুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিন বছর পরে দিদিমার মৃত্যু হয়েছিল। অবশেষে মা নার্স হিসেবে  চিকিৎসালয়ে চাকরিতে ঢুকে ছিল।

    নিনা ভলক’ভনার মনে পড়ল তাঁর যখন দশ বছর বয়স তখন থেকে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অন্তত যুদ্ধের কথা তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। জার্মানদের মস্কো আক্রমণ করার  কথা তিনি শুনেছিলেন। শীতকালের তীব্রতায় অনভিজ্ঞ জার্মানদের রুসরা ভালো শিক্ষা দেবার খবর তাদের আনন্দিত করেছিল। কিন্তু পরের বছর বসন্তকালে ককেশাস পর্বতের আশেপাশে তেলের খনি দখল করার উদ্দেশ্যে জার্মানরা আক্রমণ আরম্ভ করে। ভীষন যুদ্ধের শেষে ক্রিমিয়ার সেভাস্টপল দখল করে। তাছাড়া ডন এবং ডনেট নদীর মাঝখানের প্রায় দুশো মাইলের সীমান্তে আক্রমণ আরম্ভ করে । ভর’নেজহরের কাছে পৌঁছে ওরা দক্ষিণের দিকে এগিয়ে ককেশাসের মাইক’প পর্যন্ত এগিয়ে যায় । ইতিমধ্যে ডন নদী দিয়ে  ভাটির দিকে যাওয়া  একদল জার্মান সেনা নদীটা পার হয়ে স্তালিনগ্রাদ আক্রমণ করার জন্য আশেপাশের অঞ্চলে ছাউনি পাতে। সময়টা ছিল ১৯৪২ সনের গ্রীষ্মকাল। সেই সময়, সেই সময়েই নিনা ভলক’ভনাদের অন্যান্য শিশু-কিশোর এবং বয়স্ক লোকদের সঙ্গে জার্মান বাহিনী আসা বিপরীত দিকের বহুদূরের  জঙ্গলে আত্মগোপন করার জন্য  নিয়ে  যাওয়া হল‌। নিনা ভলক’ভনার মা নার্স হিসেবে আঘাতপ্রাপ্ত সৈনিকদের শুশ্রূষার জন্য শহরটিতে থাকতে হল।

    তারপরের ছয়মাসের তুমুল যুদ্ধের আবহাওয়া ছিল বর্ণনাতীত।জার্মানরা তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল।আকাশমার্গ থেকে আক্রমণ শহরটাকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছিল। কিন্তু শীত আরম্ভ হওয়ার সময়ে রুশ বাহিনী দুদিক থেকে আক্রমণ করে জার্মানদের ১৯৪৩ সনের ২ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল।

    সেই আট মাস নিনা ভলক’ভনাদের কষ্টের সীমা ছিল না। শহরের আশেপাশের অঞ্চলটা ছিল প্রায় মুক্তাঙ্গন।বন জঙ্গল খুব বেশি ছিল না।এখানে সেখানে কয়েকটি বিশাল বিশাল গাছের এক একটি স্তূপ ছিল।তার কোথাও কোথাও চাষিদের এক একটি কাঠের ঘর ছিল।আবার কোথাও কিছুই না থাকায় লোকেরা বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরি করেছিল। এক একটি ঘরে ওরা দলবেঁধে বাস করছিল । বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসা তীব্র শীত ওদের কাবু করে ফেলছিল । খাবার জিনিসের অভাব দেখা গিয়েছিল । দুই এক জন লোক বরফে মরে পড়ে থাকা জন্তুর মাংস করাত দিয়ে কেটে খাবার জন্য নিয়ে এসেছিল। একদিন এভাবে হানা গরুর মাংস খেয়ে নিনা ভলক’ভনা বমি করেছিল।

    সেই কয়েক মাস যেন একটা যুগ ছিল। তিনি তখন ১৩ বছরে পা রেখেছিলেন। যৌবনের দরজায় মাতৃ বিহীনভাবে অন্য মানুষের সঙ্গে কাটানো দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিমাসের কয়েকটি দিনের মুহূর্তগুলি নিনা ভলক’ভনার জন্য ছিল অত্যন্ত অস্বস্তিকর।

    নিনা ভলক’ভনা লেপিনা নাটালিয়া এবং ফিয়োডরের দিকে তাকাল। তিনি ব্যাক্তি স্বাধীনতা খর্ব করে দাদুকে ধরে নিয়ে যাবার কথা, দিদিমার মৃত্যুর কথা, মহাযুদ্ধের দুর্দশার কথা বলে শেষ করার পরে বললেন-‘ যুদ্ধ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরে যখন বিধ্বস্ত শহরে ফিরে এলাম তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পরে হাহাকার এবং দুর্গন্ধের মধ্যেও যুদ্ধের পরিণতিতে একদল মানুষ বড় উৎসাহিত হয়েছিল। ওদের কয়েকজন নাক-মুখ ঢেকে আমাদের পার্টি কমিটির কার্যালয়ে নিয়ে গেল। আমি দুজন বয়স্ক মানুষকে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা আমাকে নামধাম নিয়ে খবর করবেন বলে আশ্বাস দিল। তার মধ্যে একজন লোক অন্য কাজের জন্য আমার মতো মেয়েদের সংগ্রহ করতে লাগল। বলল- বয়স্ক লোকগুলি কাপড় বোনার কাজ করছে। কিন্তু সীমান্তে যুদ্ধ করতে থাকা মানুষগুলির শার্টের জন্য বড় বড় বোতামের অভাব হয়েছে।তোমাদের বোতাম তৈরি করতে হবে।-ভল্গা নদীর তীরের একটি পাথরের ঘর তখনও নিখুঁত অবস্থায় ছিল। তারা সেখানে এখানে সেখানে পড়ে থাকা জন্তু-জানোয়ারের কঙ্কালগুলি নিয়ে আসতে লাগল। দুটো যন্ত্র এবং সরঞ্জাম নিয়ে রণ-পা পরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো একজন উৎসাহী মানুষ বলল-‘ আমরা রাইফেল নিয়ে সীমান্তে যুদ্ধ করেছিলাম এখন তোমাদের জন্য এই সরঞ্জামগুলিই হল বন্দুক। এই হাড়গুলি দিয়ে বোতাম তৈরি কর।’

    শ্রীমতী লেপিনা বলে গেল-‘ সেই বোতাম লাগানো কাজের মধ্যেই সুবিধা পেলে আমি সৈনিকদের এবং কখনো রেডক্রসের মানুষকে এবং নার্সকে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম । কয়েক মাস পরে একজন চিকিৎসক বললেন – রেডক্রসের  ঘরে বোমা পড়ায় আমার মায়ের নাকি তিন মাস আগেই  মৃত্যু হয়েছে।’

    নিনা ভলক’ভনা লেপিনা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে রুদ্ধস্বরে আস্তে আস্তে বললেন- আমি ছয় মাস বোতাম তৈরি করেছিলাম। কিন্তু তার পরে এক দিন একজন আঘাতপ্রাপ্ত মানুষকে মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করা ধরনে শুশ্রূষা করতে দেখে আমাকে নার্সের দোলে ভর্তি করে নিল । তখন থেকেই আমি এই কাজ করে সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি করে আসছি ।

    শ্রীমতী লেপিনা লম্বা করে শ্বাস নিলেন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন-‘ হ্যাঁ, সেই সময় গুলি বড় কঠিন ছিল।’

    নাটালিয়া এবং ফিয়োডর মহিলাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপরে ফিয়োডর জিজ্ঞেস করলেন-‘ শ্রীমতী লেপিনা এত দুর্যোগের মধ্যে আপনি কীভাবে বেঁচে রইলেন?’ 

    তিনি ফিয়োডরের  দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ এটা বড় প্রয়োজনীয় প্রশ্ন। তার উত্তর আমি একটা কথাই বলতে চাই যে দেশের পরিস্থিতি আমার হৃদয়ে সমস্ত মানুষের প্রতি করুণ ভাব জাগিয়ে তুলল। একথা ভেবেই আমি রোগীদের চিকিৎসা করি। প্রেম, কারুণ‍্য, এবং কর্তব্য আমাকে জন্য ভগবানের কাছে নিয়ে যায়। একটি গল্প আছে-‘ যেখানে প্রেম, সেখানেই ভগবান।’ আমি এটা বিশ্বাস করি।’

‘ অর্থাৎ’,-নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল-‘ আপনিও ভগবানে বিশ্বাসী?’

    মহিলাটি সম্মতি জানালেন।

    ‘ কিন্তু চার দশক জুড়ে তো আমাদের অর্থডক্স গির্জা ঘরগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল?’

    ‘ হ্যাঁ নাটালিয়া।’-শ্রীমতী লেপিনা বললেন-‘আমি’,-মহিলাটি হয়তো অভ্যাসের বশে দরজার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন-‘ আমি গির্জার সমস্ত কথা পছন্দ করি না।’

    ফিয়োডর বলল-‘ আপনি তাহলে টলস্টয়ের অনুগামী । তিনি গির্জার কিছু কথা সমর্থন করতেন না । এমনকি তিনি একটি বাইবেল গ্রন্থ ও প্রণয়ন করেছিলেন।’

    নিনা ভলক’ভনা লেপিনা ফিয়োডরের দিকে  তাকিয়ে বললেন-‘ আমি শুনেছি, কিন্তু পড়িনি। তিনি কিন্তু গির্জাকে নয়, সমাজকেও ভালোভাবে সমালোচনা করেছিলেন। উচ্চ শ্রেণির মধ্যে থাকা অনৈতিকতা মনে-প্রাণে ঘৃণা  করেছিলেন। তিনি সেই জন্যই’ ক্রোয়েটজার সোনাটায় পরকীয়া প্রেমের  সন্দেহে উচ্চ শাসকশ্রেণির বিষয়া পরিবারকে হত্যা করা দেখিয়েছিল। অনৈতিকতার সমালোচনা  করার জন্য  আমার বইটি ভালো লেগেছিল এবং বান্ধবী লিডিয়াকে বইটি উপহার দিয়েছিলাম।

    ‘ আচ্ছা মাসি’,-নাটালিয়া জিজ্ঞেস করল – আপনার পিতা ভলকভ রিয়াজনভের কয়েকজন বন্ধুর কথা আপনি বলেছিলেন । আপনি তাদের নাম জানেন ?’

    শ্রীমতী লেপিনা কিছু কথা মনে করতে চেষ্টা করলেন । কিন্তু তার মনে পড়ল না ।

    সেই সময়ে অ্যালেক্সের পড়ার ঘর থেকে উঁচু লম্বা ডেভিডভিচ লেপিন বেরিয়ে এলেন । তিনি ফিয়োডরদের দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ দুঃখিত, আমি টিভি দেখব, বলে বসার ঘরের এক কোণে থাকা টেলিভিশনটা চালিয়ে দিলেন । তার মধ্য থেকে ফুটবল খেলা আরম্ভ করার একটা উত্তেজনাময় কোলাহল ভেসে এল। 

    ‘আটটা বাজে।’শ্রীমতী লেপিনা বললেন-‘ আমি সবার জন্য রাতের আহার প্রস্তুত করছি।’

    নাটালিয়া কিছু একটা বলতে চাইছিল যদিও মানুষটার কথার জোর   এতই বেশি ছিল যে তাই কিছু বলতে পারল না।

‘ বেশি সময় লাগবে না। তোমরা খেলা দেখ।’- মহিলাটি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন-‘ নাটালিয়া, তোমার ইচ্ছা হলে বাবার বইয়ের সংগ্রহটা দেখতে পার।’

    তার মনের কথা বলার জন্য নাটালিয়া শ্রীমতী লেপিনার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল। নাটালিয়ার  সুবিধার জন্য বই পত্র থাকা  আলমারিটার কোণের লাইটটা জালিয়ে দিয়ে মহিলাটি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

    ফিয়োডরের দিকে তাকিয়ে নাটালিয়া বলল-‘ তুমি কিছুক্ষণ টিভি দেখ। প্রয়োজন হলে আমি ডেকে  নেব।’

    ফিয়োডর উঠে মিস্টার লেপিনের কাছে গিয়ে বসল। তিনি বেশ উৎসাহিত হলেন। খেলা আরম্ভ হয়। তিনি বললেন-‘ খেলাটা বেশ আমোদজনক হবে।’

    ফিয়োডর অভ্যাসবশত ঘড়িটার দিকে তাকাল। তা দেখে মানুষটা বললেন-‘ তুমি চিন্তা করনা। লেট হয়ে গেলে আমি তোমাদের গিয়ে রেখে আসব।’

    তিনি বললেন-‘ আমার একটি পুরোনো গাড়ি আছে-‘ঝিগুলি’।

ফিয়োডর ‘ঝিগুলি’ নামে ছোট গাড়িটির কথা জানে।’লাডা’র কথাও জানে। সে বলল-‘ ঝিগুলি’  নির্মাণ করা গাড়ির কোম্পানিটা এদিকেই রয়েছে।

    ‘ হ্যাঁ ।টলিয়াটিতে। এখান থেকে উত্তরের দিকে । ছামারা পার হয়ে যেতে হয়।’

    ছামারার উল্লেখ ফিয়োডরকে পুনরায় টলস্টয়ের কথা মনে পড়িয়ে দিল। একশো বছরেরও কিছু আগে হওয়া ছামারার দুর্ভিক্ষের জন্যই টলস্টয় মস্কভস্কিয়ে ভেদ মষ্টি’ নামের কাগজটিতে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা বর্ণনা করে একটি পত্র লিখেছিলেন। তাব বর্ণনা এতই  সজীব ছিল যে   পাঠকরা অনাহারে থাকা চাষিদের জন্য প্রায় ১৮ লাখ রুবল  দান করেছিল। তাছাড়া খাদ্যের সম্ভার ও জুগিয়েছিল‌।

    এই ছামারা অঞ্চলের পরেই টলিয়াটি এবং তার থেকে উত্তরে ভিজে আবহাওয়ার পার্ম। পার্মেই ছিল একটি প্রিজন ক‍্যাম্প-গুলাগ। দেশের কঠিন সময়ে স্বাধীনচেতা চিন্তাধারার চিন্তাবিদদের বন্দি করে রাখা জেলখানা এবং শ্রমিকদের ক‍্যাম্প। সত্তর সন থেকে একে একটি যাদুঘরে পরিবর্তন করা হয়।

    মিঃলেপিন খেলা দেখায় মগ্ন হলেন।

    খোলা রান্নাঘর থেকে নিনা ভলক’ভনা লেপিনা এলেক্সকে দেখে বলে উঠলেন – ‘তোর পড়াশোনা হয়ে গেছে কি ? আজ অতিথি দেখে রাগ করব না বলে তুই তাড়াতাড়ি উঠে গেলি?’ এলেক্স মুচকি হাসল। 

    শ্রীমতী লেপিনা আজ সকাল থেকে রান্নাবান্না ছাড়াও তার কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময় তার পিতা সকালের জগিং করে ফিরে আসছিল। খাওয়া-দাওয়া করে বাসনগুলো অ্যালেক্স স্কুল থেকে এসে ধোয়ার জন্য ওভাবে রেখে দিয়ে তাকে নিয়ে তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। সেদিন অ্যালেক্সের শিক্ষক তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল।–’ তাড়াতাড়ি চল।’- তিনি তাঁকে বারবার বলছিলেন। কেননা স্কুলে যেতে হওয়ার জন্য তার চিকিৎসালয়ে  যেতে দেরি হবে। স্কুলের শিক্ষক তাকে কেবল বলেছিল-‘ জান, এলেক্সের প্রতি তোমার চোখ কান দেওয়া উচিত। ও কিছুটা অমনোযোগী এবং উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছে।‍ বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তুমি তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলবে আর সঙ্গীদের  সঙ্গে যাতে মিছামিছি ঝগড়া না করে বুঝিয়ে বলবে।’- শিক্ষকের কথায় সম্মতি জানিয়ে তিনি দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বাসায় যেতে দেরি হবে বলে তিনি স্থানীয় রেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটিয়ে গর্জন করতে করতে রেলগাড়িটা এসে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে তাকে গন্তব্যস্থলের দিকে তখনই নিয়ে যাচ্ছিল। তারপরে কুড়ি মিনিটের মতো ট্রামে উঠে এবং বাকি পথটুকু সাত মিনিট সময় পায়ে হেঁটে চিকিৎসালয়ে পৌঁছেছিলেন। নিজের  রুমে বসে তিনি দুই মিনিটের মতো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাঁধে নেওয়া ব্যাগ থেকে বস্তুগুলি সামনের টেবিলে যত্ন করে রেখেছিলেন।

    শ্রীমতী লেপিনা বাড়ি ফিরে আসার সময় হাতে একটি ছোট পুঁটলি‌ ছিল। তার মধ্যে ছিল দুধ মাংস এবং টমাটো। তাকে দেখে কোনো যুবক ছেলে বাসের একটি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। আজকের দিনের জন্য আশ্চর্যজনক সৌজন্য। তাকে কি খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে? নাকি তাকে বুড়ি বলে মনে হচ্ছে? তিনি আর কম বয়সী  নেই। অবসর নেবেন। সেই ভাবনা তাকে কয়েক মিনিটের জন্য পীড়া দিল যদিও আধঘন্টা পরে বাস থেকে নেমে দ্রুতপায়ে এসে বাড়িতে অতিথি দেখে পুনরায় সতেজ হয়ে পড়লেন।

    শ্রীমতী লেপিনা এবার বইপত্র দেখতে থাকা নাটালিয়ার দিকে তাকালেন। একবার ফিয়োডরের  দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন ফিয়োডরের  খেলা দেখার বিন্দুমাত্র মন নেই। তা দেখে তিনি রান্নাঘর থেকে জোরে জোরে বললেন-‘ফিয়োডর , তুমি নাটালিয়ার কাছে যাবে নাকি? তোমরা কাজ নিয়ে এসেছ, সময় কম।’

    ফিয়োডর যেন কৃতজ্ঞ হল। সে মিস্টার লেপিনের প্রতি একটি সৌজন্যমূলক ভঙ্গিমা দেখিয়ে পাশ থেকে উঠে বইগুলির কাছে গেল । ইতিমধ্যে মহিলা খাবার টেবিলটা সাজাতে শুরু করেছিলেন ।

    নাটিলিয়া হাতে টলস্টয়ের একটি বই নিয়ে দেখছিল। বইটির নাম’ নবজন্ম’। সেই বইটিতেও ভলক’ভ রিয়াজনভের স্বাক্ষর ছিল। তাকে বইটি একজন বন্ধু উপহার দিয়েছিল ।

    ফিয়োডর বইটির কথা জানে । সত্তর বছর বয়সে লিখে প্রকাশ করা বইটিতে একজন ধনী ব্যক্তির নব জন্মের কথা লেখা হয়েছিল। মানুষটি বহুবছর আগে একটি মেয়ের উপরে যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল। সেই মেয়েটিকে তিনি একদিন আদালতে দেহোপজীবিনী রূপে  দেখতে পেয়েছিলেন । অনুতপ্ত সেই বিত্তশালী ব্যক্তিটি  মহিলাটিকে বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছিলেন । এটাই ছিল তাঁর পুনর্জন্ম। 

    ফিয়োডর জানে এই উপন্যাসটি’ নিভা’ নামে ম্যাগাজিনে প্রকাশ হওয়ার আগে অনেক কাটাকুটি করে সেন্সর করা হয়েছিল। পরে ভ্লাদিমির সের্টকভ বইটি ইংল্যান্ডে সম্পূর্ণকরে প্রকাশ করেছিলেন ।

    ফিয়োডর কাছে যাওয়ায় বইটা তার হাতে দিয়ে নাটালিয়া বলল-‘ দেখ, এখানেও রয়েছে ভলক’ভন রিয়াজনভ মহাশয়ের সই।’ 

বইটি সেই তখনকার সময়ের – মুগা বর্ণের। ফিয়োডর  বইটা দেখতে লাগল।

    বইটা দেখতে দেখতে নাটালিয়ার ঘাড় ব্যাথা করতে লাগল। সে বসে থাকা চেয়ারটাতে কিছুটা হেলান দিয়ে বসল এবং মাথা তুলে আলমারিতে সাজিয়ে রাখা বইগুলি দেখতে লাগল।

    বইয়ের আলমারি ছিল দুটো। দুটিতেই দু সারি করে বই ছিল। সেই সারি  দুটিতে কাচ লাগানো ছিল এবং কেবল টলস্টয়ের নয় গোগোল ,তুর্গেনিভ,ডস্টয়েভস্কি ইত্যাদি লেখকদেরও বইপত্র তাতে রাখা ছিল। নিচের অংশে কী রাখা  ছিল নাটালিয়া জানেনা কারণ কাঠের দরজা এই অংশটা ঢেকে রেখেছিল। 

    আলমারি দুটির মাঝখানের মুক্ত অংশে ছিল একটা তৈল চিত্র। আলো ছায়ার মধ্যে একজন লাজুক অথচ উজ্জ্বল চোখের পূর্ণযৌবনা যুবতির চিত্র। পেছনদিকে অস্পষ্টভাবে উজ্জ্বল একটা লাইলাক ফুল দেখা যাচ্ছিল- যেন ফুলটি যুবতির মুক্ত রঙ্গিন মানের আভাস দিচ্ছিল।

    নাটালিয়া তৈলচিত্রটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল।

    ইতিমধ্যে ফিয়োডর ‘ নবজন্ম’ নামের বইটিতে দুটো কথা উদ্ধার করেছিল। প্রথমটি হল উপন্যাসটি ভলকভ রিয়াজনভকে  উপহার দিয়েছিলেন য়ুরি ফমিসভ। বইটিতে য়ুরি ফমিসভের স্বাক্ষর ছিল। আর সঙ্গে লেখা ছিল জায়গার নাম- কাজান। সেই কাজান, যেখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যদেশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রে টলস্টয় একসময় পড়াশোনা করেছিলেন।ফিয়োডরের চোখে পড়া অন্য কথাটি হল শেষের পৃষ্ঠায় ভলকভ রিয়াজনভের কয়েকটি লিখিত কথা। তাতে লেখা ছিল- মানুষ ভুল করেই। অনুতপ্ত হয়ে তার প্রতিকার করা উচিত। মহান  লেখকদের এটা প্রত্যেকের জন্যই একটি মহান পাঠ।- কথাগুলির শেষে ছিল ভলকভ রিয়াজনভের সই।

    ফিয়োডর সেই কথা দুটি দেখানোর জন্য নাটালিয়ার দিকে তাকাল। সে তখন তৈল চিত্রটির কোণে  থাকা শিল্পীর নামটা উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল।

    ফিয়োডর কিছু বলার আগেই নাটালিয়া বলল-‘ দেখ ফিয়োডর ,তৈলচিত্রটি দেখ। এর শিল্পীর নাম টি দেখ- ভিক্টর এক…। পরেরটুকু খুব একটা স্পষ্ট নয়।

    ‘ ভিক্টর’ নামটা ফিয়োডরকে  উৎসাহিত করল। কোথায় যেন নামটা দেখেছে। সে দৌড়াদৌড়ি করে’ লেনিনগ্রাডের নয় জন নিবাসীর নাম থাকা কাগজটা তার ব্যাগ থেকে বের করে আনল।

    ‘ ঠিক, ঠিকই নাটালিয়া। এখানে আছে ভিক্টরের নাম। ভিক্টর একছুর্স্কি। তিন নাম্বারে। আর সঙ্গে–।’

    ফিয়োডর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। সে দ্রুত বইটিতে থাকা কাজানের য়ুরি ফমিসভের নামটা দেখিয়ে বলল–’ এইযে নাটালিয়া,য়ুরি ফমিসভের নামটাও এই তালিকায় রয়েছে। সাত নম্বরে–।’

    গহীন -গম্ভীর ফিয়োডরের উত্তেজনা এবং আনন্দ দেখে নাটালিয়ার ভালো লাগল।ফিয়োডর এবার তৈলচিত্রটা দেখতে লাগল। মুখটা সে কোথাও দেখেছে নাকি?

    ওরা দুজনেই তৈলচিত্রটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে হাত মুছতে মুছতে কাছে এগিয়ে আসা শ্রীমতী লেপিনা বললেন–’ তোমরা বাবার বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করেছিলে না, এই পেইন্টিংটা তার একজন বন্ধুর উপহারের চিহ্ন। তার নাম ভিক্টর একছুর্স্কি। তিনিও লেনিনগ্রাডে ছিলেন।’

    ফিয়োডর তখনও একাগ্ৰভাবে চিত্রটির দিকে তাকিয়ে ছিল। সে মহিলাটির অনুমতি নিয়ে তৈল চিত্রটির একটি ফোটো তুলল।

    শ্রীমতী লেপিনা বললেন-‘ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হল। জন্তু-জানোয়ারের মৃত্যু হল। বাড়িঘর ধ্বংস হল। কিন্তু সেই বইটি এবং পেইন্টিংটা আশ্চর্য জনকভাবে রক্ষা পেয়ে গেল।’

    তিনি বললেন-‘ আমি জঙ্গলে যাবার সময় ট্র ইকাতে এই সমস্ত কিছু বোঝাই করে দিয়ে মা বলেছিল-‘ এই জিনিসগুলি বাবার খুব আদরের। যত্নে রাখিস।’

    নিনা ভলকভনা লেপিনার  নৈশ ভোজনের টেবিল তৈরি করা হয়েছিল। তারমধ্যে ছিল রাইর পাউরুটি, মাংস ,টমাটো, কিছু ফল এবং সঙ্গে এক বোতল ভডকা।

    নৈশ ভোজনের  শেষে টিভিতে মিঃলেপিনরা সমর্থন করা দলটি গোল দিয়ে এগিয়ে যাওয়ায় তাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। তিনি ভডকার পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ঘরের একপাশে সাজিয়ে রাখা অ্যাকর্ডিয়ানটির ফিতাগুলি দুই বাহুতে ঢুকিয়ে  বুকের মধ্যে নিয়ে একটা সুর বাজাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সুরের লয় এতই সুমধুর হয়ে পড়ল যে তিনি হেসে  হেসে বাজাতে বাজাতে ঢুলতে লাগলেন। সঙ্গে  এলেক্স হাতে তালি বাজিয়ে ছন্দে ছন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে লাগল।

    সেই আনন্দের পরিবেশের মধ্যেও ফিয়োডর তৈলচিত্রটির কথাই ভাবছিল। অ্যাকর্ডিয়ানের সুর তাকে লাইলাক  ফুলের  মাঝখানে যেন নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে বসে আছে সেই পূর্ণ যৌবনা যুবতি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বড় পরিচিত– বড় পরিচিত তার সেই মানুষটি।

    ভলগ্ৰাডে রাত তখন মস্কোর দিনের মতো শীত পড়তে আরম্ভ করেছিল।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত