Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 18

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-৯) । ডঃদীপক কুমার বরকাকতী

Reading Time: 12 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese literature Dipak Kumar Barkakati 1মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃদীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা,অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন,প্রব্রজন ,ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi,New Delhi ,2010) এবং The Highlanders(Blue Rose Publishers, New Delhi,2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন,কলকাতা,২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-৯।


 

 

মস্কোতে ফেরার পথে ফিয়োডরের কিছু কথায় নাটালিয়া অবাক হল। সেই রাতে লেপিন  পরিবারের ঘরে রাতের আহার করে আসার পর থেকে ফিয়োডরের অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার কথা নাটালিয়া লক্ষ‍্য করেছিল। সে যেন কিছু একটা কথা বড় গভীর ভাবে চিন্তা করছিল। এমনিতেই গম্ভীর ফিয়োডরকে তার বিরক্ত করতে খারাপ লাগছিল। সে কেবল সেই রাতে তৈলচিত্রটির সঙ্গে ‘লেলিনগ্ৰাডের নয়জন নিবাসী’র  কোন সম্পর্ক আছে কিনা তার কথা ভাবছিল। সে তাকে একবার বলেছিল – পেন্টিংটার যুবতিটি যেন আমার পরিচিত। ক্যামেরার রিলটা প্রিন্ট করে ভালোভাবে দেখতে হবে। 

          ফিয়োডরের  চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে  নাটালিয়া কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পরেরদিন মস্কো ফেরার কথা ঠিক করে সে তার ঘরে কেবল শুতে  গিয়েছিল।

          ওদের ফিরে আসাটা ছিল জলপথে। ভল্গা নদী দিয়ে উজিয়ে আসতে আসতে নদীর মৃদু বাতাস এবং বিশালতায় ফিয়োডরের চিন্তান্বিত মুখটা কিছুটা সতেজ হয়ে পড়ল। সুদৃশ্য ফেরিটার  রেস্তোরার কাচের জানালার কাছে মেঝেতে বসে বাইরের জলের তরঙ্গ অন্যান্য ফেরি এবং পালতোলা নৌকা এবং দূরে দূরে থাকা উপকূলীয় গ্রামের দৃশ্যরাজি দেখে ফিয়োডর নাটালিয়াকে কিছু কথা বলতে লাগল। সে বলল–’ নাটালিয়া আমি তোমাকে একদিন বলা কথা পুনরায় বলছি লেনিনগ্রাডের কেসটা লিঅ’নিড এডলারের নামে । আমিও একজন এডলার এবং আমরা দুজনেই লেলিনগ্রাডের ।’

            নাটালিয়া তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল–’ হ্যাঁ,আমি জানি।’

          ফিয়োডর টেবিলে থাকা কফির পেয়ালা টার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে গেল–’ আমার বাবার নাম ইভান লিঅ’নিড’ভিছ এডলার।’

          নাটালিয়া খেয়াল করল–’ফিয়োডরের সম্পূর্ণ নাম ফিয়োডর ইভান’ভিছ এডলার– অর্থাৎ সে এডলার পরিবারের, সঙ্গে ইভানের পুত্র। তাছাড়া বাবা ইভান হল ইভান লিঅ’নিড’ভিছ এডলার–লিঅ’নিডের পুত্র এবং সঙ্গে এডলার পরিবারের। তাই ফিয়োডরের পিতা একেবারে লিঅ’নিড এডলারের পুত্র, আর এই লিঅ’নিড এডলারের নামেই ‘লেনিনগ্রাডের নয়জন নিবাসী’র মামলাটা।

          নাটালিয়া অবাক হওয়ার সঙ্গে বেশ উৎসাহিত হল। সে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই ফিয়োডর বলল–’ নাটালিয়া, সেই জন্যই আমি কালিনিনগ্রাডে গিয়েছিলাম। কেসটার এডলার এবং আমার ঠাকুর দাদা একই মানুষ কিনা । আমি হয়তো বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে বাবা এবং দাদুর বিষয়ে কিছু জানতে পারব ।

          কালিনিন নৌ-বন্দর প্রকৃতপক্ষে প্রেগেল  নদীতে থাকা একটি বিশাল সাগরীয় বন্দর। এটা বড় বড় জাহাজ চলতে পারা প্রণালী দিয়ে বাল্টিক সাগরের  সঙ্গে সংযোজিত। সাগরের গভীর জলে থাকে কয়েক মহলের এক একটি বিশাল জাহাজ। তার মধ্যে যাত্রীবাহী জাহাজের চেয়ে মালবাহী জাহাজের প্রতাপ বেশি। সেই গভীর জলের জাহাজগুলি থেকে ছোট ছোট ফেরি বা বড় নৌকায় যাত্রী  এবং মালপত্র পারে আনা হয়। কোনো কোনো জাহাজ আবার সাগরের মাঝখান পর্যন্ত তৈরি পাকা ডেকের কাছে লাগানোর ব্যবস্থা আছে। তখন যাত্রীরা সোজাসুজি তীরে নামতে পারে। ক্রেন দিয়ে ভারী মালপত্র গুলি জাহাজ থেকে নামাতে পারে। সেই জাহাজগুলি খালি হলে তীর থেকে গিয়ে অন্য জায়গায় নোঙ্গর ফেলে নিজের ফেরা যাত্রার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তীরের উপকূলে অসংখ্য ছোট-বড় নৌকা লাগানো থাকে।

          এক সময় জার্মানির পূর্বপ্রুশিয়া  নামের এই অঞ্চলটিতে টিউটনিক নাইটেরা ১২৫৫ সনে কালিনিনগ্রাডে এর রাজধানী পেতেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত জায়গাটা জার্মান মানুষে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর থেকে আরও সঙ্গে অঞ্চলটি রাশিয়ার সীমার ভেতরে আনার পর থেকে জার্মান লোকগুলি চলে গেছে এবং তার জায়গায় ধীরে ধীরে রুশ মানুষরা বসতি স্থাপন করতে লাগল। তার বারো বছর পরে ফিয়োডরের পিতা ইভান লিঅ’নিড’ভিছ তার বন্দরে চাকরি করতে গিয়েছিল এবং তিন বছর পরে ওলগা পেট্রভনাকে বিয়ে করেছিল।ফিয়োডরের জন্ম হয়েছিল সেখানেই।ফিয়োডর যখন কালিনিনগ্রাডে উপস্থিত হল, সেখানে সে কোনো  পাত্তা  পেল না। ছোট-বড় বাণিজ্য, চোরাই ব্যবসা, নাবিক এবং বন্দরের কর্মীদের ব্যস্ততা এবং হুলস্থুলে সে  সেই শৈশবের কালিনিনগ্রাডকে খুঁজেই পেল না। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত পিতা ইভান   সেই বন্দরে ফিটার হিসেবে কাজ করত। তার পরই তিনি কামা নদীর কাছে কারখানা স্থাপনের জন্য গিয়েছিল। তার বাবার সঙ্গের কেউ এখন ও সেখানে আছে কিনা তার খবর নেবার জন্য সেই বন্দরের কর্মচারীদের কাছে চেষ্টা করল। রাজনৈতিক বাতাবরণ পরিবর্তিত হওয়ায় মানুষগুলি আগের থেকে মুক্ত ভাবাপন্ন হয়েছে। মুক্তমনে বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছে। ফিয়োডর গত ২৬  বছরে  না-দেখা শহরটা, তার জনপ্রাণী এবং বন্দরটা আগের চেয়ে অনেক পরিমাণে  বড় হয়েছে। দুদিনের মতো  চেষ্টা করেও কোনো সুবিধা করতে না পেরে ফিয়োডর ফিরে এল।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-৮)


             ফিয়োডর বলল–’ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত দেখা শহরটা এবং বন্দরটা ভালোভাবে মনে নেই। কিন্তু বুঝতে পারল সেইসবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেখানে বাবার কোনো খবর পেলাম না। দুদিনপরে মস্কো ফিরে এলাম।

          নাটালিয়া বুঝতে পারল সেই জন্যই ফিয়োডর রেলপথে ফিরে আসার সময় সেও অধ্যাপক পুঝিনের সঙ্গে দেখা করে কীয়েভ থেকে  ফিরে আসছিল। যাত্রাপথে ফিয়োডর চিন্তান্বিত ভাবে কিছু পড়ছিল যে তার অস্তিত্ব সে অনুভবই করতে পারেনি।

          ‘তারপরে’–ফিয়োডর বলল–’ আমি কামা নদীর তীরের নৌকা করে ছেলনিতে  গিয়েছিলাম । সেখানেই ‘কাম-কাজ’ কারখানা। সেখানে বাবা চার বছর কাজ করেছিল। সেটা ছিল কারখানাটির আরম্ভ হওয়ার সময়।

           ফিয়োডর জানে পিতা লিঅ’নিড’ভিছ এডলার দিদিমার বন্ধু ডিমিট্রি গরিনের সঙ্গে থেকে লেনিনগ্রাডের পলিটেকনিকে পড়াশোনা করে একজন সুদক্ষ ফিটার  হয়েছিলেন। তাই তিনি বাল্টিক সাগরের উপকূলে বন্দরে সুখ্যাতির সঙ্গে চাকরি করেছিলেন। সেই সময়ে তার ওলগা পেট্রোভনার সঙ্গে সেই কালিনিনগ্রাডে বিয়ে হয়েছিল এবং ফিয়োডরের জন্ম হয়েছিল। সু দক্ষতার জন্য ইভান নতুন চাকরি নিয়ে ‘কাম-আজ’ কারখানার শুরুর  সময়ে ছেলনিতে গিয়েছিলেন। তখন ফিয়োডরের  বয়স ছিল ছয়  বছর। তখন থেকে আর যে চার বছর পিতা জীবিত ছিলেন ততদিনে ফিয়োডর বুঝতে পেরেছিল  যে মা এবং বাবার মধ্যে খুব বেশি মিল ছিল না। সেই দুঃখেই নাকি পিতা খুব বেশি ভডকা খেতেন।

          ফিয়োডর মা ওলগা পেট্রোভনার কথা পরে জানতে পেরেছিল। বিয়াল্লিশ সনের  মহাযুদ্ধের সময় ওলগা পেট্রোভনা অনাথ হয়। তাকে কেউ অনাথ আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। সেই সময়ে খবরের কাগজে সেই অনাথ ছেলে মেয়েদের বিষয়ে একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানকার অনাথ ছেলে মেয়েদের কোনো সদাশয় ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাবার জন্য আবেদন জানানো হয়। দুর্দশাগ্রস্ত বহু পরিবার এবং সঙ্গে হৃদয়বান ব্যক্তি এই ধরনের অনাথ আশ্রম থেকে কিছু ছেলে মেয়েকে তুলে নেয়।ওলগা  থাকা আশ্রম থেকেও ছেলেমেয়েদের তুলে নেওয়া হতে থাকে। একদিন সেখানে পেট্রভ নামে দম্পতি আসে। তাঁরা আসার সময় সেখানে আগত মানুষদের সুবিধার জন্য কার্যালয়ের একটি ঘরের দেওয়ালের দিকে ছেলে  এবং অন্য দেওয়ালের দিকে মেয়েদের সারি  পেতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল । মানুষ গুলি তুলে নেবার জন্য মাঝেমধ্যে ছেলে এবং মাঝেমধ্যে মেয়েদের বেছে নিয়েছিল । পেট্রভ দম্পতির কাছে হঠাৎ ছয় বছরের ওলগা এসে  নাকি বলছিল–’ কাকিমা, মানুষগুলি কেন ছেলেদের নিচ্ছে ? মেয়েদের ও নিক। আমাকেও নিন । আমি সব সময় খুব ভালো মেয়ে হয়ে থাকব।’ পেট্রভ দম্পতির ছোট মেয়েটির সাহস দেখে খুব ভালো লাগল এবং ভালোবাসা জন্মাল। পরে তারা ওকে   তুলে নিল এবং নিজের পরিবারে স্থান দিয়ে পেট্রোভনা উপাধি দিল।

          পরে ফিয়োডরের  মনে পড়ল– পরবর্তীকালে সাহসী ওলগা যন্ত্রপাতি ইঞ্জিন মেরামত করার প্রশিক্ষণ নিয়ে চালক হল এবং তার পিতা ইভান লিঅ’নিড’ভিছ এডলার   চাকরি করা কালিনিনগ্রাডের  বন্দরে চাকরি করতে লাগল। ফিয়োডরের  পিতা ছিলেন শান্ত এবং কাজের প্রতি আগ্রহী। ওলগা প্রথমে ইভানের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে পরবর্তীকালে পত্নীর মর্যাদা দাবি করে।

          পিতা’ কাম–আজ ‘ কারখানায় কাজ করার সময় ফিয়োডর মা-বাবার মনের অমিলের কথা বুঝতে পেরেছিল। পিতা ফিটার  হিসেবে ক্রেন, ইঞ্জিন প্লান্ট, সরঞ্জাম মেরামতির প্লান্ট, লেদ মেশিন ইত্যাদিতে কাজ করছিলেন। মা ওলগা চালক হিসেবে ধীরে ধীরে বড় বড় ভারী ট্রাকের ড্রাইভার হয়েছিলেন। উঁচু লম্বা, শক্তপোক্ত মা লম্বা বুট জোতা এবং চামড়ার জ্যাকেট পরে বড় বড় গাড়ি চালাতেন। অন্যদিকে বাবা কাজ থেকে ফেরার পথে অথবা বাড়িতে এসে মদের পেয়ালা নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটাতেন।

          কামা পাওয়ার প্লান্টটা কামা নদীর পাশে থাকা সেলনির বিস্তীর্ণ তৃণ বৃত্ত সমভূমিতে পাতা  হয়েছিল। বড় বড় যন্ত্রপাতি, বিশাল বিশাল পরিবহনকারী ট্রাক তৈরি করার জন্য পাতা সেই কারখানাটা তৈরি করার জন্য হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী এবং ইঞ্জিনিয়ারের আবশ্যক হয়েছিল। তাই সেখানে কয়েক মাইল জুড়ে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। মূল  কারখানাটা তৈরি করার কাজও ফিয়োডর  থাকার সময় আরম্ভ হয়েছিল।সেই সময়ে সেই এলাকাটিতে একটাই মূল পথ ছিল। অন্য শাখা প্রশাখাগুলি কাঁচা ছিল। পাকা রাস্তাটার পাশে একটা সিনেমা হল এবং সাত আটটি দোকান ছিল। তাতে দুটো মদের দোকান ও বসেছিল।শুরুর দিকে কাজ করতে আসা মানুষগুলির জন্য যেখানে সেখানে পাথরের দেওয়াল দিয়ে তৈরি এক একটি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। জায়গাটা লোহার রড,সিমেন্টের বস্তা,পাথরের স্তূপ ,বালুর সঙ্গে কাদা মাটিতে চলা ভিন্ন ভিন্ন আকারের ট্রাক,মিক্সিং মেসিন,ছোট বড় ক্রেনে হুলস্থুল এবং বর্ণময় পরিবেশ ছিল।

        সেই পরিবেশেই কাজ করে ফিয়োডর বাবা সুবিধা পেলেই পাকা পথের পাশে থাকা মদের দোকানে ঢুকে কয়েক কাপ ভডকা খেয়েছিল। এই ঠান্ডা জায়গায় মদ খাওয়াটা কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু বাবার এই অভ্যাস বেড়ে গিয়ে নেশাসক্ত হওয়ার এরকম একটি পর্যায়ে পোঁছেছিল যে  কাজে যাবার সময়েও তিনি দুকাপ খেয়ে পায়ে হেঁটে কাজে যেতে পারতেন। এভাবেই একদিন আঁকা বাঁকা পায়ে পথ চলার সময় ক্রেনের ধাক্কায় তিনি গভীরভাবে আহত হন এবং হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে মৃত্যু হয়।

        তার পরের অধ্যায়টা ফিয়োডরের জন্য ছিল বড় সংক্ষিপ্ত। এক বছর মায়ের সঙ্গে ছিল। সেই ‘কাম-আজ’ কারখানার এলাকায় ভালোভাবে তখনও স্কুল গড়ে না উঠায় ফিয়োডরকে মা ওলগা লেনিনগ্রাডে নিয়ে এসেছিল এবং বাবা থাকা লালিত পালিত হওয়া ডিমিট্রি গরিন পরিবারটির সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দিইয়েছিল।

        সেটাই-ফিয়োডর ভাবল – সেটাই মা ওলগা তার জন্য করা সবচেয়ে ভালো কাজ ছিল। সেই লেনিনগ্রাডের সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ফিয়োডর সেন্ট পিটাসবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভে সমর্থ হয়েছিল।

        তিন চার বছর পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। শেষপর্যন্ত মায়ের অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ের  খবরে তার মন বিবমিষায় ভরে উঠেছিল। সে খবরাখবর করেনি। মা ও তার খবর করার জন্য লেলিনগ্রাডে আসেনি।

        ‘অনেক বছর’-ফিয়োডর নাটালিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-‘বহু বছর ধরে আমি মায়ের কাছে যাইনি। কিন্তু ‘লেলিনগ্রাডের নয়জন নিবাসী’র কেসটি আমাকে ‘কাম-আজ’কারখানায় নিয়ে গেল।’

        কুড়ি বছর পরের ‘কাম-আজ’ফিয়োডর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে কামা হোটেল থেকে বেরিয়ে সেই মূল পাকা পথটা এবং এখানে সেখানে থাকা পাথরের ঘরবাড়িগুলি খুঁজে পাচ্ছিল না। সিনেমা হলটাও চোখে পড়ছিল না। পাকা রাস্তাগুলি শিরা উপশিরা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।রাস্তাগুলি কারখানার ইঞ্জিন,প্লান্ট সেকশন,লেথ মেশিন সেকশন,হেভি ভেহিকল সেকশন,টেকনিকেল এসেম্বলি সেকশন,পেইন্টিং সেকশন ইত্যাদি  বিশাল বিশাল ভাগগুলির সঙ্গে দূর থেকে কালো কালো বিন্দু থাকা এক একটি বিশাল সুগার কিউবের মতো দশ বারো তলা আবাসিক এলাকাগুলি পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করেছিল। কয়েকটি জায়গায় এক একটি চক গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া এই সমস্ত জায়গায় যাবার জন্য এই বিস্তীর্ণ সমভূমিতে লাল হলুদ রঙের ট্রাম চলতে শুরু করেছিল।

        ফিয়োডর আবাসিক এলাকায় পুরোনো হতে চলা একটা অ্যাপার্টমেন্টে মাকে খুঁজে বের করল। মা তাকে চিনতে পারল না। ফিয়োডরের কাছেও মায়ের মেদবহুলতার ওপরের জ্যাকেটটা অপরিচিত করে তুলল। তবু তাঁর দ্বিতীয় স্বামী ঘরের এক কোণে বসে ভডকা খেয়ে থাকার সময়েও মা ওলগা পেট্রভনা তাকে নীরস হলেও পাশে বসে আগ্রহের সঙ্গে অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। তার শিক্ষা-দীক্ষার কথা শুনে খুশি হল। ফিয়োডর পিতার কথা জিজ্ঞেস করল-‘বাবার কলা সংস্কৃতির প্রতি কেমন ধারণা ছিল?’

        ‘কলা সংস্কৃতি?’- ‘আগ্রহ ছিল। তবে ফিটারের চাকরির জন্য কিছু করে উঠতে পারে নি।’

        কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে বলল-‘আমার কিন্তু ঐ গুলিতে কোনো আকর্ষণ ছিল না। বন্দরের চাকরি করার সময় আমি কিন্তু কয়েকবার তাঁর সঙ্গে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম।’

        ঘরের কোণে বসে মদ পান করতে থাকা চালকের চাকরি করা লম্বা শীর্ণ দ্বিতীয় স্বামী সেইসময়ে বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করেছিল।

        ওলগার দৃষ্টি সেদিকে পড়ায় ফিয়োডর অন্য একটি কথা জিজ্ঞেস করার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। ফিয়োডর মাকে এত বছর পরে মা বলে সম্বোধন করতে কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করছিল। তবু জিজ্ঞেস করেছিল-‘আমাদের দাদুর কথা কিছু জান কি?’

        ওলগা ফিয়োডরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল-‘তোর দাদুর নাম লিঅ’নিড এডলার। আর কিছুই জানি না।’

        ‘তিনি কি লেনিনগ্রাডের ছিলেন?’

        ফিয়োডরের প্রশ্নের উত্তরে ওলগা পেট্রভনা বল্লেন-‘হ্যাঁ,তার আশেপাশেই। কিন্তু সমবায়ে বাড়িঘর সব চলে গেল। সময়টা তখন বড় কঠিন ছিল।’

        মা ওলগার কণ্ঠে যেন ফিয়োডর কিছুটা কারুণ্যের সূর শুনতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল –‘দাদু টলস্টয়বাদী ছিলেন কি?’তিনি সময়ের বিপরীতে।’

        ‘সে সব কথা আমি জানি না। কিন্তু টলস্টয়ের বই পড়তে ভালোবাসতেন। ঠাকুরমার বাড়িতে দুই একটি বই ছিল।’

        মায়ের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হওয়ায় ফিয়োডর বুঝতে পারল ওলগা পেট্রভনা সেসব বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছেন না। তবু জিজ্ঞেস করল –‘তুমি দাদুকে দেখনি। আমার জানামতে বাবাও দাদুকে দেখেনি। তাহলে কথাগুলি কীভাবে জানতে পারলে?’

        ওলগার দৃষ্টি পরিবর্তিত হল। ফিয়োডরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-‘আমি তোর ঠাকুরমার কাছ থেকে শুনেছি। ঠাকুরমার সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে।’

        কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মহিলাটি বললেন-‘তোকে লেলিনগ্রাডের ডিমিট্রি গরিন পরিবারে রেখে আসার জন্য তোর ঠাকুরমার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম।সেই পরিবারে তোর বাবাও লালিত পালিত হয়েছিলেন।’   

        সেই সময় কোণে বসে ভডকা খেতে থাকা ওলগা পেট্রভনার দ্বিতীয় স্বামীর নেশাটা বেশ ভালো করে ধরে এসেছিল। তিনি হাতের পেয়ালা টেবিলে সজোরে রেখে ওলগাকে জিজ্ঞেস করলেন-‘খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়নি নাকি?’

        ফিয়োডরের সামনে সেই সন্ধ্যা ওলগা পেট্রভনা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। রাতের আহারের জন্য অপেক্ষা না করে ওলগা ফিয়োডরকে বিদায় দেবার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলেন। এসে কাঁধে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বললেন—‘ফিয়োডর তোকে অনেকদিন পরে দেখতে পেয়ে ভালো লাগল। আমাদের একটি মেয়ে আছে। তোর বোন-তার নাম ইরিনা।ও বাইরে পড়াশোনা করছে।’

        বিদায় দেবার সময় ওলগা পেট্রভনা বললেন-‘ভালোভাবে থাকিস। মাঝে মধ্যে আমার খবর করিস।’

        নাটালিয়াকে কথাগুলি বলে ফিয়োডর কিছু সময় ফেরির রেস্তোরাটির কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। ভল্গা নদীর জলের ছোট ছোট তরঙ্গগুলিতে আলোর ঝলমলানি নাচতে থাকতে দেখা গেল।

        কিছুক্ষণ পরে ফিয়োডর বলল-’মা বাবার কথা বললেন। দাদুর কথা বললেন। ঠাকুরমার কাছ থেকে টলস্টয় প্রীতির কথা বললেন। কিন্তু আমার একটি কথায় ভুল থেকে গেল নাটালিয়া।’

        নাটালিয়া ফিয়োডরের  চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বলল–’ ঠাকুরমা এখন ও বেঁচে আছেন কি ?যদি থেকে থাকেন কোথায়?’

        নাটালিয়া সায় দিয়ে  বলল–’ হ্যাঁ, বড় আবশ্যকীয় কথা।’

        মস্কো পৌঁছাতে তখনও সময় বাকি ছিল। ফেরি  নিজস্ব গতিতে ভল্গার উজানে যাত্রা করছিল। সে দিকে তাকাতে তাকাতে ফিয়োডর  বলল–’ আমাকে  হয়তো পুনরায় সেলনির ‘কাম-কাজ’ কারখানায় যেতে হবে ।ঠাকুমার কথা জিজ্ঞেস করার জন্য ।সম্ভব হলে ঠিকানাটাও নিতে হবে।’

        ‘আমিও যাব তোমার সঙ্গে ।’–নাটালিয়া বলল। ফিয়োডরের  কাছে ফেরির গতি বড়  মন্থর বলে অনুভূত হল।

        মস্কোতে কয়েকদিন থেকে অধ্যাপক ক্রিয়োসকভের সঙ্গে ওরা দেখা করল। নাটালিয়া মাকেও সখি নিনা ভলকভনা লেপিনার খবর দিয়ে ফিয়োডরের সঙ্গে সেলনিতে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। মা লিডিয়া  পাভলভনা কিছুক্ষণ চিন্তা করল যদিও ফিয়োডরের গহীন গম্ভীর এবং অধ্যয়ন প্রিয় স্বভাবের জন্য মেয়েকে তার সঙ্গে যেতে দিতে বাধা আরোপ করতে ইচ্ছা হল না । কেবল বললেন – ভালোভাবে চলিস মা।’

        ফিয়োডর এবং নাটালিয়া যখন কামা নদীর পাশে ‘কাম -আজ’ কারখানা নগরীতে উপস্থিত হল তখন বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে আগস্ট মাসের ঝিরঝিরে বৃষ্টির ঝাঁক পড়তে  শুরু করেছিল। অঞ্চলটা এমনিতেই মস্কোর চেয়ে ঠান্ডা । তারমধ্যে বৃষ্টি পড়া গরম সোয়েটারের উপরে ওরা জ্যাকেট পড়ে নিয়েছিল ।

        কারখানার কর্মীদের পায়ে ছিল গামবুট, শরীরে মাথা ঢাকা রেইনকোট। ওদের কেউ কেউ কোথাও আশ্রয় নিয়েছিল বাইরের ঝির ঝিরে বৃষ্টির দিকে  তাকিয়ে ছিল। কফি এবং মদের দোকানে ভিড় হয়েছিল। ফাঁকা হলেও রাস্তাঘাটে মানুষের যাতায়াত ছিল।  ওরা ক্ষেত্র পরিচালকের খসে যাওয়া কেবিনের  দেওয়ালে কর্মচারীরা আঠা লাগিয়ে রাখা দাবীর ভিন্ন ভিন্ন পোস্টার এবং স্লোগান গুলি পার হয়ে গিয়েছিল ।

        ফিয়োডর কামা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করল । সেখানে ঠিকঠাক হয়ে ফিয়োডর মা ওলগা পেট্রোভনার  সঙ্গে যোগাযোগ করল এবং মুসা জলিল প্রস্পেক্টের একটি রেস্তোরাঁয়  বিকেলে দেখা পাওয়ার বন্দোবস্ত করল।

        ওদের হাতে তখনও তিন ঘন্টা সময় ছিল। বৃষ্টি ছেড়ে যাওয়ায় ওরা হোটেল থেকে পাশের চকটার দিকে বেরিয়ে এল। তারপর একপাক ঘুরে শহরটা দেখার জন্য সাংস্কৃতিক রাজমহল নামে আস্থা নামক আস্থানাটি থেকে লাল-হলুদ রঙের একটি ট্রামে উঠে পড়ল। কারখানার যুবক-যুবতি কর্মীরা ট্রামটা ভরেছিল। বয়স্ক মানুষতো ছিলই না, আধবয়সী দুই একজন মানুষকে সেখানে দেখা গিয়েছিল। কারখানার যুবক-যুবতি কর্মীরা ডিউটি করতে গিয়ে বেশি কথা বলছিল না যদিও মুখগুলিতে ওদের রঙিন মনের পরিচয় ফুটে উঠেছিল। লোহার ঘর্ষণে হওয়া ট্রামের বিশেষ শব্দভেদ করে ভেতর থেকে একটি সুরেলা সুর ভেসে আসছিল। সেটা ছিল ট্রামের যুবতি চালকের। তার মাথায় বাঁধা ছিল একটি রঙিন কাপড়। সে একটি নীল রঙের কাচ দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে পৃথক হয়েছিল। কিন্তু একটি দেরাজ  থেকে একটি মাইক্রোফোন বের করে গন্তব্য স্থান গুলির কথা সুরেলা কণ্ঠে বলে বলে সে যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। বলে যাচ্ছিল– কাম-আজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন , এর পরের স্টপেজ স্টুডেন্ট–

        ফিয়োডর এবং নাটালিয়া দেখল – স্টুডেন্ট নামের আস্থানায় অনেক যুবক-যুবতি নেমে গেল। অদূরে রয়েছে কাজান পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউটের একটি শাখা।

        ‘ এর পরের স্টপেজ সেন্ট্রাল।’– যুবতি চালক ঘোষণা করে গেলেন–’ এরপরে পিস প্রস্পেক্ট, তারপরে গালামালের দোকান, তারপরে নিউ টাউন, তারপরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা…।’

        যন্ত্রপাতি এবং নানা ধরনের সরঞ্জামে ভরা বড় বড় ভাঁড়ার ঘর গুলি ওরা দেখে গেল। তারমধ্যে দেখতে পেল নানা ধরনের বিদেশি লেথ মেশিন– আমেরিকার গাইডিং লুই, ইংল্যান্ডের চার্চিল, জাপানের মিটসুবিশি, জার্মানির ওয়ারনার। সঙ্গে ইটালি, বেলজিয়াম, সুইডেন, হাঙ্গেরি ইত্যাদির ও নানা ধরনের যন্ত্র।

        ফিয়োডর বুঝতে পারল কঠিন সময়ের অন্ত পড়ার হয়তো শেষ পর্যায়। দেশের নীতি শিথিল হয়ে পড়েছে।

        ট্রামটির যুবতি চালক ঘোষণা করে গেল –’ অটো প্লান্ট, তারপরে টুলুরিপিয়ারিং সেকশন…’

চলমান ট্রামটিতে পুনরায় ঘোষণা শোনা গেল–’ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিপ’, তারপরে’ রিক্রিয়েশন সেন্টার…।’

        ফিয়োডর এবং নাটালিয়ার দুই ঘন্টা সময় পার হয়ে গেল। ওরা বৃত্তাকার পথ দিয়ে এসে পুনরায় সাংস্কৃতিক রাজমহল চকটা পেল। সেখানেই রয়েছে কামা রেস্তোরাঁ।

        ওরা রেস্তোরাঁর মেঝেটিতে বসে পড়ল।

‘ দেখতো ফিয়োডর’– নাটালিয়া বলল – একটি নদীর কত প্রভাব । সেই অতীতের সভ্যতা গড়ে উঠার পর থেকে এই রেস্তোরাঁটি পর্যন্ত ।’

        ফিয়োডর সায় দিল– তুমি নিশ্চয়ই এই শহরের কাছের কামা নদীর কথাই বলছ। হ্যাঁ, আমরা থাকা হোটেলটা কামা হোটেল। এর কারখানার নাম ও ‘কাম-আজ’– কামাজ। এখান থেকে উৎপাদিত হওয়া কিছু বড় গাড়ির নাম ও কামা।’  নাটালিয়া মুচকি হাসল।

        ওরা জানে পার্মের পশ্চিম দিকে থাকা পার্বত্য অঞ্চলটি থেকে কামা নদীটির উৎপত্তি হয়েছে এবং প্রায় হাজার মাইল বয়ে  গিয়ে ভল্গা নদীতে পড়েছে। এর বেশিরভাগ অংশে বছরের ছয় মাস ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য জলপথ সূচল। বাকি ছয় মাস সম্পূর্ণটা না হলেও জায়গায় জায়গায় বরফ জমে জলপথে বাধার সৃষ্টি হয়। তবুও নদীটির জায়গায় জায়গায় তৈরি করা বাঁধগুলি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে পার্ম অন্য ঔদ্যোগিক শহরগুলিতে সারাবছর শক্তির জোগান দেওয়া হয়।  বড় সম্পদশালী এই নদীটি।

        ‘ বড় আমোদজনক’–ফিয়োডর বলল–’ একথা সমস্ত নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে বড় বেশি প্রকট।’

        ফিয়োডরদের ওলগা  পেট্রোভনার  জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। তিনি কাজের ওখান থেকে এসেছিলেন। রেস্টুরেন্টে ঢুকে গায়ের ভারী জ্যাকেটটা খুলে নিলেন এবং ফিয়োডরদের কাছে এসে বসলেন।

        ফিয়োডর নাটালিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল–’ও নাটালিয়া নিকোলায়েভনা। আমরা দুজনেই টলস্টয় এবং টলস্টয়বাদ বিষয়ে গবেষণা করছি। সেই বিষয়ে পড়াশোনা করার সময় হঠাৎ আমরা’ লেনিনগ্রাডের নয় জন নিবাসী’র একটা কেসের সন্ধান পেলাম।

        ফিয়োডর সংক্ষেপে কথা গুলি বর্ণনা করল। নাটালিয়া ও যোগদান করল। কথাগুলি মন দিয়ে শুনতে থাকা ওলগা পেট্রভনার   দিকে তাকিয়ে ফিয়োডর বলল–’ আমরা জানতে চাই কেসটাতে থাকা লিঅ’নিড এডলার আমাদের দাদু কিনা? যদি  হয় তাহলে আমি জানতে চাই প্রকৃতপক্ষে সেই সময় কী হয়েছিল?’

        তারা প্রত্যেকেই  কিছু সময় নীরবে রইল। তারপর ফিয়োডর তার কাঁধের ঝোলায় থাকা একটি বইয়ের মাঝখান থেকে একটি ফোটো বের করল এবং ওলগা  পেট্রভনার সামনে তুলে ধরে উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল–’ এই ফটোটা একটি পেইন্টিংয়ের। কার তুমি জান কি?’

        শ্রীমতী পেট্রভনা ফোটোটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। তার মুখের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে কোমল হয়ে এল। মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বললেন–’ইনিই তো শ্রীযুক্ত নাদিয়া পপভ’না। তোমার ঠাকুরমা। তোমার বাবার মা,– আমার শাশুড়ি। যুবতি বয়সের–।’

        তার পিতা  ইভান লিঅ’নিড’ভিছ এডলারের মা শ্রীযুক্তা নাদিয়া প’পভনার ফোটো তোর ঠাকুমার ফোটো

        ফিয়োডরের উৎসুকতা উত্তেজনায় পরিবর্তিত হল। সে গভীর হয়ে আসা নিঃশ্বাস সম্বরন করার চেষ্টা করে বলল–’ তাহলে আমাকে বলবে কি তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন?’

        শ্রীমতী পেট্রভনা ফোটোটার দিকে তাকিয়ে বলল–’ বড় স্নেহশীলা তোমাদের ঠাকুরমা। তিনি বেঁচে আছেন কিনা জানিনা।’

        ফিয়োডর পুনরায় জিজ্ঞেস করল–’ ঠাকুরমা কোথায় থাকে তুমি জান কি? অন্তত তোমার সঙ্গে যখন শেষ বার দেখা হয়েছিল তখন তিনি কোথায় ছিলেন?’

        ওলগা পেট্রভনা ফটোটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপরে বললেন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল লেনা নদীর তীরে উষ্ট  কুট অঞ্চলে। গ্রামটির নাম–।’

        কিছু সময় মনে করার চেষ্টা করে শ্রীমতী পেট্রভনা  বললেন – যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে য়াকুরিম গ্রামেই ছিলেন। লেনা  স্টেশনের পাশে।’

        নাটালিয়া দ্রুত  কথা গুলি নোট করে নিল।

‘ কিন্তু’,–ওলগা পেট্রভনা  বললেন-‘ আমার কিন্তু আর কিছু মনে নেই। ঠাকুমার সঙ্গে দেখা হলে সে সময়ের কথা হয়তো জানতে পারবে।’

        ফিয়োডর বলল–’ তোমার বলা কথাটুকুতেই এখনকার মতো হয়ে যাবে।’

ফিয়োডরকে ঝোলাটা সামলে নিতে দেখে মহিলাটি বললেন–’ এই কথাটার জন্যই তুমি  আমার সঙ্গে বিশেষ করে দেখা করতে চেয়েছিলে কি?’

        ফিয়োডর সায় দিয়ে বলল–’ হ্যাঁ। ঠিকানার জন্যই। তোমার নিজের সঠিক ঠিকানাটা দাও।’

তারা কথার মধ্যে কফি খেতে শুরু করেছিল। হয়ে যাওয়ায় ওলগা পেট্রভনা বলল–’ আমি তোমার সঙ্গে নাটালিয়া আছে বলে জানতাম না। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল। আমার মেয়ে ইরিনার মতোই। তোমরা যে বন্ধু সেই জন্য আর ও ভালো লাগল।’

        তিনি ঝোলা থেকে কাগজ দিয়ে ভালোভাবে মুড়িয়ে আনা একটা পুটুলি বের করে ফিয়োডরের  দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল – এই যে তোমার মায়ের কাছ থেকে একটি ছোট্ট উপহার। এটা নাও।’

        মানুষটার কণ্ঠস্বর কোমল শোনাল়। কিছুটা করুণ হয়ে পড়েছিল নাকি ফিয়োডর বুঝতে পারল না।

        যাবার আগে ওলগা পেট্রভনা তাদের থাকা হোটেলের ঠিকানা নিয়ে ফিয়োডরকে বললেন –’ফিয়োডর নিজের যত্ন নিও । আমরা ধনী নই, কিন্তু এখন আবশ্যক হলে অল্প সাহায্য করতে পারার মতো অবস্থা হয়েছে। দরকার হলে বলবে। ‘

মায়ের কথা শুনে ফিয়োডর আবেগিক হয়ে পড়ল।

‘ নিশ্চয় মা’,–সে বলল –’ আবশ্যক হলে নিশ্চয় বলব।’

        ওলগা পেট্রভনা ফিয়োডরকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। বুট জুতো  এবং জ্যাকেট পরে বেরিয়ে যাওয়া উঁচু লম্বা মানুষটার দিকে ওরা তাকিয়ে রইল।

        সেদিন রাতের দিকে হোটেলের ঘরে কেউ নাটালিয়ার  জন্য একটা উপহার দিয়ে গেল। নাটালিয়া উপহারটা নিয়ে ফিয়োডরের ঘরে দৌড়ে এসে বলল–’ আমার জন্য এটা ওলগা কাকিমা পাঠিয়েছে।’

        উত্তেজিত হয়ে পড়ায় নাটালিয়ার দিকে তাকিয়ে ফিয়োডোর বলল–’ ভালোবাসা মানুষের বড় সম্পদ। পাওয়াটা– সঙ্গে দিতে পারাটা। এটাই প্রেম। টলস্টয় প্রেম প্রকাশ করেছিল– মানুষের জন্য, দেশের জন্য। তার লেখা এবং দর্শনের মাধ্যমে। যুদ্ধ বিদ্বেষে–।’

        কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিয়োডর বলল–’ আমার মা আমাদের কাজের দায়িত্ব আর ও বাড়িয়ে দিল।আমাদের নিশ্চয় ঠাকুরমা নাদিয়া প’পভনার সন্ধানে লেনা অঞ্চলে যেতে হবে।য়াকুরিম গ্ৰামে–।’

‘ হ্যাঁ।’– নাটালিয়া সায় দিল।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>