অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১০) । নিরুপমা বরগোহাঞি
অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ড
(১)
‘Give me your tired,your poor
Your huddled masses yearning to breathe free,
The wretched refuge of your teeming shore,
Send these ,the homeless ,tempest tossed to me.
I lift my lamp beside my golden door.’
–Emma Lazarus
সকালেই গোস্বামী তাঁর অসংযত জিহ্বার পরিচয় দিলেন এবং সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল সঙ্গে সঙ্গেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখটা ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়াটা অনেকের মতো গোস্বামীরও অভ্যাস যদিও তাঁর ক্ষেত্রে যেন Habit is the second nature অত্যন্ত বেশি করে প্রযোজ্য, মুখটা ধুয়ে উঠে চায়ের কাপ হাতে না পরা পর্যন্ত তিনি নাকি সামনের সুদীর্ঘ দিনটির (পেনশন পাওয়ার পরই গোস্বামীর কাছে শীত গ্রীষ্ম উভয় ঋতুরেই দিন সুদীর্ঘ )সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি করতে পারেন না । শ্রীমতী গোস্বামীও এত বছরে স্বামীর দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হওয়া অভ্যাসটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে আসছেন , ফলে গোস্বামী মুখটা ধুয়ে এসেই প্রসারিত ডান হাতে চায়ের কাপটা পেয়ে যান।
কিন্তু আজ মুখটা ধুয়ে এসে পাঁচ মিনিটের মতো অপেক্ষা করার পরেও সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত চায়ের কাপটা না পেয়ে রান্নাঘরে অর্থাৎ অধিক শুদ্ধ ভাষায় একসময়ের পেছনের বারান্দা এবং এখনকার ‘ অস্থায়ী‘ এবং‘ অসুবিধাজনক‘ রান্নাঘরে গোস্বামী আশা নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
‘ কী হে , আজ এখন পর্যন্ত কেন গুড মর্নিং টি–এর দেখাদেখি নেই ?’
ভাঙ্গা কড়াই একটার ওপরে একটা উনুন পেতে রাখা আছে, নিচে মানে উনুনের মধ্যে কয়েকটি খড়ি– যেখান থেকে আগুনের পরিবর্তে বেশি ধোঁয়া বেরোচ্ছে, পাশেই পাকায় চায়ের কেটলিটা , শ্রীমতী গোস্বামীর আধাপাকা আধা কাঁচা চুলের মাথাটাও সেই কেটলির সমতলে প্রায় লেগে আছে, চুলগুলি পড়ে পড়ে নাই হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট চুলে বাঁধা অতি আধুনিকাদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারা খোঁপাটা আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে…।
গোস্বামীর কণ্ঠস্বরে এখন সেই মাথাটা সমতলভূমি থেকে প্রায় দুই ফুটের মতো ওপরে উঠে এল, চোখ দুটি লাল, কপালের সামনে উশৃঙ্খল চুল। শ্রীমতী গোস্বামীর এই মূর্তি দেখে গোস্বামী কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। চোখদুটি আগুনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে লাল নাকি ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছে?
দুটো কারণেই। কথাটা সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হয়ে গেল।
‘ পেনশনধারি পুরুষ মানুষের আর কিসের চিন্তা? চাকরি শেষ, সংসারের কাজও শেষ। আমরা মহিলারা একটা পা চিতায় রেখেও সংসারের অর্ধ সমাপ্ত কাজগুলি শেষ করে তারপরেই বাকি পা চিতায় রাখার অবসর পাই। গতকাল রাতের অসময়ের বৃষ্টিতে খড়িগুলি ভিজে গেল, এখন এই ভিজা খড়ি ফুঁ দিতে দিতে মাথার ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ঘরের পুরুষ মানুষ এমনই যে, গ্যাস তো দূরের কথা এক লিটার কেরোসিন জোগাড় করার সামর্থ্য নেই, আর এখন এসেছে চায়ের অর্ডার দিতে!‘
সকালের দিকেই প্রিয়তমা পত্মীর কী মধুর সম্ভাষণ! গোস্বামী মনে মনে চিন্তা করল এবং অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু সেই ভাবটা ঢাকার জন্যই হোক অথবা পরিবেশটা হালকা করার জন্যই হোক, তিনি শ্রীমতী গোস্বামীর কর্কশ কথার উত্তরে মুখে হাসি টেনে আনলেন এবং ঠাট্টার সুরে বলে উঠলেন–‘ আজ দেখছি তুমি বড় গরম হয়ে আছ। কত ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হে? চায়ের কেটলিটা তোমার মাথায় রাখলেই গরম জল হয়ে যাবে নাকি? তাহলে আমাদের গ্যাস, কেরোসিন, ভেজাখড়ি সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!
ঠিক সেই সময়ে রুণীও মুখ ধুয়ে এসে বাবার মতোই এক কাপ চায়ের আশায় বাবার প্রায় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল, এখন বাবার এই বেঁফাস কথায় সে দ্রুত পৃষ্ঠভঙ্গ দিল –আঃ বাবা যে কী বোকা, স্থান কাল পাত্র দেখে কেন কথা বলতে শিখল না ।
ঠিকই, পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়েও পিছন দিকে তাকিয়ে রুণী মায়ের বিস্ফোরণ দেখতে পেল এবং দেখল শ্রীমতী গোস্বামী মুখে কিছু একটা রাগের চিৎকার করে ওঠে কেটলির জলটুকু সেই আধা জ্বলন্ত আগুনে ঢেলে দিল।
রুণী ফিক করে হেসে ফেলল, অবশ্য মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে।তার সক্রেটিস এবং জান্তীপের গল্পটা মনে পড়ে গেল। তার পিতাও সক্রেটিসের মতো এখন বলতে পারে‘ এত গর্জনের পরে বৃষ্টি হবে সেটা নিশ্চিত।‘ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে রুণীর হাসিটা ম্লান হয়ে এল– মানুষগুলি যে সব দিক থেকে কী দুর্ভোগের শিকার হল। ওদের মা আজ কিছুদিন থেকে নানা কথা দেখেশুনে, নানা অসুবিধা ভোগে একপ্রকার রুক্ষ মেজাজের হয়ে উঠেছেন অথচ সাধারণত কত শান্ত নিরীহ স্বভাবের স্নেহময়ী মানুষটা!
রুণী এক লাফে গিয়ে অপুর বিছানার কাছে পৌঁছাল, তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী অপু তখনও সর্বাঙ্গ একটা বেড কভার দিয়ে আবৃত করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়েছিল।
রুণী গিয়ে বেডকভারটায় টান মারল–
‘ এই দাদা,উঠ উঠ, ঘুমিয়ে থাকা শেয়াল যেমন হাঁস ধরতে পারে না, ঘুমিয়ে থাকা দেশপ্রেমিকও তেমনই বিদেশি ধরতে পারেনা। তাড়াতাড়ি উঠ ।‘
এইবার রুণী অপুর চুলে আস্তে করে একটা টান মারল এবং সে সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাজড়িত কন্ঠে অপু গর্জে উঠল–‘ এই রুণী, এভাবে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দিলে কথা ভালো হবে না।‘
‘ কোনো কাঁচা ঘুম নয়, নটার পর থেকে তো শুয়েই আছিস, পড়াশোনা নেই, ঘুমোনো ছাড়া আর কি কাজ আছে? উঠতে বলছিনা উঠ, মাকে কিছু শুকনো খড়ি এনে দিতে হবে। এমনিতেই লিডার হয়েছিস, তোর মতো ভলান্টিয়ার, লিডারদের নাকি ঘরে ঘরে কেরোসিন তেল মজুদ রয়েছে।‘
অপু বিছানা থেকেই গড়গড় করে উঠল– এক দুই লিটার তো আমিও জোগাড় করতে পারি, কিন্তু তোরাই তো সেই তেল বাড়িতে ঢুকতে দিবিনা বলেছিস, এখন বিপদে পড়ে উল্টো কথা বলছিস।‘
‘ না ,বিপদে পরে বলছি না। তোকে খ্যাপাচ্ছি। এখন উঠ। কিছু খড়ির জোগাড় কর, না হলে আজ ভাত,চা সবকিছু বন্ধ ।‘
ইতিমধ্যে গোস্বামী এসে সেখানে পৌঁছেছিল, এখন রুণী মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকানোয় তিনি হেসে বললেন–‘ আজ ভালো ভিমরুলের চাকে হাত দিয়েছিলাম‘।
‘ তোমারও কোনো বিচার–বিবেচনা নেই, এই অবস্থায় মাকে খ্যাপানোর কোনো দরকার ছিল ? এখন চা কীভাবে খাবে? প্রথমে খড়িতে আকাশের জল পড়ল, এখন মর্ত্যের জল পড়ল। সেই কাঁচা খড়ি এখন জ্বালায় এমন সাধ্য কার? আজ বেশ কিছু কাগজ জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে যদি খড়ি জ্বালানো যায়। কিন্তু এত কাগজই বা কোথায় পাওয়া যাবে? গতকাল আবার সমস্ত খবরের কাগজ বিক্রি করে দেওয়া হল– বিপদ দেখছি কখনও একা আসে না, শেক্সপিয়ার না কে যেন ঠিকই বলেছেন When it rains it does not only rain ,it pours… এই দাদা, নে তোর এই মাকড়সার জাল লাগা প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলি গিয়ে জ্বালাই, শক্ত কভার গুলি ভালো খড়ির কাজ দেবে– তোরা তো আর পড়াশোনা করবি না বলেই মনে হচ্ছে। তোদের কাছে তো এখন‘ ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ‘ এর পরিবর্তে ছাত্রানাং দেশপ্রেমং তপঃ হয়ে উঠেছে–‘
শরীর থেকে বেড কভারটা টান মেরে সরিয়ে অপু এক লাফে বিছানা থেকে উঠল এবং প্রায় চিৎকার করে উঠল–‘ এই মুখেন মারিতং জগত করে থাকা মেয়েটি কানের কাছে ফ্যাচ ফ্যাচ করে আমার কাঁচা ঘুমটা একেবারে ভাঙিয়ে দিল। কথায় যে এতটা পাকা হয়ে উঠেছে, ওর সমস্ত আক্রমণের টার্গেট আমিই হয়েছি।এই, কাঁচা খড়ি যদি না জ্বলে বেশ কিছুটা কেরোসিন ঢেলে দে না–‘
অনুবাদক