| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১০) । নিরুপমা বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese novel Gosain maa Nirupama Borgohain1অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।


দ্বিতীয় খণ্ড

()

‘Give me your tired,your poor

Your huddled masses yearning to breathe free,

The wretched refuge of your teeming shore,

Send these ,the homeless ,tempest tossed to me.

I lift my lamp beside my golden door.’

 Emma Lazarus

সকালেই গোস্বামী তাঁর অসংযত জিহ্বার পরিচয় দিলেন এবং সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল সঙ্গে সঙ্গেই।

সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখটা ধুয়ে এক কাপ চা খেয়ে নেওয়াটা অনেকের মতো গোস্বামীরও অভ্যাস যদিও তাঁর ক্ষেত্রে যেন Habit is the second nature অত্যন্ত বেশি করে প্রযোজ্যমুখটা ধুয়ে উঠে চায়ের কাপ হাতে না পরা  পর্যন্ত  তিনি নাকি সামনের সুদীর্ঘ দিনটির (পেনশন পাওয়ার পরই গোস্বামীর কাছে শীত গ্রীষ্ম উভয় ঋতুরেই দিন সুদীর্ঘ )সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি করতে পারেন না । শ্রীমতী গোস্বামীও এত বছরে স্বামীর দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হওয়া অভ্যাসটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে আসছেন ফলে গোস্বামী মুখটা ধুয়ে এসেই  প্রসারিত ডান হাতে চায়ের কাপটা  পেয়ে যান। 

কিন্তু আজ মুখটা ধুয়ে এসে পাঁচ মিনিটের মতো  অপেক্ষা করার পরেও সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত চায়ের কাপটা না পেয়ে রান্নাঘরে অর্থাৎ অধিক শুদ্ধ ভাষায় একসময়ের পেছনের বারান্দা এবং এখনকার ‘ অস্থায়ী‘ এবং‘ অসুবিধাজনক‘ রান্নাঘরে গোস্বামী আশা নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

‘ কী হে আজ এখন পর্যন্ত কেন গুড মর্নিং টিএর দেখাদেখি নেই ?’

ভাঙ্গা কড়াই একটার ওপরে একটা উনুন  পেতে রাখা আছেনিচে মানে উনুনের মধ্যে কয়েকটি খড়ি– যেখান থেকে আগুনের পরিবর্তে বেশি ধোঁয়া বেরোচ্ছেপাশেই পাকায় চায়ের কেটলিটা শ্রীমতী গোস্বামীর আধাপাকা আধা কাঁচা  চুলের মাথাটাও সেই কেটলির সমতলে প্রায় লেগে আছেচুলগুলি পড়ে পড়ে নাই হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট চুলে বাঁধা অতি আধুনিকাদের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারা খোঁপাটা আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে

  গোস্বামীর কণ্ঠস্বরে এখন সেই মাথাটা সমতলভূমি থেকে প্রায় দুই  ফুটের মতো ওপরে উঠে এলচোখ দুটি লালকপালের সামনে উশৃঙ্খল চুল। শ্রীমতী গোস্বামীর এই মূর্তি দেখে গোস্বামী কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। চোখদুটি আগুনে ফুঁ দিয়ে দিয়ে লাল নাকি ক্রোধে লাল হয়ে উঠেছে?

দুটো কারণেই। কথাটা সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণিত হয়ে গেল।

‘ পেনশনধারি  পুরুষ মানুষের আর কিসের চিন্তাচাকরি শেষসংসারের কাজও শেষ। আমরা মহিলারা একটা পা  চিতায়  রেখেও সংসারের অর্ধ সমাপ্ত কাজগুলি শেষ করে তারপরেই বাকি পা চিতায় রাখার অবসর পাই। গতকাল রাতের অসময়ের বৃষ্টিতে খড়িগুলি ভিজে গেলএখন এই ভিজা খড়ি ফুঁ দিতে দিতে মাথার ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ঘরের পুরুষ মানুষ এমনই যেগ্যাস তো দূরের কথা এক লিটার কেরোসিন জোগাড় করার সামর্থ্য নেইআর এখন এসেছে চায়ের অর্ডার দিতে!

সকালের দিকেই প্রিয়তমা পত্মীর কী মধুর সম্ভাষণগোস্বামী মনে মনে চিন্তা করল এবং অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু সেই ভাবটা ঢাকার জন্যই হোক অথবা পরিবেশটা হালকা করার জন্যই হোকতিনি শ্রীমতী গোস্বামীর কর্কশ কথার উত্তরে মুখে হাসি টেনে আনলেন এবং ঠাট্টার সুরে বলে উঠলেন–‘ আজ দেখছি  তুমি বড় গরম হয়ে আছ। কত ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হেচায়ের কেটলিটা তোমার মাথায় রাখলেই গরম জল হয়ে যাবে নাকিতাহলে আমাদের গ‍্যাসকেরোসিনভেজাখড়ি সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!

ঠিক সেই সময়ে রুণীও  মুখ ধুয়ে এসে বাবার মতোই এক কাপ চায়ের আশায় বাবার প্রায় পেছনে এসে  দাঁড়িয়েছিলএখন বাবার এই বেঁফাস  কথায় সে দ্রুত পৃষ্ঠভঙ্গ দিল –আঃ বাবা যে  কী বোকাস্থান কাল পাত্র দেখে কেন কথা বলতে শিখল না ।

ঠিকইপৃষ্ঠভঙ্গ দিয়েও পিছন দিকে তাকিয়ে রুণী  মায়ের বিস্ফোরণ দেখতে পেল এবং দেখল শ্রীমতী গোস্বামী মুখে কিছু একটা রাগের চিৎকার করে ওঠে কেটলির জলটুকু সেই আধা জ্বলন্ত আগুনে ঢেলে দিল।

রুণী  ফিক করে হেসে ফেললঅবশ্য মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে।তার সক্রেটিস এবং জান্তীপের গল্পটা মনে পড়ে গেল। তার পিতাও সক্রেটিসের মতো এখন বলতে পারে‘ এত গর্জনের পরে বৃষ্টি হবে সেটা নিশ্চিত।‘ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে রুণীর হাসিটা ম্লান  হয়ে এল– মানুষগুলি যে সব দিক থেকে কী দুর্ভোগের শিকার হল। ওদের মা আজ কিছুদিন থেকে নানা কথা দেখেশুনেনানা অসুবিধা ভোগে একপ্রকার রুক্ষ মেজাজের হয়ে উঠেছেন অথচ সাধারণত কত শান্ত নিরীহ স্বভাবের স্নেহময়ী মানুষটা!

রুণী এক লাফে  গিয়ে অপুর বিছানার কাছে পৌঁছালতার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী অপু তখনও সর্বাঙ্গ একটা বেড কভার দিয়ে আবৃত করে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়েছিল।

রুণী গিয়ে বেডকভারটায় টান মারল–

‘ এই দাদা,উঠ উঠঘুমিয়ে থাকা শেয়াল যেমন হাঁস ধরতে পারে নাঘুমিয়ে থাকা দেশপ্রেমিকও তেমনই বিদেশি ধরতে পারেনা। তাড়াতাড়ি উঠ ।

এইবার রুণী অপুর চুলে আস্তে করে একটা টান মারল এবং সে সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাজড়িত কন্ঠে অপু গর্জে উঠল–‘ এই রুণীএভাবে কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দিলে কথা ভালো হবে না।

‘ কোনো কাঁচা ঘুম নয়নটার পর থেকে তো শুয়েই আছিসপড়াশোনা নেইঘুমোনো ছাড়া আর কি কাজ আছেউঠতে বলছিনা উঠমাকে কিছু শুকনো খড়ি  এনে দিতে হবে। এমনিতেই লিডার হয়েছিসতোর মতো ভলান্টিয়ারলিডারদের নাকি ঘরে ঘরে কেরোসিন তেল মজুদ রয়েছে।

অপু বিছানা থেকেই গড়গড় করে উঠল– এক দুই লিটার তো আমিও জোগাড় করতে পারিকিন্তু তোরাই তো সেই তেল বাড়িতে ঢুকতে দিবিনা বলেছিসএখন বিপদে পড়ে উল্টো কথা বলছিস।

‘ না ,বিপদে পরে বলছি না। তোকে খ‍্যাপাচ্ছি। এখন উঠ। কিছু খড়ির জোগাড় করনা হলে আজ ভাত,চা   সবকিছু বন্ধ ।

ইতিমধ্যে গোস্বামী এসে সেখানে পৌঁছেছিলএখন রুণী  মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকানোয় তিনি হেসে বললেন–‘ আজ ভালো ভিমরুলের চাকে হাত দিয়েছিলাম 

‘ তোমারও কোনো বিচারবিবেচনা নেইএই অবস্থায় মাকে খ্যাপানোর কোনো দরকার ছিল এখন চা কীভাবে খাবেপ্রথমে খড়িতে আকাশের জল পড়লএখন মর্ত‍্যের জল পড়ল। সেই কাঁচা খড়ি  এখন জ্বালায় এমন সাধ্য কারআজ বেশ কিছু কাগজ জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে যদি খড়ি জ্বালানো যায়। কিন্তু এত কাগজই বা কোথায় পাওয়া যাবেগতকাল আবার সমস্ত খবরের কাগজ বিক্রি করে দেওয়া হল– বিপদ দেখছি কখনও একা আসে নাশেক্সপিয়ার না কে যেন ঠিকই বলেছেন When it rains it does not only rain ,it pours… এই দাদানে তোর এই মাকড়সার জাল লাগা প্র্যাকটিক্যাল খাতাগুলি গিয়ে জ্বালাইশক্ত কভার গুলি ভালো খড়ির কাজ দেবে– তোরা তো আর পড়াশোনা করবি না বলেই মনে হচ্ছে। তোদের কাছে তো এখন‘ ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ‘ এর পরিবর্তে ছাত্রানাং দেশপ্রেমং তপঃ হয়ে উঠেছে–

শরীর থেকে বেড কভারটা টান মেরে সরিয়ে অপু এক লাফে বিছানা থেকে উঠল এবং প্রায় চিৎকার করে উঠল–‘ এই মুখেন মারিতং জগত করে থাকা মেয়েটি কানের কাছে ফ‍্যাচ ফ‍্যাচ  করে আমার কাঁচা  ঘুমটা একেবারে ভাঙিয়ে দিল। কথায় যে এতটা পাকা হয়ে উঠেছেওর সমস্ত আক্রমণের টার্গেট আমিই হয়েছি।এইকাঁচা  খড়ি যদি না জ্বলে বেশ কিছুটা কেরোসিন ঢেলে দে না–

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত