অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৪) । নিরুপমা বরগোহাঞি
‘অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।
প্রথম খণ্ড
(৪)
অপুঃ সেই চিরাচরিত মার্কসীয় তোতা পাখির মুখস্থ করানো বক্তৃতা। শোন রুণী, দুঃখী বলেই এভাবে অবাধ বিদেশি নাগরিককে আমাদের দুঃখী অসমকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি ? আমাদের দেখছি একদিন নিজের ঘরে পরবাসী হয়ে যেতে হবে ওদেরকে আসতে বাধা না দিলে বা যারা এসেছে তাদেরকে ফেরৎ না পাঠালে । ত্রিপুরা আর সিকিমের অবস্থা দেখতে পাচ্ছিস না – সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের দেশে মাইনোরিটি হয়ে পড়ল । তোদের মত উদারপন্থী সর্বভারতীয় দলের চেলা হয়ে থেকে আমরা অসমিয়ারা বহিরাগতকে ঘরের মাঝখানে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে ওদের সামনে নিজেকে বলিদান দিতে পারিনা । এতদিন অসমের জনগণ ঘুমিয়ে ছিল কিন্তু আজ জেগে উঠেছে, আজ অসমের জনগন দেহে রক্তের শেষ বিন্দু থাকা পর্যন্ত নিজের সুজলা সুফলা দেশমাতাকে বিদেশির কালগ্ৰাস থেকে মুক্ত করার জন্য অহিংস শান্তিপূর্ণ সংগ্ৰাম চালিয়ে যাবে।
(অপু আর রুণীর তর্কাতর্কিতে ‘ সংগ্রাম’ শব্দটা শুনেই শ্রীমতী গোস্বামীর অশান্ত বুকের ধপধপানি আর ও বেড়ে উঠে– অহিংস বা শান্তিপূর্ণ শব্দ দুটি এক কানে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে যায়, কেবল দুই কানের মাঝখানের মগজে লেগে থাকা ‘সংগ্রাম’ শব্দটি তার মাতৃ হৃদয়ে ধড়ফড়ানি জাগায়– সংগ্রাম যদি অপূ-রুণীর কোনো অনিষ্ট সাধন করে? সংগ্রাম যদি তাঁর মতো আরও অনেক মাতার সন্তানের কোনো অনিষ্ট করে? সংগ্রাম যদি এই’ সোনার পুতুল বাচ্চা’দের- তাঁরা অসমিয়া, বাঙালি, বিহারী ,নেপালি ,হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান মায়েদের বুক শূন্য করে নিয়ে যায়?)
রুণীঃদাদা, প্রব্রজনের সমস্যাটা একটি অতি জটিল সমস্যা। কিন্তু তার আগে বলে নিই যে আমরা কখনও বলব না যে বিদেশি বহিরাগতকে আমাদের রাজ্যে বসাতে হবে বা অসাংবিধানিকভাবে ভোটার লিস্টে তাদের নাম ঢোকাতে হবে। ক্ষুধার্ত বা অন্যান্য অত্যাচার বা ন্যাস্ত স্বার্থের চক্রান্তের বলি হয়ে একদল মানুষ অন্যের দেশে প্রবেশ করতেই থাকে, সমগ্র পৃথিবী জুড়েই এই ঘটনা ঘটছে। মেক্সিকোর দুঃখী জনগণ আমেরিকার যুক্তরাজ্য প্রবেশ করা কার্য কি তার শক্তিশালী সরকারও বাধা দিতে পারেনি। কিছুদিন আগে একটা খবর পড়লাম যে পাকিস্তানিরা সোজাসুজি পশ্চিম জার্মানিতে প্রবেশ করার সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রিয়ার পাহাড় অঞ্চল দিয়ে গোপনে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তাই বিদেশির অসমে অনুপ্রবেশ এরকম কোনো আশ্চর্য ঘটনা নয়। ইলেকশন কমিশনের মতে তো অসমে ১২.৬৩% ভাগ ভোটার বেড়েছে, অন্যদিকে ত্রিপুরায় বেড়েছে ২১% ভাগ এবং কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে ১৬ %।
অপুঃ তুই চুপ কর রুণী, এস এল শ্বাকধরের মিথ্যা এবং দুমুখো কথার স্বরূপ অসমবাসীর সামনে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার মুখোশ খুলে গেছে। অসমের মতো, ভারতের কোথাও এই ধরনের অবাধ বহিরাগতদের প্রবেশ হয়নি বলে শ্বাকধের বললেই হল কি। সেই ধুরন্ধর মানুষটি কাল যে কথা বলে আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে।
আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৩) । নিরুপমা বরগোহাঞি
রুণীঃ কিন্তু দাদা, গভীরভাবে ভেবে দেখতো প্রথম থেকে এই লোকদের নিজের স্বার্থে কারা অসমের মাটিতে বসিয়েছে। অসমের অনেক দেশ প্রেমিক নেতা এবং ভাষা-সংস্কৃতির রক্ষাকারীরাই নয় কি? রাজনৈতিক নেতা নিজের গদির লোভে, সরকারি অফিসার, মাটির হাকিম টাকার লোভেই নয় কি ?বহু দেশ প্রেমিক দালালি করে বহিরাগতের কাছে জমি বিক্রি করেছে । এখন জনজাতির স্বার্থে চোখের জল ফেলা রাজনৈতিক দলগুলিই একটা সময়ে ইলেকশন খেলার জন্য ট্রাইবেল বেল্টে জমিতে চাষ করা মানুষদের এনে বসিয়েছে।১৯৪৭ সন থেকে ১৯৬৭ সনের মধ্যে কেবল তামোলপুর বেল্টেই ৫০,০০০ অজনজাতীয় মানুষদের বসানো হয়েছিল। আমাদের কথা হল এটাই যে গত প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে বহিরাগত অসমে প্রবেশ করে যে মনুষ্য-পর্বতের সৃষ্টি করেছে, তাকে হুলুস্থুল করে কয়েকটি মাসে কেন, কয়েক বছরেও খসাতে পারবে না। তাছাড়া সনাক্তকরণ এত সহজ নয়, যেখানে অসমের বহু স্থানীয় অসমিয়া মানুষদের জমির পাট্টা নেই, সেখানে ভারতীয় বলে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার অবস্থা হওয়া বহু বাঙালি, বিহারী, নেপালির সেই পাট্টা বা অন্য প্রমাণ থাকার কী সম্ভাবনা থাকতে পারে? তাই সমস্যাটা বড় জটিল দাদা– এতটাই জটিল যে অসমে ভাই ভাই হয়ে থাকা মানুষের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা যে মেট্রিকে টমাস হার্ডির কবিতাটিতে পড়েছিলাম মনে আছে কি তোর?যে দুজন বন্ধু সরাইখানাতে দেখা সাক্ষাৎ হলে পরস্পরকে অভ্যর্থনা করে মদ এগিয়ে দিত,রাজনীতির চক্রান্তে,নেতার চক্রান্তে,ন্যস্ত স্বার্থের চক্রান্তে সেই প্রিয় বন্ধুরাই যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরের শ্ত্রু হিসেবে মুখোমুখি হয়।মাঝে মাঝে জানিস দাদা,আমি যে একটি কথা এত ভাবি,ভেবে ভেবে আমার চোখে জল এসে যায়-ভয়ে শরীর শিউরে উঠে-মা যে আমাদের রজব আলী এবং হলধরের কথা বলে সেই সরল বোকা অশিক্ষিত দরিদ্র অন্তরঙ্গ বন্ধু মানুষ দুটি যদি আজ এরকম পরিস্থিতির চক্রান্তে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনায় পরস্পরের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়?’
সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হওয়ার কিছু পরে বাড়িতে ফেরা ছেলেমেয়েদের এক কাপ বর্নভিটা দেবার জন্য শ্রীমতী গোস্বামী গ্যাসের চুলোর ওপরে কেটলিতে দুই কাপ জল বসিয়ে হাতে দিয়াশলাইটা নিয়ে আগুন জ্বালাতে যাচ্ছিলেন মাত্র, তখন রুণীর করুণ সুরের এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাতটা যেন কঠিন প্রস্তরে পরিণত হল, দিয়াশলাইর কাঠি জ্বালানোর মতো শক্তিটুকুও তাঁর হাতে রইল না। কী ভয়ঙ্কর কথা,কী সর্বনাশা কথা, কী অমঙ্গলের কথা। নভেম্বর মাসের শীতেও শ্রীমতী গোস্বামীর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমা হতে লাগল– হলধর আর রজব আলী, রজব আলী আর হলধর। গোঁসাই মা এবং গোঁহাই মা। হ্যাঁ,গোঁসাই মা ,গোঁহাই মা—অনেক দূর অতীতের বুক ভেদ করে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আসা এই আর্তস্বর যেন তাঁর কানের পর্দা ফাটিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
অনুবাদক