অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৫) । নিরুপমা বরগোহাঞি
‘অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।
প্রথম খন্ড
(পাঁচ)
শৈশবে অপু যত কাঁধে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল খুব কম ছেলেমেয়েই হয়তো সেভাবে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। সে ছিল গোস্বামীদের একমাত্র সন্তান, তাই পিতা যেন তাকে কোল এবং কাঁধ থেকে নামাতেই চাইত না। তাদের প্রথম সন্তান অনিমাকে পড়াশোনার সুবিধার জন্য দাদারা শহরে রেখে দিয়েছিল, কারণ মাটির হাকিমের চাকরি করা পিতার সঙ্গে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে কি আর ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে । এটাই ছিল দাদাদের বক্তব্য। তাছাড়া অনিমার জন্মের এক বছর পরে জন্ম হয়েছিল নিপুর– মাকে একজোড়া ছেলে মেয়ের জঞ্জাল সহ্য করা থেকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এরকম একটি ব্যবস্থার দ্বারা। এদিকে দিপুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী গোস্বামী প্রসূতি রোগেও আক্রান্ত হয়েছিল, এরকম একটি অবস্থায় দুটি শিশুকে পালন করাও সহজ কথা নয়। নিপুর জন্মের তিন বছর পরে জন্ম হয়েছিল অপুর এবং অপুর জন্মের তিন মাস পরে নিপুর মৃত্যু হয়েছিল, ফলে অপুর জন্য বাবার মনে জন্ম হয়েছিল বিশেষ অপত্যস্নেহের, বিশেষ উদ্বিগ্নতার। গোস্বামী অফিস থেকে এসে তাকেই নেবে, তাকেই কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। তাদের সরকারি কোয়ার্টারের প্রকাণ্ড কম্পাউণ্ডটাতে বিকেলে রাজপথ দিয়ে আসা-যাওয়া করা মানুষ প্রায়ই দেখবে সেই দৃশ্য গোস্বামী কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রীমতী গোস্বামীর কাছে আজও সেই স্মৃতি করুণ এবং মধুর অল্প ধূসর হলেও সেই ছবি যথেষ্ট স্পষ্ট। বিকেলে তিনি হাতে উল বা এমব্রয়ডারী নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন – (অপুর জন্মের এক বছরের মধ্যে তিনি অপুর জন্য কম জামা এবং সোয়েটার তো করেননি , আগে নিপুর জন্য করা সমস্ত সোয়েটার এবং জামা প্যান্ট ভিখারিদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ) সামনের ছোট নদীটির ওপারে বাঁশের ঝোপটিতে অস্ত যেতে চলা সূর্যের বিষন্ন রোদ, তাঁর হৃদয়ে আনন্দ এবং বিষাদের অনুরণন, পিতার কাঁধে উঠে আনন্দমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার প্রাণের পুতুল – একটা সুখের অনুভূতি কন্ঠ রুদ্ধ করে তুলতে চায়, পুনরায় তার নয়ন মনের চির অগোচর রাজ্যে চলে যাওয়া অন্য প্রাণের পুতুলটির জন্য তার মাতৃহৃদয়ে এখনও হাহাকার আর করুণ অনুভূতি কন্ঠকে রুদ্ধ করে রাখে। তারপরে আজ কুড়ি বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু সেই সময়ের সেই দিনগুলির স্মৃতি ছায়া ছবির মতোই মাঝেমধ্যে মনের পর্দায় ভেসে উঠে। সেই মনের পর্দায় ধূসর হয়ে গেলেও এখনও উকি মেরে যায় অন্য দুটি মূর্তিও– রজব আলী এবং হলধর, যে রজব আলী আর হলধর তখন তার চেয়ে বয়সে বড় দুটো পুরুষ মানুষ হলেও তাঁর কাছে হয়ে পড়েছিল দুটি বুড়ো শিশুর মতো এবং সেই মানুষ দুটি তাদের ঘরের বারান্দায় লেপ্টে বসে থাকতে আরম্ভ করার পর থেকে অপুর ঘুরে বেড়ানো কাঁধেরও পরিবর্তন হতে লাগল। কখন ও তাকে গোস্বামীর কাঁধ থেকে ছিনিয়ে আনবে হলধর ,কখনও রজব আলী। অপু অবশ্য হলধরের বুকে ঈর্ষার শেল হেনে রজব আলী উপস্থিত থাকলে তার কাঁধকেই পছন্দ করে। রজব আলীর অনুপস্থিতে , পিতার অনুপস্থিতে হলধর সারাদিন তাকে কাঁধে নিয়ে বেড়ানোর কথা অকৃতজ্ঞের মতো ভুলে গিয়ে হলধরকে নাকচ করে রজব আলীর কাঁধে চট করে চলে যাবার কারণ অবশ্য রজব আলীর দাড়ির গোছা যা অপু কাঁধ থেকে কাত হয়ে হয়ে টানে আর ফুর্তিতে খিলখিল করে হেসে ওঠে । হলধর মুখ কালো করে সে দিকে তাকায় এবং বিকৃত তৃপ্তিতে চিৎকার করে উঠে–-
‘ব্যাটার দাড়ির গোছা ভালো করে টেনে ছিড়ে দাও ছোট গোঁসাই।’ রজব আলী ও তখন গড়গড় করে চিৎকার করে ওঠে – ‘আমার দাড়ি না ছিঁড়ে ছোট হাকিম তোর টাক মাথার চুল ছিড়বে নাকি রে?’
আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৪) । নিরুপমা বরগোহাঞি
একদিন যেন কীভাবে এই দুটো বুড়ো শিশু এসে ধীরে ধীরে তার মাতৃহৃদয়কে উষ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রথম এসেছিল হলধর। একদিন শীতের দুপুর বেলা অপু শুয়েছিল এবং তিনি সামনের দিকের বারান্দায় রোদের উষ্ণতায় উল বুনছিলেন। হঠাৎ গেট ঠেলে , ফুলের বাগান পার হয়ে অত্যন্ত হাস্যকর মুখাবয়বের টাক মাথার একজন ক্ষীণ কালো মানুষ হনহন করে চলে এল এবং শ্রীমতি গোস্বামী কিছু জিজ্ঞেস করা বা বলার আগেই মানুষটা খপ করে কাঁধের থলে থেকে এক আঁটি পাকা কলা বের করে তার পায়ের কাছে রেখে একপ্রকার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলে উঠল–’ গোঁসাই মা, পা দুটি একটু এগিয়ে দিন তো । এই অধম হলধর একটা প্রণাম করে পাপ খন্ডন করি ।’
ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রীমতী গোস্বামী প্রথমে কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন
– কোথাকার কোনো এক পাগল এসে হাজির হল না কি?
অনুবাদক