| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৮) । নিরুপমা বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, Assamese novel Gosain maa Nirupama Borgohain1অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।


 

 

এইবার হলধরের কথার মধ্যে রজব আলী অসহায়ের  মতো বলে উঠল–’ গোঁহাই স‍্যার, আমি তো বারবার, গোঁহানী মা’ ‘গোঁহানী মা’ বলে ডাকছি,ওই তো ‘গোঁহানী মা’ গোঁহানী মা ‘ বলে শুনছে–’ রজব আলীর কথা ভালোভাবে শেষ না হতেই গোস্বামী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন এবং রজব আলী ও হলধরের জন্য চা করতে  যাওয়া শ্রীমতী গোস্বামী, স্বামীর সেই উচ্চহাসির  শব্দে বাইরে বেরিয়ে আসায় তার দিকে তাকিয়ে গোস্বামী হাসতে হাসতে বললেন–’ ওদের দুজনের আজকের কান্ড আমাকে কলেজের দিনের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে পড়ত নতুন করে সিলেট অঞ্চল থেকে আসা একটি ছেলে। সে ‘ভ’কে সব সময় ‘ব’ উচ্চারণ করত। আমরা তাকে ‘ভাত’ শব্দটির সঠিক উচ্চারণ করানোর চেষ্টা করায় একদিন সে ক্রোধে পাগল হয়ে চিৎকার করে উঠেছিল,’ আমি তো  ‘বাত’কে  ‘বাত’ই বলি তোমরা শোনার সময় শোনো ‘ বাত’। আর যখন এত বছর পরে রজব আলীর মুখে সেই একই কথা শুনতে পেলাম–’ গোস্বামী পুনরায় একটা প্রাণ খোলা হাসি হাসলেন, তারপর রজব আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন– রজব আলী, তুমি তোমার গোহাঁনী  মাকে গোহাঁনী মা বলেই ডাকবে, কারণ যেদিন তুমি তাকে গোঁসানী মা বলে ডাকতে শিখবে-সেদিন বুঝতে হবে যে রজব আলী জ্ঞানবৃক্ষের বীজ গিলেছে এবং এখন থেকে তার ‘গোসাঁনী মা’ সম্বোধনে আগের সেই শিশুর সরলতা, ভক্তি এবং ভালোবাসা নিহিত থাকবে না। গোস্বামীর এই রহস্যের মতো কথাটুকুর তাৎপর্য বোঝার জন্য রজব আলী এবং হলধর কিছুটা হাঁ করে অবাক হয়ে গোস্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকা ভঙ্গিতে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি   এবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন–’ শংকরদেবের সেই কাহিনিটা তুমি জান কি? তাঁর কাছে নানা সম্প্রদায়ের ভক্ত আসে। একজন কছারী ভক্ত শংকরদেবের সঙ্গে সব সময় তুই বলে কথা বলার দৃশ্যে অসহ্য বোধ হওয়ায় একজন অ-কছারী লোক শংকরদেবের অনুপস্থিতে তাকে ধমকাল– এমন একজন মহাপুরুষকে তুই বলার এত আস্পর্ধা তোর। আজ থেকে যদি তাকে তুই বলতে শুনি তাহলে কিন্তু কথা ভালো হবে না। আপনি বলতে না পারলেও অন্তত তুমি বলবি।’ সেদিনই রাতে শাকসব্জি না কীসের একটু উপঢৌকন নিয়ে সেই কছারী  ভক্ত শংকরদেবের কাছে এল। সেই অসময়ে ভক্তটিকে দেখে শংকরদেব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন–’ কী হে   বাপু, এই অসময়ে কিসের জন্য এসেছ? কছারী ভক্ত শংকরদেবের সামনে পুঁটলিটা রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বলল–’ প্রভু ঈশ্বর, তোকে তুমি বলতে এসেছি।’ শংকরদেব তখন তাঁর স্নেহ মাখানো হাসি হেসে বললেন–’ আমাকে তোমার তুমি বলতে হবে না, আগের মতো তুই বলেই ডাকবে, কারণ যেদিন থেকে তুমি আমাকে’ তুমি’ বলতে শুরু করবে সেদিন থেকে তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা এবং ভক্তিভাবে কৃত্রিমতা প্রবেশ করবে।’

শ্রীমতী গোস্বামী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন, স্বামীর গল্প তার মুখে একটা হাসির ঢেউ তুলল, কিন্তু চোখের কোণে তার দু ফোঁটা অশ্রু বিন্দু ঝলসে ওঠে হাসি এবং অশ্রুর অপূর্ব রামধেনু সৃষ্টি করল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-৭) । নিরুপমা বরগোহাঞি


হলধর  এবং রজব আলীকে নিয়ে শ্রীমতী গোস্বামীর একটা মুশকিলের কথা হয়েছিল এই যে ওদের আনা জিনিসগুলির দাম দেবার জন্য প্রায়ই মৌখিক যুদ্ধ চালাতে হচ্ছিল, কিন্তু তবুও মাঝে মধ্যে বশ্যতা স্বীকার করে দুই এক পদ জিনিস বিনে পয়সায়  নিতে হয় যখন হলধর বলে–’ বাগানের প্রথম জিনিসটাও আমার আপনাকে বিক্রি করতে হবে? এরপরে যত পয়সা দিতে হয় দেবেন, আজকের পাকা পেঁপেটা আমি ছোট গোঁসাইর  নাম করে এনেছি–’ আর যখন রজব আলী বলে–’ আমার বাগানের এটাই প্রথম ফুলকপি, এটা আমি ছোট গোঁসাইকে   না খাইয়ে অন্য কারও কাছে বিক্রি করতে পারব? আমার নিজের ছেলে মেয়ে নেই, বুড়ো হলে এই ছোট গোঁসাই আমাকে দেখবে না কি?’

রজব আলীর ছেলে মেয়ে কেন, স্ত্রীও নেই, তার দুর্ভাগ্যের কথা প্রথম দিনেই হলঘর তাকে বলেছিল।শাকসব্জির ভারসহ প্রথম দিন যখন রজব আলীকে হলধর তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, সেদিনই এই জীর্ণশীর্ণ মানুষটার বিশাল বুকের  অশ্রুর পুকুরের কথা তিনি জানতে পেরেছিলেন ।রজব আলী সন্তান উপহার দিতে না পারার অপরাধে নাকি তার তিন স্ত্রী তাকে ত‍্যাগ করে চলে গেছে।তখন থেকে সে তার চরের ঝুপড়িটাতে একাই থাকে, চাষবাস করে এবং হাত পুড়িয়ে নিজে রান্নাবান্না করে কোনোভাবে দিন গুজরান করছে।হলধর শেষে  বলেছিল– মানুষের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত রজবকে সেই জন্যই আমি আপনার কাছে নিয়ে এসেছি গোসাঁই মা, আপনার দয়া মায়ার শরীর, আপনার দয়াই এর  স্নেহ ব্যাকুল মনকে কিছুটা সুখ দিতে পারবে –। এরপরে হলধর নিজের কথাও বলেছিল ––’ অবশ্য গোসাঁই মা সংসার করে, ছেলে মেয়ের জন্ম দিয়ে কি মানুষের সুখ আছে?’

আমি নিজেই কি সুখ পেয়েছি? একের পরে এক আমার দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে জন্মের পরেই  মারা গেছে, এখন বাকি আছে এই পাংখাটানা ছেলেটি এবং দুটি ছেলে।মেয়ে আর নেই। ছেলে মেয়ের মা এখনও মৃত ছেলেমেয়েদের কথা স্মরণ করে মাঝেমধ্যে কাদে, আমার সান্ত্বনা মানে না। কাঁদলে আর কী হবে, মৃত সন্তান কি আর তার কোলে ফিরে আসবে?…’ এটুকু বলার পরে হলধর  হঠাৎ সচকিত হয়ে দেখেছিল যে  তার গোঁসাঁই মায়ের চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এসেছে এবং সে হুলুস্থল  করে কিছু বলার আগে তিনি রুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন – মা হওয়ার বড় জ্বালা হলধর, তোমার পরিবারকে কী দোষ দেব, তিনিতো চারটি সন্তান হারিয়েছেন, আমি যে একটি হারিয়েছি তার শোকেই অন্তরটা আজও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে–’ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত