অনুবাদ কবিতা: রাজেশ কুমার তাঁতীর অসমিয়া কবিতা । বাসুদেব দাস
কবি এবং গল্পকার রাজেশ কুমার তাঁতী অসমের যোরহাটে ১৯৭৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন।ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করা শ্রীতাঁতী বর্তমানে নুমলীগড় শোধনাগারে কর্মরত।‘অবগাহন’প্রথম গল্প সঙ্কলন।‘সেউজীয়া উপত্যকাত সূর্য নামিব’শ্রী তাঁতীর অন্যতম কাব্য সঙ্কলন।‘সেউজীয়া হৃদয়ে কব খোজা কথাবোর’সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থ।
প্রতিটি কবির প্রতিটি কবির রক্ত জলপাই রঙের (ফ্রেডরিক গার্সিয়া লোরকার স্মরণে ) জলপাই ফুলের মতো ফুটে থাকতে চাই সাদা সারি সারি বেণীর মতো আর রূপান্তরিত হতে চাই থোকাথোকা জলপাই ফলে। বিদ্রোহীর পোষাকের রঙ জলপাইর মতো গাঢ়,নিষিদ্ধ সবুজ কেউ একজন দেখেছিল ছেঁচড়াই টেনে নেওয়া একজন একজন কবিকে জলপাই বনের দিকে তাকে আজও কেউ ফিরে আসতে দেখেনি এই কবির নির্যাতনের সাক্ষী হয়েছিল একটা জলপাই গাছ। ক্ষুধায় পাগল হওয়া একদল মানুষের জন্য একজন কবি ভেবেছিল সূর্যকে একটা রুটি হিসেবে, অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল ওদের মুখে লেগে থাকা কারখানার কালো ধোঁয়ার ছাইগুলির দিকে, গলা পর্যন্ত পুঁতে রাখা মানুষগুলিকে তিনি খুঁড়ে বের করেছিলেন একটি কলমের দ্বারা—সেটাই ছিল তাঁর দোষ। জলপাই গাছে তাঁর আত্মা প্রবেশ করেছিল একটা নিথর শরীর থেকে আর টপ টপ করে খসে পড়েছিল রক্ত জলপাই রঙের পৃথিবীর প্রতিটি কবির হৃদয়ে। বাবা,মা এবং আমি বাবা পাহাড়ের পাশে একজন কৃ্ষক ছিলেন তিনি। মাটির মানুষ মাটিতে লীন হয়ে যাওয়া আর মাটি ভেদ করে বের হওয়া বীজে তিনি অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন। তাঁর হাড়্গুলি ক্রমশ মাটিতে ভরে পড়ছিল। রোদ এবং বৃষ্টিতে কাহিল হওয়া মানুষটা দাবি করেছিলেন আমার জৈবিক পিতৃ্ত্বের আমি তাঁর কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম,তিনি হেসেছিলেন। আমি দেখেছিলাম,জীবনটাকে উর্বরতা প্রদান করায় তাকে কিভাবে কাতর হতে হয়েছিল শীতার্ত রাতগুলিতেও, আগুনে পোড়া দিনগুলির চেয়েও। মা বাবাকে বৃক্ষ জ্ঞান করা তিনি বাতাসের মতোই তিনি আমার খোঁজে নিরন্তর সন্ধান চালিয়েছিলেন আর কারণে অকারণে চঞ্চল করে তুলেছিল সেই বৃক্ষকে। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্ব,দুখিনী নারী। আমাকে হারানোর দুঃখে তাপিত ভারাক্রান্ত মুখর অধিকারী। আমি নারীর সমস্ত গোপনীয়তা ভেঙ্গে আমি পালিয়ে এসেছি মায়ের গর্ভের দুয়ার ভেদ করে, আমিই দুঃখ আর বেদনা, দয়া আর করুণা সময়ের। প্রতিটি দিনকে হত্যা করে ধাবিত একজন অশ্বারোহী জীবনের বিপরীত দিকে। প্রতিটি দিন এসে আমাকে বলে প্রতিটি দিন এসে আমাকে বলে, উদযাপন কর সূর্যের আলোর শুভ্রতা এবং রাতের মায়াবী গোপনীয়তা, আমার কাছে বয়ে আনে অঞ্জলি ভরিয়ে জীবনের অমল উৎসব। আমি নিজেকে হারাই সেই উৎসবের সম্ভাবনায়, নেশা করা মানুষের মতো হাসি এবং প্রণাম জানাই নতুন শিক্ষার্থীর মতো। বলার মতো আমার আর কিছু থাকে না যখন মৃতরা এসে দাবি করে জীবন শিরচ্ছেদ করা শরীরগুলির গণসমাধি হয় শরণার্থী শিবিরগুলিতে আগুন লাগে এবং মানুষগুলি পুড়ে মরে খাণ্ডবদাহের মতো, তখন দিনটা এসে আমাকে কাঁদতে শেখায়। নিরন্তর যুদ্ধে যখন আমি আহত হই,প্রতিটি দিন এসে আমাকে তুলে ধরে যুদ্ধভূমি থেকে আমি মৃত থেকে বেঁচে উঠি আর সঙ্কল্প গ্রহণ করি এই সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
আরো পড়ুন: অনুবাদ কবিতা: নীলিমা ঠাকুরীয়া হকের অসমিয়া কবিতা
আমি সেখান থেকেই বলছি ক্ষুধা যেখানে বিলাসিতা, সেখান থেকেই আমি বলছি শত সহস্র অন্ধকার কেটে আলোর সন্ধানে ব্যাকুল সেই দিনগুলি থেকেই শিশুর অর্ধস্ফুট কথা থেকেই আমি বলছি আমি নিরন্তর বলে চলেছি কেন দুর্ভিক্ষ আসে মাটি ভেদ করে বের হয় দুঃখের অঙ্কুর দ্রুত বেড়ে চলে,ছড়িয়ে যায় বুকে জ্বলজ্বল,জ্বলজ্বল-প্রাণবন্ত মহামারীতে আক্রান্ত মানুষগুলি খাদ্যের অভাবে মৃত্যমুখী শিশুগুলি মৃতপ্রায় সময় এবং পতিত আত্মাগুলি এসে আমাকে প্রতিবাদ করে আমি দুহাত যুক্ত করি প্রার্থনায় অসন্তোষ আমার ঈশ্বর তবু আমি বলে থাকি একটা সম্ভাবনার কথা সেখান থেকেই এখানে সমস্ত উৎসবই দুঃখের উৎসব, প্রতিটি দিনই যন্ত্রণার দিন আর প্রতিটি রাত এক একটি দীর্ঘশ্বাস কারণ এখানে নগ্নতাই বস্ত্র আর শূন্যতাই জীবন আমি বলছি অহরহ সেই পুরাতন কথা প্রতিধ্বনির মতো বাজে,ওপার থেকে তোমরা এপার থেকে শুনছ কি? যুদ্ধ যুদ্ধটা চলছে,প্রত্যেকেই লড়াই করছে জিতছে বেঁচে আছে লিঙ্গভেদ না থাকা একটি যুদ্ধ জাত পাত না থাকা একটি যুদ্ধ ক্ষমতার লিপ্সা না থাকা একটি যুদ্ধ যুদ্ধটা বড় কঠিন,যুদ্ধটা বড় করুণ পিঠে শিশু,পেটে শিশু,কোলে শিশু নিয়ে মায়েরা ঝুঁকে পড়ে যুদ্ধটাতে শিশুরা দলবেঁধে যুদ্ধ করে–ডাস্টবিনে ঢেকুরা কুকুরের সঙ্গে বইতে না পারা বোঝা পিঠে নিয়ে ঝুঁকে পড়ে বৃ্দ্ধরা মানুষগুলি লড়তে থাকে টানতে না পারা,ঠেলতে না পারা বোঝার সঙ্গে। যুদ্ধটা চলছিল,যুদ্ধটা চলছে যুদ্ধে দৃশ্যরা বেঁচে আছে,যুদ্ধে অদৃশ্যরা যুদ্ধে পড়ে মরেনি নিজের মতো লড়তে না পারা একটি যুদ্ধ সময় না থাকা একটি যুদ্ধ রাতের অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে আসা আর্তনাদগুলি কোনো যোদ্ধারই বেদনা যুদ্ধে ওরা উৎসর্গ করেছে শরীরটাকে আরও একটি যুদ্ধ চলছে, তারা লড়াই করছে নিজের সঙ্গে ওরা মানুষ মারছে ওরা মরছে,ওরা হারছে জীবনের অর্থ না বোঝা যোদ্ধা তারা, হাতে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র বড় দী্র্ঘকালীন এই যুদ্ধ অন্তহীন,বিরামহীন, যুদ্ধটা আদিম,যুদ্ধটা কঠিন যুদ্ধটা বড় করুণ যুদ্ধটা বেঁচে থাকার যুদ্ধ।

অনুবাদক