Categories
অনুবাদ কবিতা: তোষপ্রভা কলিতা’র অসমিয়া কবিতা । বাসুদেব দাস
আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
(কবি তোষপ্রভা কলিতাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেছি। তাঁর স্নেহধারায় সিক্ত হয়েছি। সদ্য প্রয়াত কবির উদ্দেশ্যে এটা আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি)
১৯৪০ সনে তোষপ্রভা কলিতার জন্ম হয়। শিশু-সাহিত্য, অনুবাদ গ্রন্থ এবং ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে লেখিকার চব্বিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।২০১৩ সনে ‘সাহিত্য আকাডেমি বাল-সাহিত্য’ পুরস্কারে সম্মানিত শ্রীমতী কলিতার’কবিতা সমগ্র’২০১২ সনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত কাব্য সংকলন তিনটি বিশ্বরূপা’,’ অভিজ্ঞান লিপি’ এবং’ নির্বাচিত কবিতা’।’শরশয্যা’ তাঁর একমাত্র উপন্যাস। এই মাসের ১ অক্টোবরে তোষপ্রভা কলিতার মৃত্যু হয়।
কবি এবং জনতা
আকণ্ঠ ঋণে ডুবে
সমৃদ্ধির সোনালি ধানে
ভাঁড়ার পূর্ণ করলে,
প্রিয় কবি! তোমার বৈভব যত
তোমার ত্বকের উজ্জ্বলতা
আমারই দেওয়া;
আমারই শ্ৰম থেকে রক্ত খুঁজে নিলে।
তুমি বললেঃ তুমি হবে জীবনের উদ্দাম বাসনা,
প্রতিজন শোষিতের হাতে হাতে তুলে দেবে
মুক্তির ঠিকানাঃ
আমি ভুলে গেলাম,
তোমাকে হৃদয়ে স্থাপন করে নিলাম
এভাবেই আমি তোমার মৈ হলাম।
হায়কবি! খ্যাতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে
অর্জন করলে আমাকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য।
কখনও দেখেও না দেখা,
কখনও শব্দের ছাইয়ে ঢাকা সত্যের অঙ্গার।
আজ স্বীকারও কর না টগবগ রক্তে তোমার
জনতার আশাহত জীবনের ঋণ;
তুমি আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র
আমার দিন পূর্ববৎ মৃতবৎসা–
মৃতবৎসা দিন।
একজন সাধারণ নারীর মৃত্যুতে
‘ উগ্রবাদ’ ‘ নারীবাদ’ স্লোগানে উত্তাল নগরী,
সহজ মমতা যেখানে অসম্ভব দুষ্প্রাপ্য এখন,
স্নেহ-সুধা-সিন্ধু নিয়ে আপনার ক্ষুদ্র হৃদয়ে,
রুগ্ন দেহ নিরোগী বিরোধী মনের তিনি নম্র নত নারী।
সদালাপ,স্মিত হাস্য ,হিতৈষণা, উদ্বেল আবেগ
স্তব্ধ হল,মিলিয়ে গেল জলধিতে জীবন বুদ্বুদ;
জ্বললে নিভে যায় প্রদীপ, পাতা খসে পড়ে, ঋতু আসে যায়,
অমোঘ নিয়তি-নীতি, সঙ্গীহারা কাঁদে অর্ফিউস।
শোকে শ্লোকের জন্ম, সেই সময় ক্রৌঞ্চের দুঃখে
অশোক-হৃদয় ঋষি কবি হল, সৃষ্টি হল প্রথম কবিতা;
এক প্রিয় মানবীর অনিবার্য বিচ্ছেদ-ব্যথাকে
ছন্দে সাজাতে চেয়ে ব্যর্থ আমার অক্ষম কবিতা।
জীবন মহৎ শিল্প, কবিতা মুগ্ধ হয়ে যায়
মৃত্যুর অমোঘতাকে নিরুপায় প্রণাম জানায়।
আরো পড়ুন: অনুবাদ কবিতা: হরেন গগৈ’র অসমিয়া কবিতা । বাসুদেব দাস
কন্যাশিশু
জেগে উঠ,জননী
একবার আমাকে কোলে তুলে নাও
কপালে একটি চুমু দাও
শুকনো ঠোঁটে দাও এক ফোঁটা অমৃত
দৃষ্টির স্নেহবৃষ্টিতে স্নান করাও আমাকে
জন্মের স্নান, মৃত্যুর জন্যও ম্লান
কেননা,আমি জানি
কিছুক্ষণপর
এক পুরুষ শিশুর জীবনের জন্য
আমাকে তুলে দেওয়া হবে হত্যাকারীর হাতে।
জীবনের তাৎপর্য আমি জানিনা,মা।
জন্মেই পেয়েছি একটি তপ্ত মরু;
স্নেহচ্ছায়া আছে কেবল
অনাগত পুরুষ শিশুটির জন্য,
তার জন্য অপেক্ষমান, এক-পৃথিবী আয়োজন,
আছে মঙ্গল-উলুধ্বনি, শঙ্খ-ঘন্টা-রব,
সঞ্চিত আছে অনেক অনাত্মীয়ারও প্রাণোচ্ছ্বাস।
স্নিগ্ধ কান্তি দর্শনে তার উথলে উঠবে
একাধিক জননীর স্তন্যধারা;
তার শৈশবকে নিরাপত্তা দেবে
অজস্র সাধারণীর অযাচিত প্রীতি ধারা,
তার কৈশোরের বিকাশের জন্য
সঞ্চিত রাখা আছে
শ্রেষ্ঠতমা প্রেমিকার হৃদয়- নির্যাস।
আমি জানি সে যুগন্ধর পুরুষ হবে
পাবে আলোকসামান্যা মহীয়সীর সখিত্ব
পাবে সীমন্তিনী সুন্দরীদের বৈধ সান্নিধ্য
তার যাদুস্পর্শে রূপান্তরিতা
সামান্য মাল্য চন্দনদাত্রীও
একান্ত আনুগত্যে
প্রতীক্ষা করবে কেবল তার জন্যই
সে সাত রাজ্য ভেঙে এক রাজ্য করবে।
তার কঠিন অঙ্গুলিনির্দেশে ঘুরবে
স্ব-ভূমির ভাগ্যচক্র।
তোমাকে সে দেবে মহাপুরুষের মাতৃ হওয়ার গৌরব
বিশ্বরূপ নিয়ে সে আকাশের দিকে হাত মেলবে,মা।
তুমি দেখতে পারার চেয়ে অনেক বেশি ওপরে।
আমিতো তোমাকে কিছুই দিতে পারার কথা নয়
সেবা ছাড়া
প্রাণ ভরা ভালোবাসা ছাড়া
তোমাকে এবং আমাকে যে একই উপায়হীনতার উপাদানে
গড়া হয়েছে–
এই কথা আমি বুঝতে পারি,মা
তাহলে তুলে দাও আমাকে জল্লাদের হাতে
তার জীবনভরা অজস্র মহীয়সীর ভিড়ে
হারিয়ে যাক আমার যোগমায়া নাম।
তোমার জন্য
পৃথিবী আমার বিচার করুক
বুদ্ধির ক্ষুরধারায়;
সমালোচনার তুলাদণ্ডে ওজন করুক
আমার অনুভূতিকে,
যুক্তির ধারাল তরোয়ালে খন্ড খন্ড করুক
আমার চিন্তা ধারাকে
আমাকে বিরক্ত করুক
বিব্রত করুক
বিপর্যস্ত করুক
আমার সত্ত্বাকে;
নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে
নিক্ষেপ করুক আমাকে,
আমি মানুষটাকে।
আমার কোন খেদ নেই
যদি তুমি
কেবল তুমি
আমাকে খুঁজে দেখ
তোমার ক্ষমা সুন্দর হৃদয়ে!
অভিযাত্রা
দু’হাতের অঞ্জলিতে
ধরা দিও না
আমার সাগর!
প্রাপ্তির ক্ষুদ্র গন্ডিতে
আমি দেখতে চাই না
তোমার নিস্তরঙ্গ রূপ।
আমি জানি
প্রাপ্তিই নয়
প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এবং স্থিতি তোমার
সহনীয় করে জীবনকে,
বাসযোগ্য করে বসুন্ধরা।
তৃষ্ণায় জ্বলুক আমার কন্ঠ,
আমার হৃদয় আমি বয়ে যেতে দেব না
দুচোখে;
লুকিয়ে রাখব বুক ভরা দুঃখ
আমি বেঁধে নিলাম মন।
আমার যে বয়ে যাবার পণ
আমাকে বয়ে যেতে দাও
কেবল বয়ে যেতে দাও
নিরবধি
সেই কল্লোলিত মহা ঐশ্বর্যের
অন্বেষণে।
অনুবাদক