| 28 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ গল্প: স্বর্গযাত্ৰা । অজন্তা । অনুবাদক বাসুদেব দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Assamese story anubad swargajatra by ajanta১৯৬৮ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার কয়লামারী চা বাগিচায় অজন্তার জন্ম হয়।স্কুল এবং কলেজ জীবনের শিক্ষা উত্তর লক্ষ্মীমপুর এবং যোরহাটে।বর্তমানে অরুণাচল প্রদেশের রাজ্যিক সচিবালয়ে ব্যক্তিগত সচিব রূপে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ্(শিশুদের জন্য)অরূণাচলর সাধু, সুগন্ধী পরীর কাহিনি,বরফের ঘর। উপন্যাস অরূণাভ স্যার, ক্রেইট,যাযাবরী যাত্রার প্রেম।গল্প সঙ্কলন অজন্তার নির্বাচিত গল্প,স্পর্শ,প্রান্তিকের গল্প।


শৰ্মিষ্ঠার ভাবে আত্মমগ্ন হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ভাবছি, শর্মিষ্ঠা সন্তান প্ৰসব করার জন্য সুন্দর একটি ঘর তৈরি করে দেবার কথা। ভাবছি,আজ তার জন্য কী নিয়ে যেতে পারি। ভাবতে ভাবতে অটব্য অরণ্যের মধ‍্যে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ আমি মানুষের আভাস পেলাম। শুকনো পাতার ওপরে হাঁটা মানুষের পায়ের শব্দ। একটা দুটো নয়…বেশকিছু মানুষ। আমি নিমেষের মধ্যে আত্মগোপন করলাম। একটা ঝোপ জড়িয়ে ধরলাম। এভাবে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলাম যাতে আমি ঝোপটিতে মিশে যেতে পারি। লুকিয়ে পড়ার মতো এত বড় ঝোপও কাছে ছিলনা। নিশ্বাস বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করলাম। কোনোমতেই যাতে মানুষগুলি আমার উপস্থিতির আভাস নাপায়। মানুষগুলি বোধহয় দুরন্ত শিকারী। নাহলে এত গভীর অরণ্যে প্রবেশ করার সাহসটা বড় কম কথা নয়। অবশ্য ওরা পুলিশের ভয়ে পালানো দাগী অপরাধীও হতে পারে। আমি অনুমান করলাম, ওদের কথাবার্তা এগিয়ে আসছে। জোরে জোরে হাল্লা করে কথা বলছে না বোধহয়। চাপা কণ্ঠে কথা বলছে। হয়তো শিকার পালিয়ে যাবে ভেবে পুলিশ পেছন পেছন অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে। যদি শিকারী হয় তাহলে বনরক্ষী অফিসারের ভয়ও হতে পারে। অশেষ চেষ্টা করছি যাতে সাড়া শব্দ নাকরে এবং আমাকে নাদেখে মানুষের ভিড়টা যাতে পার হয়ে যায়। হে নীলকণ্ঠ..ভোলানাথ..রক্ষা কর…রক্ষ কর । আমি ধীরে ধীরে শরীরটা ছোট করে এনেছি …কিন্তু হাজার যত্ন করেও শুকনো পাতার ওপরে হওয়া খড়খড় শব্দ আমি নিয়ন্ত্ৰণ করতে পারি নি। পায়ের খড়খড় শব্দ কাছে চলে আসার আভাস পাচ্ছি। পায়ের শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। কে জানে ওরাও হয়তো আমার আভাস পেয়েছে। আমি জায়গাতেই নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। শরীরটাকে নাড়া চাড়া করছি না। ওরা শব্দ অনুসরণ করবে। কিন্তু…কিন্তু..কিন্তু হঠাৎ ওদের মধ‍্যে হইচই শুরু হয়েছে নাকি? ওরা যে উৎফুল্লিত হয়েছে সেকথা আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। বধির হলেও বাতাস বহন করে আনা কৃত্ৰিম এই শব্দের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমি ঝোপের আড়াল নিয়ে ওদের দিকে তাকালাম। ওরা কয়েকজনও তাকাল। অংগ ভংগী দেখ মনে হচ্ছে ওরা যেন আনন্দে চিৎকার করছে‌। কী হ’ল হঠাৎ? আমাকে নিশ্চয় দেখে নি। কারণ আমার এই চেহারা দেখে ওরা উৎফুল্লিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না। অন্তত আমার জীবন কালে এরকম নাভূত নাশ্ৰুত ঘটনা আমি দেখিনি। শর্মিষ্ঠা আমাকে বহুবার এরকম কথা বলেছে যদিও আমি কিন্তু কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি। শর্মিষ্ঠা, আমার পত্নী। রূপে গুণে বিভূষিতা আমার প্ৰাণেরো প্ৰাণ শর্মিষ্ঠার কথা মনে পড়ে আমার বুকটা ধকধক করে কাঁপতে লাগল। বেচারি আমার পথ চেয়ে থাকবে। সন্তান সম্ভবা সে। স্ফীত উদর নিয়ে ও বেশিদূরে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে পারে না। আমি খাদ্য সম্ভার নিয়ে নাগেলে ওকে উপোস দিতে হবে। তথাপি আজ সে আমাকে বারবার বেরিয়ে আসতে মানা করেছিল। তার নাকি ডান চোখ নাচছিল। শরীরটাও ভালো লাগছিল না। পেটের সন্তান বড় ঘন ঘন পাশ ফিরছিল। কিছু একটা বিপদের আগাম সঙ্কেত তাকে বার বার আতংকিত করে তুলেছে। তার কথাগুলি এবং কাতর করুণ চোখজোড়া আমাদের বিচলিত করেছিল যদিও আমরা তার কথাগুলি হাসিতে উড়িয়ে দিয়ে তাকে সাহস দেবার যত্ন করলাম। তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘ আমি থাকতে ভয় কিসের? আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব শর্মিষ্ঠা, আমার সোনা। এভাবে বসে থাকলে কীভাবে হবে বল? সময়মতো ক্ষুধা পেলে আমরা কী খাব বল? খাদ্যতো আর মুখের সামনে আকাশ থেকে খসে পড়ে না। তোমার প্ৰসবের সময়ও চলে   আসছে। আলাদা ভাবে একটা ঘরও তৈরি করে রাখতে হবে। আমাকে যেতে দাও সোনা। শর্মিষ্ঠা রাজি হল। দঢ়াই দঢ়াই বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসবে কিন্ত।আমি পথ চেয়ে থাকব।’ সে আরও বলল, অনেকদিন সে বাইরে বেরোয়নি যদিও কিছুদিন থেকে সে কিছু সন্দেহজনক মানুষকে দেখতে পাচ্ছে। আর শুয়ে থাকা অবস্থাতেও মানুষের চলাফেরা, কথা বার্তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি তাকে অভয় দিলাম,’গর্ভবস্থায় এইসব স্বাভাবিক। গর্ভস্থ সন্তানের অমংগল আশংকা করে মাতৃ বার বার কেঁপে উঠে। পুরোটাই মনের ভ্ৰম।’ সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমিও। আমার বিশাল শরীরটা এবং অন্তর ভরে থাকা ভালোবাসা তাকে যেন নিমষের মধ্যে শুষে ফেলবে। আমি মজা করে বললাম’ তোমার স্বামীর এই বিশাল শরীরটা দেখলে কারও সাধ্য হবে প্রত্যাহ্বান জানানোর?’

সে হাসল। গৌরবের হাসি। ইস…এত মিষ্টি আমার শর্মিষ্ঠার হাসি, তার স্পর্শ, তার ভালোবাসা…মান অভিমান। আমি যেন তার প্ৰেম পাওয়া পর্যন্ত এই পৃথিবীতে অমর হয়ে থেকে যাব। কিন্তু আমি যদি আজ শর্মিষ্ঠার কাছে ফিরে যেতে নাপারি? বুকটা কেঁপে উঠল। কেন তার কথা আমি আজ শুনলাম না? তাহলে সে বলা সন্দেহজনক মানুষের চলাফেরার কথাগুলি তার মনের ভ্ৰম ছিল না? মানুষগুলির হাসি আনন্দ কমে এসেছে। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। তারমানে আমাকে দেখতে পায়নি। রক্ষা করলে নীলকণ্ঠ। শতকোটি প্ৰণাম মহাদেব। বিনাপ্ৰয়োজনে ওদের সঙ্গে প্রত‍্যাহ্বানে জড়িয়ে পড়ায় আমার কোনোদিনই ইচ্ছানাশান্তিকামী প্ৰাণী আমরা। নীরব নিস্তব্ধ। এখন আমার প্ৰথম এবংপ্ৰধান দায়িত্ব শর্মিষ্ঠা। ওরা বেশ কিছুটা দূরত্ব যাওয়া পর্যন্ত আমি জায়গাতেই চুপ করে পড়ে রইলাম। তারপরে ধীরে ধীরে ঝোপ থেকে বেরোতে লাগলাম।

এখন আর এগিয়ে না যাওয়াই ভালো। শর্মিষ্ঠার কাছে ফিরে যাই। সে বোধহয় আমার জন্য পথ চেয়ে রয়েছে।কিন্তু আমি মাথাটা ঘোরানোর সুযোগ পেলাম না, আমার শরীরের পেছনের অংশে একটা বিরাট লাঠির ভয়ানক আঘাত।

আমি যন্ত্ৰণায় চিৎকার করে উঠলাম‌।ইস…ইস…শৰ্মিষ্ঠা…..। বাঁচাও…বাঁচাও..। কিন্তু কে শুনবে আমার মরণ কাতর চিৎকার; আমার তো কোনো কণ্ঠস্বর নেই। আমি কেবল মনে মনে চিৎকার করতে পারি। আমার শর্মিষ্ঠা এবং বংশ পরিবার ছাড়া আর কে শুনতে পাবে আমার চিৎকার…কে অনুভব করবে আমার কোমরের এই মারাত্মক আঘাত। কিন্তু সেই সময়ে আমার মনে সেই সমস্ত কথা মনে পড়ছিল না। আমি কেবল প্রাণপণে চিৎকার করছিলাম, মরণ কাতর চিৎকার। যন্ত্ৰণায় ফোপাচ্ছিলাম।কিছুক্ষণের জন্য আমি আমার চোখের সামনে গোটা পৃথিবীটাই অন্ধকার দেখলাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে আমি দেখি আমার সামনে একজন হৃষ্টপুষ্ট পুরুষ। হাতে বড় লাঠি। বুঝতে পারলাম, ওদের কাছ থেকে শরীরটা লুকানোর জন্য আমি বৃথা চেষ্টা করেছিলাম। আমার অতিকায় শরীরটার পিছনের দিকটা স্পষ্টভাবে ওদের চোখে পড়েছিল। আমাকে অতিক্রম করে গিয়ে দলে দলে বল্লম,সূচলোঁ অস্ৰ নিয়ে ওরা পুনরায় এগিয়ে এল।আর আমি মূর্খ ভাবলাম ওরা আমাকে দেখতেই পায়নি‌। ভাবলাম, আমার বিরাট আকার দেখে ওরা ভয়ে পালিয়ে যাবে। অনেকবার এরকম হয়েছে। তাই এভাবে ভাবার মধ্যে আমার দোষ কোথায়? আমার মৃত্যু আজ নিশ্চিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বীভৎস, করুণ মৃত্যু এরচেয়ে আর কিছুই হতে পারে না। ওরা অস্ত্ৰশস্ত্ৰে সুসজ্জিত। লাঠি ,সূঁচলোঅস্ৰ,বল্লম…আর দুটি বিরাট বিরাট তরোয়াল, দা ছিল ওদের হাতে। আমি নিরস্ত্ৰ। ভীমাকার শরীরটা আর দাঁতগুলির বাইরে যুদ্ধ করার মতো আমার আর কিছুই নেই। তবু বীরের মতো শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করব। না হলে যে শর্মিষ্ঠার কাছে আমি ওপারেও মুখ দেখাতে পারব না। সবংশে বদনামের ভাগী হয়ে আমি স্বর্গবাসীও হতে পারব না। নিমেষের মধ্যে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ফণা তুলে দাঁড়ালাম। পৃথিবীর সমস্ত ক্রোধ সংহত হয়ে আমার মাথায় ভিড় করল। আমার ক্রোধের স্বরূপ দেখে ওরা কিছুদূর পিছিয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূৰ্তে আবার তেড়ে এল। ওদের দলে বেশ লোকজন ছিল। একটা বৃত্ত বানিয়ে ওরা আমাকে ঘিরে ধরল। আমি কোনদিক থেকে আক্ৰমণ করব? একদিকে দৌড়ে গেলে …সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিক থেকে আমার গায়ে একটা বিশাল আঘাত.. সেদিকে দৌড়ে পালাতে গেলে আমার গায়ে অন্য দিক থেকে একটা আঘাত ইস…আমার শরীরে বৃষ্টির মতো আঘাত নেমে আসছে। ওরা বল্লম দিয়ে আঘাত করছে… সূঁচলো অস্র দিয়ে খোচাচ্ছে…বন্য উল্লাসে ওরা  … ওরা হাসছে …চিৎকার করছে…লাফাচ্ছে। একটা লাঠির কোপ মাথায় পড়ল। আমি জায়গাতেই মূর্ছিত হওয়ার উপক্ৰম হ‘ল। তথাপি অতি উৎসাহে বারবার উঠতে চাইছিলাম।

এদিক ওদিক চোখজোড়া জোর করে খুলে তাকাচ্ছিলাম। কেজানে শেষবারের মতো আমার শর্মিষ্ঠাকে যদি একবার দেখতে পাই। না… শর্মিষ্ঠা নেই। আমার চোখ দুটি বুজে এল।মাথায় দ্বিতীয় কোবটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। সংজ্ঞাহীন শরীর ব‍্যথা অনুভৱ করে না বলেই আমার ধারণা ছিল। কিন্তু আমি অনুভৱ করেছিলাম। আমার শরীরের ওপরে উপর্যুপরি বিশাল লাঠির আঘাতের যন্ত্ৰণা আমি অনুভব করছিলাম। সেই আঘাতগুলি পড়ছিল আমার হৃদয়ে। অনুভব করছিলাম আমার হৃদয়ে। কেবল সংজ্ঞাহীনতার জন্য আমার শরীরটা অসার হয়ে পড়েছিল। ওরা আমাকে খুব প্রহার করেছিল। সম্পূর্ণ শরীরটা আঘাত করে খুচিয়েছিল। ওরা আমাকে মেরে ফেলেছিল। লাঠির আঘাত ,দা ,বল্লমেরখোঁচা সইতে না পেরে আমার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার পরেও ওরা বন্য উল্লাসে আমার নিথর শরীরটাকে যখন লাঠি দিয়ে আঘাত করছিল তখন আমি আত্মা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম এবং আমার প্রাণহীন শরীরে ওদের করা আঘাতগুলি আমার আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমার আত্মা অবাক হয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখছিল। ওরা বারবার আমার মৃত শরীরটা লাঠি দিয়ে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করছিল। কে জানে কোথাও হয়তো একটু প্ৰাণ থেকে গেছে। যখন তারা আমার মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হল তখন তারা আমার মৃতদেহটা কাঁধে তুলে নিল। আমার বিশাল দেহটা কাঁধে তুলে নেওয়া একজনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনজন মানুষ আমার শবটা কাঁধে নিল। বাকিরা চিৎকার করে উঠল। ওরা আমার শবটা নিয়ে যাবার জন্য উদ্যত হল। আমার আত্মা আর্তনাদ করে উঠল…নিসনা… নিসনা আমার শরীরটা…শর্মিষ্ঠার আমানত..তার অধিকার…নরাধমরা…দেখতে থাক শর্মিষ্ঠার কোপ থেকে তোরা কেউ রেহাই পাবি না ।সে তোদের ঠিক খুঁজে বের করে প্রতিশোধ নেবে…।

তখনই একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। সেখানে একদল ভব্য গব্য মানুষ উপস্থিত হল। পোশাক আশাক দেখে আমিতাঁদের চিনতে পারলাম। তাদের কয়েকজন বনরক্ষী অফিসার আর বাকি কয়েকজন পুলিশ অফিসার। তারা বন্দুকধারী ছিল। অর্থাৎ তাঁরা কর্ত্তব্যরত অফিসার । তাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার হত্যাকারীদের গলা শুকিয়ে গেল। কিছু সাধারণ জনতাও সেই অটব্য অরণ্যের মধ্যে জমায়েত হল। একদল ক‍্যামেরাধারীও এসে পড়ল। অফিসাররা আমার মৃতদেহ কাঁধে করে নিয়ে যেতে দেখে আমার হত্যাকারী কয়েকজনকে প্ৰশ্ন করতে লাগল-

: এই, তোরা কেন মারলি এটাকে?

: স‍্যার, আমরা বড় গরীব। ক্ষুধার্ত মানুষ। আমরা পাখি শিকার করতে এসেছিলাম স‍্যার। কিন্তু হঠাৎ এটাকে পেয়ে যাই। একে পাওয়া আমাদের ভাগ্য স‍্যার। না হলে কি আর এটা আমাদের হাতে  ধরা দেয়? তাই আমরা এটাকে আজ ভক্ষণ করব স‍্যার। স‍্যার,এর মাংস বড় সুস্বাদু। টেষ্ট করে দেখতে চান যদি একভাগ আপনারাও নিন। কিন্তু আমাদের ধরে নেবেন না স‍্যার। ছেড়ে দিন স‍্যার। 

: কী? তোরা এর মাংস ভক্ষণ করবি? এই তোরা মানুষ না রাক্ষস? জীবজন্তুর খোঁজে এসেছিলি…এই অরণ্যের জীবজন্তু তোদের পৈতৃক সম্পত্তি নাকি যখনই ইচ্ছা হবে ধরে মেরে খাবি? কে অধিকার দিয়েছে তোদের জীবজন্তু শিকার করে খাবার? জানিস, তোরা কতবড় অপরাধ করেছিস? এই অপরাধের জন্য তোদের উনিশ শো বাহাত্তর সনের ওয়াইল্ড লাইফ প্ৰটেকশ্যন আইনের অধীনে পাঁচ বছর কাল কারাদণ্ড এবং পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। 

অন্য একজন অফিসার তাকে ফিসফিস করে বলল –

সেই আইন ওদের সুরক্ষা দেয়নি স‍্যার। এদের। বড়দের।

আমার আত্মা শুনল আমার দেহের দাম  পঁচিশ হাজার টাকা। আমি জানি না পঁচিশ হাজার টাকা আমার দেহটার উপযুক্ত দাম কি না? কিন্তু এই কথা শুনে ওরা হঠাৎ আমার শব দেহটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল। ইস…আত্মায় আঘাত পেলাম। এত অপমান আমার দেহটার। আমাকে ফেলে দিয়ে ওরা অফিসারদের পায়ে লম্বা হয়ে পড়ল। জমায়েত সাধারণ লোকেরা এবার আমার শবদেহটা ঘিরে ধরল। উল্টে পাল্টে দেখল। কিছুলোক আবার শবদেহটার কাছে আসতে ভয় পেল। দূর থেকেই বীরের মতো ফোটো তুলল। একজন অফিসারের নির্দেশে কয়েকজন মানুষ আমার দেহটা দীর্ঘ একটা ফিতা দিয়ে জরিপ করল। সে চিৎকার করে করে বলল, বারো ফুট…বারো ফুট। প্রত‍্যেকেই অবাক হয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিড়বিড় করতে থাকল…বারো ফুট…বারো ফুট। আমার মৃতদেহের কাছে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভংগিমায় আনন্দের সঙ্গে ফোটো তোলায় মানুহগুলি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।  

এদিকে অফিসার কয়েকজন আমার হত্যাকারীদের অনুনয় বিনয়ে ভুলে না গিয়ে অধীনস্থ কৰ্মচারীদের তাদের গ্ৰেপ্তার করার আদেশ দিলেন। দুয়েকজন হেণ্ডকাফ হাতে নিয়ে তৈরি ছিল। পাষণ্ড গুলিকে হাত কড়া পরাতে যেতেই কোন সুযোগে একজন দৌড়ে পালিয়ে গেল বুঝতেই পারা গেল না। দুজন তার পেছন পেছন দৌড়ে গেল। এতগুলি মানুষের কয়েকজন তার পেছনে ধাওয়া করলে তাকে ধরা কখনও অসম্ভব হত না। কিন্তু বাকি মানুষগুলি খুব মজা দেখল। আমি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম বলে দেখতে পেলাম। সে হঠাৎ কোনো একটি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস ; আমি তাকে কিছুই করতে পারলাম না।

কারণ আমি ইতিমধ্যে একটা আত্মা হয়ে পড়েছি আর এখন আমি পৃথিবীর সমস্ত পার্থিব বস্তুর স্পর্শের উর্ধে। সে রেহাই পেয়ে গেছে।

আমার শবদেহটা বনবিভাগ সমঝে নিল। মরণোত্তর পরীক্ষা করবে। পুনরায় কাঁটা ছেঁড়া করবে আমার দেহটা। কিন্তু উপায় নাই। এটা সরকারি ভাবে বাধ্যতামূলক কথা। আমার হত্যাকারীদের শাস্তি দেবার জন‍্য যদি তা করতে হয় তবে তাই হোক। আমার সন্মুখে আমার প্রিয় দেহটি একটা খাঁচায় ভরে নিয়ে গেল। আমার আত্মা কেবল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। শরীরের বিচ্ছেদে আমি চিৎকার করে কাঁদলাম… কত যে বিলাপ করলাম ; কিন্তু কেউ শুনল না একটা নিস্পাপ আত্মার ক্রন্দন..বিলাপ।  

আমার খোঁজে শমিষ্ঠা অরণ্য তন্ন তন্ন করে বেড়াচ্ছে ।আমি শুনছি তার কন্ঠস্বর। অর্থাৎ আমার আত্মা শুনতে পাচ্ছে। শরীরটা থাকলে আমি অনুভব করতে পারতাম তার কন্ঠস্বরের কম্পনাঙ্ক। শর্মিষ্ঠা চিৎকার করছে…শিবা…শিবা…..শিবা…তুমি কোথায় আছ…শি….বা…

বাতাসে ভেসে বেড়ানো আমার আত্মা চিৎকার করছে….আমি আর নেই শর্মিষ্ঠা…আমি আত্মা হয়ে গেছি…এক ঝাঁক বাতাস হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি শর্মিষ্ঠা….ওরা আমাকে বিনাদোষে মেরে ফেলেছে শর্মিষ্ঠা। নীলকণ্ঠের নামে শপথ খেয়ে বলছি,আমি ওদের প্রতি কোনো অন্যায় করিনি। আমি ওদের দেখেই লুকিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ওরা আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল শর্মি…

আমার কণ্ঠস্বর শর্মিষ্ঠা শুনতে পাচ্ছিল না। সে কেবল জিহ্বার সাহায‍্যে আমার গায়ের গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছিল।তার প্ৰাণেরও প্ৰাণের শিবার শরীরের গন্ধ। আরও একদিন….একদিন‍ পাগল হয়ে আমাকে খুঁজে বেড়ানো শর্মিষ্ঠা আমাকে খুঁজে পেল। যে জায়গায় ওরা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল সেই জায়গায় সে আমার শরীরে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিহ্ন দেখতে পেল।

সে ঠিক বুঝতে পারল, এটা তার প্রিয়তমের দেহের রক্ত। সে তখনই পাগল হয়ে মাটিতে গড়িয়ে কাঁদল, বিলাপ করে কাঁদলে…ফিরে এসো শিবা..আমার

দেহলাও… ফিরে এসো…। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি সেই মানুষগুলি তোমাকে মেরে ফেলল”। কিন্তু কীভাবে আমি পুনরায় আমার শরীর ধারণ করব। এ যে অসম্ভব। ইচ্ছাধারী নাগ কেবল রূপকথাতেই সম্ভব। কাঁদতে কাঁদতে শর্মিষ্ঠা আমার রক্ত জড়িয়ে ধরে সেখানেই একটা লাড্ডু হয়ে রক্ত জড়িয়ে ধরে সেই জায়গাতেই লাড্ডু খেয়ে শুয়ে পড়ল। সন্তান সম্ভবা শর্মিষ্ঠাকে মই বাতাস দিতে থাকলাম। আমি যে এখন একঝাঁক শীতল বাতাস।

 

শমিষ্ঠার সন্তান প্ৰসবের দিন এগিয়ে এল। ক্ষুধায়, উপবাসে, দুঃখে, ক্লান্তিতে সে সন্তান প্রসবের জন্য জায়গা খুঁজতে লাগল। আমাদের জাতির আমরাই একমাত্ৰ প্ৰজাতি যে সন্তান প্ৰসব করার জন্য ঘর তৈরি করি।শর্মিষ্ঠাও ঘর তৈরি করার জন্য একটা সুরক্ষিত জায়গা খুঁজে শুকনো গাছ পাতা নিজের শরীর দিয়ে গুটিয়ে নিয়ে ঘর তৈরি করতে লাগল। তার কষ্ট দেখে আমার আত্মা হাহাকার করে উঠল। একসময়ে শুকনো গাছ পাতা দিয়ে সে ত্ৰিশ সেন্টিমিটার উঁচু সূঁচলো একটা ঘর তৈরি করল। একদিন সে প্ৰসব ঘরটিত প্রবেশ করল। একদিন আমি জানতে পারলাম সে সন্তান প্ৰসব করেছে। এখন সে সন্তান না জাগা পর্যন্ত আর ঘর থেকে বের হবে না। না খেয়ে দুমাস পড়ে থাকবে সেখানে। আমাদের প্ৰজাতির এটাই নিয়ম। মা ডিমগুলি এভাবে পাক মেরে জড়িয়ে থাকে বলে নেউল গুই ইত্যাদি শত্রুরা কাছে আসতে পারে না। শর্মিষ্ঠা শরীরের মাংসপেশী সংকুচিত করে নিজের শরীরের তাপমান বৃদ্ধি করতে লাগল। তার অজান্তে আমি তার আশেপাশে থাকলাম। মাঝে মধ্যে তাকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুনি। আমার খুব দুঃখ হয় ।আমি জানি ডিমে তা দেওয়ার সময় সে বড় শান্ত শীতল হয়ে থাকে। আক্রমনাত্মক হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমি মনে মনে নীলকণ্ঠের কাছে আকূতি করি এই সময়ে যাতে আমার হত্যাকারীর মতো কারও তার ওপরে চোখ না পড়ে। নীলকণ্ঠ আমার প্রার্থনা শুনতে পেল। একসময়ে তার কুড়িটা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হল। তার মধ্যে অবশ্য পনেরোটা বাঁচল। মাতৃ গর্ভ থেকে বের হয়েই তারা যে যার পথে চলে গেল। এটাই আমাদের নিয়ম। বিধাতা বেঁধে দেওয়া নিয়ম। সন্তান জন্ম দিয়ে দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে দুর্বল শর্মিষ্ঠা খাদ্যের সন্ধানে বের হল । আমার বুক কেঁপে উঠল। আমি জানি, এখন সে আমার হত্যাকারীর গন্ধ খুঁজে খুঁজে অরণ্য তোলপাড় করে তুলবে। প্ৰতিশোধের অআগুন ইতিমধ্যে তাকে দহন করে ফেলেছে। এমনিতে আমরা কিন্তু মোটেই আক্ৰমণাত্মক প্ৰাণী নই। আমরা হলাম স্বভাবজাত লজ্জাশীল প্ৰাণী। কিন্তু তাদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে কিনা।

মাঝে মধ্যে অরণ্যে টহল দিয়ে ঘুরে বেড়ানো বনরক্ষীদের আশে পাশে আমি ঘুরে বেড়াই। শুনলাম,আমার শরীরটা নাকি পুতে ফেলেছে। ক্ষত বিক্ষত না হলে কোনো গবেষণাগারে রাখার ব্যবস্থা করা হত। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্ৰী এবং কিছু হৃদয়বান মানুষ আমার হত্যাকাণ্ডের তীব্ৰ নিন্দা করেছে, শোক প্ৰকাশ করেছে । হত্যাকারীদের সশ্ৰম কারাদণ্ডের দাবী করেছে। শর্মিষ্ঠা কথাগুলি শুনতে পেয়েছে কিনা জানিনা; আমার কিন্তু শুনে খুব ভালো লেগেছে। আত্মা হয়ে যাবার পর থেকে আমি খুব স্মৃতি রোমন্থন করছি। আমার মনে পড়ে শমিষ্ঠাকে প্ৰথম দেখা হওয়ার দিনটির কথা। সেই উপন্যাসোপম প্ৰেম কাহিনি বলার জন্য আমাকে দীর্ঘ ভূমিকা ফাঁদতে হবে। আমাকে দীর্ঘ ভূমিকার ‍ আয়োজন করতে হবে।–

-বলতে শুনেছি আমাদের পূৰ্বপুরুষ নীলগিরি পর্বতের। ভারতবর্ষের পালনিচ এবং পশ্চিমঘাটের গোয়া পর্যন্ত হিমালয়ের নিম্ন অঞ্চলের পাহারগুলির দুহাজার মিটার পর্যন্ত আবার পাকিস্তানের লাহোর থেকে আরম্ভ করে উত্তর ভারত হয়ে অসম পর্যন্ত এক সময়ে আমাদের জনসংখ্যা যথেষ্ট ছিল। উড়িষ্যা বিহার পশ্চিমবঙ্গ এবং আন্দামানের অটব্য অরণ্যেও আমাদের বংশ পরিবার যথেষ্ট ছিল। এখনও যে নেই তা নয়, কিন্তু এখন আমাদের প্ৰজাতি বিরল প্ৰজাতি হিসাবে পরিগনিত হয়েছে। কারণ, অকারণে মানুষ আমাদের দেখলেই হত্যা করে। বন ধংস করার ফলে আমাদের থাকার জায়গাও দিনের পরে দিন কমে আসছে। আমরা আকারে বিশাল। জন্মের সময় আমরা ন্যূনতম পঞ্চাশ সেন্টিমিটারের কম হই না। মিহি চকচকে আমাদের গায়ের চামড়া।

 সামনের দিকটায় পাথালি করে পটি থাকে।মাথার বড়  চালগুলির  কাছে থাকে কালো রং। গায়ের  রং হলধে থেকে  গাঢ় জলপাই রঙের। আমাদের  বেণীটা, মানে লেজটা  অঙ্গার   কালো। পৃথিবীর বিষাক্ত সাপ গুলির মধ্যে   আমরাই সবচেয়ে বড়  হওয়ার গর্বে গৌরবান্বিত। কিন্তু মানুষ  যেভাবে  আমাদের আক্ৰমণাত্মক স্বভাবের কথা বলে আমরা  মোটেই সেরকম  নয়। আমরা  আসলে বড়  লাজুক  স্বভাবের  শান্ত প্ৰানী। আমরা  কখনও মানুষের  সংস্পর্শে  থাকতে চাইনা। মানুষ দেখলেই আমরা  পালাই।  মানুষ আমাদের ভয় করাটা সত্যি  কথা। কিন্তু তাঁদের  অধিক সংখ্যক মানুষই সবসময় আমাদের  মেরে ফেলার  আসক্তি একটা পোষণ করে রাখে। সেইজন্য মানব জাতিকেই আমরা  আক্ৰমণাত্মক বলে ভাবি। সত্যি কথা বলতে  হলে মানব জাতিকে পরম শত্ৰূ বলে ভাবতে তাঁরা আমাদের বাধ্য করেছে।  তথাপি, আমরা  কখনও কাউকে  বিনা প্ররোচনায় আক্ৰমণ করি না। যতটা সম্ভব আঘাত খেয়ে হলেও পালাতে  চাই। যদি আক্ৰমণ করতে চাই তাহলে আমাদের কে প্রতিরোধ  করবে? আত্ম রক্ষার জন্য  বিধাতা আমাদের অতিকায় বিষস্থলীতে প্ৰায় ছয় সেন্টিমিটার  বিষ রাখার সুবিধা করে  পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। আমাদের এক ফোঁটা বিষ একটা হাতিকে মারার জন্য  যথেষ্ট। এমনকি বাতাসেও আমরা  বিষ ছিটিয়ে দিতে পারি। আমাদের প্ৰতি সর্পবিষ কেবল থাইলেণ্ডে  পাওয়া  যায়।  অবশ্য আমাদের বিষ অসার করে ফেলতে  পারা এন্টি ভেনম বা প্ৰতিসর্পবিষ সিরাম  মুম্বাইর হফকিন প্ৰতিষ্ঠানে  ঘোড়ার অসংক্ৰাম্যকরণ বিধির দ্বারা তৈয়ার করা হয়। আমাদের রাজা গোখোরো  সাপের বিষ অসার করায় সেই ঔষধে কাজ দিতে দেখা যায়। অবশ্য কারুকে  দংশন করা কার্য আমরা  জীবন রক্ষার শেষ পর্যায়েই  করি। হঠাৎ কেউ আমাদের মাড়িয়ে গেলে আমরা তাদের দংশন করাটা অবশ্য স্বভাবের  পর্যায়েই পড়ে। মানব সমাজ  মাঝে  মধ্যে যে অরণ্য ধংসের যজ্ঞের আয়োজন করে তার পরিণাম স্বরূপ আমরা আমাদের জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াতে হয়। হয়তো সেভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষের কোন একজন সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে এসে অসমে পৌঁছেছিল। উজান অসমের এক দুর্ঘোর অরণ্যে বাসা বেঁধেছিল। হয়তো নির্ঝঞ্ঝাট অরণ্য একটা পেয়ে আমার পিতামহ,প্রপিতামহ হাতে স্বর্গ পেয়েছিল। বংশ বিস্তার  করতে শুরু করে। সুখে সন্তোষে কয়েক পুরুষ পার হয়ে গেল অসমের সবুজ  অরণ্যে।  কিন্তু একদিন হঠাৎ আমাদের অরণ্য  একদল মানুষ কাটাকুটি করে ধ্বংস করতে লাগল। শুনলাম, তারা সেখানে চা পাতার চাষ করবে। বিশাল জায়গা জুড়ে চাষ। শান্ত শীতল স্বভাবের আমরা প্ৰত্যাক্ৰমণ না করে একবুক দুঃখ নিয়ে  আমাদের আশ্ৰয়স্থল ছেড়ে  অন্য আশ্ৰয়ের খোঁজে এগিয়ে চললাম। জীবশ্ৰেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে  ঝামেলায় জড়িয়ে না পরাটাই  আমাদের উদ্দেশ্য। আর আমাদের পক্ষে   সেটাই  মঙ্গলের। তাদের শরীরে  আমাদের  মতো বিষের থলি  না থাকতে  পারে, তাদের কিন্তু মগজ নামে  একটা জিনিস  আছে যার সন্মুখে বিরাট আকারের  বন‍্য হাতিও বশ হয়ে  পড়ে। 

জঙ্গলে জঙ্গলে পথ চলেছি। মাঝ পথে   কার ও আভাস পেলাম। কেউ আমাকে  অনুসরণ করছে। একবার  হঠাৎ ফিরে তাকিয়ে ধরে ফেললাম। অপূর্ব সৌন্দর্যের  চোখ জুড়ানো একটি মেয়ে । মানে একজন সর্পকন্যা। দেখলেই বোঝা যায় তার বয়স কম। যৌবনে  পা রেখেছে। আমি দেখতে পেয়েছি বলে জানতে পেরে লজ্জায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। আমি জিজ্ঞেস করলাম 

: কি নাম?

:শর্মিষ্ঠা

লজ্জিত ভাবে সে বলল। আমরা  কথা অরম্ভ করলাম-

: আমাকে ভয় করছ না লজ্জা করছ?

: দুটাই। তুমি আমাকে খেয়ো না কিন্তু।

আমার মনটা আদ্র হয়ে উঠল। কী যে বলে এই বোকা মেয়েটি; আমরা রাজা ফেটী সাপরা সাপ খাই, সে কথা  মিথ্যা নয়। কিন্তু ইঁদুর আর ঢোঁড়া সাপই আমাদের  প্ৰিয় খাদ্য। সময় বিশেষে টিকটিকিও আমরা খুব  একটা অপছন্দ করি না। আমি তাকে অভয় দিলাম-

:কোথায় যাবে?

:আশ্ৰয় স্থলের খোঁজে। আমি তোমাকে যাত্ৰা পথে সমস্ত বিপদ থেকে   রক্ষা করব।

শর্মিষ্ঠা হেসে ফেলল। আমি বললাম –

:শর্মিষ্ঠা, আমার  সমগ্ৰ যাত্ৰাপথের  সংগী হবে ? আমি সবসময়  তোমার সঙ্গে  খাদ্য ভাগ করে খাব । আমিও শরনার্থী। আমিও  আশ্ৰয়ের খোঁজে এই  এই যাত্ৰা আরম্ভ করেছি শর্মিষ্ঠা। 

:হব, হব,  তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ…

:শিবা। আমার নাম শিবা । 

শর্মিষ্ঠা এগিয়ে এল। আমার কাছে চলে এল। আনন্দে আত্মহারা হল। হওয়ার  কথাই। এই বিপদ সংকুল যাত্ৰা কালে একজন সঙ্গী পাওয়াটা  কম কথা নয়। তাতে আবার তাকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে  যাবার  প্ৰতিজ্ঞা করা একজন  সহযাত্ৰী পেয়েছে সে। 

আমরা দুজনেই একসঙ্গে পথ চলতে লাগলাম। যাত্ৰা পথে  শর্মিষ্ঠাকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে আমি তার জন্য সুস্বাদু খাদ্য গিয়ে খুঁজে   আনি। দুজনেই  পরম তৃপ্তিতে খাবার  ভাগিয়ে  খাই। রাতের দিকে খুব সচেতনতার সঙ্গে আমরা  যাত্ৰা করি, দিনের দিকে বিশ্রাম নিই। আমরা অত‍্যন্ত সক্ৰিয় হওয়ার সময় হল কাল সন্ধ্যার সময়টুকু। আমরা  দুজন দুজনের প্ৰতি খুব আসক্ত হয়ে পড়েছি। যাত্ৰার ক্লান্তি, আশ্ৰয়স্থল হারানোর বেদনা সবকিছু  আমাদের হৃদয়ে  উপচে পড়া প্ৰেমের বৃষ্টির ঝাক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনের কোষে লাল  জবা পাপড়ি  মেলেছে, প্রজাপতির পাখা মেলেছে। একদিন আমি শর্মিষ্ঠাকে প্ৰেমের প্ৰস্তাব দিলাম। সে  লজ্জা এবং আনন্দের সঙ্গে সন্মতি জানাল। যাত্ৰা কালে ফেব্ৰুয়ারি  মাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফ্ৰেব্রুয়ারি, অর্থাৎ আমাদের মিলন ঋতুর শুরু।  একজন ভর যুবতি  গোখোরো সাপকে সাধারণত কয়েকজন পুরুষ রাজা গোখোরো  সাপ  একসঙ্গে পেতে চায়। ফলে রাজা গোখোরো পুরুষদের মধ্যে   এক মহা যুদ্ধ হয় এবং বিজয়ী জন সুন্দরীর সঙ্গে  সম্ভোগ করার সুযোগ এবং সৌভাগ্য লাভ করে। কিন্তু আমার কোনো প্ৰতিদ্বন্দ্বী  ছিল না বলে আমি শর্মিষ্ঠাকে একা  পেয়েছিলাম। নিজেকে ধন্য মেনেছিলাম। আমাদের রাজা গোখোরোদের চারিত্ৰিক বৈশিষ্ট অনুসরণ করে  আমি  আমার মাথাটা শর্মিষ্ঠার গায়ে ঘষে ঘষে মিলনের ইচ্ছা প্ৰকাশ করেছিলাম। শর্মিষ্ঠাও  সন্মতি প্ৰকাশ করেছিল এবং আমি  তার  ভরা যৌবনের  শরীরটা আমার শরীর দিয়ে ঘিরে  ধরেছিলাম। মন দুটির সঙ্গে  আামাদের দুটি শরীর ও এক হয়ে গেল। আমাদের  রাজা গোখোরোদের  প্ৰজনন দেখতে পাওয়াটা মানুষের জন‍্য এক বিরল ঘটনা বলে পরিগণিত হয়। আমরা পৃথিবীর কোনো প্ৰাণী  না দেখতে পাওয়া  করে  মিলিত হতে লাগলাম।

অনুভব করলাম, আমরা  কিছু ঢালু জায়গা পেয়েছি। ক্ৰমান্বয়ে আমরা ওপরে উঠছি। অর্থাৎ ঘন অরণ্যে  ভরা  পাহাড়ের নিচু জায়গায় পৌঁছে ছি আমরা। ভালো লাগছিল। যতই  ওপরে  যাচ্ছি ততই  অরণ‍্য  ঘন হয়ে এসেছে। খাদ্যের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হয়নি। সহজেই পেয়েছি। শীতল বাতাস মন প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে। যেতে যেতে একজায়গায় আমরা থেমে গেলাম। সব দিক থেকেই সুবিধাজনক অরণ্য। বন‍্য ফুলের মিষ্টি  সুগন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া  মন জুড়োনো  একটি অরণ্য। কয়েকদিন  সেখানেই  কাটিয়ে  ভাবলাম, নতুন বাড়িটা এখানেই  তৈরি করা  যাক। শর্মিষ্ঠাও সায় দিল। বিস্তীর্ণ অরণ্য। ভোলানাথের নাম নিয়ে  শর্মিষ্ঠা এবং আমাদের  সোনার  সংসার  আরম্ভ করলাম। আমাদের সর্পদের সঙ্গে অন্য অনেক ধরনের  জীব জন্তু বাস করা জায়গা টা   ভালোই লাগল। ধীরে ধীরে জায়গাটা  সম্পর্কে  সবিশেষ জানতে পারলাম।  পাহাড়িয়া  রাজ্য অরুণাচল প্ৰদেশ। আমরা  যে জায়গায়  বসতি আরম্ভ করলাম সেই জায়গাটা  নাহরলগনে।  সাগর পৃষ্ঠ থেকে একশো পঞ্চান্ন  মিটার  উচ্চতায়।  ঘন ঘোৰ অরণ্যে দিনগুলি অতিবাহিত হতে থাকল। ইতিমধ্যে শর্মিষ্ঠা অনেক বার সন্তান প্ৰসব করল। শারীরিক মানসিক দুই থেকেই। আমরা  একজোড়া  সফল সুখী দম্পত্তি হিসাবে জীবন পার করতে শুরু করলাম। আমাদের কোনো দিনই মিলনের  জন্য  অন্য সঙ্গীর  সন্ধান করতে  হলনা। আমাদের সর্প জগতে প্ৰায় সাপই বছরে একবার করে  নিজ প্ৰজাতির সঙ্গে মৈথুনে লিপ্ত হয়। গন্ধের সহায়ে আমরা আমাদের  যৌনসঙ্গী খুঁজে নিই। আমাদের পুরুষদের লেজের দিকে ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে পারা  একজোড়া  শিশ্ন থাকে। স্ত্ৰী পুরুষ উভয়েরই  লেজের  শেষের দিকে পায়ু ছিদ্ৰের কাছে  কিছু  গ্ৰন্থি থাকে। গ্ৰন্থিগুলি  গন্ধযুক্ত হয়। প্ৰত্যেক প্ৰজাতির গন্ধের পার্থক্য থাকে। কিছু সুগন্ধ আর কিছু দুর্গন্ধ। মিলন ঋতুর সময়ে বিচরণ স্থলীতে প্ৰত্যেকেই সেই গন্ধ  রেখে যাওয়াটাই নিয়ম।  সেই গন্ধ আমাদের মৈথুন ক্ৰিয়ার জন্য আকৃষ্ট করে। কিন্তু শর্মিষ্ঠা এবং আমাকে  কখনও অন‍্য কারুর  উগ্ৰগন্ধ যৌনরস আকুল করেনি। আমরা আমাদের মধ্যেই  মগ্ন ছিলাম।

মাঝে মধ্যে  শর্মিষ্ঠা চিন্তিত হয়, বিহ্বল হয়। কারণ আগে একটাও নরমানুষ উঁকি  নামারা অরণ্যটিতে আজকাল মানুষের প্রবেশ ঘটছে।খড়ি যোগার করার জন‍্য, বন‍্য  শাক সব্জি জোগাড় করার  জন্য তারা অরণ্যে প্রবেশ করে। জনজাতিরা  এখানে সাপের মাংস  ভক্ষণ করে । তার মধ্যে তে যদি  কথাবোৰৰ ভু লৈ আহে মই গমকে নাপাওঁ। অবশ্য আমাদের  জীবন কালে এই অরণ্যে কয়েকবার আমি বিরাটকায় ভারতীয় শিল অজগর বা পাইথন মলুরাচ শিকার করে। মহা উল্লাসে বহন  করে নিয়ে যেতে দেখেছি । বিষহীন হওয়ার জন্য ওরা  বিন্দুমাত্র ভয় না করে ওদের  শিকার করতে পারে। আমি  জানি, শর্মিষ্ঠার  ভয় অমূলক নহয় । মানুষের  সঘন দেখা সাক্ষাৎ আমাদের জন্য  নিরাপদ না হয়। আমরা আরও জানি যে একদিন আমাদের এই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। যতই মানুষের আসা যাওয়া বাড়বে ততই অরণ্যের পরিসর  কমে আসবে। একদিন অরণ্য নাই হয়ে যাবে। আর আমরাও  একদিন পৃথিবী থেকে মুক্ত হয়ে যাব। শর্মিষ্ঠার আতঙ্ক  বাড়বে বলে আমি তাকে কথা গুলি বলি না।

শর্মিষ্ঠা পুনরায় সন্তান সম্ভবা  হয়েছে। তার শরীরটা প্রায়ই ভালো থাকছে না। তার মধ্যে সে আবার অরণ্যে মানুষ  দেখে চিন্তিত হয়েছে।  এমন সময়ে  একদিন সেই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে গেল। মানুষের  হাতে বিনাদোষে আমার  প্ৰাণ গেল। আমার আদরের শর্মিষ্ঠা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল।  দিনগুলি  পার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরটার মোহ আমি  ত্যাগ করতে  পারছি। আসলে এখন আমাকে  মায়া মোহ ত‍্যাগ করে অনন্তধামে যাত্রা করতে হবে। কিন্তু আমি শর্মিষ্ঠার মায়া ছাড়তে পারিনি। সত্যি কথা বলতে গেলে ওকে  মানুষের মধ্যে ছেড়ে অনন্তধামে যাবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। যে যে আঘাত আমার এই শক্তিমান শরীর সহ্য করতে পারল না সেই আঘাত আমার কোমল দেহ শর্মিষ্ঠাকে যদি সহ্য করতে হয় তাহলে তার কি দশা হবে?ইস আমি  ভাবতেই পারি না। অন্য কিছু ভয়ও রয়েছে আমার। আমাদের  চামড়ার  একটা বিরাট ব্যবসা রয়েছে যার জন্য অজস্ৰ সাপ বিনাদোষে নিধন করা হয়। সাপের  চামড়া  দিয়ে তৈরি করা  গহনা, জুতো, ব‍্যাগ আদির যথেষ্ট মূল্য রয়েছে। বিদেশে রপ্তানি হয় আমাদের সুন্দর চামড়ার। অবশ্য উনিশ শ পচাত্তর ছিয়াত্তর সনের  বন্যজীৱন সংরক্ষণ নীতি আমাদের চামড়া, বিষ আদির রপ্তানিতেও প্ৰতিবন্ধকতা লাগিয়েছে। কিছুলোক আবার আমাদের  দেখিয়েও ব্যবসা করে। আমাদের নাকি নাচায়। আমরা নাকি সঙ্গীতের তালে তালে নাচি। বর আমোদজনক মিথ‍্যা  কথা। বাতাস বহন করে আনা কোনো শব্দ আমরা ধরে  ফেলতে পারি  যদিও কৃত্ৰিম স্পন্দনশীল ধ্বনি থেকে আমরা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাটাই আমাদের সহজাত প্ৰবৃত্তি।   সাপেরা ওদের বাঁশীর সুরে  মানুষকে মুগ্ধ করে। আমাদের সর্প কূলের ভেতরে পিট-ভাইপার ছাড়া অন্য কেউ  এত স্পষ্ট করে দেখতে  পায় না। সর্পকুল যে কোনো বস্তু একটার আকার এবং গতি দেখতে পায়। তাই সাপেরা সাপুড়ের বাঁশির  গতি অনুসলণ করে হয়তো অনেকে শরীর নাচায়। অবশ্য অন্য সাপের  তুলনায় আমাদের রাজা গোখোরোর  দৃষ্টি শক্তি প্ৰখর। সাপুড়েরা  আমাদের থলের  ভেতরে, বোতলের  ভেতরে  ভরিয়ে রাখে । ইস কী যে নির্দয় এই মানব জাতি। কেউ কেউ  আমাদের  পুজো করে। নাগ পঞ্চমী পুজো। আমাদের  মাটির  পাত্ৰে রাখে এবং  পুজোর  শেষে মুক্ত করে  দেওয়া হয়। মগজের অধিকারী  জীবশ্ৰেষ্ঠ মানুষ  একবার ও ভেবে দেখে না  যে বিনাদোষে কারাবাস খাটার  যন্ত্ৰনা কত। আমাদের  ধরা  বা মারার কারণ অনেক।  বিভিন্ন কারণে আমাদের গবেষণার জন্য ও ধরে। আমাদের সবাইকে মানব জাতি এক একটি বৈজ্ঞানিক নামেও নামকরন করেছে। আমরা রাজা গোখোরো  প্ৰজাতি একটা নাম পেয়েছে ‘অফিঅফেগাচ হান্নাহ’। নামটা অবশ্য খারাপ  নয়। জানি না এই মানব জাতির কাছ থেকে আমার শর্মিষ্ঠা কতদিন আত্মগোপন করতে  পারবে। 

জানিনা, মানুষেরা কেন বুঝতে পারেনা যে ব্যবহার করতে জানলে গোখোরো সাপের বিষ মানুষের পরম বন্ধু। নাহলে কব্ৰক্সিন, নাইলক্সিন জাতীয় অতিমাত্ৰা ব‍্যথার ঔষধ গুলি গোখোরো সাপের ঔষধ থেকে কেন প্ৰস্তুত করা হত ; কিং-কব্ৰা ভেনম বা রাজা সাপের বিষ থেকে তৈরি বিষনাশক অন্য বিষনাশকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলেও প্ৰমাণিত হয়েছে। মরফিনের মতো  ড্ৰাগ নাশ করতে নাপারা বিষ ও  আমাদের বিষ থেকে  তৈরি  বিষনাশকে নাশ করার  উদাহরণ রয়ে গেছে। 

জানিনা, মানুষ কেন বুঝতে পারেনা যে প্ৰকৃতির ভারসাম্যতা রক্ষার ক্ষেত্ৰে আমাদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আমরা কৃষকের পরম বন্ধু। পৃথিবীতে এরকম কোনো প্ৰাণী আছে যে আমাদের মতো তড়িত গতিতে ইঁদুরের ঘরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে ইঁদুর ধরে খেতে পারে। দুই হাজার সাত সালের সমীক্ষা অনুসারে ইঁদুর ভারতের প্রায় পাঁচ দশমিক ৮৭ লাখ টন গম, তিন দশমিক চুরাশি লাখ টন চাল, সাত দশমিক একুশ লাখ টন আঁখ  নষ্ট করে।

আমার শর্মিষ্ঠার বয়স হয়েছে। সে আজকাল আগের মতোদ সচেতন সপ্ৰতিভ ভাবে  অরণ্যটিতে  বিচরণ করতে পারে  না। আমাকে হারিয়ে  মানসিক ভাবেও ভেঙ্গে  পড়েছে। বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকে। আমার  সংশয় বেড়ে চলেছে। এহেনে অবস্থায় কোনো মানুষ আক্ৰমণ করলে ও কি নিজেকে বাঁচাতে পারবে? প্ৰভূ ভোলানাথের। চরণে তার রক্ষার জন্য প্ৰার্থনা করা ছাড়া আমি  একটা আত্মা যে আমার  অনন্ত কালের প্ৰেয়সী, আমার পত্নী শর্মিষ্ঠার জন‍্য কিছুই করতে পারব না। অরণ্যটা  দিন দিন ফাঁকা হয়ে আসছে। আমার হত্যাকারীরা  এখন কোথায়  কীভাবে  আছে, ওদের শাস্তি কতদিনের  হল ইত‍্যাদি কথাগুলি জানার উপায় নেই। ওদের দ্বিতীয়বার  এই অরণ্যে  দেখতে পাইনি। কিন্তু অন্য মানুষ মাঝে মধ্যে   দেখতে  পাই। জানি না  মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যারা আমাদের ভালোবাসে, তাদের হাতে  সর্প জাতির ভবিষ্যৎ কতটা নিরাপদ।

আমার জন্য   বার বার স্বর্গযাত্ৰার সতর্কবার্তা  আসছে। একটা আত্মার নরকে বসবাস কত দিনই বা সম্ভব হবে। জীবিত কালে কোনো নীতি বর্হিভূত কার্য নাকরার জন্য, নরকে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে  নি:স্বার্থ স্বর্গীয় প্ৰেম করার জন্য  আমি   সসন্মানে স্বর্গবাসের। আমন্ত্ৰণ পেয়েছি। প্ৰভু নীলকণ্ঠ জটাধারী আমার  সহায় হবে।

এখন এখানে আমি  শর্মিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করছি। শরীর ছেড়ে শর্মিষ্ঠা একদিন  আত্মা হয়ে  উড়ে উড়ে আসবে আমার কাছে।   তার  পরে, আমরা দুজনে একসঙ্গে  স্বর্গযাত্ৰা করব। এই পৃথিবীতে আমরা  আর দ্বিতীয়বার আসব না যেখানে মানুষ থাকে। যে  পৃথিবীতে জীবশ্ৰেষ্ঠ মানুষ আমাদের বিনাদোষে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে  আঘাত হেনে  হত্যা করে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত