নক্ষত্র, শাপলা, স্পার্টকাস ও ভাসানযাত্রার গল্প
এক
সিপাই, ল্যান্সনায়েক, নায়েক, হাবিলদার, নায়েব সুবেদার, সুবেদার মেজর, ডি.এ.ডি, এ.ডি ছয়/ছয়টা সিঁড়ি টপকে তবে অফিসার ডি.এ.ডি., মানে উর্দিতে তিনটা তারা আর এ.ডি. সবচেয়ে বড়ো র্যাঙ্ক দুইটা শাপলা ও একটা তারা। ক্যাপ্টেন? ক্যাপ্টেনেরও তিনটা তারা। ক্যাপ্টেনের চেয়ে এক সিঁড়ি উপরে মেজর। মেজর অর্থ উর্দিতে দুইটা শাপলা। হ্যাঁ-হ্যাঁ মেজরের পরই না লেফটেন্যান্ট কর্ণেল? একটা তারা আর একটা শাপলা। লেফটেন্যান্ট কর্ণেলের পর কর্ণেল। তার উর্দিতে ঝলমল করে দুইটা শাপলা…তারপর যেন কে? মাগো, এত কি মনে রাখা যায়? হ্যাঁ, ব্রিগেয়িার! তার উর্দিতে জানো দুইটা তরবারি মানে তলোয়ার ক্রস করা এমন ভঙ্গিতে আঁকা থাকে। ব্রিগেডিয়ার কত উঁচুতে যেন বা খোদ জিব্রাইল ফেরেশতার ডানায় চড়ে বেহেশতে উড়ে চলার মতো উঁচু-মাথা তুলে তাকাতে গেলে ঘাড় ঘুরে পড়ার দশা। তা’ সেই ব্রিগেডিয়ারের উপর যারা থাকেন তাঁদের বলা হয় মেজর জেনারেল তাঁর উর্দিতেও দুইটা তলোয়ার ক্রস করা। মেজর জেনারেলের উপর কে জানো? লেফটোন্যান্ট জেনারেল। হ্যাঁ কিন্তু তাঁর উর্দিতে দুইটা না তিনটা না চারটা তলোয়ার, তা নূরজাহান বেগম কি করে বলে? সাঁইত্রিশ বছর আগে বিয়ের সময় স্বামী ছিল সিপাহী জওয়ান। সেই থেকে ল্যান্সনায়েক, নায়েক, হাবিলদার, নায়েব সুবেদার আর সুবেদার মেজর পাঁচ/পাঁচটা সিঁড়ি টপকে ডি.এডি. অফিসার হয়েছিল। ক্যাপ্টেনের উর্দিতেও তিনটা তারা আর ডি.এ.ডি.-র উর্দিতেও তিনটা তারা। তবে কিনা ক্যাপ্টেনের বয়স হলো তার বাহিনীর সার্ভিসের শুরুতে কুড়ি-একুশ হতে বড়জোড় তেইশ-চব্বিশের ভেতর আর সিপাই থেকে ডি.এ.ডি. হতে হতে বয়স পঞ্চাশ পার। কারো উর্দিতে শুরুতেই তিনটা তারা আর কারো কিনা তিনটা তারায় ঝলমল করতে চুল পাকা শেষ। আর লেফটোন্যান্ট জেনারেল যারা হয়? তারা ত’ দেশের রাষ্ট্রপতিই হয়। দু/দশ জন নেতা গুলি খেয়ে মারা যায় আর হঠাৎ একদিন টেলিভিশনের সামনে এসে অনেক তারা, শাপলা কি তলোয়ার আঁকা উর্দি পরা কেউ এসে বলে, …‘সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হওয়ায় সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে আমি লেফটেন্যান্ট জেনারেল।’
গত বেশ কিছু বছরে অবশ্য তেমনটা কম হচ্ছিল। গুলি খেয়ে নেতারা কম মরছিল আর তাই দেশের দায়িত্ব নিতে তরবারি ক্রস উর্দি পরা কেউ টেলিভিশনে সেভাবে আসেনি। শেষ যিনি এলেন, তিনিও ঠিক কারো মৃত্যুর পর আসেননি। কিন্তু এই দ্যাখো, ঠিক ব্রিগেডিয়ারের উর্দির শাপলা, তারা আর তলোয়ার গুনতে যাবার সময় থেকেই নুরজাহান বেগম ফাঁপড়ে পড়ে যায়। কেমন এলোমেলো হয়ে যায় সবকিছু। তা হবে না? গত পাঁচ বছর ধরে স্বামী ডি.এ.ডি. হবার পর নানান ডেপ্যুটেশন আর্মির যারা তাদের এখানে চাকরি করতে আসে, সেই আর্মির বউদের সাথে একই পার্টি কি অনুষ্ঠানে নূরজাহান বেগম বা তারই মত অন্য ডি.এ.ডি.-র বউরা খানা-পিনা করতে পারত। তবু, সোফা কিন্তু আলাদা। অপস্ অফিসার ভাবি বা অপারেশন এ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসারের স্ত্রী, টু-আই-সি ভাবি বা সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের স্ত্রী, কমিশন ভাবি বা কমিশন অফিসারের স্ত্রী আর সেক্টর কমান্ডার ভাবি বা সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রীরা পার্টিতে বসে এক সোফায় আর ডি.এ.ডি. বা এ.ডি.-র বউরা বসে এক সোফায়। কমিশন বা সেক্টর কমান্ডার ভাবিদের বয়সও প্রায় নূরজাহান বেগমদের কাছাকাছিই হয়। কিন্তু, অপস্ অফিসার বা টু-আই-সি ভাবিরা অনেক সময় প্রায় মেয়ের বয়সী। তার উপর যা সাজ! আরে, এরা বুড়ি হলে অবশ্য আরো বেশি সাজে। ঠোঁটে লিপস্টিক, নখ সব সময় এত নিখুঁত নেলপালিশে ঢাকা বুঝি কখনো থালা-বাসন ধোয়া বা গোসলটাও বোধ করি এরা করে না… তা’ সেই নূরজাহান বেগমকে কি করে এক সোফায় বসতে দ্যায় অপস্ অফিসার ভাবি, টু-আই-সি ভাবি, কমিশন ভাবি কি সেক্টর কম্যান্ডার ভাবি? হায় সোফা! স্বামীর পাঁচ/পাঁচটা প্রমোশনের পর কিনা পার্টিতে তবু সোফায় বসতে পারে তারা। আর যখন কিনা ছিল সিপাহি, ল্যান্সনায়েক বা নায়েকের বউ? জওয়ানের বউ?
‘ডার্টি জওয়ানস্! হেল উইদ য়ু! বাস্টার্ড!’
‘চল্ চল্ চল্
চল্ চল্ চল্
ঊর্দ্বে গগনে বাজে মাদল,’
কী শুনবে তুমি নওজোয়ান?
‘কী আর শুনব কও নূরজাহান? শুনি শুধু বাস্টার্ড! লেফট্ রাইট লেফট।’ বলে হাসতে থাকে। সদ্য বিয়ে হওয়া নূরজাহান মেহেদি রাঙা হাতে মুখে হাত চাপা দেয় বিস্ময়ে, ‘কী করো? কী করো গো তুমি?’ লোকটি এবার নূরজাহানকে চেয়ারে বসা থেকে কোলে তুলে নেয়। এক টানে খোঁপা খুলে ফেলে চুলে মুখ গোঁজে, ‘দুইটা ভাতের জন্য মালা কষ্ট নুরু। জানো তো সবই। আব্বা অসময়ে মারা গেল। সৎ বড়ো ভাইরা দেখলো না। ক্লাস নাইনের পর পড়তে না পেয়ে এই বি.ডি.আরে আসছি। আর্মির গাল খেতে খেতে চাকরি করছি। তুমি কক্ষণো আমাকে কষ্ট দিও না।’
অবাক চোখে নূরজাহান দ্যাখে তার হাতের মেহেদির নক্সায় গড়িয়ে পড়ছে জল। এত লম্বা-চওড়া লোকটার চোখে পানি?
‘কয়টা দিন ছুটিতে আসছি! কি আরাম! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারি। সার্ভিসে শুধু রাত দিন গালি আর গালি। আমরা তো অফিসার না। আমরা হইলাম জওয়ান। হা! হা!’
লোকটা আবার নূরজাহানকে কোল হতে চেয়ারে বসিয়ে আয়নার সামনে ফের দাঁড়ায়। নিজে নিজেই অদৃশ্য কাউকে স্যালুট ঠোকে। স্যালুট ঠোকে আর চিৎকার করে ওঠে, ‘অ্যাটেনশন। হেউ জওয়ানস্ ! হেল…টেক রাইট টার্ন। লেফট রাইট লেফট… হা!…হা! হা!’
সিপাহী মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম লেফট রাইট ছেড়ে আবার নজরুলের গান ধরে,
‘চলরে নওজোয়ান
শোনরে পাতিয়া কান…
ভাঙরে ভাঙ আগল!
চল্ রে চল্ রে চল্ !’
লোকটি দরাজ গলায় গান গাওয়া ছেড়ে অবাক মানা বা অবাক মানতেই থাকা নূরজাহানের কোলে মুখ গোঁজে,‘প্রমোশন পাইছি নুরু। তোমার সাথে বিয়ার এক সপ্তাহের মাথায় সিপাহী হইতে ল্যান্সনায়েকের প্রমোশন পাইলাম। চিঠি আসছে! তুমি আসায় আমার ভাগ্য ফিরলো।’
নূরজাহান লজ্জা পায়, ‘ইশ! আমার জন্যই বুঝি? তুমি না মুক্তিযুদ্ধ করছো? এটাতেও তো আগে আগেই প্রমোশন হয় তোমার।’
‘করছি! ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ হইতে বাংলাদেশ রাইফেলস্ হইলাম। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মুন্সি আব্দুর রব আর ল্যান্সনায়েক হামিদুর রহমান দুই/দুইজন বীরশ্রেষ্ঠ আমাদের বি.ডি.আরে.-র! কিন্তু, তবু আমরা তো নূরু কখনো সেক্টর কমান্ডার হইতে পারবো না। ‘এস’ ফোর্স, ‘জেড’ ফোর্স কি ‘কে’ ফোর্স। সিপাহী থেকে ল্যান্সনায়েক কি নায়েকই বড়োজোর। তারপর?’
‘এত মন খারাপ করে না।’
‘তুমি ভাবো আমি পাগল, না? দুইটা ভাতের জন্য কী কষ্ট! তবে, দেইখো তুমি… তোমার মত মেয়ে ঘরে আনছি জওয়ানের বউ কইরা রাখার জন্য না। দাদি আম্মার কাচে হাজার শোকর…’
‘দাদি আম্মা কী করলেন?’
‘কী করলো? আরে তোমারে দেখার আগে এক মহা ধবধবা ফর্সা মাইয়া দেখা হইছিলো। আমার দুই কলিগ বা বন্ধু সেই মেয়েরে পছন্দ করলো। দাদি পছন্দ করলো তোমারে। এই যে আমাদের অর্মির স্যারদের বউদের দেখি না? সব ফর্সা মহিলাগুলা আইজ অমুকের বসের সাথে কি কাইল তমুকের জুনিয়ারের সাথে টাঙ্কি মারে! দেইখা-শুইনা আমারো ফর্সা মাইয়াতে ভয় ছিলো! শুধু কই কি নূরু, আরো প্রমোশন পাইতে হইলে কি অফিসার হইতে হইলে আরো খাটতে হবে। তোমারে ফেলায় সীমান্তে সীমান্তে ঘুরতে হবে, বর্ডারে বর্ডারে, আমি দুনিয়ার অন্য কোন নারীর দিকে তাকাবো না। খোদ ববিতাও যদি সামনে আসে তা-ও না তুমিও অন্য কোন পুরুষের দিকে।
‘তওবা-তওবা আমিও তোমার সাথে বর্ডারে বর্ডারে ঘুরবো, তোমারে ছাড়বো না।’
‘প্রথম কয়েক বছর একসাথেই ঘুরবো! তারপর ছেলে-মেয়ে হইলে তাদের ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য তখন ঢাকাতেই থাকতে হবে।’ ‘বাহ্, এ তো দেখি গাছে কাঠাঁল আর…’
‘না-না-সত্যি আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক পড়াশুনা শিখাইতে হবে। একটারে আর্মিতে দেবো। আমি ত’ শালা সারা জীবন থাকবো বি.ডি.আর.! কথা দাও নুরু তুমি কখনো অন্য কোন…’
‘আরে এইটা কী কও?’
নূরজাহানের গালেও কখন জল গড়ানো শুরু করেছে সে টের পায়নি।
‘খোদার কসম -আমি সাজগোজ সব ছাইড়া দেব। পর্দা করবো।’ ‘তাই করো। সেদিন আমাদের নায়েক আখতার আলীর বউ শবনম আখতার এক অবিবাহিত ক্যাপ্টেনের সাথে ভাগলো। ক্যাপ্টেনের কোনই শাস্তি হইলো না। আখতার আলীর মুখের দিকে তাকানো যায় না। আল্লাহ না করুক, আমরা যদি ওনাদের বউদের দিকে নজর দিতাম? একজনও বাইচা থাকতে পারতাম? ওনারা কিন্তু সুন্দরী দেখলে আমাদের বউদের দিকে ঠিকই নজর দ্যায়!’
সেই শুরু। নূরজাহানের প্রিয় নায়িকা ছিল সুচন্দা। উঁচু খোঁপা, ঈষৎ কানি বের করে কাজল টানা, ছিম-ছাম শাড়ি সব বাদ দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ।
‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত,
আমরা আনিবো রাঙা প্রভাত,
আমরা টুটাবো তিমির রাত
বাধার বিদ্ধ্যাচল-
নব-নবীনের গাহিয়া গান,
সজীব করিবো মহাশ্মশান…’
‘আম্মা! আম্মা!’ বড়ো মেয়ে কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নূরজাহান বেগম টের পায়নি, ‘আল্লাহ্…আম্মা, তুমি জায়নামাজে বইসা গুনগুন করতেছ? ও আম্মা, তুমি কি পাগল হইয়া গেলা?’ নূরজাহান বেগম ভেজা চোখে তাকায়, ‘গান গাইলাম নাকি? আমি কি জায়নামাজে? কয়টা বাজেরে পিঙ্কি?’ বড়ো মেয়ের পিঙ্কি ডাক নাম। বাপের মতোই গোলাপি ফর্সা আর টলটলে চেহারা। গত এক মাস ধরে বাপের জন্য নফল রোজা রেখে রেখে শুকিয়ে গেছে। উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে মা’র কপালে হাত রাখে, ‘আবার ফেইন্ট হইছিলো নাকি?’
‘হ্যাঁ সেজদা দেবার সময় কেমন জানি মাথাটা চক্কোর দিল তারপর এই তো আবার উইঠা বসছি!’
‘আর উইঠা বইসা গুনগুন করা শুরু করছো? তাও জায়নামাজে বইসা? আম্মা তোমারে নিয়া তো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাইতে হবে দেখি! নামাজের শক্তি কি মনের জোর না কুলায় তো জায়নামাজটা গুটায় রাইখা গুন গুন করো। আব্বার এই অবস্থা!এই সময় এমন কিছু বুইঝা করো কি না বুইঝা করো যে গুনাহ্ না হয়।’
নূরজাহান বেগম এবার জায়নামাজ গুটিয়ে একপাশে রেখে শুয়ে পড়ে, ‘তোর আব্বা ছুটিতে আসলেই এই গানটা গুনগুন করতাম। তুই যখন পেটে আমার সবকিছু কেমন তালগোল পাকায় যাচ্ছে, মা!’
এবার পিঙ্কিও তার মা’র গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, ‘সে কি জানি না আম্মা? তোমার চেয়ে নামাজ-রোজা-পর্দা কে বেশি করে? কোন্ দুঃখ তুমি আজ জায়নামাজে বইসাও দিক-দিশা হারায় ফেলতেছ তা’ কি বুঝি না?’
‘মা রে! যদি কোর্ট মার্শাল দেয়?’
‘কোর্ট মার্শাল দেবে না আম্মা! দরকার বোধে আমি সারা বছর নফল রোজা রাখবো। তিনশ‘ পঁয়ষট্টি দিনই রোজা রাখবা তবু, তুমি এত ভাইঙ্গো না। তুমি দেইখো আম্মা কোর্ট মার্শাল দেবে না।’
‘ষাইট ষাইটটা অফিসার খুন। ওরা আমাদের ছাড়বে নারে পিঙ্কি। এই দেশের প্রাইম মিনিস্টার কি প্রেসিডেন্ট কারো সাধ্য নাই ওদের একটা টোকা দেয়। ওরা আমাদের মানুষ মনে করে না। আল্লাহ! তুমি আর কত দুঃখ দেবা, আল্লাহ্?’
‘আম্মু…’
ছোটো ছেলে ঘরে ঢোকে। তিন ছেলে-মেয়ের ভেতর এরই রঙটা নূরজাহানের মতো শ্যামলা। নূরজাহানের মতোই একটু ছোটো-খাটো। কিন্তÍ মেধায় সবচেয়ে শানিত। ‘ওরা যদি কোর্ট মার্শাল দেয়, ওরা যদি আমার আব্বুকে আর অন্য কাকুদের ফাঁসিতে ঝোলায় আমি বড়ো হয়ে…!’
‘বড়ো হয়ে কী করবি তুই সজল? হ্যাঁ?’ খুব উদ্বিগ্ন ভাবে প্রশ্ন করে পিঙ্কি যেন সজল বড়ো হয়ে সত্যি এমন কিছু করতে পারবে যা তার বাবারা পারেনি। আর সেই পারাটা দেখার উপরই যেন তার বাদবাকি জীবনের বেঁচে থাকা।
‘বড়ো হয়ে আমি এর বদলা নেব।’
‘সজল’ আর্ত চিৎকারে পিঙ্কি ছোটো ভাইয়ের মাথা বুকে চেপে ধরে, ‘আস্তে বল্ ভাইয়া। কেউ শুনবে।’ ‘কেউ শুনবে না আপা। কেন এত ভয় পাও তোমরা? আব্বুকে তো ওরা রিমান্ডে মেরে মেরে পঙ্গু বানিয়েই ফেলেছে। আব্বুর ফাঁসি না হলেও আব্বু কি আর কখনো হাঁটতে পারবে? গান গাইতে পারবে?
এক ঝটকায় বড়ো বোনের আলিঙ্গন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে দিয়ে সজল তার চশমা খুলে চোখ মোছে।
‘ইসশ্… চোদ্দ বছরের ছেলে তার পাকা কথা শোনো।’ মৃদু একটা চড় বসায় পিঙ্কি তার ছোটো ভাইয়ের গালে। পরক্ষণেই ফের জড়িয়ে ধরে, ‘তুই আমাদের সবার ছোটো। এসব ভাবনা এখন ভাববি না। আগামী বছর তোর এস.এস.সি। তুই জি.পি.এ. ফাইভ পেলে আব্বা আবার হাঁটতে পারবে, দেখিস।’
মেজ ছেলে কখন বাথরুম থেকে গোসল করে বের হয়ে এ ঘরে ঢুকেছে। ইন্টারের পরপরই তাকে চাকরিতে ঢুকতে হলো। বাবার মতোই লম্বা আর সুন্দর দেখতে বলে ‘ক্যাটস্ আই’-এর শোরুমে একটা চাকরি পেতে সমস্যা হয়নি তার। এখন রোজার মাস বলে সামনে ঈদের কেনা-কাটার বাস্ততায় নামকরা শপিং মল বা ব্যুটিক হাইসগুলো শিক্ষিত আর মোটামুটি দেখতে-শুনতে ছেলে-মেয়েদের সেলস বয় বা সেলস গার্ল হিসেবে কাজে নিচ্চে। পিঙ্কিরও পরশু থেকে ‘কুমুদিনী’তে ঢুকবার কথা। আজ পাঁচমাস হয় বেতনের যে অর্দ্ধেক টাকাটা তাদের পাবার কথা, তা-ও তারা পাচ্ছে না। নূরজাহান বেগম বি.এ পাসের পর আর ছেলে-মেয়েরা বড়ো হলে ল পাস করে হাইকোর্টে প্রাকটিস করছেন। গত কয়েক বছরে আর্থ্যাইটিসের সমস্যায় কোর্ট বিল্ডিংয়ের দীর্ঘ করিডোরে হাঁটতে সমস্যা হয় বলে প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আবার চাকরি খুঁজতে হবে। চেনা-জানা দু/একটা জায়গায় কথা হচ্ছে তার। স্বামীর মামলার জন্যই এক/দু’টা মানবাধিকার সংস্থায় দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তাদের সাথেও পরিচয় হচ্ছে তার। তারাই বলছে চাকরি দেখে দেবে।
‘ভাত খাব আপু।’
‘আমিই উঠছি দাঁড়া। ও তো রান্না করলো এতক্ষণ। আমি না হয় খেতে দিই।’ ছেলে-মেয়েরা দিনের কাজ শেষে পাশে এলেই তিনি আবার শরীরে জোর ফিরে পান।
দুই
রাজস্থলীর সেই সকাল এই পাহাড়ি এলাকায় যেমনটি হয় তেমনি ছিল। দীর্ঘ ও খাড়াই পাকদন্ডি বেয়ে এক/একটি দূরগামী ট্রাক বা বাস হঠাৎই লাল ধুলা উড়িয়ে যাচ্ছে বহদুর।
কখনো কখনো চাঁদের গাড়িতে একসাথে চেপে বসেছে বাঙালি, ত্রিপুরা, চাকমা। বিষন্ন মুখ পাহাড়িরা কেউ কেউ বা পাহাড়ের খাদে মাইলের পর মাইল হাঁটছে কাঁধে কলা, আনারস অথবা পেঁপের ঝাঁকা নিয়ে। মাইল খানেক পর পর সেনা চৌকি। বি.ডি.আর ক্যাম্প। ডি.এ.ডি বিনোদ ভূষণের ঘুম ভেড়ে গেছিলো সকাল সাড়ে সাতটায়। হাত মুখ ধুয়ে আটটা নাগাদ অফিসে ঢুকলেন। হাজার বছরের সংস্কারে এরই ভেতর গায়ত্রী মন্ত্রও জপা শেষ। এই রাজস্থলী ১১নং বি.ডি.আর. ব্যাটালিয়নের সেক্টর কমান্ডার বা অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আনিসুর রহমান গত রাতটা ক্যাম্পাসে না থেকে সাত মাইল দূরে একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে রাতে থেকেছেন। আনিসুর রহমানকে বিনোদ ভূষণ একটু ভয় পান। আজ হতে প্রায় চোদ্দ বছর আগে চুয়াডাঙায় আনিসুর রহমান ও তিনি একই ক্যাম্পাসে ছিলেন। আনিসুর রহমান সেবারও আর্মি হতে ডেপ্যুটেশনে টু-আই-সি বা সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড হিসেবে তাঁদের ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। বিনোদ ভূষণ তখনো ডি.এ.ডি.। আজ চোদ্দ বছর ধরেই তিনি ডি.এ.ডি। সেনাবাহিনীর অফিসাররা চায়ই না বি.ডি.আর-এর জওয়ানদের ভেতর থেকে কেউ আদৌ ডি.এ.ডি. বা অফিসার rank পর্যন্ত আসুক। সারা বাংলাদেশে হাজার হাজার বি.ডি.আর জওয়ানের ভেতর হিন্দু-মুসলিম সব মিলিয়ে মাত্র সাকুল্যে জনা বিশ-পচিঁশ ডি.এ.ডি. বা অফিসার কর্মকর্তা আছেন। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, সীমান্তে অস্ত্র উদ্ধার বা চোরাচালান রোধে বিশাল বীরত্ব দেখানো, বাহিনীর বিভিন্ন পরীক্ষায় সমরতত্তে¡ অসাধারণ নম্বর পেয়ে তবে অফিসার rank অর্জন করেছেন। তা-ও পেতে পেতে যৌবন অস্তাগত। ষোল বছর বয়সে বিনোদ ভূষণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তখন তিনি নবম শ্রেণীতে পড়েন। তখন তার মাত্র স্বরভঙ্গ। মাত্র মুখে ব্রন। ঠিক মতো শেভ করতে শেখার আগেই তিনি গেরিলা প্রশিক্ষণ নিলেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু সামনা সামনি অপারেশনেরও অংশ নিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরবার পর তাঁর বাবা-মা তাঁকে আবারো স্কুলে যেতে বললেন। কিন্তু নয় মাস রাইফেল ঘাড়ে করে আর নিজের হাতে কয়েকজন রাজাকার ও দু’জন সেনা মারার পর তাঁর মনে হলো আবারো বই হাতে করে স্কুলে যাওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। তার ভেতরের কিশোরটি হঠাৎই এক বছরে এক পরিপক্ক মানুষ হয়ে গেছে। ১৯৭২-এ তিনি বি.ডি.আর-এ যোগ দেন। ধৈর্য্য ধরে আর তিনটি বছর পড়ে সেনাবাহিনীতে পরীক্ষা দিলেই কিন্তু হতো। তাহলে আর সারা জীবন এই বি.ডি.আর জওয়ান বা দ্বিতীয় সারির সৈন্যের তকমা নিয়ে চলতে হতো না। ডি.এ.ডি.-র উপর এ.ডি. সারা বাংলাদেশে খোদ মুসলিমদের ভেতর হতেই অফিসার আছে হাতে গোনা। সংখ্যায় দশের নিচে। এবং অতি উচ্চস্তরের ধর-পাকড়, তদ্বির ছাড়া এটা হয়না। যা হোক সেই চুয়াডাঙ্গায় থাকার সময় টু-আই-সি মোহাম্মদ আনিসুর রহমান ও তাঁর বাসা পাশাপাশি। আনিুসর রহমান তখন মেজর। তখনো লেফটোন্যান্ট কর্ণেল হননি। আনিসুর রহমানের স্ত্রী দেখতে তত ভালো নয়। একটু জড়সড় ও অপ্রতিভ গোছের। বিনোদ ভূষনের স্ত্রী নন্দিনী গোস্বামী আবার সুশ্রী ও সপ্রতিভ গোছের। নন্দিনীর খরচের হাতটা একটু বড়ো। তার কয়েকটা ভাই-বোন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকে বলে ঘরে কিছু বাড়তি বিলাস দ্রব্য আছে। কেন জানি আনিসুর রহমানের সন্দেহ হলো এই চুয়াডাঙ্গার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ব্রাহ্মণ বিনোদ ভূষণ নির্ঘাৎ চোরা চালানের পয়সা মেরে মেরে অনেক টাকার কুমীর হয়েছেন। নাহলে বি.ডি.আর-এর ঘর এত সাজানো গোছানো আর তাঁর বউ কিনা আর্মি অফিসারদের বউদের চেয়েও চটপটে? হঠাৎই সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিনোদ ভূষণের বিরুদ্ধে তিনি দূর্নীতির মামলা ঠুকে দিলেন। ক্যাম্পাসের অন্য আর্মি অফিসাররা পর্যন্ত এ ঘটনায় লজ্জা পেলেন। গোপনে কেউ কেউ বিনোদ ভূষণকে নৈতিক সমর্থন অবধি যোগালেন। দু’বছর মামলা চলার পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ স্বয়ং এত বিরক্ত হলো যে আনিসুর রহমানকে চুয়াডাঙা থেকে বদলি করা হলো। কিন্তু, ক্ষিপ্ত আনিসুর রহমান যাবার সময় বলে গেলেন যে এত সহজে তিনি ছাড়বেন না। বিনোদ ভূষনের ‘মুখোশ’ একদিন না একদিন উন্মোচিত হবেই! তেরো বছর পর খুঁজে খুঁজে
গত বছর আনিসুর রহমান এখন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ও টু-আই-সি’র বদলে খোদ সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ঠিক এই রাজস্থলী ১১নং ব্যাটালিয়নে এসে হাজির। অবশ্য গত সাত/আট মাস ধরেই তাঁর ব্যবহার খুব বিনয়ী। তবু, কেমন ভয় করে বিনোদ ভূষণের। তিনি সাধ্যমতো ‘স্যার’ ‘স্যার’ করেন। তা’ আনিসুর রহমান তাঁকে এই সকাল আটটা বেজে বারো মিনিটে অয়্যারলেসে জানালেন যে তিনি রাজস্থলী বাজারে অপারেশন করবেন যে চোরাচালান হচ্ছে কিনা এবং সেভাবে গোপনীয়তা বজায় রেখে বি টাইপ টহল বের করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি যেন নেওয়া হয়। তিনি তাই করলেন। সকালটা এভাবে একটু ব্যস্ততায়ই কাটলো। সকাল দশটার দিকে আনিসুর রহমান রাজস্থলী বাজারের অপারেশন থেকে ব্যাটালিয়নে ফিরে এলেন। এগারোটা নাগাদ তাঁর রুমে ডাক। মেজর আরমানকে ডাকা হয়েছে।
‘আপনারা কোন খবর শুনেছেন?’ অধিনায়ক জিজ্ঞাসা করলেন।
‘না তো স্যার! কী ব্যাপার?
‘উনি তো না হয় আর্মিরই মানুষ। আপনি বি.ডি.আর.-এর ডি.এ.ডি.। আপনিও জানেন না?
‘কী হয়েছে স্যার?’
সামান্য ফ্যাকাশে মুখে আনিসুর রহমান টি.ভি. অন করলেন। টেলেপে ব্রেকিং নিউজের শিরোনাম। আনিসুর রহমান অফিস থেকে বের হয়ে তাড়াহুড়া করে সিগন্যাল সেন্টারে গেলেন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বন্ধ করে দিয়ে চাবি নিজের কাছে রাখলেন। তারপর মেগাজিনও বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রাখলেন।
‘একটু বসেন বিনোদ। আরমান, আপনিও বসেন।’
‘বসছি স্যার।’
‘ঢাকার পিলখানার অবস্থা তো দেখেছেন। আমাদের এখানে।’ ‘কিছু হবে না স্যার। এই দূর পাহাড়ি এলাকায় আমাদের জওয়ানেরা কিছুই জানে না। আপনি বড়ো ভাইয়ের মতো, বাবার মতো তাদের ডেকে বোঝান যে সেনাবাহিনী বি.ডি.আর. ভাই ভাই। দেখবেন ওরা কিছু করবে না।’ ‘এই ক্যাম্পাসে আমরা আর্মি অফিসাররা সংখ্যায় সবাই অতি নগণ্য। আপনারা চাইলেই…
‘কিচ্ছু হবে না স্যার। আমাদের উপর বিশ্বাস রাখেন।’ ‘সৈন্যদের কল করেন তাহলে। আমি ওদের সাথে কথা বলবো।”
রাজস্থলীর একটা ছোট্ট টিলার উপর এই ব্যাটালিয়নের সবুজ ঘাসে সারি বেঁধে দাঁড়ালো জাওয়ানেরা। আনিসুর রহমান সামনে এসে দাঁড়ালেন, ‘বাংলাদেশ রাইফেলস্ ব্যাটালিয়নের প্রাণপ্রিয় সদস্যগণ।’
অনেক দুঃখ আর শঙ্কার ভেতরেও হঠাৎই একটু হাসি পেল বিনোদ ভূষনের । প্রাণপ্রিয় সদস্যগণ? কুত্তার বাচ্চা, সান অফ আ ফাকিং বীচ, সান অফ আ হোর ছাড়া আর্মি তাদের ডাকে? স্যালুট, স্যালুট বিদ্রোহীরা।ঢাকার পিলখানায় যা করেছো তোমরা! যদি একদিনের জন্যও ওদের তুই-তোকারি ডেকে খুন করতে পারো! ছিঃ এ কি ভাবছেন তিনি? হাজার হোক বিনোদ ভূষণ একজন সৈনিক। যে সৈনিক সিনিয়রকে মানে না, ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা মানে না সে তো ডাকাতেরও অধম। ইন আর্মি, সিনিয়র ইজ অলওয়েজ সিনিয়র।
‘দেশমাতৃকার সেবায় অতন্দ্র প্রহরীগণ!’ কাঁপা কাঁপা গলায় আনিসুর রহমান বক্তৃতা করেছেন। অতন্দ্র প্রহরীগণ? ক্যানো? বি.ডি.আর তো জওয়ান। সে তো ক্রীতদাস। রাত জেগে সীমান্তে বি.এস.এফ-এর শিখ সৈন্যদের গুলি খেয়ে বেঁচে হোক আর মরে হোক আমরা চোরা চালানের মাল পুনরুদ্ধার করি আর তোমরা সেরা সিগারেট, মদের বোতল, মুম্বাই জারদৌসি কাজ শাড়ি আর সোনর গহনা তোমাদের বাসায় নিয়ে যাও। এই যে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আনিসুর রহমান, তোমাকে আমি এখন গুলি করতে পারি। এই বি.ডি.আর-এর জওয়ানরা সব আমার অধস্তন। আমাদের তোমরা অফিসার বলতে চাও না। জওয়ান রেখে দিতে চাও সারা জীবন। কিন্তু, অস্ত্র চালাতে আমরা কম জানি না। আমি বললেই এই জওয়ানরা এক্ষণি তোমাদের তিন-চারজন আর্মি অফিসারকে টুঁটি টিপে মেরে ফেলতে পারে। টি.ভি. না দেখলেও রেডিওতে বিদ্রোহের খবর ওরা জানতে পেরেছে। ভিতরে ভিতরে ওরা সব ফুঁসছে। প্রধানমন্ত্রী এ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তোমরা কি ট্যাঙ্ক নামাতে চাও সেনাবাহিনী? নামাও না! ধনী আর গরীব সৈন্যদের একবার মুখোমুখি লড়াই হয়ে যাক। চাকর আর মালিক পাঞ্জা লড়–ক একবার। কিন্তু, আমি তা’ করবো না। দ্যাখো বাবা অফিসার…লেফটেন্যান্ট কর্ণেল…আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিতে পারি। বি.ডি.আর কি উপকথার সেই ইঁদুর আর আর্মি কি সিংহ? তা’ দ্যাখো ইঁদুরও কখনো কখনো সিংহের রক্ষাকর্তা হয়।
‘আমার প্রাণপ্রিয় বি.ডি.আর.ভাইগণ! দেশের এক কঠিন ক্রান্তিলগ্নে আমরা উপনীত। তোমরা হয়তো অবগত আছো যে ঢাকার পিলখানায় বি.ডি.আর. দরবার হলে এক শ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান বা সৈন্য হঠাৎই বি.ডি.আর প্রধান ও তার স্ত্রী সহ বেশ কিছু সেনা অফিসারকে হত্যা করেছেন। তবে, তোমাদের প্রতি আমাদের বিশ্বাস আছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনী ও তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। কিছু কিছু সেনা অফিসার কখনো কখনো কোন বি.ডি.আর সৈন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও সব সেনা অফিসার খারাপ নয়। একজন প্রকৃত সেনা অফিসার কখনো অন্য কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। সেনাবাহিনী-বি.ডি.আর. ভাই ভাই।’
‘বালের ভাই।’ সুবেদার সারোয়ার চিৎকার করে ওঠে।
‘সারোয়ার। খবরদার।’ বিনোদ ভূষণ কড়া ধমক লাগান, ‘স্যারের বক্তব্যে কোন বাধা দেওয়া চলবে না।’ ‘ভাই? যখন কথায় কথায় আমাগো কুত্তা শুয়ার কয়?’ হাবিলদার কামালের বক্তব্য শেষ হতে পায় না, তার আগেই বিনোদ ভূষণ আঙুল তোলনে, ‘সরে যাও তোমরা! লাইন থেকে সরে দাঁড়াও বলছি।’
‘ক্যান সরবো?’ নায়েক মামুন মুখ তোলে।
‘ক্যান সরবো?’ একই সাথে বহুজন গলা তোলে। সুবেদার সারোয়ার নায়েক (সিগন্যাল) কবির, নায়েক (সিগন্যাল) গণেশ, হাবিলদার, কামাল, ল্যান্স নায়েক (ড্রাইভার) অমল, সুবেদার আকবর, নায়েক মামুন, হাবিলদার মমিন, নায়েক সুবেদার আবুল…সবাই একসাথে গলা চড়ায়, ‘একবার হুকুম করেন। এই আর্মির খচ্চরগুলোরে খতম কইরা দিই ঢাকার মতো।’
‘বেয়াদব। স্কাউন্ড্রেল।’
মহল্লায় অন্য কারো কাছে নিগৃহীত শিশু সন্তানকে খমক দিতে গিয়ে বাবা মা’র ভেতরটা যেমন ছিঁড়ে যায়, বিনোদ ভূষন বোঝেন এই তরুণদের ধমক দিতে তার ভেতরটাও তেমনি ছিঁড়ে যাচ্ছে, ‘গো ব্যাক টু ইওর ইউনিট। কেন গুজবে কেউ কান দেবে না। কোন ধরনের নাশকতায় জড়ালে আর্মি বি.ডি.আর.আমরা কেউ বাঁচাবো না।’ সৈন্যরা তখনকার মতো চুপ করে যায়। মাথা নিচু করে ফিরে যায় যে যার কাজে।
আনিসুর রহমান এবং আরো তিন-চার জন সেনা কর্মকর্তা সহ বিনোদ ভূষনকেও বসতে হলো টি.ভি. রুমে একই সোফায়। মহাভারতে পিতামহ দেবব্রতের শরশয্যাও কি এই সোফার মত ছিল নাকি? টি.ভি-তে একটার পর একটা ফুটেজে ভেসে আসছে খুন, মৃত্যু, লুট, অগ্নি সংযোগের কাহিনী। অন্য সেনা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বসে তিনি বি.ডি.আর. অফিসার হয়ে সেসব দৃশ্য দেখছেন। কেউই যেন কারোর মুখের দিকে অবধি তাকাতে অবধি পারছেন না। সেই পাকিস্তান আমল হতে ই.পি.আর. হয়ে আজকের বি.ডি.আর-সৈন্যদের বহু বছরের বঞ্চণা বোধের ভীমাকৃতি খড়ের স্তুপে কেউ হঠাৎই ছুঁড়ে দিয়েছে একটি মাত্র দেশলাই কাঠি আর হয়তো সামান্য কেরোসিন। তারপর লঙ্কাকান্ড যা শুরু হবার হয়েছে। কিন্তু, কে করলো আর কেনই বা করলো? ঢাকার প্রধান বিদ্রোহী বি.ডি.আর নেতা যাকে দেখানো হচ্ছে তাকে তিনি চিনতেন। মৃদুভাষী একজন মানুষ এমন ভয়ানক বিদ্রোহে কেন জড়াতে গেলেন? তিনি কি এর পরিণতি জানেন না? আর্মি যদি এখন ট্যাঙ্ক নিয়ে নামে? যদি সব গুঁড়িয়ে দেয়? কারা করলো? বাংলাদেশে আর্মির সাথে কেউ পারেনি। শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান কেউ না। সেনাবাহিনী এদেশের প্রধান নেপথ্য সরকার। সে হাসিনা খালেদা যেই কেন না ক্ষমতায় আসুক। ঢাকায় তার স্ত্রী আর মেয়ে কেমন আছে? মেয়েটা এবার ও লেভেল দিচ্ছে। একটাই মেয়ে তাদের। তাকে একটু ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে, এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতে ‘যোগ্য’ করার জন্য বউ মেয়েকে নিয়ে ঢাকাতে রয়ে গেছে আজ কয়েক বছর। পিলখানার যে বি.ডি.আর পরিবারগুলো রয়েছে তাদের কি হবে? শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে জিতবে তো সেনাবাহিনীই। বিনোদ ভূষণ জানেন যে তাদের ক্যাম্পাসের এই তিন-চার জন সেনা কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের জান-মান-সম্ভ্রম প্রাণপনে রক্ষার পরও তিনি জেল-ফাঁসি এড়াতে পারবেন না। বিশেষতঃ আরো তিনি বি.ডি.আর এর গোটা কয় অফিসার র্যাঙ্কধারীদের একজন। অনায়াসে তাঁকে এই মিউটিনির মাস্টার মাইন্ডদের একজন হিসেবে ধরা হবে। অথচ, থাকেন তিনি রাজস্থলীতে। ঘটনার কত দূরে। কোন্ বুদ্ধিতে এমন বোকার মতো কান্ড ঘটালো তারই বাহিনীর অফিসার ও সৈন্যরা? ইতিহাস বলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে গোরা সৈন্যের কাছে শেষমেশ পারেনি মঙ্গল পান্ডে, ঝাঁসির রানী, নানা সাহেব আর তাঁতিয়া টোপী। এখন কালো বাঙালির ভেতরই দু’ভাগ। হারবে শেষমেষ গরীব পক্ষই। দাসরা কখনো পারেনি। স্পার্টাকাসও পারেনি। বিনোদ ভূষণ, তুমি কি ভীতু? তুই শালা ভীরু সংখ্যালঘু! পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে তোমার ছেলেদের বললেই তারা এই তিন-চারটা আর্মি অফিসারকে মেরে ফেলবে। তাছাড়া তুমি মারবার কে বিনোদ ভূষণ? তাঁদের মৃত্যু যদি নিশ্চিত হয়েই থাকে…! অর্জুন যখন কাঁদছিলেন যে তাঁরই আত্মীয়-পরিজনকে তিনি সংহার করবেন না তখন পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ তার মুখ হাঁ করে বিশ্বরূপ দেখালেন। সেই ব্যদিত মুখ গহ্বরে বিপক্ষের সব সৈন্য আগে থেকেই ঢুকে বসে আছে। মহাকাল সবাইকে সংহার করেন। ডি.এ.ডি. তৌহিদ আর তার সৈন্যরা কি এই ষাট জন সেনা অফিসারকে মেরেছে? না, তাদের মৃত্যু আগেই নির্ধারিত ছিল? দূর, যদি সব কিছু আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকে, অর্জুন যদি নিমিত্ত মাত্রই হবেন, সবাইকে যদি আগেই মেরে রাখা হবে থাকে তবে তুই ভগবান আবার কেন অনার্যের মতো শোক দুঃখ পরিহার করে হাতে অস্ত্র নিয়ে শত্রু সংহার করতে বলছিস? এই ক্যাম্পাসে আমরা বি.ডি.আর সৈন্যরা যদি এই তিন-চারটা আর্মি অফিসারকে মেরেই ফেলি… কোন্ ভগবান বা কোন্ আল্লাহ তাদের বাঁচাতে পারবে? নিষ্কাম কর্ম। না…না…ইন আর্মি, সিনিয়র ইজ অলওয়েজ সিনিয়ার। চেইন অফ কম্যান্ড ভাঙা সৈনিকের পক্ষে মহাপাপ। আজ সাঁইত্রিশ বছর সৈনিকের চাকরি করে তিনি মানুষ কি হিন্দু কি মুসলিম এসব কিছুর আগে তার মনে হয় তিনি সৈনিক। সৈনিকের দায়িত্ব কি? চেইন অফ কম্যান্ড না ভাঙা? সোলজার উইদাউট ডিসিপ্লিন ইজ মেয়ার থাগস।
তিন
সীমিত
৩৬ রাইফেলস্ ব্যাটালিয়ন
দিনাজপুর
দূরালপনী:
৭০.০/১৭-এ//আর ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬
০৮ জুন ২০০৯
গ্রেফতারকৃত বি.ডি.আর সদস্যদের উত্তরাধিকারীগণকে গ্রেফতারের তারিখ ও মামলা নম্বর জানানো প্রসঙ্গে বরাতঃ
(ক) সদর দপ্তর বাংলাদেশ রাইফেলস্ রেকর্ড উইং, ঢাকা পত্র নম্বর ০১/১/১/আর- ডকুমেন্ট তারিখ ১৪ মে ২০০৯ (সকলকে নয়)।
(১) বরাত পত্র অনুযায়ী আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে, গত ২৫-২৬/শে ফেব্রæয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে অত্র ব্যাটালিয়নের আর. ডি. ও.-১৮২-কে গত ০৩ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে রাত্রি ২১:৩০ ঘটিকার সময় বি.ডি.আর দিনাজপুর সেক্টর রেস্ট হাউজ থেকে দিনাজপুর থানা পুলিশ কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। পরবর্তিতে নিউমার্কেট থানা, ঢাকার মামলা নম্বর- ৯, তারিখ ০৬ এপ্রিল ২০০৯ (বি.ডি.আর বিদ্রোহ মামলা) মোতাবেক গত ১৭ এপ্রিল ২০০৯ তারিখ হতে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তার বর্তমান অবস্থান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
২) ইহা আপনাদের অবগতির জন্য প্রেরণ করা হলো।
আনোয়ারুল কবির (মেজর )
বিতরণ: নূরজাহান বেগম, স্ত্রী,
ঠিকানা : ১৪, নিলক্ষেত
ঢাকা।
‘হ্যালো, নূরজাহান ভাবি? আমি দিনাজপুর বি.ডি.আর-এর নায়েব সুবেদার মাওলা বখশ বলছিলাম।’
‘কি ব্যাপার বলেন তো?’
‘ভাবি…ডি.এ.ডি.. স্যারকে তো গতকাল রাত নয়টায় রেস্ট হাউজ হইতে এ্যারেস্ট কইরা দিনাজপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়া গেছে!’
‘এ আপনি কী বলতেছেন?’
‘জ্বি ভাবি…’
‘কিন্তু, আপনাদের ভাই ত’ কোন বিদ্রোহ তৎপরতার সাথে ছিল না। ওরা ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সকালে আর্মি বি.ডি.আর. হেড কোয়াটারে আক্রমণ করতে পারে, এই ভয়ে যখন সাধারণ সৈনিকরা সব অস্ত্র হাতে জড়ো হচ্ছিলো, উনি তখন উল্টা অস্ত্র তাদের কাছ থেকে নিয়া থানায় জমা দিছেন। হ্যান্ড মাইকে মাইকিং করে সবাইকে থামতে বলছেন। দিনাজপুর বি.ডি.আর কোয়ার্টারে থাকা আর্মি অফিসারদের নিরাপদ জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন!’
‘আপনি খুব সরল মানুষ ভাবি। স্যারের একটাই দোষ যে নিজের পরিশ্রমে আর ঈমানের জোরে উনি সিপাই হইতে অফিসার র্যাঙ্ক পর্যন্ত উঠছেন। আর্মি এই একটা সুযোগ পাইছে। আমাদের ভেতর মাথা গরম যারা এই কান্ডটা ঘটাইলো তাদের দোষে সাধারণ জওয়ান তো ওরা মারবেই! অফিসার সারা দেশে পনেরো-কুড়ি যে কয়জন আমাদের ভেতর আছে সবাইকে বিদ্রোহের সাথে জড়িত দেখায় ওরা মাইরা ফেলবে। যাতে আমাদের ভেতর শুধু জোয়ান ছাড়া কেউ না থাকে। ওদের লাখি-ঝাঁটা খাবে, মোট টানবে, চাল-ডালেরর বস্তা টানবে! আর্মি হতে বলছে কি যে স্যারের মোবাইলে সার্চ করে কল রেজিস্টারে নাকি ঢাকার প্রধান বিদ্রোহীর নম্বর দেখা গেছে। সেইটাই ওনার প্রধান অপরাধ। ভাবি এত কথা মোবাইলে বলাও মুশকিল। আমার শ্যালকের বাড়ির বাথরুমে ঢুইকা কথা বলতেছি।’
‘আপনি আর একটু সময় রাখেন। আপনাদের ভাই এখন কোথায়?’ ‘স্যাররে তো আমাদের সামনে চোখ-হাত-পা বাইন্ধা, ফাঁসির আসামীদের মতো কালো পোশাক পরায়ে ডি.এফ.আই.-এর লোক ক্যান্টনমেন্ট নিয়া কাল সারা রাত বোধ হয় টর্চার করছে। ওনার সাথে আরো কিছু সাধারণ জওয়ানকেও বিদ্রোহী হিসাবে মামলায় নিছে। আমি ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ছুটিতে দেশের বাড়ি পিরোজপুর থাকায় এ যাত্রায় বাঁচলাম।’ কথা বলতে বলতে একটু কাশেও মাওলা বখশ। তার গলায় সর্দি বসা। ‘ভাবি, ওনাকে সম্ভবত ঢাকায় চালান দেবে। দিনাজপুর বি.ডি.আর-এ বিদ্রোহ চেষ্টা আর পিলখানায় হত্যাকান্ড দুই/দুইটা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ওনাকে চালান দেবে।’
‘উনি মুক্তিযুদ্ধ করছে আপনি জানেন?’ নূরজাহান বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন, ‘উনি কী করে রাষ্ট্রদ্রোহী হবেন?’
‘ওদের একটাই কথা। স্যারের মোবাইলে ২৫ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানার মুল বি.ডি.আর. বিদ্রোহীর ফোন নম্বর কল রেজিস্টারে দেখা গেছে।’
‘ওনারা দু’জন একসাথে সার্ভিসে জয়েন করছিল। দু’জনই এক র্যাঙ্কের। পিলখানার ঘটনা শুনে চেনা মানুষের খোঁজ নিতে ফোন করছিলো…’
‘সেই কথা তো আর আপনি তাদের বুঝাইতে পারবেন না। আপনি দিনাজপুর আসেন তাড়াতাড়ি।’
…তা’ দ্যাখো নজরুলের চল্ চল্ চল্ গানটা শিষ বাজিয়ে গাইতে গাইতে যে লোকটা একটা আস্ত জীবন পার করে দিল, সিপাই, ল্যান্সনায়ক, নায়েক, হাবিলদার, নায়েব, সুবেদর মেজর হতে ডি.এ.ডি. হয়ে আগামী বছর এ.ডি. হবারও কথা ছিল যার! অসম্ভব দীর্ঘ ও গৌরবর্ণ সুপুরুষ চেহারা দেখে আগের বছর নূরজাহান বেগমের কাছে আসা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, কালো ও টাক মাথা সেনাবাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেনের সম্বন্ধ বাতিল করে দেওয়া তার স্কুল শিক্ষক বাবা বি.ডি.আর-এর সিপাহীর সাথে সম্বন্ধ ফেরাতে পারলেন না।
‘এ নিশ্চয় বড়ো ঘরের ছেলে। মানে ভালো বংশ। ক্যাপ্টেন কি সিপাহী আমি বুঝি না। ভালো ছেলে মনে হইলো। এমন জামাই পাশে নিয়া হাঁটাও গর্ব- পরমা সুন্দরীও এমন জামাই পেলে ধন্য হবে। আর তুই আমার কালো, ছোটো-খাটো মেয়ে! মা, তোর সম্বন্ধ এইখানেই ঠিক করলাম।’
নূরজাহান বেগমের ভীষণ কল্পনাপ্রবণ আর রোমান্টিক মনের বাবা বলেছিলেন যে বাবা ষাট বছর বয়সেও লুকিয়ে মা’র জন্য গরমের দিনে সাদা বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসতেন, সুচিত্রা-উত্তমের ছবি দেখে আবেগে কাঁদতেন- হাসতেন। তেমন কল্পনাপ্রবন ও বিষয়-বুদ্ধিহীন না হলে আর্মি ক্যাপ্টেন বাদ দিয়ে কেউ বি.ডি.আর-এর সিপাহীর সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়? আব্বাগো! আমিও তো সিপাহি-ক্যাপ্টেন নিয়া মন খারাপ করি নাই। এ কী হইলো আব্বা? তুমি বাঁইচা নাই। আমি কি করি! তোমাদের নূরজাহানের বয়স একান্ন হইলেও আজাে যে সেই ছোটো খুকিটাই আছে। বাহাত্তরে বিয়ের আর পনেরো বছর পর সন্তান হইলো। এই পনেরো বছরে যে স্বামী আর ধৈর্য্যহারা হয় নাই, অন্য মেয়ে বিয়া করে নাই। সেই লম্বা সিনেমার নায়কদের মতো রূপবান লোকটির সাথে আর এবছর এপ্রিলের আঠারো তারিখ যখন কোর্টে বেলা দুইটার সময় তার দেখা হলো মানুষটা হাঁটতে পারছে না। তিন তারিখ থেকে আট তারিখ পর্যন্ত দিনাজপুরে পাঁচদিন আর এখানে নয় হতে আঠারো তারিখ নয় দিন। মোট চোদ্দ দিন রিমান্ডে টর্চারের পর চারজন ধরে তুলে নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। চোখের নিচে কালশিটে। মুখে দাড়ি। পায়ের আঙুলের নখ সব ওপড়ানো। কোর্টে রিমান্ড বাতিল করে জেল হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ এলো। এক মাস দশ দিন হাসপাতালে কাটার পর আবার নয় দিন রিমান্ড। এখন আবার হাসপাতাল। খাওয়া-দাওয়া কিছুই করতে পারছে না মানুষটা। বেতনও বন্ধ। নূরজাহান বেগমের ভাই-বোনরা ভালোমানুষ। তারা মুখ ফুটে না চাইতেই বোনের সংসারে সব সাহায্য দিচ্ছে। তবু, এমনভাবে কতদিন?
‘পেপার লাগব আন্টি?’
বাসে কিশোর হকার পেপার দিচ্ছে। এখন সেই দিনাজপুর অবধি দৌড়াও স্বামীর গত চার মাসের বকেয়া বেতনের অন্ততঃ আদ্ধেকটা আদায় করতে। ছেলে-মেয়েদের পড়ার জন্য ডি.এ.ডি. মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম এ শহর হতে ও শহর বদলি হতেন। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নূরজাহান ঢাকাতেই থাকতেন।
‘এই হকার!’
পার্স হতে দশ টাকা বের করে একটা পেপার কেনেন তিনি। ক্ষুর্ধাত বাঘিনীর মতো খুঁজতে থাকেন বি.ডি.আর বিদ্রোহ সংক্রান্ত যেকোন সংবাদ। হুম! শেষের পাতায় ছ’এর কলামে নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত বয়ানে গতকাল রাতে কুমিল্লা জেলখানায় জনৈক বি.ডি.আর. সদস্যের আত্মহত্যার খবর। এত সদস্য সত্যিই আত্মহত্যা করছে? কবে তার নিজের স্বামীর আত্মহত্যার খবর আসবে কে জানে?
বাসের এ.সি-র ঠান্ডা বাড়ছে। ছোটো ছেলের একটি ডায়রি লুকিয়ে নিজের ব্যাগে নিয়েছেন তিনি। ছেলের জন্য খুব গর্ব হয় তার। নূরজাহান বেগমের বাবার সামান্য লেখা-লেখির অভ্যাস ছিল। নূরজাহান বেগম নিজেও ইডেন কলেজে পড়ার সময় অল্প স্বল্প লিখতেন। মাথায় হিজাব পরা তার একটা কারণেই। তার এমন রাজপুত্রের মতো স্বামী যে কোন কারণেই হোক নূরজাহান বেগমের শ্যামবর্ণ, ছোট-খাটো শরীরটাকেই এত মহার্ঘ মনে করে এসেছেন যে অল্পতেই স্ত্রীকে জড়িয়ে অন্যদের নিয়ে তিনি ঈর্ষা করে বসতেন। এই একটা অস্বস্তিকর অভ্যাস ছাড়া আর কোন দোষই কি আছে তার স্বামীর? সেই জায়গাটা স্বস্তি যোগাতেই তার এই পর্দা করা। নইলে তার মতো গান পাগল, বই পাগল নারী আজো কয়টা এই বাংলাদেশে? ছোটো ছেলের ভারি লেখার নেশা। রাইফেলস পাবলিক স্কুলের ম্যাগাজিনে এর মধ্যেই দু/একটি গল্প ও কবিতা লিখেছে সে। আনমনে ছেলের ডায়েরির পাতা উল্টান তিনি।
‘১৯ শে এপ্রিল ২০০৯।’
আব্বুকে আজ আবার জেলে নিয়ে গেছে। আব্বু ভালো ভাবে হাঁটতেও পারছে না। আমাদের স্কুলের ইতিহাসের স্যারকে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। তিনি গতকাল আমাকে গোপনে রোমের দাসবিদ্রোহের উপর একটা বই দিয়েছেন। আমাকে ফিসফিস করে বলেছেন আমার আব্বু একজন গ্ল্যাডিয়েটর। যারা যারা বিদ্রোহ করেছে, তারা সব্বাই গ্ল্যাডিয়েটর। আমি রাসেল ক্রোর সিনেমাটা দেখেছি। গত ঈদেই তো আব্বুই না ডিভিডিটা এনেছিল? আমার টিচার বলেছেন আমি যেন এই বইটা ভালো মতো পড়ি। তিনি আরো বলেছেন স্পার্টাকসদের কখনো মৃত্যু হয় না। বইটা স্যারকে কয়েকদিন পর ফেরত দিতে হবে। ক্লাসের বই ছাড়া, অন্য বই ফটোকপির টাকা চেয়ে আম্মুর উপর এখন চাপ দেওয়া যাবে না। বরং হাতে লিখে তুলি, ‘স্পার্টাকাস ছিল একজন দাস ও গ্ল্যাডিয়েটর যে কিনা রোমক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৃতীয় দাস বিদ্রোহে নেতৃত্বে দিয়েছিল। বর্তমান কালে স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ দাস-ভিত্তিক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম হিসেবে দেখা হয়।
১০০ অব্দে রোমক প্রজাতন্ত্র
স্পার্টাকাসের জন্ম পরিচিতি নিয়ে ঐতিহাসিকগণ মোটামুটি একমত। প্লুতার্ক তাকে ‘যাযাবর গোত্র উদ্ভূত থ্রেসীয় বংশজাত’ এবং স্বভাবের দিক হতে ‘থ্রেসীয়র পরিবর্তে অধিকতর গ্রিক চারিত্রের’ বলে বর্ণনা করেছেন। আপ্পিয়ান বলেন ‘থ্রেসীয় জন্ম সত্তে¡ও একবার তিনি যুদ্ধে রোমক বাহিনীর পক্ষে লড়াই করেন। তবে তার পরপরই তিনি কারাবন্ধী হিসেবে ধৃত হন ও gladiator হিসেবে বিক্রি হন। ফ্লোরাস তাকে বলেছেন তিনি থ্রেসিয়ান ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর সদস্য ছিলেন, পরে রোমক সৈন্যদলে যোগ দিয়েও সেনাবাহিনী হতে পালান ও ডাকাত হন এবং তারপর একজন gladiator হন। প্লুতার্কের মতে, স্পার্টাকাসের স্ত্রী ভবিষ্যৎগণনা করতে পারতেন। তিনিও তার স্বামীর সাথে দাসী হন।’
চার
মহাস্থানগড় মাজারে নিদ্রিত পীর মাহি সওয়ারের থানে লাল সুতা বেঁধে এসেছিল শিরিন বানু। সাধারণত পুত্র সন্তানের আশায় মানত করে মেয়েরা। দু’টো ছেলের পর শিরীন বানুর স্বামী তৈয়ব আলীর শখ হলো মেয়ের। তা’ দ্যাখো আজকাল বিয়ের উনিশ বছর পর আর কেউ বাচ্চা নেয়? কিন্তু, ঐ তৈয়ব আলী মেয়ে মেয়ে করে পাগল। গত আগস্টে ঢাকার পিলখানার ডিউটি থেকে শেষ লম্বা সময়ের ছুটিতে এসেছিল সে। এক মাস দশ দিন ছুটি। তারপর ঈদ আর কোরবানী ঈদেও পাঁচ পাঁচ দশ দিন করে থেকে গেছে। ততদিনে সে তৃতীয় বারের মতো সন্তান সম্ভবা। শিরিন বানুর বয়স এখন উনচল্লিশ। সে গৌরবর্ণা, দীর্ঘাঙ্গী ও স্বাস্থ্যবতী। তার চোখ দুটো বড়ো বড়ো, নাক খাড়া ও চুলের গোছা এখনো পুরুষ্টু ও কোমর ছোঁয়। কাজেই স্বামী যখন তৃতীয় সন্তান ও বিশেষ করে একটি কন্যা সন্তানের জন্য মিনতি করলো, সে খুব আপত্তি করলো না। যেহেতু শিরিন বানু জানে অথবা জানে না সে এই প্রাচীনা ধরিত্রীর মতোই সহনশীলা ও পুষ্পময়ী কিনা। কোরবানী ঈদের সময় এসেও স্বামীর কি পাগলামি, ‘মেয়ে যদি না হয়? হযরত মাহি সওয়ারের থানে অবশ্য সূতা বান্ধিবা লাগিব্যু।’
শিরিন বানুর বড়ো বোন একটা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলার শিক্ষিকা। তার স্বামীয় স্কুলের শিক্ষক। দু’জনেই তারা প্রায় কোলকাতার মানুষের মতো শুদ্ধ কথা বলে। তা’ বুবু বলে, ‘জামাই মিঞা, এখন তো আল্ট্রা-সাউন্ড রিপোর্টেই জানা যায় যে ছেলে না মেয়ে হবে। তুমি না ঢাকায় থাকো?’
‘সে ম্যুই ঢাকায় থাকি আর যিখান্যেই থাক্যি, বাবা মাহি সওয়ার আমার জিন্দা পীর।’
তা’ দ্যাখো স্বামীর কথাতেই না শিরীন বানু ডাক্তারের কাছে আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট করাতে যায়নি। গেলে বাবা মাহি সওয়ার ক্রুদ্ধ হতে পারেন যে তারই বান্দা, তারই ভক্ত কিনা তাঁর থানে সূতা বেঁধেও বিশ্বাস রাখতে পারেনি, উল্টো দৌড়েছে ইংরেজি পড়া ডাক্তারের কাছে। তখন যদি তিনি সব পন্ড করে দেন? শিরিন বানু ২৪ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তখন সে সাত মাসের গর্ভবতী।আবারো মহাস্থানগড় মাহি সওয়ারের থানে গিয়ে পুরনো সূতা তুলে নতুন লাল সূতা বাঁধে, মাজারের দরবেশের কাছ থেকে পানিপড়া নেয়, এলো চুলে মাজারের চত্বরে জবা গাছ ফুল তুলে একটা পেতলের থালায় জবা ফুল, আগরবাতি, চাল, খান কয় আলু আর কাঁচকলা, দু’টো দশ টাকার নোট ভক্তি ভরে রেখে আসে। তা’ এই সাত মাসে পড়ার পর থেকে প্রায়ই তার হাতে পায়ে পানি আসে। বাচ্চার বাবা তো ঢাকায়। স্বামীর চাকরির বয়স কুড়ি, তাদের বিয়ের বয়স উনিশ আর বিয়ের ভেতর সব মিলিয়ে চার-পাঁচ বছরও কি গুনে গুনে একসাথে সংসার করা হয়েছে? সিপাহী আর ল্যান্স নায়েক থেকে নায়েক হতেই উনিশ বছর লেগে গেল। ক’টাকাই বা বেতন? এই আয়ে স্বামী তাকে ঢাকায় পিলখানার কোয়ার্টারে নিয়ে তুলতে পারে না। পারে না বলে বগুড়াতেই যখন তাদের দু’জনারই চোদ্দ পুরুষের বসত, নিজেদের একটা টিনের ঘরও আছে, সেখানেই থাকুক না কেন শিরিন বানু তার চোদ্দ আর আট বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে? মহাস্তানগড় মাজারে এলেই কি এক কৌতুহলে শিরিন বানু অল্প দূরের গোকুলের ভিটা আর বিশেষ করে বেহুলার মঠ দেখতে যাবেই। বেহুলা সুন্দরীর মঠ দেখলেই তার বুক শিরশির করে উত্তেজনায়। কত বড়ো সতী! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। লোহার বাসরে ঢুকে পড়লো কাল নাগিনী, লখিন্দরকে দংশন করলো। তারপর মৃত স্বামীকে জিয়ন্ত করিতে বেহুলা সুন্দরী ভেলায় সমুন্দর পার হইলেন। বেহুলার মঠের সামনে অন্ধকারে ঝিকিয়ে উঠছে সার সার জোনাকি।
‘শিরিন, যাব্যি না? বাড়ি ফিরব্যি না?’ বড়ো বোন নিগার বানু তাড়া দেয়।
‘হ্যাঁ, বুবু। চলো।’ চব্বিশে ফেব্রুয়ারি রাতে কি মনে করে বড়ো বোন নিগার বানুকে বাসায় রেখে দেয় শিরিন।
‘আমার শরীরটা কেমন করে বুবু। তুমি আজ থাক্যে যাও।’
নিগার বানু খুব অমত করে না। কাল তার স্কুলে এমনিই একদিন ছুটি হয়েছে। দু’টো ছেলের বয়স আঠারো ও কুড়ি। স্বামী নির্বিবাদ মানুষ। সে বাড়িতে ফোন করে দেয়। সেই রাতে তারা দুই বোন অনেকক্ষণ রাতে টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে হিন্দি সিনেমার গান দেখে ঘুমিয়ে পড়ার পর শিরিন বানু স্বপ্নে দ্যাখে লাল সালুর ভেতর হতে জেগে উঠেছেন স্বয়ং বাবা মাহি সওয়ার। স্বপ্নে সেই সাদা দাড়ি গোঁফের প্রাচীন বৃদ্ধের বহুক্ষণ ঠোঁট নড়তে দেখা যায়। কিন্তু সে কি বলে তা’ শিরিন বানু শুনতে পায় না। বুঝি শুনতে পায় না বলেই তার মুখ হতে ‘আ-আ’ করে এক অস্ফুট, কাতর ধ্বনি বের হয়। পরক্ষণেই শিরিনবানু দ্যাখে সে যেন আর শিরিন বানু নেই। সে যেন এক বিয়ে বাড়িতে মেয়েলী গীতের সাথে নৃত্যরতা। পরক্ষনেই আবার তিনি যৌবনশালিনী ষোড়শী! রক্ত চেলি আবরণে বাসরঘরে কম্পমানা কিন্তু, বিয়ের শাড়ি আর সাজ মিলাতে না মিলাতেই শিরিন বানু নদীতে নৌকা করে যাচ্ছে। সে কি বাপের বাড়ি তবে নইওর যাচ্ছে? কিন্তু, তার নৌকায় সাদা চাদরে কে ঢাকা? নৌকায় আবার দ্যাখে শিরিন বানু বোরখা পড়া। তবে মুখের নেকাব খোলা। তার সামনের এই মুর্দা কে? দূরে কোথায় মনসা পূজায় পালা গানের ধুয়া…
“আস্তে ফ্যালো পাও বেহুলা, ধীরে ফ্যালো পাও গো!
ঐ বাসরে যেতে আমার মন যে কেমন করে গো!
আস্তে ফেললাম পাও গো সাধু ধীরে ফেললাম পাও!
ঐ বাসরে যাব না সাধু বলি যে আপনারে গো!
ঐ বাসরে যেতে আমার মন যে কেমন করে গো!
বাতাসে কুয়াশার স্বরের মতো মনসা গানের ধুয়ার আস্তর কেটে, সাদা দাড়ি আর চুলের বাবা মাহি সওয়ার আবার সরব হন, ‘একটু আগে তুমি নাচছিলে ক্যানো মা? বিবাহিতা নারীর আবিয়াতো নারীর মতো নাচ-গান, রহস্য-পরিহাস ঠিক নয়।’
‘বাবা-আমার খুব বিপদ-আমার স্বামী মারা গেছেন…’
‘শিরিন। অ শিরিন।’
নিগার বানুর ডাকে আর হাতের সজোর ধাক্কায় শিরিনের ঘুম ভাঙে।
‘পিঠা করিছি। তুই খাত্যে ভালোবাসিস। ওঠ, খাবি আয়।’
‘আমি এ কী দেক্যলাম বুবু?
শিরিন বানুর মূখে স্বপ্নের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে একটু ভড়কে গেলেও নিগার বানু উপরে হাসে,
‘তোর যে কত কুসংস্কার। ডেলিভারির টাইম কাছে তাই এত চিন্তা ধরিবার লাগিছে।’ বুবু এই মুহুর্তে কলিকাতার মানুষের মতো বা বইয়ের ভাষার মতো কথা বলে না, ‘জামাই নাই। কাল আবার বেহুলার মঠ দেক্যেছিস। দুনিয়ার পীর-সন্ন্যাসী, তাবিজ-কবচ, মনত…’
বুবু তাকে পিঠা খেতে দিয়ে নিজের ঘরে চলে যাবার কথা বলতে না বলতে সামনের আম গাছে দুটো কাক ডাকে।
‘আজ থাক্যো, বুবু। দুলা মিঞা আর তোমার ছেলেরাও আস্যুক। দোফর বেলা সবাই এক সাথে খানা খাই।’
নিগার বানু অমত করে না। সে মোবাইলে তার স্বামী ও ছেলেদের স্কুলে ছুটির পর এই বাসায় আসতে বলে। ঘরের রোয়াকে পিঠা খেতে খেতে আরো অলস ও সুখী একটি দিনের মন্থরতা যাপনে তারা দুই বোন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ঘোরায়, দুপুরের রান্নার পরিকল্পনা করে ও পরস্পরের চুলে নারকেল তেল ঘষাঘষি করে। হঠাৎই থমকে যায় নিগার বানু, ‘ইয়া আল্লা? ই সব কী দেকাচ্ছ্যে?’
‘কী বুবু?’
‘ও কী? নাকে রুমাল আর বি.ডি.আর-এর উর্দি পরা, হাতে বন্দুক সব কী করছ্যে? ও শিরিন, এদিকে আয়।’
পাঁচ
বাস দিনাজপুর পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা। নূরজাহান বেগম স্বামীকে একা দিনাজপুরে রেখে ঢাকায় চলে আসার আগে বড়ো ছেলের এক সহপাঠীর পরিবারের সাথে তাদের বেশ সখ্যতা হয়েছিল। মাসুদের বাবা দিনাপপুরের একটি বড়ো আবাসিক হোটেলের মালিক। তাদের বাসাতেই তিনি উঠবেন। নূরজাহান বেগমের স্বামী রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আসামী জেনেও তাদের আচরণে এতটুকু হেরফের হয়নি। ঢাকা সি.এম.এম কোর্টের পারমিশন নিয়ে গত সপ্তাহেই জেলারের কাছে গত কয়েক মাসের বেতনের অর্ধ্বেকটা অন্তত: পাবার আবেদন জানিয়েছেন। জেলার সেই আবেদন পত্রে সম্মতি স্বাক্ষর দিয়েছেন। এখন দিনাজপুর সোনালী ব্যাঙ্ক শাখায় ম্যানেজার বরাবর জেলারের স্বাক্ষরবাহী চিঠি জমা দিলে কাল সকালে তিনি বেতনের টাকা তুলতে পারবেন। বেতন অবশ্য এ ক’মাস ব্যাঙ্ক একাউন্টে অর্ধ্বেক হারে ঠিকই জমা হয়েছে। কিন্তু, টাকাটা তুলতে পারার জন্য জেলারের স্বাক্ষর দরকার ছিল। বাস-স্ট্যান্ডে নামতেই মাসুদ নিজেই গাড়ি নিয়ে হাজির।
‘চলেন খালাম্মা।’ মাসুদ নূরজাহানের লাগেজ হাতে নেয়।
রাতে খাওয়া-দাওয়া সরতে না সারতে দিনাজপুর ক্যান্টটমেন্টেরই এক হাবিলদারের ছেলে লেনিন ফোন করে।
‘আন্টি, আমি লেনিন।’
‘বলো বাবা।’
‘আন্টি, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই এক দিনাজপুর বি.ডি.আর. ক্যাম্পাস হতেই প্রায় ৩৩ জনের মতো বি.ডি.আর সৈন্য গ্রেপ্তার হয়েছে?’
‘জানি।’
‘যাদের ভাগ্য বেশি খারাপ তার টর্চার সয়ে ঢাকা জেলে বন্দী। অর্দ্ধেক এখন ঢাকা জেলে আর অর্দ্ধেক দিনাজপুর জেলে। এই যে দিনাজপুর বি.ডি. আর-এর তেত্রিশ জন সদস্য সরকারী কোয়ার্টারের জায়গা হারিয়ে না খেয়ে না পরে দিন কাটাচ্ছে, তারা আগামীকাল দুপুর বারোটায় একটা সাংবাদিক সম্মেলন করতে চায়। আপনি গত পরশু সকালে বিবিসি-তে ক্ষতিগ্রস্ত বি.ডি.আর. পরিবারগুলোর পক্ষে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন না?’
‘হ্যাঁ, তুমি শুনেছো?’
‘শুনবো না মানে? এটা শোনার পরই তো ঠিক করলাম যে আমরা এই সংবাদ সম্মেলনটি করবো। আর, আপনার ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম যে আপনি কবে দিনাজপুর আসবেন। কালকে সকালে আপনার ব্যাঙ্কের কাজ কখন শেষ হবে? তারপর কি আসবেন আমাদের প্রেস কনফারেন্সে? দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে হবে।’
‘আসবো বাবা, আমার আর কোন ক্ষতির পরোয়া নাই, মরলে সবাই একসাথে মরি। আমার ব্যাঙ্কের কাজ সকাল দশটার ভেতরই হয়ে যাবে। তোমার আব্বু কী ঢাকা না দিনাজপুর জেলে?
‘উনি দিনাজপুর জেলেই আছেন। উনিই আমাকে পরশুদিন জেলখানার দরজায় বললেন আপনার সাথে যোগাযোগ করতে। বললেন আপনি এখন আমাদের সব বি.ডি.আর. পরিবারের আশা ভরসা। তখনি প্রেস কনফারেন্সের আইডিয়াটা মাথায় এলো। আরো কয়েকটা ফ্যামিলি সদস্যদের সাথে আলাপ হলো। এখানে বি.ডি.আর. ক্যাম্পাস অফিসে লুকিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনি আসছেন।’
‘কিন্তু, প্রেস কনফারেন্স তো একটা প্রস্তুতির ব্যাপার। তোমাদের প্রস্তুতি কেমন?’
‘আমরা পোস্টার ব্যানার করেছি। একটা লিফলেটও লুকিয়ে ছেপেছি। পত্রিকায় সাংবাদিকদের সাথেও সব যোগাযোগ করেছি। আপনি তো বহুদিন দিনাজপুর থেকেছেন, প্রেস ক্লাব তো চেনেন? আসতে পারবেন না একা একাই দুপুর বারোটায়?’
‘খুব পারবো।’
ছয়
সারারাত ঘুমাতে পারেননি বিনোদ ভূষণ। এই বি.ডি.আর. ক্যাম্পাসের তিন আর্মি ভাবিই অর্থাৎ সেক্টর কমান্ডার, টু-আই-সি বা সেকেন্ড ইন কমান্ড আর অপস অফিসার বা অপারেশন অফিসারের স্ত্রীই গত রাতে তাকে মোবাইলে ফোন করে ‘কল’ বলে অনেক খোঁজ-খবর করেছেন। সম্ভবত স্বামীদের পরামর্শ মতোই এই ফোনগুলো তারা করেছেন। আনিসুর রহমানের স্ত্রী প্রায় বৃদ্ধা হলেও অপর দুই আর্মি তরুনী ও বেশ সুন্দরী। অন্য সময় এই আর্মি ভাবিরা পর্যন্ত তাদের বি.ডি.আর. অফিসারদের কি মানুষ মনে করে? আজ তাদের গলার স্বর সম্পূর্ণ আলাদা।
‘আর্মি-বি.ডি.আর. আমরা তো এতদিন ভাই ভাই-ই জানতান। আপনি আমাদের আপন বড়ো ভাইয়ের মতো।’
তা’ বৈকি। তার যা বয়স সন্তান হতে হতে অনেক দেরি না হলে এই দুই তরুণী তার মেয়ের বয়সীই হতো হয়তো! তাই কখন যেন তিনি একটু আর্দ্রও হলেন, ‘এসব ভাববেন না। আমি নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও আপনাদের রক্ষা করবো।’ ফোন রেখে ভেতরটা কেমন বিকল লাগলো।
তা’ ভোর রাতের পর একটু ঘুম আসছিল। তবু, নিয়ম মেনে সকাল সাতটা সোয়া সাতটার ভেতর উঠে পড়লেন। সকাল আটটায় কাঁটায় কাঁটায় অফিস কক্ষে ঢুকলেন। আজকের অফিস আর দশ দিনের অফিসের মতো হবে কি? আপাতঃদৃষ্টে সবাইকে শান্তই মনে হচ্ছে। সেক্টর কমান্ডার বা অধিনায়ক আনিসুর রহমান সকাল সাড়ে আটটায় সিগন্যাল সেন্টার ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আর মোবাইল যোগাযোগ খুলে দিলেন। সাথে সাথে রাজস্থলী ১১ নম্বর ব্যাটালিয়নের সাথে সেক্টর সদর রাঙামাটি সহ দেশের সব বি.ডি.আর. স্টেশনের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। এদিকে এই রাজস্থলী বি.ডি.আর. অফিসের পাশেই রাজস্থলী ডিগ্রী কলেজ। সকাল দশটায় সেখানে সেক্টর কমান্ডারের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান উদ্ধোধন করার কথা। কিন্তু, আনিসুর রহমান স্যার এখন বলছেন তিনি যাবেন না। বরং মেজর আরমান আর বিনোদ ভূষণ যেন তাঁর জায়গায় যান। তাই করলেন তাঁরা। পৌনে দশটায় অনুষ্ঠানে যাবার কিছু পরেই সাড়ে দশটার দিকে আনিসুর রহমানের ফোন। অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করে তাঁরা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন।
‘এসেছেন? শোনেন, খবর আছে। রাঙামাটি রিজিওন্যাল হেড কোয়ার্টার থেকে এইমাত্র অর্ডার এসেছে যে আমরা রাজস্থলীর সব আর্মি অফিসার ও তাদের পরিবার খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টে চলে যাব। আপনি দায়িত্বে থাকবেন। আমরা সবাই এখনি চলে যাবো।’
‘কি বলছেন স্যার? এটা কি করে সম্ভব? আমাদের এখানে তো কিছুই হয়নি স্যার। আপনি নিজেই দেখলেন। ভবিষ্যতেও কিছু হবে না।’
সুবেদার মেজর মোস্তাফিজও সেকথায় সায় দিলেন, ‘থাকেন স্যার, ভয় পেয়েন না। কাল মাথা গরম করে দু/চারটা ছেলে কি বলেছে, আমরাই ওদের সামলে রাখবো।’
‘হ্যাঁ, আমাদের ইউনিটে এমন হবে না স্যার। বিশ্বাস রাখেন আমাদের উপর।’
‘আমি বিশ্বাস করি বিনোদ। কিন্তু উপরের নির্দেশ যে আমাদের যেতে হবে। আরমান, আপনি ক্যাম্পাসের সব আর্মি অফিসার আর ভাবিদের বলেন এক কাপড়ে আর একটা হ্যান্ডব্যাগে যা যা ভরা যায় সব নিয়ে এখনি নেমে আসতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ি খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছতে পারে। বিনোদ, চলে যাবার আগে আপনাকে আমি কিছু ব্যাপারে ব্রিফিং দেব।’
সাত
‘শিরিন ঢাকা আস্যে গেচে।’
নিগার বানু শিরিন বাানুর কাঁধে খোঁচায়। সকালের আলো ফুটছে। বাস এখন গাবতলি টার্মিনালে। বাপকে জেলে নেবার এক মাস তিন সপ্তাহর মাথায় যে মেয়ে হলো। গেল এপ্রিলে পুরো নয়টা মাস মা’র রক্ত খেয়েছে। বোশেখের দুই তারিখে মেয়ে জন্মাবার পর দেখতে দেখতে আজ আশ্বিন মাস এসে গেল। রোজা গেল, চাঁন রাত আর ঈদ গেল। ঈদের দিন রাতেই তারা দুই বোন আর এই পাঁচ মাসের মেয়ে বাসে উঠে বসেছে। মানুষটা যে ঈদটা জেলখানায় কাটালো। তাদের বড়ো অফিসাররা যদি অস্ত্র হাতে ও এর সাথে মারামারি করে তার স্বামী সাধারণ জওয়ান। স্যারদের হুকুম মতো ডিউটিতে প্যারেড করতে নেমেছিল। তা’ না মানুষটা এখন জেল খাটছে। ঈদে দুই ছেলেকে এবার কাপড় দিতে পারে নাই। নিগার বানু আর তার স্বামীই তার ছেলেদের জামা দিয়েছে, তাকে শাড়ি দিয়েছে। একটা মাত্র ডি.পি.এস। ভেঙে গেল পাঁচ মাসে। এই বগুড়া-ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার-বগুড়া করতেই পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রায় শেষ। এক একবার জেলখানায় এসে দেখা করা, মানুষটার জন্য এটা ওটা ফলটা-মূলটা কেনা, বাস ভাড়ায় তিন হাজার টাকা শেষ হয়ে যায়। মার্চ-এপ্রিলে শিরিন বানুর এখন তখন অবস্থা। নিগার বানুর স্বামী তখন যাওয়া আসা করছে। সি.এম.এম. কোর্ট, উকিলের বাড়ি, জেলখানা। মে মাসের সাত তারিখেই শিরিন বানুর মাথায় বাই চাপলো। স্বামী তার মেয়ের মুখ দেখতে চাওয়াতেই না বাবা মাহি সওয়ারের থানে লাল সূতা বেঁধে বেঁধে শেষমেশ একটা মেয়ে হলো তাদের! এই মেয়েকে সে বাপের কাছে নিয়ে যাবে না?
‘বস্যা থাকলি যে? নাম।’ নিগার বানু আবার তাড়া দেয়।
তড়িঘড়ি শাড়ির ওপর আলাদা চাদরের ভেতর হাত দিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের মুখ স্তন বৃন্ত থেকে সরিয়ে শাড়ি ঠিক করে শিরিন বানু। তারপর চাদরটা আবার টেনে বড় বোনের পিছন পিছন নামে। এ.সি. বাসে অনেক ভাড়া। তাই এ.সি. বাসে ওঠে না তারা। শিরিন বানুর চাদর থাকলেও নিগার বানু চটপট মানুষ। বেয়াল্লিশেও সে কাটা কাটা সুন্দরী। পরিপাটি শাড়ির ওপর কোন বাড়তি চাদর নাই তার। গাবতলি টার্মিনালে নামতেই সকালের ঠান্ডা হওয়ায় শরীর জুড়ায়। একটা সি.এন.জি ডেকে জেলখানার সামনে আসতেই দেড়শো টাকা শেষ। জেলখানার ওয়েটিং রুমে তাদের মতোই আরো বেশ কিছু বি.ডি.আর. ফ্যামিলি এসেছে। বাথরুমের অবস্থা ঘিন ঘিন। তবু সেখানেই বাথরুম সারতে হয়। তারপর চোখে-মুখে পানি। নিগার ও শিরিন বানু দু’জনেই গড়পরতা বাঙালি মেয়েদের তুলনায় লম্বা, স্বাস্থ্যবতী ও ফর্সা। ফলে জেলখানার সেন্ট্রি, পাহারাদার অনেকেই হাঁ করে দ্যাখে তাদের। দুই বোন হাত মুখ ধোওয়া শেষ না করতেই কোলের মেয়েটা আবার স্তন্য পান করতে চায়। ওয়েটিং রুমের কাঠের বেঞ্চিতে বসে মেয়েকে স্তন্য পান করানোর জন্য ডান পা খানা ভাঁজ করে তুলতেই শিরিনের ফর্সা পায়ের গোড়ালি হতে আরো দু’ইঞ্চি উপরে সরে যায় কাপড়। সেদিকে তাকায় ওয়েটিং রুমের কোন কোন পুরুষ। শিরিন অবশ্য সেই দৃষ্টি অনুভব করতে পারে না। সে নিরাকার ও অচেনা -যেহেতু সে জানে অথবা জানে না যে সে নিজেই সেই তপ্ত হিম কাঞ্চনবর্ণা, সদা প্রসন্নময়ী, দিব্য জগজ্জননী কিনা। এদিকে দ্যাখো মেয়েকে স্তন্য পান শেষ করাতেই সকাল পৌনে আটটা বেজে যায়। আর বেলা সাড়ে বারোটায় স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ। আশেপাশে কোথাও নাস্তা করেই সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে ওয়েটিং রুমের সামনের টেবিলে জমা দিতে হবে। এই নাজিমুদ্দিন রোডের জেলখানার পাশেই দু/একটি দোকান আছে। শিরিন আর নিগার বানু মেয়েকে সহ একটা দোকানে গিয়ে পরোটা, ভাজি আর চায়ের অর্ডার দেয়। জীবনকে সেই মূহুর্তে তাদের এমনকি সুখকরও মনে হয়।
‘তোমরা কি মা বি.ডি.আর. ফ্যামিলি?’
এক বয়স্কা মহিলা আর পাশে এক কিশোর ছেলে তাদের টেবিলের ঠিক মুখোমুখি বসেছে।
‘জ্বি, আপনারা?’
‘আমরাও বি.ডি.আর.। আমার দেশ গোপালগঞ্জ। তোমাগের?’
‘বগুড়া।’
‘আপনার কে আছে জেলখানায়?’
‘আমার বড়ো ছেলে। আমার স্বামী বেঁচে নাই। বড়ো ছেলের উপরিই ছোটো ভাই-বুনগুলোর নেকাপড়ার খরচ ছেলো। তা’ সে তো এখন হাতকড়া বান্ধা। তা’ পেপারে তো দিছে কোর্ট মার্শাল হবি না । কিন্তু, বি.ডি.আর. আইনে বিচারই কি ভালো হলো? তাতেও তো ম্যালা রিস্ক। যদি সাধারণ আইনে বিচার হতি পারতো।’
‘আপনারা কি বেতন পাচ্ছেন?’ শিরিন বানু পিরিচে চা ঢেলে চুমুক দিতে গিয়ে হঠাৎই সতর্ক গলায় জিজ্ঞাসা করে যেন বা এইমাত্র খুব কিছু তার মনে পড়ে গেল।
‘না। অর্দ্ধেক বেতন দিবার কথা! তা-ও দিতিছে না।’
শিরিন বানুর বুক হতে বাতাস ঠেলে বেরিয়ে আসে, ‘আমরাও পাছো না। ঈদের বোনাসও না। কিন্তু, আর্মির বউ-বেটিরা সব বাইশ লাখ, পনেরো লাখ টাকা পাছ্যে যে। উরা যে পাছ্যে।’
বোরখা পরা কিন্তু নেকাব খোলা আর একটি অল্প বয়সী মেয়ে এসে বসে তাদের টেবিলে। এই মেয়েটির সাথে কেউই নেই। ভারি রুগ্ন আর শ্যামলা। যেন অঘ্রানের হিম ঠান্ডা লেগে যাওয়া একটা শালিক পাখি।
‘তুমি…আপনি কি একাই আসিছো?’ বয়স্কা মহিলা জিজ্ঞাসা করেন।
‘হ্যাঁ। এই ঘটনার পর বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি সবার কাছ হতে একঘরে হয়ে আচি।’
‘দেশ কই?’
‘কুষ্টে।’
‘ছেলে-মেয়ে আছে?’
‘না…. তিন মাস বিয়ি হয়িচি আমার।’
‘কোর্ট মার্শাল দিলি ত’ সব গুলি খায়ে শেষ হয়ি যাতো…তা’ হবে নানে…কিন্তু বি.ডি.আর. আইনেই বা কী হবি?’
প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাছ্যে। বত্রিশ জন নতুন রিমান্ডে নিছ্যেও নাকি। সবচেয়ে বেশি ভয় নাকি ২৪ ব্যাটালিয়ন আর ৪৪ ব্যাটালিয়নের সদস্যদের।’ শিরিন বানু বলে।
‘বড়ো সুন্দরী মেয়ে তুমি। তোমার স্বামীকে রিমান্ডে নেয় নাই তো?’
‘নিছ্যে না?’ শিরিন বানু নাশতা শেষে মেয়েকে কোলে দোলাতে দোলাতে হাসে, ‘টানা একত্রিশ দিন টর্চার । আঙুল আর হাতের কনুইয়ের গিটে গিটে মার। বেহুঁশ হবার নাগিছে তো স্যালাইন পুশ করে হুঁশ ফিরায়ে আবার মারেছ্যে।’
‘আমার ছল অবশ্য সাত দিন সইছে।’
‘আমার স্বামী চোদ্দ দিন।’ রুগ্ন শালিক বলে।
শিরিন বানু যেহেতু তিনি নিরাকার ও অচেতন সদা হিম কাঞ্চনবর্ণ গৌরী, প্রসন্নময়ী সাক্ষাৎ জগজ্জননী। এ সকল আলাপের ভেতরই হঠাৎ মেয়েকে কোলে দোলাতে দোলাতে কৌতুক হাসেন তার মনে পড়ে স্বামীকে জেলে নেবার দেড় মাসের মাথায় ভূমিষ্ঠ এই কন্যাই তার তিন সন্তানের ভেতর পৃথিবীতে আসার সময় তাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। শিরিন বানু যার ঊনচল্লিশেও সহজ ও স্বাভাবিক প্রসব হয়।শুধু প্রসব দ্বারে কয়েকটা সেলাই… ক্ষুদ্ধ শিশু কন্যার মাতৃ জরায়ুতে মুহুর্মুহু পদবিক্ষেপ। এই কন্যা বাবা মাহি সওয়ারের আশীর্বাদ পুতঃ যিনি কালে কালে বেহুলার মত সতী হইবেন…।
ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে। সাড়ে বারোটা বাজে।
‘বি.ডি.আর ফ্যামিলি যত আছেন, সব ভেতরে চলেন। পরিবারের সাথে দেখা করার সময় আর পাবেন না।’
আট
দায়িত্ব হস্তান্তর/গ্রহণ গোলাবারুদ
৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন, দিনাজপুর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ নং স্মারকের আলোকে ৩৬, রাইফেল ব্যাটালিয়ন, দিনাজপুরের বিদ্যমান নিম্ন বর্ণিত গোলাবারুদগুলো আরডিও -১৮২ উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক, দিনাজপুর ও জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ, দিনাজপুর-এর মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর/গ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হইলো:
ক্রমিক নং
গোলাবারুদের প্রকার
ব্যাটালিয়ন ম্যাগাজিনে অস্ত্র সহ রক্ষিত গোলাবারুদের সংখ্যা
১।
কার্তুজ এস.এ. ৭.৬২X২৫ মি,মি. বল
পিস্তল চীনা
২০৪টি
২।
কার্তুজ এস.এ. ৭.৬২X৩১ মি,মি. বল
পিস্তল চীনা
১,০০,১৬ টি
৩।
কার্তুজ এস.এ. ৭.৬২X৩৯ মি,মি. বল
পিস্তল চীনা
৪২,০১৫ টি
৪।
কার্তুজ এস.এ. ৭.৬২X৩৯ মি,মি. বল পিস্তল চীনা
৪২, ২২৬টি
৫।
কার্তুজ এস.এ. ৭.৬২X৫৪ মি,মি. বল
পিস্তল চীনা
২,১৭১টি
৬।
কার্তুজ কিউ.এফ. ৭৫ মি.মি. আর আর
০৭টি
৭।
গ্রেনেড হ্যান্ড আর্জেজ ৮৪ এইচ.ই কমপ্লিট
৭৫১ টি
৮।
রকেট ৪০ মি.মি. এইচ.ই. এটি টাইপ-৬১
১২টি
৯।
৬০ মি.মি. মর্টার এইচ.ই.
২৭০টি
১০।
বম্বস্ এম.এল. ৮২ মি.মি. মটার এইচ.ই.
০১টি
১১।
গ্রেনেড হ্যান্ড আর্জেজ ৭২/৯১
(প্রাকটিস বডি)
৬৬টি
১২।
ফিউজ ফর গ্রেনেড হ্যান্ড আর্জেজ ৭২/৯১
১১৭টি
১৩।
ড্রিল কার্তুজ ফর রাইফেল/এস.এম.জি./
এল. এম.জি
১২৫টি
১৪।
সেকসনালাইজড কাটমডেল ফর গ্রেনেড হ্যান্ড আর্জেজ-৮৪
০১টি
১৫।
কার্তুজ ফর রাইফেল/এস.এম.জি./
এল.এম.জি.
১,২৫৩টি
১৬।
প্রাকটিস মর্টার সেল ৮২ মি.মি.
মর্টার এম. ৬২
১৫টি
১৭।
প্রাকটিস মর্টার প্রজেকটাইল ৮২ মি.মি.
মর্টার
১৮টি
১৮।
প্রাকটিস মর্টার সেট অফ কম্পোনেন্টস ৮২
মি.মি. মর্টার এম.-৬২
৭৫টি
১৯।
মিম ফায়ার গোলাবারুদ পিস্তল চীনা
০৩টি
হস্তান্তরকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর:
আর.ডি.ও-১৮২ ডি.এ.ডি.
মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম
উপ-সহকারী পরিচালক
৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়ন,
দিনাজপুর
তারিখ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ গ্রহণকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর
১। জেলা প্রশাসক, দিনাজপুর
তারিখ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯
২। ভারপ্রাপ্ত, পুলিশ সুপার।
দিনাজপুর।
ফেব্রুয়ারি ২০০৯
দিনাজপুর জেলা অধিক্ষেত্রে অত্র এলাকার বাহিরে ৩৬, দিনাজপুর ব্যাটালিয়ন, দিনাজপুরে কোন অস্ত্র বা গোলাবারুদ নেই বা কারও হাতেও কোন অস্ত্র বা গোলাবারুদ নেই।
‘আপনার হাসব্যান্ড নিজেই বোধ করি মনে মনে জানতেন যে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। যে কারনেই নিজ হাতে অস্ত্র জমা দেবার কাগজের এই কপিটা তিনি আপনার কাছে দেবার জন্য এ্যারেস্ট হবার আগেই আমাকে দিয়ে দেন। এই কাগজটাই কোর্টে আপনার স্বামীকে বাঁচাবে। এই কাগজটাই প্রমাণ করছে সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে যে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি তিনি তারঁ অধীনস্থ বি.ডি.আর. সৈন্যদের উত্তেজিত করে অস্ত্রাগার লুট করিয়ে বিদ্রোহের চেষ্টা করেছেন। আসলে উনি বরং সব অস্ত্র দিনাজপুর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে জমা দিয়েছেন। এমন কি সেনা আইনেও যদি বিচার হতো! এই কাগজ কোর্ট মার্শালও ঠেকিয়ে দিতে পারত…অবশ্য কোর্ট মার্শালের ক্ষেত্রে কোন কাগজ দেখার চেষ্টা করে না ওরা, জাস্ট ঝুলায় দেয়।’ এডভোকেট সানাউল্লাহ খান একটা সিগারেট ধরান।
‘আচ্ছা, রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্টে রেফারেন্স চেয়ে পাঠানোর পর এই এমিরাস কিউরিরা মিলে যেটা ঠিক করলো যে বি.ডি.আর. আইনে বিচার হতে পারে… এটা সেনা আইনে বিচারের চেয়ে ভালো হলেও বি.ডি.আর. আইনে বিচারও কি শেষ পর্যন্ত ভালো হলো? না মন্দের ভালো?’
‘মন্দের ভালো।’ এটুকু বলে সানাউল্লাহ খান সিগারেটের ছাই ছাইদানিতে ফেলেন।
‘সাধারণ আইনে বিচার করা যায় না?’
‘অবশ্যই যায়। আপা, একটা কাজ করেন না কেন? আপনি বাংলাদেশের গ্রেপ্তার হওয়া বি.ডি.আর. সদস্যদের পরিবারগুলোর পক্ষে হাইকোর্টে একটা রিট পিটিশন করেন।’
‘আমি আর কত কালার্ড হবো?’
‘কালার্ড হবার কি কোন বাকি আছে? যুদ্ধে যখন নেমেছেন, যুদ্ধটা করেন না।’
‘সেটা অবশ্য ঠিক কথাই। কিন্তু, আমি রিট পিটিশন করে লাভ?’
‘লাভ এটাই যে আপনার রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে দেশের জাঁদরেল আইনজীবী হতে শুরু করে আমার মতো পুঁচকে আইনজীবী, মানবাধিকার সংস্থাগুলো চেষ্টা করবে সাধারণ আইনে বিচারের দাবিতে আওয়াজ তোলার। এনিওয়ে, দিনাজপুরে আপনার হাসব্যান্ডের স্যালারি তুলতে যাবার সময় যে প্রেস ব্রিফিংটা ওখানে করার কথা ছিল, তা’ তো করতে পারেননি? আর্মি কি সবকিছু ক্যান্সেল করেছে?
‘হ্যাঁ, আমাকে অর্গ্যানাইজার যে ছেলেটা-লেনিন-সে-ই পরে সকাল এগারোটার দিকে ফোন করে বলেছে পালাতে। আর্মি কিভাবে সব খোঁজ নিয়ে যে ছাপাখানায় পোস্টার, লিফলেটগুলো ছিল-সেই ছাপাখানায় হামলা করেছে। ধর-পাকড়ও করেছে কিছু। লেনিন অবশ্য পালাতে পেরেছে। ও ঘোড়াশালে ওর মামাবাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। ওর বাবা ত’ দিনাজপুর জেলে।’
নয়
সেক্টর কমান্ডারের ঘরে বসে ব্রিফিং লিখতে থাকার সময়েই অন ডিউটি সিগন্যাল অপারেটর বিনোদ ভূষনকে মেসেজ দিল, ‘রাঙামাটি সেক্টরের ডি.কিউ. (ডিভিশনাল কোয়ার্টার) অফিসার আপনার সাথে কথা বলতে চায়।’
বিনোদ ভূষণের হয়ে আনিসুর রহমান ফোন ধরলেন, ‘ডি.এ.ডি. সাহেব পরে কথা বলবেন। ওনাকে বলো যে বিনোদ এখন আমার সাথে কথা বলছেন।’
একটু পর সিগন্যাল অপারেটর নায়েক কবির আবার ফোন দিল, ‘ডি.কিউ. স্যার আপনার সাথে কথা বলবেন। ডি.এ.ই. স্যার! চারপাশ থেকে গুজব আসছে যে আর্মি নাকি আমাদের বিভিন্ন সেক্টর আর ব্যাটালিয়ন দখল করতে আসছে। চিটাগাংয়ে বায়তুল ইজ্জত সহ অনেকগুলো বি.ডি.আর. ইউনিটে নাকি ফায়ারিং শুরু হয়েছে। স্যার, আপনি ডিকিউয়ের সাথে কথা বলেন।’
এরই ভেতর হাবিলদার মেজর আওরঙ্গজেব রুমে ঢুকে পড়লো, ‘স্যার, ক্যাম্পাসের মসজিদে কোয়ার্টার গার্ডের সামনে সৈন্যরা সব জড়ো হইছে। সবাই খুব উত্তেজিত। আপনি ওদের সাথে কথা বলেন।’
আনিসুর রহমানও একটু বুঝি নার্ভাস হলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি তাহলে ডি.কিউ.-এর সাথে কথা বলে আর সৈনিকদের সাথে দেখা করেই আসেন।’
‘জ্বি। আপনি কোন চিন্তা করেন না, স্যার।’
‘একটু দাঁড়ান।’
আনিসুর রহমান ফ্যাকাশে মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিনোদ ভূষণ বুঝলেন। সেনা অধিনায়ক গরীব বি.ডি.আর. জওয়ানদের হাতে মৃত্যু ভয়ে ভীত।
‘স্যার। গরীবের উপর বিশ্বাস রাখেন। আমার শরীরের এক বিন্দু রক্ত থাকতে…আমার লাশ না পড়া পর্যন্ত আপনাকে আমি রক্ষা করবো। আপনি আমার সিনিয়র।’
বিনোদ ভূষণ বারান্দায় বের হতেই আওরঙ্গজেব পিছু পিছু ছুটে এলা। ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলো, ‘এইটা ধনী গরীবের লড়াই স্যার। জালেম আর মজলুমের লড়াই। আপনি কমান্ডার আনিস স্যারের কাছ থেকে কোত আর ম্যাগাজিনের চাবি নিয়া নিজের মুঠোয় রাখেন। নইলে বাইরে থেকে আর্মি মার্চ কইরা এইখানে আসলেই আমাদের ব্রাশ ফায়ার কইরা ঝাঁজরা কইরা দেবে। আপনি নিজেও ত’ বি.ডি.আর., স্যার।’
এ কথার কোন উত্তর না করেই তিনি সিগন্যাল সেন্টারে গেলেন।
রাঙামাটির ডি.কিউ অফিসার টেলিফোন লাইনে, ‘বি.ডি.আর-এর বিভিন্ন সেক্টর আর ব্যাটালিয়নে তো হাঙ্গামার খবর শোনা যাচ্ছে। আপনার ইউনিটের খবর কী?’
‘আমাদের ব্যাটালিয়ন ঠিক আছে। এখানে কোন গন্ডগোল নাই। আর্মি অফিসাররাও নিরাপদ রয়েছে।’
‘সতর্ক থাকেন। লোকজনকে কন্ট্রোলে রাখেন।’
দশ
তথ্যদাতা: রেহানা আক্তার (বয়স:২৪)
ভিকটিমের সাথে সম্পর্ক: বোন
ভিকটিম: মোঃ আওলাদ হোসেন,
প্রযত্নে: ইলিয়াস আলী (অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার)
৪০/৭, মনেশ্বর রোড,
হাজারীবাগ, ঢাকা-১২০৯।
কোচিং সেন্টারের নাম ও ঠিকানা:
আলফা সেন্টার
৪০/৭, মনেশ্বর রোড,
হাজারীবাগ, ঢাকা-১২০৯।
ভিকটিম মোঃ আওলাদ হোসেন একজন সিভিলিয়ান বা বেসামরিক ব্যক্তি এবং অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মোঃ ইলিয়াস আলীর ছেলে। বাবা ইলিয়াস আলী পটুয়াখালি থাকেন। বাবা মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা।
মা: রওশন বেগম,
স্ত্রী: ফাতেমা সুলতানা আলো।
‘গত ০৫ মার্চ ২০০৯ বিকাল ৪টায় একটা পাজেরো গাড়ীতে সিভিল পোশাকে ৪ জন লোক এসে আমার ভাইকে কোচিং সেন্টার থেকে নিয়ে যায়। ভাইকে নিয়ে যাওয়ার ০৩দিন পর র্যাব রাত ২ টায় কোচিং সেন্টারে তল্লাশি করে কম্পিউটার নিয়ে যায়।
০৫ মার্চ ভাইকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা বুঝতে পারি নাই কারা নিয়ে যাচ্ছে। আমার মা আর কোচিং সেন্টার অফিসের ম্যানেজার ইকবালের সামনে দিয়ে দিয়ে যায়। মা ৪ তলা থেকে দেখেছে ভাইকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
৫ দিন নিখোঁজ ছিলো। আমরা অনেক খুঁজেছি। পাই নাই। ২ দিন পরে অর্থাৎ ০৮ মার্চ ২০০৯ তারিখে হাজারীবাগ থানায় জি.ডি. করার জন্য গেলেও থানা জি.ডি. গ্রহণ করে নাই। পুলিশ বলে এটা মামলা হয়, জি.ডি. হয় না। তখন আমরা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সে কারণে মামলা কিংবা জি.ডি. কোনটাই করা হয় নাই।
৫ দিন পরে অর্থাৎ ১০/০৩/০৯ তারিখে থানার এক লোক (নাম সম্ভবত মামুন) আমাকে ফোন করে বলে আপনার ভাইকে হাজারীবাগ থানায় আনা হয়েছে। এরপর সঙ্গে সঙ্গে আমি, আমার ভাবী ও আমার পরিচিতি এক মহিলা থানায় যাই। থানায় গিয়ে দেখা করতে চাইলেও প্রথমে পারি নাই। পরে পুলিশকে অনুরোধ করার পরে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর দেখা করতে দিয়েছে।
ভাবী সন্তানসম্ভবা ছিলো। ভাবীকে ভাই বলে নাই যে তাকে টর্চার করা হয়েছে। শুধু বলেছে যে সে ভালোই আছে। আমাকে অবশ্য লুকিয়ে বলেছে যে সে মরণের হাত থেকে ফিরে এসেছে। দেখলাম ভাইয়ের হাতে আঘাতের চিহ্ন, মুখের ঠোঁটে কাটা দাগ ছিলো। ৫ দিনে একেবারে শুকিয়ে গেছে।
পুলিশ আমার ভাইয়ের মোবাইল, মানিব্যাগ আর বেল্ট আমাদের দিয়ে দিয়েছে সেদিন। আমি দেখেছি আমার ভাই সেদিন যে কাপড় পড়া ছিলো ঐদিনও একই কাপড় পরা ছিলো। আমার ভাবীর বাচ্চা হয়েছে। একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। আমার মায়ের হার্টের অসুখ। আমার ভাইয়ের মোবাইলে অনেক বি.ডি.আর. সদস্যের নাম্বার ছিলো। কারণ বি.ডি.আর. সদস্যদের ছেলেমেয়েরাই মূলত আমাদের কোচিং সেন্টারে পড়তো।
০১ মে শুক্রবার আবেদন করে জেল গেটে ভাইয়ের সাথে আমি ভাবী সহ দেখা করেছি। আমার ভাই শুধু বলেছে আমার জন্য দোয়া করো। আমাদের কোচিং সেন্টারে মিউটিনির আগে বিদ্রোহী বি.ডি.আর. সদস্যদের মিটিং করার যে কথা পত্রিকায় দেখেছি সেটা সত্য নয়। আমাদের ম্যানেজার ইকবাল কোচিং সেন্টারে থাকে। সেও বলেছে তার জানা মতে এখানে কোনও মিটিং হয় নাই।আমার বাবা রিটায়ার করার পর হাজারীবাগ এলাকায় একটি মুদিখানার দোকান করেছিলেন। কিন্তু, দোকানে লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছিলো বেশি। সে কারণে দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এরপর বাবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। সেখানে অবসর জীবন যাপন করছে। বাবা, মা ও ছোটো ভাই জুয়েল সেখানে থাকে। আমি ও আমার ছোটো বোন চামেলী আক্তার আমার ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকি। আমি ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স পাস করেছি। ছোটো বোন ম্যানেজমেন্টে অনার্স ১ম বর্ষে পড়ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। আমার ভাই বি.এস.সি. পাস। আমার ভাইকে মোট ৪ বার রিমান্ডে নিয়েছে। প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। এখন মূল মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মূল মামলায় গ্রেফতার দেকানোর পর ০৭ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।
আগামী ১১ মে ২০০৯ তারিখে মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সেদিন আমাদের পক্ষের আইনজীবী কোর্টে দাঁড়াবে। এখনো পর্যন্ত আইনজীবীকে ৭,০০০/- টাকা দেওয়া হয়েছে। আমাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই এভাবে টাকা দেওয়ার। কারণ ভাই ছিলো সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার অনুপস্থিতিতে কোচিং সেন্টারটি কোনওরকমে আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। অভিভাবকেরা পত্রিকায় কোচিং সেন্টারের নাম দেখে আতঙ্কিত হয়ে শিশুদের নিয়ে অন্য কোচিং-এ ভর্তি করাচ্ছে। সে কারনে আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। যে কোনও মূহুর্তে কোর্চি সেন্টারটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন আমাদের ঢাকায় থাকার সঙ্গতি থাকবে না।
র্যাবের কাছে কম্পিউটারটি রয়েছে। আমাদের কম্পিউটারটি দরকার। কিভাবে কম্পিউটারটি ফেরত পাওয়া যাবে বুঝতে পারছি না। ‘মানব উন্নয়ন সংস্থার’র নিকট আমার নিরাপরাধ ভাইকে এভাবে আটক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় জড়ানোর বিষয়ে আইনগত সহায়তা কামনা করছি।’
তথ্য সংগ্রহ তথ্য সংগ্রহের তারিখ: ০৫/০৫/২০০৯
সিকান্দার বখত। সময়: সকাল ১১টা ১৫ মিনিট,
স্থান: মানব উন্নয়ন সংস্থা।
এগারো
‘…পুড়–ন কাথা ইদাত তুলি ওজুরি ওজুরি কাণের লই
আরে নাদিন তম্ববি, তুল্লিয়া সাঙ্গু পারিয়া দিলে কার লাগি?’ আশ্চর্য তো! হাবিলদার মেজর আওরঙ্গজেব, সুবেদার সারোয়ার কি হাবিলদার মমিন মিলে সেক্টর কমান্ডার আনিসুর রহমানের কাছ হতে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে চাবি কেড়ে আনছে, কোয়ার্টার গার্ডের সামনে জওয়ানরা ক্ষোভে চিৎকার করছে আর বিনোধ ভূষনের কিনা এই ভয়ঙ্কর মূহুর্তে মনে পড়ছে চাকমা বিয়ে বাড়িতে শোনা উভা-গীত বা প্রেমের গান? লো প্রেশারে মাথা ঘুরতে শুরু করলেই তার এইসব অদ্ভুত ফিলিংস হয়।
‘তম্ববি ছড়া ইজে ইঝাই মাঝে এক কুড়–ম
তম্ববিরে দোলদোল কান্দে পুনে মধ্যে এক সুড়’…
‘স্যার, এই নেন চাবি।’
‘কিসের চাবি?’
‘ম্যাগাজিনের চাবি। বি.ডি.আর. এর অস্ত্রের মালিক বি.ডি.আর। আপনি যখন সিগন্যাল সেন্টারে কথা বলছিলেন, আমরা সেক্টর কমান্ডারের কাছে হতে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে চাবি নিয়ে আসছি। নইলে আর্মি আমাদের ঘেরাও করতে আসতেছে, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। অনুমতি দেন স্যার। আমরা এখনি ম্যাগাজিন ভাইঙ্গা অস্ত্র হাতে নেব। না হলে সব মারা পড়বো।’ ‘উফ্। কে তোমাদের এসব করতে বললো? চাবি কমান্ডারকে ফেরত দিয়ে আসো।’ ‘আল্লার নামে এই হুকুম দেবেন না স্যার। ভালো হবে না। চাবি বরং আমরা আপনার হাতে দেব। তবু, আর্মির হাতে দেব না।’
হাবিলদার মেজর আওরঙ্গজেব বিনোদ ভূষণের হাতে চাবি তুলে দেন। ‘ঠিক আছে। ঠিক আছে। তোমরা শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না। কোন ভয় নাই।’ সুবেদার সারোয়ারও বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার বলছেন আমাদের শান্ত হতে। সবাই শান্ত হও।’ ‘ইয়া আলী। আমাদের ম্যাগজিন খুলে দেন।’ ‘আর্মি যদি সত্যি আমাদের আক্রমণ করতে আসে, তখন আমিই তোমাদের বলবো পাল্টা আক্রমণ করতে। এখন শান্ত হও।’ ‘আর্মি যখন আসবে, তখন আর সময় পাবেন না স্যার। ততক্ষণে আমরা সবাই ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে যাব। ’জওয়ানরা ঘিরে ধরে তাকে। দিশেহারা লাগে বিনোদ ভূষণের। তিনি কার? কাকে রক্ষা করবেন? বি.ডি.আর না আর্মি?
সুবেদার মেজর মোস্তাফিজের হাতে তিনি চাবি তুলে দেন।
‘একটু দ্যাখো যেন কেউ ম্যাগাজিন না খোলে। আমি স্যারদের বিদায় দিয়ে আসি।’
চার/চারজন সেনা অফিসার ও তাদের স্ত্রীরা দু’টো পাজেরো গাড়িতে ততক্ষণে উঠে পড়েছেন। বিনোদ ভূষণ তাদের স্যালুট দিলেন। হ্যান্ড মাইকে রিভার ঘাট ও ট্রেনিং ক্যাম্পকে বলেন পথে যেন এই সেনা অফিসার ও তাদের পরিবার বর্গকে কোন বাধার মুখোমুখি না হতে হয়।
বারো
স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ
দক্ষ সামরিক কৌশল প্রণেতা হিসেবে স্পার্টাকাসের সুনাম থাকলেও তার বাহিনীর অধিকাংশ সৈনাই ছিল সমরজ্ঞানহীন ক্রীতদাস। এই বিদ্রোহীদের নিয়ে স্পার্টাকাস ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির উপর কালদেরা অরণ্যের সুপ্ত বনানীতে প্রশিক্ষণ চালাতেন। এবং এভাবেই তারা রোকমদের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে।স্পার্টাকসের কাছে গ্রোবারের যুদ্ধে পতনের পর, প্রেটর পুন্নিয়াস ভারিনিয়াসের নেতৃত্বে প্রায় ৪,০০০ রোমক সৈন্য মোতায়েন করা হয় যাতে তারা দাস বিদ্রোহীদের দমন করতে পারে। ভারিনিয়াসের বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ল্যুসিয়াস ফুরিয়াসকে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে ২,০০০ সৈন্যের একটি অগ্রগামী বাহিনী যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। ভিসুভিয়াস ছেড়ে আরো অগ্রসর হবার পথে কসিনিয়াসের হারকিউলেনিয়ামের নিকট স্পার্টাকাস রোকমদের আর একটি বাহিনী খুঁজে পান। আরো দক্ষিণে ল্যুসানিয়ার কাছে বিদ্রোহীরা ভারিনিয়াসের ৪,০০০ সৈন্যকে মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
বসন্তকাল নাগাদ বিদ্রোহীরা উত্তরে গল প্রদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হলো এবং ক্যাম্পেনিয়ার কাছে গাইয়াস থোরোনিয়াসের আওতায় রোমকদের আর একটি বাহিনীকে পরাজিত করে। স্পার্টাকাস উত্তরে আরো অভিযান চালাতে চাইল। কিন্তু, তাঁর সাথি ক্রিক্সাস খোদ রোম আক্রমণ করতে চাইলো ও ত্রিশ হাজার বিদ্রোহীকে নিয়ে আপুলিয়া অঞ্চলে গেল। অবশেষে এই দাস বিদ্রোহ দমন করতে রোমক কনসাল ল্যুসিয়াস গেল্লিয়াস পুবিকোলা ও নস নেলিয়াস লেন্টুলাস ক্লোডিওনাস স্পেন, গল ও জার্মানী হতে চায় বাহিনী সৈন্য মোতায়েন করে বিদ্রোহীদের দমন করলো। এই চার বাহিনী সৈন্যের ভেতর দুই বাহিনী সৈন্য উত্তরে স্পার্টাকাসকে অবরোধ করে। লেন্টুলাস ছিলেন এই দুই বাহিনীর নেতা। অপর দুই বাহিনী প্রেটর কুইন্টাস আরিয়াসের নেতৃত্বে আপুলিয়ায় ক্রিক্সাসকে হত্যা করে। বাকি দুই বাহিনী স্পার্টকাসের পিছনে ধাওয়া করে।
সজল ঘুমিয়ে পড়েছে। কি মায়াবি আর নিষ্পাপ মুখ। নূরজাহান বেগম আস্তে করে সজলের মাথার বালিশ ঠিক করে দেন। তাঁর ছেলে-মেয়েদের ভেতর সবচেয়ে মেধাবি এই ছোটো ছেলে। ছোটোবেলা থেকেই সজলের খুব লেখক হবার স্বপ্ন। ভাবা যায় চোদ্দ বছরের ছেলে ডায়েরিতে স্পার্টাকাসের ইতিহাস তুলে রাখছে? তা-ও নূরজাহান বেগমের পয়সা বাঁচাতে যেন ফটোকপি করতে না হয়? সজল কি জানে রিমান্ডে তার বাবার পেনিসে সই ফোটানো হয়েছে? মলদ্বারে ইলেকট্রিক শক? একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছেন নূরজাহান বেগম। কিন্তু চাকরিটাতে তিনি জয়েন করতে পারবেন না। বি.ডি.আর. সৈন্যদের জন্য সাধারণ আইনে বিচার চেয়ে রিট পিটিশন করতে হবে। সামনে মামলার জন্য ম্যালা দৌড়াদৌড়ি। দেশের বাড়ির কয়েক বিঘা জমি গোপনে ইতিমধ্যেই তাকে বিক্রি করতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের না জানিয়েই এটা তাকে করতে হয়েছে।
পিঙ্কির বিয়ের কথা চলছিল। আপাতত সব বাদ। ‘কুমুদিনী’তে সেলস গার্লের কাজে মাসান্তে কিছু পয়সা তো পাচ্ছে। বড়ো নিদারুণ একটা ঈদ গেল। ছেলে-মেয়েরাও কিছু খেতে চায়নি। বড়ো ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটা বাজে। ঘুম হয় না আজকাল। এই এক রোগ হয়েছে নতুন। অনিদ্রার। ভোর রাতের দিকে একটু ঘুম আসে। তখন ভারি অবাক করা সব স্বপ্ন আসে। মৃত বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজন সবাইকে স্বপ্নে দ্যাখেন। মানুষটার কি ফাঁসি হবে? ফাঁসি হয়তো হবে না। কিন্তু, জেল হবে। অন্তত আট/দশ বছরের জেল। সাঁইত্রিশ বছরের চাকরির পর আর বড়োজোর চার-পাঁচ বছর পরই রিটায়ারমেন্ট হতো। কিন্তু, পেনশনের টাকা হয়তো একটাও পাবেন না। শেষবয়সে বুড়ো-বুড়ি কী করবেন? চির জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে ফিরবে কি মানুষটা? হ্যাঁচ করে ড্রয়ারটি খুললেন। স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট, বিভিন্ন প্রমোশনের কাগজ-পত্রের ফাইল। জওয়ানের আবার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট? এই সার্টিফিকেট কি সত্য? তার স্বামী কি স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার আবদান চির উজ্জ্বল হয়ে রইবে?
তেরো
১৩, বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
রাঙামাটি।
বিষয়: নালিশী দরখাস্ত।
ঘটনাস্থল: ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়ন, রাজস্থলী, রাঙামাটি।
ঘটনার সময় ও তারিখ : ২৬ ফেব্রæয়ারি ২০০৯ সকাল : ১০:৩০ ঘটিকা।
আসামীর নাম : (১) সুবেদার সারোয়ার, (২) নায়েক (সিগন্যাল) কবির, (৩) নায়েক (সিগন্যাল) গণেশ, (৪) ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণ, (৫) হাবিলদার কামাল, (৬) ল্যান্স নায়েক (ড্রাইভার) অমল, (৭) সুবেদার আকবর, (৮) সায়েখ মামুন, (৯) হাবিলদার মমিন, (১০) নায়েক সুবেদার আবুল, (১১) জে.সি.ও সহকারী আনোয়ার সহ আরো অনেকে। ধারা: ১২০-বি/১২১/১২-১-এ দন্ডবিধি।
জনাব,
বিনীত নিবেদন এই যে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানা, ঢাকার বি.ডি.আর. সদর দপ্তর, বি.ডি.আর. বিদ্রোহের জের ধরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে আনুমানিক ১০:২০ ঘটিকায় কতিপয় উচ্ছৃংখল সৈনিক বিদ্রোহী হয়ে উর্দ্ভতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যাটালিয়নের কোত এবং ম্যাগাজিনের তালা ভেঙ্গে ফেলে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করতঃ বিভিন্ন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনার অবতারণা করে।
২। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে রাত ২১.০০ ঘটিকায় চিত্তবিনোদন কক্ষে টি.ভি. দেখার সময় সুবেদার সারোয়ারের নেত্বত্বে অন্যান্য জে.সি.ও-রা সকল সৈনিকদের বিদ্রোহে উদ্ধুদ্ধ করে। ব্যাটালিয়ন সিগঃ সেন্টারের কর্তব্যরত অপারেটর নায়েক (সিগন্যাল) কবির, ৩ নায়েক (সিগন্যাল) গণেশসহ ১০/১২ জন সিগঃ সদস্য বিভিন্নভাবে ব্যাটালিয়নে সৈনিকদের মধ্যে গুজব ছড়ায়। এক্ষেত্রে কোম্পানীসমূহের সি.এম.এইচ.-গন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে সকলা ০৯:৪৫ হতে আনুমানিক ১০:০০ ঘটিকা পর্যন্ত ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণের উপস্থিতিতে কোত হতে অধিনায়কের অনুমতি ব্যতিরেকে অস্ত্র লুট করা হয়। এ সময় হাবিঃ বুলবুল, ল্যাঃ নাংঃ (ড্রাইভার) ফজলসহ প্রায় ৫০ জন বিভিন্ন পদবীর বিদ্রোহী সদস্য স্বপ্রণোদিত হয়ে অস্ত্র হাতে নেয়। উল্লেখ্য সুবেঃ মমিন অস্ত্র লুট করার ব্যাপারে অপরাপর সদস্যদের উষ্কানী প্রদান করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে সকাল ১০:০০ ঘটিকায় ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণ অফিসে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ওয়্যারলেস সেটে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর ও অধীনস্থ সকল বি.ও.পি./সি.আই.ও. সমূহকে অস্ত্র সহকারে স্ট্যান্ড টু করান।
৩। আর.পি.এন.সি.ও নায়েক কবিরের নেতৃত্বে ৫ জন অস্ত্র তাক করে আর.পি. গেইট বন্ধ করে রাখে। সেখানে অধিনায়ক এবং অন্যান্য অফিসার ও পরিবারবর্গকে সরকারি জীপ থেকে ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণের নির্দেশে নামিয়ে দেয় এবং ওয়্যারলেস সেট কেড়ে নেয়। হাবিঃ কামালের নেতৃত্বে ৩/৪ জন বিদ্রোহী সদস্য ব্রীজের পাটাতন তুলে অফিসারদের বহনকারী গাড়ি আটক করে এবং অস্ত্র তাক করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখ সকাল ১১.০০ ঘটিকায় সুবেঃ আকবরের নেতৃত্বে ১০/১২ জন বিদ্রোহী সদস্য রাস্তার দু’পাশে পজিশন নিয়ে অস্ত্র তাক করে ও অফিসারদের গাড়ী থামায়। ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণের নেতৃত্বে বিদ্রোহী সদস্যদের ১টি বেসামরিক এলাকায় অস্ত্র মোতায়েন করে এবং মাইকিং করে জনগণকে আতঙ্কিত করে তোলে। ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টার মাস্টার ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণের নেতৃত্বে জে.সি.ও. সহকারী আনোয়ার ও অধিকাংশ সহকারী এমনকি সেকশনের অধিকাংশ ড্রাইঃ অধিকাংশ সিগঃ সদস্য অস্ত্রসহ বিদ্রোহে অংশ নেয়।
৪। অতএব, উপর্যুক্ত ঘটনার প্রেক্ষিত্রে অত্র নালিশী দরখাস্তের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিনীত অনুরোধ জানাইতেছি।
তারিখ : ৮ই এপ্রিল ২০০৯ নিবেদক,
পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা,
রাজস্থলি থানা, রাঙামাটি
সাক্ষীদের নাম : লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মোঃ আনিসুর রহমান, অধিনায়ক, ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়ন, রাজস্থলী এবং
১/১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের আরো অনেকে।
‘এ ক্যা বোলতি তু? ক্যা মায় বোলু’ আতি ক্যা খ্যান্ডালা? ঘুমেঙ্গে নাচেঙ্গে যায়েঙ্গে এ্যাশ করেঙ্গে অর ক্যা?’ বাসের দুলুনিতে এই গানটাই কেন বারবার মনে আসছে নন্দিনী গোস্বামীর… বি.ডি.আর.-এর দরবার হলে গত বছর বি.এস.এফ. কর্মকর্তারা সপরিবারে বেড়াতে এলে বি.ডি.আর. প্রধানের নিহত স্ত্রী অন্য বি.ডি.আর. সদস্যরা তাকে যতই গালি দিক, তার ডাল-ভাতের দুর্নীতি নিয়ে যাই বলুক, নন্দিনী মনে করেন যে ভদ্রমহিলা ভালোই ছিলেন। তিনি থাকতে লেডিস ক্লাবটা যতটা জমজমাট ছিল, তা কি আর হবে? তা’ সেই তিনি বি.এস.এফ-এর গেস্ট কাপলদের খুশি করতে বাংলাদেশের বি.ডি.আর. হেড কোয়ার্টারে থাকা বি.ডি.আর. ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্ত্রীদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ভারতীয় অতিথিদের খুশি করতে কয়েকটি হিন্দি গান ও গানের সাথে নাচও ছিল। মহিলারাই করেছিল সব। সেনা ও বি.ডি.আর সদস্যদের স্ত্রীদের ভেতরই যারা একটু লম্বা, হাল্কা ও শ্যাম বর্ণের তাদের ছেলের সাজে ও তুলনামূলক হ্রস্ব, ভারি ও গৌরবর্ণদের মেয়ের সাজে সাজিয়ে এই অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। নন্দিনী আমির খানের চরিত্রে ও ঢাকা বি.ডি.আর.-এর টোয়াইসি-র স্ত্রী রূপা ভাবিকে রানী মুখার্জীর চরিত্রে সাজানো হয়েছিল। না, কই,..এই যে নন্দিনী একে বি.ডি.আর সদস্যের স্ত্রী তাতে একজন হিন্দু মহিলা…বিডি.আর.-এর ফার্স্ট লেডি মন্দ ব্যবহার দূরে থাক- নন্দিনী জন্মগত ভাবেই একটু হাসি-খুশি প্রকৃতির বলে তাকে তিনি অসম্ভব পছন্দ করতেন। বি.ডি.আর. ও সেনা সদস্যদের যেসব স্ত্রীরা একটু সামাজিক বা মিশুকে প্রকৃতির তাদের জন্য ভদ্রমহিলা ছিলেন সদা অবারিত দ্বার। নূরজাহান ভাবি যেমন অভিযোগ করে তেমন আলাদা সোফায় তাকে বসতে তো হয়ই নি উল্টো গতবার রাঙামাটিতে তার স্বামীর পোস্টিং হবার আগে ঢাকা বি.ডি.আর. লেডিস ক্লাবের শেষ ফ্যাশন শোতে দীর্ঘাঙ্গী নন্দিনীকে তিনি তাঁর নিজের গায়ের জামদানিটা দিয়েছিলেন। কত জন কত কি বলেছে। কেউ বলছে এই দম্পতি এক ডাল-ভাত থেকে ছয়শো কোটি টাকা মেরেছে, কেউ বলেছে বি.ডি.আর.-এর স্কুলে ইংরেজি মাধ্যম কোর্স চালু করে ভদ্রমহিলা দুই বছরে চল্লিশ কোটি দাঁও মেরেছে। নন্দিনী অবশ্য এত রাজনীতির কথা-বার্তা বোঝে না। ভদ্রমহিলা থাকলে আজ তার স্বামীর এই দূর্গতি হয় না। দ্যাখো কান্ড, স্বামী রাঙামাটি হতে ঢাকা জেলে ট্রান্সফার হয়েছেন। ঢাকা মানেই রিমান্ড। রাঙামাটি জেল হতে কাগজপত্র নিতে নন্দিনীর রাঙামাটি আসা। আর এত ঝামেলার ভেতরও কিনা তিনি গত বছরের অনুষ্ঠানের গানের কথা মনে করছেন। আরো দ্যাখো শুধু স্বামী নয়, মৃতা বি.ডি.আর. প্রধানের স্ত্রীর জন্যও তার মাঝে মাঝে কেমন কান্না পায়। কী করুণ মৃত্যু! পত্র-পত্রিকায় কি রক্তাক্ত ছবি এসেছে তাঁর। এই ভদ্রমহিলা বেঁচে থাকলে তাঁর স্বামীর এত দূর্গতি বোধ করি হতো না। ‘আপা’ বলে সামনে গিয়ে একবার কেঁদে পড়লেই হতো। যে বিনোদ ভূষণ চক্রবর্তী জওয়ানদের ধমকে-ধমকে ‘স্যার’দের নিরাপদে জিপে তুলে দিলেন…আনিসুর রহমানকে চাইলে তিনি শেষ করতে পারতেন… সেই আনিসুর রহমানই দু’মাস না গড়াতে বিদ্রোহ সৃষ্টির অভিযোগে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে সোজা মামলা ঠুকে দিলেন। অথচ, দেশের বিভিন্ন বি.ডি.আর. কোয়ার্টারে যেখানে সামরিক অফিসারদের সাথে বি.ডি.আর. অফিসারদের সম্পর্ক কিছুমাত্র ভালো সেখানে সেনা অফিসাররাই বি.ডি.আর-দের উল্টো মামলার হাত হতে বাঁচতে সাহায্য করছে। অথচ, এই আনিসুর রহমানের সাথে সত্যিই তাঁরা কোনদিন একটা মন্দ ব্যবহার বা উদ্ধত আচরণ কিছুই করেন নি।
‘হা ভগবান!’
গভীর ভাবে একটা শ্বাস ছাড়েন নন্দিনী। ঢাকায় বাবার বাড়ি তাকে আশ্রয় দিচ্ছে। বড়ো মেয়েটাকে তারা শখ করে ও লেভেল পড়িয়েছেন। ভালো রেজাল্ট। সামনে এ লেভেলের পড়া। খরচ কোথা থেকে আসবে? মেয়েটিও ও লেভেলে অনেকগুলো ‘এ’ পেয়েও ‘এ’ লেভেলে ভর্তি হতে পারছে না। একটাই মেয়ে তাদের। বিনোদ ভূষণের বেতন বন্ধ গত ক’মাস। রাজস্থলীতে তাদের ক্যাম্পাসের সব আর্মি অফিসারদের স্ত্রীদের হাতে-পায়ে ধরেছেন এবার নন্দিনী। সত্যি বলতে, একা আনিসুর রহমান ছাড়া অন্য কোন সেনা কর্মকর্তা বা তাঁদের স্ত্রীদের নন্দিনী ও বিনোদের ব্যাপারে সহানূভূতিও রয়েছে। কিন্তু, আনিসুর রহমানই প্রধান। তাকে সবাই ভয় পায়।
চোদ্দ
‘আব্বু’।
সজলের দিকে এক ঝলকে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন তরিকুল। জেলখানা হতে দু’সপ্তাহ আগে আর একবার রিমান্ডে নেবার পরই তাকে হাসপাতালে আসতে হলো। জেল হাসপাতালেই। এক ছুটে বাবার বুকের কাছে চলে এলো সজল। তরিকুলের চোখে জল আসে। এই ছেলে আর কখনো তাঁকে হাঁটতে দেখতে পারবে না।
বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সজলের চোখেও জল আসে। কিশোর দুই চোখে ভৎসর্নার চেষ্টা করে।
‘রাসেল ক্রো আব্বু।’
‘রাসেল ক্রো?’
‘Gldaiator।’
তরিকুল স্তব্ধ হয়ে যান। একটু ভয়ও করে তার। হাসপাতাল হলেও জেলখানারই এক্সটেনশন। এখানে এসব কথা না বলাই ভালো।
‘তোমাকে একটা বই গিফট করেছেন একজন।’
‘কে?’
‘আমাদের ইতিহাস টিচার। প্রথমে আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। আমি সমানে ডায়েরিতে নোট নিয়েছি। গতকাল ফেরত দিতে গেলে বললেন আমার কাছেই রাখতে। পরে কী ভেবে বইয়ে তোমাকে উদ্দেশ্য করে সিগনেচার করেছেন।’
‘কই দেখি?’ নূরজাহান ততক্ষণে চিকেন স্যুপ বাটিতে ঢালছেন। আর কি শুকিয়ে গেছে পিঙ্কি। মেয়েকে ইশারায় কাছে ডাকেন তিনি, ‘এখনো রোজা রাখছিস বুঝি? আর রাখতে হবে না।’
জেল হাসপাতালের এই একটা রুমেই ছয় জন আহত বি.ডি.আর অফিসার সার দিয়ে শুয়ে আছে। একটু উঁচুর দিকের র্যাঙ্ক এদের। এখান থেকে ঠিক পাশের বেডেই ডি.এ.ডি. বিনোদ ভূষণ রাত-দিন পিঠে দু’টো বালিশ আর কোলে একটি বালিশ দিয়ে কি যেন লেখে কাগজ-কলমে। কোমর হতে নিচ অবধি তার প্লাস্টার।
‘কী লেখেন এত?’
‘আমার জবানবন্দি।’
‘এত লম্বা জবানবন্দি? কবে শেষ করবেন?’
‘জানি না, আপনিও একটা লেখেন না।’
‘কী লিখব?’
‘কেন? আপনার উপর করা অন্যায়, মিথ্যা ষড়যন্ত্র…’
‘লিখে লাভ?’
তরিকুল উদাস হয়ে যান। সামনের জানালা হতে একটা শ্বেতকরবীর গাছ তার অস্পষ্ট মাথা নাড়ে। ছোটো ছেলের রেখে যাওয়া ইতিহাস বইয়ের পাতা নাড়েন।
পনেরো
‘বল তোদের সাথে কে কে ছিল? সি.আই.এ. না আই.এস,আই.? বল কুত্তার বাচ্চারা। নইলে বিচিতে সুই দেব।’
সত্যি সত্যি পেনিসে সুই ফোটানো হলো।
‘বি.ডি.আর.-এর অফিসার। কুত্তাকে লাই দিতে নাই। লাই দিলেই মাথায় চড়ে।’ ‘এই জুতার তলে থাকা বি.ডি.আর.-রা আমাদের ষাট জন অফিসারকে খতম করেছে। আমাদের মা বোনদের গায়ে পর্যন্ত হাত দিয়েছে।’ ‘টয়লেট থেকে একটা কাঠিতে একটু গু মেখে এনে এদের মুখে মেখে দিতে হবে। দেখা যাক, কথা না বলে থাকে কি করে!’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গোটা শরীর প্লাস্টার করে মেঝেতে পড়ে থাকতে হয়েছে তাদের তিন জনকেই। একত্রিশ ও বত্রিশ নম্বরের মেল ক্যাসুয়ালটি ওয়ার্ডে জায়গা মেলে নি তাদের। চট্টগ্রামের বায়তুল ইজ্জতের সিপাহী মোফাজ্জল আর ঢাকার পিলখানায় পোস্টিং কিন্তু বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বাড়ি নায়েক তৈয়ব আলীর কাছে আজরাইল এসেছিল ভোর রাতেই। সে, আবু রায়হান, ল্যান্স নায়েক, বায়তুল ইজ্জত বত্রিশ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে মেঝেতেই তাদের তিনজনেরই তখনো হাতে সূচ ফুটিয়ে স্যালাইন চলছে। চেনা-পরিচিত কেউই ছিল না। জেলখানা থেকে তাদের পুনরায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার। এই তিনজনের ভেতরে সে আবু রায়হান আর সিপাহী মোফাজ্জল দু’জনেই বায়তুল ইজ্জতের। পরস্পরকে চেনে তারা। এমনকি তৈয়ব আলীর সাথেও গাইবান্ধায় অনেক আগে…প্রায় আট/দশ বছর আগে…তারা দু’জন একসাথে কাজ করেছে। তৈয়ব আলী গাইবান্ধায় তখন তার পরিবারকে সাথে নিয়ে থাকতো। এই প্রকান্ড মার খাওয়া শরীর ও মনের কোন ভুল না হলে সম্ভবতঃ তৈয়ব আলীর বাসায় এক রাতে সে দাওয়াতও খেয়েছিল। তৈয়ব আলীর স্ত্রী হিন্দুদের দুর্গা প্রতিমার মতো রূপসী। তিনজনের ভেতর হয়তো আল্লাহর ইচ্ছাতে একা সেই শুধু শরীরটা একটু নাড়াতে পারছে। গতকাল বুধবার হতে একটু সব কিছু মনে করতে পারছে। বাথরুমে একা যাবার মতো শক্ত নয় তার শরীর। এই বত্রিশ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে মেঝেতে শায়িত তার হাতে সূচ ফোটানো। মেঝেতে পাতা একটা চাদরের উপর সে শোওয়া। গায়ে একটা ময়লা কাঁথা কোন্ দয়াবান দিয়ে গেছে কে জানে? কাঁথার ভেতর লুঙ্গিটা ঢিলে। যৌনাঙ্গে ক্যাথিটার বসানো। গা পুড়ে উঠছে জ্বরে। আর, তেমন সময়েই সে স্পষ্ট দেখতে পেল আজরাইল যেন তৈয়ব আলী আর মোফাজ্জলের কাঁধের কাছে এসে বসলো। বহু আগে ছোটোবেলায় দাদিমার কাছে গল্পে গল্পে সে শুনেছিল যখন আজরাইল আসে, তখন যার বা যাদের জান সে কবচ করবে।তাদের হঠাৎই ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে। এক ফোঁটা দমের জন্য কেমন মুখ হাঁ করতে থাকে তারা, সারা শরীরে খিঁচুনি আসে, এক ফোঁটা শ্বাসের জন্য কী কষ্ট …যে পৃথিবীর হাওয়া-বাতাসে জন্মের পর থেকে বান্দা কাটিয়েছে। সেই পৃথিবীর বাতাস হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবু ভুলেও জান কবচ হয়ে যাওয়া আদমের পাশে যায় না সে…আবু রায়হান কী করে জানে? বাহ্, তার বাপের মৃত্যু কাছ থেকে দ্যাখেনি সে? হাসপতালের সাদা বেডে বাবার সে কি গড়াগড়ি? একটু বাতাস, এখন কই? কোথায় বাতাস? তারা সব ভাই-বোন মিলে কষ্ট করে আই.সি.ইউ. এতে পর্যন্ত বুড়ো মানুষটাকে ভর্তি করিয়েছিল। সাত দিন মুখে অক্সিজেন মাক্স। হাতে পায়ে কত সুই। বড়োলোকরাও এত খরচ করে না যা তারা তাদের বাপকে বাঁচাতে করেছিল। কিন্তু, কী করে সেই অগ্নিভ ফেরেশতার সাথে পারবে এই তুচ্ছ মাটির মানুষ? সাত দিন কৃত্রিম শ্বাসে বাপকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছিল। আহ্ , কেউ নেই? ভোর রাতের এই আজানের সময়টা ছুরিকাঘাত, যান্ত্রিক দুর্ঘটনা কি বড়ো বড়ো সব রোগের পুরুষ রোগীদের ওয়ার্ডে রাতভর পুরুষালি গোঙানির পর মাত্রই ঠান্ডা ও নিদ্রালু যখন হতে শুরু করেছে… মেঝেতে সার দেওয়া কাটা-ছেঁড়া ও ময়লা মাখা রোগীরাও একটু যেন বা দু’চোখের পাতা এক করেছে তার পাশেই সার দেওয়া মোফাজ্জল আর তৈয়ব আলী একটু কি কিছু বলতে চাইল? একবার কি যন্ত্রণায় গুঙ্গিয়ে, ছটফট করে উঠল তারা?
‘সিস্টার।’
আবু রায়হান বুঝিয়া একবার নার্সের নাম ধরে ডাকতে চায়। কিন্তু, সাদা পোশাকের কাউকে দেখা যায় না।
ষোল
অনন্তর সেই শিশু কন্যা যিনি কালে কালে সর্বাঙ্গ সুলক্ষণা ও বেহুলার ন্যায় পরম সতী হইবেন। মাতৃস্তন্য পানে নিদ্রিত এবং শিরিন বানু যিনি হিমকাঞ্চনবর্ণা গৌরী, স্তন্য পান করানো জনিত অবসাদে ঢুলু ঢুলু। সেই হেতু আজিকাল আশ্বিনেও আষাঢ় সদৃশ ঝড়জল। অগ্রে বেহুলা, ধান্য দুর্ব্বা হরিদ্রা দুগ্ধের মঙ্গল আশীর্ব্বাদে সন্তান অভিলাসিনী ও পশ্চাতে লখিন্দর। ইন্দ্রনীল কামবর্ণ সেই যুবা বাসরঘরের দিকে পদ বিক্ষেপে মুহুর্তেই সচকিত আহা, ঘাগট নদীতে যদি বা নবমাতৃকা নৌকা ভাসাইলেন… বাবা মাহি সওয়ারের থানে তিনিই কি রক্তবর্ণ সূতা গাঁথেন নাই, এলো চুলে ভর পোয়াতি তোলেন নাই কি জবা ফুল? তবে বেহুলা! এই বঙ্গে কী রূপে বিধবা হন? তবু দেবরাজ ইন্দ্র নিষ্ঠুর ও তিনি রমণীকে উর্বশী রূপে দেখিতে উচ্ছুক। যদিচ বাবা মাহি সওয়ার চরম ক্রুদ্ধ ও স্বপ্নে তিনি প্রায়শই জিজ্ঞাসাপরায়ণ,
‘একটু আগে তুমি নাচছিলে ক্যানো মা? বিবাহিতা নারীর আবিয়াতো নারীর মতো নাচ-গান, রহস্য-পরিহাস ঠিক নয়।’
‘বাবা, আমার স্বামীর বড়ো বিপদ।’ তখন দূরে কোথাও চৈত্রের পুষ্পময়ী সঙ্গীতের মতো মনসা পালা গানের ধুয়া-
“আস্তে ফ্যালো পাও বেহুলা, ধীরে ফ্যালো পাও গো।
আস্তে ফেললাম পাও গো সাধু ধীরে ফেললাম পাও।
ঐ বাসরে যাব না সাধু বলি যে আপনারে গো।
ঐ বাসরে যেতে আমার মন যে কেমন করে গো।”
সেই হেতু বেহুলা নবোঢ়ার সাজ পরিত্যাগবশত নৃত্যরতা উর্বশী, ভাসানযাত্রায় অমলিনা তবে, ঘাগটে শাপলা ও অন্যান্য পুষ্পদিসকল পুনর্ভবা হউক, আকাশে নক্ষত্র উঠুক…।
কবি,কথাসাহিত্যিক