আকাশে ওড়ার দিনগুলো (পর্ব- ৫)

Reading Time: 4 minutes

 

নতুন জায়গায় প্রতিটা দিনই নতুন, প্রতিটা দিনই সুন্দরকে খুঁজে বেড়ানোর। তাই ২১ তারিখে ক্লাস শেষ হলেও প্রতিদিনের মতো পরিকল্পনা হতে থাকে আজ কোথায় যাওয়া যায়। সেদিন তিনটার দিকেই আমাদের ক্লাস শেষ হয়ে গেল। ক্লাস শেষে আমরা ১৬ জন সদস্য সিটিতে যাবার জন্য একমত হতে পারলাম, বাকিরা যে যার মতো বেড়াবে বলে চলে গেল।

কোন টিম তৈরি হলে কোথাও বেড়াতে যাবার যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। একমত হতে গেলে সময়ক্ষেপণও হয়। তবে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঝুমা বেশ ঠাণ্ডা মাথাতেই সামলাতে পারে, এটা ওর দক্ষতা। আমি এই কয়দিনে ঝুমাকে যতো দেখছি ততো অবাক হয়েছি, প্রচণ্ড প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর বুদ্ধিমতী একজন মেয়ে ঝুমা। ইংরেজী “Smart” শব্দটির আভিধানিক অর্থ যা যা হওয়া উচিত সেসবের প্রায় সব গুণই ওর মধ্যে আছে। আমাদের ১৬ জনের এই দলের নেতৃত্ব তাই ওকেই নিতে হয়েছিল।

সেদিন ক্যাম্পাস থেকে আমাদের ১৬ জনের দলটি হাসি ঠাট্টা করতে করতে ক্যাম্পাসের পেছন দিকের রাস্তা ধরে প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটা পথ পাড়ি দিলাম ফেরি ধরার উদ্দেশ্যে। শেষ মুহূর্তে প্রায় দৌড়ে আমরা হন্তদন্ত হয়ে ফেরিতে উঠলাম।

ফেরিতে পা রাখার পূর্বমুহূর্তে সেদিন আমি প্রথমবারের মতোন ওপাল কার্ড ব্যবহার করেছি। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর এটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। গতবছর কলকাতা যাবার পর মেট্রো রেলে ভ্রমণের সময় কয়েন দিয়ে এন্ট্রি-এক্সিট করতে হয়েছিল। সিডনির ওপাল কার্ড অনেকটা সেরকমই। এটা আমাদের ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দেয়া হয়েছিল। আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা ইচ্ছা করলে এই কার্ড রিচার্জ করতে পারবো।

সিডনির পরিবহন ব্যবস্থা খুবই উন্নত ও অত্যাধুনিক। এখানে স্বল্প দূরত্ব বা দূরের গন্তব্যস্থানে যাতায়াতের জন্য বেশিরভাগ মানুষ ট্রেন ব্যবহার করে। তবে আমরা সিডনির সৌন্দর্য দেখবো বলে ফেরিপথে সিটিতে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসের মাঝে ফেরির সামনে দাঁড়িয়ে আমি, ঝুমা, যুগ্ম জেলা জজ জসীম ভাই, অতিরিক্ত জেলা জজ ওসমান হায়দার স্যার, সিনিয়র সহকারী জজ আজাদ প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। ছোট প্যারামাটা নদীর স্বচ্ছ পানিতে তখন বৃষ্টির আঁচড়ে এলোমেলো আঁকাআঁকি চলছে। সকালে রোদ থাকলেও বিকাল হতে হতে বৃষ্টির গতি বাড়ছিল।

একসময় সিডনি ওপেরা হাউজের কাছাকাছি আসামাত্রই সবাই মুগ্ধ হয়ে সমুদ্রের তীরঘেঁষে নির্মিত অপেরা হাউজের সৌন্দর্য দেখছিলাম। দূর থেকে হারবার ব্রিজও দেখা যাচ্ছিল। কিছু কিছু সৌন্দর্য মুগ্ধতার সীমা অতিক্রম করলে কথা হারিয়ে যায়। আমি তেমন বাকহীন হয়ে দেখছিলাম-এই পৃথিবী কী আশ্চর্য সুন্দর!

হারবার বন্দরে নোঙর করা ছিল বিশাল এক যাত্রীবাহী প্রমোদতরী। এতই বিশাল ছিল জাহাজটি যে আমার মোবাইলের ক্যামেরার ফ্রেমে কোনোভাবেই ধরতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে জাহাজটির জৌলুস দেখে বারবার আমার বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের কথা মনে পড়ছিল।

ফেরি থেকে আমরা নামতে না নামতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। আমরা পড়িমরি করে অপেরা হাউজের দিকে ছুটলাম।

সিডনি অপেরা হাউজে ৬৫ ডলার খরচ করে লাইভ শো দেখা হবে কিনা তা নিয়ে আমাদের দলটি দলছুট হয়ে গেল। সে এক মজার অভিজ্ঞতা। আমরা ঘুরে ঘুরে অপেরা হাউজের বাহ্যিক আর অভ্যন্তরীন সৌন্দর্য, বিলাসবহুল ক্যাফে দেখছি আর এ ওর সঙ্গে কানাকানি করছি কী করা যায়। তবে কয়েকজন আধুনিক মন-মানসিকতার স্যার বলছিলেন, জীবনে কী আছে, সিডনিতে আসলাম আর বাইরে থেকে অপেরা হাউজের ছবি তুলে চলে গেলাম তা কী আর হয়! ব্যস আমাকে আর ঝুমাকে পায় কে, আমরা অপেরা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

তারপর টিমের কিছু সদস্য চলে গেলেও আমরা অনেকেই থাকলাম এবং বিদেশের মাটিতে আবেগতাড়িত হলাম অপেরা হাউজে কর্মরত দুজন বাংলাদেশের মানুষ পেয়ে। তারা আমাদের সহজে টিকিট পেতে সাহায্য করলেন এবং দেশের মানুষ পেয়ে নিজেরাও আনন্দে ভাসলেন। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। মঞ্চের পর্দা উঠলো। দেখলাম অপেরা ‘এন্টনিও অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’, সেদিন কিন্তু ভুল করেও আমরা টিকিটের মূল্য বাংলাদেশী টাকায় কনভার্ট করিনি। খুব ধীরগতির অপেরা শো দেখতে দেখতে আমাদের টিমের কয়েকজন স্যার ঘুমাচ্ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মগাম্ভীর্যে নানান কৌতুক করছিলেন। তবে কারো মধ্যেই আফসোস ছিল না যে, টাকাটা নষ্ট হলো। কারণ সত্যি নিজের জন্য কুড়িয়ে পাওয়া এই সময়কাল আমরা ভীষণভাবে উপভোগ করছিলাম।

এই প্রথম এমন কোনো শো সামনাসামনি দেখেছি। ইতিহাসের বিস্ময়কর নারী ক্লিওপেট্রার চরিত্র রূপায়নকারী অভিনেত্রীর মোহনীয় রূপ আর সম্মোহনী অভিনয় শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। মাঝেমাঝে উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে কিছু কিছু সংলাপ বুঝতে সমস্যা হলে ঝুমা, আমিসহ স্যারেরা বোকার মতো তাকিয়ে থেকেছি। পর্দার ওঠা-নামা, হঠাৎ করে মঞ্চের সব অভিনেতা, অভিনেত্রীর স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া কিংবা পালাক্রমে স্ট্যাচু হওয়া, স্ট্যাচু অবস্থা থেকে চরিত্রের প্রাণ ফিরে পাওয়া-এসব কিছুতেই চমকের পর চমক ছিল।

অপেরা শেষ হলে ফুরফুরে মনে দীর্ঘ দিন বাচ্চাদের না ছুঁতে পারার টানাপোড়েন ভুলে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অপেরা হাউজ আর হার্বার ব্রিজের আলো ঝলমলে সৌন্দর্য উপভোগ করেছি।

সিডনি অপেরা হাউজ থেকে বের হয়ে আমরা রেল স্টপেজে চলে গেলাম। ট্রেনে চেপে আমরা Harris Park নেমে পায়ে হেঁটেই আমাদের হোটেল অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তখন রাত ৯.০০ টা। রাস্তাঘাটে দু’একটা গাড়ি ছাড়া তেমন কোন যানবাহন চলাচল করছিল না। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করে অবাক হলাম প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করা। ঝুমা জানালো, ওদের বেশির ভাগ লোকের গাড়ি রাতে রাস্তাতেই পার্ক করা থাকে। দেশের সঙ্গে তুলনাটা এবার কেন যেন এসেই গেল। দেশে এভাবে রাতে রাস্তায় গাড়ি রাখা হলে মামলার হার কী পরিমাণ বাড়তে পারে ভেবে আতঙ্কিত হলাম।

পরের দিন ২২ তারিখে দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি। সেদিন বৃষ্টিভেজা ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি আর প্রচুর ছবি তুলেছি। এই দিনটিও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না আমার জন্য। আসলে সিডনিতে আসার পর প্রতিটি মুহূর্তই এত মূল্যবান মনে হচ্ছিল যে খুঁটে খুঁটে প্রতিটা সেকেন্ড উপভোগ করার চেষ্টা করেছি। ক্লাসের অবসরে তাই কাগজে টুকে রাখছিলাম টুকিটাকি সময়ের হিসাব। আমার মনে হয় মোবাইল আর ল্যাপটপের চেয়ে কলমই বেশি স্মৃতি ধরে রাখতে সক্ষম। যন্ত্র বিশ্বাসঘাতকতা করে স্মৃতি মুছে ফেললেও কাগজে তুলে রাখা শব্দেরা ঠিকই ধরে রাখে সময়ের স্বাক্ষর। তাই ঘুরতে না গেলেও প্রতিদিনের খামখেয়ালি ভাবনাগুলো নোট করে রেখেছি।

(চলবে)

.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>