ক্যাঙ্গারুর দেশে আমি (পর্ব-১)

Reading Time: 4 minutes

২৫শে মার্চ ২০১৫ আমার আর বড়ো মেয়ের ভিসা এল আর ৩১শে মার্চ দুজনে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এর ফ্লাইট ধরে রওয়ানা হলাম সিডনির পথে । আসলে আমার হাসব্যান্ড ৯ মাস আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি ভিসা নিয়ে। তারপর আমাদের ডিপেডেন্ট ভিসার দরখাস্ত করা হয়েছে। সাধারণত তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই ভিসা চলে আসার কথা। কিন্তু মাঝখানে ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ চলে আসায় আমাদের ভিসা গুলো চলে গিয়েছিলো নিচে। আমি তো চাকরি বাকরি ছেড়ে বসে আছি এই আজ আসে কি কাল আসে। বড়ো জন পারলে স্কুল ছেড়ে বসে থাকে! এই পরিস্থিতিতে যেদিন ভিসা এসেছে আর একটুও দেরি না করে রওয়ানা।

অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে। সেখানে নিজের পছন্দ মতো বাড়ি খোঁজা যায়। যেমন দুটো বেডরুম, একটা বাথরুম, একটা গ্যারেজ এই ধরণের যার যা প্রয়োজন। ইউনিট নেবো (এখানে ফ্ল্যাটকে ইউনিট বলে) না হাউস নেবো তাও বেছে নেওয়া যায়। স্বভাবতই ইউনিটের ভাড়া কম হয়। ভাড়ার পরিমান  আর বাকি সব তথ্য অনুযায়ী পর পর বাড়ির ছবি চলে আসে। ঘরের ভেতর বাইরে সব দেখে নেওয়া যায়। একটা অদ্ভুত ব্যাপার এখানে দুটো বেডরুম এর বাড়ির সাথে দুটো গ্যারেজ দেখেছি কিন্তু দুটো বাথরুম কখনো চোখে পড়েনি। এর কারণ এখনো আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি যদিও।

এ দেশে প্রতি সপ্তাহে ভাড়া দিতে হয়। সিডনি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর গুলোর মধ্যে একটা। মাস প্রতি ভারতীয় টাকার হিসেবে প্রায় এক লক্ষর নিচে দুই কামরার বাড়ি পাওয়া বেশ কঠিন। স্টেশনের কাছে হলে তো কথাই নেই। ভাড়ার পরিমান খানিকটা বেড়েই যায়। এ দেশে অফিস বা অন্য যে কোনো কাজে মাইনেও সপ্তাহে বা পনের দিন বাদে বাদে হয় (পে আউট বলে)। তাই একসাথে যাতে চাপ না পরে সেজন্য ভাড়া সপ্তাহে সপ্তাহে নেওয়া হয়। নির্ধারিত ব্যাঙ্ক একাউন্ট থেকে কেটে যায় নিজে নিজেই।

তা, আমাদের আসার কথায় ফিরে যাই। ভিসা গ্রান্ট হওয়ার আগে একটা কেস অফিসার নিয়োগ করা হয় যার দায়িত্ব কাজের গতিকে তরান্বিত করা। আরো কোনো কাগজ পত্র লাগবে কিনা, অন্য কোনো তথ্য প্রয়োজন কিনা এসব দেখে ভিসার ইন্টারভিউ ডেট ঠিক করে দেওয়া। অস্ট্রেলিয়ার ভিসা ইন্টারভিউ ফোনেই হয়। কেস অফিসার নিয়োগ হওয়া মানেই কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে ভিসা যদি কাগজ পত্র সব ঠিক থাকে।

বাড়ি ভাড়া খোঁজার মোক্ষম সময় এটা।  এতদিন আমার হাসব্যান্ড এক বন্ধুর সাথে হাউস শেয়ার করে থাকতো। ঠিক হলো দুটো বেডরুম, একটা বাথরুম আর একটা গ্যারেজ ওয়ালা বাড়ি দেখবো আমরা।তখন সিডনির সাথে কলকাতার সময়ের সাড়ে পাঁচ ঘন্টার তফাৎ। সিডনি সাড়ে পাঁচ ঘন্টা এগিয়ে। কলকাতায় বসে আমি আর সিডনিতে বসে আমার বর বাবাজি একসাথে একটা নির্দিষ্ট সময় মতো ওয়েবসাইট খুলে একসাথেই বাড়ি খুঁজতে লাগলাম।

বড়ো মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে সিডনি যাচ্ছে। ফলে ওর হাই স্কুল যেন বাড়ি থেকে দূরে না হয় সেটা খুব জরুরি। এখানে অবশ্য সব অঞ্চলেই পাবলিক স্কুল থাকে। আমরা চাইছিলাম একটু যেন হাঁটাহাঁটি করারও সুযোগ থাকে আবার ট্রেন বাসের ঝামেলায় যেন পড়তে না হয়।

এ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স হবে তারপর গাড়ি কেনা, কে জানে কত সময় লাগবে, কাজেই স্টেশনও যেন কাছে হয়। ট্রেন টাই পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে। মোটামুটি সব জায়গার সাথেই লোকাল ট্রেন  মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। বাস একটু গন্ডগোলের। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বাস পাওয়া যায় না। আর সব জায়গায় যায়ও না। আমি এই সাড়ে চার বছরে হাতে গুনে 4 বার বাসে উঠেছি কিনা সন্দেহ। যাই হোক, হাসপাতাল, বাজার হাট সবকিছুই হাতের নাগালে প্রয়োজন। এত পছন্দ করে এত কঠিন ভিসা প্রসেসের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এত সময় অপেক্ষা করে সিডনি আসছি একটু সমুদ্রের কাছাকাছি থাকবো না? আবার পকেট টাও তো দেখতে হবে! সময় অল্প অথচ প্রচুর কঠিন কাজ সামনে, কাজেই সেরকম ভাবে বাড়ি দেখা শুরু হলো।

এখানে আবার আমার পছন্দ হলেই হবে না, বাড়ি ভাড়া পাওয়ার অনেক ব্যাপার আছে। আগে ওয়েবসাইট থেকে পছন্দের বাড়ি গুলোর ফর্ম ফিল আপ করতে হবে। একই বাড়ি অনেকেই পছন্দ করে ফর্ম ফিল আপ করতে পারে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সাধারণত রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অফিসের সাথেই যোগাযোগ করা যায়। ওই এজেন্ট অফিস থেকে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় একদিন সব অপ্প্লিকেন্টদের একসাথে নিয়ে বাড়িটা দেখানোর। সেটাকে রিয়েল এস্টেট ইন্সপেকশন বলে।

বাড়ি পছন্দ হলে নিজেদের যাবতীয় ইতিহাস দিয়ে ফর্ম ফিলআপ করে জমা করতে হয়। এবার সেই সব অ্যাপ্লিকেশনস বাড়ি ওয়ালাকে দেখায় ওই এজেন্টরা। তারপর বাড়িওয়ালা পছন্দ করে কাকে বাড়ি দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ভেতরে একটু আধটু চেনা জানা থাকলে মন্দ হয় না।

যদিও অনেক ক্ষেত্রে চেনা জানা থাকলে সরাসরিও ভাড়া পাওয়া যায় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে। কিন্তু সে জন্য হয় স্থানীয় লোকজনকে সরাসরি চিনতে হবে না হয় কারো মাধ্যমে চিনতে হবে। যেমন পরবর্তী কালে আমরা এখানে আমাদের এক কলকাতার বন্ধুকে বাড়ি পেতে সাহায্য করেছিলাম সেই বাড়ির মালিকের সাথে পরিচিতি হওয়ায়।

যাইহোক তখন তো আমাদের চেনা পরিচিতির কোনো ব্যাপার নেই কাজেই একটা বাড়ি পছন্দ করে বসে থাকলে চলবে না। তাই বেশ কয়েকটা বাড়ির ফর্ম জমা করা হলো। সময় অল্প থাকার জন্য অফিস সামলে বেশি বাড়ি ইন্সপেকশন করা সম্ভব হলো না আমার হাসব্যান্ড অনির্বাণের পক্ষে। শনি আর রবিবারই  মোটামোটি ইনস্পেকশন গুলো হয়। আমাদের পৌঁছানোর মধ্যে মাত্র দুটো সপ্তাহ পাওয়া গেলো ফলে যে বাড়িটা সবার আগে পাওয়া যাবে সেটাই নিয়ে নেওয়া হবে বলে স্থির হলো।

একদিকে আমাদের ভিসা এল আরেক দিকে বাড়িও পাওয়া গেলো। বড় মেয়ে অনুষ্কাকে যে স্কুলে ভর্ত্তি করবো ভেবেছি তার কাছাকাছিই হলো। সেন্ট জর্জ হসপিটাল হাঁটা পথে (১ কিলোমিটারের মধ্যে)। বাজার হাট, স্টেশন সবই নাগালের মধ্যে (৫০০-৬০০ মিটারের মধ্যে), আর প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে সকাল বা সান্ধ্য ভ্রমণে যেতে চাইলে পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায়।

উপরি পাওনা হলো পাড়ার দোকান। পিজা শপ থেকে, বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান, নেপালি দোকান একবারে দু পা গেলেই। পদ্মার ইলিশ থেকে, নেপালি মোমো (একদম তাজা) আর এদিকে ইডলি থেকে ধোকলা কোনো কিছুই বাদ নেই পাওয়া যেতে। একদম গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা লাউ বা কুমড়ো শাক কিংবা রসগোল্লা বা কালো জাম একদম বাড়িতে তৈরী, সব হাতের কাছে। বাঙালি তো তাই ভোজন রসিক কথা টা সাথে এসেই যায়। পাশের সবার্ব (পাড়ার মতো আরকি) জুড়ে লাইন দিয়ে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। ফুচকা থেকে মোগলাই, বিরিয়ানী থেকে কোর্মা কি চাই?

একদিকে আমাদের গোছগাছ চলছে অন্যদিকে অনির্বাণ নতুন বাড়ির জন্য খাট অর্ডার করছে, বাসন পত্র কিনছে। আমরা দুজন খুব ভালোবেসে সংসার করি। ঠিক যেমন ছোট বেলায় রান্না বাটি খেলতাম, তেমন। এখনো আমার ছোট্ট বেলার খেলার সাথীটির সাথে এক সাথে সবজি বাজার থেকে জামা কাপড় – সব এক সাথে কেনা কাটা করি। তাই ঠিক হলো সংসার শুরু করতে ঠিক যেটুকু না হলেই নয় সেটুকু ও কিনে রাখবে, বাকি আমরা পৌঁছলে এক সাথে করবো। ১লা এপ্রিল আমরা পৌঁছাবো আর ২৭শে মার্চ থেকে বাড়িটা আমরা পেলাম, বেক্সলির উল্সলি স্ট্রিট এ। উফঃ কি স্বস্তি। শুরু হলো আমাদের আবার নতুন করে লাল নীল সংসার।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>