| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২১) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comমিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২১।


নাডিয়া প’পভনার বান্ধবী মারিয়াএন্টন’ভনা তার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। সঙ্গে এসেছিল তার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট তার বোন মারিনা। তিনজন সুন্দরী যুবতির হাসিমুখ বিশেষ করে মারিয়ার উদ্ভাসিত মুখ নাডিয়াদের ঘরের পরিবেশটাকেই যেন আলোকিত করে তুলল। সে নাডিয়াকে একটা সুখবর দিতে এসেছিল। কিন্তু ১৭ বছরের বোনটি কাছে থাকার জন্য দিতে পারছিল না । তাছাড়া ওদেরবৈঠকখানা ঘরে দাদা মিখাইল প’পভিছভেসিলিয়েভলিঅ’নিড এডলারের সঙ্গে অন্য দিনের মতোই একান্ত মনে দাবা খেলায় মগ্ন হয়েছিল।

মারিয়া এবং নাডিয়া একসঙ্গে ফরাসি ভাষা শিখে। ওরা সাহিত্যের পুঁথি পড়ে এবং আলোচনা করে। সেদিন ও মারিয়া নাডিয়ার থেকে নেওয়া বই দুটি ফিরিয়ে দিতে এসেছিল।

‘ যাবার সময় দুটো বই দিয়ে দিস তো।’– মারিয়া বলল।

‘ হ্যাঁ দেব। এখানে আসা কয়েকজন মানুষ আমাকে টলস্টয়ের বই উপহার দিয়েছে।’

নাডিয়ার কথা শুনে মারিয়া মুচকি হাসল। সে বলল–’ মানুষের ভালোবাসা হয়তো তোর প্রতি বেশিহয়েছে,নয় কি?’

নাডিয়ার মুখটা কোমল হয়ে মুচকি হাসি ছড়িয়েপড়েছিল।।সে কিছু একটা বলতে চেয়ে একবার ষোড়শী মারিয়ার দিকে তাকাল। সে কিছুটা দূরে বসে একটি বইয়ের পাতা উল্টে চলেছে এবং মাঝে মধ্যে দাবা খেলতে থাকা সুদর্শন যুবকদুটির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে ।

নাডিয়ামারিয়াকে চুপি চুপি বলল–’ চল এটিকে যাই।’

ওরা দুজন বিশেষ শব্দ না করে সিঁড়িদিয়ে উপরে উঠে এল। এটিকের জানলা দিয়েওদের চোখে ভেসে উঠল দূরের খোলা মাঠ, ফুলের বাগান, টেলিগ্রাফের ধাতুর খুঁটির সারি এবং দূরে বিলীন হয়ে যাওয়া ধুলায়ধুসরিত পথটি।

নাডিয়া বলল–’ বুঝেছ, বয়স্ক দুজন মানুষ আমাকে প্রশংসা করে। একজন তো ছবি এঁকেছে। সে বারদুয়েক বলেছে– তুমি এই লাইলাক ফুলের মতোউজ্জল এবং সুন্দর। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করব না–মূর্চ্ছা যাবে।’

মারিয়া হাসল।’ আর অন্যজন?’– সে জিজ্ঞেস করল।

সে তো আমার তৈলচিত্রটামস্কোতে নিয়ে গেল। সে বলেছে–’ আমি এখানে থাকলেও তোমার চিত্রটি আমার সঙ্গে মস্কোতে থাকবে।’

‘ আর?’– মারিয়ানাডিয়াকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল–’ আর সেই যুবক লিঅ’নিড এডলার? সে তোর প্রশংসা করে না?’

নাডিয়া গম্ভীর হল। সে বলল – ‘সে প্রশংসা করে না। আমার দিকে কখনও তাকায় এবং জিজ্ঞেস করে– শিল্পীটার সামনে বসে তোমার খারাপ লাগে না?’

মারিয়া হাসতে লাগল। সে বলল–’ ঈর্ষা, সে ঈর্ষা করে। মানে সে তোকে মনে মনেভালোবাসে।’

নাডিয়া চুপ করে রইল। তার চোখ জোড়া ধীরে ধীরেঅবনমিত হল।

‘ বুঝেছিসনাডুছা, আমার ভালো খবরটা তোকে বলিনি। ডিমিট্রিগরিনের সঙ্গে অবশেষে আমার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে ।’

‘হ‍্যাঁ’– নাডিয়াউৎফুল্ল হয়ে পড়ল। সে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরল।–’ খুব মজা হবে তোর বিয়েতে।’–নাডিয়ারকণ্ঠস্বর উচ্চকিত হল।

এটিকে উঠা সিঁড়িতেপায়ের শব্দ শোনা গেল। সতেরো বছরের মারিনা ধীরে ধীরে উঠে আসছে। তথাপি নাডিয়া বলল–’ এতক্ষণ বলিস নি কেন?’

‘ এটা বলার জন্যই তো আমি এসেছি।’

নাডিয়া বলল–’ আমাদের এই খবরটা পালন করতে হবে। পুশকিন থিয়েটারে যাবি? সেই যে আমরা গেলিনাওল’ন’ভার অপেরা এবং বেলে দেখেছিলাম? কে জানে এখন থিয়েটারে কী চলছে?’

মারিনা ঘরে প্রবেশ করে বলল–’ দিদি নাডিয়া আমাকেও কিন্তু নিয়ে যেতে হবে অপেরায়।’

মারিয়া বলল–’ তুই না। আমি ডিমিট্রি এবং নাডিয়া।’ আর – সে নাডিয়ার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল –’লিঅ’নিড?’

নাডিয়া পুনরায় গম্ভীর হয়ে পড়ল। সে কিছুই না বলে এটিকের টেবিলে পড়ে থাকা দুটি বই মারিনার দিকে এগিয়ে দিল।

নাডিয়া কাচের জানলা দিয়ে দূরে মা মাছা রমান’ভনাকে দেখতে পেল। মায়ের স্বাস্থ্য বেশ ভালো হয়েছে। শহরের বেকারির কাজ শেষ করে তিনি ধীরে ধীরে আসছেন। তার পরনে হাঁটু পর্যন্ত একটি স্কার্ট। গায়ে একটি পাতলা সোয়েটার এবং মাথায় পেছনে রয়েছে একটি সুন্দর কাপড়। তার হাতে কোনো ব্যাগ নেই। বেকারি থেকে সবসময় আনা দুটি পাউরুটি নিয়ে ব্যাগটা বহন করে আনছে তার সঙ্গে সঙ্গে আসা চমন’ভ মুচির পুত্র গ্রেবিল’ভে। সে তার খালি বস্তাটা বাঁ হাতের বগলের নিচে ঢুকিয়ে আনছে।

নাডিয়া বলল–’ মা এসেছে। চল নিচে যাই।’

ওরা নিচে গেল এবং কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত হয়ে ভেতরে আসা মাকে বসতে  দিয়েনাডিয়া কফি বানাল এবং প্রত্যেককে কফি দিল। মিখাইলরাও খেলার জায়গাতেই সোজা হয়ে বসল এবং নাডিয়াএগিয়েদেওয়া কফির পেয়ালায় চুমুক দিল।

ওদের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা অবস্থাতেই মাছা রমান’ভনা বললেন–’ তোরা অনেকক্ষণ থেকেই খেলছিস বলে মনে হচ্ছে। একটু উঠে বাইরে থেকে হাঁটাহাঁটি করে আয়তো।’

যুবতিরা তাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল। মিখাইল এবং লিঅ’নিড কিছুটা অপ্রস্তুত হল। ওরা কয়েক চুমুক দিয়ে কফিটা শেষ করল।

মিখাইল বলল– ‘পিটার যেলেনক’ভ আসার সময় হয়ে গেছে বোধহয়।’

সে লিঅ’নিডকেনিয়ে বাইরে গেল।

মারিয়ারা কিছুক্ষণ পরে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।মাছা রমান’ভনা ওদের দরজার মুখ থেকেই বিদায় দিল।

লিঅ’নিডদের সঙ্গে বাইরেরবারান্দায় দেখা হওয়ায়নাডিয়ামিখাইলকে বলল – বুঝেছ দাদা, মারিয়ার একটা ভালো খবর আছে।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়ানাডিয়ার হাতটা টিপে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল–’ধ‍্যাৎ’

মিখাইল এবং লিঅ’নিডমারিয়ার দিকে উৎসুক ভাবে তাকাল।তার লজ্জা লাগল।

নাডিয়া বলল–’ ঠিক আছে আমি পরে বলব।’

মারিয়া এবং মারিনা ধীরে ধীরেবেরিয়ে গেল। যাবার সময়মারিনার চপল দুই চোখ মিখাইলের দুই চোখ স্পর্শ করে গেল।

শহর থেকে আসা রাস্তায়দুইজনমধ্যবয়সী মানুষকে দেখা যাচ্ছে।নাডিয়া দূর থেকে তাদের চিনতে পারল। একজন ভ্লাডিমির ভেলিস্ক আর অন্যজনভলক’ভ রিয়াজন’ভ।

সে ভেতরে এসে লিঅ’নিডদের দিকে তাকিয়ে বলল – মস্কোর মানুষ দুজন ফিরে এল। তারা এর মধ্যেই পৌঁছে যাবে।’

‘ তাই নাকি?’ মিখাইল বলল।

সে জিজ্ঞেস করল–’ তুই মারিয়ার কথা কী বলতে চাইছিলি?’

নাদিয়ার এবার অজান্তেই লিঅ’উনিটের দিকে চোখ গেল। সে বলল–’ ডিমিট্রিগরিনের সঙ্গে মারিয়ারবিয়ের দিন ঠিক হয়েছে।’

‘ ডিমিট্রিগরিন?’লিঅ’নিড বলল –’ সে আমার বন্ধু। তাকে ভালোভাবে জানি।’

কথাটা বলার সময় সে নাডিয়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়েরইল।

‘ বড় ভালো খবর।’– মিখাইল বলল–’ বিয়েতে যেতে হবে। তবে এখন পিটার যেলেনক’ভের আসার ও সময় হয়ে গেছে।’

লোকগুলিকে এগিয়ে আনার জন্য লিঅ’নিডকেনিয়েমিখাইল ওদের কাঠের গেটের দিকে এগিয়ে গেল ।

ভ্লাডিমিরভেলিস্করা আসার কিছুক্ষণ পরে পিটার যেলেনক’ভ এবং অন্যান্যরা ধীরে ধীরে আসতে শুরু করল। লোকগুলির চুপচাপ এবং চিন্তান্বিত মুখগুলি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত থাকা ঘরের আনন্দের পরিবেশ দূর করে ধীরে ধীরে গম্ভীর করে তুলল।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২০) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে পিটার যেলেনক’ভ বললেন – আমরা আলোচনা আরম্ভ করতে পারি কি ?’

তিনি খবরটা জানতেন যদিও ভ্লাডিমিরভেলিস্ককে অন্যের জ্ঞাতার্থে মস্কো ভ্রমণের বৃত্তান্ত তুলে ধরতে বললেন।

ভ্লাডিমিরভেলিস্ক তার কথা গুলি বর্ণনা করে গেলেন–’ মিঃচট্টোভারতীয় যদিও গান্ধীরমতোঅহিংসায় বিশ্বাসী নন। তাই আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে কোনো ধরনের পরামর্শ সাহায্য পেলাম না।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি বললেন–’ আমার বোধে আমাদের নিজেকেই আমাদের কার্যপদ্ধতি স্থির করতে হবে।’

পরিবেশটা নীরব এবং গম্ভীর হয়ে পড়ল।

পিটার যেলেনক’ভ নীরবতা ভেঙ্গে বললেন–’ হ্যাঁ, আমাদের নিজেকেই আমাদের কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করে নিতে হবে, কিন্তু টলস্টয়ের আদর্শে এবং গান্ধী হাতে-কলমে দেখানো অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের সাহায্যে। এই অহিংস পন্থায় গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন করে জয়ীহয়েছিল। গত বারো বছর আগে ভারতে অহিংস পন্থায় অসহযোগ আন্দোলন করে মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পেরেছিল । আমাদেরকে এই ধরনের কার্যপন্থা হাতে নিতে হবে যাতে যাদের জন্য আমরা কাজ করব তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারি।’

তিনি বললেন–’ একসময়ের ব্যারিস্টার মহাত্মা গান্ধী স্বইচ্ছায়দরিদ্রতা গ্রহণ করেছে। তিনি সাধারণভাবে এবং ঋষির মতো গত দশ এগারো বছরের আগে থেকে জীবন যাপন করছেন। নিজে সুতো কেটে বোনা কাপড় পরে পঞ্চাশ বছর বয়স থেকে চাষাদের মতো বসবাস করছেন। আমাদের টলস্টয়ও ছাপ্পান্ন বছর বয়স থেকে চাষির জীবন যাপন করেছিলেন । সাধারণ এবং কোমল মনের মানুষের হৃদয় প্রবেশ করার এটাই হল প্রথম পদক্ষেপ।’

তিনি পুনরায় বললেন–’ আমাদের শীতপ্রধান দেশে গান্ধীরমতো স্বল্প পোশাক পরাটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয়কাপড়গুলি সাধারণ হলে খারাপ হবে না নাকি?’

এতদিনে লিঅ’নিড, মিখাইল,ভ্লাডিমিরভেলিস্ক,ভলক’ভ রিয়াজন’ভ এবং অন্যান্যরা দেখে আসা পিটার যেলেনক’ভের পোশাকটা সেদিনই তিনি প্রথম লক্ষ্য করলেন–তাঁর পোশাকও তেমনই খুব সাধারণ। মুখের দীর্ঘ দাড়িগুলিও চাষিদেরমতোই।তাঁর ব্যক্তিত্বের সেই দিকগুলি এতদিন চোখে না পড়ায় এডলার নিজে বড় অবাক হল।

যেলেনক’ভ বললেন–’ এই ধরনের সাজপোশাকে আমরা যদি জনসাধারণের হৃদয়ের আহ্বান প্রচার করতে চাই তাহলে তারা নিশ্চয় আমাদের কাছাকাছি চলে আসবে । তার জন্য আমাদের চাই কেবল প্রচার, আর প্রয়োজন অনুসারে একটি প্রচার পত্রিকা।’

তিনি বললেন–’ ভেসিলিদেরমাটি দখলের সময়েও হয়তো আমরা প্রচার পত্রিকা নিয়েনিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ করব। অস্ত্রশস্ত্র বিহীন হয়ে সম্পূর্ণ অহিংসভাবেগান্ধীরমতোসত্যাগ্রহ করব। সত্যাগ্রহ মানেই হল সত্যের প্রতি থাকা আমাদের আগ্রহ। সত্য হল মানুষের ভূমিস্বত্ব। সামন্তবাদ উঠে যাওয়ার পর থেকে, ভূমিদাস প্রথা অন্ত হওয়ার পর থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের নিজের স্বত্ব অটুট থাকতে হবে। কিছুটা জর্জবাদেরমতো মনে হলেও বর্তমানের জন্য ভূমিস্বত্বটাই আমাদের কাছে সততা। সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আমরা আগ্রহী।’

তিনি বললেন–’ প্রতিরোধ করা মানুষ যখন দশজন থেকে একশো জন হবে, হাজার জন হতে আর কত সময় লাগবে? নিরীহ মানুষের শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে শাসকদের তাদের কার্যসূচী পরিবর্তন করতে প্রভাবিত করবে। আমরা শুধু ভেসিলিদেরই নয় আশেপাশের চার-পাঁচটি জায়গায় হতে চলা উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদ খসড়া এক সপ্তাহের ভেতর প্রস্তুত করব ।’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পিটার যেলেনক’ভ পুনরায় বললেন – এখন ফমিশেভ,ঝুছুপ’ভ এবং চের্নভমহাশয়দের কাছে আমার অনুরোধ যে তাদের নিজেদের জায়গায় যেন এরকম অহিংস নীতির কথা প্রচার করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে।’

মানুষগুলি প্রস্তাবটিতে সায় দিল।

লিঅ’নিড এডলার পিটার যেলেনক’ভের কথাগুলি খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। এক সপ্তাহ পরে তিনি যখন পুনরায় আলোচনা সভায় ফিরে এলেন, তখন তিনি যেন অন্য যুবক হয়ে ফিরে এলেন।

যেলেনক’ভের সভার পরের দিন লিঅ’নিড এডলার অন্যান্য দিনের মতোই গণআদালতে হওয়া একটা বিচার প্রক্রিয়ার সাক্ষী হয়ে পড়েছিলেন । কিন্তু সেই বিচার প্রক্রিয়ার কথা গুলি লিখে যাবার সময় তার মনটা বিষাদে ঘিরে ধরেছিল। একজন ধর্মযাজক কোনো এক শ্রেণির কৃষকের ঘর মাটি ক্রোক করায় কৃষকদের নিয়ে বাধা দিয়েছিল। তখনই আরক্ষীরাওদেরছত্রভঙ্গ করে দেয়। তারপরে মানুষগুলি হাতে নিয়ে আসা চাষের সরঞ্জামগুলি নিয়েআরক্ষীদের আক্রমণ করতে শুরু করে। সেই সময়েআরক্ষীরাউগ্ৰ হয়ে পড়ে এবং পরের সারিতে থাকা বন্দুকধারীরা গুলি করতে শুরু করে। পনেরো কুড়ি জন আহত এবং দুজনের মৃত্যু হয়। ধর্মযাজকটিও মানুষের ঠেলা ধাক্কায় আহত হয়। সেভাবেই তাকে অন্য কয়েকজন মানুষের সঙ্গে ধরে আনে এবং বিচার করে। সেই বিচারে দীর্ঘ দাড়িরধর্মযাজকটি এবং কয়েকজনকেকয়েদির শিবিরে শ্রমিক হিসেবে পাঠানোর স্থির করে । বিচারালয়ের ঘর থেকে বেরিয়েই কোনো একজন ধর্মযাজকটিরমাথায় থাকা বিশেষ টুপিটার সঙ্গে তাঁর পা পর্যন্ত বিস্তৃত দীর্ঘ পোশাকটির ওপরের আলংকারিক অংশটা সরিয়েনিয়েযায়। 

বিচারপতির পেছনেরদেওয়ালে থাকা স্টালিনের একটি বিশাল চিত্রের দিকে মুখ করে বিচার প্রক্রিয়ার কথাগুলি লিখে থাকার সময়ইলিঅ’নিডের মনটা বিষাদে ভরে পড়ল। শেষ পর্যন্ত সে অস্থির হয়ে পড়ল। সারাদিন বিরক্ত করে থাকা এই অস্থিরতার শেষে যখন তার মনটা অস্বস্তিতে ভরে পড়ল তখন কার্যালয়ের ছুটির আগে আগে গণআদালতের অফিসারের সঙ্গে বাকবিনিময়হওয়ার সুবিধা না হতেই পদত্যাগ পত্র দাখিল করে সে কার্যালয় থেকে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল। তার মনে হল সে যেন বড় মুক্ত হয়ে পড়েছে।

সারারাত সে কথাগুলি চিন্তা করল এবং সকালে গতানুগতিকভাবেকার্যালয়ে যাওয়ার সময়বেরিয়ে গেল। সে গণআদালতের অনতিদূরে পার্কের মতো খোলা জায়গায় থাকা একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। সে দেখল আদালতে দু-একজন করে মানুষ আসতে শুরু করেছে। বিচারের জন্য কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোককে আনা হয়েছে। তার মধ্যে দুই একজন সম্ভ্রান্ত শ্রেণির মানুষকেও দেখা যাচ্ছে। বাইরে আর দশজন চাষা শ্রেণির মানুষ বিমর্ষ বদনে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং বিচারের জন্য আনা দু একজনের সঙ্গে ভাব বিনিময় করার চেষ্টা করছে।

লিঅ’নিড দূর থেকেই পুরো পরিবেশটা বুঝতে পারল। সে নুরা করে নিয়ে আনা ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করা একটা বড় কাগজ তার সামনে মেলে দুই হাতে তুলে ধরল। সেখানে সে গতরাতে লিখেছিল–’ অতীত থেকে থাকা মাটি বাড়ির ব্যক্তিগত স্বত্ব আমরা সমর্থন করি। আমাদের স্বত্ব আমাদের ফিরিয়ে দিক।’

লিঅ’নিড কাগজটা তুলে ধরে অনেকক্ষণ বসে রইল। হাতের ব্যথা হওয়ায় সে দুই একবার উঠে দাঁড়াল এবং হাতদুটো নিচে নামিয়ে পেটের ওপরে কাগজটা মেলে ধরল। আদালত এবং সে বসে থাকা জায়গার মাঝখানের পায়ে চলা পথ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া কয়েকজন মানুষ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

গণ আদালতের সামনে জমায়েতহওয়াকয়েকজনচাষি পথের অন্যপারে থাকা পার্ক জাতীয় খোলা জায়গার বেঞ্চে বসে থাকা লিঅ’নিডের ওপরে চোখ পড়ল। তারপর দুইজন মানুষ ধীরে ধীরে তার কাছে অ’এসে সে ধরে থাকা শক্ত কাগজ গুলি সামনে থেকে পড়তে লাগল। শহরের মানুষের মতো সাজ পোশাক পরা লি’অনিডের দিকে তারা অবাক   হয়ে তাকাতে লাগল। একজন তাকে জিজ্ঞেস করল– ‘এটাতো আমাদের কথা। আপনিও সমর্থন করেন?’

লি’অনিড হ্যাঁ বলে মাথা ঝাঁকিয়েসায় দিল।

মানুষটা একপাশে বসে পড়ল। বলল – আপনার নিশ্চয় হাতে ব্যথা রয়েছে।। কাগজটা আমাকে দিন।’

লিঅ’নিড ধরে রাখা কাগজটা মানুষটা হাতে নিয়ে তুলে ধরল।।

অন্য মানুষটি গণ আদালতের সামনে জমাট বেঁধে থাকা মানুষগুলির কাছে গেল এবং কিছু সময় কথা বলে সঙ্গে তিনজন অন্য মানুষ নিয়ে ফিরে এল। তাদের দুজন লিঅ’নিডের পাশে বেঞ্চে বসল।‌ অন্য দুজন বেঞ্চে বসে থাকা মানুষ গুলির পেছনদিকেদাঁড়িয়েরইল। 

মানুষগুলি নীরবে শক্ত কাগজ গুলি মাঝেমধ্যে একে অপরের হাতে দিল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলি হাতে নিয়ে  তুলে ধরল।

সামনের পায়ে হাঁটা পথ দিয়েআসা যাওয়া করতে থাকা আমলা অফিসার  এবং অন্যদিকে একজন মানুষ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে ফলকটা পড়ে মানুষগুলির দিকে তাকিয়ে যেতে লাগল।

গণ আদালতের সামনে থাকা আরও দুজন মানুষ  পেছনে গিয়েদাঁড়াল । আদালতের আশেপাশে কর্তব্যরতআরক্ষীতিনজনওদের দূর থেকে লক্ষ্য করছিল। ওদের সংখ্যা বেড়ে চলায় দীর্ঘ বুট জুতো পরা আরক্ষী অফিসার গটগট করে সেদিকেএগিয়ে গেল এবং ওদের সামনে পৌঁছার আগেই হুঙ্কার দিয়ে বলল – এখানে জমায়েত করতে দেওয়া হবে না ।’

একজন আরক্ষী অফিসার ওরা ধরে থাকা কাগজটা ছিড়ে ফেলল এবং অন্যজন সেখান থেকে মানুষগুলিকে সরে যেতে বাধ্য করল।

লোকগুলি দূরে সরে গেল।

লিঅ’নিড কিছুক্ষণ একা সেখানে দাঁড়িয়েরইল। একজন আরক্ষী অফিসারতার দিকে তাকিয়েজিজ্ঞেস করল–’ আপনি আদালতে কাজ করেন না?’

লিঅ’নিড বলল–’হ‍্যাঁ, করতাম। পদত্যাগ করেছি।’

সে যতটা সম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বলল।

আরক্ষী অফিসার বললেন – আদালতের কাজ যদি ভালো না লাগে তাহলে অন্য কাজ খুঁজে নিন। এসব করবেন না।’

লিঅ’নিড এডলার সেখান থেকে ধীরে ধীরে সরে যাওয়ায় অফিসারটি গম্ভীর পদক্ষেপে পুনরায় নিজের কাজে ফিরে গেলেন।

দিন তিনেক পরে লিঅ’নিড যখন নাডিয়ামিখাইলদেরবাড়িতেযেলেনক’ভের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত হল তখন সে অন্য দিনের মতোঅমায়িক ভাবে বসে কথা শুনতে থাকল না, সোজা হয়ে বসে আলোচনায় কথা বলা জ্যেষ্ঠ লোকদিগের দিকে তাকিয়ে ভাগ নিতে উদ্যত হয়ে রইল।

যেলেনক’ভ সেদিন সকলের মধ্যে দুটি করে ফটো বিতরণ করল। একজন পাক্কা দীর্ঘ চুলদাড়ি সহ বয়স্ক মানুষের এবং অন্যটি টাই কোট পরা উজ্জল চোখের যুবকের।

পিটার যেলেনক’ভ বলতে লাগলেন–’ আমরা সবাই টলস্টয়বাদী। আমাদের প্রিয়লিওটলস্টয়ের ফোটো সঙ্গে রাখতে হবে বলেই আমি সেই প্রথম ফোটোটা আপনাদের দিলাম। আর সঙ্গে দিলাম মহাত্মাগান্ধীরআফ্রিকায় থাকার সময়ে যুবক কালের ফোটো। তার সেই তরতাজা ফোটোটা আমাদের গান্ধী পন্থায় কাজ করার জন্য নিশ্চয় প্রেরণা দান করবে। আমাদের মাত্র মানুষের মধ্যে অহিংসার শক্তি কত বোঝাতে পারতে হবে।’

লিঅ’নিডএডালার এইরকম সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে বসে থাকা চেয়ারটিতে সোজা হয়ে পিটার যেলেনক’ভের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল–’ মহাশয়রা, চার দিন আগে যেন আমার সেরকম একটি অভিজ্ঞতা হল। তার আগেরদিন আদালতে চলা একটা কেসের বিচারের প্রতি বিরোধ ভাব মনে জাগার জন্য আমি আমলার পদ থেকে পদত্যাগ করলাম এবং তার পরের দিনই আমাকে অহিংস শক্তির প্রভাবের অভিজ্ঞতা বলীয়ান করে তুলল।’

লিঅ’ নিডের কথাগুলিতে আত্মবিশ্বাস বড় স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হল। সেকেসটির কথা এবং পরেরদিন পার্কের বেঞ্চে বসে প্রদর্শন করা কাগজগুলি আহ্বান দিয়ে আনা অন্য পাঁচজন মানুষের কথা বিবৃত করে বলল ।

তার কথাগুলি লেনিনগ্রাডে স্থায়ী অস্থায়ীভাবে বাস করা প্রতিটি মানুষ ভালোভাবে শুনে গেল। নাডিয়া মা মাছা রমান’ভনাকে রান্নাঘরে দুই এক পদ কাজ করে সাহায্য করছিল।লিঅ’নিডের অপরিচিত ধীর গম্ভীর কথা তার অন্তর স্পর্শ করে গেল ।মা ও কফি ঢালার কাজ বন্ধ করে তার কথা শুনতে লাগল ।

লিঅ’নিড বলে গেল – আমি কাউকে সঙ্গে নিইনি। আমার সঙ্গী ছিল কেবল কাগজটা এবং তাতে লেখা কথাগুলি। আমি কাউকে আহ্বান করিনি, কোনো শ্লোগানদিইনি। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে দুই একজন করে পাঁচজন মানুষকে আমি আকর্ষণ করতে পারলাম । আমার সামনে দিয়ে যাওয়া আমলা অফিসার এবং কাছাকাছি কিছু কাজে আসা কয়েকজন মানুষ আমাদের ফলকটি এবং আমাদের দেখে গেল।’

সে বলে গেল–’ সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল অন্য কাজে ব্যস্ত থাকা তিনজনআরক্ষীর মধ্যে দুজনকে আমাদের কাছে আসতে বাধ্য করল। আমি এখন বুঝেছি।’

সে বলল–’ অহিংসা শক্তির প্রভাব প্রবল।’

সমস্ত মানুষ স্বল্পভাষীলিঅ’নিডের দিকে একদৃষ্টেতাকিয়ে ছিল । তার কথা শেষ হওয়ায় প্রত্যেকেই অল্প সময় চুপ করে রইল। রান্নাঘরের নাডিয়া এবং মাছা রমান’ভনাও স্থির হয়ে অপেক্ষা করে রইল।

নীরবতা ভঙ্গ করে দীর্ঘ দাড়িতে এবার কোমল ভাবে হাত বুলিয়েযেলেনক’ভ বললেন – বড় ভালো কাজ শুরু করেছ যুবক। তোমার আমাদেরও খবর দেওয়া উচিত ছিল।’

‘ কিন্তু,’– তিনি বললেন– ‘আমাদের কার্যপন্থা হবে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ কেবল প্রচার নয় । সরকার আমাদের বিরুদ্ধে নীতিবিরুদ্ধ কার্যপন্থা হাতে নিয়েছে সেই কার্যপন্থার বিরোধ করে প্রতিরোধ করাটাই হবে আমাদের কার্যপন্থা। তাই ভুক্তভোগীদেরহৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করাটাই হবে আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ। এই বিষয়ে লিঅ’নিডের অভিজ্ঞতা আমাদের নিশ্চয়সহায় করবে ।’

পিটার যেলেনক’ভের বক্তব্য সবাইকে পুনরায় একবার লিঅ’নিড এডলারের  দিকে তাকাতে বাধ্য করল। সাধারণত অমায়িক ভাবে নীরবে থাকা তার উজ্জ্বল মুখ এবং চোখ দেখে মানুষগুলি আশ্চর্য হল।

‘ কিন্তু একটি কথা,’– যেলেনক’ভ বললেন – আমাদের কিছুটা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এখনই আরক্ষীর চোখে পড়ার মতো কাজ করলে আমাদের লক্ষ্যে বাধা আসতে পারে।’

মানুষটার কথা বুঝতে না পেরে সমবেত মানুষগুলি তার মুখের দিকে তাকিয়েরইল।

যেলেনক’ভ পুনরায় বললেন–’ আমাদের ভেশিলিদের অঞ্চলে প্রথম কাজ করতে হবে। তাই অন্য অঞ্চলে কী ধরনের পরিস্থিতি হয়েছেসেকথা জানলেই আমরা আমাদের কার্যপন্থার খসড়া তৈরি করতে পারব । তাই –।’

তিনি জর্জিয়ারনিকোলাইচের্নভের দিকে তাকে জিজ্ঞেস করলেন – আপনার কিছু বলার আছে কি ?’

নিকোলাইচের্নভ বললেন–’ আমাদের কথার চেয়েইউক্রেইনের কথাই আলোচনা করা উচিত। গত চার বছর আগে থেকে আরম্ভ হওয়া পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পর থেকে যৌথ পাম, যৌথ উদ্যোগের নামে সেখানে অনেক জোর জুলুম চলছে । ইউক্রেইনএমনিতে খাদ্যের ভান্ডার। সেই জন্য মস্কোতে পাঠানোর জন্য শস্যের কিস্তি সেখানে নির্ধারণ করে দেওয়াহয়েছে। সেখানেই কৃষকদের বিরোধ করে নিজেদের চাষের জমিও নাকি জ্বালিয়েদেওয়াহয়েছে। সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।’

পিটার যেলেনক’ভ বললেন–’ মানুষগুলি হিংসায় নয় শান্তির দ্বারা বিরোধ করা উচিত ছিল।’

‘হ‍্যাঁ,’– নিকোলাইচের্নভ বললেন–’ তিন বছর আগেই, মানে ১৯২৯ সনে স্টালিন ইউক্রেইনে এক লক্ষের মতো তাঁর বিশিষ্ট সৈনিককে পাঠিয়েছিল।‌ তাদের মাধ্যমে আরও তিন চার হাজার পন্ডিত, বিজ্ঞানী, সামাজিক শিল্পী এবং ধার্মিক কিছু নেতাকে তিনি গ্রেপ্তার করান। দলের শুদ্ধিকরণের নামে অনেককে বহিষ্কার করেন। আর বাকিদের অজুহাত বের করে হত্যা করেন।’

কাজাখ অঞ্চলের শ্বিগানভঝুছুপ’ভ এতক্ষণ চুপ করেছিল। তিনি বললেন–’ হত্যা? হত্যা যেন বড় সাধারণ কথা। গম চুরি করলেও নাকি হত্যা করে। সঞ্চিত খাদ্য রাখতে পারে না। বাড়িবাড়িখানাতল্লাশি চলে। বাইরে থেকেও খাদ্য আসতে দেয় না। তাই বাড়িতে একটা গম থাকলেও দশ বছরের কারাদণ্ড ভুগতে হয় মৃত্যুর মুখে পড়তেহয়।’

‘হ‍্যাঁ।’ নিকোলাইচের্নভ পুনরায় বললেন–’ বাড়িতে থাকা পুরুষ, যুবক সন্তানহীন মহিলা এবং যুবতিদের সামগ্রিক পাম, যৌথ উদ্যোগ, খনি এবং কারখানার দাস শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিয়ে গেছে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন মানুষ মরতে শুরু করেছে।’

‘হ‍্যাঁ।’–শ্বিগানভঝুছুপ’ভ বললেন–’ বাড়িতে শিশুনিয়ে থাকা কিছু মহিলা খাদ্যের অভাবে নিজের শিশুকে শহরে নিয়ে যাওয়া চলন্ত রেলগাড়ির লোকের উদ্দেশ্যে ছুঁড়েদিয়ে ভালো ভাবে রাখতে চিৎকার করে বলছে। এতটাইদুঃখজনক হয়ে পড়েছে দেশের পরিস্থিতি।’

কাজাখ এবং জর্জিয়ার দুজন মানুষ চুপ করে থাকায় পরিবেশ গম্ভীর হয়ে পড়ল।

মস্কোরভ্লাডিমিরভেলিস্ক বললেন–’ আমরা আমাদের এখানকার পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতে দেব না।’

ভলকভরিয়াজনভ বললেন – হ্যাঁ আমরা এসবের প্রতিরোধ করব । ‘

কাজানেরয়ুরিফমিচেভেও প্রস্তাবে সায় দিলেন। ভেসিলিয়েভএতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ পরে বললেন–’ আমাদের এখন ভেসিলিদের উচ্ছেদের প্রতিরোধের কথা ভাবতে হবে । আমার বোধে আমরা সকলেই একসঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করাটা ঠিক হবে না।’

পিটার যেলেনক’ভ মিখাইলের দিকে তাকিয়ে বললেন–’ হ‍্যাঁ, যুবক তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সে কথা ভাবতে হবে।

কিছুক্ষণ থেমে সকলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–’ মিখাইলের বক্তব্য অনুসারে ভেসিলিদের ওখানে আমরা সবাই একসঙ্গে যাব না ।আমি, ভ্লাডিমিরভেলিস্ক এবং য়ুরিফমিসেভ যাব। পড়ে আমাদের কাছে প্রতিরোধের জন্য ভলক’ভ রিয়াজনভের সঙ্গে মিখাইল এবং শ্বিগানকঝুছুপ’ভ যাবে । আর যখন এই অঞ্চলের প্রতিরোধের কথা আসবে তখন ভিক্টর একছুর্স্কির সঙ্গে নিকোলাইচের্নভ এবং লিঅ’নিড থাকবে।’

পিটার যেলেনক’ভ বললেন–’ আমরা এখন এই তিন ভাগে আমাদের নিজ নিজ অঞ্চলের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে হবে। তারপরে প্রতিরোধের নিয়মের কথা তাদের মধ্যে প্রচার করতে হবে।’

সেদিনের আলোচনার অন্ত পড়ল। নাদিয়া এবং মাছা রমানভ’না পরিবেশন করা কফি খেয়েভ্লাডিমিরভেলিক্স যখন বাড়ির দরজা দিয়েবেরিয়ে এল, তখন রাস্তা দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার দুজন মানুষের উপরে তার চোখ পড়ল। তারই একজনের মুখটা যেন তার পরিচিত। পার হয়ে যাওয়ার সময়বাঁ হাত দিয়ে দুবার দু’দিকের মুচে তা দিয়ে যাচ্ছে। 

কফি দিতে আসা নাডিয়ারআস্থাভরা সপ্রশংস দৃষ্টির কথা ভেবে ভেবেলিঅ’নিড এডলার ফিরে আসার সময় পথে ওদিক থেকে আসা একজন আরক্ষী অফিসারকে দেখতে পেলেন। কাছাকাছি আসায় তিনি বললেন–’ শুভ সন্ধ্যা মিষ্টার এডলার’।

‘ শুভ সন্ধ্যা’–লিঅ’নিডপ্রত‍্যুত্তরদিয়ে অপরিচিত আরক্ষীঅফিসারের দিকেপ্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘ আমি পাভল’ভ টেলপুগ’ভ।’ অফিসারটি বললেন–’ গণআদালতের আশেপাশেই আমি কাজ করি।’

লিঅ’নিড এডলার অফিসারটিকে চিনতে পারলেন। তিনিই সেদিন পার্কের বেঞ্চ থেকে তাদের সরিয়েপাঠিয়ে তাকে অন্য কাজ খুঁজে নিতে বলেছিল ।

‘ আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগল মিঃটেলপুগ’ভ।’

লিঅ’নিড করমর্দন করলেন ।

‘এদিকে নিশ্চয় বন্ধুর বাড়িতেগিয়েছিলেন, নয় কি মিঃএডলার?’

লোকটির কথায় সায় দিয়ে সরে এলেন যদিও লিঅ’নিডের কপালে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।

তখনও সন্ধ্যা হয়নি। খোলা পথের আশেপাশে থাকা টেলিগ্রাফের ধাতুর ফাঁপা খুঁটিগুলি থেকে গো়ঁ গোঁ শব্দ ভেসে আসছিল।

শহরের কাছে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।লিঅ’নিড এডলারকে মুক্ত পথটি দিয়েছায়ারমতো যেতে দেখা গেল। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত