
কমলকুমার মজুমদার
কমলকুমার মজুমদারের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৪ নভেম্বর কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে। পিতা প্রফুল্লচন্দ্র মজুমদার, মা রেণুকাময়ী মজুমদার। পিতামহ বরদাকান্ত মজুমদার, তাঁদের স্থায়ী নিবাস চব্বিশ পরগণা জেলার টাকীতে। কমলকুমারের জন্মকালে তাঁর পিতা পুলিশ অফিসার হিসেবে কলিকাতায় কর্মরত, থাকতেন ভাড়া বাড়িতে। সাঁওতাল পরগণার রিখিয়ায় তাঁরা বাড়ি করেছিলেন। এ হিসেবে কমলকুমারের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয় বিচিত্রস্থানে। আধুনিক বাঙলা কথাসাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিগণিত। তাঁকে বলা হয় 'লেখকদের লেখক'। তাঁর উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা অনন্যপূর্ব আখ্যানভাগ ও ভাষাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। বাংলা কথাসাহিত্য বিশেষ করে উপন্যাস ইয়োরোপীয় উপন্যাসের আদলে গড়ে উঠেছে। কমলকুমার মজুমদার সেই অনুসরণতা পরিহার করেছিলেন।
তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুরূহতম লেখকদের এক জন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলেন; যেমন সুহাসিনীর পমেটম উপন্যাসে ২৫০ পৃষ্ঠায় যদি-চিহ্ন বিহীন মাত্র একটি বাক্য লক্ষ করা যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের দুবোর্ধ্যতম লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। দীক্ষিত পাঠকের কাছে কমলকুমার অবশ্যপাঠ্য লেখক হিসেবেই সমাদৃত হলেও অদ্যাবধি তিনি সাধারণ্যে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য ভাবে, বাংলা সরকারের জনগণনা বিভাগ, গ্রামীন শিল্প ও কারুশিল্প, ললিতকলা অ্যাকাডেমি এবং সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। এ ছাড়াও তিনি ছবি, নাটক, কাঠের কাজ, ছোটদের আঁকা শেখানো, ব্যালেনৃত্যের পরিকল্পনা, চিত্রনাট্য রচনা করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
১৯৬৯ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'অন্তর্জলি যাত্রা' প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ 'নিম অন্নপূর্ণা' প্রকাশিত হয়। পরবর্তী গ্রন্থাবলী: গল্পসংগ্রহ, পিঞ্জরে বসিয়া শুক, খেলার প্রতিভা ও দানসা ফকির।
তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসসমূহ হল: অন্তজর্লি যাত্রা, গোলাপ সুন্দরী, অনিলা স্মরণে, শ্যাম-নৌকা, সুহাসিনীর পমেটম, পিঞ্জরে বসিয়া শুক এবং খেলার প্রতিভা। ছোটগল্প গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: অন্নপূর্ণা, গল্প সংগ্রহ। একদিকে, ভাষায় আর অপরদিকে বিষয়ে নির্জনতা দুয়ের মধ্যবর্তী পথে বিচরণ করে কমলকুমার সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর চিরায়ত কাহিনিগুলো। বহমান বাঙালিত্বকে রূপময়তায় চিত্রায়িত করেছেন, শহুরে জীবনে থেকে খুঁটিয়ে দেখেছেন কৌম জীবন, তার আখ্যান লিখেছেন অপরিচিত জগতের অন্যরকম জীবন ও জীবিকার ছোঁয়ায়, যা অন্তিমে হয়ে উঠেছে ধ্রুপদী। তা কি ভাষার গুণে, না দেখার অনন্যতায়? কমলকুমারের জীবদ্দশায় পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল দুটি মাত্র উপন্যাস আর দুটি গল্প সংকলন। বিচিত্র জীবন ও আশ্চর্য সব জীবিকা গ্রহণের অন্তে তিনি কিন্তু মনোনিবেশ করেছিলেন কাহিনিবিন্যাসে, যা হয়ে উঠেছে শেষপর্যন্ত লেখকরূপেই তাঁর প্রধান পরিচয়।
