
সত্যজিৎ রায়
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি চলচ্চিত্রকার; আলোকচিত্রী, চিত্রকর, শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও সুপরিচিত। ১৯২১ সালের ২ মে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে। পিতা প্রখ্যাত লেখক, সম্পাদক ও আলোকচিত্রী সুকুমার রায় ছিলেন রয়াল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন-এর ফেলো। তাঁর মাতা সুপ্রভা রায় ছিলেন একজন সঙ্গীতশিল্পী ও হস্তশিল্পে পারদর্শী এবং তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীও ছিলেন প্রখ্যাত লেখক, শিশু সাহিত্যিক, চিত্রকর, আলোকচিত্রী, ব্লক ডিজাইনার এবং শিশুতোষ পত্রিকা সন্দেশ (১৯১৩)-এর সম্পাদক। জন্মের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই পিতাকে হারিয়ে মামার আশ্রয়ে দৃঢ়চেতা মাতার তত্ত্বাবধানে সত্যজিৎ রায়ের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয়। বালিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বি.এ পাসের পর ১৯৪০ সালে সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন।
১৯৪৩ সালে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। বিজ্ঞাপনের ভাষা ও ডিজাইনে তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। প্রায় একই সময়ে তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ এবং পত্রিকায় ছবি অাঁকা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায় গঠন করেন কলকাতা চলচ্চিত্র সংসদ। পরবর্তী বছরে তাঁর সুযোগ ঘটে ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। রেঁনোয়া তাঁর পরিচালিত দ্য রিভার ছবির কিছু অংশ কলকাতায় শুটিং করেন এবং সত্যজিৎ তা প্রত্যক্ষ করেন।
পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে তিনি গঠন করেন ‘কনক পিকাচার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ এ সময় এ পারফেক্ট ডে নামে একটি চিত্রনাট্য রচনা করেন।
১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী নিউইয়র্কে প্রদর্শিত হয় এবং ঐ বছরই, আগস্টে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। মুক্তির পরপরই ছবিটি সারা বিশ্বে প্রশংসা লাভ করে এবং পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করে। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালী রাষ্ট্রপতি ও পশ্চিমবঙ্গ সাংবাদিক সমিতির পুরস্কার লাভ করে। ঐ বছরই ছবিটি ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ হিসেবে জুরি বোর্ডের বিশেষ পুরস্কার অর্জন করে।
লেখক হিসেবেও সত্যজিৎ রায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে: বিষয় চলচ্চিত্র, একেই বলে শুটিং, আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস, ফেলুদা সিরিজ, শঙ্কু সিরিজ, পিকুর ডায়েরী ইত্যাদি। পুরস্কার: পথের পাঁচালী-এর জন্য ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬-এর মধ্যে ভারত ছাড়াও মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার; অপরাজিত পেয়েছে ভেনিস, সানফ্রান্সিসকো, বার্লিন, ডেনমার্কসহ ৫টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ইনার আই’ এবং টিভি চিত্র ‘সদগতি’ও পেয়েছে দেশ-বিদেশের পুরস্কার। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি পেয়েছেন বিশেষ সম্মান ও পুরস্কার। তিনি ভারত সরকারের নিকট থেকে ৪০টি পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৬০টি পুরস্কার লাভ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে দেশ-বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ম্যাগসেসেই পুরস্কার, ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন অব অনার’ (১৯৮৭), ‘ভারতরত্ন’ (১৯৯২), বিশেষ ‘অস্কার’ (১৯৯২) পুরস্কার ইত্যাদি। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু হয় ।
