মণিষকে যদি তার কোন বন্ধু জিজ্ঞাসা করত তার বউ বন্দনা সেনের কথা যে, বন্দনা কেমন আছে? সে ঠোঁট উল্টে জবাব দিত একদা কোন এক দিন বউ ছিল এখন সে আবার ইন্ডিয়ায় ফিরে গেছে। শিক্ষিত বন্ধু তাই আর পরের প্রশ্ন করেনি কনো দিন। বন্ধুরা বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য বন্দনার কোন খবর নেয়নি। মণিষ আবার বিয়ে করেছে আমেরিকার মেয়েকে এবং এখন তার পূরবের কোন উতপাত নেই সে খুব শান্তি ও সুস্থতার সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে।মনিষ কলকাতার ছেলে থাকে ডাব্লিনে, সেটা ইষ্টবেএরিয়ার ঠান্ডার শহর। মণিষ বিজ্ঞানি, সে কেন্সার নিয়ে রিসার্চ করছে।বুদ্ধিমান প্রথম থেকেই এবং এক কথার মানুষ, যাকে বিয়ে করবেই বলে ছিল সে ওই বন্দনা সেন।
বন্দনা প্রেসিডেন্সির সোসিওলজির ছাত্রী, সবে বি-এ পাশ করেছে। ফাস্টক্লাস ফাস্ট। ছোট্ট বন্দনা কত আর বয়স! সবে একুশ! দু-চোখে স্বপ্ন, সমাজের সমস্ত সন্তানদের থাকতে দেবে তার মা আর বাবা, কাকা আর কাকিমা, মামা আর মাসি আর আর তুতো ভাই পড়সির আত্মীয়দের সঙ্গে।অদম্য উদ্যগে সে সোসিওলজিতে মাটারস করার জন্য ফর্ম তুলেছে জমাও করেছে নাম উঠেছে লিস্টের একে বারে এক নাম্বারে, সুতরাং ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু বাধা এলো এক বিশাল পাহাড়, সে মণিষ। বাবার বন্ধুর ছেলে আমেরিকায় থাকে, বিজ্ঞানি, বিশাল মাইনে, আর বন্দনা পড়বে সেখানে, বন্দনার বাবা-মা এই প্রস্তাবে এত খুশি হলো যে দেরি করল না। শুভদিন সুলগ্ন দেখে মনিষের সঙ্গে বিয়ে দিল। মনিশের বাবা মাও খুব আহাল্লাদিত বন্দনাকে বউমা হিসাবে পেয়ে।
বিয়ের পরে কয়েক মাস বন্দনা এখানেই থাকল, বাবা মা দুজনে ওই কলেজে পড়ান, বন্দনার বিয়ে দিয়ে যেন পৃথিবীর কাজ সম্পন্ন করেছেন, দিন-রাত ফুরফুরে হাওয়ায় কেবল ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আজ এই সেমিনার তো কাল সেই সেমনার, আর মুখে মাঝে মাঝে জামায়ের রিসার্চের গল্প।
দেখতে দেখতে কয়েক মাস পেরিয়ে গেলো, বন্দনা বিয়ে করেও আগের মতোই উজ্জল আচ্ছে সেই ভাবনার নড়চড় নেই , পৃথিবীর সমস্ত বাচ্চাদের মা বাবা,মামা-মাসি, কাকা কাকিদের আর আর তুতো ভাইদের সঙ্গে বাস করতে দেবে। এমন পড়া শুনা করবে আর তার আবিস্কার হবে এই যে, কেউ আর একা থাকবে না।এই সব ভাবতে ভাবতে এক দিন মণিষের মেইল এলো এখন সে তার স্ত্রীর আমেরিকা যাবার সব ব্যবস্থা করেছে। ব্যাস বন্দনার কলেজে পড়ানো বাবা মা আর মণিষের বাবা মা সকলে মিলে চললেন আমেরিকা। কাটল কয়েক দিন আমেরিকায় তার পর বাবা মায়েদের চলে যাওয়া ভালো লাগেনি বন্দনার যেমন তেমনি আমেরিকায় পড়বে সে টাও তার ভালো লাগেনি তাই সে কেবলই প্রেসিডেন্সির গল্প শোনাতে থাকল মণিষকে। মণিষ বিজ্ঞানি সারা দিন ল্যাবে থাকে। কতই না জীবাণু এক টার পর একটা মারার চেষ্টা করে, কিছু জীবানু মরে কিন্তু জন্মায় হাজার হাজার।
বন্দনা মণিষের জীবাণু গল্পে মন দিতে পারে না সে এখানেও দেখে বাচ্চারা একাই কাঁদে আর মাঝে মাঝে কান্না থামিয়ে মুখে ভরা চুষি চোষে। মণিষ বন্দনার প্রতি অমন যোগি আবার বন্দনাও তাই, কাওকে সে গুরুত্ব দেয় না শুধু আবার প্রেসিডেন্সিতে ফিরে আসতে চায়। বন্দনা দিন দিন কেমন বিষণ্ণ হয়ে যেতে থাকল, কিছু দিন পরে বন্দনার বাবা ফোন করে জানালো যে, সে গানের যে বিশারদ পরীক্ষা দিয়ে ছিলো তাতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে, বন্দনা সঙ্গে সঙ্গে বলল বাবা দেশে ফিরে যাবো, আমার এখানে ভালো লাগে না, মা কে ফোন দাও, মাকেও একই কথা জানায়, মা এখানে ভালো লাগে না, প্রেসিডেন্সিতে ফিরে যেতে চাই।
মা বাবা দুজনেই চমকে ওঠে, সে কি কথারে! আকাশের চাঁদের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি! তোর চারিপাশে হাজার তারা, তোর অসুবিধা কোথায়? বন্দনা তার সভাব অনুযায়ি, বলল, না-না ও কিছুনা, আমার কেবল ভালো লাগছে না। বন্দনা মনে মনে বলে, এখানে আকাশ আছে নক্ষত্র আছে চাঁদ আছে কিন্তু অক্সিজেন নেই মা, আমার ভালো লাগে না। বন্দনা তার বাবা মাকে যেমন অতিষ্ঠ করে দেশে যাবার জন্য তেমনি মণিষকে ও। কেউই তার কথায় কান দিল না, সকলেই ভাবল সে এক সময় ঠিক হয়ে যাবে।
মণিষ বাড়ি ফিরে এলে বন্দনা বেরিয়ে পড়ে বাড়ির বাইরে, মণিষ তাঁকে খুঁজতে বেরোয়, বন্দনা সে একা পাহাড়ের উপরে গিয়ে বসে থাকে, মণিষ তাঁকে জোর করে গাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে আসে, বোঝায় আমেরিকা কত সুন্দর। বন্দনা বলে, নিশ্চয় সুন্দর তবে আমার ভালো লাগছে না। মণিষ বলে বন্দনা, আমাকে আমার কাজকে তোমার ভালো লাগে না? বন্দনা ফিক করে হেসে বলে তোমাকে আমার আশার ক্যান্সরের জীবানু মনে হয়।
মণিষ এই কথা শুনে ভাবতে থাকে আবার ভাবতে থাকে এবং ভাবতে থাকে। কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে রাখে, কিছু ক্ষণ আকাশের দিকে তাকায় তারপর বলে, বাকি পড়াটা কি পড়বে না বন্দনা? বন্দনা সহজ জবাব–পড়বো তবে প্রসিডেন্সিতে, এখানে নয়, বলেই চুপ হয়ে যায় অনেক ক্ষণ চুপ থাকে তার পর আরো পাঁচ দিন দশ দিন চুপ হয়ে যায়, যেন বোবা কালা সে । মণিষ একদিন আবার বন্দনা কে বলল, তোমার কি আমাকে পছন্দ নয়?
বন্দনা অনেকক্ষণ চুপ থেকে জানায় নিশ্চয় পছন্দ তবে আমার ফার্স্ট চয়েস প্রেসিডেন্সিতে মাস্টারস করা, কিন্তু তোমার জন্যই হলো না, বন্দনা মাথা নাড়িয়ে বলে, না-না ঠিক বললাম না, বাবা মায়ের জন্যই হল না, দেখো আবার ভুল বললাম, আমার জন্যই হল না গো। আমি বলতেই পারলাম না যে আমি পড়াকে প্রেম করি- হা-হা-হা- করে হাসতে হাসতে হাসতে বলল একেবারেই ভুল বললাম, আমার পড়া হল না কেবল তা তোমার আর তোমার জেদের জন্য। হ্যাঁ এটাই ঠিক। হা-হা-হা-হা-হা-হা-হা-হা।
মণিষ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বন্দনার চোখের দিকে, সে দেখতে পায় বন্দনা ঠিক নেই, অসংলগ্ন কথা বলছে । তাকে ডাক্তার দেখানো উচিত।
এখানে ডাক্তার দেখানোর হাজার একটা বায়ানাক্কা তাছাড়া গাদাগাদা ডলার দাও, তবুও স্ত্রী বলে কথা! অনেক সময়বার করে এক মনরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে গেলে, তিনি বলেন সিজোফিনিয়ার লক্ষণ এখনই উপযুক্ত সময় চিকিৎসার। মণিষের মাথায় বাজ পড়ল যেন। এই কথা শুনে তার সুন্দর চকচকে বুদ্ধি চৌখুশ মুখের উপর দিয়ে যেন কালোমেঘ ঘনিয়ে উঠল। মনের ভিতরে এক-দুই করে হিংসারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, কেন এমন হল! তাহলে কি তার আগে থেকেই ছিল? শ্বশুরমহাশয় একবার বললেন না! আর বন্দনা? সে? সে তো বলতে পারত? এতো সময় কোথায় যে আমি তার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াব! মণিষ মনে মনে সমস্ত আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে লড়ায় করে মারামারি করে রক্তাক্ত হয় হঠাৎ মনে পড়ে এখন এখানে কেউ নেই সে নিজের সঙ্গেই এমন যুদ্ধ করছে। মণিষ গাড়ি চালাচ্ছিল এবং ঠিক ভাবেই চালিয়ে বাড়ি এলো, বন্দনা বলল আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কেনো? আমিতো অসুস্থ নয়! ও বিজ্ঞানি তুমি কি বাড়িটাকে ও ল্যাব বানিয়ে ফেলেছো? আমি কি তোমার রিসার্চের সাবজেক্ট?
মণিষ চুপ থাকে ও একা থাকার চেষ্টা করে, রাত্রি হতেই মণিষ তার মাকে ডায়াল করে জানায় সব কথা, মা বিশ্বাস করেন না, কারন বন্দনাকে তিনি অপরিচিতের ঘর থেকে আনেন নি, বন্দনা ছোট থেকেই তার মায়ের কাছে পরিচিত। মনিষের বুঝতে ভুল হচ্ছে। মনিষ তার শ্বশুরকে জানায় সব কথা যে, তার সময় কোথায় যে বন্দনাকে নিয়ে বসে থাকবে? বন্দনাকে যেনো দেশে নিয়ে যেতে আসেন। তারপর মণিষ আর খবর নেয় নি, অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, আইন-কানুনে না গিয়ে দুই বাড়ি মিউচুয়েল ডিভোর্স করে নিয়েছে। মণিষ পরে আমেরিকান লেডিকে বিয়ে করে যে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলো, মণিষ তার বউ একসঙ্গে কোথায় না উড়ে যায়! ছুটি পেলেই আকাশের নিচে কখন চিল হয়ে কখনও বা বাজপাখির মতো মেঘ থেকে মেঘেদের দেশে দেশে উড়তে উড়তে কোন এক সবুজ মাটিতে নেমে পড়ে কেবল দৌড়ায়। খুব ভালো সাঁতার জানে মণিষ। এটা অবশ্য তার মায়েরই কৃতিত্ব। প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরে লেকে নিয়ে যেত সাঁতার শেখাতে। মণিষ বাইচ কম্পিটিশন করে। এখানে সে খুব উপোভোগ করে জীবন কে। সে রে ম্যারীল্যান্ডের বীচে পরিবারের সঙ্গে উইক এন্ড কাটাতে এসেছে।, বউ রোথসচাইল্ড বীচে গরম বালির উপরে কাঠ কুমিরের মতো শুয়ে শরীর সেঁকে নিচ্ছে। ছোট ছেলে মণিষের কাছে মাঝে মাঝে ছুটে আসে আবার সমুদ্র উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যায়। মণিষ আর বাঙালিবাবা নয় যে দৌড়ে যাবে আতঙ্কিত হয়ে জলে খুঁজবে যে ছেলে কোথায়? বড়ো মেয়ের জন্য প্রথম প্রথম এই ভাবে উৎবেলিত হতো কিন্তু রোথস বোঝাত এমন শারীরিক প্রকাশ বাচ্চাদের সেলফকনফিডেন্সের জন্য ভুল পদক্ষেপ। এই সব কথা বুঝতে বুঝতে মণিষের মন কোথায় হারিয়ে যেত! খোয়ামনকে আবার ঘাড় ধরে নিয়ে আসত আর ল্যাবের কাঁচের জারে ভরে রেখে বলত , যদি কোন দিন সময় পায় তো…!
মণিষকে তার মা ভায়োলিন বাজাতে শিখিয়েছিল আর সে ভায়োলিন মণিষ এখনও বাজায় তবে একা আর একাকি কনো পাহাড়ের পাথরের কোলে না হলে সমুদ্র তীরে বালুর সাগরে। রোথস এই সুর খুব ভালোবাসে তবে এই সুর সে দূর থেকে আরো দূরে ভাসিয়ে এনে তারপর কান পেতে কানে করে শোনে। মণিষ একমনে ভায়লিন বাজাচ্ছে, কে যেনো পিছন থেকে তার কাঁধে এসে হাত রাখল। মনিষ টের পায় কিন্তু তখনও বেহালার কান্না থামাতে পারল না মনিষ পুরোটা বাজিয়ে থামল অতি যতনে। পিছন দিকে তাকাতেই হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল, বুকটা এখনো বাঙালির মতো ডিপ করে ওঠে তার, ওমা অমর্ত্যসেন! তিনিও বুঝি ম্যারিল্যান্ডের বীচে! মানুষটি হা-হা-হা-করে হেসে উঠল, আসলে কি জানো মণিষ যাকে ভালোবাসে তার ছবিই সবার মুখে দেখতে পায় হা-হা-হা। মনিষ গাল টানটান করে হাসে তার পর উঠে দাঁড়ায় আর বন্ধু জামানের গলা জড়িয়ে ধরে তার পর তাঁকে কাঁধে তুলে সমুদ্রের জলে ঝাঁপসাঁতার। তারপর থিতু। মণিষ তার জীবনে এই জামানের সঙ্গেই এই ভাবে খুনসুটি করতে পারে।জামান তার গ্রাজুয়েটের বন্ধু। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটিতে যখন পড়তে আসে তখন থেকেই জামানের সঙ্গে বন্ধুত্ব। জামান বাংলাদেশের বান্দরবানের ছেলে, একই সাবজেক্ট নিয়ে পড়া-শুনা ছিলো দু-জনের। বাংলায় কথা বলা থেকে বাংলার দুষ্টুমি সবই মিলে যেতেই সেই থেকে হরিহর হয়েছে তারা আর তা আজও তেমনিই আছে। মণিষ প্রশ্ন করে, তোর লন্ডন কেমন লাগছে জামান ?
জামান মাথা নাড়িয়ে জানালো, ভালো খুব ভালো। তবে দেশের জন্য তো কিছু একটা করতে হবে তাই দেশে একটা হসপিট্যাল তৈরি করছি, ক্যান্সারের। এখনও কমপ্লিটহয় নি ভাবছি সামনে বছর ওপেন করবো। মনিষ সৌম্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, অস্ফুট কথা মারভেলাস! ওয়ান্ডারফুল! মণিষ নিজের বুকে হাত রেখে মাথা নামিয়ে বলে, শ্রদ্ধা!
জামান তার নরম হাতটা ঘুষি মারার জন্য পাকাতে থাকে, তার পর বলে দেখবি শ্রদ্ধা জানানোর ফল। শ্রদ্ধা জানাবি যদি তাহলে এক্সমাসের ছুটিতে বাংলাদেশ চল যারা এই হসপিটাল করার জন্য মৌমাছির মত সঞ্চয় করে । মনিষ বলে, ঠিক আছে রোথসকে বলে দেখি।
দেখতে দেখতে ডিসেম্বার চলে এল, বেশ ঠান্ডা পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। আর কয়েক দিন পরেই রাস্তায় বেরোন মুস্কিল হবে, এতো বরফ পড়বে, গেলো বছরতো চার ফুট বরফ রাস্তায়! ভাবছে মনিষ ভাবছে বসে বসে। রাত গভীর হতে থাকে, বাইরের বেরোনো যায় না। রোথস দিয়ে গেছে ড্রিংস, মাঝে মাঝে চুমুক দেয় আর নেট এক্সপ্লোর করতেই থাকে।কোথায় কি জারনাল বেরোল ক্যান্সারের উপর।এমন সময় জামানের ফোন- হায় ডিয়ার! হাও আর ইউ? হোপ তুমি কাল আসছো, আমি বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে থাকবো, সি ইউ টুমোরো। বাই।
মণিষ ফোন রাখতেই বড় মেয়ে মারথা বাবাকে বলে, উইথ এ গ্রুপ অফ ফ্রেন্ডস উইল গো টু আফ্যানদিস ফর এক্সমাস হলিডে, হো মাই ড্যাড।
এই টা তার প্রথম বার একা একা বাইরে বেরনো।বয়স চৌদ্দ। মণীষ মেয়ের গাল টিপে ধরে বলে, ওকেই মাই সুইট হার্ট! মেয়ে মারথা খুশি হয়ে বাবাকে চুমু খেয়ে বলে, মাই মাই ডেড! গুডনাইট।
ওকেই গুড নাইট।
মণিষ ভোর হতেই রোথস আর তার ছোট ছেলে জেনকে নিয়ে এয়ারপোর্ট তারপর ঢাকা। সেখানে কয়েক গোন্ডা বন্ধু ঝেঁকে ধরে ছেঁকে তুলে একে বারে বান্দরবান। ওরা ট্রেনে আসেনি কারন মণিষ বারবার বলেছিলো সে সাভার হয়ে যেতে চায়। কারন সেই গারমেন্টস ফ্যাক্ট্রি যেখানে মেয়েরা কাজ করতে এসে আর বাড়ি ফেরে নি। এই সব দেখতে দেখতে বান্দরবান আটঘন্টার পথ কি করে কে জানে ছয় ঘন্টায় পৌঁছালো ওরা।
রজনীবিহান সকাল! সুন্দর অতি সুন্দর! মনিষরা যেখানে আছে সেটি এক জঙ্গল আর পাহাড়ে ঘেরা , অনেক বড় ক্যাম্পপাস।অনেক দিন পরে মনিষ ভোরের সূর্য ওঠা আর অসংখ্য পাখির ডানা মেলে কিচির মিচির ডাক শুনতে শুনতে শুনতে উড়ে যাওয়া দেখে নি। এমন বাঁশগাছের লম্বা ডগার দোল খাওয়া চোখে পড়ে নি। অনেক দিন হল সেই তার ইন্ডিয়া যেতে পারে নি। মা বাবা এসে এসে দেখা করে গেছেন।
যাই হোক জামানের হাস্পাতাল দেখে খুব খুশি, মণিষ বলল সেও সাহায্য করবে। বিকেলে জামানের মায়ের এনজিওর এ্যাক্টিভিটি দেখতে যেতে হবে খুব করে বলেছেন। তাছাড়া ওরা পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে আরো আরো অনেক কিছু।
জামানের মাকে এর আগেও দেখেছে মণিষ, মণিষকে খুব ভালোবাসে জামানের মা, কত রকমের শুকটি ভর্তা করেছেন, শুধু তাই না পিঠে পুলি, পঞ্চাশ রকমের মাছ। মনিষ আর খাবারের সঙ্গে পেরে ওঠে না। রোথস আর জেন খাবারের সঙ্গে খুব মাখামাখি হয়ে আছে। মনিষ তার পরিবার, জামান আর তার পরিবার নিয়ে চলল মায়ের এন-জি- ও র এক্টিভিটি দেখতে। জামান জানালো তার মা-ই তাকে এই হাস্পাতাল করতে সাহায্য করেছে আর তার মায়ের অনুরোধেই করা।
গাড়ি এসে থামল একটা চাঁপা গাছের নিচে। অনেক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুল হাতে। একটু দূরে কিছু মেয়ে নাচ করছে তার একটু দূরে কিছু মেয়ে মিউজিক বাজাচ্ছে। মেয়েরা ফুল দিয়ে অতিথি বরণ করল। জামান মনিষ ফুল নিয়ে ভিতরের ঘরে গেলো, সেটি ট্রোমাকাউন্সেলিং ঘর, উপযুক্ত করে সাজানো। জামানের মা তার কাজের ডকু ফ্লিম দেখাতে প্রজেক্টার অন করলেন। মনিষ দেখছে, কত মেয়ে! খুব উজ্জল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। এরা নাকি খুব কম বয়সে পাচার হয়ে ছিলো, তারপর উদ্ধার করা হয়েছে, কেউ নেপালের কেউ ইন্ডিয়ার কেউ এদেশেরই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে একটি মেয়ে ভারতের ও পাগোল তাই ভুল করে কাঁটাতার পেরিয়ে এ দেশে। সরকার ওকে আমার এখানে দিয়ে গেছে। ওই যে দেখছেন ওই মেয়েটি কি দারুণ ওর হাসি। তাই তো ওর হাসিটাকে এত রকম ভাবে দেখানো হয়েছে। মনিষ দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে ভ্রু কোঁচকায়, রোথস মনিষকে বলে, সে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। জামানের মা হামিদা হক সঙ্গে করে নিয়ে যান মেয়েদের কাছে, রোথস আর তার ছোট ছেলে জামানের স্ত্রী আরো অনেকেই বসে আছেন, এখানে মেয়েদের এই ভাবে কথা বলা যায় না। ওরা আগে যা বলবে তা শুনতে হবে তারপর কথা। মেয়েরা নাচ করল, প্রান ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে গানে, তারপর, লীলাবালি, গানএলো, তার পর এলো জলতরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল -, তত ক্ষণে জামান আর মণিষ হাসপাতালের ওটির প্লান নিয়ে বাইরে কথা বলছে। হাল্কা মৃদু হাওয়া দক্ষিণ থেকে উত্তরে, পূর্বে তার পর চতুরদিকে বয়ে যাচ্ছে, এই হাওয়া মণিষের মাথার চুলের গোছাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে, ভেসে আসছে একটা গান, ভেসে এলো মণিষের কানে আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচার ঘরে
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার
যদি পাপ মনে করি অবিচার কাহার পরে
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
মনিষ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে, কে গায় এ গান! কি মিষ্টি অপূর্ব সুরেলা কন্ঠ এ গানের সুর।
হামিদা হক জানালেন, জানেন তো এই মেয়েটিকে পেয়ে ছিলাম স্পেনে, এক জাহাজির ঘরে, সে অনেক কথা, কত ঝক্কি, ভারত বলে আমার না আমরা বলি আমার না , মেয়েটি বলে বাংলা আমার ভাষা। স্পেন সরকার আইন কানুন মেনে এ দেশে পাঠিয়েছে কারন সে বাংলা ভাষায় কথা বলে তাই, এটাও তো সত্যি কথা, বাংলা মানেই তো বাংলাদেশ। হা-হা-হা- আমরা এটা গর্ব করি।
মণিষ বলে, রাইট, ইয়েস দিস ইজ এবসুলুটলি আপনাদেরই রাইটস।
আবার মণিষের কান যায়
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণেক তরে…এ গানের গভীর টানে মণিষ ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ায়, এতো মিষ্টি সুরের গলা মেয়েটির, এতো রুগ্ন মেয়েটি, নাক উঁচু! গায়ে রঙ মিষ্টিকালো! চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে দুলছে।
মণিষ থমকে যায়, হামিদা জানায় মেয়েটি একটা ইউনিভারসিটির কথা বলে, আমরা সেই ইউনিভারসিটিতে ওর ফোটো পাঠিয়েছিলাম কোন উত্তর করেনি ওরা। মেয়েটি বলে আমি ফারস্ট ক্লাস ফার্স্ট। তার আচার আচরণ এত সোবার, কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনা ওর ঠিকানা, ও বলতেও পারে না।
মণিষ গান শুনতে শুনতে একে বারে মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, মণিষ মাথা তোলে না চোখ বন্ধ করে গান শুনছে।
হামিদা হক মণিষের কানে কানে জানালেন, এর গানে তাল না দিলে খুব রাগ করে ও। আপনি তাল দিন হাতে। সকলে মুগ্ধ হয়ে গান শোনে। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে আছে কেউ অর্ধেক চোখ খুলে তাল দিয়ে যাচ্ছে।
তুমি যে জীবন দিয়েছো আমায় কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়
আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভরে
আমার বিচার কর তব আপন করে।
মণিষ মেয়েটির হাত তার নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মণিষ চোখবন্ধ করে আছে, তার দু চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।
মেয়েটি বলল – জানেন তো এই গানটিই করি আমি, আর যত বিদেশি ডোনার এই গান শুনে এমনি করেই আমার হাত ধরে বলে, মেলোডীয়াস ভয়েস, বাঙালিরা বলে, কি সুরেলা গলা তোমার! আমার তো হাসি পায়, আসলে আমিতো গানে এমনি পাস করিনি, আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ছিলাম।
হামিদা হক বললেন, এইজন্যই মিউজিথেরাপির কথা বলা হয়েছে। দেখুন আজ কিন্তু একটা নতুন খবর জানালো রিকি রহমান। ও নাকি গানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ও তার নামটা ও বলতে পারে না, রিকি রহমান নামটা সে নিজেই বেছে নিয়েছে।
মণিষ মেয়েটির হাত এখনও ধরে আছে আর তার ঠোঁট দুটিকে মুখের ভিতরে ভরে কান্না নিয়ন্ত্রনের চেষ্টাই ব্যার্থ মণিষ, মণিষের সারা শরীর গোপন কান্নার তীব্র ঢেউয়ে কাঁপতে থাকে।
রিকি আবার গাইতে থাকল
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।
দু-লাইন গেয়ে বলল, ও আন্টি এই ডাক্তার বাবু খুব কান্নাকাটি করছেন, তুমি ডাক্তারবাবুকে মিডিসিন দাও।
জানেন তো ডাক্তারবাবু আমিও কাঁদি অনেক কথা বলি আমার মা বাবারা কলেজে পড়ান। আমি সোসিওলজিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট প্রেসিডেন্সী থেকে, আমার নাম…মনে পড়ে না গো, কিছুতেই মনে পড়ে না। আমাকে টেগর বলেছেন আমাকে টেগর বলেছেন –
হামিদা হক আদর করে বলেন- দেখো রিকি আবার ওই কথা? টেগরতো কবে মারা গেছেন, তোমার সঙ্গে কি করে কথা বলবেন টেগর?
রিকি মিষ্টি হেসে বলে, আন্টি ডাক্তার বাবুকে মেডিসিন দাও, উনি এখনও কাঁদছেন। ও-ডাক্তারবাবু।
মণিষ নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। রিকির হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় দিকবিদিকে দৌড়াতে থাকে। হামিদাদের এন জি ও র পান্থ পথের গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে মনিষ, আকাশের দিকে মুখ তুলে বাচ্চার মতো হাউমাউকরে কাঁদে। আজ যেন সে ফুজিয়ামা! অস্ফুট শব্দ বেরোয় বন্দনা …। সে নিজের কান চেপে ধরে, আর বলে, না না না–কিন্তু সে সুরেলা সুর কানের ভিতরে প্রবেশ করে শরীরকে চারাতে থাকে
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে। আমার বিচার…।
জন্ম সত্তরের দশকে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়।বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিদ্যায় স্নাতকোত্তর।কর্মজীবন শুরু সমাজসেবী সংস্থায়।প্রথম প্রকাশিত বই ফরিদার সাতকাহন।দ্বিতীয় গল্পসংকলন ফিরে আয় ফুলবউ।উপন্যাস ভাঙন চরিত কথা।কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০০৩ সালে পেয়েছেন রোকেয়া পুরস্কার। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি থেকে পেয়েছেন ভ্রমণ অনুদান।ভারতীয় ভাষা পরিষদ থেকে যুব পুরস্কার। ২০০৮ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ইলাচঁন্দ স্মৃতি পুরস্কার। ২০১০ সালে বাংলাদেশ দরিয়া নগর কবিতা মেলায় বিশেষ সম্মানে সম্মানিত। ২০১২ সালে সমাজ কর্মী হিসাবে পান রূপসী বাংলা টিভি চ্যানেল থেকে ‘আজকের অপরাজিতা’ পুরস্কার।