বাবাকে একটি খোলা চিঠি কিংবা সত্য অনুসন্ধানের খোঁজে
বিতস্তা ঘোষাল ও তাঁর বাবা বৈশম্পায়ন ঘোষাল একসাথে।
বৈশম্পায়ন ঘোষাল ভাষা সংসদ অনুবাদ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা , সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, মাতা কুসুম কুমারী আন্তর্জাতিক সম্মান, বাংলা আকাদেমি সম্মান, শ্রেষ্ঠ মানব পুত্র সম্মান সহ একাধিক পুরস্কার।জন্ম -১৯৪৪, জন্মাষ্ঠমী।মৃত্যু -২০১৭ এর ১১ জানুয়ারি।
“চাঁদটা ভীষণ বেহায়া
আমরা নিচে দুজনা
তারাকে ডেকে বলছে- ‘ও সই’
নীচে চেয়ে দেখ না!”- বৈশম্পায়ন ঘোষাল
বাবা, বেশ কদিন হয়ে গেল তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। কথাও হয় না। নিচের দিকে তাকাও না তুমি তোমার ওই বিশাল বাড়ির জানলা থেকে। আমি তো নিচে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু তুমি অনুমতি না দিলে উপরে উঠতে পারি না। তাই এই লেখা।
কেমন আছো তুমি? কতদিন তুমি বলো না, শরীরটা ঠিক নেই রে। ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞেস করলে বলো, এই তোদের নিয়েই চিন্তা। তোদের কারোরই স্বাস্থ্য ভালো হল না। আমদের শরীর ঠিকের উপরেই যেন তোমার শরীর ভালো থাকা- মন্দ থাকা।
রোজ সকালে উঠেই প্রথম যে কথাটা মনে হয়, সেটা হল, রাতে তোমার ঘুম হয়েছিল তো! কাল রাতে ওষুধগুলো দিয়ে এসেছিলাম, সব কটা খেয়েছিলে ঠিক করে? তুমি আজকাল ভীষণ ভুলে যাও, পরদিন গিয়ে দেখি একটা না একটা ওষুধ ওই লম্বা খোপ কাটা ওষুধের বাক্সের মধ্যেই পড়ে কিংবা তোমার চেয়ারের তলায় ।
অথচ রোজ তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে আসি।তারপরেও. .
তুমি খুব চঞ্চল হয়ে যাচ্ছ। আটটা বাজলেই ফোন করবে, কি রে এখনো এলি না বলে, অথচ যাবার পর কয়েকটা মামুলি কথা বলার পরই বলো, নে , যা, তোর মা অপেক্ষা করছে, তুই এলে মা’র মনটা ভালো থাকে। যেন আমি না এলে তোমার কোনো মন খারাপ হয় না। কিন্তু সেটা তুমি না বলে বলো, সারাদিন তোর মা কথা বলার সঙ্গী খোঁজে। তুই এলে একটু লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করে…। বলেই তুমি অদ্ভুত এক হাসি হাস। বাধ্য মেয়ের মতো উঠে যাই মায়ের ঘরে।
কিন্তু আমারও তো কত কথা বলার থাকে তোমাকে। তুমি শুনতেই চাও না।দুটো থেকে তিনটে কথা বলেই বলে ওঠো, আর হাতে গোনা কটা দিন।
এই কথাটা শুনলেই রাগ হয় ভীষণ।একটা মানুষ সারাদিন বদ্ধ ঘরে বসে মৃত্যু চিন্তা করছে। আর যেন কোনো কাজ নেই! আবার বলো- আমি মরে গেলে অবশ্য তোদের এখন কোনো ক্ষতি হবে না। রাগে আমার সর্ব শরীর জ্বলে ওঠে। একঘরে বন্দী থেকে যত ভুলভাল ভাবনা। তুমি না থাকলে আমাদের সমস্ত জগতটাই যে ব্যর্থ হয়ে যায় বাবা, এটা কী তুমি জানো না! রেগে গিয়ে উঠে যাই তোমার সামনে থেকে। বলি, এই ঘরটাই যত নষ্টের গোড়া। তোমাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দিল।
অবশ্য তুমি বলো, এই ঘরটা তোমার ঈশ্বর সাধনার ঘর। তা ঠিক, ওই ঘরে ঢুকলেই কেমন ধূপ, চন্দন, অগরূ, আরো কত কীর গন্ধ নাকে আসে।মনটা শান্তিতে ভরে যায়। মনে হয় কোনো ঈশ্বরের সামনে মাথা নিচু করে তার পায়ের তলায় বসে আছি ।
হ্যাঁ বাবা, তুমি আমার ঈশ্বর। আমি তোমার মধ্যেই আমার রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, মহাবীর, বুদ্ধ, হজরত মহম্মদ, যীশু খ্রীষ্টকে দেখি।
তুমি তো বলো ধর্ম বলে আসলে কিছু নেই। যেকোনো দেশের রাজনৈতিক শক্তি, পুরোহিততন্ত্র এই ধর্মকে তৈরি করে সাধারণ মানুষকে নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্য। তোমার মতে, মানুষের একটিই ধর্ম, তা হল মানবতাবাদ।সারা বিশ্বে এই একটি ধর্মকেই প্রমোট করার দরকার। কিন্তু কিছু স্বার্থপর মানুষ তা কখনোই হতে দেবে না।
তোমার লেখা এই কবিতাটা সেই ছোটো থেকেই আমাকে খুব টানে- তুমি মানবিকতা, ধর্ম, প্রেম, ভালবাসা নিয়ে কথা বলার সময় বারবার এটা শোনাতে-
“
তোমরা আমায় পাগল ভেবেছ
আমায় দিয়েছ ব্যথা- তাই আমি আজ
বলে যাব দুটি কথা
ভাববে কত অপমান করে গেছ
মানুষের দাম দাও নাই ভাই
মানুষ হয়েও মানুষেরে চেননি-
দুটি ভাল কথা মনে করেও বলনি
আজ আমি কিছু বলে যাব তাই।
……
জীবন আমার ইতিহাসে ভরা
কতযুগ ধরে আঁকা সেই ছবি
সেটাই বলতে আজকে হয়েছি কবি।
……
হরপ্পায় আমি প্রথম সভ্য মানুষ
আমিই জ্বেলেছি প্রথম জ্ঞানের শিখা
আমিই হলাম প্রথম প্রেমের দীপিকা
……
বেদুইন মাঝে হজরত আমি
আমি বুদ্ধের বেশে শান্তি শান্তি করি
মানব রক্ত আমি চাইনি করতে পান
যুদ্ধেরে আমি ঘৃণায় দিয়েছি গাল
খ্রীষ্টের বেশে বলেছিন ক্ষমা করো
প্রেম প্রীতি দিয়ে নতুন পৃথিবী গড়।
মধ্যযুগের আমিই নানক
চৈতন্যের প্রেমে আমিই পাগল
দীন-ইলাহির আমিই স্রষ্টা
তৈ্মুর আর চেঙ্গিসের রাঙা করা পথে
আমি শান্তির জল দিয়েছি।
মহাযুদ্ধের গ্লানি তোমাদের আকাশে আকাশে
গাছের পাতায় পাতায়
সেই গ্লানি দূর করতে
আমি স্বর্গের সুধা হয়ে ঝরেছি।
যেদিকে তাকাই প্রান্তর সব রূক্ষ
রাতের শিশির কান্নার মত ঝরে
দূরে চলে যায় আলেয়ার আঁখি
উদাসীর সুরে ভৈরবী গান ধরে
চোখ মেলে দেখি সকরুণএক নারী
বলে যৌবন পেয়ে এতখানি হল ভ্রান্তি!
সব পাবে বল- শান্তি শান্তি শান্তি।
আমি চুপ করে থাকি-
বলি, আমি সব মানুষের সব হৃদয়ের সবচেয়ে বড় প্রেম
আমি সব ধর্মের সবচেয়ে বড় বাণী
আমি সত্যম, আমি শিবম। আমি সুন্দরম”
প্রথম প্রথম মনে হত এই কবিতাটার সঙ্গে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মিল আছে। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারলাম আসলে এটা পুরোটাই সব জাত ধর্ম বর্ণের ঊর্দ্ধে উঠে আদ্যন্ত শান্তির ভালোবাসার প্রেমের কবিতা, যেখানে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে।
হ্যাঁ বাবা, আমিও তাই বিশ্বাস করি।সেইজন্য সব ধর্ম সমন্বয়ের সাধনা করি।মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্ব না থাকে, যদি পরস্পরের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা না থাকে তবে বৃথাই এই মনুষ্য জীবন ।
আমার তোমার থেকে ধর্ম, ইতিহাস, পুরাণ, সংস্কৃতি , অর্থনীতি, ভূগোল, সাহিত্য, শিল্প সব কিছু নিয়ে আলোচনা শুনতে ভালো লাগে। কারন তুমি তো কোনো পুঁথিগত কথা বলো না। তোমার বক্তব্যে নিজস্ব একটা দর্শন উঠে আসে।সেই জীবন দর্শন আমাকে প্রভাবিত করে।
অথচ এর পরেও তুমি ঈশ্বর সাধনা করো। আমি তোমার থেকে বহুবার জানতে চেয়েছি, তুমি ঈশ্বর দেখেছ?
তুমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে হেসেছ। বলেছ, ঈশ্বর অনুভব করতে হয়। তাকে ছুঁতে হয়।
তুমি ছুঁয়েছিলে বাবা।আমি নিজের চোখে দেখেছি ।
তুমি বললে, ‘আমি আর মাত্র আট দিনের বাসিন্দা’। বিশ্বাস করো আমি তখন থেকেই বুঝতে পারছিলাম তুমি তোমার যাত্রা শুরু করে দিয়েছ।
কিন্তু বাবা, তুমি তো তখনি যাত্রা শুরু করোনি।আমার কেন যেন মনে হয় তোমার যাত্রা শুরু হয়ে গেছিল সেই ১৭-১৮ বয়সেই।যখন তুমি সন্যাস হবার বাসনায় ঘর ছেড়ে ছিলে।তোমার কবিতার খাতায় তখন যে সব কবিতা লেখা থাকত, তার থেকে বহু কবিতাতেই সেই যাত্রার ধ্বনি শুনতে পেয়েছি ।
তুমি লিখেছিলে-
‘দৃঢ় পদক্ষেপে
একটি স্থির মৃত্যু এগিয়ে আসছে –
আমি অসহায় ভাবে
তার হাতে নিজেকে
কেমন করে যেন সমপর্ন করে দিচ্ছি
যেমন আলো নিজেকে নিভিয়ে দিয়ে
সমপর্ন করে অন্ধকারকে।’
এই কবিতা লেখার সময় তোমার বয়স ১৮। বাস্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, এ বয়স জানে রক্ত দানের পূন্য -বলে যে ১৮ কে উদ্দেশ্য করে কবি সুকান্ত লিখছেন, তুমি সেই বয়সে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পন করতে চাইছ।
কিংবা তুমি লিখছ-
‘এক ফুয়ের-ই তোড়ে
কোথায় যাব ঝরে
তবু কত আশা
কাজ করছি খাসা’
আবার তুমিই লিখছ-
“ রাতের তারার মত আমিও ঘুমতে চাই।
রাতের শিশিরের সাথে আমিও মিশে থাকব
দিগন্তের অন্ধকার ভরা রাতে।।
কোনো দিন শুনতে পাব না
পৃথিবীর কথা- পৃথিবীর গান –পৃথিবীর কান্না
আমার জীবনে বইবে না কোনো ইতিহাস।।
হাজার হাজার বছর ধরে আমি কেবল ঘুমবো”।
জীবনানন্দ লিখলেন, তিনি হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর বুকে হাঁটতে চান, আর তুমি ঘুমতে চাইলে!
আর তার পরেই বললে-
“ একদিন স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাবে।
চমকিয়ে তাকাবো পৃথিবীর দিকে
দেখব- জবা ফুলের মত লাল আকাশ,
ঘাসের মত সবুজ মাটি এক হয়ে গেছে।।
সহস্র সহস্র মেঘের কান্নায়
সমুদ্রের কল গর্জনে
আমি পৃথিবীতে ছিটকিয়ে পড়ব।
চোখ খুলতেই দেখব-
তুমি দাঁড়িয়ে, মুখে মৃদু হাসি
বলবে স্বপ্ন সত্যি, ভয় নেই
তোমাকে আর ঘুমতে হবে না।
আমি অবাক দৃষ্টিতে
চির পরিচিত পৃথিবীর দিকে
চেয়ে থাকব।।”(২১ শে অগ্রহায়ণ, ১৩৬৭)
একই কবিতার মধ্যে এই যে দ্বৈতস্বত্বা- এটাই সারা জীবন তুমি বহন করেছ।
কিন্তু কেন বাবা! তোমার কেন এসব লাইন মনে হত? আমি জানি তুমি শেলী, কিটস, বায়রন, সিলভিয়া প্ল্যাথ,ভার্জেনিয়া উলফ, জীবনানন্দ প্রভৃতি কবির দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলে। কিন্তু এটাও জানি তুমি পাশাপাশি বিবেকানন্দর মতো শক্তিকে আঁকড়ে ধরেছিলে জীবনের প্রতিটা জটিল পথ পেড়বার জন্য। শুধু তো তাই নয়, তুমি একই সঙ্গে কালি সাধনা ও কৃষ্ণ নাম জপ করতে।কারন তোমার কাছে একদিকে কর্মযোগ, আরেক দিকে শাক্ত যোগ দুটোই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলে। ফলে একদিকে সন্যাস হবার তীব্র বাসনা, অন্য দিকে সংসার- এই দুইয়ের মধ্যে তুমি সমঝোতা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলে।
তোমার জীবনের কী অভিপ্রায় ছিল, সেটা এতদিন বাদে আমার কাছে স্পষ্ট। তুমি নিজেও জানতে ওটাই তোমার একমাত্র কাজ ছিল, সেটা শেষ করেই তোমার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তোমার লেখাতেই তা স্পষ্ট।
তুমি লিখেছ-
“ জীবনের সেই সত্যটাকে
আমি জেনে নেব বলে
আমার এ বুভুক্ষু হৃদয়
কতদিন গেছে জ্বলে
জীবনের মানে আছে নাকী?
বলেছে মনের ঢেউ-
আমার হৃদয়ের এ কান্না
তোমরা শোনোনি তো কেউ
অমৃতের পুত্রের কাছে তাই
রাখলাম আমার প্রার্থনা-
তোমার পবিত্র অঙ্গীকারে।” (৩০/০৪/৬৪)
তুমি বল- ‘সত্যকে আমরা ভালবাসি। তাই তাকে জানার আগ্রহে দৃশ্যমান সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করি। আমরা খুব সাধারণ মানুষ। তার ফলে সত্যকে ঠিক পাই না- তার আপাতঃ সৌন্দর্য থেকেও বঞ্চিত হই। প রিণতিতে শুধু রিক্ততা আর নিঃস্বতা।
কিন্তু আমি জানি, জীবনের সেই চরম সত্যটার সামনে গিয়েও তোমার এই সংসার ছেড়ে যাওয়া হল না।
ছোটো ছোটো ভাই বোন, মা, এমনকি সন্যাসী বাবার জীবনও তোমাকে বহন করতে হল। আর তারপর মায়ের সঙ্গে বৈবাহিক জীবন। তিন সন্তান।দায়িত্ব দায়িত্ব আর দায়িত্ব ।
তুমি আসলে তখন থেকেই তোমার যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলে মনে মনে। খালি পিঠেতে চাবুক মেরে রক্তাক্ত মন নিয়ে প্রতিদিনের এই মানব জনম কাটিয়েছ।সকলের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করেছ। আর মনে মনে তোমার ঈশ্বরের কাছে পৌছানোর পথটা একটু একটু করে তৈরি করেছ। সেখানে তুমি একেবারে নিঃসঙ্গ সম্পূর্ণ এক যোগী।
সেখানে তুমি লিখছ-
“ হে ঈশ্বর –
তোমার অনির্বাণ অগ্নিতে
তুমি আমাকে পোড়াও
হে ঈশ্বর –
আমার আমার আত্মার শুচিতাকে
তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও।
হে ঈশ্বর-
আমি সুতীব্র যন্ত্রণায়
ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছি।
হে ঈশ্বর –
সৃষ্টির মত পবিত্র কর
আমি সমস্ত ক্ষণ তাই চেয়েছি”।( ১৭/০৯/৬৩)
তোমার মধ্যে এই চাওয়াটাই ভীষন ভাবে জড়িয়ে ছিল। পার্থিব তুমি। এত কাজ করলে। পৃথিবী বিখ্যাত হলে। কিন্তু কোথাও তুমি ধরা দিলে না।
শুধু নীরব সাধনাতেই নিজেকে বিলীন করলে।
“ তোমাকে পাবার উচ্ছ্বাসে
আমার হৃদয়ে
এক অদ্ভুত বিবর্ণতা জাগে
চারপাশে নির্জনতা
অশরীরী ছায়ার মতন স্তব্ধতা
জলের মতন ঘোরে।
স্তব্ধতার অন্ধকারে
ডুব দিতে গিয়ে
বারবার আমি তোমাকে খুঁজি।
তোমাকে কেন আমি খুঁজি ?
রক্তে নোনা স্বাদ পাব বলে?
কি অদ্ভুত নির্জনতা- কি অদ্ভুত স্তব্ধতা!
আমার মনের শরীরে সেই স্বাদ বুকে চেপে
তোমাকে চেয়েছি কেন?
চারপাশে উচ্ছ্বসিত জল
মাঝখানে নক্ষত্রের মত দ্বীপ
আশ্বাসিত দ্বীপের স্বপ্ন
নাবিকের চোখে-
সমুদ্রের নোনা ঢেউ
সুদূর আকাশে সমুদ্র পাখি
দ্বীপ অদৃশ্য হল-
তবু নাবিকের চোখে জাগে নূতন প্রত্যয়” ( ৭/১০/৬৪)
ছোটো থেকেই সেই জ্যোতির বলয় দিয়ে আমাদেরও ছুঁয়ে রেখেছ। যার ফলে আমরাও শেষ পর্যন্ত কোথাও একটা নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসীর মতো জীবন কাটাতে চেয়েছি, অন্য দিকে তোমার কর্মযোগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজেদের মতো কাজ করে চলেছি।
কিন্তু বাবা, আমরা সবাই রক্ত মাংসের মানুষ। আমাদের মধ্যে লোভ,ঈর্ষা, হিংসা না থাকলেও একটা খিদে আছে। প্রশংসা পাবার খিদে, সাফল্য পাবার খিদে। হ্যাঁ, যেটুকু কাজ করি সেটা যেন লোকে জানে, ভালোবাসে- এই ইচ্ছে থেকে এখনো বেরতে পারিনি।
কিন্তু তুমি তো সত্যি নির্লোভ যোগী শিব। শ্মশানে বা কৈলাশে হয়তো নেই, অথচ যেখানে, যে ঘরে ছিলে সেটাকেই স্বর্গ বানিয়ে নিয়েছ।
কারন তুমি জানতে-
“ শতাব্দীর পরে
রক্তাক্ত ইতিহাসের গূঢ় হওয়া ধুলো
ম্লান হবে ভোরের ঊষার নিশা জাগরণের শেষে।
আকাশের প্রদীপেরা
চিরদিন জানি এরা
চেয়ে আছে বিপুল আগ্রহে
মানুষের সভ্যতা কবে
মানবত্বের রূপ পাবে মহা সমারোহে
গান আর কবিতা
শেখাবে ভালবাসা
পড়ে থাকা আর গড়ে ওঠা মানুষের মাঝে…”
তুমি ঈশ্বর হতে চাওনি বাবা। নানা প্রলোভন স্বত্তেও। তুমি সারাজীবন খালি শান্তি আর ভালবাসার কথা বলে গেলে। বিনিময়ে কিছু না চেয়েই।
ঈশ্বরেরও লোভ থাকে বাবা। কিন্তু তোমার তো সেটুকুও ছিল না। নইলে কেউ পারে বাবা ক্ষমতার শীর্ষে থেকে, এত পুরস্কার, সম্মান, অর্জন করে মাত্র ৪২ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে! না বাবা, কাজটা সোজা ছিল না।
যে পথে তুমি হাঁটবে বলে রেড কার্পেট বেছানো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে, যাতে তোমার পায়ে ধুলো না লাগে, তোমার জুতো পর্যন্ত মাথায় করে নিয়ে যেত- সেই পথের সীমারেখা তুমি টেনে দিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে সেই ৪২ এই।
না বাবা এই ত্যাগ কোনো সাধারন মানুষ করতে পারে না।
হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে আমি অনেকবার তোমাকে ডেকেছি। ভেবেছি এই বুঝি তুমি এলে, অথচ তুমি আসোনি একবারও।তীব্র অভিমান হয়েছে। মনে মনে কেঁদেছি। তারপর তুমি এলে যেদিন মাথায় বরফ জল ঢালা হচ্ছে , আর সব রিপোর্ট অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ, সেইদিন। আমার মাথার মধ্য তখন তোমার লেখা কতগুলো লাইন ঘুরছে অবচেতনে-
“ অকস্মাৎ মৃত্যু এসে / হানা দেবে জীবন্ত প্রহর / তারপর শূন্যতা- না আর কিছু/ নির্জনে কাঁপে যেন /কার কন্ঠস্বর”- আর তখনি তুমি সামনের সোফায় বসলে, ধুতি পাঞ্জাবি পরা। আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখতে কোনো ভুল হয়নি বাবা।তোমার গায়ের সেই ঐশ্বরীয় গন্ধ,স্পর্শ সব আমার শরীরে ছড়িয়ে গেল।
পরদিন থেকে আমি সুস্থ হতে শুরু করলাম।
বাবা আমি ঈশ্বর দেখেছি , তোমার ঘরে। তুমি শুয়েছিলে বিছানায়। তোমার পাশে আমি। হঠাৎই বাথরুম পেল। নেমে সবে ঢুকছি বাথরুমে, সেই মুহুর্তে মেয়েটা ঢুকলো।লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, গলায় লাল জবার মালা, পায়ে মল, আলতা, এলো চুল।ঠিক মা কালি।আমি সব ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।আর তুমি বললে, দিলি না যেতে, এল নিজে।
হ্যাঁ বাবা, আমি অন্যায় করেছি, সেদিন তোমাকে যেতে না দিয়ে। আমার যে তোমাকে ছাড়া চলে না। তাই স্বার্থপরের মতো তোমাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারলাম কই! তুমি ঠিক ৪৮ ঘন্টার মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে আমাকে তোমার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে চলে গেলে। সেদিন সকালেও তুমি বলেছিলে সেই ছবিটা কোথায় রাখলি, মেয়েটা কিন্তু আসবে, ওর হাতে ছবিটা দিতে হবে।
কিন্তু বাবা কোন ছবি সেটা বলোনি।আমিও দেখতে পাই নি।
আজ আমি দেখতে পেলাম সেই ছবিটা তোমার ঘরে।তোমার চেয়ারে বসে আছে ।আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, বেঁকা ঠোঁট নিয়ে, আর বলছে কী রে কেমন খেল দেখালি, ভেবেছিলি এত সহজেই পার পেয়ে যাবি! তা হচ্ছে না।এখনো তোর কাজ বাকি।
আমার আর কত কাজ বাকি বাবা? খুব ক্লান্ত লাগছে আজকাল।তোমার কাছে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই তুমি ধ্যান করছ। তোমার সারা শরীর দিয়ে জ্যোতি ঠিকরে বেরচ্ছে। লাল একটা আভা তোমায় ঘিরে। কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পাচ্ছি না কিছুতেই।
কত দূরে তুমি। কত আলোক বর্ষ হাঁটলে আমি তোমার বুকে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব? কবে আসবে আমায় নিতে। তুমি ভালো আছো তো বাবা!
কোনো প্রশ্নের উত্তর তুমি দিলে না।শুধু বললে, এখনো সময় হয় নি।যখন হবে তখন ঠিক আসব।
আমি অপেক্ষায় রইলাম বাবা।তুমি খুব বেশি দেরি কোরো না।তোমাকে ছেড়ে থাকা দিনদিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছে , নানা কাজে-অকাজে ডুবে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করছি।
কিন্তু বাবা আর কতদিন. .
বড্ড কষ্ট হচ্ছে যে আমার. . .
ইতি-
তোমার …।
.
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক
অসাধারণ, মহাত্মার আশিস আমাদের ওপর বর্ষিত হোক। লেখককে শুভেচ্ছা,অভিনন্দন ।