গীতরঙ্গ: হাওড়া জেলার বাদাই গান । সৌরভ দত্ত ও তুষার বসু
উনিশ‘শ ও বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের থানাধীন বারো বেলে তথা বাদেবালিয়া,যমুনাবালিয়া,নিজবালিয়া,নিমাবালিয়া,গড়বালিয়া,ইছাপুর,ত্রিপুরাপুর,রণমহল ও শিয়ালডাঙা গ্রামগুলিতে ‘বাদাই গান‘-এর বেশ জমজমাট আসর বসতো।ভাদ্র মাসের ‘জন্মাষ্টমী‘ তিথি উপলক্ষে এই গানের বহুল প্রচলন ছিল। হাওড়া জেলার আরো কিছু নিকটবর্তী গ্রামে জন্মাষ্টমী তিথিতে বাদাই গানের জমকালো অনুষ্ঠানের কথা শোনা যায়।যেমন পানপুরের ঘোষ পরিবারের শ্যামসুন্দর জিউ এবং দত্ত পরিবারের রঘুনাথ জিউ–এর মন্দির প্রাঙ্গণে জন্মাষ্টমীর পরের দিন মেলা সহযোগে বাদাই গানের আসর বসে। শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্তমূলক ‘বাদাই গান‘-এ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট।‘বাদাই গানে‘ কৃষ্ণজন্মকথা কীর্তনাঙ্গ সংকীর্তনে গ্রাম প্রদক্ষিণ করার প্রথা ছিল।বাদাই গানের আসর বসত নাট মন্দির চত্বরে,বারোয়ারী আসরে কিংবা সম্পন্ন গৃহস্থের অঙ্গনে সামিয়ানা টাঙিয়ে।কীতনাঙ্গ ছাড়াও বাদাই গানে টপ্পা, ঝুমুর,গাজনের সুর প্রযুক্ত হয়ে থাকে।বাদাই গানে যন্ত্রানুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঢোল,কাঁসি,নুপূর,খঞ্জনী, বাঁশি ও বাঁশরী।
বাদাই গান লোকগীতির মতো লোক মুখে প্রচলিত গীত নয়।তবে লোকগানের মতো গ্রামীণ জীবনের সুখ–দুঃখের সঙ্গী হিসেবে ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে উৎসবে পরিণত হয়েছিল।এই সব গানের রচয়িতাগণ ছিলেন নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,নারায়ণ চক্রবর্তী,ভজহরি মান্না,ঈশ্বর চন্দ্র জানা,কুঞ্জবিহারী জানা।এছাড়াও বাদাই গানের ভনিতায় কিশোরী,রাইচরণ,রসিক চন্দ্র ও দ্বিজ মাধবের নামল্লেখ পাওয়া যায়।এক সময়ের বহুল প্রচলিত বাদাই গানে বর্তমানের দূরদর্শনের সিরিয়ালের দর্শকগণ আর কোন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে বাদাই গান আজ এক লুপ্ত অধ্যায়।
তথাপি জন্মাষ্টমী আছে।হাওড়ার জেলার একাধিক স্থানে অষ্টকোণাকৃতি টেরাকোটা রাসমঞ্চগুলির উপস্থিত সেকথাই প্রমাণ করে।রাসমঞ্চের অসামান্য সব ভাস্কর্য নিদর্শন লুকিয়ে রয়েছে মাড়ঘুরালি,নিজবালিয়া,ইছাপুর প্রভৃতি স্থানে।যেগুলি জন্মষ্টমীকে কেন্দ্র করে বাদাই গানের অস্তিত্বকে জানান দেয়।বাঙালি হিন্দুর প্রথা মানা চলছে চলবে।কৃষ্ণকথার মতো মাধুর্যময় পুরাণ কাহিনি তো সেই কোন দ্বাপর যুগে ঈশ্বরের অবতার, শ্রীকৃষ্ণ মথুরা–বৃন্দাবনে বাল্যলীলা করে গেছেন,তার রেশ নিয়ে ভক্তগণ যুগ থেকে যুগান্তরেও বাৎসল্য রসে নিমজ্জিত আছেন। পণ্ডিতগণের বিচারে কৃষ্ণকথা তৃতীয়–চতুর্থ শতকের বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ ও মহাভারতের বিষয়।বাদাই গানের উৎসেও কৃষ্ণকথা।তাছাড়া ভারতবর্ষে তো কানু ছাড়া গীত নাই।মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদকর্তাগণ তো আবার পদাবলীতে কৃষ্ণকে রোমান্টিক নায়ক করে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বৃন্দাবন মাতিয়ে দিয়েছেন।
এই কৃষ্ণের লোকোত্তর মহিমা বাদাই গান রচয়িতাগণ লৌকিক রসের ভিয়ানে যেভাবে রূপায়িত করেছেন তাকে ভক্তিরসের প্রাবল্যে ভরপুর হয়ে ভক্তজনের মনোরঞ্জন করেছে।সেই সঙ্গে এই বঙ্গে রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সংকীর্তনের মাধ্যমে নগর পরিক্রমাও বাদাই গানের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।বাদাই গানে কৃষ্ণজন্মবৃত্তান্ত সংকীর্তনের অনুসঙ্গেই কেবল নয়–টপ্পা,ঝুমুর,গজল সুরেও গীত হতো,হয়তো সুরকারগণের বৈচিত্রের অনুধ্যানে।আসলে ‘বাদাই গান‘ কৃষ্ণকথায় সংকীর্তনের আদলে লৌকিক গীত বিশেষ।
এই প্রসঙ্গে ঊনিশ শতকের ৫–৬ এর দশকে দাশনগরে আলামোহন দাস প্রবর্তিত জন্মাষ্টমী মেলার স্মৃতি শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলাকে মনে করিয়ে দেয়।বৈদ্যুতিন যন্ত্রচালিত কৃষ্ণজন্মকথা দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।বাদাই গানের অনুসঙ্গে সেই সিনেম্যাটিক চিত্রকল্পগুলি সত্যিই নয়নাভিরাম ছিল।
কাহিনির অনুসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত বাদাই গানে যেভাবে বৈদ্যুতিন যন্ত্রচালিত পুতুল প্রদর্শনীতে পরিবেশিত হয়েছিল তার কিছু উদাহরণ নীচে দেওয়া হল:-
দৃশ্য–১:কংস কারাগার–দেবকী ও বাসুদেব শৃঙ্খলে বাঁধা–প্রহরীগণের সদা জাগ্রত দৃষ্টি–কিন্তু কৃষ্ণের জন্মমুহূর্তে সব শৃঙ্খল মুক্ত–প্রহরীগণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন–দৈব নির্দেশে বসুদেব কৃষ্ণ কোলে বেরিয়ে পড়েছেন।
বাদাই গান: “গোলক ধাম পরি হরি পতিত পাবন হরি
ভূ–ভার হরিবারে,সদয় দেবকীরে,
মথুরায় রাখতে ভক্তের মান…
হলো দৈববাণী গগনে
বসুদেব স্বকর্নে শুনে
পুত্র বক্ষে লয়ে
গেলো যে নন্দালয়ে“
দৃশ্য–২:ভরা ভাদ্রে বর্ষণমুখর অন্ধকার রাতে উত্তাল যমুনা পার হতে গিয়ে কৃষ্ণের যমুনা জলে অন্তর্ধ্যান…পরে খুঁজে পাওয়া…তরঙ্গবিক্ষুব্ধ যমুনা জলে শৃগালরূপী দেবী দুর্গার পারাপার দেখে বসুদেব নিশঙ্ক হয়ে যমুনা পার হয়ে উপস্থিত নন্দালয়ে।
বাদাই গান: “নন্দের মন্দিরে রাখিয়া কৃষ্ণেরে,
বসুদেব কাঁদে শিরে কর হানি–
বলে,যা কোরে কুমার জীবন আঁধারি,
বসুদেব–দেবকীর নয়নের রতন–
বয়োবৃদ্ধ হলে কেন যেন ভুলো না আমারে কখন“।
বাসুদেব নন্দালয় থেকে কন্যারূপী যোগমায়াকে নিয়ে মথুরায় প্রত্যাবর্তন–কংস কারাগার থথীতি পূর্ববৎ।
দৃশ্য–৩:পরদিন নন্দালয়ে পুত্রলাভে গোপকুল আনন্দে নৃত্য–গীত সহযোগে দধিকর্দম উৎসবে মেতেছে।
বাদাই গান: “শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইলেন নন্দালয়ে
শুনে আনন্দ গোপবৃন্দ,
দেখিতে গোবিন্দ,
(একে একে) হইলেন নন্দালয় উদয়।“
দৃশ্য–৪:কংস জানতেন দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত কৃষ্ণের হাতে তাঁর মৃত্যু—তাই সন্তান জন্মের পর বাসুদেবের আনা কন্যাকে দেখে কংসের অত্যাচার চরম—কিন্তু সেই সদ্যজাতা কন্যাকে কংস নিজ হাতে নিয়ে তুলে আছাড় মারতে গেলে যোগমায়া আকাশ পথে উড়ে যাবার সময় বলে যান—
“তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।“
ফলে আবারও দান্ডাবেড়ি—নির্যাতন—কারারুদ্ধ দেবকী বাসুদেবের নিদারুণ করুন অবস্থা।
বাদাই গান:”কাঁদি আমার দিবানিশি,চক্ষের জলে দুঃখে ভাসি
এ কষ্ট কি সায়– বক্ষে শিলা,গলে রাশি,
এমন বিপদে কোথায় হরি
বিপদভঞ্জন শ্রীমধুসূদন হে–
দয়াময় দয়া করো–ও–ও দ্বিজ নারানে।“
দৃশ্য–৫:অত:পর শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা…গোষ্ঠযাত্রা,বকরাক্ষস,পুতনা রাক্ষসী ও কেশি দৈত্য নিধন—গিরিগোবর্ধন ধারণ—গোকুল রক্ষা করে দেবত্বের প্রকাশ—কালিয়া দমন ইত্যাদি অবশেষে কংস বধ—কংসের পিতা উগ্রসেনের হাতে রাজত্ব অর্পণ করে কৃষ্ণ বলরাম সহ দ্বারকায় প্রস্থান।
দাশনগরের পুতুল প্রদর্শনীতে কৃষ্ণজন্মকথা যেভাবে পরিবেশিত বাদাই গানের অনুষ্ঠানেও গায়কগণের গায়কীতে সুরের মাধুর্য্যে,অভিনয়ের কৃতিত্বে এবং ভক্তিরসের পরিবেশনে সেইসব চিত্রকল্পেই অনুরণন শোনা যেতো।
জগৎবল্লভপুর বাদা অঞ্চলের কবিগণ কৃষ্ণকে পরমপুরুষ জ্ঞানে যে লীলামাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন তাতে লৌকিক জীবনের বাৎসল্যই অভিব্যক্ত।সচ্চিদানন্দ পূর্ণব্রহ্ম কৃষ্ণ নবরূপে মা যশোদার কাছে পুত্র রূপে ধরা দিয়েছেন।বাদাই গানেও তাই বালকরূপী ব্রহ্মস্বরূপ কৃষ্ণের ঐশী মহিমা গীতিরূপ বাৎসল্য রসে ভরপুর হয়েই পরিবেশিত:
“যশোদা মাগো তুমি বড় ভাগ্যবতী
পুণ্যবতী,ভাগ্যবতী মাগো পেয়েছো অমন ছেলে।
ডেকেছে সে তোমায় মা,মা বলে।“
ভগবান কৃষ্ণের নবরূপে আবির্ভাব বাদাই গানে কেবল কৃষ্ণকে স্মরণ করেই নয়,নবদ্বীপচন্দ্রের অন্তরঙ্গ কৃষ্ণ ও বর্হিরঙ্গে রাধা রূপে বিভোর বঙ্গজনার হরিসংকীর্তনের মুখরতা।
হাওড়ার অন্যতম গ্রাম জনপদ পানপুরের বাদাইগানের আসর আসর ভেঙে যাওয়ার এক বৃহৎ ইতিহাস আছে।আসুন গল্পটা শুরু করা যাক–‘মহারাজ, দূর করে দাও শালা–কুটুম,ঘরে রেখোনা‘–দীনু ঘোষের গানের এই আখর শুনে আপাদমস্তক জ্বলে উঠলেন গোপাল দত্তের শ্যালক,দত্তবাড়ির গান বাঁধার মূল কারিগর কেদার সরকার।নিজে গোপাল দত্তের শালা,তাঁকেই প্রকারন্তরে দূর করে দেবার কথা বলা হয়েছে সম্মানে আঘাত লাগল তাঁর।তাৎক্ষণিকভাবে লাফিয়ে উঠে জবাব খুঁজতে গিয়ে চালে ভুল করে ফেললেন।বললেন—
“পাণ্ডববংশে ঢ্যামনা ছেলে জন্মেছে পাঁচজন
তার মধ্যে দীনু ঘোষ একজন।“
ব্যাস্!আসরের তাল গেল কেটে।দীনু ঘোষ গান ছেড়ে বললেন–“আমি তো শাস্ত্রীয় কথা বলেছি।মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে এই বক্তব্য।তাঁর শ্যালক শকুনিকে তাড়িয়ে দেওয়াল কথা এখানে বলা হয়েছে।কেদারবাবু সেটা গায়ে নিয়ে অশাস্ত্রীয়ভাবে আমাকে আক্রমণ করছেন।‘
কেদারবাবু বললেন–“আমিও শাস্ত্রীয় কথা বলেছি।ঢ্যামনা মানে অবৈধ।পাণ্ডুপুত্রগণ তো অবৈধ সন্তানই ছিলেন।কিন্তু সরাসরি আমার নাম করা হল কেন?পাণ্ডবদের মধ্যে ‘দীনু ঘোষ‘ কে?”
এর উত্তর কেদারবাবুর কাছে ছিল না।ফলে দু‘পক্ষের মধ্যে বাক্–বিতণ্ডা শুরু হয়ে গেল।দু‘পক্ষের শরীরেই জমিদারী রক্ত।কেউ কাউকে রেয়াত করে না।ভেঙে গেল বাদাইগানের আসর।সেই থেকে পানপুরের ঘোষবাড়ি–দত্তবাড়ির বাদাই গেল পৃথক হয়ে।তারপর আবার শুরু হল কিছু পরে।ছায়া সুনিবিড় পানপুর গ্রামের বিশিষ্টতা বাদাই গানে।উলুবেড়িয়ার শতগাঁয়ের পেটের কথা(দ্বিতীয় খণ্ড)-তে যা বিস্তারিত ধরা আছে।যদিও ‘বাদাই‘ না ‘বাধাই‘ পাঠকের মনে এ ধন্দ থেকেই যায়।কারণ দত্তবাড়ির বন্দনা অংশে ‘বাধাই‘ শব্দটির উল্লেখ আছে।কিন্তু পল্লী বাংলার লোকসংস্কৃতি চর্চায় আমরা প্রায় সর্বত্রই ‘বাদাই‘ শব্দের দেখা পাই।‘বাদাই‘ শব্দের অর্থ বিবরণ বা বাদ–বিতণ্ডা।আবার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ[বি+ষ(সৎ)] আস্বাদনযোগ্য।পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলা ছাড়াও বাদাইগানের প্রচলন রয়েছে বর্ধমান,দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা প্রভৃতি অঞ্চলে। এবং হাওড়ার বালিয়া পরগণা অঞ্চলে একসময় বাদাইগানের বহুল প্রচলন ছিল।বর্ধমানের বাদাইগানের সঙ্গে পানপুরের বাদাইগানের চারিত্রিক ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। আবার পানপুরের ঘোষবাড়ি ও দত্তবাড়ির বাদাই গানের মধ্যেও সূক্ষ্ম সুরের পার্থক্য বিদ্যমান।ঘোষবাড়িতে চড়া সুরের ব্যবহার এবং দত্তবাড়িতে কোমলসুরের প্রাধান্য লক্ষণীয়।
জন্মাষ্টমীর পরদিন অর্থাৎ নন্দোৎসবের দিন পানপুরের দুটি বাড়িতে এখনো বাদাইগানের আসর বসে।ঘোষবাড়ির কেন্দ্রে থাকেন ঘোষ পরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ এবং দত্তবাড়ির মধ্যমণি দত্তদের কুলদেবতা রঘুনাথ জিউ।শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনি এবং মহাভারত থেকে কটূ প্রশ্ন গানের মাধ্যমে অপরপক্ষকে করা হয়।অপরপক্ষ তার জবাব দিয়ে অন্য প্রশ্নের অবতারণা করে।এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না একপক্ষ হার স্বীকার করছে।ঘোষ ও দত্তদের আগমন বর্ধমান থেকে।হয়ত কোনভাবে বর্ধমানে প্রচলিত বাদাই গানের ধারাটি তাঁরা এখানেও প্রচলন করেন।আগে দত্তবাড়ির সঙ্গে ঘোষবাড়ির এই কবিয়ালি লড়াই হত।দু‘পক্ষেরই একজন করে মূল গায়েন থাকতেন।তাঁর সঙ্গে দুই বাড়ির দোহাররা সঙ্গ দিতেন।দত্ত বাড়ির গোপাল দত্তের শ্যালক কেদার সরকার ছিলেন দত্তবাড়ির মূল গায়ক।তাঁর নিবাস ছিল ধাঁইপুর।সেই ধাঁইপুর থেকে তিনি পালকি চড়ে আসতেন।একমাস থাকতেন পানপুরে।দত্তবাড়ির বাদাইয়ের বন্দনা গান তাঁরই রচনা।যে বছর বাক–বিতণ্ডায় ঘোষ ও দত্তবাড়ির বাদাই গান আলাদা হয়ে গেল।তার পরের বছর থেকে ঘোষবাড়িতে বাদাইগানের প্রতিপক্ষ হল ভাণ্ডারগাছার মারিকরা এবং দত্তবাড়িতে পোয়ালিরা।সে আর এক কাহিনি।দুই বাড়িতেই বাদাইগানের যে সূচনা হল আজও তার পরিবর্তন হয়নি।ঘোষবাড়িতে এবং দত্তবাড়িতে দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকে কবিয়ালরা আসেন।কিন্তু কতদিন আসবেন সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।।মূল গায়ক গৌরচন্দ্র কবিয়ালের আক্ষেপ–“ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর এই পেশায় আসতে না চাওয়ায় গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির এই ধারাটি ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাবে।“ঘোষ ও দত্ত পরিবারের বন্দনা গান—
“জ্ঞানহীনে জ্ঞান দেমা বীণাপাণি
আমি জ্ঞানহীন,অভাজন তব তত্ত্ব কি জানি?
(হায়)কোথায় মাগো শ্বেতাঙ্গিনী
অজ্ঞানে জ্ঞান দায়িনী,–মা মাগো।“
ঘোষবাড়ির বন্দনা গান-
“তারা সার,অসার সংসার তুমি মাত্র সার
শিবত্ব ইন্দ্রত্ব ব্রহ্মত্ব পদ ব্রহ্মময়ী চরণে তোমার…”
লহরগান—
“ভাদরের ভরা বানে ফুঁসছে যেন আজ যমুনা
প্রকৃতি সেজেছে এমন তাই মধুপের আনাগোনা
কুঞ্জে কুঞ্জে শঙ্খধ্বনি
ব্যাপার কিলা ও সজনি
রাজবাড়িতে মধুরধ্বনি বাজছে সানাই মন টেকে না…”
হাওড়াজেলার বাদাইগানের ভিত্তিভূমি হিসাবে পানপুর গ্রামটি নিঃসন্দেহে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্যতার দাবি রাখে।পানপুরের আকাশে বাতাসে আজও অনুরণিত হয় বাদাইগানের লহর।
কিন্তু অধিকাংশ স্থানে জন্মাষ্টমী তিথিতে বাল গোপালের আরাধনা আজও মন্দিরে মন্দিরে হলেও বাদাই গানের দিন প্রায় শেষ।প্রথা হিসাবে পূজার্চ্চনাটুকু নিয়ম রক্ষা হিসাবে হয়ে থাকে।কিন্তু বাদাই গানের মতো লোকগান আর কোথাও হয় না।তাই কবির খেদোক্তিটুকু সার—
“ছিল হে উৎসব,মহোৎসব,শ্রীদোল উৎসব,শ্রীনন্দ উৎসব
দেখেছ যে সব,দেখো হে সব,কেশব অভাবে শব–প্রায় সব।“
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
১.কৌশিকী বেলাভূমির ইতিকথা জগৎবল্লভপুর অধ্যায়(দ্বিতীয় খণ্ড)-নারায়ণ ঘোষাল
২.বাদাই গান–ড.শিবেন্দু মান্না
৩.উলুবেড়িয়ারর শত গাঁয়ের পেটের কথা(দ্বিতীয় খণ্ড)
৪.এছাড়া বিশেষ কৃতজ্ঞতা–সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,বিপ্লব ঘোষ,সঞ্জীব ঘোষ,বিদ্যুৎ দত্ত ও প্রদ্যুৎ দত্ত]
[সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি:–সৌরভ দত্ত,পিতা–গোবিন্দ দত্ত,জন্ম তারিখ –১৪/১২/১৯৮৭,শিক্ষাগত যোগ্যতা–সাম্মানিক বাংলা স্নাতক (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়),পেশা–গৃহশিক্ষকতা।সম্পাদিত পত্রিকা-‘কবিতা তোমাকে‘ ও ‘মাজু পুঁথিপত্র‘।প্রথম কবিতার বই-‘সোহাগি হরিণ তুমি’,।এছাড়া উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-‘অন্ধকার রোমান্টিক‘(যৌথ),’জেগে আছো হিমরক্ত?’,’ভ্যালেন্টাইন কবিতাগুচ্ছ‘, ও ‘রক্তপাখির গান।উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ‘পশ্চিমবঙ্গ ছোট পত্রিকা সমন্বয় সমিতি‘-র পুরস্কার ‘কবিতা তোমাকে‘-র প্রতিবাদ সংখ্যার জন্য (২০১৮)।সম্মাননা-‘সপ্তপর্ণ সাময়িক পত্রিকা সম্মাননা‘(২০১৯)।পত্রিকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যা-‘সিরিয়ার গণহত্যা‘ ও ‘প্রতিবাদ‘ সংখ্যা‘।যন্ত্রস্থ-‘বিশেষ কবিতা‘ সংখ্যা।]
[সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:-
চিত্রশিল্পী,কবি,ছোটগল্পকার,প্রাবন্ধিক তুষার বসু।জন্ম–১৯৬১।শিক্ষাগত যোগ্যতা–এম.এ,বি.এড।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-‘গন্তব্যহীন‘ ও ‘সোহাগপাখি‘। সহকারী সম্পাদক -‘কবিতা তোমাকে ‘।নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন আঞ্চলিক লোক ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজে।‘প্রতিদিন‘,’মাতৃশক্তি‘,’উদ্দীপন‘,’আলোর ফুলকি‘,’মেটেফুল‘,’সারঙ্গ‘,’কলকাতার যিশু‘ প্রভৃতি একাধিক পত্র–পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।]