| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক নারী

ধারাবাহিক বধূ পাঁচালি: ভাঙা রূপকথা । শকুন্তলা চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

১.

 

গৌরী গাঙ্গুলি ছিলেন কলকাতার এক অত্যন্ত ধনী পরিবারের কন্যা—ধীরেন্দ্রনাথ এবং পারুল গাঙ্গুলির দ্বিতীয়া কন্যা।ল্যান্সডাউন রোডের ওপর সাতখানা বাড়ী ছাড়াও, তাঁদের ছিলো আরও সম্পত্তি। প্রতিপত্তিও কম ছিলো না।গৌরীর পরিবারের অনেকেই উকিল হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,badhu panchali bhanga rupkotha
অল্পবয়সে গৌরী চ্যাটার্জি

অরুণ চ্যাটার্জি ছিলেন গৌরীর গানের স্কুলের এক বন্ধুর দাদা। সুপুরুষ, সুগায়ক, অভিনয়ে প্রবল ঝোঁক।কিন্তু আর্থিক অবস্থা অতি সাধারণ।ম্যাট্রিক পাশ করে অরুণ তখন পোর্ট কমিশনার্সে সামান্য মাইনের চাকরি করছেন, বাড়ীতে মা-বাবা ছাড়াও আছেন ছোট দুই ভাই। এহেন পরিবারে বিয়ে দিতে স্বভাবতই আপত্তি করেছিলেন গৌরীর অভিভাবকেরা—মেয়ে সুন্দরী, রমেশ মিত্র স্কুলে পড়াশোনা করছে, গান শিখছে, সেলাই এবং অন্যান্য গৃহকর্মে সুনিপুণা, অপূর্ব হাতের রান্না, বাবার পয়সা আছে…..অরুণ চ্যাটার্জির চেয়ে অনেক ভালো পাত্র লুফে নেবে গৌরীকে!

কিন্তু সেই যে বলে—‘মিয়া বিবি রাজী তো ক্যায়া করেগা কাজী?’

কোনো আপত্তিই টিকলো না।

বহু কথা চালাচালির পর, অবশেষে ১৯৪৮ সালে, ষোড়শী গৌরীর সঙ্গে বাইশ বছরের অরুণের বিবাহ সম্পন্ন  হলো—যার আদিতে সব ‘শুভ’ মনে হলেও, অন্তে সব পাল্টে গেলো।

অরুণ তখনও চাকরির জোয়ালে বাঁধা। যদিও তাঁর একটি ছবি, ‘দৃষ্টিদান’, তখন মুক্তি পেয়েছে কিন্তু সাফল্য তখনও দূর অস্ত্। টালিগঞ্জ পাড়ায় কেউ কেউ অরুণকে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারল’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন।কিন্তু হাল ছাড়লেন না অরুণ, হাল ছাড়লেন না গৌরী। স্বপ্নের পেছনে অনলস পরিশ্রমে দৌড়ে চললেন অরুণ, সঙ্গে সঙ্গে রইলেন গৌরী—যাঁর মুখের আদলে শিল্পী নিরঞ্জন পাল গড়ে দিয়েছিলেন চ্যাটার্জিবাড়ীর লক্ষ্মীপ্রতিমা, কোজাগরী পূর্ণিমায় যে লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন করে যান অরুণের বাবা শ্রী সাতকড়ি চ্যাটার্জি। সাতকড়ি গৌরীকে বাড়ীর লক্ষ্মী বলে মানতেন, অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

শেষ পর্যন্ত সফল হলো তপস্যা, ধরা দিলেন সৌভাগ্যলক্ষ্মী। ১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বসু পরিবার’ এবং ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিদুটোর পর আর অরুণকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি—টালিগঞ্জ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করলো। অরুণ হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির কিংবদন্তী উত্তমকুমার, তুলনাহীন মহানায়ক। ধন-জন-ঐশ্বর্যে, পালা-পার্বণে, ভরে উঠলো গিরিশ মুখার্জি রোডের পৈত্রিক বাড়ী। শাড়ী-গয়নায় ঝলমল করে উঠলো গৌরীর ছেলেমানুষী মন।

তৈরী হলো নিউ আলিপুরের বাড়ী—পুত্র গৌতমকে নিয়ে সেখানে উঠে গিয়েও, বাবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে আবার পৈত্রিক বাড়ীতে ফিরে এলেন অরুণ-গৌরী। বাড়ীর সামনের অংশটিকে নতুন করে বানিয়ে, আধুনিক ব্যবস্থায় চারতলা ফ্ল্যাটের মতো করে নিলেন অরুণ। মাঝখানের উঠোন বাদ দিয়ে, পেছনে রইলো বাড়ীর পুরোনো অংশ—যেখানে আছেন ভাইরা এবং তাঁদের সংসার।

গৌরী কিন্তু পৈত্রিক বাড়ীতে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বেশ আনন্দেই ছিলেন।

ছেলে তখন দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস্ স্কুলের আবাসিক ছাত্র। অরুণ ব্যস্ত কাজ নিয়ে। গৌরী একা একা কি করেন? পাঁচজনের সঙ্গে গল্প করে, পাঁচজনকে নিয়ে সিনেমায় গিয়ে, প্রতি শনিবারে সবার জন্য ফ্লুরিজের কেক কিনে এনে, দিব্যি সময় কেটে যেতো তাঁর।

একটু অভিমানী হলেও, খুবই সরল সাধারণ হাসিখুশী স্বভাবের মানুষ ছিলেন গৌরী।

নিতান্তই সংসার-কেন্দ্রিক এবং সামাজিক ছিলো তাঁর জগত—একক ভাবে কিছু করার কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে সবকিছু করাতেই ছিলো গৌরীর আনন্দ।

 

অরুণের পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কিছু করতে হবে, অরুণকে একটা সুন্দর ঘেরাটোপে ঢাকা শিল্পীসুলভ দূরত্ব দিতে হবে—এমনটা তাঁর মনে আসতো না।

সেইখানেই কি ভুলটা হয়েছিলো?

অরুণ ছিলেন শিল্পী, শৌখিন, সৌন্দর্যের পূজারী। নিজেকে প্রসারিত করার দিকে ছিলো তাঁর ঝোঁক। পাশ্চাত্যের প্রভাবেও তিনি প্রভাবিত—পিয়ানো, ইংরেজী ছবি দেখা….যেগুলো গিরিশ মুখার্জি রোডের পৈত্রিক বাড়ীতে ছিলো একেবারেই নতুন ‘কনসেপ্ট’। জীবনের ঝকমকে বিলাসবহুল দিকটি যেমন তাঁর আকাঙ্খিত ছিলো, তেমনই নজর ছিলো তাঁর শৈল্পিক পরিপূর্ণতার দিকে …. যে ত্রুটিবিহীন পরিপূর্ণতার নাগাল পাওয়া হয়তো বা সাধারণ জীবনে অসম্ভব। তবুও শিল্পী মন সেই পরিপূর্ণতার খোঁজেই ছুটে চলে—আর সেই অণ্বেষণেই কেটে যায় জীবন, ফেরার পথ মেলে না।

অরুণের ভুবনজয়ী হাসিতে মেয়েরা পাগল, এ’কথা তো গৌরী জানতেনই। অরুণের খ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আশপাশের শুভানুধ্যায়ীরা গৌরীর কানে নানারকম কথা তুলে দিচ্ছিলেন। গৌরীর সরল মনে ঢুকলো সন্দেহের বীজ, যা একবার ঢুকলে আর বেরোতে চায় না।

সৌন্দর্যের বদলে, দাম্পত্যজীবন ভরে উঠলো কলহের কালিতে।

ছেলেমানুষ গৌরী কিছু বোঝার আগেই জ্বলে উঠলো আগুন — পুড়ে গেলো গৌরীর সাধের সংসার।

১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, অরুণের জন্মদিনের পার্টিতে, অরুণ-গৌরীর হলো চূড়ান্ত কলহ—সেই রাত্রেই ঘর ছাড়লেন অরুণ। প্রথমে উঠলেন গিয়ে চলচ্চিত্র জগতের এক বান্ধবীর বাড়ী। বান্ধবী সেই রাত্রির মতো অরুণকে থাকতে দিলেন, তবে বলে দিলেন যে পরের দিন অরুণকে ফিরে যেতে হবে গৌরীর কাছে। কিন্তু ক্রোধ তখন তুঙ্গে, ফেরার কথা কানেও নিলেন না অরুণ। বাংলা ছবির মুকুটহীন সম্রাটকে থাকতে দেওয়ার জন্য ঘরের অভাব হবে নাকি!

সত্যিই ঘরের অভাব হলো না। ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে হলো অরুণের নতুন ঘর। শৌখিন পাড়ায় আধুনিক কেতাদুরস্ত ফ্ল্যাট। চিত্রজগতের তারকাদের আপ্যায়নের উপযুক্ত পরিবেশ, শৃঙ্খলহীন আমোদপ্রমোদ। সঙ্গে আধুনিক ঘরণী, যিনি নিজেও চিত্রজগতের প্রখরযৌবনা গ্ল্যামারাস নায়িকা—গৌরীর মতো আবেগপ্রবণ ছেলেমানুষ নন। নিজের তৈরী দূরত্বে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন অরুণ, যদিও পৈত্রিক বাড়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়লেন না। হয়তো সম্পর্ক ছাড়লেই ভালো হতো, অন্তত গৌরীর জন্য। কিন্তু অপূর্ব কৌশলে, দু’নৌকায় দু’পা দিয়ে, ভারসাম্য বজায় রাখলেন অরুণ। একটি হলো বিলাসের নন্দনকানন, আরেকটি হলো বিশ্রামের বৈকুন্ঠ। শুধু বৈকুন্ঠের লক্ষ্মী সেই ধাক্কাটা সামলাতে পারলেন না। সাতকড়ি চারবছর হলো পরলোকে, কিন্তু অরুণের মা চপলাদেবী তখনও জীবিতা।অরুণ রোজ এসে মা’কে প্রণাম করেন, সংসার খরচের টাকা তুলে দেন হাতে, ভাইয়েদের খোঁজখবর নেন, ভাই-ভাতৃবধূ-ছেলে-মেয়েদের মাঝে মাঝে ময়রা স্ট্রিটের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। অরুণের ইচ্ছেই নিয়ম, সেই নিয়মেই সবাই চলেন — গৌরী একা প্রতিবাদ করে কি করবেন? এরপর প্রতিবাদ করাটাই ছেড়ে দিলেন গৌরী।

বারোবছরের ছেলে গৌতম তখন দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস্ স্কুলের আবাসিক ছাত্র, ছুটিতে ছাড়া বাড়ী আসে না—সে যে কিভাবে নিলো এই সংবাদ, গৌরী ভালো করে বুঝতেই পারলেন না। সে কি নিরাপত্তাহীনতার স্বীকার হলো, না ‘এটাই স্বাভাবিক’ ভেবে বড়ো হোলো?…

সংসার থেকে গৌরীর যেন আর কিছু পাওয়ার নেই, সংসারে আর কিছু করারও নেই। মদ আর পেথিড্রিন ইঞ্জেকশনে অজ্ঞান হয়ে থাকাটাই অতএব গৌরীর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেলো। অতিরিক্ত অত্যাচারে লিভার সিরোসিস হলো। অসুস্থ অবস্থায় শয্যা নিলেন গৌরী। মাত্র ৩১ বছর বয়স তখন তাঁর।

ছুটে এলেন অরুণ—চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয়! চব্বিশ ঘন্টার মাইনে-করা নার্স, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, নামী ডাক্তারে বাড়ী ভরে উঠলো। অপারেশন, ওষুধ, সেবা চললো প্রায় তিন-সাড়ে তিন বছর ধরে। গৌরীর শরীরটা আবার উঠে দাঁড়ালো, মুখোমুখি হলো রূঢ় বাস্তবের—ময়রা স্ট্রিটে অরুণের নতুন সংসার।লোকে বলছে অরুণ ‘লিভিং টুগেদার’ করছেন, কেউ বা বলছে অরুণ নাকি আবার বিয়ে করেছেন।

১৯৬৩ সালে, হিন্দু স্বামীর প্রথমা স্ত্রী বর্তমানে, স্বামীর আবার বিয়ে হয় কি করে? কেউ গৌরীকে এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছেন না। আইনি রাস্তায় গেলে, কোর্ট হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দিয়ে দিতে পারতো—কিন্তু গৌরী সেই রাস্তায় গেলেন না। প্রতি বিবাহবার্ষিকীতে তখনও যে অরুণ তাঁর ‘গজু’র হাতে তুলে দিচ্ছেন উপহার আর গৌরীকে পাশে নিয়ে বসে গান ধরছেন – “সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে…..ভুলো না!” অরুণের দেওয়া হাতখরচের টাকা খরচ করে তিনি আদালতে যাবেন, অরুণকে কাঠগড়ায় তুলবেন? না, না, সে হয় না! তার চেয়ে এই ভালো — জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা, মেনে নেওয়া!

মেনে নিতেই তো শিখেছে মেয়েরা, শিখিয়েছে সমাজ-সংসার। গৌরীও সেই শেখানো পথেই চললেন। অপমানের কাঁটা মাড়িয়ে হাঁটলেন জীবনের আরও কয়েকটা বছর। স্বামী অরুণের সঙ্গে জ্ঞাতিদের বাড়ী পূজোর অঞ্জলি দিতে গিয়ে শুনলেন বাঁকা মন্তব্য – “একি? সঙ্গে গৌরী কেন? সে কই?” মনের অশান্তির সঙ্গে বেড়ে চললো ওজন। শরীর আর পুরো সুস্থ হলো না। ভেঙে যাওয়া সংসারের সাজানো ঘরে বসে, গৌরী তখন দেওরের মেয়েদের পুতুলের বিয়ে দেন। আর চারতলার ঘরে, সঙ্গীহীন নির্জন সন্ধ্যায়, টিভিতে অরুণের সিনেমা দেখেন — ‘হারানো সুর’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’….। নিজের মনেই বলতে থাকেন – “আচ্ছা, অরুণ ময়রা স্ট্রিটে কি করে গেলো? কেন গেলো?…..ও যদি শ্রীমতি __এর সঙ্গে থাকতো, তাও নাহয় বুঝতাম, কিন্তু ওখানে…..।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,badhu panchali bhanga rupkotha
পুত্রবধূ সুমনা ও মেজ দেবর বরুণ চ্যাটার্জির মেয়ে মৌসুমীর সঙ্গে গৌরীদেবী

বলেন, আবার উঠে সংসারের দৈনন্দিনতায় নিজেকে ডুবিয়ে দেন। অরুণ এলে ঘরে এসে বসেন। এইভাবেই চলে জীবন। আর অরুণ? আকাশপানে ছুটে-চলা ভাগ্যরেখা তাঁকে ততদিনে করে তুলেছে টালিগঞ্জের মহানায়ক। ব্যস্ততার মাঝেও, প্রতিদিন তিনি একবার করে আসেন গিরিশ মুখার্জি রোডের পৈত্রিক বাড়ীতে। সামলে রাখেন দুই সংসার। আসেন, কিন্তু থাকেন না। অরুণের গাড়ী চলে যাওয়ার পর, প্রতিটি নিঃসঙ্গ দিন আর রাত যেন গৌরীকে ব্যঙ্গ করে — মনে করিয়ে দেয় যে তিনি এখন রূপকথার রাজার ‘দুয়োরাণী’।

১৯৬৭ সালে, কলকাতা যখন রাজনীতির আগুনে উত্তপ্ত, অরুণ পা রাখলেন বম্বেতে — নিজের প্রযোজনায়  করলেন হিন্দী ছবি ‘ছোটি সি মুলাকাত’। বড়ো বাজেটের ছবি—সঞ্চয়ের প্রায় সবটাই ঢেলে দিলেন এই ছবির পেছনে। কিন্তু ছবিটি চললো না। ক্ষতির পরিমাণ হলো আকাশ-ছোঁওয়া। মাধ্যাকর্ষণের টান বুঝি লাগলো এবার ভাগ্যরেখায়। অরুণের হলো একটা বড়ো হার্ট-এ্যাটাক।

সেই এ্যাটাক থেকে সুস্থ হয়ে উঠলেন, কিন্তু বিশ্রাম নিলেন না মহানায়ক—নিতে পারলেন না। বম্বে তাঁকে ফিরিয়ে দিলেও, টালিগঞ্জে তখনও তিনি একচ্ছত্র নায়ক। একের পর এক চিত্রনাট্য নিয়ে হাজির হচ্ছেন পরিচালক-প্রযোজকরা, অরুণও অক্লান্ত পরিশ্রমে শূণ্য কলসী আবার পূর্ণ করার চেষ্টা করছেন ছবির পর ছবিতে অভিনয় করে। বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছবি করলেন তিনি সেই সময়ে, কিছু চরিত্রাভিনয়ও। ১৯৭৫-এর ‘অমানুষ’ ছবিটির সূত্র ধরে, হিন্দী ছবির দর্শকও শেষে তাঁকে গ্রহণ করলো।

কিন্তু নানাদিক থেকে অশান্তির টানাপোড়েন শুরু হয়েছে তখন অরুণের জীবনে। আর্থিক এবং শারীরিক সমস্যা তো আছেই, এছাড়াও দুই সংসারের সন্তোলন রক্ষা করা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছে। ১৯৭৬-এ, অরুণের ‘দত্তক’ নেওয়ার খবরে, দুই পরিবারে শুরু হলো চাপান-উতোর আর আইনের মারপ্যাঁচ। সংসারে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার যুদ্ধে এবার নামতে হলো গৌরীকে। গৌরীর তরফ থেকে চিঠি গেলো ময়রা স্ট্রিটে—তাঁর অজ্ঞাতে এবং অনুমতি ছাড়া, ভারতীয় আইনে তাঁর স্বামীর কোনো দত্তক সন্তান থাকতে পারে না। কিন্তু অন্যপক্ষও তখন ব্যস্ত নিজের অধিকার সিদ্ধ করতে, তাই নিষ্পত্তি হলো না। যার ফলশ্রুতি, ভবিষ্যতে অরুণের সম্পত্তি সংক্রান্ত দীর্ঘকালীন মামলা। তবে সে আরও পরের কথা, অরুণের মৃত্যুর পর। কিন্তু তার আগে, বেড়ে চললো অশান্তি।…আপাতদৃষ্টিতে অরুণের পেশাগত সাফল্য থাকলেও, শ্যুটিং-এর সময় সহ্য করতে হলো কোনো নায়িকার অপমান—হ্যাঁ, টালিগঞ্জের মহানায়ককেও। নিরাপত্তাহীনতার ছায়া ভেসে আসে মাঝে মাঝে—আর কতদিন ধরে রাখা যাবে এই সিংহাসন?….

সবদিকের চাপে ব্যতিব্যস্ত অরুণ শেষদিকে যেন আর পেরে উঠছিলেন না। জীবনের ভার যেন বড়ো বেশী বেড়ে উঠছে। মাঝে মাঝে গৌতমকে বলেন যে তিনি এবার একটু শান্তিতে থাকতে চান, নিউ আলিপুরের বাড়ী সম্বন্ধে খোঁজ করেন। জ্যোতিষীর কথায় হাতে একটা আংটি ধারণ করেছেন—গৌরীর খারাপ ‘দশা’ চলছে….ফাঁড়া যাতে কেটে যায়। ১৯৭৮ সালে, একবার ময়রা স্ট্রিটের বাড়ী ছেড়ে পৈত্রিক বাড়ীতে চলেও এসেছিলেন অরুণ। বেশ রাতে তাঁর গাড়ী এসে থামলো—এইসময় সাধারণত তিনি আসেন না। হার্টের কারণে, সিঁড়ি ভাঙা তখন একেবারে বারণ অরুণের। লোক দিয়ে চারতলার ঘর থেকে জোড়া খাট নামিয়ে আনা হলো। একতলার ঘরে শুলেন অরুণ-গৌরী। সারারাত দরজার বাইরে রোয়াকে বন্ধুদের নিয়ে বসে রইলেন গৌতম, যেন কিসের আশঙ্কায়। ভোর হতে না হতে শুরু হলো ফোন। আবার ফিরে গেলেন অরুণ ময়রা স্ট্রিটে।…..

কিছুদিনের মধ্যেই তোড়জোড় শুরু হলো অরুণের আমেরিকা যাওয়ার—মূলতঃ নিউইয়র্ক-নিউজার্সির বেঙ্গলি এ্যাসোসিয়েশনের অতিথি হিসাবে, তবে আমেরিকার আরও কয়েকটি জায়গাতেও যাওয়ার কথা হচ্ছে। ১৯৭৯-র গ্রীষ্মে যাওয়ার কথা, কিন্তু কাগজপত্র তৈরীতে লেগে যাবে বেশ কিছুদিন। তাই এই আগাম প্রস্তুতি।

আমেরিকা—স্বপ্নের দেশ। গৌরী কিন্তু অরুণের হাত ধরে সেই স্বপ্নের দেশে পা রাখতে পারবেন না—সঙ্গে যাবেন অন্য সঙ্গিনী। যাঁর মুখের আদলে একদিন প্রথম লক্ষ্মীর আরাধনা হয়েছিলো গিরিশ মুখার্জি রোডের চ্যাটার্জি বাড়ীতে—সেই গৌরী তখন আর অরুণের জীবনের গতিপথের পরিচালক নন, সহযাত্রীও নন।

এবারে দারুণভাবে ভেঙে পড়লেন গৌরী। জীবনের ভার যেন তিনিও আর বইতে পারছেন না। প্রতিদিনের এই মৃত্যুর চেয়ে, একদিন এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যায় না? ……

শুরু হলো মৃত্যুর সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলা। আটমাসের ব্যবধানে চলে গেলেন দু’জনেই। ১৯৮০-র জুলাইতে হার্ট এ্যাটাকে চলে গেলেন অরুণ—সফল ‘নায়ক’-এর জৌলুস আর দ্বন্দ্ব নিয়ে। তার ক’মাস বাদেই, ১৯৮১-র এপ্রিলে গেলেন ক্যানসারে আক্রান্ত ৪৮ বছরের গৌরী। পেছনে পড়ে রইলো ধুলো আর কাদা—উত্তমকুমারের সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিন-ব্যাপী উত্তরাধিকারের মামলা, যার নিষ্পত্তি হলো শূণ্যতে এসে।

 

 

 

তথ্যঋণ: শ্রীমতি মৌসুমী চ্যাটার্জ্জি দত্ত

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত